রাবণের গোটা লঙ্কা জ্বলছে । চতুর্দিকে যেদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল আগুনের লেলিহান শিখা ভিন্ন অপর কিছুই চোখে পড়ে না । কি সেই পর্বতপ্রমাণ শিখা । যেনো আজ সমগ্র লঙ্কা নগরীকে ভস্ম করে দেবে । চারপাশে রাক্ষসেরা কেবল এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। রাবণের রাজ্য আজ গ্রাস করেছে স্বয়ং বৈশ্বানর । যেনো দেবতাবৃন্দ রাবণের ধ্বংস হেতু যজ্ঞ করে তাতে রাক্ষসদের দেহ ও পবন দেবতার প্রবাহিত বায়ুকে আহুতি দিচ্ছে। হনুমান লম্ফ দিয়ে এদিক ওদিক আগুন দিয়েই বেড়াচ্ছে। আর হনুমানের পিতা হাওয়া প্রবাহিত করে এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে আগুন প্রবাহিত করে হনুমানকে সাহায্য করছে । কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হল না। তাঁর সমস্ত গৃহে আগুন ধরলেও কুম্ভকর্ণের নিঃশ্বাসে অগ্নি নির্বাপিত হল। তাঁর দুই পুত্র কুম্ভ ও নিকুম্ভ পলায়ন করলো। এমনকি রাবণের মাতা কেকসীর গৃহ ভস্ম করলে সেই আদি রাক্ষসী কোন মতে বাহিরে আসলো । রাবণের মন্ত্রী সেনাপতির গৃহ কোন বাগান বাকী রাখলো না। কেবল বিভীষণের গৃহতে অগ্নি সংযোগ করলো না হনুমান । আর অশোক বনে অগ্নি সংযোগ করলো না। হনুমানের জলন্ত লেজ থেকে ধোয়া সমেত অগ্নি থাকলেও হনুমানের বিন্দু মাত্র কষ্ট হচ্ছিল্ল না । কোথায় গেলো স্বর্ণ লঙ্কা! রাবণ স্ত্রী সমেত অশোক বনে আসলো । সে এক মুহূর্তের জন্য সীতার স্থানে তাঁর ইষ্টদেবী ভদ্রকালীর তেজময়ী স্বরূপ প্রত্যক্ষ করলো । তিনি সহস্র জিহ্বা দ্বারা লঙ্কার ভোগ নিচ্ছেন । যেনো সমগ্র লঙ্কাকে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়েছে । দেবী সীতা অট্টহাস্য করলেন । সেই অট্টহাস্য যেনো গগনে গগনে গর্জে উঠলো । সীতাদেবী সেই অগ্নির প্রকাশিতা তেজ শক্তি সম বাক্যে বললেন- “দুর্মতি রাবণ! তুই আমার স্বামী রঘুবীরের সাথে যুদ্ধের বাসনা রাখিস? দেখ তেঁনার সামান্য সেবক এসে তোর লঙ্কা কেমন ভস্ম করে দিলো। আর যদি তিঁনি আসেন ভাব তোর কি দশা হবে ? ওরে রাবণ এবার তোর চিতার আগুন জ্বলবে । তাই বলছি আমার স্বামীর কাছে আমাকে ফিরিয়ে ওঁনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।”
রাবণ ক্রোধে বলল- “মূর্খা নারী ! তোর স্বামী সামান্য এক বানর দিয়ে আমাকে ভয় দেখিয়েছে! দশানন রাবণ এইসবে ভীত নয় । তোর জন্য একশো লঙ্কাকে আমি বলি দিতে পারি। কিন্তু কদাপি তোকে ঐ ভিক্ষুক রামের হাতে ফিরিয়ে দেবো না। সেই ভিখারী যদি ভাবে সামান্য বানর নিয়ে এসে লঙ্কা জয় করবে, তবে সে মস্ত বড় ভ্রম করছে।” মন্দোদরী বলল- “প্রভু! এই সতী নারী সীতা সত্যই বলছে । আপনি এর কথা মেনে নিন। দেখুন আপনার দর্পের পরিণাম । আপনার সন্তান আজ নিহত। লঙ্কার চার বীর যোদ্ধা প্রান হারিয়েছে। না জানি কত রাক্ষসেরা হতাহত হয়েছে। সেই শ্রীরামচন্দ্রের একজন দূত এসে যদি এই অবস্থা করতে পারে তবে গোটা সেনা সমেত রামচন্দ্র আসলে না জানি কি হবে? আমি চারিদিকে কেবল অমঙ্গল দেখতে পাচ্ছি। আপনি সীতার কথা মেনে নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়াসুন।” রাবণ প্রবল কণ্ঠে বলে উঠলো- “কদাপি নয়। এতদিন সীতাকে আমি বিবাহের ইচ্ছায় এখানে রেখেছি। এখন সীতা লঙ্কার গৌরব। সেই গৌরবকে আমি ঐ ভিখারী রামের হাতে কিছুতেই দেবো না। সেই রাম যুদ্ধের অভিলাষ করেছে। আমি এর যোগ্য জবাব দেবো। লঙ্কা দহনের শাস্তি সে পাবে। জীবিত থাকতে যতক্ষণ শ্বাস থাকবে ততক্ষণ আমি সীতাকে ফিরিয়ে দেবো না। এই গর্বিতা সীতার সকল গর্ব চূর্ণ করবো।” এভাবে রাবণ সীতার সকল কথা উড়িয়ে দিলো। লঙ্কার লেলিহান অগ্নি দেখে রাবণের পরিবর্তন হল না । লঙ্কার থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে যে ধোয়া উঠছিলো তা সাগর পাড়ে বসে অঙ্গদ, জাম্বুবান, নল , নীল , গবাক্ষ আদি বানরেরা বসে দেখছিলো। তারা তখনও জানতো না যে হনুমান লঙ্কায় আগুন দিয়েছে । তারা ঐ ধোঁয়া সম্বন্ধে বিস্মৃত ছিলো । অপরদিকে রাবণের একে একে বলশালী অশ্ব, হস্তী পুড়ে ভস্ম হল। বাকী অশ্ব, হস্তী পলায়ন করলো । স্বর্ণ রথ গুলি আগুনে গলে তপ্ত সোনার নদীর ন্যায় লঙ্কার রাজপথ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল্ল। লঙ্কার বিজয় স্তম্ভ হুড়মুড় করে বিকট শব্দে ভেঙ্গে রাক্ষসদের মাথায় পড়লো । হনুমান এরপর নিজের জলন্ত পুচ্ছের অগ্নি নেভানোর জন্য নিজের মুখে নিজের লেজ চেপে ধরতেই লেজের আগুনে মুখ পুড়লো, কিন্তু আগুন নিভল না ।
হনুমান সেই অবস্থায় মাতা সীতার কাছে গিয়ে সব কিছু বলে বলল- “মা! এই আগুনে আমার মুখ পুড়েছে। আমি এখন স্বজাতির কাছে কিভাবে মুখ দেখাবো ?” মাতা সীতা বললেন- “পুত্র! তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তুমি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সেবক । তিঁনি থাকতে ভয় কি। আমি বর প্রদান করছি আজ হতে সকল হনুমানের মুখ পোড়া হবে। যাতে তারা কেউ তোমাকে দেখে ব্যাঙ্গ না করে। তুমি সমুদ্রের জলে লাঙুলের অগ্নি নির্বাপিত করো।” হনুমান এবার ফিরতে অনুমতি চাইলো। মাতা সীতা অনুমতি দিয়ে বলল- “পুত্র! মনে রেখো আমাকে রাবণ দুমাস সময় দিয়েছে। ওঁনাকে বল এই দুমাসের মধ্যেই যেনো তিঁনি রাবণকে বধ করে আমাকে উদ্ধার করেন।” “তাই হবে” বলে হনুমান লম্ফ দিয়ে আকাশে উঠলো । এবার রাবণ কে বলল- “রাবণ । অন্তিম বার বলছি। দেখলি তো ভগবান শ্রীরামের সাথে শত্রুতার ফল কি? আজ ঘর পুড়িয়েছি। কাল শ্মশানে তোর চিতায় আগুন দেবো। তাই যাতে বাঁচতে চাস- সেই উপায় বলি। ভগবান শ্রীরামের কাছে ক্ষমা চেয়ে মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে রাজ্যসুখ ভোগ কর । অন্যত্থায় কি পরিণাম হবে তা দেখতেই তো পাচ্ছিস।” রাবণ বলল- “সীতাকে আমি ফিরাবো না। সে যে পরিস্থিতি হোক। তোর ঐ ভিক্ষুক প্রভু রাম যুদ্ধ চায়- তো যুদ্ধ হবে। যুদ্ধে তোদের বধ করে ঐ রাম আর লক্ষণের বধ করে বিজয় উৎসব করবো। তুই গিয়ে বল সীতাকে রাবণ ফিরিয়ে দেবে না। যুদ্ধ চাইলে সে যেনো এসে আমার সাথে যুদ্ধ করে।” হনুমান বলল- “দশানন! তোর বুদ্ধি নাশ হয়েছে। তোর মৃত্যু ধেয়ে আসছে। ঠিক আছে যুদ্ধক্ষেত্রেই তোর সাথে দেখে হবে।” এই বলে হনুমান উড়ে চলল । প্রথমে সমুদ্রের গভীর জলে লাঙুল ডুবিয়ে অগ্নি নির্বাপিত করলো। তখন একটি মৎস্য হনুমানের লেজের পুচ্ছের জল ভক্ষণ করেছিলো । এরপর হনুমান ফিরে চলল প্রভু শ্রীরামের কাছে ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন