শুরু হল সেঁতু বন্ধনের কাজ। বানরেরা ধরাধরি করে বিশাল তাল, শাল, শিশু গাছ আনলো। বিশাল প্রকাণ্ড গুঁড়ি কেটে এনে ধরাধরি করে আনলো । অতি প্রকাণ্ড তাল বৃক্ষ শয়ে শয়ে বানর ধরে এনে সমুদ্র তটে জমা করতে লাগলো । তাঁর সাথে মন্দার পর্বত থেকে প্রকাণ্ড শিলা বানরেরা বহন করে আসতে লাগলো । সমুদ্র তটে প্রচণ্ড উত্তাপের বদলে সূর্য দেবতা স্বল্প উত্তাপ প্রান করছিলেন, যাতে ভগবানের সেবক দের কোন রূপ কষ্ট না হয় । সকলে নাওয়া খাওয়া ভুলে সমানে কাজ করে যেতে লাগলো । ভল্লুক, মর্কট, বানর যে যতটা পারে বিশালাকার শিলাখণ্ড আর শাল বৃক্ষ এনে দিলো । হনুমান শ্রীরামের মহিমা গায়কের মতোন গাইছিলো। শ্রীরামের মহিমা শুনে পশুদের সকল ক্লান্তি দূরীভূত হয়েছিলো । হনুমান সকল শিলাখণ্ডে ‘রাম’ নাম লেখে যাছিল্লো। ‘রাম’ নামে ভবসমুদ্র পার হওয়া যায়- এতো মাত্র একশো যোজণ । ‘রাম’ নাম জপ করেই রাজা দশরথের ব্রহ্মহত্যা পাপ নিবারিত হয়েছিলো । কোটি পাতকীর পাপ নাশ হয় ‘রাম’ নাম উচ্চারন করলে । তারকব্রহ্ম ‘রাম’ নাম জপ না করে মনুষ্য যদি হেলায় দিন কাটায় তবে তার মনুষ্য জনম বৃথা । কি সন্ন্যাসী , কি ব্রাহ্মণ, কি ক্ষত্রিয় , কি বৈশ্য কি শুদ্র – চণ্ডাল- অন্তজ যদি ‘রাম’ নাম কীর্তন করে তবে সে দেবতুল্য হয় । আর উচ্চকূল ব্যাক্তি যদি ‘রাম’ নাম ত্যাগ করে তবে তাহার ন্যায় অচ্ছুৎ আর কেহ হয় না । দস্যু যদি ‘রাম’ নাম জপ করে ‘মহর্ষি’ হতে পারে তবে ‘রাম’ নামে কি না হয়। নল আর নীল সেই সকল প্রস্তর , বিশাল বৃক্ষ, প্রকাণ্ড গুঁড়ি সমুদ্রে নিক্ষেপ করা মাত্র ভেসে থাকলো। সমুদ্রের ঢেঊ কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি করলো না । মজবুত করে একটির সাথে একটি জোড়া লাগলো । ‘রাম’ নামের এই মহিমা যে নল নীলের ওপর অভিশাপ এখন ‘বরদান’ এ পরিণত হয়েছে । কাহারো মুখে ক্লান্তি নেই । সকলে কাজ করে যাচ্ছে।
এইভাবে দশ যোজন, বিশ যোজন, ত্রিশ যোজন সেঁতু নির্মাণ হল। বড় বড় বৃক্ষের আর বড় বড় প্রস্তরের নির্মিত সেঁতুতে কিছু ফাঁক ফোঁকর থেকেই যাছিল্ল। যেগুলো বানর, মর্কট, ভল্লুক, লেঙুরদের নজরে আসছিলো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাষ্ঠবিড়াল এসে ছোট্ট ছোট্ট প্রস্তর নিয়ে এসে সেই ফাঁকফোকর গুলো ভরাট করে যাত্রাপথ মসৃণ করছিলো । তখন হনুমান বিড়াল দের সড়িয়ে দিলো । হনুমান ভেবেছিলো এই ক্ষুদ্র প্রানী আর কি সহায়তা করবে ? যথা-
কাষ্ঠবিড়াল সব আইল তথাকারে ।
লাফ দিয়া পড়ে গিয়া সাগরের তীরে ।।
অঙ্গেতে মাখিয়া বালি ঝাড়য়ে জাঙ্গালে ।
ফাঁক যত ছিল তাহা মারিল বিড়ালে ।।
যাতায়াত করে সদা বীর হনুমান ।
বিড়ালেরে চারিদিকে ফেলে দিয়া টান ।।
কান্দিয়া কহিল সবে রামের গোচর ।
মারিয়া পাড়য়ে প্রভু পবন- কুমার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
কাষ্ঠবিড়াল সকল গিয়ে প্রভু রামের কাছে বলল- “প্রভু আমরা তুচ্ছ হয়েও কি আপনার সেবা করতে পারবো না। আমরা সেঁতুর ফাঁকফোকর ক্ষুদ্র প্রস্তর দিয়ে বন্ধ করছিলাম । পবনপুত্র এসে আমাদের বিতারিত করল। আমরা দুর্বল, বিশাল প্রস্তর বহনের শক্তি নেই। তাই এইভাবে আপনার সেবা করছিলাম।” কাষ্ঠবিড়ালীদের এইরূপ ভক্তি দেখে ভগবান রাম অতি প্রীত হলেন । এই বিড়ালিদের ভক্তি দেখে তাঁর চোখে জল আসল । তিনি কাষ্ঠবিড়ালি দের করে তুলে আদর করলেন। বললেন-
হনুমানে ডাকিয়া কহেন প্রভু রাম ।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেন কর অপমান ।।
যেমন সামর্থ্য যার বান্ধুক সাগর ।
শুনিয়া লজ্জিত হইল পবন- কুমার ।।
সদয় হৃদয় বড় প্রভু রঘুনাথ ।
কাষ্ঠবিড়ালের পৃষ্ঠে বুলাইল হাত ।।
চলিল সবাই তবে জাঙ্গাল উপর ।
হনুমান বলে শুন সকল বানর ।।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেহ কিছু না বলিবে ।
সাবধান হ’য়ে সবে জাঙ্গালে চলিবে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
হনুমান লজ্জিত হয়েছিলেন । তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন এই দুর্বল কাষ্ঠবিড়ালিরা কি আর প্রভুর সেবা করবে। এরা তো নিজেরাই সামর্থ্য হীন । পরে ভাবলেন তিনি ত ভ্রম করেছেন। স্বয়ং প্রভুই তো সৃষ্টি রচনার সময় এদের এইটুকুই শক্তি দিয়েছিলেন । সুতরাং এরা এইটুকু দিয়েই প্রভুর সেবা করবে । তাই তিনি কাষ্ঠবিড়ালীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁদেরকেও প্রভুর সেবার অধিকার দিলেন । কাষ্ঠবিড়ালীরা অতি ক্ষুদ্র হয়েও এই মহৎ কাজে যোগদান করল ।
আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছে, যারা দরিদ্র । অনেকে আছে সহায় সম্বলহীন । কিন্তু তাই বলে তাঁদের যে প্রভুর সেবা করার অধিকার নেই- এমন নয় । এই কাষ্ঠবিড়ালীরা তাঁর প্রমান। ভগবান শ্রীরাম এই নগণ্য জীবগুলিকে সেঁতুবন্ধনের কাজে নিয়ে এসেছিলেন । নগণ্য, ক্ষুদ্র, দরিদ্র যে যেই অবস্থায় থাকুক, সেই অবস্থায় ভগবানের সেবা করা কর্তব্য। “শবরী” অধ্যায়ে সেখানে বিশ্লেষণ হয়েছে । ভগবান মনুষ্য জাতি সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কর্তব্য সেই ঈশ্বরের ভজনা করা । আমরা অনেকেই ভাবি আমি দরিদ্র, আমি নিঃসহায় , আমি ক্ষুদ্র- আমি কি ভগবানের সেবা করবো ? ভগবানের সেবা হয় তো কেবল মন্দিরে। যেখানে ছাপান্নো ব্যাঞ্জন, কত পুস্প, কত সুগন্ধি দ্বারা ভগবানের সেবা হয়। এই ধারনা ভুল । বস্তুত ঈশ্বরের ভজনা যেখানে হয় সেটিই মন্দির । ইট দিয়ে একটি কক্ষ বানানো বানিয়ে যে মন্দির আমরা দেখি, সেটিই যে কেবল ও একমাত্র মন্দির - এমন নয়। গাছতলায় বসেও যদি কেউ ভগবানের সেবা, ভজনা করেন- সেই গাছতলাই মন্দির। অপরদিকে পাকা দালানে যদি ভগবানের সেবা ভজনা না হয়, তবে সেটা কেবল ইঁটের স্তূপ মাত্র । আর যে যেই অবস্থায় থাকে তাঁকে সেই অবস্থায়, সেই ভাবে ঈশ্বরের ভজনা করা উচিৎ। আমাদের মনে খুব একটা ভুল ধারনা আছে যে রাশি রাশি ব্যাঞ্জন ও এলাহী ভাবে ভগবানের পূজা করলেই সেই পূজা সফল হয়- এটা খুব বড় ভুল। এই অজুহাতে অনেক দরিদ্র ব্যক্তি ঈশ্বর ভজনা করেন না। বলেন আমার নিজের নাই, আমি কি ঈশ্বরকে দেবো ? আরে এই জগতে যা কিছু সবই তো ঈশ্বরের সৃষ্টি। আর এলাহী ভাবে পূজো করলেই ভগবান সন্তুষ্ট হয় না। শবরীর প্রদত্ত সামান্য জাম ফলেই ভগবান তৃপ্ত হয়েছিলেন। যে দরিদ্র সে সামান্য বাতাসা দিয়েই ভগবানের সেবা করবে- আর যে ধনী সে যদি সামান্য বাতাসা দিয়ে কার্পণ্য করে, সেটা তার পক্ষে অনুচিত হবে। যাঁর যা সামর্থ্য- সেই ভাবেই ঈশ্বরের ভজনা করা উচিৎ । যাই হোক, দেখতে দেখতে সেঁতু নির্মাণ সমাপ্ত হল। লঙ্কার তট পর্যন্ত শত যোজন সেঁতু তৈরী হল। লঙ্কায় বসে রাবণ গুপ্তচরদের মুখে সব শুনে কেবল দর্পে হাস্য করতে লাগলো ।
( ক্রমশঃ )
এইভাবে দশ যোজন, বিশ যোজন, ত্রিশ যোজন সেঁতু নির্মাণ হল। বড় বড় বৃক্ষের আর বড় বড় প্রস্তরের নির্মিত সেঁতুতে কিছু ফাঁক ফোঁকর থেকেই যাছিল্ল। যেগুলো বানর, মর্কট, ভল্লুক, লেঙুরদের নজরে আসছিলো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাষ্ঠবিড়াল এসে ছোট্ট ছোট্ট প্রস্তর নিয়ে এসে সেই ফাঁকফোকর গুলো ভরাট করে যাত্রাপথ মসৃণ করছিলো । তখন হনুমান বিড়াল দের সড়িয়ে দিলো । হনুমান ভেবেছিলো এই ক্ষুদ্র প্রানী আর কি সহায়তা করবে ? যথা-
কাষ্ঠবিড়াল সব আইল তথাকারে ।
লাফ দিয়া পড়ে গিয়া সাগরের তীরে ।।
অঙ্গেতে মাখিয়া বালি ঝাড়য়ে জাঙ্গালে ।
ফাঁক যত ছিল তাহা মারিল বিড়ালে ।।
যাতায়াত করে সদা বীর হনুমান ।
বিড়ালেরে চারিদিকে ফেলে দিয়া টান ।।
কান্দিয়া কহিল সবে রামের গোচর ।
মারিয়া পাড়য়ে প্রভু পবন- কুমার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
কাষ্ঠবিড়াল সকল গিয়ে প্রভু রামের কাছে বলল- “প্রভু আমরা তুচ্ছ হয়েও কি আপনার সেবা করতে পারবো না। আমরা সেঁতুর ফাঁকফোকর ক্ষুদ্র প্রস্তর দিয়ে বন্ধ করছিলাম । পবনপুত্র এসে আমাদের বিতারিত করল। আমরা দুর্বল, বিশাল প্রস্তর বহনের শক্তি নেই। তাই এইভাবে আপনার সেবা করছিলাম।” কাষ্ঠবিড়ালীদের এইরূপ ভক্তি দেখে ভগবান রাম অতি প্রীত হলেন । এই বিড়ালিদের ভক্তি দেখে তাঁর চোখে জল আসল । তিনি কাষ্ঠবিড়ালি দের করে তুলে আদর করলেন। বললেন-
হনুমানে ডাকিয়া কহেন প্রভু রাম ।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেন কর অপমান ।।
যেমন সামর্থ্য যার বান্ধুক সাগর ।
শুনিয়া লজ্জিত হইল পবন- কুমার ।।
সদয় হৃদয় বড় প্রভু রঘুনাথ ।
কাষ্ঠবিড়ালের পৃষ্ঠে বুলাইল হাত ।।
চলিল সবাই তবে জাঙ্গাল উপর ।
হনুমান বলে শুন সকল বানর ।।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেহ কিছু না বলিবে ।
সাবধান হ’য়ে সবে জাঙ্গালে চলিবে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
হনুমান লজ্জিত হয়েছিলেন । তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন এই দুর্বল কাষ্ঠবিড়ালিরা কি আর প্রভুর সেবা করবে। এরা তো নিজেরাই সামর্থ্য হীন । পরে ভাবলেন তিনি ত ভ্রম করেছেন। স্বয়ং প্রভুই তো সৃষ্টি রচনার সময় এদের এইটুকুই শক্তি দিয়েছিলেন । সুতরাং এরা এইটুকু দিয়েই প্রভুর সেবা করবে । তাই তিনি কাষ্ঠবিড়ালীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁদেরকেও প্রভুর সেবার অধিকার দিলেন । কাষ্ঠবিড়ালীরা অতি ক্ষুদ্র হয়েও এই মহৎ কাজে যোগদান করল ।
আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছে, যারা দরিদ্র । অনেকে আছে সহায় সম্বলহীন । কিন্তু তাই বলে তাঁদের যে প্রভুর সেবা করার অধিকার নেই- এমন নয় । এই কাষ্ঠবিড়ালীরা তাঁর প্রমান। ভগবান শ্রীরাম এই নগণ্য জীবগুলিকে সেঁতুবন্ধনের কাজে নিয়ে এসেছিলেন । নগণ্য, ক্ষুদ্র, দরিদ্র যে যেই অবস্থায় থাকুক, সেই অবস্থায় ভগবানের সেবা করা কর্তব্য। “শবরী” অধ্যায়ে সেখানে বিশ্লেষণ হয়েছে । ভগবান মনুষ্য জাতি সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কর্তব্য সেই ঈশ্বরের ভজনা করা । আমরা অনেকেই ভাবি আমি দরিদ্র, আমি নিঃসহায় , আমি ক্ষুদ্র- আমি কি ভগবানের সেবা করবো ? ভগবানের সেবা হয় তো কেবল মন্দিরে। যেখানে ছাপান্নো ব্যাঞ্জন, কত পুস্প, কত সুগন্ধি দ্বারা ভগবানের সেবা হয়। এই ধারনা ভুল । বস্তুত ঈশ্বরের ভজনা যেখানে হয় সেটিই মন্দির । ইট দিয়ে একটি কক্ষ বানানো বানিয়ে যে মন্দির আমরা দেখি, সেটিই যে কেবল ও একমাত্র মন্দির - এমন নয়। গাছতলায় বসেও যদি কেউ ভগবানের সেবা, ভজনা করেন- সেই গাছতলাই মন্দির। অপরদিকে পাকা দালানে যদি ভগবানের সেবা ভজনা না হয়, তবে সেটা কেবল ইঁটের স্তূপ মাত্র । আর যে যেই অবস্থায় থাকে তাঁকে সেই অবস্থায়, সেই ভাবে ঈশ্বরের ভজনা করা উচিৎ। আমাদের মনে খুব একটা ভুল ধারনা আছে যে রাশি রাশি ব্যাঞ্জন ও এলাহী ভাবে ভগবানের পূজা করলেই সেই পূজা সফল হয়- এটা খুব বড় ভুল। এই অজুহাতে অনেক দরিদ্র ব্যক্তি ঈশ্বর ভজনা করেন না। বলেন আমার নিজের নাই, আমি কি ঈশ্বরকে দেবো ? আরে এই জগতে যা কিছু সবই তো ঈশ্বরের সৃষ্টি। আর এলাহী ভাবে পূজো করলেই ভগবান সন্তুষ্ট হয় না। শবরীর প্রদত্ত সামান্য জাম ফলেই ভগবান তৃপ্ত হয়েছিলেন। যে দরিদ্র সে সামান্য বাতাসা দিয়েই ভগবানের সেবা করবে- আর যে ধনী সে যদি সামান্য বাতাসা দিয়ে কার্পণ্য করে, সেটা তার পক্ষে অনুচিত হবে। যাঁর যা সামর্থ্য- সেই ভাবেই ঈশ্বরের ভজনা করা উচিৎ । যাই হোক, দেখতে দেখতে সেঁতু নির্মাণ সমাপ্ত হল। লঙ্কার তট পর্যন্ত শত যোজন সেঁতু তৈরী হল। লঙ্কায় বসে রাবণ গুপ্তচরদের মুখে সব শুনে কেবল দর্পে হাস্য করতে লাগলো ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন