হনুমান নানান বার্তা বলতে বলতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষণকে নিয়ে যেতে লাগলেন । ঋষমূক পর্বতে ‘মলয়’ নামক একটি পর্বতচূড়া ছিলো। সেখানেই বালির ভ্রাতা সুগ্রীব, জাম্বুবান, নল, নীল আর অল্প কিছু বানর থাকতো । সুগ্রীব দূর থেকে দেখলো হনুমান দুজন যোদ্ধাকে পরম খাতির যত্ন করে নিয়ে আসছে। সুগ্রীব খুব ভয় পেলো। একবার ভাবল শেষে কি হনুমান বালির সাথে বন্ধুত্ব করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো! এইবার বুঝি যমরাজ উপস্থিত- তার প্রান নিতে। ওদিকে কিস্কিন্ধ্যায় বন্দী রুমার সাথে আর সাক্ষাৎ হবে না। শেষে এই লেখা ছিলো। জাম্বুবান ভীত সুগ্রীবকে বোঝালো যে এরা বোধ হয় শত্রু না, না হলে হনুমানের মতো এত বিচক্ষণ ব্যাক্তি কেন এদের এখানে নিয়ে আসবেন? হনুমানের সাথে ভগবান রাম ও লক্ষণ সেইস্থানে আসলেন। সুগ্রীবের ভীত মুখ দর্শন করে হনুমান হাস্য করে বললেন- “সুগ্রীব! এঁনাদের দেখে ভয়ের কারন নেই। বরং প্রভুর দর্শন করলে সকল ভয় দূর হয়, যাঁকে দেখে তুমি মিছা ভয় পাচ্ছো- তিনি তোমাকে সকল দিক থেকে ভয়মুক্ত করবেন। এঁনারা বালির প্রেরিত যোদ্ধা নয়। ইনি আমার প্রভু। এঁনারা অযোধ্যার রাজকুমার।” সুগ্রীব তখন রাম লক্ষণের সাথে কুশল বিনিময় করলেন । ভগবান রাম নিজের জীবনের ঘটনা সকল বলে বললেন- “পিতৃসত্য পালনের জন্য চতুর্দশ বৎসরের জন্য বনে এসে রাক্ষসদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। লঙ্কারাজ রাবণের ভগিনীকে শাস্তি দেই। আর রাবণ সেই প্রতিশোধের জন্য আমার স্ত্রীকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গেছে। এখন রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য তোমার সহায়তা প্রয়োজন।” সুগ্রীব কৃতাঞ্জলিপুটে বলল- “হে রাম! আমি আপনার দুঃখ উপলব্ধি করতে পারি। আমার আপনার অবস্থা একই। আমার স্ত্রী রুমা আমার ভ্রাতা বালির নিকট বন্দী। আমার ভ্রাতা ইন্দ্রের বর প্রাপ্ত- তাঁহাকে যুদ্ধে পরাজিত করা দুষ্কর । তাই এইরকম পালিয়ে এই ঋষমূক পর্বতে আশ্রয় নিয়েছি। মহর্ষি মতঙ্গের অভিশাপের কারণে বালি এখানে আসতে পারে না।”
এই বলে সুগ্রীব আরোও জানালো- “বহু আগে আমার ভ্রাতা মায়াবী নামক এক রাক্ষস বধ করবার নিমিত্ত একটি পর্বতে প্রবেশ করে। কিছু সময় বাদে গুহা থেকে রুধির ধারা বহির্গমন হতে থাকলে- আমি ভেবেছিলাম সেই রাক্ষসের হাতে বুঝি ভ্রাতা বালি নিহত হয়েছেন। এবার যাতে সেই রাক্ষস গুহা থেকে বাহিরে না আসতে পারে সেই ভয়ে গুহামুখ বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে দাদা বালির নামে রাজ্য চালনা করতে থাকি। সিংহাসনের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র লোভ ছিলো না। এরমধ্যে আমার দাদা বালি সেই মায়াবী রাক্ষসকে বধ করে গুহার মুখ উন্মোচন করে রাজ্যে ফিরে আমাকে লোভী, গুহামুখ বন্ধ করে বালিকে মারবার ষড়যন্ত্রকারী বিবেচনা করে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করে। এখন সে আমাকে হত্যা করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাই অস্ত্র সহিত আপনাদের আসতে দেখে আমি ভীত হয়েছিলাম । কারণ বালি এখানে না আসতে পারলেও- সে কোন ঘাতককে আমাকে হত্যা করবার জন্য প্রেরন করতেই পারে!” শুনে রামচন্দ্র শোকার্ত সুগ্রীবকে সান্ত্বনা দিলেন। অভয় দিলেন । সুগ্রীব যেনো ভগবান রামের সংস্পর্শে এসে নিজেকে ভয়মুক্ত মনে করলেন। সত্যি তো! এই রামচন্দ্রের ছত্রছায়ায় নিজেকে যেনো সর্বপ্রকার ভয়- শঙ্কা থেকে মুক্ত স্বাধীন মনে হয় । ভগবান রাম বললেন- “মিত্র সুগ্রীব! অগ্নিসাক্ষী রেখে আজ আমরা দুজনে বন্ধুত্বের সম্পর্কে বদ্ধ হবো। আজ হতে রামচন্দ্র আর সুগ্রীব বন্ধু। হে বন্ধু! আমি তোমার দুঃখ অনুভব করতে পারি। আমি বালি আর রাবণের মধ্যে কোনরূপ ভেদ দেখি না। দুজনেই ক্রোধী, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, কামুক ও নিষ্ঠুর । এইরূপ দুর্মতি, পরপীড়ক নিষ্ঠুরেরা বেঁচে থাকলে সাধুজন লোকের বহু কষ্ট হয়। সৃষ্টির কল্যাণে এদের নিহত করা উচিৎ। সীতা উদ্ধারে তুমি বানর কুল সমেত আমাকে সহায়তা করো। এই দাশরথি রাম তোমাদের সহায়তা প্রার্থনা করছে।”
সুগ্রীব বলল- “মিত্র! বানর কুলের রাজা এখন বালি। এই অবস্থায় বালির সম্মতি ছাড়া কোন বানর আপনাকে সহায়তা প্রদান করতে অসমর্থ । কারন বালিকে দেখে সকলে শঙ্কিত । আপনি বালিকে বধ করে আমাকে রাজ্যভার দিন। আমি কথা দিচ্ছি আমি সীতাদেবীকে অনুসন্ধান করবো। সমগ্র বানরকুল নানাদিকে তাঁহার অন্বেষণ করবে।” ভগবান রামচন্দ্র সম্মতি দিলেন। তিনি ও সুগ্রীব অগ্নিসাক্ষী করে বন্ধুত্ব পাতালেন। অগ্নির সামনে শপথ রাখলেন একে অপরকে সাহায্য করবেন । সুগ্রীব জানালো- কিছুদিন আগে তারা আকাশ মার্গে এক নারীর ক্রন্দন ও একজন দানবের অট্টহাস্য শুনেছেন, সেসময় আকাশ থেকে কিছু অলঙ্কার গহনা পতিত হয়। সুগ্রীবের আদেশে বানরেরা সেই অলঙ্কার দেখালো। রামচন্দ্র দেখে ক্রন্দন করে বললেন- “এই তো আমার সীতার অলঙ্কার। সীতা বুদ্ধিমতী! বোধ হয় আমাকে সঙ্কেত দেবার জন্যই এইস্থানে অলঙ্কার নিক্ষেপ করেছে।” রামচন্দ্র তখন সীতার কেয়ুর, বালা, কুণ্ডল, কণ্ঠের হার বুকে চেপে শোক বিলাপ করতে লাগলেন। নুপূর দেখে লক্ষণ বলল- “দাদা! আমি রোজ বৌঠানকে প্রনাম করবার সময় তার চরণে এই নুপুর দেখেছি। এই অলঙ্কার স্বয়ং বৌঠানের।” শোকার্ত রামচন্দ্র কঠোর হয়ে বললেন- “যে আমার সীতাকে আমার থেকে দূরে নিয়ে গেছে তাকে আমি বধ করবো। স্বয়ং দাশরথি রাম আজ এখানে এই শপথ নিলাম।” এরপর রামচন্দ্র প্রথমে জাম্বুবানকে দূত করে বালির রাজ্যে পাঠালেন । জাম্বুবান গিয়ে বালিকে সতর্ক করে বলল- “বালি! তুমি সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দাও। সুগ্রীবকে রাজ্যে নিয়ে আসো। সে তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তোমাদের স্বর্গীয় পিতা মহারাজ অক্ষয় স্বর্গ থেকে তোমাদের বৈরীভাব দেখে কষ্ট পাচ্ছেন। এই বৈরীভাবকে সমাপ্ত করো।” বালি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল- “ঐ লোভী ভ্রাতাকে আমি কদাপি নিজ রাজ্যে স্থান দেবো না। স্বামীর কুকর্মের ফল স্ত্রী ভোগ করে। অতএব সুগ্রীবের পাপের শাস্তি রুমা পাবে।” জাম্বুবান ফিরে আসলো। বালি যে মানবেই না এটা সবাই আন্দাজ করেই নিয়েছিলো । জাম্বুবানের মুখ বালির আস্ফালন সকল শুনে ভগবান রাম স্থির করলেন এবার এই পাপী বালিকে বধ ভিন্ন আর উপায় নেই। যে দুর্মতি শান্তিপ্রস্তাব মানে না- তাঁকে নিধন করাই শ্রেয় । তিনি শপথ করলেন বালিকে মেরে তিনি সুগ্রীবকে রাজ্য দেবেন । বালির পত্নী তারা কিন্তু স্বামীকে অনেক বোঝালো যে রুমাকে মুক্তি দিয়ে সুগ্রীবকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বালি নিজের স্ত্রীর কথা পাত্তা দিলো না ।
(ক্রমশঃ)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন