লঙ্কেশ রাবণ অবাক হল হনুমানের কথা শুনে । দশ চোখ কটমট করে বলল – “ মূর্খ কপি! তোর এত সাহস যে লঙ্কারাজ রাবণকে উপদেশ প্রদান করিস ? এখুনি তোকে সমুচিত দণ্ড প্রদান করবো । তোকে শিরোচ্ছেদ করা হবে। তুই আমার আদেশ ভিন্ন লঙ্কায় প্রবেশ করে আমার বাগান লণ্ডভণ্ড করেছিস । আমার আশ্রিত রাক্ষসদের বধ করেছিস । আমার প্রিয় পুত্র অক্ষয়কুমারকে বধ করেছিস।” এই বলে হনুমান এর দিকে লঙ্কেশ দশানন দশমুখ মেলে চেয়ে সেনাদের আদেশ দিলো শীঘ্র একে হত্যা করো । সেখানে বিভীষণ ছিল। সে এসে বলল- “অগ্রজ! এ আপনি কি করছেন ? হনুমান শ্রীরামের দূত । সে দূত রূপে এসে আত্মরক্ষার নিমিত্ত যুদ্ধে জড়িয়েছে। দূতকে হত্যা করা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ।” লঙ্কারাজ রাবণ তখন ক্রোধে বিভীষণকে নানা আকথা কুকথা বলে বলল- “তুমি ভ্রাতা হয়েও লঙ্কার শত্রুদের পক্ষ নিচ্ছো? এই কপি এসে লঙ্কায় কি উপদ্রব করেছে তাকি তুমি অবগত নও ?” বিভীষণ বলল- “দাদা! এই কপির শাস্তি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু দূত রূপে এই কপি লঙ্কায় আগমন করেছে। এমনিতেই আপনি নারী হরণ করে অখ্যাতি ও অপযশ কুড়িয়েছেন। এর উপর দূত হত্যা করলে ত্রিলোকে আরোও কলঙ্ক হবে।” রাবণ ভাবল তাই তো ! দূত রূপে আগত এই কপিকে হত্যা করা উচিৎ না। কিন্তু এই কপিকে মৃত্যুদণ্ডের থেকেও ভয়ানক কিছু শাস্তি দিতে হবে। হঠাত রাবণ ভাবল এর লাঙুল টাই পুড়িয়ে দেই। লাঙুল পুড়লে আর গজাবে না। সারা জীবন এ তখন স্বজাতির কাছে লজ্জিত হয়ে তিলে তিলে যন্ত্রনা ভোগ ক্রবে। রাবণ বলল- “তাই হোক! এই কপিকে প্রাণে মারবো না। বরং এর লাঙুল পুড়িয়ে দাও। এই দুষ্ট কপি আমার সামনে লাঙুল নির্মিত আসনে বসে দর্প প্রকাশ করেছে। এর লাঙুল আগুনে পোড়াও।” সাথে সাথে রাক্ষসেরা হৈহৈ করে হনুমানকে নিয়ে গেলো। লাঙুলে কাঁপড়, ঘৃত, তৈল মাখাতে লাগলো ।
হনুমানের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি! লাঙুল বড় করতে লাগলো । এত বড় করলো যে রাক্ষসেরা যতই কাপড় পেঁচায়, তত কম পড়ে । হাজারে হাজারে রাক্ষস এসে হনুমানের লাঙুলে কাপর পেঁচাতে থাকলো । হনুমানের হাত পা বন্দী, তবুও সে লাঙুল দিয়ে নানা দুষ্টুমি করতে থাকলো। রাক্ষসদের কখনো বেঁধে আছার দিলো, কখনো বা তেলের ভাণ্ড উলটে দিলো। কখনো কাউকে লেজের আঘাতে ফেলে দিলো। হনুমান চুপ করে এই সকল কর্ম করতে থাকলো । লঙ্কার রাক্ষস রাক্ষসীরা হনুমানকে নিয়ে নানা ব্যাঙ্গ করতে থাকলো । এরপর যতটুকু লেজে কাঁপর পেঁচিয়ে ঘৃত, তৈল মর্দন করা হয়েছিলো ততটুকুতেই আগুন দেওয়া হল। সীতাদেবী এই শুনে অগ্নিদেবের কাছে প্রার্থনা করলেন – “হে অগ্নি! যদি আমি মনে প্রাণে সতী হয়ে থাকি, তবে ঐ আগুনে যেনো হনুমানের কোনরূপ ক্ষতি না হয়।” আগুন লাগিয়ে রাক্ষস রাক্ষসীরা অতি বিকট হয়ে হাস্য করতে থাকলো । হনুমান প্রবল জোরে রামনাম নিয়ে এক ঝটকায় বন্দী দশা খুলে ব্রহ্মাস্ত্রের সকল ক্ষমতা বিনষ্ট করলো । তারপর এক লম্ফ দিয়ে রাবণ রাজার প্রাসাদে গেলো। সেখানে নানা আসবাবপত্র , পর্দা , শয্যাতে লেজের আগুন থেকে আগুন ধরিয়ে দিলো। দাউদাউ করে রাবণ রাজার প্রাসাদে আগুন ধরল । এরপর হনুমান রাবণ রাজার নানা কক্ষ তে এক ভাবে গিয়ে চতুর্দিকে আগুন ছড়িয়ে দিলো। অগ্নিদেবতা আর পবন দেবতা উভয়ে মিলে হনুমানকে সাহায্য করলো। যত রাক্ষস প্রহরায় ছিলো বিকট অগ্নিশিখার বলি হল । বাকী রাক্ষসেরা, রাবণের শত রানী, দাস দাসী, সেপাই যে যেদিকে পারলো দৌড়ে পলায়ন করলো । হনুমান রাবণের প্রাসাদে প্রতি কক্ষে আগুন দিলো। মেঘনাদ , মেঘনাদের স্ত্রী সকল পলায়ন করলো। এক কক্ষে হনুমান দেখলো সেখানে নবগ্রহ বন্দী হয়ে আছে। তারা হনুমানের কাছে মুক্তির আবেদন করলো। হনুমান তাহাদিগের মুক্তি দিলেন । নবগ্রহ বর দিলো , বলল- “হনুমান! আমরা কদাপি তোমার ভক্তের অনিষ্ট করবো না। তোমার ভক্তেরা, তোমার পূজারীরা সর্বদা গ্রহপীড়া থেকে মুক্ত থাকবেন। আমরা সদয় হয়ে তাহাদিগের মঙ্গল করবো।” হনুমান নবগ্রহের মুক্তি দিয়ে লঙ্কার অনান্য বাটিটে বহ্নি ছড়িয়েদিলেন । রাবণের অস্ত্রাগার, অশ্ব শালা, হস্তীশালায় অগ্নি দিয়ে অস্ত্র, অশ্ব , হস্তী গুলোকে ভস্ম করলেন। এরপর অগণিত জমায়েত স্বর্ণ রথ কে আগুন ধরিয়ে দিলেন । বিবিধ বাগিচায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দিলেন। লঙ্কার বিজয় স্তম্ভে এমন আঘাত করলেন যে চিড় ধরল ।
এইভাবে হনুমান লঙ্কার প্রতি ঘরে আগুন ছড়িয়ে দিতে লাগলো। রাক্ষসেরা হনুমানকে ধরতে পারলো না। লম্ফ দিয়ে হনুমান পালিয়ে গেলো । সকলে ঘড়া ঘড়া জল দিতে থাকলো। কিন্তু কতটুকু আর নেভে? এক দিকে আগুন নিভলে নয়দিকে জ্বলে উঠে । কে কার প্রাণ বাঁচাবে- তাই চিন্তা। কত রাক্ষস, রাক্ষসী পরিবার সমেত জীবন্ত দগ্ধ হল।
এক ঘরে অগ্নি দিতে আর ঘর জ্বলে ।
কে করে নির্মাণ তার কেবা কারে বলে ।।
অগ্নিতে পুড়িয়া পড়ে বড় ঘরের চাল ।
অর্ধেক স্ত্রী পুরুষের গায়ের গেল ছাল ।।
উলঙ্গ উন্মত্ত কেহ পলায় উভরড়ে ।
লেজে জড়াইয়া ফেলে অগ্নির উপরে।।
ছোট বড় পুড়িয়া মরিল এককালে ।
রাক্ষস মরিল কত স্ত্রী লইয়া কোলে ।।
কেহ বা পুড়িয়া মরে ভার্যা পুত্র ছাড়ি ।
কাহারো মাকুন্দ মুখ দগ্ধ গোঁপদাড়ি ।।
লঙ্কা মধ্যে সরোবর ছিল সারি সারি ।
তাহাতে নামিল যত রাক্ষসের নারী ।।
সুন্দর নারীর মুখ নীরে শোভা করে ।
ফুটিল কমল যেনো সেই সরোবরে ।।
দূরে থাকি দেখে হনুমান মহাবল ।
লেজের অগ্নিতে তার পোড়ায় কুন্তল ।।
সর্বাঙ্গ জলের মধ্যে জাগে মাত্র মুখ ।
অগ্নিতে পোড়ায় মুখ দেখিতে কৌতুক ।।
ত্রাসে ডুব দিল যদি জলের ভিতরে ।
জল পিয়া ফাঁপর হইয়া সবে মরে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
এইভাবে সমস্ত লঙ্কা নগরীতে আগুন দিলো হনুমান । বড় বড় বৃক্ষ গুলি প্রকাণ্ড অগ্নি শিখা ধারন করে জ্বলতে থাকলো। স্বর্ণ লঙ্কাকে দেখে অগ্নিলঙ্কা মনে হচ্ছিল্ল। চারিদিকে কেবল রাক্ষসদের হাহাকার । যে যেদিকে পারছে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কে কার ঘরের আগ্নুন নির্বাপণ করবে? লঙ্কারাজ রাবণ বাগিচার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখলেন তার সুন্দর রাজসভা, শয়ন কক্ষ, অস্ত্রাগাড়, রম্য বারান্দা সকল কিছুই অগ্নি বিশাল জিহ্বা দিয়ে গ্রহণ করছেন । চারপাশে কেবল ভস্ম উড়ছে । আর কুণ্ডলী পাকিয়ে বিশাল সর্পের ন্যায় সেই ধোঁয়া আকাশে উঠছে । রাক্ষসেরা পলায়মান অবস্থায় কেউ কেউ পদদলিত হয়ে মরছিল । কেউ আবার ঝিলে ভীরে পদদলিত হয়ে দম আটকে মরল । হনুমান সমানে সেই লেজের অগ্নি দিয়ে একের পর এক ঘরে আগুন দিচ্ছিল্ল। আকাশ থেকে এই দ্বীপকে দেখলে মনে হয় অগ্নির দ্বীপ ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন