১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ৯ )


রাবণের গোটা লঙ্কা জ্বলছে । চতুর্দিকে যেদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল আগুনের লেলিহান শিখা ভিন্ন অপর কিছুই চোখে পড়ে না । কি সেই পর্বতপ্রমাণ শিখা । যেনো আজ সমগ্র লঙ্কা নগরীকে ভস্ম করে দেবে । চারপাশে রাক্ষসেরা কেবল এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। রাবণের রাজ্য আজ গ্রাস করেছে স্বয়ং বৈশ্বানর । যেনো দেবতাবৃন্দ রাবণের ধ্বংস হেতু যজ্ঞ করে তাতে রাক্ষসদের দেহ ও পবন দেবতার প্রবাহিত বায়ুকে আহুতি দিচ্ছে। হনুমান লম্ফ দিয়ে এদিক ওদিক আগুন দিয়েই বেড়াচ্ছে। আর হনুমানের পিতা হাওয়া প্রবাহিত করে এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে আগুন প্রবাহিত করে হনুমানকে সাহায্য করছে । কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হল না। তাঁর সমস্ত গৃহে আগুন ধরলেও কুম্ভকর্ণের নিঃশ্বাসে অগ্নি নির্বাপিত হল। তাঁর দুই পুত্র কুম্ভ ও নিকুম্ভ পলায়ন করলো। এমনকি রাবণের মাতা কেকসীর গৃহ ভস্ম করলে সেই আদি রাক্ষসী কোন মতে বাহিরে আসলো । রাবণের মন্ত্রী সেনাপতির গৃহ কোন বাগান বাকী রাখলো না। কেবল বিভীষণের গৃহতে অগ্নি সংযোগ করলো না হনুমান । আর অশোক বনে অগ্নি সংযোগ করলো না। হনুমানের জলন্ত লেজ থেকে ধোয়া সমেত অগ্নি থাকলেও হনুমানের বিন্দু মাত্র কষ্ট হচ্ছিল্ল না । কোথায় গেলো স্বর্ণ লঙ্কা! রাবণ স্ত্রী সমেত অশোক বনে আসলো । সে এক মুহূর্তের জন্য সীতার স্থানে তাঁর ইষ্টদেবী ভদ্রকালীর তেজময়ী স্বরূপ প্রত্যক্ষ করলো । তিনি সহস্র জিহ্বা দ্বারা লঙ্কার ভোগ নিচ্ছেন । যেনো সমগ্র লঙ্কাকে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়েছে । দেবী সীতা অট্টহাস্য করলেন । সেই অট্টহাস্য যেনো গগনে গগনে গর্জে উঠলো । সীতাদেবী সেই অগ্নির প্রকাশিতা তেজ শক্তি সম বাক্যে বললেন- “দুর্মতি রাবণ! তুই আমার স্বামী রঘুবীরের সাথে যুদ্ধের বাসনা রাখিস? দেখ তেঁনার সামান্য সেবক এসে তোর লঙ্কা কেমন ভস্ম করে দিলো। আর যদি তিঁনি আসেন ভাব তোর কি দশা হবে ? ওরে রাবণ এবার তোর চিতার আগুন জ্বলবে । তাই বলছি আমার স্বামীর কাছে আমাকে ফিরিয়ে ওঁনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।”

রাবণ ক্রোধে বলল- “মূর্খা নারী ! তোর স্বামী সামান্য এক বানর দিয়ে আমাকে ভয় দেখিয়েছে! দশানন রাবণ এইসবে ভীত নয় । তোর জন্য একশো লঙ্কাকে আমি বলি দিতে পারি। কিন্তু কদাপি তোকে ঐ ভিক্ষুক রামের হাতে ফিরিয়ে দেবো না। সেই ভিখারী যদি ভাবে সামান্য বানর নিয়ে এসে লঙ্কা জয় করবে, তবে সে মস্ত বড় ভ্রম করছে।” মন্দোদরী বলল- “প্রভু! এই সতী নারী সীতা সত্যই বলছে । আপনি এর কথা মেনে নিন। দেখুন আপনার দর্পের পরিণাম । আপনার সন্তান আজ নিহত। লঙ্কার চার বীর যোদ্ধা প্রান হারিয়েছে। না জানি কত রাক্ষসেরা হতাহত হয়েছে। সেই শ্রীরামচন্দ্রের একজন দূত এসে যদি এই অবস্থা করতে পারে তবে গোটা সেনা সমেত রামচন্দ্র আসলে না জানি কি হবে? আমি চারিদিকে কেবল অমঙ্গল দেখতে পাচ্ছি। আপনি সীতার কথা মেনে নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়াসুন।” রাবণ প্রবল কণ্ঠে বলে উঠলো- “কদাপি নয়। এতদিন সীতাকে আমি বিবাহের ইচ্ছায় এখানে রেখেছি। এখন সীতা লঙ্কার গৌরব। সেই গৌরবকে আমি ঐ ভিখারী রামের হাতে কিছুতেই দেবো না। সেই রাম যুদ্ধের অভিলাষ করেছে। আমি এর যোগ্য জবাব দেবো। লঙ্কা দহনের শাস্তি সে পাবে। জীবিত থাকতে যতক্ষণ শ্বাস থাকবে ততক্ষণ আমি সীতাকে ফিরিয়ে দেবো না। এই গর্বিতা সীতার সকল গর্ব চূর্ণ করবো।” এভাবে রাবণ সীতার সকল কথা উড়িয়ে দিলো। লঙ্কার লেলিহান অগ্নি দেখে রাবণের পরিবর্তন হল না । লঙ্কার থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে যে ধোয়া উঠছিলো তা সাগর পাড়ে বসে অঙ্গদ, জাম্বুবান, নল , নীল , গবাক্ষ আদি বানরেরা বসে দেখছিলো। তারা তখনও জানতো না যে হনুমান লঙ্কায় আগুন দিয়েছে । তারা ঐ ধোঁয়া সম্বন্ধে বিস্মৃত ছিলো । অপরদিকে রাবণের একে একে বলশালী অশ্ব, হস্তী পুড়ে ভস্ম হল। বাকী অশ্ব, হস্তী পলায়ন করলো । স্বর্ণ রথ গুলি আগুনে গলে তপ্ত সোনার নদীর ন্যায় লঙ্কার রাজপথ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল্ল। লঙ্কার বিজয় স্তম্ভ হুড়মুড় করে বিকট শব্দে ভেঙ্গে রাক্ষসদের মাথায় পড়লো । হনুমান এরপর নিজের জলন্ত পুচ্ছের অগ্নি নেভানোর জন্য নিজের মুখে নিজের লেজ চেপে ধরতেই লেজের আগুনে মুখ পুড়লো, কিন্তু আগুন নিভল না ।

হনুমান সেই অবস্থায় মাতা সীতার কাছে গিয়ে সব কিছু বলে বলল- “মা! এই আগুনে আমার মুখ পুড়েছে। আমি এখন স্বজাতির কাছে কিভাবে মুখ দেখাবো ?” মাতা সীতা বললেন- “পুত্র! তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তুমি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সেবক । তিঁনি থাকতে ভয় কি। আমি বর প্রদান করছি আজ হতে সকল হনুমানের মুখ পোড়া হবে। যাতে তারা কেউ তোমাকে দেখে ব্যাঙ্গ না করে। তুমি সমুদ্রের জলে লাঙুলের অগ্নি নির্বাপিত করো।” হনুমান এবার ফিরতে অনুমতি চাইলো। মাতা সীতা অনুমতি দিয়ে বলল- “পুত্র! মনে রেখো আমাকে রাবণ দুমাস সময় দিয়েছে। ওঁনাকে বল এই দুমাসের মধ্যেই যেনো তিঁনি রাবণকে বধ করে আমাকে উদ্ধার করেন।” “তাই হবে” বলে হনুমান লম্ফ দিয়ে আকাশে উঠলো । এবার রাবণ কে বলল- “রাবণ । অন্তিম বার বলছি। দেখলি তো ভগবান শ্রীরামের সাথে শত্রুতার ফল কি? আজ ঘর পুড়িয়েছি। কাল শ্মশানে তোর চিতায় আগুন দেবো। তাই যাতে বাঁচতে চাস- সেই উপায় বলি। ভগবান শ্রীরামের কাছে ক্ষমা চেয়ে মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে রাজ্যসুখ ভোগ কর । অন্যত্থায় কি পরিণাম হবে তা দেখতেই তো পাচ্ছিস।” রাবণ বলল- “সীতাকে আমি ফিরাবো না। সে যে পরিস্থিতি হোক। তোর ঐ ভিক্ষুক প্রভু রাম যুদ্ধ চায়- তো যুদ্ধ হবে। যুদ্ধে তোদের বধ করে ঐ রাম আর লক্ষণের বধ করে বিজয় উৎসব করবো। তুই গিয়ে বল সীতাকে রাবণ ফিরিয়ে দেবে না। যুদ্ধ চাইলে সে যেনো এসে আমার সাথে যুদ্ধ করে।” হনুমান বলল- “দশানন! তোর বুদ্ধি নাশ হয়েছে। তোর মৃত্যু ধেয়ে আসছে। ঠিক আছে যুদ্ধক্ষেত্রেই তোর সাথে দেখে হবে।” এই বলে হনুমান উড়ে চলল । প্রথমে সমুদ্রের গভীর জলে লাঙুল ডুবিয়ে অগ্নি নির্বাপিত করলো। তখন একটি মৎস্য হনুমানের লেজের পুচ্ছের জল ভক্ষণ করেছিলো । এরপর হনুমান ফিরে চলল প্রভু শ্রীরামের কাছে ।

( ক্রমশঃ )

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।