১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড পর্ব – ৬ )


বর্ষা চলে গেছে। আকাশে নীল মেঘের মাঝে শ্বেত শুভ্র মেঘের আনাগোনা। বর্ষায় স্নাত উদ্ভিদের শাখাপ্রশাখা বিবিধ পুস্পে ছেয়ে গেছে। হরেক রকম পাখীর কলতান চতুর্দিকে মুখরিত করে তুলেছে । অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা তৈরী হয়েছে চারপাশে । বৃষ্টি আর নেই। পথে ঘাটে কত নাম না জানা বিবিধ লতা, পাতায় নানান পুস্প ধরেছে । পম্পা নদীর বুকে হাঁসেরা খেলা করছে। নদীর ধারে পাণকৌড়ি, বক, মাছরাঙা ইত্যাদি নানান পক্ষী । কবি কৃত্তিবাস এই সময়ের বর্ণনা করেছেন এইভাবে-

বরিষা হইল গত, শরৎ প্রবেশ ।
তথাপি না হইল জানকীর উদ্দেশ ।।
ভেকের নিনাদ গেল, মেঘের গর্জন ।
নির্মল চন্দ্রমা তারা প্রকাশে গগন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

শরৎ ঋতুর প্রাকৃতিক শোভা বড়ই নমনীয়। ঋতুরাজ বসন্ত ও শরৎ অপূর্ব শোভা সৃষ্টি করে। চতুর্দিকে কাশফুলে আচ্ছন্ন মাঠ- ঘাট। শেফালীর কুঁড়ি সবে বিকশিত হতে শুরু করেছে। কিন্তু বর্ষা অতিক্রান্ত হলেও সুগ্রীবের আর দেখা নেই । ভগবান রামচন্দ্র বলছেন- “ভ্রাতা লক্ষ্মণ । এটাই আদর্শ সময় সীতাকে অন্বেষণ করার। এখন নির্মল আকাশ। তেমন গরম বা শীতলতা নেই। বৃষ্টি নেই। এই সময় দীঘি- পুকুর জলে ভরা। যেখানে ইচ্ছে সেখানেই জল প্রাপ্তি সম্ভব। এই আদর্শ সময়। কোথায় সুগ্রীব! সেতো এলো না। সে কি ভুলে গেছে?” লক্ষ্মণ বলল- “ভ্রাতা! সুগ্রীব স্ত্রী সঙ্গে পরম সুখে দিন যাপন করছে। রাজকীয় সকল সুখ ভোগ করছে। সে কি আপনাকে সহায়তা করার কথা আর মনে রেখেছে ? এই জগতে অধিকাংশ মানুষই সুগ্রীবের ন্যায়। মুখে প্রতিজ্ঞা করে- কিন্তু কাজে নয়। উপকার নিতে জানে- কিন্তু দিতে নয়। সুখ নিতে জানে- কিন্তু অপরকে সুখী করতে জানে না। সুগ্রীবই সেই ধরণের।” ভগবান রাম বিলাপ করে বললেন- “হায়! আমি সুগ্রীবকে রাজাসন দিলাম। সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে আমাকে সর্ব প্রকারে সহায়তা করবে। কোথায় আর কি?” ভগবান রামের এইরকম বিলাপ শুনে লক্ষ্মণ অতি ক্রুদ্ধ হল। ক্রোধে যেনো সৌমিত্রের সমস্ত রোমকূপ দিয়ে অগ্নি বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। অতি ক্রোধী হয়ে লক্ষ্মণ বলল- “ভ্রাতা! সুগ্রীব সকল কিছু বিস্মৃত হয়েছে। এবার আমি তাকে মনে করাবো যে সে কি প্রতিজ্ঞা করেছিলো? প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারীকে বধ করলেও পাপ হয় না। সে কথা দিয়েও কথা রাখেনি। আজ তাকে টেনে এনে আপনার চরণে রাখবো।” এই বলে সুগ্রীব হনহন করে ধনুর্বাণ নিয়ে কিস্কিন্ধ্যা নগরীতে চললেন। লক্ষ্মণের এমন উগ্র মূর্তি দেখে বানর, লেঙুর, হনুমান, ভল্লুকেরা যে যেদিকে পারলো পলায়ন করলো। সুজলা সুফলা নগরীতে অতর্কিতে দস্যু আক্রমণ হলে যেমন সকল লোক বিক্ষিপ্ত ভাবে এদিক ওদিক পলায়ন করে ঠিক সেইভাবে পলায়ন করলো । অঙ্গদ , লক্ষ্মণের এমন বিকরাল রূপ দেখে ঘনঘন কেঁপে নানা স্তবস্তুতি করতে থাকলেন ।

লক্ষ্মণের হুঙ্কারে কেঁপে কেঁপে উঠলো কিস্কিন্ধ্যা নগরী । সে গিয়ে রাজমহলের বাহিরে ঘন হুঙ্কার দিয়ে সুগ্রীবকে নানান বাক্য বলতে লাগলো। বলল- “সুগ্রীব! তুমি কি শ্রীরামচন্দ্রকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হয়েছো? বর্ষার দুমাস চলে গেছে তবুও তুমি একবারও ওঁনার সাথে সাক্ষাৎ করো নি? তুমি এমন নিষ্ঠুর কেন? যিঁনি তোমাকে এত সুখ ঐশ্বর্য দিলেন- তুমি তাঁর প্রতিদান এইভাবে দিলে? তুমি অগ্নিদেবকে সাক্ষী করে করা শপথ ভঙ্গ করেছো। তুমি সৌমিত্রের বিক্রম জানো না। মনে হয় তোমাদের দুভ্রাতার মৃত্যু বিধাতা আমাদের হস্তেই লিখে রেখেছেন। বড় ভ্রাতা দাশরথি রঘুনন্দনের হাতে হত হয়েছে- তোমার মৃত্যু আমার হাতে হবে। তোমার এই রাজ্য আমি ধ্বংস করবো।” লক্ষ্মণের কথাতে যেনো অগ্নি বর্ষণ হচ্ছিল্ল। সুগ্রীব ভেতর থেকে শুনে ভাবল তাই তো। এতকাল হয়ে গেলো তিনি এমন অকৃতজ্ঞ যে, মিত্র রামের সাথে সাক্ষাৎই করেন নি। অগ্নি সাক্ষী করে করা প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হয়েছেন। আজ এই রাজকীয় সুখ, রুমাকে প্রাপ্তি এমনকি রুমার কারাবাস থেকে মুক্তি সব প্রভু শ্রীরামের দয়াতেই হয়েছে । লক্ষ্মণ ত উচিৎ কথাই বলছে। সুগ্রীব তাড়াতাড়ি রাজমহল থেকে বের হয়ে করজোড়ে লক্ষ্মণের সামনে বসে বললেন- “হে সৌমিত্র ! আপনি শান্ত হোন। সত্যি আমি খুব বড় অপরাধ করেছি। মিত্র শ্রীরামের দয়াতেই আজ এই সকল পেয়েছি। তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা আমার উচিৎ নয়। আমি শপথ করেছিলাম বালি বধের পর আমি সমগ্র বানর সেনা সমেত দেবী সীতার অন্বেষণ করবো। হে সৌমিত্র ! আমি সমস্ত অপরাধ নতমস্তকে স্বীকার করে প্রভু শ্রীরামের শরণাগত হলাম। এবার আপনি যা উচিৎ মনে করবেন- সেটাই করবেন।” সুগ্রীবের মধুর বাক্যে লক্ষ্মণ শান্ত হলেন । উগ্র রূপ কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো। তিনি বললেন- “তবে আমার দাদার নিকট গিয়ে তাঁহার কাছে এইরূপ ক্ষমা প্রার্থনা করো।”

সুগ্রীব তখন ভগবান রামের কাছে গিয়ে চরণে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা চাইলেন । ভগবান রাম বিন্দুমাত্র বকাঝকা না করে মিত্র সুগ্রীবকে উঠিয়ে আলিঙ্গন করে বললেন- “সখা! এবার আমার স্ত্রী সীতার অন্বেষণের জন্য সহায়তা করো। দেখো কতকাল যাবত আমি ও সীতা অভিন্ন হয়ে আছি। এই ক্লেশ আমি যেমন ভোগ করছি, তেমনি সীতাও পাচ্ছে। তোমার এই মিত্র তোমার নিকট সহায়তা ভিক্ষা চাইছে।” সুগ্রীব বললেন- “তাই হবে। আমার আদেশে ভূভাগে যেখানে যত বানর, লেঙুর, ভল্লুক আছে সকলে এসে হাজির হবে কিস্কিন্ধ্যায়।” এবার কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে বলা যাক। সুগ্রীবের নিদেশে ত্রিশ কোটি বানর ভূলোকে নানাদিক থেকে বানর দের আনতে গেলো। “জয় শ্রী রাম” ধ্বনি তুলে বানরেরা চতুর্দিক থেকে কিস্কিন্ধ্যায় আসতে লাগলো। শতাবলী, গবাক্ষ, শ্রীমৈন্দ, ধূম্রাক্ষ , নীলাক্ষ, প্রমাথী বানরেরা এক কোটি করে বানর নিয়ে কিস্কিন্ধ্যায় আসলো। হিঙ্গুলিয়া পর্বত থেকে কোটি কোটি উচ্চ বানর সকল আসলো। সত্তর কোটি বানর নিয়ে হনুমানের পিতা কেশরী আসলেন । বিনোদ, মলয়, সম্পাতি , ভল্লুকদের নিয়ে জাম্বুবান, দুর্জয় বানর, অঙ্গদ একশো কোটি বানর নিয়ে আসলো। এই ভাবে শতকোটি অক্ষৌহিণী বানর সেনা চতুর্দিকে জমা হল। চারিদিকে “হুপ, হুপ” শব্দ ভিন্ন অপর কিছুই শোনা গেলো না । যতদূর চোখে যায় যেনো সমুদ্রের নীল জলরাশির ন্যায় অগণিত বানর, ভল্লুক, লেঙুর, শিম্পাঞ্জী , কাঠবিড়ালী আর মর্কট ভিন্ন অপর কিছুই দেখা গেলো না। “জয় শ্রীরাম” ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ছেয়ে গেলো। রামচন্দ্র দেখে খুব খুশী হলেন। বানরদের প্রশংসা করে বললেন- “হে বীরগণ ! আপনারা সকলেই আমার জন্য এসেছেন। আমি জানি আপনারাই আমার স্ত্রীকে খুঁজে বের করতে পারবেন। আপনারা শক্তিমান- অনায়েসে রাক্ষস দের বধ করতে সমর্থ । এই দাশরথি রাম আপনাদের নিকট সদা কৃতজ্ঞ থাকবে।” এবার সীতামাতাকে খুঁজতে কে কোথায় যাবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হোলো।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।