চতুর্দশ শক্তিশালী রাক্ষসের নিধনের বার্তা পেয়ে খড় আর দূষণ আশ্চর্য, অবাক ও অতিশয় ক্রুদ্ধ হল। তারা রাগে গর্জন করতে করতে সমস্ত রাক্ষস সেনাকে হস্তি, অশ্ব, রথ সহ তৈরী হতে আদেশ দিলেন । দূষণ রাক্ষস ছয় হাজার সেনা সমেত যুদ্ধে চললেন, এছাড়া খড় রাক্ষস অযূথ রথ, অশ্বারোহী , হস্তী বাহিনী, পদাতিক রাক্ষস সেনা নিয়ে চললেন। খড়ের সেনাপতি বিকট দর্শন ত্রিমস্তকধারী ত্রিশিরা রাক্ষস প্রকাণ্ড মুগুর নিয়ে রথে উঠলেন । হৈ হৈ করতে করতে ভয়ানক দর্শন রাক্ষসেরা আসতে লাগলো । বন জঙ্গলে ভেঙ্গে, প্রকাণ্ড বৃক্ষ গুলিকে উৎপাটন করে রাক্ষসেরা আসতে লাগলো। অযূথ রাক্ষসের আগমনে মনে হতে লাগলো এক ঝড় যেনো জঙ্গল মধ্য দিয়ে ধেয়ে আসছে। রাম বললেন- “লক্ষণ তুমি জানকী সহিত পর্বতের গুহায় আশ্রয় নাও। এই রাক্ষসদের সাথে আমি এখন যুদ্ধ করবো।” লক্ষণ বলল- “অগ্রজ! আপনি কেন আমাকে এত দুর্বল বিবেচোনা করেন? আমি চোখের পলকে এই রাক্ষসদের ধ্বংস করতে পারবো। আপনি ও বৌঠান দুজনে বিশ্রাম করুন। আমি এদের যমালয়ে প্রেরন করবো।” রামচন্দ্র মৃদু হাস্য করে বললেন- “লক্ষণ, ভ্রাতা ! আমি জানি তুমি এই সকল রাক্ষস তৃণবৎ নষ্ট করতে পারবে। কিন্তু এই রাক্ষসদের বিনাশ করতে আমি ইচ্ছা করি। তাই ইহাদিগকে আমি ধ্বংস করবো।” অগ্রজের আদেশ মেনে লক্ষণ তখন সীতাদেবীকে নিয়ে পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিলেন । অপরদিকে খড়, দূষণ তার বিশাল সেনা নিয়ে এসে সমানে চতুর্দশ সেনার দেহ দেখতে পেলেন। শৃগাল, শকুন, কাকেরা সেই মৃতদেহ আনন্দে ভক্ষণ করছে। খড় রামচন্দ্রের সুন্দর কোমল রূপ দর্শন করে বললেন- “ওহে বনবাসী যোদ্ধা। আমি জানি তুমি বীর। তোমার মতো বীরকে দেখে আমার হত্যা করতে মন চাইছে না। তুমি তোমার স্ত্রীকে আমাদের হস্তে সমর্পণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আমরা তোমাকে ক্ষমা করবো।” রামচন্দ্র বললেন- “ওহে দুর্মতি! যুদ্ধক্ষেত্রে বাক্যালাপ না করে যুদ্ধ করো। দেখি তোমার শক্তি কত!”
খড় ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ করতে আদেশ দিলেন । হৈ হৈ করে “রামকে মারো” বলে রাক্ষসেরা উজ্জ্বল শানিত অস্ত্র নিয়ে ধেয়ে গেলো। শ্রীরামচন্দ্র মন্ত্র পড়ে বজ্র বাণ, ইন্দ্রাস্ত্র বাণ নিক্ষেপ করলেন । বাণের প্রভাবে আকাশ থেকে অনেক জোরে শব্দ করে বজ্রপাত হতে লাগলো। সেই বজ্রে রাক্ষসেরা ঝলসে গেলো। ভগবান রাম পর্বত বাণ নিক্ষেপ করলেন। গগন থেকে পর্বতের চূড়ার ন্যায় শিলাখণ্ড পতিত হল । সেই শিলার আঘাতে রথ, হস্তী, অশ্বারোহী সকল পিষ্ট হতে লাগলো। রক্ত নদীর ধারা প্রবাহিত হতে লাগলো বর্ষার জলে পুষ্ট নদীর জলের ন্যায় । পবন বাণ নিক্ষেপ করে রাক্ষসদের বহু উচুতে নিয়ে গেলেন, সেখান থেকে ভূপতিত হয়ে শয়ে শয়ে রাক্ষস চূর্ণবিচূর্ণ হল । গৃধ, কাক আদি মাংসাশী প্রানী ও শৃগালেরা মনের সুখ বিচরণ করতে লাগলো মাংস খণ্ডের আশায় । দেবতারা আকাশে জড় হলেন এই যুদ্ধ দেখবার জন্য । ভগবান রাম এরপর সূচীমুখ, শিলামুখ বাণ নিক্ষেপ করলেন। রাক্ষসদের হাত, পা, মুণ্ড কেটে কেটে বহু দূরে দূরে পতিত হল। উড়ন্ত কাক, গৃধ, শৃগালেরা সেই মাংস পাবার জন্য নিজেদের মধ্যে কোন্দল করতে লাগলো। অবশেষে এত রাক্ষসের ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উড়ে এলো যে তারা কোন্দল ভুলে মনের সুখে রক্ত, মাংস, নাড়ি-ভুঁড়ি ভোজন করতে লাগলো । মুণ্ডুহীন রাক্ষসেরা কবন্ধের ন্যায় মায়াবলে উঠে দাঁড়িয়ে নৃত্য করছিলো। ভগবান রাম অগ্নিবাণ ছুড়লেন । আকাশ থেকে অগ্নিপিণ্ড পতিত হতে লাগলো। অগ্নিতে ভস্ম হয়ে রাক্ষসদের ভস্ম চতুর্দিকে আচ্ছন্ন করে দিলো । অগ্নিতে হস্তী, অশ্ব আদি ভস্ম হল। রামচন্দ্রের নিক্ষেপিত দিব্যাস্ত্র থেকে হাজার হাজার শর উৎপন্ন হয়ে রাক্ষসদের বুকে বিদ্ধ হল। রক্তে মেদিনী কর্দমাক্ত হয়েছিলো। এরপর ভগবান রাম পুনঃ শিলাবাণ নিক্ষেপ করে বাকী রথ, হস্তী, অশ্বগুলি রাক্ষস সহিত পিষ্ট করলেন । এভাবে হত হতে দেখে ত্রিশিরা রাক্ষস এসে রামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলো । ত্রিশিরার সব অস্ত্র ভগবান রাম ধ্বংস করে দিলেন । ত্রিশিরা ক্রুদ্ধ হয়ে হস্তের প্রকাণ্ড মুগুর নিক্ষেপ করলে ভগবান রাম সেই মুগুর ধ্বংস করলেন। তারপর তিনটি শর দিয়ে ত্রিশিরার তিন মস্তক কেটে ফেললেন।
সব রাক্ষস অন্ত হয়েছে। এখানে দেহের স্তূপ জমেছে। রক্তনদীর ধারা গিয়ে গোদাবরীতে মিশেছে। চতুর্দিকে মাংসাশী প্রানী সকল মনের আনন্দে নিহত রাক্ষসদের ভক্ষণ করছে। দেহের স্তূপে বড় বড় বৃক্ষ গুলি চাপা পড়ে গেছে । দূষণ রাক্ষস রামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন । নানা দিব্যাস্ত্র রামচন্দ্রের দিকে নিক্ষেপ করলেও সব শর রামচন্দ্রের চালিত বাণে ধ্বংস হয়ে গেলো। এরপর ভগবান রাম তীক্ষ্ণ শর দ্বারা দূষণের রথের অশ্ব, সারথি, ধ্বজ, ছত্র, চক্র সব খণ্ডন করে গোটা রথ টাই খণ্ড খণ্ড করলেন । দূষণ লম্ফ দিয়ে ভূমিতে নেমে শূল নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে , রামচন্দ্র গন্ধর্ব বাণে দূষণের দেহ দ্বিখণ্ড করে দিলেন । ভ্রাতাকে নিহত হতে দেখে খড় শোক পেলো। রথ হতে নেমে ক্রুদ্ধ হয়ে একাকী খড় রামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো। খড় বাণে বাণে আচ্ছদিত করে রামচন্দ্রকে ঢেকে দিলো। রামচন্দ্র বললেন- “মূর্খ রাক্ষস তুমি এমন বালকদের ভাতি কেন যুদ্ধ করছ? তোমার শর আমার গাত্রে পুষ্পসম ঠেকছে। যাও ভালো মতো যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসো।” খড় ক্রোধে অধীর হয়ে এক বাণে রামচন্দ্রের ধনুক খণ্ড খণ্ড করে দিলো । রামচন্দ্র তখন মহর্ষি শরভঙ্গ প্রদত্ত শার্ঙ্গ ধনুক নিলেন। প্রবল বীক্রমে যুদ্ধ করলেন । রামচন্দ্রের শরে খড়ের সর্বাঙ্গ রক্তে প্লাবিত হল। রক্তে রক্তময় চতুর্দিকে। যেনো এইস্থানে রক্তবৃষ্টি হয়েছে। গাছগুলি নিজস্ব বর্ণ হারিয়ে রক্তবর্ণ ধারন করেছে। মাংসাশি পশু পক্ষী গুলির গাত্রবর্ণ অবধি রক্তবর্ণ হয়েছে । এরপর রামচন্দ্র দিব্যাস্ত্রে খড়ের বধ করলেন। সব রাক্ষস নিহত। দণ্ডকারণ্যে আর রাক্ষসের অস্তিত্ব নেই । মুনি ঋষি, ঊর্ধ্বে দেবতাবৃন্দ ভগবান রামের ওপর পুস্প বর্ষণ করে স্তব স্তুতি করতে লাগলেন । শূর্পনাখা ক্রন্দন করতে করতে লঙ্কায় গমন করলো । রাক্ষসেরা ভগবানের হাতে নিধন হয়ে দিব্যদেহ প্রাপ্ত করে বৈকুণ্ঠধাম প্রাপ্তি করলো । নিহত রাক্ষসদের দেহের স্তূপে যেনো মনে হয় বিধাতা এই স্থানে পর্বতমালা তৈরী করেছেন । চতুর্দিকে কেবল রাক্ষসদের খণ্ড খণ্ড দেহ, খণ্ড অস্ত্র, খণ্ড রথ- অশ্ব- হস্তী , কীরিট , রক্তাক্ত আভূষণ ব্যতীত আর কিছুই দেখা গেলো না ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন