২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

দ্বাদশ অধ্যায়ঃ ভক্তিযোগ

                                                      ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়

অর্জ্জুন উবাচ -


এবং সততযুক্তা যে ভক্তাস্ত্বাং পর্য্যুপাসতে।
যে চাপ্যক্ষরমব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমাঃ।।১


অর্থঃ- (১) অর্জ্জুন বলিলেন – সতত ত্বদ্‌গতচিত্ত হইয়া যে সকল ভক্ত তোমার উপাসনা করেন এবং যাঁহারা অব্যক্ত অক্ষরের উপাসনা করেন, এই উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে?


“এবং” – এইরূপে অর্থাৎ দশম অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে যে নিস্কাম কর্ম্মযুক্ত ভক্তির সাধন উক্ত হইয়াছে, তাহাই লক্ষ্য করা হইয়াছে। এইরূপ সগুণ ঈশ্বরের উপাসক এবং নির্গুণ ব্রহ্মোপাসক; ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে, ইহাইঅর্জ্জুনের প্রশ্ন।

শ্রীভগবানুবাচ -

ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুক্তা উপাসতে।
শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।।২


অর্থঃ- (২) শ্রীভগবান্‌ কহিলেন, - যাঁহারা আমাতে মন নিবিষ্ট করিয়া নিত্যযুক্ত হইয়া পরম শ্রদ্ধা সহকারে আমার উপাসনা করেন, তাঁহারাই আমার মতে যুক্ততম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সাধক।


এই শ্লোকে স্পষ্টই বলা হইল যে ব্যক্তোপাসনা বা ভক্তিমার্গই শ্রেষ্ঠ। তবে জ্ঞানমার্গে নির্গুণ ব্রহ্মোপাসনা কি নিস্ফল? না, তা নয়। জ্ঞানমার্গে ব্রহ্মোপাসনা দ্বারাও তাঁহাকে পাওয়া যায়।

যেত্বক্ষরমনির্দ্দেশ্যমব্যক্তং পর্য্যুপাসতে।
সর্ব্বত্রগমচিন্ত্যঞ্চ কূটস্থমচলং ধ্রুবম্।।৩
সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সর্ব্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ।
তে প্রাপ্নুবন্তি মামেব সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ।।৪


অর্থঃ- (৩-৪) কিন্তু যাহারা সর্ব্বত্র সমবুদ্ধিযুক্ত এবং সর্ব্বপ্রাণীর হিতপরায়ণ হইয়া ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহৃত করিয়াসেই অনির্দ্দেশ্য,অব্যক্ত, সর্ব্বব্যাপী, অচিন্ত্যা, কূটস্থ, অচল, ধ্রুব, অক্ষর বরহ্মের উপাসনা করেন, তাহারাও আমাকেই প্রাপ্ত হন।

ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্।
অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।।৫


অর্থঃ- (৫) অব্যক্ত নির্গুণব্রহ্মে আসক্তচিত্ত সেই সাধকগণের সিদ্ধি লাভে অধিকতর ক্লেশ হয়; কারণ, দেহধারিগণ অতি কষ্টে নির্গুণ ব্রহ্মবিষয়ক নিষ্ঠা লাভ করিয়া থাকেন।


দেহধারিগণের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মবিষয়ক নিষ্ঠা লাভ করা অতি কষ্টকর। কারণ, দেহাত্মবোধ বিদূরিত না হইলে নির্গুণ ভাবে স্থিতিলাভ করা যায় না।

যে তু সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরাঃ।
অনন্যেনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে।।৬
তেষামহং মনুদ্ধর্ত্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ।
ভবামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম্।।৭


অর্থঃ- (৬-৭) কিন্তু যাহারা সমস্ত কর্ম্ম আমাতে অর্পণ করিয়া, একমাত্র আমাতেই চিত্ত একাগ্র করিয়া, ধ্যাননিরত হইয়া আমার উপাসনা করেন, হে পার্থ, আমাতে সমর্পিতচিত্ত সেই ভক্তগণকে আমি অচিরাৎ সংসারসাগর হইতে উদ্ধার করিয়া থাকি।
কিন্তু আমার ভক্তগণ আমার উপাসনা করিলে আমার প্রসাদে নায়াসেনিদ্ধিলাভ কদুইটা কথা উল্লেখযোগ্য - (১) সর্ব্বকর্ম্ম আমাতে সমর্পন। (২) অনন্যভক্তি যোগে আমার উপাসনা। সুতরাং ভক্তিমার্গেও কর্ম্মত্যাগের কোন প্রয়োজন নাই। ঈশ্বরে সর্ব্বকর্ম্ম সমর্পণের উপদেশ হইতে বরং ইহাই বুঝা যায় যে ভক্তিমার্গেও নিস্কাম ভাবে কর্ম্ম করাই কর্ত্তব্য।

ময্যেব মন আধৎস্ব ময়ি বুদ্ধিং নিবেশয়।
নিবসিষ্যসি ময্যেব অত ঊর্দ্ধং ন সংশয়।।৮


অর্থঃ- (৮) আমাতেই মন স্থাপন কর, আমাতে বুদ্ধি নিবিষ্ট কর, তাহা হইলে দেহান্তে আমাতেই স্থিতি করিবে, ইহাতে সন্দেহ নাই।

অথ চিত্তং সমাধাতুং ন শক্নোষি ময়ি স্থিরম্।
অভ্যাসযোগেন ততো মামুচ্ছাপ্তুওং ধনঞ্জয়।।৯


অর্থঃ- (৯) হে ধনঞ্জয়, যদি আমাতে চিত্ত স্থির রাখিতে না পার,তাহা হইলে পুনঃপুনঃ আভ্যাসদ্বারা চিত্তকে সমাহিত করিয়া আমাকে পাইতে চেষ্টা কর।

অভ্যাসেহপ্যসমর্থোহসি মৎকর্ম্মপরমো ভব।
মদর্থমপি কর্ম্মাণি কুর্ব্বন্ সিদ্ধিমবাপ্স্যসি।।১০


অর্থঃ- (১০) যদি অভ্যাসেও অসমর্থ হও, তবে মৎকর্ম্মপরায়ণ হও (অর্থাৎ শ্রবণ, কীর্ত্তন, পূজাপাঠ ইত্যাদি কর্ম্মের অনুষ্ঠান কর); আমার প্রীতি সাধনার্থ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলেও তুমি সিদ্ধি লাভ করিবে।

অথৈতদপ্যশক্তোহসি কর্ত্তুং মদ্ যোগমাশ্রিতঃ।
সর্ব্বকর্ম্মফলত্যাগং ততঃ কুরু যতাত্মবান্।।১১


অর্থঃ- (১১) যদি ইহাতেও অশক্ত হও, তাহা হইলে মদ্‌যোগ অর্থাৎ আমাতে কর্ম্মার্পণরূপ যোগ আশ্রয় করিয়া সংযতাত্মা হইয়া সমস্ত কর্ম্মের ফল ত্যাগ কর।

শ্রেয়োহি জ্ঞানমভ্যাসাজ্ জ্ঞানাদ্ধ্যানং বিশিষ্যতে।
ধানাৎ কর্ম্মফলত্যাগস্ত্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্।।১২


অর্থঃ- (১২) অভ্যাস অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, জ্ঞান অপেক্ষা ধ্যানশ্রেষ্ঠ। ধ্যান অপেক্ষা কর্ম্মফলত্যাগ শ্রেষ্ঠ। এইরূপ ত্যাগের পরই শান্তি লাভ হইয়া থাকে।

অদ্বেষ্টা সর্ব্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এবচ।
নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।১৩
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।।১৪


অর্থঃ- (১৩-১৪) যিনি কাহাকেও দ্বেষ করেন না; যিনি সকলের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন ও দয়াবান্‌; যিনি সমত্ববুদ্ধি ও অহঙ্কারবর্জ্জিত, যিনি সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন, সদা সন্তুষ্ট, সমাহিতচিত্ত, সংযত-স্বভাব, দৃঢ়বিশ্বাসী, যাহার মন বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, ঈদৃশ মদ্ভক্ত আমার প্রিয়।

যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ।
হর্ষামর্ষভয়োদ্ বেগৈর্ম্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ।।১৫


অর্থঃ- (১৫) যাহা হইতে কোন প্রাণী উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না এবং যিনি স্বয়ংও কোন প্রাণি-কর্ত্তৃক উত্যক্ত হন না এবং যিনি হর্ষ, অমর্ষ, ভয় ও উদ্বেগ হইতে মুক্ত, তিনি আমার প্রিয়।

অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ।
সর্ব্বারম্ভপরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।।১৬


অর্থঃ- (১৬) যিনি সর্ব্ব বিষয়ে নিঃস্পৃহ, শৌচসম্পন্ন, কর্ত্তব্যকর্ম্মে অনলস, পক্ষপাতশূন্য, যাহাকে কিছুতেই মনঃপীড়া দিতে পারে না এবং ফল কামনা করিয়া যিনি কোন কর্ম্ম আরম্ভ করেন না, এতাদৃশ ভক্ত আমার প্রিয়।

যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।
শুভাশুভপরিত্যাগী ভক্তিমান্ যঃ স যে প্রিয়ঃ।।১৭


অর্থঃ- (১৭) যিনি ইষ্টলাভে হৃষ্ট হন না, অপ্রাপ্যবস্তুলাভে আকাঙ্ক্ষা করেন না, যিনি কর্ম্মের শুভাশুভ ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়াছেন, ঈদৃশ ভক্তিমান্‌ সাধক আমার প্রিয়।

সমঃ শতৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ।
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জ্জিতঃ।।১৮
তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনী সন্তুষ্টো যেন কেনতিৎ।
অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান্ মে প্রিয়ো নরঃ।।১৯


অর্থঃ- (১৮-১৯) যিনি শত্রু-মিত্রে, মান-অপমানে, শীত-উষ্ণে, সুখ-দুঃখে সমত্ববুদ্ধিসম্পন্ন, যিনি সর্ব্ববিষয়ে আসক্তিবর্জ্জিত, স্তুতি বা নিন্দাতে যাঁহার তুল্য জ্ঞান, যিনি সংযতবাক্‌, যদ্দৃচ্ছালাভে সন্তুষ্ট, গৃহাদিতে মমত্ববুদ্ধিবর্জ্জিত, এবং স্থিরচিত্ত, ঈদৃশ ভক্তিমান্‌ ব্যক্তি আমার প্রিয়।


যে তু ধর্ম্মামৃতমিদং যথোক্তং পর্য্যুপাসতে।
শ্রদ্দধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেহতীব মে প্রিয়াঃ।।২০


অর্থঃ- (২০) যাঁহারা শ্রদ্ধাবান্‌ ও মৎপরায়ণ হইয়া পূর্ব্বোক্ত অমৃততুল্য ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন, সেই সকল ভক্তিমান্‌ আমার অতীব প্রিয়।


ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসুপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে ভক্তিযোগো নাম দ্বাদশোহধ্যায়ঃ।।




ভিডিও গীতা কীর্তনঃ https://www.youtube.com/watch?v=RXA7CUJtcs0


সংগৃহীতঃhttp://geetabangla.blogspot.com/
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।