বালির দেহ বহু যত্নে পুস্প মাল্য চন্দন, অগুরু বিবিধ সুগন্ধি পুস্প ও সুগন্ধি দিয়ে লিপ্ত করে পম্পা নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হল। এখানেই বালির সৎকার হবে। বালক অঙ্গদ পিতার মুখাগ্নি করলেন । এরপর বালির শ্রাদ্ধ-শান্তি করা হল। বিপুল দান ধ্যান- প্রচুর ভোজন করানো হল। বানর জাতির রাজা ছিলেন বালি। কিস্কিন্ধ্যা থেকেই সমগ্র বানর জাতির পরিচালনা করা হত। এমন বলা হয় বালির চিতায় তাঁর পত্নী তারাদেবী ঝাঁপ দিয়ে সতী হতে চাইলে ভগবান রাম বাধা প্রদান করেন । এবং তিনি বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন মৃত বালির পত্নী তারা আর সুগ্রীবের বিবাহ দিয়ে । হয়তো সেযুগে সতীদাহ প্রথা কঠোর ভাবে ছিলো। কিন্তু ভগবান রাম এমন পরিবর্তন আনলেন যে বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় জীবন্ত দাহ নয়- বরং তাহার পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা । যাতে নারীজাতি সম্মান নিয়ে মাথা তুলে বেঁচে থাকতে পারে । সুগ্রীব রাজা হয়ে অঙ্গদকে বানালো যুবরাজ । সুগ্রীবের পর অঙ্গদ হবে কিস্কিন্ধ্যার রাজা । বালক অঙ্গদ এই ছোট বয়সেই মহাবীর । বড় বড় বৃক্ষ , প্রস্তর অনায়েসে তুলতে পারে। যথাসময়ে সুগ্রীব রাজা হয়ে সিংহাসনে বসলেন । দাস দাসী সব সেবা করতে লাগলো । ভগবান রামচন্দ্রের প্রতিনিধি হয়ে লক্ষণ রাজবাটি গিয়ে সুগ্রীবকে অভিনন্দন জানালো। শ্রীরাম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি চতুর্দশ বৎসর কোন রাজবাটিটে পা রাখবেন না । রাজকীয় কোন সেবা গ্রহণ করবেন না । ভগবান রামের নির্দেশ মতো লক্ষণ জানালেন- “দাদার নির্দেশ এখন দুমাস বর্ষাকাল । এই সময় চতুর্দিকে বন্যা হয়। এই সময় জানকী দেবীকে খুঁজে বের করা অসাধ্য। তুমি এই দুমাস আনন্দে রাজসুখ উপভোগ করো। দুমাস গত হলে তুমি প্রতিশ্রুতি মতো তোমার সেনাদের অন্বেষণ কর্মে নিযুক্ত করবে।” সুগ্রীব বলল- “আজ্ঞে সৌমিত্র তাই হবে। মিত্র শ্রীরাঘবের এই উপকার আমি কদাপি বিস্মৃত হবো না। তিনি না থাকলে আমার সহিত কখনো রুমার আর পুনর্মিলন হতো না। রুমা কারাগারে দম বদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করতো। আমি হয়তো বা কোনদিন বালির হাতেই নিহত হতাম। শ্রীরামের ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না। বর্ষা অতিক্রান্ত হলেই আমি গিয়ে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করে পরিকল্পনা করিব।”
বর্ষা ঋতু আরম্ভ হল। আকাশে নবজলধরের মেলা। প্রখর রোদ্রে ধরণী আজ চাতকের মতো বর্ষণের অপেক্ষায় ছিলো। স্বশব্দে বজ্রপাত ধরণীর সেই পিপাসা মেটানোর সঙ্কেত দিলো। ময়ুর পেখম মেলে নৃত্য করতে লাগলো। বিবিধ পক্ষী বনের নানাস্থান হতে মধুর সুরে কলরব করতে লাগলো । জলপূর্ণ কালোমেঘ গুলি পরস্পর সংঘর্ষে বিকট শব্দ করতে লাগলো। তাহাদের মধ্যে সৌদামিনী এমন ভাবে খেলা করতো যেনো মনে হয় তাহারা মেঘের কোলেই অবস্থান করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় মেঘেরা গর্জন করে প্রবল বারিধারা বর্ষণ করলো। যেনো দেবাধিপতি মহেন্দ্রর বাহন গজরাজ ঐরাবত তাঁহার অসংখ্য শুণ্ড দিয়া অবিরত ধারায় ধরণীকে সিক্ত করছে । নদীর জলে প্লাবন এলো। চতুর্দিকে জলে মগ্ন। যখন সামান্য সূর্য দেখা যেতো- তখন চক্রবাক, রাজহংস- হংসী কেলি করতো। ময়ুড়- ময়ূরী পরস্পর যুগলকে নিবিড়তম করেছিলো। ঘন ঘন মেঘের রণহুঙ্কার আর তাঁর সাথে অস্ত্রের ন্যায় অবিরত বৃষ্টিবিন্দু মেঘের রাজ্য থেকে আসছিলো । নব বৃষ্টির আনন্দধারা পেয়ে ভেককুল অতি উচ্চ আনন্দে রব করে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছিল- কারন সেইদিগেই ভুজঙ্গকূল ধাবমান হচ্ছিল্ল । মালতী, জুঁই, যূথিকা, রজনীগন্ধা , বিথিকা, টগড়, বেলি ইত্যাদি নানান সুগন্ধি ফুল বৃষ্টির বিন্দু মেখে অপূর্ব রূপ ধারন করেছিলো- যার ফলে সমগ্র অরণ্য স্বর্গীয় সুগন্ধে ভরে উঠেছিলো । শ্রীরামচন্দ্র শোক করছেন সীতাদেবীর জন্য। বর্ষা বিরহের ঋতু। এইসময় প্রিয়তম/ প্রিয়তমের ভাবনায় মন ভরে ওঠে, সুতরাং এই অবস্থায় স্ত্রীবিচ্ছেদের যন্ত্রনা ভগবান রাম বুকে চেপে কেবল সীতারই কথা ভাবছিলেন । রামচন্দ্র বললেন-
বরিষার ধারাতে পৃথিবী ছাড়ে তাপ ।
সীতারে স্মরিয়া রাম করেন সন্তাপ ।।
আমার বচনে কর লক্ষ্মণ আরতি ।
দুরন্ত বরিষা ঋতু, স্থির নহে মতি ।।
সূর্য চন্দ্র দোঁহে বরিষার মেঘে ঢাকে ।
আমি ত মরিব ভাই জানকীর শোকে ।।
সজল জলদে শোভে বিদ্যুৎ যেমন ।
জানকী আমার কোলে ছিলেন তেমন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
সীতা বিহনে এমন বর্ষায় রামচন্দ্র অতি শোকে। তিনি কেবল সীতার অম্বেষণ করেই চলছেন । বর্ষার মেঘ আর রামচন্দ্রের নয়ন বোধ হয় উভয়ে একত্র হয়ে গেছে। পুরন্দরের সহস্র নয়ন দিয়ে যেভাবে সলিল ধারা বর্ষিত হয়, তেমনি শ্রীরামের উভয় নয়ন সীতাবিহনে অশ্রুধারা বর্ষণ করছে । অপরদিকে সাগর পাড়ে লঙ্কায় বন্দিনী সীতার সমদশা । বর্ষায় তিনি সিক্ত হয়ে সেই বৃক্ষতলে বসেই কেবল প্রভু রঘুবীরকেই স্মরণ করছেন । সমুদ্রের ঢেউ বৃষ্টির প্রসাদ পেয়ে ভয়ানক লহরী রূপে লঙ্কার সীমানায় আছড়ে পড়ছে । সমুদ্র আজ উথালপাতাল । রাবণ স্বর্ণছত্রে আবৃত হয়ে অশোকবাটিকায় আসলেন। আবার বিবাহের প্রস্তাব ও রামের নিন্দে করে বললেন- “হে সীতে! তুমি তোমার অহং বোধ ত্যাগ করো। দেখো সমুদ্রদেব কেমন লহরী সৃষ্টি করেছেন। তোমার ভিক্ষুক পতি রাম কোনদিনই এখানে আসতে পারবেন না। সুতরাং রামের চিন্তা বিসর্জন দিয়ে আমার চিন্তা করো। আমাকে বিবাহ করে রাজপুরী গিয়ে সুখ ভোগ করো। কেন এই বৃক্ষতলে কষ্ট ভোগ করছ?” শুনে সীতাদেবী ক্রোধে বললেন- “রে দুর্মতি! তোর ন্যায় মহাপাপীর মুখ দর্শন করাও পাপ। তোর সহিত বাক্যালাপ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। তবুও বলি তুই আমাকে যেইখানেই রেখে থাক- আমার স্বামী রঘুবীর সেইস্থানেই এসে আমাকে উদ্ধার করবেন । তুই রঘুবীরের পরাক্রম সম্বন্ধে অবগত নস । আমি দেখেছি তাঁর হস্তে কিভাবে রাক্ষসকূল মশকের ন্যায় ধ্বংস হয়েছে। শীঘ্র তুইও ওঁনার বীরত্ব দেখতে পাবি। এতকাল আমি তোর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করেছি। তোর মতো দুরাচারীর নিকট কাকুতি মিনতি করা আর পাথরের নিকট রোদন করা একইব্যাপার। তোর জীবনের শেষ অধ্যায় আরম্ভ হয়েছে। মৃত্যু তোর দিকে ধেয়ে আসছে। আমাকে বিবাহ করার ইচ্ছাই তোর ধ্বংসের মূল কারণ হবে।” এই বলে সীতাদেবী প্রচণ্ড ক্রোধী হলেন। রাবন গর্জন করতে করতে সেই স্থান ছেড়ে গেলো। সীতাদেবী একাগ্র মনে কেবল প্রভু শ্রীরামকেই স্মরণ করতে লাগলেন । মনে মনে প্রার্থনা জানাতে লাগালেন যেন শীঘ্র এসে তাঁহাকে এই পাপপুরী থেকে নিয়ে যান। বোধ হয় রাম ও সীতার চোখের জল সারা বর্ষা ধরে গগন থেকে পতিত হল। এই ভাবে বর্ষা ঋতু অতিক্রান্ত হল।
( ক্রমশঃ )
বর্ষা ঋতু আরম্ভ হল। আকাশে নবজলধরের মেলা। প্রখর রোদ্রে ধরণী আজ চাতকের মতো বর্ষণের অপেক্ষায় ছিলো। স্বশব্দে বজ্রপাত ধরণীর সেই পিপাসা মেটানোর সঙ্কেত দিলো। ময়ুর পেখম মেলে নৃত্য করতে লাগলো। বিবিধ পক্ষী বনের নানাস্থান হতে মধুর সুরে কলরব করতে লাগলো । জলপূর্ণ কালোমেঘ গুলি পরস্পর সংঘর্ষে বিকট শব্দ করতে লাগলো। তাহাদের মধ্যে সৌদামিনী এমন ভাবে খেলা করতো যেনো মনে হয় তাহারা মেঘের কোলেই অবস্থান করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় মেঘেরা গর্জন করে প্রবল বারিধারা বর্ষণ করলো। যেনো দেবাধিপতি মহেন্দ্রর বাহন গজরাজ ঐরাবত তাঁহার অসংখ্য শুণ্ড দিয়া অবিরত ধারায় ধরণীকে সিক্ত করছে । নদীর জলে প্লাবন এলো। চতুর্দিকে জলে মগ্ন। যখন সামান্য সূর্য দেখা যেতো- তখন চক্রবাক, রাজহংস- হংসী কেলি করতো। ময়ুড়- ময়ূরী পরস্পর যুগলকে নিবিড়তম করেছিলো। ঘন ঘন মেঘের রণহুঙ্কার আর তাঁর সাথে অস্ত্রের ন্যায় অবিরত বৃষ্টিবিন্দু মেঘের রাজ্য থেকে আসছিলো । নব বৃষ্টির আনন্দধারা পেয়ে ভেককুল অতি উচ্চ আনন্দে রব করে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছিল- কারন সেইদিগেই ভুজঙ্গকূল ধাবমান হচ্ছিল্ল । মালতী, জুঁই, যূথিকা, রজনীগন্ধা , বিথিকা, টগড়, বেলি ইত্যাদি নানান সুগন্ধি ফুল বৃষ্টির বিন্দু মেখে অপূর্ব রূপ ধারন করেছিলো- যার ফলে সমগ্র অরণ্য স্বর্গীয় সুগন্ধে ভরে উঠেছিলো । শ্রীরামচন্দ্র শোক করছেন সীতাদেবীর জন্য। বর্ষা বিরহের ঋতু। এইসময় প্রিয়তম/ প্রিয়তমের ভাবনায় মন ভরে ওঠে, সুতরাং এই অবস্থায় স্ত্রীবিচ্ছেদের যন্ত্রনা ভগবান রাম বুকে চেপে কেবল সীতারই কথা ভাবছিলেন । রামচন্দ্র বললেন-
বরিষার ধারাতে পৃথিবী ছাড়ে তাপ ।
সীতারে স্মরিয়া রাম করেন সন্তাপ ।।
আমার বচনে কর লক্ষ্মণ আরতি ।
দুরন্ত বরিষা ঋতু, স্থির নহে মতি ।।
সূর্য চন্দ্র দোঁহে বরিষার মেঘে ঢাকে ।
আমি ত মরিব ভাই জানকীর শোকে ।।
সজল জলদে শোভে বিদ্যুৎ যেমন ।
জানকী আমার কোলে ছিলেন তেমন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
সীতা বিহনে এমন বর্ষায় রামচন্দ্র অতি শোকে। তিনি কেবল সীতার অম্বেষণ করেই চলছেন । বর্ষার মেঘ আর রামচন্দ্রের নয়ন বোধ হয় উভয়ে একত্র হয়ে গেছে। পুরন্দরের সহস্র নয়ন দিয়ে যেভাবে সলিল ধারা বর্ষিত হয়, তেমনি শ্রীরামের উভয় নয়ন সীতাবিহনে অশ্রুধারা বর্ষণ করছে । অপরদিকে সাগর পাড়ে লঙ্কায় বন্দিনী সীতার সমদশা । বর্ষায় তিনি সিক্ত হয়ে সেই বৃক্ষতলে বসেই কেবল প্রভু রঘুবীরকেই স্মরণ করছেন । সমুদ্রের ঢেউ বৃষ্টির প্রসাদ পেয়ে ভয়ানক লহরী রূপে লঙ্কার সীমানায় আছড়ে পড়ছে । সমুদ্র আজ উথালপাতাল । রাবণ স্বর্ণছত্রে আবৃত হয়ে অশোকবাটিকায় আসলেন। আবার বিবাহের প্রস্তাব ও রামের নিন্দে করে বললেন- “হে সীতে! তুমি তোমার অহং বোধ ত্যাগ করো। দেখো সমুদ্রদেব কেমন লহরী সৃষ্টি করেছেন। তোমার ভিক্ষুক পতি রাম কোনদিনই এখানে আসতে পারবেন না। সুতরাং রামের চিন্তা বিসর্জন দিয়ে আমার চিন্তা করো। আমাকে বিবাহ করে রাজপুরী গিয়ে সুখ ভোগ করো। কেন এই বৃক্ষতলে কষ্ট ভোগ করছ?” শুনে সীতাদেবী ক্রোধে বললেন- “রে দুর্মতি! তোর ন্যায় মহাপাপীর মুখ দর্শন করাও পাপ। তোর সহিত বাক্যালাপ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। তবুও বলি তুই আমাকে যেইখানেই রেখে থাক- আমার স্বামী রঘুবীর সেইস্থানেই এসে আমাকে উদ্ধার করবেন । তুই রঘুবীরের পরাক্রম সম্বন্ধে অবগত নস । আমি দেখেছি তাঁর হস্তে কিভাবে রাক্ষসকূল মশকের ন্যায় ধ্বংস হয়েছে। শীঘ্র তুইও ওঁনার বীরত্ব দেখতে পাবি। এতকাল আমি তোর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করেছি। তোর মতো দুরাচারীর নিকট কাকুতি মিনতি করা আর পাথরের নিকট রোদন করা একইব্যাপার। তোর জীবনের শেষ অধ্যায় আরম্ভ হয়েছে। মৃত্যু তোর দিকে ধেয়ে আসছে। আমাকে বিবাহ করার ইচ্ছাই তোর ধ্বংসের মূল কারণ হবে।” এই বলে সীতাদেবী প্রচণ্ড ক্রোধী হলেন। রাবন গর্জন করতে করতে সেই স্থান ছেড়ে গেলো। সীতাদেবী একাগ্র মনে কেবল প্রভু শ্রীরামকেই স্মরণ করতে লাগলেন । মনে মনে প্রার্থনা জানাতে লাগালেন যেন শীঘ্র এসে তাঁহাকে এই পাপপুরী থেকে নিয়ে যান। বোধ হয় রাম ও সীতার চোখের জল সারা বর্ষা ধরে গগন থেকে পতিত হল। এই ভাবে বর্ষা ঋতু অতিক্রান্ত হল।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন