১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১৬ )


শুক আর শারণ সকল কিছুই দেখেছিলো। সে গিয়ে দশানন রাবণকে সকল সংবাদ প্রদান করল । বলল- “দশানন! শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ সেনা সমেত সমুদ্র পাড়ে উপস্থিত । এবং বানর যোদ্ধা নল আর নীল সমুদ্রে সেঁতু তৈরী করতে কাজে লেগে পড়েছে। সেঁতু তৈরী হলেই তারা এখানে আসবে।” দশানন রাবণ অট্টহাস্য করলো। তার দেখাদেখি সভামাঝে বিভীষণ ব্যতীত সকলেই তাচ্ছিল্ল্য ভরে হাসল । বিভীষণ জানতো এই হাসি কিছুকালের মধ্যেই লঙ্কা দেখে বিদায় নেবে । দশানন রাবণ বলল- “দেবতারা যার পদসেবা করে তাকে মারবে ঐ তুচ্ছ ভিক্ষুক ভাতৃদ্বয়! বনের পশু নিয়ে লঙ্কা জয় করার স্বপ্ন সে দেখছে। আসতে দাও ওদের। আসবে ঠিক, কিন্তু একটাও ফিরে যাবে না। লঙ্কাই হবে ওদের মৃত্যুভূমি।” সকল রাক্ষসেরা রাবণের নামে জয়ধ্বনি করে রাবণকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহ দিতে লাগলো । রাক্ষসেরা জানালো বহুদিন যাবত পশু মাংস আহারের স্বাদ । ঐ বানর, মর্কট, ভল্লুক, লেঙুরদের মাংসে উদর তৃপ্ত হবে। এইভাবে রাক্ষসেরা নানা বিধ কল্পনা বুনে হাস্য করতে লাগলো । বিভীষণ বলল- “ভ্রাতা! আপনি কি এখনো বিজয়ী হবার স্বপ্ন দেখেন ? আপনার কি মনে হয় আপনি শ্রীরামকে বধ করতে সমর্থ হবেন ? এ কদাপি হয় না। ঈশ্বরকে বধ করা যায় না। আপনি কেন এমন মিথ্যা কল্পনা রচনা করে আনন্দ করছেন ? এই রাক্ষস বীরেরা কেউ কিন্তু বাঁচবে না। আপনার লঙ্কা ধ্বংস হয়ে যাবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই রাক্ষসদের পরিবার স্বজন হারানোর ব্যাথায় গভীর শোকে আচ্ছন্ন হবে। ভ্রাতা! যদি আপনি এমন অনর্থ রোধ করতে চান , তবে এখুনি সীতাদেবীকে ফিরিয়ে দিয়ে ভগবান শ্রীরামের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন।” রাবণ এই কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়লো। রাক্ষসেরা শুনে ক্ষেপে সকলে বিভীষণের গর্দান চাইলো। বিভীষণ রাক্ষস কুলের কলঙ্ক। রাক্ষস হয়ে কিনা ঐ তুচ্ছ ভিক্ষুক আর বনের পশুদের ভয় করে। রাবণ বলল- “বিভীষণ! তুমি সীমা লঙ্ঘন করো না। নাহলে তোমাকে লঙ্কা থেকে বিতারিত করতে বাধ্য হবো।”

বিভীষণ বলল- “ভ্রাতা! আমি আপনাকে, আপনার পুত্রদের, আপনার রাজ্য, আপনার প্রজাদের খুবুই স্নেহ করি। আপনি এদের বিনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছেন। শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করার পরিণাম যে কি হবে আপনি তা ভাবতে পারছেন না । তিনি সাক্ষাৎ বিষ্ণু । অসুর নিধন করেন। তাঁর সহিত যুদ্ধে জয়ী কেউ হতে পারে না । সীতাদেবী রাক্ষসদের কালরাত্রি স্বরূপ, আর তেনাতেই আপনার এত প্রীতি কিভাবে আসে ? আপনি লঙ্কার কালকে অশোক বনে রেখেছেন। এক মহা দুর্যোগ আসতে চলেছে। আপনি সত্বর সীতাদেবীকে , শ্রীরামের হাতে তুলে দিন। এতে আপনিও বাঁচবেন, এই লঙ্কাও বাঁচবে , আপনার সেনা সকল বাঁচবে । শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করার অর্থ বিনাশ। ভুলে গেলেন কিশোরকালে এই শ্রীরাম কিভাবে অনায়েসে তাড়কার আশ্রিত তিন কোটি রাক্ষস বধ করেছিলেন। তাড়কা, মারীচ, সুবাহু এই দর্পেই হত হয়েছে। বিরাধের ন্যায় শক্তিশালী রাক্ষস এই শ্রীরামের হাতে নিহত হয়েছে। আরোও ভাবুন খড়, দূষণ এর বলশালী চৌদ্দ রাক্ষস কিভাবে বধ হয়েছে। খড়, দূষণ, ত্রিশিরা এই সমস্ত দেবতাদের অবধ্য রাক্ষসকে অনায়েসে রঘুপতি রামচন্দ্র নিহত করেছেন। আপনি তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। লঙ্কা দহন নিজের চোখেই দেখলেন। ভগবান রামের শরের সামনে আপনার এই রাক্ষসেরা ভেকের ন্যায়। অতএব সীতাদেবীকে ফিরিয়ে আপনিও ভগবান শ্রীরামের শরণ নিন। তিনি ভক্তবৎসল । তাঁর শরণ নিলে আর কোন ভয় থাকবে না । হৃদয়ে এই বৈরীভাবকে ধ্বংস করে রামভক্তি স্থাপন করুন। ভগবান রামের নাম জপ করুন। ঐ নাম জপ করেই দস্যু রত্নাকর , বাল্মিকী মুনি হয়েছেন।” এত শুনে রাবণ কুপিত হল-

তবে সেই দশানন মহাবেগে চলে ।
পদাঘাত কৈলা বিভীষণ বক্ষঃস্থলে ।।
বিভীষণ অচেতন হইয়া তাহায় ।
পড়িল ধরণীতলে ছিন্ন তরুপ্রায় ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইবার রাবণ বললেন- “কুলাঙ্গার! তুই নিজ ভ্রাতার পক্ষ ত্যাগ করে ঐ শ্রীরামের নাম করিস। যা দূর হয়ে যা লঙ্কা থেকে। তোর মুখ আর দেখবো না।” এই বলে রাবণ , বিভীষণের বুকে পদাঘাত করে দূর করে দিলো । বিভীষণ রাবণের পা জড়িয়ে বলল- “দাদা! আমাকে তাড়িয়ে দাও , খেদ নেই। কিন্তু লঙ্কার সর্বনাশ কে আমন্ত্রণ জানিও না। শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করার পরিণাম কেবল সর্বনাশ। হাহাকার উঠবে কেবল লঙ্কা থেকে । সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” রাবণ বলল- “দূর হ! এত যখন রামের প্রতি প্রীতি! তো ঐ রামের ওখানেই থাক। আর দ্যাখ কিভাবে আমি তাদের যমালয়ে প্রেরন করি।”

বিভীষণ তখন নিজ অনুচর নিয়ে সাগর পারে বানরদের মাঝে আসলো । সমুদ্র তটে বিভীষণ ও তাঁর আশ্রিত রাক্ষসদের ঘুরতে দেখে বানরেরা রাবণের গুপ্তচর ভেবে বেঁধে ধরে শ্রীরামের কাছে নিয়ে গেলো । হনুমান দেখে বলল- “আরে তোমরা করো কি? ইনি আমাকে সেদিন মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচিয়েছেন। ইনি প্রভুর ভক্ত। ইনি জাতিতে রাক্ষসরাজ রাবণের ভ্রাতা হলেও, অন্তর থেকে প্রভুর ভক্ত। শীঘ্র এর বন্ধন মোচন করো।” বিভীষণের বন্ধন খোলা হল। তিনি গিয়ে প্রভু শ্রীরামের চরণে লুটিয়ে পড়লেন । অনেক স্তবস্তুতি করলেন। সকল ঘটনা সবিস্তারে বললেন। ভগবান শ্রীরাম বললেন- “রাবণের বিনাশ নিকটে এসেছে। তাই সে তোমার মতোন শুভবুদ্ধিদাতাকে বিতারিত করে কুটিল রাক্ষস দের বুদ্ধি শুনছে।” বিভীষণ বলল- “প্রভু! আমি অনেক বুঝিয়েছি আমার ভ্রাতাকে । তিনি কোন কথাই শোনেন নি। বৌঠান দেবী মন্দোদরী, আমাদের পিতামাতা এমনকি অনেকেই বুঝিয়েছেন , কিন্তু আমার অগ্রজের সকল বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। সে কারোর কথাই শোনে নি। আজ আমাকে পদাঘাত করে বিতারিত করেছেন।”এই বলে বিভীষণ পুনঃ পুনঃ নানা ঘটনা বললেন। রাক্ষসদের সকলের বুদ্ধি ভ্রম হয়েছে। তাদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। রাবণের জেদে সব কটা মরবে । ভগবান রাম বললেন- “বিভীষণ! আজ থেকে তুমি আমার মিত্র হলে। তোমার ন্যায় ধার্মিক , শাস্ত্রজ্ঞ শাসক লঙ্কার রাজা হবার যোগ্য। তোমার ন্যায় ব্যক্তি রাজা হলে রাজ্যে সুখ, সমৃদ্ধি , উন্নতি বৃদ্ধি পায়। আমি শপথ করছি, দশানন রাবণকে বধ করে আমি তোমাকে লঙ্কার রাজা বানাবো। তুমিই হবে আগামী লঙ্কার রাজা।” এই বলে বিভীষনের রাজতিলক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন ভগবান শ্রীরাম। সমুদ্র বারি দ্বারা অভিষেক করলেন । এইদিকে বানরেরা সকল কিছু জমায়েত জিনিষ দিয়ে সেতুর কাজ শুরু করলো।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।