ওঁ তৎ সৎ
শ্রীভগবান্ উবাচ
অভয়ম্ সত্ত্বসংশুদ্ধিঃ-জ্ঞান-যোগ-ব্যবস্থিতিঃ।
দানম্ দমঃ-চ যজ্ঞঃ-চ স্বাধ্যায়ঃ-তপ আর্জবম্।।১।।
অহিংসা সত্যম্-অক্রোধঃ-ত্যাগঃ শান্তিঃ-অপৈশুনম্।
দয়া ভূতেষু-অলোলুপ্ত্বম্ মার্দবম্ হ্রীঃ-অচাপলম্।। ২।।
তেজঃ ক্ষমা ধৃতিঃ শৌচম্-অদ্রোহঃ ন-অতিমানিতা।
ভবন্তি সম্পদম্ দৈবীম্-অভিজাতস্য ভারত।।৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন-হে ভারত! ভয়শূন্যতা, সত্তার পবিত্রতা, পারমার্থিক জ্ঞানের অনুশীলন, দান , আত্মসংযম,যজ্ঞ অনুষ্ঠান, বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন, তপশ্চর্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্যবাদিতা, ক্রোধশূন্যতা, বৈরাগ্য,শান্তি, অন্যের দোষ দর্শন না করা, সমস্ত জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা, লজ্জা,অচপলতা, তেজ, ক্ষমা, ধৈর্য, শৌচ, মাৎসর্য শূন্যতা, অভিমান শূন্যতা -- এই সমস্ত গুণগুলি দিব্যভাব সমন্বিত ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।
তাৎপর্যঃ পঞ্চদশ অধ্যায়ের শুরুতেই অশ্বত্থ বৃক্ষবৎ এই জড় জগতের বর্ণনা করা হয়েছে। তার শাখামূলগুলিকে জীবের মঙ্গলজনক ও অমঙ্গলজনক বিভিন্ন কর্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। নবম অধ্যায়ে দেব ও অসুরদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বৈদিক রীতি অনুসারে সাত্ত্বিক কর্মকে মুক্তিপ্রদ, মঙ্গলজনক কর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রকার কার্যকলাপকে দৈবী প্রকৃতি বলে অভিহিত করা হয়। যারা দৈবী প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত, তারা মুক্তির পথে অগ্রসর হন। পক্ষান্তরে, যারা রাজসিক ও তামসিক কর্ম করছে, তাদের পক্ষে মুক্তি লাভের কোন সম্ভবনা নেই। তারা হয় এই জড় জগতে মনুষ্যরূপে অবস্থান করবে, নয়তো অধোগামী হয়ে পশুজীবন বা আরও নিম্নতর জীবন লাভ করবে। এই ষোড়শ অধ্যায়ে ভগবান দৈবী প্রকৃতি, তার গুণাবলী এবং আসুরিক প্রবৃত্তি ও তার গুণাবলীর বর্ণনা করা করেছেন। এই সমস্ত গুণের সুবিধা ও অসুবিধার কথাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।
অভিজাতস্য শব্দটি যার এখানে অনুবাদ হচ্ছে দিব্যগুণে যার জন্ম হয়েছে, তার উল্লেখ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দিব্য পরিবেশে সন্তান উৎপাদনের পন্থা বৈদিক শাস্ত্রে ' গর্ভাধান সংস্কার' নামে পরিচিত। পিতামাতা যদি দিব্যগুণ সম্বনিত সন্তান কামনা করেন, তা হলে তাঁদের মানব- জীবনের জন্য অনুমোদিত দশটি নিয়ম মেনে চলতে হবে। ভগবদ্ গীতাতে আমরা আগেই পড়েছি যে, সুসন্তান লাভের জন্য স্ত্রী-পুরুষের যে যৌন মিলন, তা শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। স্ত্রী -পুরুষের যৌন মিলন যদি কৃষ্ণভাবনাময় হয়, তা হলে তা নিন্দনীয় নয়। যাঁরা কৃষ্ণভাবনাময়, তাঁদের অন্তত কুকুর-বেড়ালের মতো সন্তান উৎপাদন না করে এমন সন্তান উৎপাদন করা উচিত, জন্মের পরে যারা কৃষ্ণভাবনাময় হবে। সেটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় নিমগ্ন পিতা-মাতার সন্তানরূপে জন্ম গ্রহণ করার সৌভাগ্য।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দৈবী সম্পৎ বিমোক্ষায় নিবন্ধায়-আসুরী মতা।
মা শুচঃ সম্পদম্ দৈবীম্-অভিজাতঃ-অসি পাণ্ডব।।৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- দৈবী সম্পদ মুক্তির অনুকূল, আর আসুরিক সম্পদ বন্ধনের কারণ বলে বিবেচিত হয়। হে পাণ্ডুপুত্র! তুমি শোক করো না,
কেন না তুমি দৈবী সম্পদ সহ জন্মগ্রহণ করেছ।
তাৎপর্যঃ আসুরিক গুণে যে অর্জুনের জন্ম হয়নি, সেই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে এখানে উৎসাহিত করছেন। সেই যুদ্ধে তাঁর জড়িয়ে পড়ার কারণ আসুরিক ছিল না। কারণ, তিনি স্বপক্ষ ও বিপক্ষ যুক্তিগুলির বিবেচনা করে দেখছিলেন। তিনি বিবেচনা করছিলেন,ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো সম্মানীয় পুরুষদের হত্যা করা ঠিক হবে কি না। সুতরাং তিনি ক্রোধ, দম্ভ অথবা নিষ্ঠুরতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কর্ম করছিলেন না। তাই, তিনি আসুরিক গুণসম্পন্ন ছিলেন না। শত্রুর উদ্দেশ্যে বাণ নিক্ষেপ করা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এবং তার এই কর্ম থেকে নিরস্ত হওয়াকে আসুরিক বলে মনে করা হবে। সুতরাং, অর্জুনের শোক করার কোনই কারণ ছিল না। যিনি জীবনের বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রমোচিত আচরণ করেন, তিনি দিব্যস্তরে অধিষ্ঠিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকে-অস্মিন্ দৈবঃ আসুরঃ ত্রব চ।
দৈবঃ বিস্তরশঃ প্রোক্তঃ আসুরম্ পার্থ মে শৃণু।।৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! এই সংসারে দৈব ও আসুরিক -- এই দুই প্রকার জীব সৃষ্টি হয়েছে। দৈব সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এখন আমার থেকে অসুর প্রকৃতি সম্বন্ধে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ অর্জুন যে দিব্যগুণে জন্মগ্রহণ করেছেন , সেই আশ্বাস দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এখানে আসুরিক পন্থার বর্ণনা করেছেন। এই জগতের বদ্ধ জীবদের দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যাঁরা দিব্যগুণে জন্মগ্রহণ করেছেন , তাঁরা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন, অর্থাৎ তাঁরা শাস্ত্র এবং সাধু, গুরু ও বৈষ্ণবের নির্দেশ মেনে চলেন। প্রামান্য শাস্ত্রের আলোকে কর্তব্য অনুষ্ঠান করা উচিত। এই মনোবৃত্তিকে বলা হয় দিব্য। যারা শাস্ত্র নির্দেশিত বিধি-নিষেধের অনুসরণ না করে তাদের নিজেদের খেয়ালখুশি মতো আচরণ করে, তাদের বলা হয় আসুরিক। শাস্ত্রের বিধি-নিষেধের প্রতি অনুগত হওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেবতা ও অসুর উভয়ের জন্ম হয় প্রজাপতি থেকে। তাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে, দেবতারা বৈদিক নির্দেশ মেনে চলেন এবং অসুরেরা তা মানে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
প্রবৃত্তিম্ চ নিবৃত্তিম্ চ জনাঃ ন বিদুঃ-আসুরাঃ।
ন শৌচম্ ন-অপি চ-আচারঃ ন সত্যম্ তেষু বিদ্যতে।।৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা ধর্ম বিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অর্ধম বিষয় থেকে নিবৃত্ত হতে জানে না। তাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার ও সভ্যতা বিদ্যমান নেই।
তাৎপর্যঃ প্রতিটি সভ্য মানব- সমাজে কতকগুলি শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন আছে, যেগুলি প্রথম থেকেই মেনে চলা হয়। বিশেষ করে আর্যদের, যারা বৈদিক সভ্যতাকে গ্রহণ করেছে এবং যারা সভ্য মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত বলে পরিচিত। তাদের মধ্যে যারা শাস্ত্রের নির্দেশ মানে না, তাদের অসুর বলে গণ্য করা হয়। তাই এখানে বলা হচ্ছে যে, অসুরেরা শাস্ত্রের বিধান জানে না এবং তাদের মধ্যে কেউ যদি তা জেনেও থাকে, সেগুলি অনুসরণ
করবার কোন প্রবৃত্তি তাদের নেই। ধর্মে তাদের বিশ্বাস নেই, অসুরেরা অন্তরে ও বাহিরে শুদ্ধ নয়। স্নান করে, দাঁত মেঝে, কাপড় পরিবর্তন করে ইত্যাদি শৌচ পন্থায় দেহকে পরিস্কার রাখার জন্য সর্বদাই যত্নশীল হওয়া উচিত। অন্তরের পরিচ্ছন্নতার জন্য সর্বদাই ভগবানের পবিত্র নাম স্মরণ করা উচিত এবং হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণকৃষ্ণ হরেহরে / হরেরাম হরেরাম রামরাম হরেহরে এই মহামন্ত্র কীর্তন করা উচিত। বাইরের ও অন্তরের পরিচ্ছন্নতার এই সমস্ত নিয়মগুলি অনুসরণ করার কোন প্রবৃত্তি অসুরদের নেই।
মানুষের আচরণ যথাযথভাবে পরিচালিত করার জন্য অনেক নিয়ম ও বিধান আছে যেমন মনুসংহিতা হচ্ছে মনুষ্য-জাতির আইন শাস্ত্র। এমন কি আজও পর্যন্ত হিন্দুরা মনুসংহিতা অনুসরণ করে। উত্তরাধিকারের আইন ও অন্য অনেক আইন এই গ্রন্থ থেকে
নিরূপণ করা হয়েছে। মনুসংহিতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, নারীদের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নয়। তার অর্থ এই নয় যে, নারীদের ক্রীতদাসীর মতো রাখতে হবে। তার অর্থ হচ্ছে তারা শিশুর মতো। শিশুদের স্বাধীনতা দেওয়া হয় না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদের ক্রীতদাসের মতো রাখা হয়। অসুরেরা এই সমস্ত নির্দেশগুলি এখন অবহেলা করছে এবং তারা মনে করে যে, পুরুষদের মতো নারীদের ও স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। সে যাই হোক, নারীদের এই স্বাধিনতা পৃথিবীর সমাজ-ব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের প্রতিটি স্তরে নারীদের রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত। শৈশবে তাদের পিতা-মাতার, যৌবনে পতির এবং বাধ্যক্যে উপযুক্ত সন্তানদের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। মনুসংহিতার নির্দেশ অনুসারে এটিই হচ্ছে যথার্থ সামাজিক আচরণ। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কৃত্রিমভাবে নারী জীবনের ধারণাকে গর্বস্ফীত করবার উপায় উদ্ধাবন করেছে এবং তাই আজকের মানব-সমাজে বিবাহ- ব্যবস্থা প্রায় লোপ পেতে বসেছে। আধুনিক যুগের নারীদের নৈতিক চরিত্রও অত্যন্ত অধঃপতিত হয়েছে। সুতরাং অসুরেরা সমাজের মঙ্গলের জন্য যে সমস্ত নির্দেশ তা গ্রহণ করে না এবং যেহেতু তারা মহর্ষিদের অভিঙ্গতা এবং মুনি-ঋষিদের প্রদত্ত আইন-কানুনগুলি মেনে চলে না, তাই অসুরদের সামাজিক অবস্থা দুর্দদশাগ্রস্ত
শ্রীভগবান্ উবাচ
অসত্যম্-অপ্রতিষ্ঠম্ তে জগৎ-আহুঃ-অনীশ্বরম্।
অপরস্পর-সম্ভুতম্ কিমন্যৎ কামহৈতুকম্।।৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আসুরিক স্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলে যে, এই জগৎ মিথ্যা, অবলম্বনহীন ও ঈশ্বরশূন্য। কামবশত এই জগৎ উৎপন্ন হয়েছে এবং কাম ছাড়া আর অন্য কোন কারণ নেই।
তাৎপর্যঃ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা সিদ্ধান্ত করে যে, এই জগৎটি অলীক,এর পিছনে কোনও কার্য-কারণ নেই, এর কোন নিয়ন্তা নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই-- সব কিছুই মিথ্যা। তারা বলে যে, ঘটনাচক্রে জড় পদার্থের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যে ভগবান এই জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তারা তা মনে করে না। তাদের নিজেদের মনগড়া কতকগুলি মতবাদ আছে-- এই জগৎ আপনা হতেই প্রকাশিত হয়েছে এবং এর পেছনে যে ভগবান রয়েছেন, সেটি বিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। তাদের কাছে চেতন ও জড়ের কোন পার্থক্য নেই এবং তারা পরম চেতনকে স্বীকার করে না। তাদের কাছে সবই কেবল জড় এবং সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হচ্ছে একটি অজ্ঞনতার পিণ্ড। তাদের মত অনুসারে সব কিছুই শূন্য এবং যা কিছুরই অস্তিত্বের প্রকাশ দেখা যায়, তা কেবল আমাদের উপলব্ধির ভ্রম। তারা স্থির নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছে যে, বৈচিত্র্যময় সমস্ত প্রকাশ হচ্ছে অজ্ঞনতা জনিত ভ্রম, ঠিক যেমন স্বপ্নে আমরা অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারি প্রকৃতপক্ষে যাদের কোন অস্তিত্ব নেই। তারপর যখন আমরা জেগে উঠব,তখন আমরা দেখতে পাব যে,সব কিছুই কেবল একটি স্বপ্নমাত্র। কিন্তু বস্তুতপক্ষে, অসুরেরা যদিও বলে যে, জীবন একটি স্বপ্নমাত্র, কিন্তু স্বপ্নটি উপভোগ করার ব্যাপারে তারা খুব দক্ষ।
তাই জ্ঞান আহরণ করার পরিবর্তে তারা এই স্বপ্নরাজ্যে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ে। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, কেবল স্ত্রী-পুরুষের মৈথুনের ফলে যেমন একটি শিশুর জন্ম হয়,এই পৃথিবীরও কোন আত্মা ছাড়াই জন্ম হয়েছে। তাদের মতে, কেবলমাত্র জড় পর্দাথের সমন্বয়ের ফলেই জীবসকলের উদ্ভব হয়েছে এবং আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। যেমন, দেহের ঘাম থেকে এবং মৃতদেহ থেকে কোন কারণ
ছাড়াই প্রাণী বেরিয়ে আসে, তেমনই সমস্ত জগৎ এসেছে মহাজাগতিক প্রকাশের জড় পর্দাথের সমন্বয়ের ফলে। তাই জড়া প্রকৃতিই এই প্রকাশের কারণ এবং এ ছাড়া অন্য আর কোন কারণ নেই। তারা ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণের কথা বিশ্বাস করে না। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়ত্রে সচরাচরম্। " আমর অধ্যক্ষতার সমস্ত জড় জগৎ পরিচালিত হচ্ছে। " পক্ষান্তরে বলা যায়,অসুরদের জড় জগতের সৃষ্টি সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান নেই। তাদের সকলেরই নিজের নিজের একটি মতবাদ আছে।তাদের মতে শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত তাদের মনগড়া মতবাদের মতোই একটি মতবাদ মাত্র। শাস্ত্রের নির্দেশ যে প্রামান্য সিদ্ধান্ত তারা তা বিশ্বাস করে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ইদম্-অদ্য ময়া লব্ধম্-ইমম্ প্রাপ্স্যে মনোরথম্।
ইদম্--অস্তি-ইদম্-অপি মে ভবিষ্যতি পুনঃ-ধনম্।।১৩।।
অসৌ ময়া হতঃ শত্রুঃ-হনিষ্যে চ-অপরান্-অপি।
ঈশ্বরঃ-অহম্-অহম্ ভোগী সিদ্ধঃ-অহম্ বলবান্ সুখী।।১৪।।
আঢ্যঃ-অভিজনবান্-অস্মি কঃ-অন্যঃ-অস্তি সদৃশঃ ময়া।
যক্ষ্যে দাস্যামি মোদিষ্যে ইতি-অজ্ঞান-বিমোহিতাঃ।। ১৫।।
অনেক-চিত্তবিভ্রান্তাঃ মোহ-জাল-সমাবৃতাঃ।
প্রসক্তাঃ কাম-ভোগেষু পতন্তি নরকে-অশুচৌ।।১৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা মনে করে ---" আজ আমার দ্বারা এত লাভ হয়েছে এবং আমার পরিকল্পনা অনুসারে আরও ধন লাভ হবে। ঐ শক্র আমার দ্বারা নিহত হয়েছে এবং অন্যান্য শক্রদেরও আমি হত্যা করব। আমিই ঈশ্বর,আমি ভোক্তা। আমিই সিদ্ধ, বলবান ও সুখী। আমি সবচেয়ে ধনবান এবং অভিজাত আত্মীয়স্বজন পরিবৃত। আমার মতো আর কেউ নেই।
আমি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করব, দান করব এবং আনন্দ করব।" এভাবেই অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা অজ্ঞানের দ্বারা বিমোহিত হয়। নানা প্রকার দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে এবং মোহজালে বিজড়িত হয়ে কামভোগে আসক্তচিত্ত সেই ব্যক্তিরা অশুচি নরকে পতিত হয়।
তাৎপর্যঃ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা ধন-সম্পদ আহরণ করার বাসনায় কোন অন্ত নেই। তা অসীম। তারা কেবল চিন্তা করে কি পরিমাণ অর্থ তার এখন আছে এবং সেই অর্থকে আরও বাড়াবার জন্য নানা রকম বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে। সেই উদ্দেশ্যে যে কোন রকম পাপকর্ম করতে তারা দ্বিধা করে না এবং তাই তারা কালোবাজারী আদি অবৈধ কাজকর্মে লিপ্ত হয়। তারা তাদের সঞ্চিত অর্থ, গৃহ, জায়গা-জমি, পরিবার আদি সমস্ত সম্পদের দ্বারা মুগ্ধ হয়ে থাকে এবং তারা সর্বদাই পরিকল্পনা করে কিভাবে সেগুলির আরও উন্নতি সাধন করা যায়। তারা তাদের নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের উপরে আস্থাবান এবং তারা জানে না যে, যা কিছু তারা ভাল করছে, তা সবই তাদের পূর্বকৃত পূণ্যকর্মেরই ফল মাত্র। এই ধরণের সমস্ত ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ তারা পায়। কিন্তু তার কারণ যে তাদের পূর্বকৃত কর্ম, সেই সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। তারা মনে করে যে, তাদের সঞ্চিত ঐশ্বর্য তারা তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফলেই আহরণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষ তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার উপর আস্থাবান। তারা কর্মফলে বিশ্বাস করে না। মানুষ তার পূর্বকৃত কর্মের ফলে উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করে অথবা ধনবান হয়, অথবা উচ্চ শিক্ষিত হয় কিংবা রূপবান হয়। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষ মনে করে যে, সমস্তই ঘটনাচক্রে এবং তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফলে ঘটেছে। বিভিন্ন রকমের মানুষের রূপ, গুণ, শিক্ষা আদির পিছনে যে এক অতি সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রয়েছে, তা তারা অনুভব করতে পারে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
আত্মসম্ভাবিতাঃ স্তব্ধাঃ ধনমান-মদান্বিতাঃ।
যজন্তে নাম-যজ্ঞৈঃ-তে দম্ভেন-অবিধিপূর্বকম্।।১৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সেই আত্মাভিমানী, অনম্র এবং ধন ও মানে মদান্বিত ব্যক্তিরা অবিধিপূর্বক দম্ভ সহকারে নামমাত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে।
তাৎপর্যঃ নিজেদের সর্বেসর্বা বলে মনে করা এবং কোন রকম অধ্যক্ষতা অথবা প্রামাণ্য শাস্ত্রের পরোয়া না করে অসুরেরা তথাকথিত ধর্মানুষ্ঠান বা যজ্ঞবিধির অনুষ্ঠান করে থাকে। যেহেতু তারা নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক সূত্র বিশ্বাস করে না, তাই তারা অত্যন্ত উদ্ধত। তার কারণ হচ্ছে সঞ্চিত ধন- সম্পদ ও অহঙ্কারে মত্ত হয়ে তারা মোহাচ্ছন্ন। কখনও কখনও এই ধরনের অসুরেরা ধর্মপ্রচারক সেজে জনসাধারণকে বিপথগামী করে এবং ধর্ম সংস্কারক বা ভগবানের অবতার রূপে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করে। তারা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ভান করে, অথবা দেব- দেবীর পূজা করে , অথবা নিজেদের মনগড়া ভগবান তৈরি করে। সাধারণ লোক তাদের ভগবান বলে মনে করে তাদের পূজা করে। মূর্খ লোকেরা তাদের ধর্মজ্ঞ বা দিব্যজ্ঞান - সম্পন্ন বলে মনে করে। তারা সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে সব রকম অপকর্মে লিপ্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে যাঁরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, তাদের প্রতি নানা রকম বিধি- নিষেধের নির্দেশ রয়েছে। অসুরেরা কিন্তু এই সমস্ত বিধি নিষেধের ধার ধারে না। তাদের মতে কোন নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করার দরকার নেই। যার যার নিজের মত অনুযায়ী এক একটি পথ বার করে নিলে চলে। অবিধিপূর্বকম্ অর্থাৎ কোন বিধি- নিষেধের পরোয়া না করে কথাটির উপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। অজ্ঞাত ও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলেই এগুলি হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অহঙ্কারম্ বলম্ দর্পম্ কামম্ ক্রোধম্ চ সংশ্রিতাঃ।
মাম্-আত্ম-পর-দেহেষু প্রদ্বিষন্তঃ-অভ্যসূয়কাঃ।।১৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অহঙ্কার, বল,দর্প, কাম ও ক্রোধকে আশ্রয় করে অসুরেরা স্বীয় দেহে ও পরদেহে অবস্থিত পরমেশ্বর স্বরূপ আমাকে দ্বেষ করে এবং সাধুদের গুণেতে দোষারোপ করে।
তাৎপর্যঃ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা সর্বদাই ভগবানের মহত্ত্বের বিরোধিতা করে এবং তাই তারা শাস্ত্রের নির্দেশ বিশ্বাস করতে চায় না। তারা শাস্ত্র ও পরম পুরুষোত্তম ভগবান উভয়েরই প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। তাদের তথাকথিত
জড় প্রতিষ্ঠা, তাদের সঞ্চিত সম্পদ, তাদের শক্তিসামর্থ্য, এগুলিই হচ্ছে তাদের এই মনোভাবের কারণ। তারা জানে না যে, তাদের এই জীবনটি হচ্ছে তাদের পরবর্তী জীবনকে গড়ে তোলার একটি মহান সুযোগ। সেটি না জেনে তারা অন্য সকলের প্রতি হিংস্র আচরণ করে এবং তাদের নিজের শরীরেও হিংস্র আচরণ করে। তারা পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানের পরোয়া করে না, কারণ তাদের কোন জ্ঞান নেই। শাস্ত্র বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তারা ভগবানের অস্তিত্ব অস্বীকার করবার জন্য নানা রকম কপট প্রমাণের অবতারণা করে এবং শাস্ত্রের নির্দেশ খণ্ডন করার চেষ্টা করে। তারা মনে করে যে, সব রকম কর্ম করার শক্তি ও স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। তারা মনে করে যে, যেহেতু শক্তি, সামর্থ্য অথবা বিত্তে কেউই তাদের সমকক্ষ নয়, তাই তারা যা ইচ্ছা তাই করে যেতে পারে, কেউই তাকে বাধা দিতে পারবে না। তাদের কোন শত্রু যদি ইন্দ্রিয়-পরায়ণ কার্যকলাপে বাধা দিতে চেষ্টা করে, তখন তারা তাকে সমূলে বিনাশ করার পরিকল্পনা করে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তান্-অহম দ্বিষতঃ ক্রুরান্ সংসারেষু নরাধমান্।
ক্ষিপামি-অজস্রম্-অশুভান্-আসুরীষু-ত্রব যোনিষু।।১৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সেই বিদ্বেষী, ক্রুর ও নরাধমদের আমি এই সংসারেই অশুভ আসুরী যোনিতে অবিরত নিক্ষেপ করি।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ্ করা হয়েছে যে, পরমেশ্বরের ইচ্ছার প্রভাবেই জীবাত্মা কোন বিশেষ শরীর প্রাপ্ত হয়। আসুরিক মানুষেরা ভগবানের পরমেশ্বরত্ব অস্বীকার করে যথেচ্ছাচার করতে পারে। কিন্তু তাদের পরবর্তী জীবন নির্ধারিত হবে পরম পুরুষোত্তম ভগবানেরই ইচ্ছা অনুসারে--- তাদের নিজের ইচ্ছা অনুসারে নয়। শ্রীমদ্ভগবতে তৃতীয় স্কন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মৃত্যুর পরে জীবাত্মা কোন বিশেষ শরীর প্রাপ্ত হওয়ার জন্য উচ্চতর শক্তির তত্ত্বাবধানে মাতৃজঠরে স্থাপিত হয়। তাই জড় জগতে আমরা পশু , পাখি, কীট, পতঙ্গ, মানুষ আদি নানা রকমের প্রজাতির প্রকাশ দেখতে পাই। এদের প্রকাশ হয়েছে উচ্চতর শক্তির প্রভাবে।
ঘটনাচক্রে এদের উদ্ভব হয়নি। অসুরদের সম্বন্ধে এখানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, তারা বারবার অসুরযোনি প্রাপ্ত হয় এবং এভাবেই তারা চিরকাল ঈর্ষাপরায়ণ নরাধামরূপে থাকে। এই ধরনের আসুরিক জীবন সর্বদাই কামার্ত, সর্বদাই অত্যাচারী ও কুলষিত এবং সর্বদাই অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তারা ঠিক জঙ্গলের শিকারীদের মতো আসুরিক প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
আসুরীম্ যোনিম্-আপন্নাঃ মৃঢ়াঃ জন্মনি জন্মনি।
মাম্-অপ্রাপ্য-ত্রব কৌন্তেয় ততঃ যান্তি-অধমাম্ গতিম্।।২০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে কৌন্তেয়! জন্মে জন্মে অসুরযোনি প্রাপ্ত হয়ে, সেই মৃঢ় ব্যক্তিরা আমাকে লাভ করতে অক্ষম হয়ে তার থেকেও অধম গতি প্রাপ্ত হয়।
তাৎপর্যঃ সকলেই জানে যে, ভগবান হচ্ছেন পরম করুণাময়। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভগবান অসুরদের প্রতি কখনই করুণাময় নন। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা জন্ম- জন্মান্তরে অসুরযোনি প্রাপ্ত হয় এবং পরমেশ্বর ভগবানের কৃপা থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা ক্রমান্বয়ে অধঃপতিত হতে হতে অবশেষে কুকুর, বেড়াল ও শূকরের শরীর প্রাপ্ত হয়। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই ধরনের অসুরদের পরবর্তী কোন জীবনেই ভগবানের কৃপা লাভ করার কিছুমাত্র সম্ভবনা থাকে না। বেদেও বলা হয়েছে যে, এই ধরনের মানুষেরা ক্রমান্বয়ে নিমজ্জিত হতে হতে অবশেষে কুকুর ও শূকরের শরীর প্রাপ্ত হয়। এখন এই সম্বন্ধে বিতর্কের উত্থাপন করে কেউ বলতে পারে যে, ভগবান যদি এই সমস্ত অসুরদের প্রতি কৃপা-পরায়ণ না হন, তা হলে তাঁকে কৃপাময় বলে জাহির করা উচিত নয়। এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, বেদান্তসূত্রে উল্লেখ আছে, পরমেশ্বর ভগবান কাউকেই ঘৃণা করেন না। অসুরদের যে সবচেয়ে অধঃপতিত জীবন দান করেন, তাও তাঁর কৃপারই এক রকম প্রকাশ। কখন কখন অসুরেরা পরমেশ্বর ভগবানের হাতে নিহত হয়, কিন্তু এভাবেই ভগবানের হাতে নিহত হওয়াও তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক। কারণ, বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, ভগবানের হাতে মৃত্যু হলে তৎক্ষণাৎ মুক্তি লাভ হয়। ইতিহাসে রাবণ, কংস, হিনণ্যকশিপু আদি বহু অসুরের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে -- তাদের হত্যা করবার জন্য ভগবান নানারূপে অবতরণ করেছেন। সুতরাং, ভগবানের কৃপা অসুরদের উপরেও বর্ধিত হয় যদি তারা ভগবানের হাতে নিহত হবার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্রিবিধর্ম নরকস্য-ইদম্ দ্বারম্ নাশনম্-আত্মনঃ।
কামঃ ত্রোধঃ-তথা লোভঃ-তস্মাৎ-ত্রতৎ-ত্রয়ম্ ত্যজেৎ।।২১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কাম,ক্রোধ ও লোভ -- এই তিনটি নরকের দ্বার, অতত্রব ঐ তিনটি পরিত্যাগ করবে।
তাৎপর্যঃ এখানে আসুরিক জীবনের কিভাবে শুরু হয়, তার বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ কাম উপভোগ করবার চেষ্টা করে এবং তার অতৃপ্তিতে তার চিত্তে ক্রোধ ও লোভের উদয় হয়। সুস্থ মস্তিষ্ক যে মানুষ আসুরিক জীবনে অধঃপতিত হতে না চায়, তাকে অবশ্যই এই তিনটি শক্রর সঙ্গ বর্জন করতে হবে। এই তিনটি শত্রু আত্মাকে এমনভাবে হত্যা করে, যার ফলে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আর কোন সম্ভবনাই থাকে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্রতৈঃ-বিমুক্ত কৌন্তেয় তমোদ্বারৈঃ-ত্রিভি-নরঃ।
আচরিত-আত্মনঃ শ্রেয়ঃ-ততঃ যাতি পরাম্ গতিম্।। ২২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে কৌন্তেয় ! এই তিন প্রকার তমোদ্বার থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ আত্মার শ্রেয় আচরণ করেন এবং তার ফলে পরাগতি লাভ করে থাকেন।
তাৎপর্যঃ মানব জীবনের তিনটি শত্রু -- কাম, ক্রোধ ও লোভ থেকে সর্বদাই অত্যন্ত সর্তক থাকতে হবে। কাম,ক্রোধ ও লোভ থেকে মানুষ যতই মুক্ত হয়,তার জীবন ততই নির্মল হয়। তখন সে বৈদিক শাস্ত্র - নির্দেশিত বিধি-নিষেধের অনুশীলন করতে সক্ষম হয়। মানব-জীবনের বিধি-নিষেধগুলি অনুশীলন করার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে আত্মজ্ঞান লাভের স্তরে উন্নীত হতে পারে। এই প্রকার অনুশীলন ফলে কেউ যদি কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে, তা হলে তার সাফল্য অনিবার্য। বৈদিক শাস্ত্রে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সম্বন্বিত যথাযথ কর্ম আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মানুষকে নির্মল জীবনের স্তরে উন্নীত করবার জন্য। সেই সমগ্র পন্থাটি সর্ম্পূনভাবে নির্ভর করছে কাম, ক্রোধ ও লোভ পরিত্যাগ করার উপর। এই পন্থায় জ্ঞান অনুশীলন করার ফলে আত্ম- উপলব্ধি চরম স্তরে উন্নীত হওয়া যায়। ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে এই আত্ম- উপলব্ধি পূর্ণতা লাভ হয়। এই ভক্তিযোগে বদ্ধ জীবের মুক্তি অনিবার্য। তাই বৈদিক প্রথায় চারটা বর্ণ ও জীবনের চারটি আশ্রমের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তাকে বলা হয় দৈব-বর্ণাশ্রম ধর্ম। সমাজে বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রমের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধান নির্দিষ্ট হয়েছে এবং কেউ যদি যথাযথভাবে সেগুলি আচরণ করে , তা হলে আপনা থেকেই সে অধ্যাত্ম উপলব্ধির চরম স্তরে উন্নীত হতে পারে। তখন সে নিঃসন্দেহে মুক্তি লাভ করতে পারবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যঃ শাস্ত্রবিধিম্-উৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ।
ন স সিদ্ধিম্-অবাপ্নোতি ন সুখম্ ন পরাম্ গতিম্।। ২৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে কামাচারে বর্তমান থাকে, সে সিদ্ধির,সুখ অথবা পরাগতি লাভ করতে পারে না।
তাৎপর্যঃ পূর্বেই বলা হয়েছে, মানব-সমাজে বিভিন্ন বর্ণের ও আশ্রমের জন্য শাস্ত্রবিধি বা শাস্ত্রীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে এই সমস্ত বিধিগুলি অনুশীলন করা। কেউ যদি সেই নির্দেশগুলি অনুশীলন না করে কাম, ক্রোধ ও লোভের বশবর্তী হয়ে নিজের খেয়ালখুশি মতো জীবন যাটন করতে থাকে, তা হলে সে কখনই সিদ্ধি লাভ করতে পারবে না। পক্ষান্তরে বলা যায়, কোন মানুষ সিদ্ধান্তগতভাবে এই সমস্ত শাস্ত্রনির্দেশ সম্বন্ধে অবগত থাকতে পারে, কিন্তু সে যদি তার নিজের জীবনে সেগুলিকে আচরণ না করে, তা হলে সে বুঝতে হবে যে, সে একটি নরাধম।
মনুষ্য-শরীর প্রাপ্ত জীবের কাছে এটিই প্রত্যাশা করা হয় যে, সে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন জীবনের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য শাস্ত্র-নির্দেশগুলি অনুশীলন করবে। সে যদি তা না করে, তা হলে তার অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সমস্ত বিধি-নিষেধ নৈতিক আচার-অনুষ্ঠান করেও সে যদি ভগবৎ-তত্ত্ব উপলব্ধির স্তরে উন্নীত না হয়, তা হলে বুঝতে হবে যে, তার সমস্ত জ্ঞানই ব্যর্থ হয়েছে। আর এমন কি ভগবানের অস্তিত্বকে স্বীকার করেও যদি সে ভগবানের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত না করে, তবে বুঝতে হবে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ। তাই ধীরে ধীরে কৃষ্ণভাবনামৃত ও ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হতে হবে। তখনই কেবল সিদ্ধির সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়। এ ছাড়া আর কোন উপায়েই তা সম্ভব নয়।
কামকারতঃ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জ্ঞাতসারে মানুষ শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে কাম আচরণ করে। সেই আচরণগুলি নিষিদ্ধ জেনেও যদি তা আচরণ করা হয়,তাকে বলা হয় খেয়ালখুশি মতো আচরণ কার। সে জানে যে, সেগুলি অনুশীলন করা উচিত, কিন্তু তবুও সে তা করে না, তাই তাকে বলা হয় খামখেয়ালী। এই সমস্ত মানুষদের পরিণতি হচ্ছে যে,তারা ভগবানের দ্বারা দন্ডিত হয়। মানব-জীবনের যে চরম সিদ্ধি, তা তারা কখনই লাভ করতে পারে না। মানব-জীবনের বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনকে পবিত্র
করা এবং যারা শাস্ত্রবিধি অনুশীলন করে না, আচরণ করে না, তারা কখনই পবিত্র হতে পারে না এবং তারা যথার্থ শান্তি লাভ করতে পারে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তস্মাৎ-শাস্ত্রম্ প্রমাণম্ তে কার্য-অকার্য-ব্যবস্থিতৌ।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্র-বিধান-উক্তম্ কর্ম কর্তুম্-ইহ-অর্হসি।।২৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অতত্রব, কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। অতত্রব শাস্ত্রীয় বিধানে কথিত হয়েছে যে কর্ম, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও।
তাৎপর্যঃ পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সমস্ত বৈদিক বিধি ও নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা। কেউ যদি ভগবদ্ গীতার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরে কৃষ্ণভাবনার অমৃতময় স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হস, তখন তিনি বৈদিক শাস্ত্র প্রদত্ত জ্ঞানের চরম সিদ্ধির স্তরে উপন্নীত হয়েছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই পন্থাকে অত্যন্ত সরল করে দিয়ে গেছেন। তিনি মানুষকে কেবল হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণকৃষ্ণ হরেরাম।
হরেরাম হরেরাম রামরাম হরেহরে--- এই মহামন্ত্র কীর্তন করতে, ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবায় নিযুক্ত হতে এবং ভগবৎ প্রসাদ গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।।যিনি এভাবেই ভক্তিমূলক কর্মধারায় প্রত্যক্ষভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন, তিনি সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রাদি অনুশীলন করছেন বলেই বুঝতে হবে। তিনি সঠিকভাবে বৈদিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। অবশ্যই, যারা কৃষ্ণভাবনার অমৃতময় স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবানের সেবায় যুক্ত হতে পারেনি, তাদের পক্ষে বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে কর্তব্য-অকর্তব্য বিচার করে কর্ম করা উচিত। কোন রকম কুর্তক না করে বৈদিক নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে যাওয়া উচিত। তাকেই বলা হয় শাস্ত্রবিধির আচরণ করা। শাস্ত্র হচ্ছে চারটি ক্রটি থেকে মুক্ত এবং বদ্ধ জীবের যে চারটি ক্রটি আছে, সেগুলি হচ্ছে-- ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব ( ভুল করার প্রবণতা, মোহগ্রস্ত হওয়া, প্রবঞ্চনা করার প্রবণতা ও অপূর্ণ ইন্দ্রিয়াদি)। এই চারটি প্রধান ক্রটি থাকার জন্য বদ্ধ জীব বিধিনিয়ম রচনার অযোগ্য। সেই কারণেই শাস্ত্রোক্ত বিধিনিয়মগুলি এই চারটি ক্রটি থেকে সর্ম্পূনভাবে মুক্ত বলে সমস্ত মহামুনি, ঋষি, আচার্য মহাত্মাগণ শাস্ত্রের নির্দেশগুলিড়কে কোনও রকম পরিবর্তন না করে গ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষে অনেক আধ্যাত্মিক সম্প্রদায় রয়েছে, যেগুলি সাধারণত দুভাগে বিভক্ত-- নির্বিশেষবাদী ও সবিশেষবাদী। তাঁরা উভয়েই অবশ্য বৈদিক নির্দেশ অনুসারেই জীবন যাপন করেন। শাস্ত্রনির্দেশ অনুশীলন না করে কখনই সিদ্ধিলাভ করা যায় না। তাই, যিনি যথার্থভাবে শাস্ত্রের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনিই ভাগ্যবান।
ইতি - দৈব ও আসুরিক প্রকৃতিগুলির পরিচয় বিষয়ক ' দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ' নামক শ্রীমদ্ভগবদগীতার ষোড়শ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ অন্তে শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা-
ওঁ যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্ ভবেৎ ।
পূর্ণং ভবতু ত্বৎ সর্বং ত্বৎ প্রসাদাৎ জনার্দ্দন ।।
মন্ত্র হীনং ক্রিয়া হীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন ।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তুমে ।।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন