এখন মেঘনাদ নিরুপায় হয়ে বলল- “ওহে কপি! তুমি বৃহৎ কোন মায়াবী বা ছদ্দবেশী দেবতা যেই হও না কেন- আমি তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্রে বন্ধন করবো। ব্রহ্মাস্ত্র থেকে মুক্তি কেউ পায় না। দেখি তোমার কত মায়া।” এই বলে মেঘনাদ ধনুকে ব্রহ্মাস্ত্র আনয়ন করলো। মন্ত্র পড়ে হনুমানের দিকে নিক্ষেপ করলো। ব্রহ্মাস্ত্রের মুখ দিয়ে প্রলয় সমান অগ্নি নিক্ষেপ হল। চারপাশে প্রলয় ঝড়, বজ্রপাত হতে লাগলো। সমুদ্রের জলে বিশাল ঢেউ উৎপন্ন হল। ব্রহ্মাস্ত্রের তেজে চতুর্দিকে চোখ ধাঁধানো আলো সৃষ্টি হল। হনুমান দেখলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে ব্রহ্মাস্ত্রে তাঁর কোন ক্ষতিই হবে না। কিন্তু তিনি ব্রহ্মাস্ত্রে বদ্ধ না হলে ব্রহ্মার অপমান হবে। প্রজাপতি ব্রহ্মার সম্মান রাখার জন্য তিনি ব্রহ্মাস্ত্র কে স্বীকার করে নিলেন ও রজ্জুবদ্ধ হলেন । মেঘনাদ বিজয়ীর ন্যায় অট্টহাস্য করে বললেন- “চলো! আবার আমার পিতা দশানন তোমাকে উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করবেন।” হনুমান বদ্ধ হয়েছে এই শুনে রাক্ষস রাক্ষসীরা আনন্দে নৃত্যগীত করতে করতে হনুমানকে দেখতে আসলো । ভয়ার্ত হয়ে সীতাদেবী অবিরত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন যেনো হনুমান মুক্ত হয়ে যায়। লঙ্কার রাক্ষসেরা হনুমানকে দেখে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলেন ।মেঘনাদের নামে জয়জয়কার পড়ে গেলো। রাবণ এলেন লঙ্কার রাজসভাতে তে। সেখানে হনুমানকে বন্দী করে আনা হয়েছে । রাবণের সুন্দর রাজসভা এত অনুপম সুন্দর যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সোনা মাণিক্যের দিব্য ঝলকে আলো হয়ে আছে চতুর্দিক । রাক্ষসেরা সমানে হট্টগোল করে হনুমানের জন্য মৃত্যুদণ্ড চাইছিলো। রাবনের সামনে বন্দী হনুমান দণ্ডায়মান । হনুমান বলল- “লঙ্কারাজ! আমি একজন দূত! আপনার রাজ্যে কি দূতকে এই ভাবে দাঁড় করিয়ে বন্দী করে অভ্যর্থনা জানানো হয়? আপনি যদি আমাকে আসন প্রদান না করেন, তবে আমি নিজের জন্যই নিজে একটি আসন রচনা করছি।” এই বলে হনুমান তাঁর লাঙুল বৃহৎ করে পেঁচিয়ে কুণ্ডলী বদ্ধ করে তাঁর ওপর বসলেন । একেবারে রাবণের মুখোমুখি। হনুমানের বিক্রম দেখে রাক্ষসেরা সব হা করে থাকলো । দশানন ভাবল এই কপি কে? একি ছদ্দবেশী দেবতা? নাকি শিবের কোন সেবক। বহু আগে নন্দী শাপ দিয়েছিলো যে নর বানরের হাতে লঙ্কার ধ্বংস হবে- এই কি সে? রাবণ বলল- “তুই কে? কোথার থেকে কেন লঙ্কায় এসেছিস? তোর এত সাহস হল কিভাবে যে আমার বাগান তছনছ করিস, আমার পুত্র ও আমার সেনাদের হত্যা করেছিস?” হনুমান বলল- “ওরে দুর্মতি! যাঁর ইচ্ছাতে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় হয়, যিঁনি এই ব্রহ্মাণ্ড রচনা করেছেন, যাঁর ইচ্ছায় শেষনাগ মস্তকে এই বসুমতীকে ধারন করেন – আমি তাঁরই দাস । যিঁনি দেবতাদের রক্ষা করবার জন্য অবতার গ্রহণ করেন, তোমার মতোন মূর্খকে শাস্তি দিয়ে থাকেন আর কঠোর হরধনুক ভঙ্গ করে থাকেন, খড়- দূষণ- ত্রিশিরা-মারীচ যিনি বধ করেছেন- আমি তাঁরই দাস।” এই শুনে লঙ্কারাজ রাবণ সহ সকলে হাসতে থাকলেন। কিন্তু পড়ে পুত্রের মৃত্যুর কথা মনে হওয়াতে রাবণ হাস্য থামিয়ে ক্রোধী হয়ে বললেন- “ও তাহলে সেই ভিক্ষুক রাম তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? শুনি সেই বনবাসী ভিখারী আমাকে কি বলেছে?” হনুমান বলল- “মূর্খ ! তিনি রাজারও রাজা। তুমি বালির হস্তে পরাজিত হয়েছিলে, সেই বালি নিহত হয়েছেন তাঁরই হাতে। হে লঙ্কেশ আমি বন্দী অবস্থায় আমার প্রভুর সেবা করে যেতে চাই। আমি সীতামাতার কাছে প্রভুর সংবাদ দিয়েছি। আমি ক্ষুধার্ত হয়ে ফল খাচ্ছিল্লাম। সেই অবস্থায় তোমার পুত্র ও তোমার সেনাদের বধ করি। দেখো আমি ভগবান শ্রীরামের তুচ্ছ সেবক হয়েই তোমার এমন সর্বনাশ করে দিলাম। এবার ভাবো তিঁনি যদি অস্ত্র ধরেন, তাহলে তোমার কি দশা হবে?”
হনুমান আরোও বলল- “হে লঙ্কেশ! আমি করজোড়ে বিনীত ভাবে বলছি, প্রভু শ্রীরামের সাথে শত্রুতা করো না। মাতা সীতাকে ওঁনার কাছে পৌছে দিয়ে ওঁনার কাছে ক্ষমা চাও। তুমি মহান পুলস্ত্য ঋষির বংশজ । এভাবে এই পবিত্র কুলে কালিমা লেপন করো না । মন থেকে সকল পাপ, অহঙ্কারকে বিসর্জন দিয়ে ভবভয়হারী শ্রীরামকে মনে অধিষ্ঠিত করো। এই জগতে ‘রাম’ নামই সত্য। বাকী সব অসার। তুমি সেই জগতের সার ‘রাম’ নাম অবিরত জপ করে প্রভু শ্রীরামের শরণ লও । আমি শপথ করে বলছি, রামবিমুখদের এই জগতে কেহ রক্ষা করতে পারে না। ব্রহ্মা ও শিব এসেও তোমাকে বাঁচাতে পারবেন না। অতএব মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” শুনে সকলে অট্টহাস্য করলো। বলশালী রাক্ষসেরা ভাবল তারা এত শক্তিমান হয়ে ঐ তুচ্ছ নরের নাম জপ করবে। আরে নর তো আহার্য। তাকে আবার পূজা? রাবণ দশমুখ দিয়ে অট্টহাস্য করে বলল- “এবার দেখছি আমার এক পরম জ্ঞানী বানর গুরু জুটেছে, যে আমাকে ধর্ম কথা শেখাচ্ছে। ওরে দুষ্ট ! তুই আমাকে কি জ্ঞান দিচ্ছিস? তোর শিয়রে যে কাল উপস্থিত। কিছুক্ষণ পর তুই পৃথিবী থেকে সোজা যমের দক্ষিণ দুয়ারে যাবি।” হনুমান অনেক বুঝিয়ে রাবণকে রাজী করাতে পারলো না। হনুমান বলল- “ঠিক উল্টোটাই হবে দশানন। রামভক্তদের তুই কালের ভয় দেখাচ্ছিস? যাঁর মুখে রাম নাম জপ হয় তাঁকে যম স্পর্শ অবধি করতে পারে না। আমি নয়, বরং তুই যমের দক্ষিণ দুয়ারে যাবি। আর সেই দিনটি ক্রমশঃ সন্নিকটে আসছে। মৃত্যুর পূর্বে ব্যাক্তির বাড়বাড়ন্ত প্রবল হয় বলে শুনেছিলাম। আজ চাক্ষুষ উদাহরণ দেখলাম । বিনাশের আগে মানুষের বিপরীত বুদ্ধি হয়।” হনুমানের কথা শুনে রাবণ ক্রোধে দাঁত কটমট করতে লাগলো।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন