আর্য কোনো জনজাতি ছিল না। আর্য মানে কোনো জাতি নয়, 'ব্যবহারে যে মহান' তাকে আর্য বলা হতো। সাধারণত ক্ষত্রিয় রাজাদের আর্যপুত্র বলে সম্বোধন করা হতো। অনেকে আর্য মানে একটি উচ্চ পদকে বুঝিয়েছেন। ভারতের আদি নাম আর্যাবর্ত। ম্যাক্স মুলার আর্য বলতে ভাষা ভিত্তিক শ্রেণী বুঝিয়েছেন, জনজাতি হিসাবে নয়।
আর্য বলতে জীবন যাপনের শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতিকে বোঝানো হয়েছে, বেশির ভাগ আধুনিক পণ্ডিত এই মতবাদ মেনে নিয়েছেন। তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র আর্যদের বর্ণবিভাগ। 'অন্ত্যযশ' বলে একটি উপজাতিকে আর্য বলা হচ্ছে না কারণ তারা আর্যদের এই জীবন যাপন পদ্ধতি মেনে চলতো না। অথর্ব বেদে অনার্যদের 'ব্রাত্য' বলা হয়েছে। অর্থাৎ যাদের কোনো পুজোর রীতিনীতি ছিল না।
সমগ্র ঋক বেদে 'আর্য' শব্দটি কখনোই একটি জনজাতিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়নি। যদি আর্যরা বিদেশী, আলাদা একটি জনজাতি হতো, তবে তারা নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক আবদ্ধ রাখতো নিজেদের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে। কিন্তু আর্য অনার্যদের মধ্যে বিবাহ খুব সাধারণ ছিল।
বর্ণবিভাগ প্রথায় চারটি বর্ণ ছিল। বর্ণ এখানে জীবিকা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু 'বর্ণ' মানে রঙ, তাই ইউরোপীয় পণ্ডিতরা রঙ অর্থে ব্যবহার করলো। দুটি বর্ণ বা রঙের কথা বলা হলো, সাদা ও কালো। প্রথম তিনটি বর্ণ সাদা ও শেষ বর্ণ কালো হয়ে গেলো। আর ভারতীয়দের আসল রঙ বাদামী অনুল্লিখিত থেকে গেলো। সব কিছু আরোপিত, কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। ঋক বেদে 'অনাস' বলে এক জাতির উল্লেখ আছে। 'অনাস' এর মানে 'নাক নেই' বলে ধরে নেওয়া হয় কারণ আর্যরা 'উন্নত নাসা' ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত 'অনাস' মানে যারা ঠিক ভাবে কথা বলতে পারতো না।
আর্যরা যদি সাদা হতো তবে তাদের উপাস্য বিষ্ণু, কৃষ্ণ কখনো কালো হতেন না। মহাভারতের নায়ক অর্জুন কালো, দ্রৌপদীর আর এক নাম কৃষ্ণা মানে কালো। এই মহাকাব্যের রচয়িতা বেদব্যাস কুরূপ ছিলেন। প্রচলিত আর্য মতবাদ সঠিক হলে তিনি অতি অবশ্যই কোনো সাদা সাহেব হতেন।
খ্রীঃ পূঃ 1500 সালে ইউরোপ থেকে কোনো জনজাতি ভারতে প্রবেশ করেনি। ওই সময় বড় কোনো অভিপ্রয়াণের কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। প্রায় এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগরে স্থানান্তরিত হবার প্রমাণ আছে। সেখান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে তারা। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আনুমানিক 60000 বছর আগে হয় এবং তার পরে আর কোনো জনজাতির অনুপ্রবেশ ভারতে ঘটেনি। আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে এক পৃথক ভারতীয় জনজাতির উন্মেষ ঘটে। নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যাতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে 60000 বছর ধরে ভারতে অন্য কোনো বড় মাপের বহিরাগত জনজাতি আসেনি। নৃতত্ত্ববিদ ডঃ বি এস গুহ প্রাগৈতিহাসিক মানব কঙ্কাল ও আজকের কঙ্কাল গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে ভারতীয় জাতিতে মোট ছয় রকম জাতির মিশ্রন ঘটেছে।
1. Negrito 2. Proto - Australoid 3. Mongoloid 4. Mediterranean 5. Western Brachycephate 6. Nordic
পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে খুব বড় সংখ্যায় মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে ইউরোপে চলে যায়। আর তাই ভাষাগত সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ইউরোপের সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতার অবদান বলা যেতে পারে।
*********************************************
বৈদিক সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী পর্যায়
------------------------------------------------------------------------
আর্যরা যদি বাইরে থেকে না আসে তাহলে এরা কারা? আর কোথা থেকেই বা এলো? আর্যরা কোথাও থেকে আসেনি। বিগত প্রায় 60000 বছর ধরে তারা ভারতীয় উপমহাদেশেই বসবাস করছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তারা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতা তৈরি করেছিল, সেটা হলো সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা।
হরপ্পা সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ বিগত কয়েক বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন কার্যের ফলে পাওয়া গেছে। প্রতিটা শহরের ডিজাইন, প্ল্যানিং, লে আউট সব এক। এক রকম নিকাশী ব্যবস্থা, খাদ্যশস্য ভাণ্ডার, স্নানাগার, বড় বড় প্রাসাদ, সব শহরেই পাওয়া গেছে। খ্রীঃ পূঃ 2600 সালে মেসোপটেমিয়ার সাথে হরপ্পার বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হরপ্পার সীলমোহর, গয়নার যে রকম নমুনা পাওয়া গেছে, একে তাই কোনো বিচ্ছিন্ন সভ্যতা না বলে এক সুশাসিত সাম্রাজ্য বলা উচিত হবে। সাম্রাজ্য অর্থাৎ কোনো কেন্দ্রীয় সংগঠিত শক্তিশালী শাসক ছাড়া এত নিয়ম মেনে সব কিছু করা সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে এমন এক সাম্রাজ্য এক যাযাবর গোষ্ঠীর হঠাৎ আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেলো, সেটা অসম্ভব।
হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংস প্রধানতঃ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হয়েছিল। মহেঞ্জোদারো শহরেই 3 বার ভীষণ বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও মহেঞ্জোদারো অনেক উঁচুতে অবস্থিত ছিল। কিন্তু নীচু জায়গা সব সম্পূর্ণ রূপে জলের তলায় জলে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, আর সেই সব জায়গার খোঁজ এখন পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই পালিয়ে যাওয়া ছাড়া নাগরিকদের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। গুজরাটের লোথাল একটা বড় বন্দর শহর ছিল। জল দিয়ে ঘিরে যেখানে নোঙ্গর ফেলা হতো, আজো একি রকম আছে। বড়সড় কোনো আক্রমণ হলে সব ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো। এখনো পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতার কোনো জায়গায় আক্রমণের কোনো চিহ্ন নেই। কাজেই বন্যা ছাড়া ধ্বংসের অন্য কারণ ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না।
সরস্বতী নদী খুব বিশাল ছিল যা শুকিয়ে যায়। সিন্ধু নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এদের প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। এই সব জায়গার মাটি লবণাক্ত হয়ে যায়। রাজস্থান মরুভূমিতে পরিণত হয়। সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাবার পর মানুষ পূর্বে সরে আসে গঙ্গা যমুনা অববাহিকায়। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় এই সময় পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে আসার। খ্রীঃ পূঃ 1900 এর পরে মেসোপটেমিয়ার সাথে আর কোনো বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় যে শাসন ছিল তা দুর্বল হয়ে যায়। অর্থনীতিও ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ বেকার হয়ে যায়। পরবর্তী কালের হরপ্পা শহরে আগের মত নগর পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়নি। বড় বড় বাড়ির বদলে ছোট ছোট বাড়ি পাওয়া যায়। শিল্পের অবনতি, নিকাশী ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রশাসন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। বড় শহর বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেলো। ছোট শহরে মানুষের ভিড় বেড়ে গেলো। কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব হলো কারণ জমি সব অনুর্বর হয়ে যায় বন্যার জন্য। কাজেই মানুষ উর্বর জমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।
1995 থেকে 98 সালে মেহেরগড়, নৌশারো এবং পিরাকে ব্যাপক খননকার্য চলে। এই জায়গাগুলো প্রমাণ করে যে উন্নত শহুরে হরপ্পা সভ্যতা থেকে কিভাবে গ্রাম্য সভ্যতায় পরিণত হলো। খ্রীঃ পূঃ 1900 থেকে খ্রীঃ পূঃ 1300 সাল এই জন্য পরবর্তী হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়।
নাগরিক মানুষ অবস্থার বিপাকে পড়ে গ্রামীণ হয়ে গেলেও সংস্কৃতি কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় না। রীতিনীতি হারিয়ে যায় না। ধীরে ধীরে শুধু বিবর্তন হয়েছে মাত্র সময়ের সাথে সাথে। হরপ্পা সভ্যতার ওজন ও পরিমাপের পদ্ধতি গুপ্ত যুগেও পাওয়া যায়। বর্তমানে আমরা যে জগ, গরু বা পশু টানা গাড়ির অংশ, চিরুনি ব্যবহার করি, সেগুলো হরপ্পা সভ্যতার সময়েও ব্যবহৃত হতো।
1790 সালে জন প্লেফেয়ার একটি হিসাব কষে বলেন যে হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু খ্রীঃ পূঃ 4300 তে। বৈজ্ঞানিক ভাবে এই তথ্যের বিরোধিতা কেউ করেনি। কিন্তু বেন্টলে যে অযৌক্তিক অবাস্তব কারণ দেখান, সেটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামি। যেহেতু খ্রীঃ পূঃ 4000 এর আগের সময় বাইবেলের সময়পঞ্জী বহির্ভূত, তাই ব্যাখ্যা হলো না।
আসলে ঋক বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে কোনো বহিরাগত আক্রমণকারী আসেনি। বরঞ্চ বলা যায় যে দেশীয় সভ্যতার মৌলিক পুনর্গঠন হয়েছিল মাত্র।
ইউরোপীয় পণ্ডিতরা যে ঋক বেদের রচনাকাল খ্রীঃ পূঃ 1500 ধরেছিলেন, সেটাও কিন্তু গোড়াতেই ভুল হয়েছে। কারণ বেদ 'শ্রুতি'। অর্থাৎ বহু বছর ধরে প্রচলিত এই বেদ যা মানুষ শুনে মনে রেখে এসেছে। সেক্ষেত্রে কথ্য ভাষার পরিবর্তন হলেও শ্রুতি কিন্তু অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনা বেশী। অনেকে হরপ্পা সভ্যতার সাথে যজুর্বেদের মিল খুঁজে পেয়েছেন। আর ঋক বেদ হয়তো তার আগের সভ্যতায় তৈরি হয়েছিল, যখন সরস্বতী নদী প্রধান নদী ছিল।
আর ঠিক এখানেই শুরু হলো সব সমস্যার সূত্রপাত। কারণ ঋক বেদ ও অন্যান্য বৈদিক সাহিত্য পড়লে বোঝা যায় যে ভারতীয় সভ্যতা কতটা প্রাচীন। ভারতীয় সভ্যতা আসলে পৃথিবীর অন্যতম প সভ্যতা। ইউরোপীয় সভ্যতা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ভারতীয় সভ্যতার কাছে নিতান্তই শিশু হয়ে গেলো। কাজেই শুরু হলো কাটাছেঁড়া। অবৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলো বৈদিক সভ্যতা ইউরোপীয় সভ্যতার অবদান। ভারতীয় ভাষা ইউরোপীয় ভাষা থেকে সৃষ্ট। ভারতীয় বিজ্ঞান, দর্শন গ্রীসের বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আমরা, ভারতীয়রা এই তত্ত্ব আজো বিশ্বাস করি। আজো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস পড়ানো হয়, তাদের অনুবাদ করা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হয়।
ভারতবর্ষ আজো তাদের ইতিহাসে ইউরোপের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করেনি। দয়ানন্দ সরস্বতী, ঋষি অরবিন্দ বা বাল গঙ্গাধর তিলকের মত হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া সেই সময় এর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। আজো আসমুদ্রহিমাচল মনে করে যে আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী এবং তারা ইউরোপীয় বংশধর। এখনো খ্রীস্টান মিশনারীদের করা বেদের অনুবাদের উপর নির্ভর করে আমরা কথা বলি যেমন ম্যাক্স মুলার, গ্রিফিথ, মনিয়ের উইলিয়ামস, এইচ এইচ উইলসন ইত্যাদি। আজ যদি আমরা বাইবেলের অনুবাদ করে তার ইতিহাস নিজেদের মত করে বোঝাতে যাই, খ্রীস্টানরা মেনে নেবে কি?? আসলে উপমহাদেশের হিন্দুরা হিন্দু ব্যতীত সবাইকে বিশ্বাস করে এসেছে। আর নিজেদের নিম্ন মানের ভেবে ঘৃণা করে এসেছে। পরিণতি ভোগ তো করতেই হবে যতক্ষণ না স্বীয় চেষ্টায় মহিমান্বিত হয়ে সদর্পে নিজের আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।
সোর্সসমূহ :
1. T. Kivisild et. al, Current Biology, Vol 9, No 22, pp 133-134
2. Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, by Jonathan Mark Kenoyer, Oxford University Press, Karachi/American Institute of Pakistan Studies, 1998.
3. Myth of the Aryan Invasion of India by David Frawley
4. Koenaard Elst
5. Indian Gods and Kings, the story of a living past by Emma Hawkridge, Houghton Miffin Company 1935
6. Concise History of the World, An Illustrated Time Line by National Geographic
7. Racial Elements in the Population by DrB S Guha.
https://www.istishon.com/?q=node%2F23877
আর্য বলতে জীবন যাপনের শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতিকে বোঝানো হয়েছে, বেশির ভাগ আধুনিক পণ্ডিত এই মতবাদ মেনে নিয়েছেন। তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র আর্যদের বর্ণবিভাগ। 'অন্ত্যযশ' বলে একটি উপজাতিকে আর্য বলা হচ্ছে না কারণ তারা আর্যদের এই জীবন যাপন পদ্ধতি মেনে চলতো না। অথর্ব বেদে অনার্যদের 'ব্রাত্য' বলা হয়েছে। অর্থাৎ যাদের কোনো পুজোর রীতিনীতি ছিল না।
সমগ্র ঋক বেদে 'আর্য' শব্দটি কখনোই একটি জনজাতিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়নি। যদি আর্যরা বিদেশী, আলাদা একটি জনজাতি হতো, তবে তারা নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক আবদ্ধ রাখতো নিজেদের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে। কিন্তু আর্য অনার্যদের মধ্যে বিবাহ খুব সাধারণ ছিল।
বর্ণবিভাগ প্রথায় চারটি বর্ণ ছিল। বর্ণ এখানে জীবিকা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু 'বর্ণ' মানে রঙ, তাই ইউরোপীয় পণ্ডিতরা রঙ অর্থে ব্যবহার করলো। দুটি বর্ণ বা রঙের কথা বলা হলো, সাদা ও কালো। প্রথম তিনটি বর্ণ সাদা ও শেষ বর্ণ কালো হয়ে গেলো। আর ভারতীয়দের আসল রঙ বাদামী অনুল্লিখিত থেকে গেলো। সব কিছু আরোপিত, কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। ঋক বেদে 'অনাস' বলে এক জাতির উল্লেখ আছে। 'অনাস' এর মানে 'নাক নেই' বলে ধরে নেওয়া হয় কারণ আর্যরা 'উন্নত নাসা' ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত 'অনাস' মানে যারা ঠিক ভাবে কথা বলতে পারতো না।
আর্যরা যদি সাদা হতো তবে তাদের উপাস্য বিষ্ণু, কৃষ্ণ কখনো কালো হতেন না। মহাভারতের নায়ক অর্জুন কালো, দ্রৌপদীর আর এক নাম কৃষ্ণা মানে কালো। এই মহাকাব্যের রচয়িতা বেদব্যাস কুরূপ ছিলেন। প্রচলিত আর্য মতবাদ সঠিক হলে তিনি অতি অবশ্যই কোনো সাদা সাহেব হতেন।
খ্রীঃ পূঃ 1500 সালে ইউরোপ থেকে কোনো জনজাতি ভারতে প্রবেশ করেনি। ওই সময় বড় কোনো অভিপ্রয়াণের কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। প্রায় এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগরে স্থানান্তরিত হবার প্রমাণ আছে। সেখান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে তারা। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আনুমানিক 60000 বছর আগে হয় এবং তার পরে আর কোনো জনজাতির অনুপ্রবেশ ভারতে ঘটেনি। আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে এক পৃথক ভারতীয় জনজাতির উন্মেষ ঘটে। নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যাতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে 60000 বছর ধরে ভারতে অন্য কোনো বড় মাপের বহিরাগত জনজাতি আসেনি। নৃতত্ত্ববিদ ডঃ বি এস গুহ প্রাগৈতিহাসিক মানব কঙ্কাল ও আজকের কঙ্কাল গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে ভারতীয় জাতিতে মোট ছয় রকম জাতির মিশ্রন ঘটেছে।
1. Negrito 2. Proto - Australoid 3. Mongoloid 4. Mediterranean 5. Western Brachycephate 6. Nordic
পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে খুব বড় সংখ্যায় মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে ইউরোপে চলে যায়। আর তাই ভাষাগত সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ইউরোপের সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতার অবদান বলা যেতে পারে।
*********************************************
বৈদিক সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী পর্যায়
------------------------------------------------------------------------
আর্যরা যদি বাইরে থেকে না আসে তাহলে এরা কারা? আর কোথা থেকেই বা এলো? আর্যরা কোথাও থেকে আসেনি। বিগত প্রায় 60000 বছর ধরে তারা ভারতীয় উপমহাদেশেই বসবাস করছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তারা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতা তৈরি করেছিল, সেটা হলো সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা।
হরপ্পা সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ বিগত কয়েক বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন কার্যের ফলে পাওয়া গেছে। প্রতিটা শহরের ডিজাইন, প্ল্যানিং, লে আউট সব এক। এক রকম নিকাশী ব্যবস্থা, খাদ্যশস্য ভাণ্ডার, স্নানাগার, বড় বড় প্রাসাদ, সব শহরেই পাওয়া গেছে। খ্রীঃ পূঃ 2600 সালে মেসোপটেমিয়ার সাথে হরপ্পার বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হরপ্পার সীলমোহর, গয়নার যে রকম নমুনা পাওয়া গেছে, একে তাই কোনো বিচ্ছিন্ন সভ্যতা না বলে এক সুশাসিত সাম্রাজ্য বলা উচিত হবে। সাম্রাজ্য অর্থাৎ কোনো কেন্দ্রীয় সংগঠিত শক্তিশালী শাসক ছাড়া এত নিয়ম মেনে সব কিছু করা সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে এমন এক সাম্রাজ্য এক যাযাবর গোষ্ঠীর হঠাৎ আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেলো, সেটা অসম্ভব।
হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংস প্রধানতঃ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হয়েছিল। মহেঞ্জোদারো শহরেই 3 বার ভীষণ বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও মহেঞ্জোদারো অনেক উঁচুতে অবস্থিত ছিল। কিন্তু নীচু জায়গা সব সম্পূর্ণ রূপে জলের তলায় জলে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, আর সেই সব জায়গার খোঁজ এখন পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই পালিয়ে যাওয়া ছাড়া নাগরিকদের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। গুজরাটের লোথাল একটা বড় বন্দর শহর ছিল। জল দিয়ে ঘিরে যেখানে নোঙ্গর ফেলা হতো, আজো একি রকম আছে। বড়সড় কোনো আক্রমণ হলে সব ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো। এখনো পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতার কোনো জায়গায় আক্রমণের কোনো চিহ্ন নেই। কাজেই বন্যা ছাড়া ধ্বংসের অন্য কারণ ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না।
সরস্বতী নদী খুব বিশাল ছিল যা শুকিয়ে যায়। সিন্ধু নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এদের প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। এই সব জায়গার মাটি লবণাক্ত হয়ে যায়। রাজস্থান মরুভূমিতে পরিণত হয়। সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাবার পর মানুষ পূর্বে সরে আসে গঙ্গা যমুনা অববাহিকায়। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় এই সময় পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে আসার। খ্রীঃ পূঃ 1900 এর পরে মেসোপটেমিয়ার সাথে আর কোনো বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় যে শাসন ছিল তা দুর্বল হয়ে যায়। অর্থনীতিও ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ বেকার হয়ে যায়। পরবর্তী কালের হরপ্পা শহরে আগের মত নগর পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়নি। বড় বড় বাড়ির বদলে ছোট ছোট বাড়ি পাওয়া যায়। শিল্পের অবনতি, নিকাশী ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রশাসন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। বড় শহর বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেলো। ছোট শহরে মানুষের ভিড় বেড়ে গেলো। কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব হলো কারণ জমি সব অনুর্বর হয়ে যায় বন্যার জন্য। কাজেই মানুষ উর্বর জমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।
1995 থেকে 98 সালে মেহেরগড়, নৌশারো এবং পিরাকে ব্যাপক খননকার্য চলে। এই জায়গাগুলো প্রমাণ করে যে উন্নত শহুরে হরপ্পা সভ্যতা থেকে কিভাবে গ্রাম্য সভ্যতায় পরিণত হলো। খ্রীঃ পূঃ 1900 থেকে খ্রীঃ পূঃ 1300 সাল এই জন্য পরবর্তী হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়।
নাগরিক মানুষ অবস্থার বিপাকে পড়ে গ্রামীণ হয়ে গেলেও সংস্কৃতি কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় না। রীতিনীতি হারিয়ে যায় না। ধীরে ধীরে শুধু বিবর্তন হয়েছে মাত্র সময়ের সাথে সাথে। হরপ্পা সভ্যতার ওজন ও পরিমাপের পদ্ধতি গুপ্ত যুগেও পাওয়া যায়। বর্তমানে আমরা যে জগ, গরু বা পশু টানা গাড়ির অংশ, চিরুনি ব্যবহার করি, সেগুলো হরপ্পা সভ্যতার সময়েও ব্যবহৃত হতো।
1790 সালে জন প্লেফেয়ার একটি হিসাব কষে বলেন যে হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু খ্রীঃ পূঃ 4300 তে। বৈজ্ঞানিক ভাবে এই তথ্যের বিরোধিতা কেউ করেনি। কিন্তু বেন্টলে যে অযৌক্তিক অবাস্তব কারণ দেখান, সেটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামি। যেহেতু খ্রীঃ পূঃ 4000 এর আগের সময় বাইবেলের সময়পঞ্জী বহির্ভূত, তাই ব্যাখ্যা হলো না।
আসলে ঋক বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে কোনো বহিরাগত আক্রমণকারী আসেনি। বরঞ্চ বলা যায় যে দেশীয় সভ্যতার মৌলিক পুনর্গঠন হয়েছিল মাত্র।
ইউরোপীয় পণ্ডিতরা যে ঋক বেদের রচনাকাল খ্রীঃ পূঃ 1500 ধরেছিলেন, সেটাও কিন্তু গোড়াতেই ভুল হয়েছে। কারণ বেদ 'শ্রুতি'। অর্থাৎ বহু বছর ধরে প্রচলিত এই বেদ যা মানুষ শুনে মনে রেখে এসেছে। সেক্ষেত্রে কথ্য ভাষার পরিবর্তন হলেও শ্রুতি কিন্তু অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনা বেশী। অনেকে হরপ্পা সভ্যতার সাথে যজুর্বেদের মিল খুঁজে পেয়েছেন। আর ঋক বেদ হয়তো তার আগের সভ্যতায় তৈরি হয়েছিল, যখন সরস্বতী নদী প্রধান নদী ছিল।
আর ঠিক এখানেই শুরু হলো সব সমস্যার সূত্রপাত। কারণ ঋক বেদ ও অন্যান্য বৈদিক সাহিত্য পড়লে বোঝা যায় যে ভারতীয় সভ্যতা কতটা প্রাচীন। ভারতীয় সভ্যতা আসলে পৃথিবীর অন্যতম প সভ্যতা। ইউরোপীয় সভ্যতা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ভারতীয় সভ্যতার কাছে নিতান্তই শিশু হয়ে গেলো। কাজেই শুরু হলো কাটাছেঁড়া। অবৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলো বৈদিক সভ্যতা ইউরোপীয় সভ্যতার অবদান। ভারতীয় ভাষা ইউরোপীয় ভাষা থেকে সৃষ্ট। ভারতীয় বিজ্ঞান, দর্শন গ্রীসের বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আমরা, ভারতীয়রা এই তত্ত্ব আজো বিশ্বাস করি। আজো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস পড়ানো হয়, তাদের অনুবাদ করা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হয়।
ভারতবর্ষ আজো তাদের ইতিহাসে ইউরোপের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করেনি। দয়ানন্দ সরস্বতী, ঋষি অরবিন্দ বা বাল গঙ্গাধর তিলকের মত হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া সেই সময় এর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। আজো আসমুদ্রহিমাচল মনে করে যে আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী এবং তারা ইউরোপীয় বংশধর। এখনো খ্রীস্টান মিশনারীদের করা বেদের অনুবাদের উপর নির্ভর করে আমরা কথা বলি যেমন ম্যাক্স মুলার, গ্রিফিথ, মনিয়ের উইলিয়ামস, এইচ এইচ উইলসন ইত্যাদি। আজ যদি আমরা বাইবেলের অনুবাদ করে তার ইতিহাস নিজেদের মত করে বোঝাতে যাই, খ্রীস্টানরা মেনে নেবে কি?? আসলে উপমহাদেশের হিন্দুরা হিন্দু ব্যতীত সবাইকে বিশ্বাস করে এসেছে। আর নিজেদের নিম্ন মানের ভেবে ঘৃণা করে এসেছে। পরিণতি ভোগ তো করতেই হবে যতক্ষণ না স্বীয় চেষ্টায় মহিমান্বিত হয়ে সদর্পে নিজের আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।
সোর্সসমূহ :
1. T. Kivisild et. al, Current Biology, Vol 9, No 22, pp 133-134
2. Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, by Jonathan Mark Kenoyer, Oxford University Press, Karachi/American Institute of Pakistan Studies, 1998.
3. Myth of the Aryan Invasion of India by David Frawley
4. Koenaard Elst
5. Indian Gods and Kings, the story of a living past by Emma Hawkridge, Houghton Miffin Company 1935
6. Concise History of the World, An Illustrated Time Line by National Geographic
7. Racial Elements in the Population by DrB S Guha.
https://www.istishon.com/?q=node%2F23877
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন