ওঁ তৎ সৎ
শ্রীমদ্ভগবদগীতা
অর্জুন উবাচ
সন্ন্যাসস্য মহাবাহো তত্ত্বম্-ইচ্ছামি বেদিতুম্।
ত্যাগস্য চ হৃষীকেশ পৃথক্-কেশিনিসূদন।। ১।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে মহাবাহো! হে হৃষীকেশ! হে কেশিনিসূদন! আমি সন্ন্যাস ও ত্যাগের
তত্ত্ব পৃথকভাবে জানতে ইচ্ছা করি।
তাৎপর্যঃ প্রকৃতপক্ষে ভগবদ্ গীতা সতেরটি অধ্যায়েই সমাপ্ত। অষ্টাদশ অধ্যায়টি হচ্ছে পূর্ব অধ্যায়গুলিতে আলোচিত বিভিন্ন বিষয়বস্তুর পরিপূরক সারাংশ। ভগবদ্ গীতার প্রতিটি অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গুরুত্ব সহকারে উপদেশ দিচ্ছেন যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলনই হচ্ছে জীবনের পরম লক্ষ্য। সেই একই বিষয়বস্তু জ্ঞানের গুহ্যতম পন্থারূপে অষ্টাদশ অধ্যায় সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ছয়টি অধ্যায়ে ভক্তিযোগের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে --যোগিনামপি সর্বষাম্-- " সমস্ত যোগীদের মধ্যে যিনি সর্বদাই তাঁর অন্তরে আমাকে চিন্তা করেন, তিনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ "। পূরবর্তী ছয়টি অধ্যায়ে শুদ্ধ ভক্তি, তার প্রকৃতি এবং তার অনুশীলনের বর্ণনা করা হয়েছে। শেষ ছয়টি অধ্যায়ে জ্ঞান, বৈরাগ্য, জড়া প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপ, অপ্রাকৃত প্রকৃতি ও ভগবৎ-সেবার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে সমস্ত কর্মের অনুষ্ঠান করা উচিত, যিনি ওঁ তৎ সৎ শব্দগুলির দ্বারা প্রকাশিত হয়েছেন, যা পরম পুরুষ শ্রীবিষ্ণুকেই নির্দেশ করে। ভগবদ্ গীতার তৃতীয় পর্যায়ে দেখানো হয়েছে যে, ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন ছাড়া আর কিছুই জীবনের চরম লক্ষ্য নয়। পূর্বতন আচার্যগণের দ্বারা এবং ব্রক্ষসূত্র বা বেদান্ত-সূত্রের উদ্ধৃতি সহকারে তা প্রতিপন্ন হয়েছে। কোন কোন নির্বিশেষবাদীরা মনে করেন যে বেদান্ত-সূত্রে একচেটিয়া অধিকার কেবল তাঁদেরই আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেদান্ত-সূত্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি হৃদয়ঙ্গম করা। কারণ
ভগবান নিজেই হচ্ছেন বেদান্ত-সূত্রের প্রণেতা এবং তিনিই হচ্ছেন বেদান্তবেত্তা। সেই কথা পঞ্চাদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটি শাস্ত্রের, প্রতিটি বেদেরই প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি। ভগবদ্ গীতায় সেই কথা বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ভগবদ্ গীতায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে সমগ্র বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্তসার বর্ণণা করা হয়েছে, তেমনই অষ্টাদশ অধ্যায়েও সমস্ত উপদেশের সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবদ্ গীতার দুইটি বিষয় ত্যাগ ও সন্ন্যাস সম্বন্ধে অর্জুন স্পষ্টভাবে জানতে চাইছেন। এভাবেই তিনি এই দুইটি শব্দের অর্থ সম্বন্ধে জিঙ্গাসা করেছেন
ভগবানকে সম্বোধন করে এখানে যে দুইটি শব্দ ' হৃষীকেশ ' ও ' কেশিনিসূদন ' ব্যবহার করা হয়েছে তা তাৎপর্যপূর্ণ। হৃষীকেশ হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অধিপতি শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন তাঁকে অনুরোধ করেছেন, সবকিছুর সারমর্ম এমন ভাবে বর্ণনা করতে যাতে তিনি তাঁর মনের সাম্যভাব বজায় রেখে অবিচলিত চিত্ত হতে পারেন। তবুও তাঁর মনে সন্দেহ রয়েছে এবং সন্দেহকে সব সময় অসুরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণকে তিনি বাকিটুকু প্রথম কমেন্টে দেওয়া
শ্রীভগবান্ উবাচ
কাম্যানাম্ কর্মনাম্ ন্যাসম্ কবয়ঃ বিদুঃ।
সর্ব-কর্ম-ফল-ত্যাগম্ প্রাহুঃ-ত্যাগম্ বিচক্ষণাঃ।। ২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- পণ্ডিতগণ কাম্য কর্মসমূহের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে জানেন এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ সমস্ত কর্মফল ত্যাগকে ত্যাগ বলে থাকেন।
তাৎপর্যঃ কর্মফলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত যে কর্ম, তা ত্যাগ করতে হবে। সেটিই হচ্ছে ভগবদ্ গীতার নির্দেশ। কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞান লাভের জন্য যে কর্ম, তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। পরবর্তী শ্লোকগুলিতে তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যজ্ঞ সম্পাদনের বিভিন্ন বিধি-বিধান বৈদিক শাস্ত্রে আছে। পুত্র লাভের জন্য অথবা স্বর্গ লাভের জন্য বিশেষ বিশেষ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে হয়, কিন্তু কামনার বশবর্তী হয়ে যজ্ঞ করা বদ্ধ করতে হবে। কিন্তু তা বলে, নিজের অন্তর পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠান অথবা পারমার্থিক বিজ্ঞানে উন্নতি লাভের জন্য যে সমস্ত যজ্ঞ, তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্যাজম্ দোষবৎ-ইতি-একে কর্ম প্রাহুঃ-মনীষিণঃ।
যজ্ঞ-দান-তপঃ-কর্ম ন ত্যাজম্-ইতি চ-অপরে।।৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এক শ্রেণীর মনীষীগণ বলেন যে, কর্ম দোষযুক্ত, সেই হেতু তা পরিত্যাজ্য। অপর এক শ্রেণীর পণ্ডিত যজ্ঞ, দান, তপস্যা প্রকৃতি কর্মকে অত্যাজ্য স্বিদ্ধান্ত করেছেন।
তাৎপর্যঃ বৈদিক শাস্ত্রে এমন অনেক কার্যকলাপের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন,যজ্ঞে পশুরবলি দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। আবার সেই সঙ্গে এটিও বলা হয়েছে যে, পশুহত্যা করা অত্যন্ত ঘৃণ্য কর্ম। যদিও যজ্ঞে পশুবলির নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পশুহত্যা করার কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। যজ্ঞে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশুটিকে নবজীবন দান করা। কখনও কখনও যজ্ঞে বলি দেওয়ার মাধ্যমে পশুটিকে নতুন পশুর জীবন দেওয়া হত এবং কখনও কখনও পশুটিকে তৎক্ষণাৎ মনুষ্য-জীবনে উন্নীত করা হত। কিন্তু এই সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলেন যে, পশুহত্যা সর্বতোভাবে বর্জন
করা উচিত,আবার কেউ বলেন যে, কোন বিশেষ যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া মঙ্গলজনক। যজ্ঞ সম্বন্ধে এই সমস্ত সন্দেহের নিরসন ভগবান নিজেই এখন করেছেন।
জানতে পরবর্তী পোস্টে চোখ রাখুন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
নিশ্চয়ম্ শৃণু মে তত্র ত্যাগে ভরতসত্তম।
ত্যাগঃ হি পুরুষব্যাঘ্র ত্রিবিধঃ সংপ্রকীর্তিতঃ।। ৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভরতসত্তম! ত্যাগ সম্বন্ধে আমার নিশ্চয় সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর। হে পুরুষোত্তম! শাস্ত্রে ত্যাগও তিন প্রকার বলে কীর্তিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ ত্যাগ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ থাকলেও, এখানে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রায় দিচ্ছেন, যা চরম সিদ্ধান্ত বলে গ্রহণ করা উচিত। যে যাই বলুন, বেদ হচ্ছে ভগবান প্রদত্ত নীতিবিশেষ। এখানে ভগবান নিজেই উপস্থিত থেকে যা বলছেন,তাঁর নির্দেশকে চরম বলে গ্রহণ করা উচিত। ভগবান বলেছেন যে, প্রকৃতির যে গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কর্ম ত্যাগ করা হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছু বিবেচনা করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যজ্ঞ-দান-তপঃ-কর্ম ন ত্যাজম্ কার্যম্-ত্রব তৎ।
যজ্ঞঃ দানম্ তপঃ-চ-ত্রব পাবনানি মণীষীণাম্।। ৫।।
অনুবাদঃ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্যাজ্য নয়, তা অবশ্যই করা কর্তব্য। যজ্ঞ, দান ও তপস্যা মণীষীদের পর্যন্ত পবিত্র করে।
তাৎপর্যঃ যোগীদের উচিত মানব-সমাজের উন্নিত সাধনের জন্য কর্ম সম্পাদন করা। মানুষকে পরমার্থের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী অনেক শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া আছে। দৃষ্টান্তস্বরুপ, বিবাহ অনুষ্ঠানকেও এই রকম একটি পবিত্র কর্ম বলে গণ্য করা হয়। তাকে বলা হয় 'বিবাহ-যজ্ঞ'। একজন সন্ন্যাসী, য়িনি সব কিছু ত্যাগ করেছেন এবং পারিবারিক সর্ম্পক ত্যাগ করেছেন, তাঁর পক্ষে কি বিবাহ অনুষ্ঠানে উৎসাহ দান করা উচিত? ভগবান এখানে বলেছেন যে, মানব-সমাজের মঙ্গলের জন্য যে যজ্ঞ, তা কখনই ত্যাগ করা উচিত নয়। বিবাহ যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে সংযত করে শান্ত করা, যাতে সে পরমার্থ সাধনের পথে এগিয়ে যেতে পারে। অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই ' বিবাহ-যজ্ঞ' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবন যাপন করা উচিত এবং তাদের এভাবেই অনুপ্রাণিত করা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের কর্তব্য। সন্ন্যাসীর কখনই স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, যারা জীবনের নিম্নস্তরে রয়েছে, যারা যুবক, তারা বিবাহ করে সহধর্মাণী গ্রহণ করা নিরস্ত থাকবে। শাস্ত্রে নির্দেশিত সব কয়টি যজ্ঞই পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় লাভ করার জন্যই সাধিত হয়। তাই, নিম্নতর স্তরে
সেগুলি বর্জন করা উচিত নয়। তেমনই হৃদয়কে নির্মল করার উদ্দেশ্যে দান করা হয়। পূর্বের বর্ণনা অনুযায়ী যোগ্য পাত্রে যদি দান করা হয়, তা হলে তা পারমার্থিক উন্নতির সহায়ক।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্রতানি-অপি তু কর্মাণি সঙ্গম্ ত্যক্ত্বা ফলানি চ।
কর্ত্যবনি-ইতি মে পার্থ নিশ্চিতম্ মতম্-উত্তমম্।। ৬।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! এই সমস্ত কর্ম আসক্তি ও ফলের আশা পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠান করা উচিত।
ইহাই আমার নিশ্চিত উত্তম অভিমত।
তাৎপর্যঃ যদিও সব কয়টি যজ্ঞই পবিত্র, তবুও তা অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে কোন রকম ফলের আশা করা উচিত নয়। পক্ষান্তরে বলা যায়,জাগতিক উন্নতি সাধনের জন্য যে সমস্ত যজ্ঞ, তা বর্জন করতে হবে। কিন্তু যে সমস্ত যজ্ঞ মানুষের অস্তিত্বকে পবিত্র করে এবং তাদের পারমার্থিক স্তরে উন্নীত করে, তা কখনই ত্যাগ করা উচিত নয়। কৃষ্ণভাবনায় ভগবদ্ভক্তি লাভের সহায়ক সব কিছুকে সর্বতোভাবে গ্রহণ করা উচিত। শ্রীমদ্ভগবতেও বলা হয়েছে, যে সমস্ত কার্যকলাপ ভগবদ্ভক্তি লাভের সহায়ক তা গ্রহণ করা উচিত। সেটিই হচ্ছে ধর্মের সর্বোচ্চ নীতি। ভগবদ্ভক্তি সাধনের যে কোন রকমের কার্য, যজ্ঞ বা দান ভগবদ্ভক্তের গ্রহণ করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণঃ ন-উপপদ্যতে।
মোহাৎ-তস্য পরিত্যাগ-তামসঃ পরিকীর্তিতঃ।।৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কিন্তু নিত্যকর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। মোহবশত তার ত্যাগ হলে, তাকে তামসিক ত্যাগ বলা হয়।
তাৎপর্যঃ জড় সুখ ভোগের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত কর্ম তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কিন্তু যে সমস্ত কর্ম মানুষকে পারমার্থিক ক্রিয়াকলাপে উন্নীত করে, যেমন ভগবানের জন্য রান্না করা, ভগবানকে ভোগ নিবেদন করা এবং ভগবৎ প্রসাদ গ্রহণ করা অনুমোদন করা হয়েছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সন্ন্যাসীর নিজের জন্য রাস্না করা উচিত নয়। নিজের জন্য রান্না করা নিষিদ্ধ, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের জন্য রান্না করতে কোন বাধা নেই। তেমনই, শিষ্যকে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবার জন্য সন্ন্যাসী বিবাহ-যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে পারেন। এই সমস্ত কর্মগুলিকে যদি কেউ পরিত্যাগ করে, তা হলে বুঝতে হবে যে, সে তমোগুণে কর্ম করছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দুঃখম্-ইতি-ত্রব যৎ কর্ম কায়-ক্লেশ-ভয়াৎ-ত্যজেৎ।
সঃ কৃত্বা রাজসম্ ত্যাগম্ ন-ত্রব ত্যাগ-ফলম্ লভেৎ।।৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যিনি নিত্যকর্মকে দুঃখজনক বলে মনে করে
দৈহিক ক্লেশের ভয়ে ত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই সেই রাজসিক ত্যাগ করে ত্যাগের ফল লাভ করেন না।
তাৎপর্যঃ অর্থ উপার্জন করাকে ফলশ্রয়ী সকাম কর্ম বলে মনে করে কৃষ্ণভক্তের অর্থ উপার্জন পরিত্যাগ করা উচিত নয়। কজকর্ম করে অর্থ উপার্জন করে সেই অর্থ যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করা হয়, অথবা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা যদি
পারমার্থিক কৃষ্ণভক্তির সহায়ক হয়, তা হলে সেই সমস্ত কর্মগুলি কষ্টদায়ক বলে তার ভয়ে সেগুলির অনুশীলন থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। এই ধরনের ত্যাগ রাজসিক মনোভাবাপন্ন।
রাজসিক কর্মের ফল সব সময় ক্লেশদায়ক হয়ে থাকে। সেই মনোভাব নিয়ে কেউ যদি কর্ম পরিত্যাগ করেন, তা হলে তিনি ত্যাগের যথার্থ সুফল কখনই অর্জন করেন না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
কার্যম্-ইতি-এব যৎ কর্ম নিয়তম্ ক্রিয়তে-অর্জুন।
সঙ্গম্ ত্যক্ত্বা ফলম্ চ-ত্রব সঃ ত্যাগঃ সাত্ত্বিকঃ মতঃ।।৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে অর্জুন! আসক্তি ও ফল পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে যে নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, আমার মতে সেই ত্যাগ সাত্ত্বিক।
তাৎপর্যঃ এমন মনোভাব নিয়ে সর্বদাই নিত্যকর্মে অনুষ্ঠান করা উচিত যেন ফলের প্রতি অনাসক্ত হয়ে কাজ করা হয়। এমন কি, কাজের ধরনের প্রতিও আনাসক্ত হওয়া উচিত। কৃষ্ণভাবনাময় কোন ভক্ত যদি কখনও কোন কারখানাতেও কাজ করেন, তখন তিনি কারখানার কাজের প্রতি আসক্ত হন না এবং কারখানার শ্রমিকদের প্রতিও আসক্ত হন না। তিনি কেবল শ্রীকৃষ্ণের জন্য কাজ করেন এবং যখন তিনি কর্মফল শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন, তখন তাঁর সেই কর্ম অপ্রাকৃত স্তরে অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন দ্বেষ্টি-অকুশলম্ কর্ম কুশলে ন-অনুষজ্জতে।
ত্যাগী সত্ত্ব-সমাবিষ্টঃ মেধাবী ছিন্ন-সংশয়ঃ।।১০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সত্ত্বগুণে আবিষ্ট, মেধাবী ও সমস্ত সংশয়-ছিন্ন ত্যাগী অশুভ কর্মে বিদ্বেষ বরেন না এবং শুভ কর্মে আসক্ত হন না।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ কৃষ্ণভাবনাময় বা সত্ত্বগুণময়, তিনি কাউকে বা শরীরের পক্ষে ক্লেশদায়ক কোন কিছুই ঘৃণা করেন না। তিনি শারীরিক দুঃখ-কষ্টের পরোয়া না করে যথাস্থানে ও যথাসময়ে তাঁর কর্তব্য পালন করে চলেন। ব্রক্ষভুত স্তরে অধিষ্ঠিত এই সমস্ত মানুষদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং তাঁদের কার্যকলাপ সর্ব প্রকারেই সন্দেহাতীত বলে জানতে হবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন হি দেহভৃতা শক্যম্ ত্যক্তুম্ কর্মাণি-অশেষতঃ।
যঃ-তু কর্ম-ফল-ত্যাগী সঃ ত্যাগী-ইতি-অভিধীয়তে।।১১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অবশ্যই
দেহধারী জীবের পক্ষে সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু যিনি সমস্ত কর্মফল পরিত্যাগী, তিনিই বাস্তবিক ত্যাগী বলে অভিহিত হন।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে যে,কেউ কখনও কর্ম ত্যাগ করতে পারে না। তাই, কর্মফল ভোগের আশা না করে যিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্য কর্ম করেন,যিনি সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত ত্যাগী। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের বহু সভ্য আছেন, যাঁরা অফিসে, কলকারখানায় অথবা অন্য জায়গায় খুব কঠোর পরিশ্রম করছেন এবং তাঁরা যা রোজগার করছেন, তা সবই সংঘকে দান করছেন। এই সমস্ত মহাত্মারাই যথার্থ সন্ন্যাসী। ত্রঁরাই যথার্থ ত্যাগের জীবন যাপন করছেন। এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিভাবে কর্মফল ত্যাগ করতে হয় এবং কি উদ্দেশ্য নিয়ে সেই কর্মফল ত্যাগ করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অনিষ্টম্-ইষ্টম্ মিশ্রম্ চ ত্রিবিধম্ কর্মণঃ ফলম্।
ভবতি-অত্যাগিনাম্ প্রেত্য ন তু সন্ন্যাসিনাম্ ক্বচিৎ।। ১২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যাঁরা কর্মফল ত্যাগ করেননি, তাঁদের পরলোকে অনিষ্ট, ইষ্ট ও মিশ্র-- এই তিন প্রকার কর্মফল ভোগ হয়। কিন্তু সন্ন্যাসীদের কখনও ফলভোগ করতে হয় না।
তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা অবগত হয়ে যে মানুষ কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করছেন, তিনি সর্বদাই মুক্ত। তাই তাঁকে মৃত্যুর পরে তাঁর কর্মফল-স্বরূপ সুখ বা দুঃখ কিছুই ভোগ করতে হয় না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
পঞ্চ-ত্রতানি মহাবাহো কারণানি নিবোধ মে।
সাংখ্যে কৃতান্তে প্রোক্তানি সিদ্ধয়ে সর্ব-কর্মণাম্।। ১৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে মহাবাহো! বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্তে সমস্ত কর্মের সিদ্ধির উদ্দেশ্যে এই পাঁচটি কারণ নির্দাষ্ট হয়েছে, আমার থেকে তা অবগত হও।
তাৎপর্যঃ প্রশ্ন হতে পারে যে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই যখন একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে, তা হলে কোনটিই ভোগ করতে হয় না? ভগবান বেদান্ত দর্শনের দৃষ্টান্ত দিয়ে এখানে বিশ্লেষণ করছেন কি করে তা সম্ভব। তিনি বলছেন যে, সমস্ত কার্যের পিছনে পাঁচটি কারণ আছে এবং সমস্ত কার্যের সাফল্যের পিছনেও এই পাঁচটি কারণ আছে বলে বিবেচনা করতে হবে। সাংখ্য কথাটির অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের বৃন্ত এবং বেদান্তকে
সমস্ত আর্চাযেরা জ্ঞানের চরম বৃন্ত বলে গ্রহণ করেছেন। এমন কি শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেদান্ত-সূত্রকে এভাবেই স্বীকার করেছেন। তাই, এই সমস্ত শাস্ত্রের গুরুত্ব ও প্রামাণিকতা যথাযথভাবে আলোচনা করা উচিত।
সব কিছুর চুড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ বা নিষ্পত্তি হচ্ছে পরমাত্মার ইচ্ছা। সেই সম্বন্ধে ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে -- সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ। তিনি সকলকে তার পূর্বের কর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নানা রকম কাজে নিযুক্ত করেছেন। অন্তর্যামীরূপে তিনি যে নির্দেশ দেন, সেই নির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণভাবনামৃত কর্ম করলে, এই জন্মে বা পরজন্মে কোন কর্মফল উৎপাদন করে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অধিষ্ঠানম্ তথা কর্তা করণম্ চ পৃথগ্ বিধম।
বিবিধাঃ-চ পৃথক্ চেষ্টাঃ দৈবম্ চ-ত্রব-অত্র পঞ্চমম্।।১৪।।
অনুবাদঃ অধিষ্ঠান অর্থাৎ দেহ, কর্তা, নানা প্রকার করণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ, বিবিধ প্রচেষ্টা ও দৈব অর্থাৎ পরমাত্মা --এই পাঁচটি হচ্ছে কারণ।
তাৎপর্যঃ অধিষ্ঠানম্ শব্দটির দ্বারা শরীরকে বোঝানো হয়েছে। শরীরের অভ্যন্তরস্থ আত্মা কর্মের ফলাদি সৃষ্টি করছেন এবং সেই কারণে তাঁকে বলা হয় কর্তা। আত্মাই যে জ্ঞাতা ও কর্তা, সেই কথা শ্রূতি শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। এষ হি দ্রষ্টা ( প্রশ্ন উপনিষদ ৪/৯)। বেদান্ত-সূত্রের জ্ঞোহত এব ( ২/৩/১৮) এবং কর্তা শাস্ত্রর্থবত্ত্বাৎ ( ২/৩/৩৩) শ্লোকেও তা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে কাজ করার যন্ত্র এবং ইন্দ্রিয়গুলির সহায়তায় আত্মা নানাভাবে কাজ করে। প্রতিটি কাজের জন্য নানা রকম প্রয়াস করতে হয়। কিন্তু সকলের সমস্ত কার্যকলাপ নির্ভর করে পরমাত্মার ইচ্ছার উপরে, যিনি সকলের হৃদয়ে বন্ধুরূপে বিরাজ করছেন। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন পরম কারণ। এই অবস্থায়, যিনি অন্তর্যামী পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ-সেবা করে চলছেন, তিনি স্বাভাবিকভাবেই কোন কর্মের বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ হন না। যাঁরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময়, তাঁদের কোন কর্মের জন্যই তাঁরা নিজেরা শেষ পর্যন্ত দায়ী হন না। সব কিছুই নির্ভর করে পরমাত্মার বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ইচ্ছার উপর।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শরীর-বাক্-মনোভিঃ-যৎ কর্ম প্রারভতে নরঃ।
নায্যম্ বা বিপরীতম্ বা পঞ্চ-ত্রতে তস্য হেতবঃ।।১৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শরীর,বাক্য ও মনের দ্বারা মানুষ যে কর্ম আরম্ভ করে, তা ন্যায্যই হোক অথবা অন্যায্যই হোক,এই পাঁচটি তার কারণ।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে উল্লিখিত 'ন্যায্য' এবং তার বিপরীত 'অন্যায্য' শব্দ দুটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ন্যায্য কর্ম শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং অন্যায্য কর্ম শাস্ত্রবিধির অবহেলা করে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু যে কাজই হোক না কেন, তার সম্যক্ অনুষ্ঠানের জন্য এই পঞ্চবিধ কারণ প্রয়োজন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তত্র-ত্রবম্ সতি কর্তারম্-আত্মানম্ কেবলম্ তু যঃ।
পশ্যতি-অকৃতবুদ্ধিত্বাৎ সঃ পশ্যতি দুর্মতিঃ।।১৬।।
অনুবাদঃ অতত্রব, কর্মের পাঁচটি কারণের কথা বিবেচনা না করে যে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে, বুদ্ধির অভাববশত সেই দুর্মতি যথাযথভাবে দর্শন করতে পারে না।
তাৎপর্যঃ কোন মূর্খ লোক বুঝতে পারে না যে, পরম বন্ধুরূপে পরমাত্মা তার হৃদয়ে বসে আছেন এবং তিনি তার সমস্ত কার্যকলাপ পরিচালনা করছেন। যদিও কর্মক্ষেত্র, কর্মকর্তা, প্রচেষ্টা ও ইন্দ্রিয়সমূহ --এই চারটি হচ্ছে জড় কারণ, কিন্তু পরম কারণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। সুতরাং চারটি জড় কারণকেই কেবল দেখা উচিত নয়, পরম নিমিত্ত যে কারণ, তাকেও দেখা উচিত। যে পরমেশ্বরকে দেখতে পায় না, সে নিজেকেই কর্তা বলে মনে করে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যস্য ন-অহংকৃতঃ ভাবঃ বুদ্ধিঃ-যস্য ন লিপ্যতে।
হত্বা-অপি সঃ ইমান্-লোকান্ হস্তি ন নিবধ্যতে।।১৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যাঁর অহঙ্কারের ভাব নেই এবং যাঁর বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি এই সমস্ত প্রাণীকে হত্যা করেও হত্যা করেন না এবং হত্যার কর্মফলে আবদ্ধ হন না।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে ভগবান অর্জুনকে বলছেন যে, যুদ্ধ না করার যে বাসনা তা উদয় হচ্ছে অহঙ্কার থেকে। অর্জুন নিজেকেই কর্তা বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু তিনি অন্তরে ও বাইরে পরম অনুমোদনের কথা বিবেচনা করেননি। কেউ যদি পরম অনুমোদন সম্বন্ধে অবগত হতে না পারে, তা হলে তিনি কেন কর্ম করবেন? কিন্তু যিনি কর্মের কারণ, নিজেকে কর্তা এবং পরমেশ্বর ভগবানকে পরম অনুমোদনকারী বলে জানেন, তিনি সব কিছু সুচারুভাবে করতে পারেন। এই ধরনের মানুষ কখনই মোহাচ্ছন্ন হন না। ব্যক্তিগত কার্যকলাপে এবং তার দায়িত্বেরর উদয় হয় অহঙ্কার, নাস্তিকতা অথবা কৃষ্ণভাবনার অভাব থেকে। যিনি পরমাত্মা বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের পরিচালনায় কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করে চলেছেন, তিনি যদি হত্যাও করেন, তা হলে তা হত্যা নয় এবং তিনি কখনই এই ধরনের হত্যা করার জন্য তার ফল ভোগ করনে না। কোন সৈনিক যখন তার সেনাপতির আদেশ অনুসারে শত্রুসৈন্যকে হত্যা করে, তখন তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। কিন্তু কোন সৈনিক যদি
তার নিজের ইচ্ছায় কাউকে হত্যা করে, তা হলে অবশ্যই বিচারলয়ে তার বিচার হবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
জ্ঞানম্ জ্ঞেয়ম্ ও পরিজ্ঞাতা ত্রিবিধা কর্ম-চোদনা।
করণম্ কর্ম কর্তা-ইতি ত্রিবিধঃ কর্ম-সংগ্রহঃ।।১৮।।
অনুবাদঃ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা--এই তিনটি কর্মের প্রেরণা ; করণ, কর্ম ও কর্তা-- এই তিনটি কর্মের আশ্রয়।
তাৎপর্যঃ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা-- এই তিনের অনুপ্রেরণায় আমাদের সমস্ত দৈনন্দিন কাজকর্ম সাধিত হয়। কাজের সহায়ক উপকরণাদি, আসল কাজটি এবং তার কর্মকর্তা--এদের বলা হয় কাজের উপাদান। মানুষের যে কোন কাজকর্মে এই উপাদানগুলি থাকে। কাজ করার আগে খানিকটা উদ্দীপনা থাকে, যাকে বলা হয় অনুপ্রেরণা। কাজটি ঘটবার আগে যে মীমাংসা উপনীত হওয়া যায়, তা হচ্ছে সূক্ষ্ম ধরনেরই কাজ। তারপর কাজটি ক্রিয়ার রূপ নেয়। প্রথমে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও ইচ্ছা -- এই সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ত্রবং তাকে বলা হয় উদ্দীপনা। কর্ম করার অনুপ্রেরণা যদি শাস্ত্র বা গুরুদেবের নির্দেশে থেকে আসে, তা হলে তা অভিন্ন। যখন অনুপ্রেরণা রয়েছে এবং কর্তা রয়েছে, তখন মনসহ ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে প্রকৃত কার্য সাধিত হয়। মন হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্র। যে কোন কার্যের সমস্ত উপাদানগুলিকে বলা হয় কর্মসংগ্রহ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
জ্ঞানম্ কর্ম চ কর্তা চ ত্রিধা-ত্রব গুণভেদতঃ।
প্রোচ্যতে গুণসংখ্যানে যথাবৎ-শৃণু তানি-অপি।১৯।।
অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা তিন প্রকার বলে কথিত হয়েছে। সেই সমস্তও যথাযথ রূপে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ চতুদর্শ অধ্যায়ের জড়া প্রকৃতির গুণের তিনটি বিভাগ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। সেই অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, সত্ত্বগুণ হচ্ছে জ্ঞাণোদ্ভাসিত, রজোগুণ হচ্ছে জড়- জাগতিক ও বৈষয়িক এবং তমোগুণ হচ্ছে আলস্য ও কর্ম বিমুখতার সহায়ক। জড়া প্রকৃতির সব কয়টি গুণই হচ্ছে বন্ধন। তাদের মধ্যে মুক্তি লাভ করা যায় না। এমন কি, সত্ত্বগুণের মধ্যেও মানুষ আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সপ্তদশ অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন গুণে অধিষ্ঠিত ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন পূজা পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্লোকে ভগবান প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রকমের জ্ঞান, কর্তা ও কর্ম সম্বন্ধে বর্ণনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্বভূতেষু যেন-একম্ ভাবম্-অব্যয়ম্-ঈক্ষতে।
অবিভক্তম্ বিভক্তেষু বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্।।২০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে এক অবিভক্ত চিন্ময় ভাব দর্শন হয়, অনেক জীব পরস্পর ভিন্ন হলেও চিন্ময় সত্তায় তারা এক, সেই জ্ঞানকে সাত্ত্বিক বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ যিনি দেবতা, মানুষ, পশু, পাখি, জলজ বা উদ্ভিজ্জ সমস্ত জীবের মধ্যেই এক চিন্ময় আত্মাকে দর্শন করেন, তিনি সাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী। প্রতিটি জীবের মধ্যে একটি চিন্ময় আত্মা রয়েছে, যদিও জীবগুলি তাদের পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের দেহ অর্জন করেছে। সপ্তম অধ্যায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, পরমেশ্বর ভগবানের পরা প্রকৃতি বা উৎকৃষ্ট শক্তি থেকেই প্রত্যেক জীবের দেহে জীবনী-শক্তির প্রকাশ ঘটে। এভাবেই প্রতিটি জীবদেহে জীনবীশক্তির-স্বরূপ এক উৎকৃষ্টা পরা প্রকৃতিকে দর্শন করাই হচ্ছে সাত্ত্বিক দর্শন। দেহের বিনাশ হলেও সেই জীবনী-শক্তিটি অবিনশ্বর। জড় দেহের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়। যেহেতু বদ্ধ জীবনে জড় অস্তিত্বের নানা রকম রূপ আছে, তাই জীবনীশক্তিকে ঐভাবে বহুধা বিভক্ত বলে মনে হয়। এই ধরনের নির্বিশেষ জ্ঞান হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধিরই একটি অঙ্গ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
পৃথক্ত্বনে তু যৎ-জ্ঞানম্ নানাভাবান্ পৃথগ্-বিধান্।
বেত্তি সর্বেষু ভূতেষু তৎ-জ্ঞানম্ বিদ্ধি রাজসম্।।২১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আত্মা অবস্থিত বলে পৃথকরূপে দর্শন হয়, সেই জ্ঞানকে রাজসিক বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ জড় দেহটি হচ্ছে জীব এবং
দেহটি নষ্ট হয়ে গেলে তার সঙ্গে সঙ্গে চেতনাও নষ্ট হয়ে যায় বলে যে ধারণা, তাকে বলা হয় রাজসিক জ্ঞান। সেই জ্ঞান অনুসারে দেহের বিভিন্নতার কারণ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন রকমের চেতনার প্রকাশ। এ ছাড়া পৃথক কোন আত্মা নেই, যার থেকে চেতনার প্রকাশ হয়। দেহটি হচ্ছে যেন সেই আত্মা এবং এই দেহের ঊর্ধ্বে পৃথক কোন আত্মা নেই। এই ধরনের জ্ঞান অনুসারে চেতনা হচ্ছে সাময়িক, অথবা স্বতন্ত্র কোন আত্মা নেই। কিন্তু সর্বব্যাপক এক আত্মা রয়েছে, যা পুর্ণ জ্ঞানময় এবং এই দেহটি হচ্ছে সাময়িক অজ্ঞনতার প্রকাশ, অথবা এই দেহের অতীত কোনও বিশেষ জীবত্মা অথবা পরমাত্মা নেই। এই ধরনের সমস্ত ধারণাগুলিকেই রজোগুণ-জাত বলে গণ্য করা হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তু কৃৎস্নবৎ-একস্মিন্ কার্যে সক্তম্-অহৈতুকম্।
অতত্ত্বার্থবৎ-অল্পম্ চ তৎ-তামসম্-উদাহৃতম্।।২২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আর যে জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত তত্ত্ব অবগত না হয়ে, কোন একটি বিশেষ কার্যে পরিপূর্ণের ন্যায় আসক্তির উদয় হয়, সেই তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ সাধারণ মানুষের 'জ্ঞান' সর্বদাই তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন, কারণ বদ্ধ জীবনে প্রত্যেক জীব তমোগুণে জন্মগ্রহণ করে থাকে। যে মানুষ শাস্ত্রীয় অনুশাসন মতে কিংবা শ্রীগুরুদেবের কাছ থেকে প্রামাণ্য সুত্রে জ্ঞানের বিকাশ সাধন করেনি, দেহ-সম্পর্কিত তার সেই জ্ঞান সীমাবদ্ধ। শাস্ত্রীয় অনুশাসন মতো কর্ম সাধনের কোন চিন্তাভাবনাই সে করে না। তার কাছে অর্থ-সম্পদই হচ্ছে ভগবান এবং জ্ঞান হচ্ছে দেহগত চাহিদার তৃপ্তিসাধন। পরম তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে এই ধরনের জ্ঞানের কোন সর্ম্পক নেই। এটি অনেকটা সাধারণ পশুর জ্ঞানের মতো--শুধুমাত্র আহার, নিদ্রা, আত্মরক্ষা ও মৈথুন সংক্রান্ত জ্ঞান। এই ধরণের জ্ঞানকে এখানে তমোগুণ-প্রসূত বলে অভিহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বলা যেতে পারে যে, এই দেহের উর্ধ্বে চিন্ময় আত্মা সংক্রান্ত যে জ্ঞান, তাকে বলা হয় সাত্ত্বিক জ্ঞান। মনোধর্ম ও জাগতিক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে যে সমস্ত মতবাদ ও ধারণা সম্পর্কিত জ্ঞান, তা হচ্ছে রজোগুণশ্রিত এবং কেবলমাত্র দেহসুুখ ভোগের উদ্দেশ্যে যে জ্ঞান, তা হচ্ছে তমোগুণাশ্রিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
নিয়তম্ সঙ্গরহিতম্-অরাগদ্বেষতঃ কৃতম্।
অফলপ্রেপ্সুনা কর্ম যৎ-তৎ-সাত্ত্বিকম্-উচ্যতে।।২৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ফলের কামনাশূন্য ও আসক্তি রহিত হয়ে রাগ ও দ্বেষ বর্জনপূর্বক যে নিত্যকর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়।
তাৎপর্যঃ শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুসারে সমাজের বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রম-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিধিবদ্ধ বৃত্তিমূলক কর্তব্যকর্মাদি অনাসক্তভাবে কর্তৃত্ববোধ বর্জন করে সম্পাদিত হলে এবং সেই কারণেই অনুরাগ অথবা বিদ্বেষমুক্ত হয়, পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি কিংবা আত্ম-উপভোগ রহিত হয়ে সম্পাদিত হলে, তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তু কামেপ্সুনা কর্ম সাহঙ্কারেণ বা পুনঃ।
ক্রিয়তে বহুলায়সম্ তৎ রাজসম্-উদাহৃতম্।।২৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কিন্তু ফলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ও অহঙ্কারযুক্ত হয়ে বহু কষ্টসাধ্য করে যে কর্মের অনুষ্ঠান হয়, সেই কর্ম রাজসিক বলে অভিহিত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অনুবন্ধম্ ক্ষয়ম্ হিংসাম্-অনপেক্ষ্য চ পৌরুষম্।
মোহাৎ-আরভ্যতে কর্ম যৎ-তামসম্-উচ্যতে।।২৫।।
অনুবাদঃভাবী বন্ধন, কর্ম জ্ঞানাদির ক্ষয়, হিংসা এবং নিজ সামর্থ্যের পরিণতির কথা বিবেচনা না করে মোহবশত যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে তামসিক কর্ম বলা হয়।
তাৎপর্য্যঃ রাষ্ট্রের কাছে বা পরমেশ্বর ভগবানের প্রতিনিধি যমদূতদের কাছে আমাদের সমস্ত কর্মের কৈফিয়ত দিতে হয়। দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্ম হয়ে থাকে ধ্বংসাত্মক, কারণ তা শাস্ত্র-নির্দেশিত ধর্মের অনুশাসনাদি ধ্বংস করে। অনেক ক্ষেত্রেই তা হিংসাভিত্তিক হয় এবং অন্য জীবকে কষ্ট দেয়। নিজের ব্যক্তিগত অভিঙ্গতার আলোকে এই ধরনের দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্ম হয়ে থাকে। একে বলা হয় মোহ এবং এই ধরনের সমস্ত মোহযুক্ত কাজই হচ্ছে তমোগুণ-জাত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মুক্তসঙ্গঃ-অনহংবাদী ধৃতি-উৎসাহ-সমন্বিতঃ।
সিদ্ধি-অসিদ্ধ্যোঃ-নির্বিকারঃ কর্তা সাত্ত্বিকঃ উচ্যতে।।২৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সমস্ত জড় আসক্তি থেকে মুক্ত, অহঙ্কারশূন্য, ধৃতি ও উৎসাহ সমন্বিত এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নির্বিকার --এরূপ কর্তাকেই সাত্ত্বিক বলা হয়।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত সর্বদাই প্রকৃতির জড় গুণগুলির অতীত। তাঁর উপরে ন্যস্ত হয়েছে যে সমস্ত কর্ম, সেগুলির ফলের আকাঙ্ক্ষা তিনি করেন না। কারণ, তিনি গর্ব ও অহঙ্কারের উর্ধ্বে বিরাজ করেন। তবুও সেই কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পুন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি সর্বদাই উৎসাহ নিয়ে কাজ করে চলেন। যে দুঃখ-দুর্দশা, বাধা-বিপত্তির সম্মূখীন তাঁকে হতে হয়, তার জন্য তিনি দুশ্চিন্তা করেন না। তিনি সর্বদাই উৎসাহী। তিনি সফলতা বা বিফলতা কোনটিরই পরোয়া করেন না। তিনি সুখ ও দুঃখ উভয়ের প্রতিই সমভাবাপন্ন। এই ধরনের কর্তা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
রাগী কর্মফল-প্রেপ্সুঃ-লুব্ধঃ হিংসাত্মকঃ-অশুচিঃ।
হর্ষশোকান্বিতঃ কর্তা রাজসঃ পরিকীর্তিতঃ।।২৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কর্মাসক্ত, কর্মফলে আকাঙ্ক্ষী, লোভী, হিংসাপ্রিয়, অশুচি, হর্ষ ও শোকযুক্ত যে কর্তা, সে রাজসিক কর্তা বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ বিশেষ কোন কর্মের প্রতি বা তার ফলের প্রতি কোন মানুষের গভীর আসক্ত হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে জড়-জাগতিক বিষয়াদি, ঘরবাড়ি ও স্ত্রী-পুত্রের প্রতি তাঁর অত্যধিক আসক্তি। এই ধরনের মানুষের উচ্চতর জীবনে উন্নীত হওয়ার কোন অভিলাষ নেই। তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এই পৃথিবীটিকে যতদূর সম্ভব জড়-জাগতিক পদ্ধতিতে আরামদায়ক করে তোলা। সে স্বভাবতই অত্যন্ত লোভী এবং সে মনে করে যে, যা কিছু সে লাভ করেছে তা সবই নিত্য এবং তা কখনই হারিয়ে যাবে না। এই ধরনেন মানুষ অত্যন্ত পরশ্রীকাতর এবং ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের জন্য যে কোন জঘন্য কাজ করতে প্রস্তুত। তাই, এই ধরনের মানুষ অত্যন্ত অশুচি এবং তার উপার্জন পবিত্র না অপিবত্র, সেই সম্বন্ধে সে পরোয়া করে না। তার কাজ যদি সফল হয়, তখন সে খুব খুশি হয় এবং তাঁর কাজ যদি বিফল হয়, তা হলে তার দুঃখের অন্ত থাকে না। এই ধরনের কর্তা রজোগুণে আচ্ছন্ন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অযুক্তঃ প্রাকৃতঃ স্তব্ধঃ শঠঃ নৈষ্কৃতিকঃ-অলসঃ।
বিষাদী দীর্ঘসূত্রী চ কর্তা তামসঃ উচ্যতে।। ২৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অনুচিত কার্যপ্রিয়, জড় চেষ্টাযুক্ত, অনস্র, শঠ, অন্যের অবমাননাকারী, অলস, বিষাদযুক্ত ও দীর্ঘসূত্রী যে কর্তা, তাকে তামসিক কর্তা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুসারে আমরা জানতে পারি কি ধরনের কর্ম করা উচিত এবং কি ধরনের কর্ম করা উচিত নয়। যারা এই সমস্ত অনুশাসন মানে না, তারা অনুচিত কর্মে প্রবৃত্ত হয়। এই ধরনের মানুষেরা সাধারনত বিষয়ী হয়। তারা প্রকৃতির গুণ অনুসারে কর্ম করে, কিন্তু শাস্ত্রের অনুশাসন অনুসারে কাজ করে না। এই ধরনের কর্মীরা সাধারণত খুব একটা ভদ্র হয় না। সাধারণত তারা অত্যন্ত ধূর্ত এবং অপরকে অপদস্থ করতে খুব পটু। তারা অত্যন্ত অলস, তাদেরকে কাজ করতে দেওয়া হলেও ঠিকমতো করে না এবং পরে করবো বলে তা সরিয়ে রাখে। তাই তাদের বিষণ্ণ বলে মনে হয়। তারা যে - কোন কার্য সম্পাদনে বিলম্ব করে; যে কাজটি এক ঘন্টার মধ্যে করা সম্ভব, তা তারা বছরের পর বছর ফেলে রাখে। এই ধরনের কর্মীরা তমোগুণে অধিষ্ঠিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
বুদ্ধেঃ-ভেদম্ ধৃতেঃ-চ-ত্রব গুণতঃ-ত্রিবিধম্ শৃণু।
প্রোচ্যমানম্-অশেষেণ পৃখক্ত্বেন ধনঞ্জয়।।২৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ধনঞ্জয়! জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ অনুসারে বুদ্ধির ও ধৃতির যে ত্রিবিধ ভেদ আছে, তা আমি বিস্তারিতভাবে ও পৃথকভাবে বলছি, তুমি শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির গুণ অনুসারে তিনটি ভাগে বিভক্ত জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা সম্বন্ধে বর্ণনা করে, ভগবান এখন একইভাবে কর্তার বুদ্ধি ও ধৃতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
প্রবৃত্তিম্ চ নিবৃত্তিম্ চ কার্য-অকার্যে ভয়-অভয়ে।
বন্ধম্ মোক্ষম্ চ যা বেত্তি বুদ্ধিঃ সা পার্থ সাত্ত্বিকী।।৩০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! যে বুদ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, কার্য ও অকার্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মুক্তি --- এই সকলের পার্থক্য জানতে পারা যায়, সেই বুদ্ধি সাত্ত্বিকী।
তাৎপর্যঃ কর্ম যখন শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়, তখন তাকে বলা হয় প্রবৃত্তি বা করণীয় কর্ম এবং যে কর্ম করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি, তা করা উচিত নয়। যে মানুষ শাস্ত্রের নির্দেশ সম্বন্ধে অবগত নয়, সে কর্ম এবং তার প্রতিক্রিয়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বুদ্ধির দ্বারা পার্থক্য নিরূপণের যে উপলব্ধির বিকাশ হয়, তা হচ্ছে সত্ত্বগুণাশ্রিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যয়া দর্মম্-অধর্মম্ চ কার্যম্ চ-অকার্যম্-ত্রব চ।
অযথাবৎ প্রজানাতি বুদ্ধিঃ সা পার্থ রাজসী।।৩১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে বুদ্ধির দ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য আদির পার্থক্য অসম্যক্ রূপে জানতে পারা যায়, সেই বুদ্ধি রাজসিকী।
শ্রীভগবান্ উবাচ্
অধর্মম্ ধর্মম্-ইতি যা মন্যতে তমসা-আবৃতা।
সর্বার্থান্ বিপরীতান্-চ বুদ্ধিঃ সা পার্থ তামসী।।৩২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্খ! যে বুদ্ধি অধর্মকে ধর্ম এবং সমস্ত বস্তুকে বিপরীত বলে মনে করে, তমসাবৃত সেই বুদ্ধি তামসিকী।
তাৎপর্যঃ তমোগুণশ্রিত বুদ্ধিবৃত্তি সব সময়ে য়েভাবে কাজ করা উচিত, তার বিপরীতটাই করে। যেগুলি আসলে ধর্ম নয়, সেগুলিকেই তারা ধর্ম বলে মেনে নেয়, আর প্রকৃত ধর্মকে বর্জন করে। তামসিক লোকেরা মহাত্মাকে মনে করে সাধারণ মানুষ, আর সাধারণ মানুষকে মহাত্মা বলে মেনে নেয়। সকল কাজেই তারা কেবল ভুল পথটি গ্রহণ করে। তাই, তাদের বুদ্ধি তমোগুণে আচ্ছন্ন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ধৃত্যা যয়া ধারয়তে মনঃ-প্রাণ-ইন্দ্রিয়-ক্রিয়াঃ।
যোগেন-অব্যভিচারিণ্যা ধৃতিঃ সা পার্থ সাত্ত্বিকী।।৩৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! যে অব্যভিচারিণী ধৃতি যোগ অভ্যাস দ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াসকলকে ধারণ করে, সেই ধৃতিই সাত্ত্বিকী।
তাৎপর্যঃ যোগ হচ্ছে পরমাত্মাকে জানার একটি উপায়। ধৃতি বা দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে যিনি পরম আত্মাতে ত্রকাগ্র হয়েছেন এবং মন, প্রাণ ও সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে পরমেশ্বরে একাগ্র করেছেন, তিনি ভক্তিযোগে কৃষ্ণভাবনার সঙ্গে যুক্ত। এই ধরনের ধৃতি সত্ত্বগুণাশ্রিত। এখানে অব্যভিচারিণ্যা কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই শব্দটির দ্বারা সেই সমস্ত মানুষদের কথা বলা হচ্ছে, যাঁরা কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা আর অন্য কোন কার্যকলাপের দ্বারা কখনই পথভ্রষ্ট হন না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যয়া তু ধর্মকামার্থান্ ধৃত্যা ধারয়তে-অর্জুন।
প্রসঙ্গেন ফলাকাঙ্ক্ষী ধৃতিঃ সা পার্থ রাজসী।।৩৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে অর্জুন! হে পার্থ! যে ধৃতি ফলাকাঙ্ক্ষার সহিত ধর্ম, অর্থ ও কামকে ধারণ করে, সেই ধৃতি রাজসী।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ সব রকম ধর্ম অনুষ্ঠান বা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সর্বদাই ফলের আকাঙ্ক্ষা করে, যার একমাত্র বাসনা হচ্ছে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করা এবং যার মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়গুলি এভাবেই নিযুক্ত হয়েছে, সে রজোগুণাশ্রিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যয়া স্বপ্নম্ ভয়ম্ শোকম্ বিষাদম্ মদম্-ত্রব চ।
ন বিমুঞ্চতি দুর্মেধা ধৃতিঃ সা পার্থ তামসী।।৩৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! যে ধৃতি স্বপ্ন, ভয়, শোক, বিষাদ, মদ আদিকে ত্যাগ করে না, সেই বুদ্ধিহীনা ধৃতিই তামসী।
তাৎপর্যঃ এমন সিদ্ধান্ত করা উচিত নয় যে, সাত্ত্বিক মানুষেরা স্বপ্ন দেখে না। এখানে স্বপ্ন বলতে বোঝাচ্ছে অত্যধিক নিদ্রা। সত্ত্ব, রজ বা তম যে গুণই হোক না কেন, স্বপ্ন সর্বদাই থাকে। স্বপ্ন দেখাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যারা বেশি না ঘুমিয়ে পারে না, যারা জড় জগৎকে ভোগ করার গর্বে গর্বিত না হয়ে পারে না, যারা জড় জগতে কর্তৃত্ব করার স্বপ্ন দেখছে এবং যাদের প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয় আদি সেভাবেই নিযুক্ত, তারা তমোগুণের ধৃতি দ্বারা আচ্ছন্ন বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সুখম্ তু-ইদানীম্ ত্রিবিধম্ শৃনু মে ভরতর্ষভ।
অভ্যাসাৎ রমতে যত্র দুঃখ-অন্তম্ চ নিগচ্ছতি।।৩৬।।
অনুবাদঃ হে ভারতর্ষভ! এখন তুমি আমার কাছে ত্রিবিধ সুখের বিষয় শ্রবণ কর। বদ্ধ জীব পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা সেই সুখে রমন করে এবং যার দ্বারা সমস্ত দুঃখের অন্তলাভ করে থাকে।
তাৎপর্যঃ বদ্ধ জীব বারবার জড় সুখ উপভোগ করতে চেষ্টা করে। এভাবেই সে চর্বিত বস্তু চর্বণ করে। কিন্তু কখন কখন এই ধরনের সুখ উপভোগ করতে করতে কোন মহাত্মার সঙ্গ লাভ করার ফলে সে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, বদ্ধ জীব সর্বদাই কোন না কোন রকমের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের চেষ্টায় রত থাকে। কিন্তু সাধুসঙ্গের প্রভাবে সে যখন বুঝতে পারে যে, তা কেবল একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি, তখন সে তার যথার্থ কৃষ্ণভাবনার জাগরিত হয়ে ওঠে। তখন সে এভাবেই আবর্তনশীল তথাকথিত সুখের কবল থেকে মুক্ত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তৎ-অগ্রে বিষম্ ইব পরিণামে-অমৃত-উপমম্।
তৎ-সুখম্ সাত্ত্বিকম্ প্রোক্তম্-আত্ম-বুদ্ধি-প্রসাদজম্।।৩৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে সুখ প্রথমে বিষের মতো কিন্তু পরিণামে অমৃততুল্য এবং আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির নির্মলতা থেকে জাত, সেই সুখ সাত্ত্বিক বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ আত্মজ্ঞান লাভের পথে মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করে ভগবানের প্রতি মনকে ত্রকাগ্র করবার জন্য নানা রকমের বিধি-নিষেধের অনুশীলন করতে হয়। এই সমস্ত বিধিগুলি অত্যন্ত কঠিন, বিষের মতো তিক্ত। কিন্তু কেউ যদি এই সমস্ত বিধিগুলির অনুশীলনের মাধ্যমে সাফাল্য অর্জন করে অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি প্রকৃত অমৃত পান করতে
শুরু করেন এবং জীবনকে যথার্থভাবে উপভোগ করতে পারেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
বিষয়-ইন্দ্রিয়-সংযোগাৎ-যৎ-তৎ-অগ্রে-অমৃতোপমম্।
পরিণামে বিষম্ ইব তৎ-সুখম্ রাজসম্ স্মৃতম্।।৩৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন-বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে সুখ প্রথমে অমৃতের মতো এবং পরিণামে বিষের মতো অনুভূত হয়, সেই সুখকে রাজসিক বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ একজন যুবক যখন একজন যুবতীর সান্নিধ্যে আসে, তখন যুবকটির ইন্দ্রিয়গুলি যুবতীটিকে দেখবার জন্য, তাকে স্পর্শ করবার জন্য এবং যৌন সম্ভোগ করবার জন্য তাকে প্ররোচিত করতে থাকে। এই ধরনের ইন্দ্রিয়সুখ প্রথমে অত্যন্ত সুখদায়ক হতে পারে, কিন্তু পরিণামে অথবা কিছু কাল পরে, তা বিষবৎ হয়ে উঠে। তারা একে অপরকে ছেড়ে চলে যায় অথবা তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তখন শোক, দুঃখ আদির উদয় হয়। এই ধরনের সুখ সর্বদাই রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের মিলনের ফলে উদ্ভুত যে সুখ, তা সর্বদাই দুঃখদায়ক এবং তা সর্বোতভাবে বর্জন করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-অগ্রে চ-অনুবন্ধে চ সৃখম্ মোহনম্-আত্মনঃ।
নিদ্রা-আলস্য-প্রমাদ-উত্থম্ তৎ-তামসম্-উদাহৃতম্।।৩৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে সুখ প্রথমে ও শেষে আত্মার মোহজনক এবং যা নিদ্রা,আলস্য ও প্রমাদ থেকে উৎপন্ন হয়, তা তামসিক সুখ বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ আলস্য ও নিদ্রার যে সুখ তা অবশ্যই তামসিক এবং যে জানে না কিভাবে কর্ম করা উচিত এবং কিভাবে কর্ম করা উচিত নয়, তাও তামসিক। তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন মানুষদের কাছে সবই মোহজনক। তার শুরুতেও সুখ নেই এবং পরিণতিতেও সুখ নেই। রজোগুণে আচ্ছন্ন মানুষদের বেলায় শুরুতে এক ধরনের ক্ষণিক সুখ থাকতে পারে এবং পরিণামে তা হয় দুঃখদায়ক, কিন্তু তামসিক মানুষদের বেলায় শুরু ও শেষ সর্ব অবস্থাতেই কেবল দুঃখ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন তৎ-অস্তি পৃথিব্যাম্ বা দিবি দেবেষু বা পুনঃ।
সত্ত্বম্ প্রকৃতিজৈঃ-মুক্তম্ যৎ-ত্রভিঃ স্যাৎ ত্রিভিঃ-গুণৈঃ।।৪০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এই পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে অথবা স্বর্গে দেবতাদের মধ্যে এমন কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, যে প্রকৃতিজাত এই ত্রিগুণ থেকে মুক্ত।
তাৎপর্যঃ ভগবান এখানে সারা জগৎ
জুড়ে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের যে সমষ্টিগত প্রভাব, তার সারমর্ম বিশ্লেষণ করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ব্রাক্ষণ-ক্ষত্রিয়-বিশাম্ শূদ্রাণাম্ চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাব-প্রভবৈঃ-গুণৈঃ।।৪১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পরন্তপ! স্বভাবজাত গুণ অনুসারে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদেব কর্মসমূহ বিভক্ত হয়েছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শমঃ দমঃ-তপ শৌচম্ ক্ষান্তি-আর্জবম্-ত্রব চ।
জ্ঞানম্ বিজ্ঞানম্-আস্তিক্যম্ ব্রক্ষ-কর্ম স্বভাবজম্।।৪২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান,
বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এগুলি ব্রাক্ষণদের স্বভাবজাত কর্ম।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শৌর্যম্ তেজঃ দাক্ষ্যম্ যুদ্ধে চ- অপি-অপলায়নম্।
দানম্-ঈশ্বর-ভাবঃ-চ ক্ষাত্রম্ কর্ম স্বভাবজম্।।৪৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে অপলায়ন, দান ও শাসন ক্ষমতা--এগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম।
শ্রীভগবান্ উবাচ
কৃষি-গোরক্ষ্য-বাণিজ্যম্ বৈশ্য-কর্ম স্বভাবজম্।
পরিচর্যা-আত্মকম্ কর্ম শূদ্রস্য-অপি স্বভাবজম্।।৪৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য এই কয়েকটি বৈশ্যের স্বভাবজাত কর্ম এবং পরিচর্যাত্মক কর্ম শূদ্রের স্বভাবজাত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
স্বে স্বে কর্মণি-অভিরতঃ সংসিদ্ধিম্ লভতে নরঃ।
স্বকর্ম-নিরতঃ সিদ্ধিম্ যথা বিন্দতি তৎ-শৃণু।।৪৫।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- নিজ নিজ কর্মে নিরত মানুষ সিদ্ধি লাভ করে থাকে। স্বীয় কর্মে যুক্ত মানুষ যেভাবে সিদ্ধি লাভ করে, তা শ্রবণ কর।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যতঃ প্রবৃত্তিঃ-ভূতানাম্ যেন সর্বম্-ইদম্ ততম্।
স্বকর্মণা তম্-অভ্যর্চ্য সিদ্ধিম্ বিন্দতি মানবঃ।।৪৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যাঁর থেকে সমস্ত জীবের পূর্ব বাসনারূপ প্রবৃত্তি হয়, যিনি ত্রই সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত
আছেন, তাঁকে মানুষ তার নিজের কর্মের দ্বারা অর্চন করে সিদ্ধি লাভ করে।
তাৎপর্যঃ পঞ্চদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সমস্ত জীবই পরমেশ্বর ভগবানের অণুসদৃশ অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ। এভাবেই ভগবান সমস্ত জীবের আদি উৎস। বেদান্তসূত্রে তার সত্যতা প্রতিপন্ন হয়েছে --জন্মাদ্যস্য যতঃ। সুতরাং, পরমেশ্বর ভগবান প্রত্যেকটি জীবের প্রাণের উৎস। ভগবদ্ গীতার সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে,পরমেশ্বর ভগবান তাঁর দুটি শক্তি--অন্তরঙ্গা শক্তি ও বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা সর্বব্যাপ্ত। তাই, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানকে তাঁর শক্তিসহ আরাধনা করা। সাধারণত বৈষ্ণব ভক্তেরা ভগবানকে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি সহ উপাসনা করেন। তাঁর বহিরঙ্গা শক্তি হচ্ছে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির বিকৃত প্রতিবিম্ব। বহিরঙ্গা শক্তিটি হচ্ছে পটভূমি, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান পরমাত্মা রূপে নিজেকে বিস্তার করে সর্বত্র বিরাজমান।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শ্রেয়ান্ স্বধর্মঃ বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বানুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তম্ কর্ম কুর্বন্-ন-আপ্নোতি কিল্বিষম্।।৪৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- উত্তম রূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা অসম্যক রূপে অনুষ্ঠিত স্বধর্মই শ্রেয়। মানুষ স্বভাব-বিহিত কর্ম করে কোন পাপ প্রাপ্ত হয় না।
তাৎপর্যঃ মানুষের স্বধর্ম ভগবদ্ গীতায় নির্দিষ্ট হয়েছে। পৃুর্ববর্তী শ্লোকগুলিতে
ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে যে,বিশেষ বিশেষ প্রকৃতির গুণ অনুসারে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্তব্যকর্ম নির্ধারিত হয়েছে। অপরের ধর্মকর্ম অনুকরণ করা কারও পক্ষে উচিত নয়। যে মানুষ স্বাভাবিকভাবে শূদ্রের কাজকর্ম করার প্রতি আকৃষ্ট, তার পক্ষে কৃত্রিমভাবে নিজেকে ব্রাক্ষণ বলে জাহির করা উচিত নয়। তার জন্ম যদি ব্রাক্ষণ পরিবারেও হয়ে থাকে, তা হলেও নয়। এভাবেই স্বভাব অনুসারে তার কর্ম করা উচিত। কোন কাজই ঘৃণ্য নয়, যদি তা পরমেশ্বর ভগবানের সেবার জন্য অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাক্ষণের বৃত্তিমূলক কর্তব্য অবশ্যই সাত্ত্বিক। কিন্তু কেউ যদি স্বভাবগতভাবে সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন না হয়, তা হলে তার ব্রাক্ষণের বৃত্তি অনুসরণ করা উচিত নয়। ক্ষত্রিয় বা শাসককে কত রকমের ভয়ানক কাজ করতে হয়। তাকে হিংসার আশ্রয় নিয়ে শক্র হত্যা করতে হয় এবং কুটনীতির খাতিরে কখনও কখনও তাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়। এই ধরনের হিংসা ও ছলনা রাজনীতির মধ্যে থাকেই। কিন্তু তা বলে ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম পরিত্যাগ করে ব্রাক্ষণের ধর্ম আচরণ করা উচিত নয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সহজম্ কর্ম কৌন্তেয় সদোষম্-অপি ন ত্যজেৎ।
সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেন-অগ্নিঃ-ইব-আবৃতাঃ।।৪৮।।
শ্রীভগবান্ উবাচঃ হে কৌন্তেয়! সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও ত্যাগ করা উচিত নয়। যেহেতু অগ্নি যেমন ধূমের দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই সমস্ত কর্মই দোষের দ্বারা আবৃত থাকে।
তাৎপর্যঃ মায়াবদ্ধ জীবনে সব কাজই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কুলষিত। ত্রমন কি কেউ যদি ব্রাক্ষণও হন, তা হলেও তাঁকে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হয় যাতে পশু বলি দিতে হয়। তেমনই, ক্ষত্রিয় যতই পুণ্যবান হোন না কেন, তাকে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। তিনি তা পরিহার করতে পারেন না। তেমনই, ত্রকজন বৈশ্য, তা তিনি যতই পুণ্যবান হোন না কেন, ব্যবসায়ে টিকে থাকতে হলে তাঁর লাভের অঙ্কটি তাঁকে কখনও লুকিয়ে রাখতে হয় অথবা কখনও তাঁকে কালোবাজারি
করতে হয়। এগুলি অবশ্যম্ভাবী। এগুলিকে পরিহার করা যায় না। তেমনই, কোন শূদ্রকে যখন কোন অসৎ
মনিবের দাসত্ব করতে হয়, তখন তাকে তার মনিবের আজ্ঞা পালন করতে হয়,যদিও তা করা উচিত নয়।
এই সমস্ত ক্রটি সত্ত্বেও, মানুষকে তার স্বধর্ম করে যেতে হয়, কেন না সেগুলি
তার নিজেরই স্বভাবজাত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অসক্তবুদ্ধিঃ সর্বএ জিতাত্মা বিগতস্পৃহঃ।
নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিম্ পরমাম্ সন্ন্যাসেন-অধিগচ্ছতি।।৪৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- জড় বিষয়ে আসক্তিশূন্য বুদ্ধি, সংযতচিত্ত ও ভোগস্পৃহাশূন্য ব্যক্তি স্বরূপগত কর্ম ত্যাগপূর্বক নৈষ্কর্মরূপ পরম সিদ্ধি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ যথার্থ ত্যাগের অর্থ হচ্ছে নিজেকে সর্বদা পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা। তাই মনে করা উচিত যে, কর্মফল ভোগ করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আমরা যেহেতু পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ, তাই আমাদের সমস্ত কর্মের প্রকৃত ভোক্তা হচ্ছেন ভগবান। সেটিই যথার্থ কৃষ্ণভাবনা । কৃষ্ণভাবনাময় নিয়োজিত মানুষ হচ্ছেন যথার্থ সন্ন্যাসী। এই মনোভাব অবলম্বন করার ফলে মানুষ যথার্থ শান্তি লাভ করতে পারেন। কারণ, তিনি তখন যথার্থভাবে পরমেশ্বর ভগবানের জন্য কাজ করেন। এভাবেই তিনি আর কোন রকম
বিষয়ে প্রতি আসক্ত হন না। তিনি তখন ভগবৎ সেবালব্ধ দিব্য আনন্দ ব্যতীত আর কোন রকম সুখভোগের প্রতি অনুরক্ত হন না। বলা হয় যে, সন্ন্যাসী তাঁর পূর্বকৃত সমস্ত কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত তথাকথিত সন্ন্যাস গ্রহণ না করেই, আপনা থেকেই এই মুক্ত স্তরে অধিষ্ঠিত হন। চিত্তবৃত্তির এই অবস্থাকে বলা হয় যোগারূঢ় বা যোগের সিদ্ধ অবস্থা। এই সম্বন্ধে তৃতীয় অধ্যায়ে প্রতিপন্ন হয়েছে, যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাৎ --যিনি আত্মাতেই তৃপ্ত, তাঁর কর্মফল ভোগের আর কোন ভয় থাকে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সিদ্ধিম্ প্রাপ্তঃ যথা ব্রহ্ম তথা-আপ্নোতি নিবোধ মে।
সমাসেন-এব কৌন্তেয় নিষ্ঠা জ্ঞানস্য যা পরা।।৫০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে কৌন্তেয়! নৈষ্কর্ম সিদ্ধি লাভ করে জীব যেভাবে জ্ঞানের পরা নিষ্ঠারূপ ব্রহ্মকে লাভ করেন, তা আমার কাছে সংক্ষেপে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনের কাছে বর্ণনা করেছেন কিভাবে মানুষ পরম পুরুষোত্তম ভগবানের জন্য সমস্ত কাজ করার মাধ্যমে কেবল তার বৃত্তিমূলক কর্মে যুক্ত থেকে অনায়াসে পরম সিদ্ধি স্তর লাভ করতে পারে।
শুদুমাত্র পরমেশ্বর ভগবানের তৃপ্তি সাধনের জন্য কর্মফল ত্যাগ করার মাধ্যমে অনায়াসে ব্রহ্ম-উপলব্ধির পরম স্তর লাভ করা যায়। সেটিই হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধির পন্থা। জ্ঞানের যথার্থ সিদ্ধি হচ্ছে শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনা লাভ করা, যা পূরবর্তী শ্লোকগুলিতে বর্ণনা করা হয়েছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
বুদ্ধ্যা বিশুদ্ধয়া যুক্তঃ ধৃত্যে-আত্মনম্ নিয়ম্য।
শব্দাদীন্ বিষয়ান্-ত্যক্ত্বা রাগ-দ্বেষৌ ব্যুদস্য চ।।৫১।।
বিবিক্তসেবী লঘ্বাশী যতবাক্-কার-মানসঃ।
ধ্যানযোগপরঃ নিত্যম্ বৈরাগ্যম্ সমুপাশ্রিতঃ।।৫২।।
অহঙ্কারম্ বলম্ দর্পম্ কামম্ ক্রোধম্ পরিগ্রহম্।
বিমুচ্য নির্মমঃ শান্তঃ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে।।৫৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে মনকে ধৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে, শব্দ আদি ইন্দ্রিয় বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে, রাগ ও দ্বেষ বর্জন করে, নির্জন স্থানে বাস করে, অল্প আহার করে, দেহ, মন ও বাক্ সংযত করে, সর্বদা ধ্যানযোগ যুক্ত হয়ে বৈরাগ্য আশ্রয় করে, অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ, পরিগ্রহ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে, মমত্ব বোধশূন্য শান্ত পুরুষ ব্রহ্ম- অনুভবে সর্মথ হন।
তাৎপর্যঃ বুদ্ধির সাহায্যে নির্মল হলে মানুষ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হন। এভাবেই মানুষ চিত্তবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সর্বদাই সমাধিস্থ থাকেন। তখন আর তিনি ইন্দ্রিয়-তর্পণের বিষয়ের প্রতি আসক্ত হন না এবং তখন তিনি তাঁর কাজকর্মে রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত হন। এই ধরনের নিরাসক্ত মানুষ স্বভাবতই নিরিবিলি জায়গায় থাকতে ভালবাসেন। তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করেন না এবং তিনি তাঁর দেহ ও মনের সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে রাখেন। তখন আর তাঁর মিথ্যা অহঙ্কার থাকে না, কারণ তিনি তখন তাঁর দেহকে তাঁর স্বরূপত বলে মনে করেন না। নানা রকম জড় পর্দাথ আহরণ করে তাঁর দেহটিকে স্থূল ও শক্তিশালী করে তোলার কোন বাসনাও তখন আর তার থাকে না। যেহেতু তখন আর তাঁর দেহাত্মবুদ্ধি থাকে না, তাই মিথ্যা দর্পও থাকে না। পরমেশ্বর ভগবানের কৃপায় মানুষ তখন যা পায়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন এবং ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের অভাব হলে ক্রুদ্ধ হন না। ইন্দ্রিয়সুখ বিষয় আহরণ করার কোনও রকম প্রচেষ্টা তিনি তখন করেন না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।
সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিম্ লভতে পরাম্।।৫৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তি কোন কিছুর জন্য শোক করেন না বা আকাঙ্ক্ষা করেন না। তিনি সমস্ত প্রাণীর প্রতি সমদর্শী হয়ে আমার পরা ভক্তি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ নির্বিশেষবাদীর কাছে ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া বা ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়াটা হচ্ছে শেষ কথা। কিন্তু সবিশেষবাদী বা শুদ্ধ ভক্তদের শুদ্ধ ভক্তিতে যুক্ত হবার জন্য আরও অগ্রসর হতে হয়। এর অর্থ হচ্ছে যে, শুদ্ধ ভক্তিযোগে যিনি ভগবানের সেবায় যুক্ত, তিনি ইতিমধ্যেই মুক্ত হয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মভূত হয়ে ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মভূত না হলে তাঁর সেবা করা যায় না। ব্রহ্ম- অনুভূতিতে সেবা ও সেবকের মধ্যে কোন ভেদ নেই, তবুও উচ্চতর চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের মধ্যে ভেদ রয়েছে।
জড় জীবনের ধারণা নিয়ে কেউ যখন ইন্দ্রিয়- তৃপ্তির জন্য কর্ম কররন, তাতে দুর্ভোগ থাকে। কিন্তু চিৎ- জগতে যখন কেউ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করেন, সেই সেবায় কোন দুর্ভোগ নেই। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত কোন কিছুর জন্য অনুশোচনা অথবা আকাঙ্ক্ষা করেন না। যেহেতু ভগবান পূর্ণ, তাই জীব যখন ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হন, তখন তিনিও পূর্ণতা প্রাপ্ত হন। তিনি তখন সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত নির্মল নদীর মতো। কৃষ্ণভক্ত যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কোন কিছুই চিন্তা করেন না। জড় -সুখভোগের প্রতি তাঁর আর কোন আসক্তি থাকে না। কারণ, তিনি জানেন যে, প্রতিটি জীবই হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ এবং তাই তারা নিত্য দাস। তিনি জড় জগতে কাউকেই উচ্চ অথবা নীচ বলে গণ্য করেন না। উচ্চ-নীচবোধ ক্ষণস্থায়ী এবং
এই ক্ষণস্থায়ী অনিত্য জগতের সঙ্গে ভক্তের কেন সর্ম্পক থাকে না। তাঁর কাছে পাথর আর সোনার একই দাম। এটিই হচ্ছে ব্রহ্মভূত স্তর এবং শুদ্ধ ভক্ত অনায়াসে এই স্তরে উন্নীত হতে পারেন। ভগবদ্ভক্তির এই পরম পবিত্র স্তরে পৌছলে, পরব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া বা ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নাশ করার ধারণা অত্যন্ত ঘৃন্য বলে মনে হয় এবং স্বর্গ লাভের আকাঙ্ক্ষাকে আকাসকুসুম বলে মনে হয়। তখন ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষদাঁত ভাঙা সাপের মতোই প্রতিভাত হয়। বিষদাঁত ভাঙা সাপের কাছ থেকে যেমন কোন রকম ভয় থাকে না, তেমনই ইন্দ্রিয়গুলি থেকে আর কোন ভয়ের আশাঙ্ক্ষা থাকে না, যখন তারা আপনা থেকেই যংযত হয়। জড় জগতর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যারা ভবরোগে ভুগছে, তাদের পক্ষে এই জগৎ দুঃক্ষময়। কিন্তু ভগবদ্ভক্তের কাছে সমগ্র জগৎটি বৈকুণ্ঠ বা চিৎ- জগতের মতো। এই জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষও ভক্তের কাছে একটি পিপীলিকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু , যিনি এই যুগে শুদ্ধ ভক্তি প্রচার করেছেন, তাঁর কৃপায় ভগবদ্ভক্তির এই পরম নির্মল স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ভক্ত্যা মাম্-অভিজানাতি যাবান্ যঃ চ অস্মি তত্ত্বতঃ।
ততঃ মাম্ তত্ত্বতঃ জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।৫৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ভক্তির দ্বারা কেবল স্বরূপগত আমি যে রকম হই, সেরূপে আমাকে কেউ তত্ত্বত জানতে পারেন। এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বত জেনে, তার পরে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।
তাৎপর্যঃ অভক্তেরা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কখনই জানতে পারে না। মনোধর্ম প্রসূত জল্পনা-কল্পনার দ্বারাও তাঁকে জানেত পারা যায় না। কেউ যদি পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে চায়, তা হলে তাকে শৃদ্ধ ভক্তের তত্ত্ববধানে শুদ্ধ ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে পরম পুরুষোত্তম ভগবান সম্বন্ধীয় তত্ত্বজ্ঞান তার কাছে সর্বদাই আচ্ছাদিত থেকে যাবে। ভগবদ্ গীতায় (৭-২৫) আগেই বলা হয়েছে, নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য-- তিনি সকলের কাছে প্রকাশিত হন না। কেবল পণ্ডিতের দ্বারা অথবা মনোধর্ম -প্রসূত
জল্পনা-কল্পনার দ্বারা কেউ ভগবানকে জানতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযেগে যিনি ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, তিনিই কেবল শ্রীকৃষ্ণকে তত্ত্বত জানতে পারেন। এই জ্ঞান লাভে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কোন সাহায্য করতে পারে না।
কৃষ্ণতত্ত্বের বিজ্ঞান সম্বন্ধে যিনি পূর্ণরূপে অবগত হয়েছেন, তিনিই শ্রীকৃষ্ণের আলয় চিন্ময় ভগবৎ - ধামে প্রবেশ করার যোগ্য হন। ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার অর্থ স্বাতন্ত্র্যহীন হওয়া নয়। সেই স্তরেও ভগবৎ- সেবা রয়েছে এবং যেখানে ভক্তিযুক্ত ভগবৎ- সেবা রয়েছে, সেখানে অবশ্যই ভগবান, ভক্ত ও ভক্তিযোগের পন্থা রয়েছে। এই প্রকার জ্ঞানের কখনও বিনাশ হয় না, এমন কি মুক্তির পরেও বিনাশ হয় না।মুক্তির অর্থ হচ্ছে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্ব-কর্মাণি-অপি সদা কুর্বাণঃ মৎ-ব্যপাশ্রয়ঃ।
মৎ-প্রসাদাৎ-অবাপ্নোতি শাশ্বতম্ পদম্-অব্যয়ম্।।৫৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আমার শুদ্ধ ভক্ত সর্বদা সমস্ত কর্ম করেও আমার প্রসাদে নিত্য অব্যয় ধাম লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ মদ্ ব্যাপাশ্রয় কথাটির অর্থ হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের আশ্রয়। জড় কলুষমুক্ত হবার জন্য শুদ্ধ ভক্ত পরমেশ্বর ভগবান বা তাঁর প্রতিনিধি গুরুদেবের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করেন। শুদ্ধ ভক্তের ভগবৎ সেবার কোন সময়-সীমা নেই। তিনি সর্বদাই চব্বিশ ঘন্টা পূর্ণরূপে ভগবানের নির্দেশ অনুসারে ভগবানের সেবায় যুক্ত। যে ভক্ত এভাবেই কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, ভগবান তাঁর প্রতি অত্যন্ত সদয়। সমস্ত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও পরিণামে তিনি ভগবৎ-ধামে কৃষ্ণলোকে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর ভগবৎ - ধাম প্রাপ্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। সেই পরম ধামে কোন পরিবর্তন নেই। সেখানে সবকিছুই নিত্য, অবিনশ্বর ও পূর্ণ জ্ঞানময়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরঃ।
বুদ্ধিযোগম্-উপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততম্ ভব।।৫৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- তুমি বুদ্ধির দ্বারা সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে, বুদ্ধিযোগের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক সর্বদাই মদ্গতচিত্ত হও।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কেউ যখন কর্ম করেন, তখন তিনি নিজেকে সমস্ত জগতের প্রভু বলে মনে করে কাজ করেন না। তিনি কাজ করেন সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের
দ্বারা পরিচালিত, তাঁর একান্ত অনুগত দাসরূপে। দাসের কোনও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকে না। তিনি কাজ করেন কেবল তাঁর প্রভুর আদেশ অনুসারে। পরম প্রভুর দাসরূপে যিনি কর্ম করছেন, তাঁর লাভ অথবা ক্ষতির প্রতি কোন রকম আসক্তি থাকে না। তিনি কেবল তাঁর প্রভুর আদেশ অনুসার বিশ্বস্ত ভৃতোর মতো তাঁর কর্তব্য করে চলেন। এখন, কেউ তর্ক করতে পারেন যে, শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিগত তত্ত্ববধানে অর্জুন কর্ম করছিলেন, কিন্তু এখন শ্রীকৃষ্ণ এখানে নেই, তখন কিভাবে কর্ম করা উচিত? কেউ যদি এই গ্রন্থে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে অথবা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধির নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে, তা হলে তার ফল একই। এই শ্লোকে মৎপরঃ সংস্কৃত শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবা ছাড়া জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য নেই এবং এভাবেই কর্ম করার সময় একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা উচিত--" এই বিশেষ কাজটি করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ আমাকে নিযুক্ত করেছেন। " এভাবে কাজ করলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে হবে। এটিই হচ্ছে যথার্থ কৃষ্ণভাবনা। এখানে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, খামখেয়ালীর বশে যা ইচ্ছা তাই করে ফলটি শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করা উচিত নয়। সেই ধরনের কাজকর্ম কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবা নয়। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে কর্মম করা উচিত। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রীকৃষ্ণের এই নির্দেশ গুরু-পারম্পর্যে সদ্ গুরুর মাধ্যমে পাওয়া যায়। তাই গুরুর আদেশ পালন করাটাই জীবনের মূখ্য কর্তব্য বলে গ্রহণ করা উচিত। কেউ যদি সদ্ গুরুর আশ্রয় প্রাপ্ত হন এবং তাঁর নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে চলেন, তা হলে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তজীবনে তাঁর সিদ্ধি অনিবার্য।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মচ্চিত্তঃ সর্ব-দুর্গাণি মৎ-প্রসাদাৎ-তরিষ্যসি।
অথ চেৎ-ত্বম-অহঙ্কারাৎ শ্রোষসি বিনঙ্ক্ষ্যসি।।৫৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এভাবেই মদ্গতচিত্ত হলে তুমি আমার প্রসাদে সমস্ত প্রতিবন্ধক থেকে উত্তীর্ণ
হবে। কিন্তু তুমি যদি অহঙ্কার-বশত আমার কথা না শোন, তা হলে বিনষ্ট হবে।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভগবদ্ভক্ত তাঁর জীবন ধারণের জন্য যে সমস্ত কর্তব্যকর্ম, তা সম্পন্ন করবার জন্য অনর্থক উদ্বিগ্ন হন না। সব রকমের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা থেকে এই মহা মুক্তির কথা মূর্খ লোকেরা বুঝতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে যিনি কর্ম করেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অতি অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হন। তাঁর যে বন্ধু তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে সর্বক্ষণ তাঁর সেবা করে চলছেন, তাঁর সমস্ত সুখ-সুবিধার দিকে তিনি তখন দৃষ্টি রাখেন এবং নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করেন। কখনই নিজেকে জড়া প্রকৃতির নিয়মের বন্ধন থেকে মুক্ত বলে মনে করা উচিত নয়,অথবা আমাদের নিজেদের্ম ইচ্ছামতো কাজকর্ম করবার স্বাধীনতা আমাদের আছে বলে মনে করা উচিত নয়। প্রত্যকেই জড় জগতের কঠোর আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু যখনই তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কাজকর্ম করতে শুরু করেন, তখনই তিনি জড় জগতের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হন। খুব সর্তকতার সঙ্গে আমাদের মনে রাখা উচিত, কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবানের সেবা যে করছে না, সে এই জড় জগতের ঘূর্ণিপাকে, জন্ম-মৃত্যৃর সমুদ্রে নিমজ্জিত হচ্ছে। কোন বদ্ধ জীবই জানে না কি করা তাঁর উচিত এবং কি করা তাঁর উচিত নয়। কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনাময় কৃষ্ণভক্ত, তিনি কোন কিছুর পরোয়া না করে তাঁর কাজকর্ম করে চলেন। কারণ তাঁর অন্তর থেকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রতিটি কাজকর্মে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তিঁর গুরুদেব তা অনুমোদন করেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-অহঙ্কারম্-আশ্রিত্য ন যোৎস্যে ইতি মন্যসে।
মিথ্যা-এষঃ ব্যবসায়ঃ-তে প্রকৃতিঃ-ত্বাম্ নিযোক্ষ্যতি।। ৫৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যদি অহঙ্কারকে আশ্রয় করে 'যুদ্ধ করব না'
এরূপ মনে কর, তা হলে তোমার সংকল্প মিথ্যাই হবে। কারণ, তোমার প্রকৃতি তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবে।
তাৎপর্যঃ অর্জুন ছিলেন যুদ্ধবিশারদ এবং ক্ষত্রিয়ের প্রকৃতি নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই যুদ্ধ করাটাই ছিল তাঁর কর্তব্য। কিন্তু মিথ্যা অহঙ্কারের ফলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর গুরু, পিতামহ ও বন্ধুদের হত্যা করলে তাঁর পাপ হবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেকে তাঁর সমস্ত কর্মের কর্তা বলে মনে করেছিলেন, কেন এই সমস্ত কর্মের শুভ ও অশুভ ফলগুলি তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবান যে সেখানে উপস্থিত থেকে তাঁকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, সেটি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। সেটিই হচ্ছে বদ্ধ জীবের
বিস্মৃতি। কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ --সেই অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান নির্দেশ দেন এবং মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তার জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য ভক্তিযোগে ভগবানের সেই নির্দেশগুলি পালন করা। ভগবান যেভাবে মানুষের ভবিতব্য নিরূপণ করতে পারেন, সেই রকম আর কেউ পারে না। তাই পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের
নির্দেশ বা তাঁর প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেবের নির্দেশ কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। কোন রকম ইতস্তত না
করে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের আদেশ পালন করা উচিত। তা হলে সর্ব অবস্থাতেই নিরাপদে থাকা যায়।
।।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-অহঙ্কারম্-আশ্রিত্য ন যোৎস্যে ইতি মন্যসে।
মিথ্যা-এষঃ ব্যবসায়ঃ-তে প্রকৃতিঃ-ত্বাম্ নিযোক্ষ্যতি।। ৫৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যদি অহঙ্কারকে আশ্রয় করে 'যুদ্ধ করব না'
এরূপ মনে কর, তা হলে তোমার সংকল্প মিথ্যাই হবে। কারণ, তোমার প্রকৃতি তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবে।
তাৎপর্যঃ অর্জুন ছিলেন যুদ্ধবিশারদ এবং ক্ষত্রিয়ের প্রকৃতি নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই যুদ্ধ করাটাই ছিল তাঁর কর্তব্য। কিন্তু মিথ্যা অহঙ্কারের ফলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর গুরু, পিতামহ ও বন্ধুদের হত্যা করলে তাঁর পাপ হবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেকে তাঁর সমস্ত কর্মের কর্তা বলে মনে করেছিলেন, কেন এই সমস্ত কর্মের শুভ ও অশুভ ফলগুলি তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবান যে সেখানে উপস্থিত থেকে তাঁকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, সেটি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। সেটিই হচ্ছে বদ্ধ জীবের
বিস্মৃতি। কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ --সেই অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান নির্দেশ দেন এবং মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তার জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য ভক্তিযোগে ভগবানের সেই নির্দেশগুলি পালন করা। ভগবান যেভাবে মানুষের ভবিতব্য নিরূপণ করতে পারেন, সেই রকম আর কেউ পারে না। তাই পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের
নির্দেশ বা তাঁর প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেবের নির্দেশ কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। কোন রকম ইতস্তত না
করে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের আদেশ পালন করা উচিত। তা হলে সর্ব অবস্থাতেই নিরাপদে থাকা যায়।
।।
শ্রীভগবান্ উবাচ
স্বভাবজেন কৌন্তেয় নিবদ্ধঃ স্বেন কর্মণা।
কর্তুম্ ন-ইচ্ছসি যৎ-মোহাৎ করিষ্যসি-অবশঃ-অপি তৎ।।৬০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে কৌন্তেয়! মোহবশত তুমি এখন যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করছ না, কিন্তু তোমার নিজের স্বভাবজাত কর্মের দ্বারা বশবর্তী হয়ে অবশভাবে তুমি তা করতে প্রবৃত্ত হবে।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কেউ যদি কর্ম করতে রাজি না হয়, তা হলে সে প্রকৃতির যে গুণে অবস্থিত, সেই গুণ অনুসারে কর্ম করতে বাধ্য হয়। প্রত্যকেই প্রকৃতির গুণের বিশেষ সংমিশ্রণের দ্বারা প্রভাবিত এবং সেভাবেই কাজকাজ করছে। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে নিজেকে নিযুক্ত করে, সে মহিমান্বিত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাম্ হৃদ্দেশে-অর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্র-আরূঢ়ানি মায়য়া।।৬১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপে যন্ত্রে আরোহণ বরিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।
তাৎপর্যঃ অর্জুন পরম জ্ঞাতা ছিলেন না এবং যুদ্ধ করা বা না করা সম্বন্ধে তাঁর বিবেচনা তাঁর সীমিত বিচার শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, জীবাত্মাই সর্বেসর্বা নয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবান বা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা রূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে অবস্থান করে তাদের পরিচালনা করেন। দেহত্যাগ করার পর জীব তার অতীতের কথা ভুলে যায়। কিন্তু পরমাত্মা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞাতারূপে তার সমস্ত কর্মের সাক্ষী থাকেন। তাই, জীবের সমস্ত কর্মগুলি পরমাত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়। জীবের যা পাপ্য তা সে প্রাপ্ত হয় এবং পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে জড়া প্রকৃতিজাত এক-একটি দেহে আরূঢ় হয়ে এই জড় জগতে ভ্রমণ করে থাকে। জীব যখনই একটি জড় শরীর প্রাপ্ত হয়, তখনই তাকে সেই শরীরের ধর্ম অনুসারে কর্ম করতে হয়। যেমন, কোন মানুষ যখন একটি দ্রুতগামী গাড়িতে বসে থাকেন, তখন তিনি মন্থরগ্রামী গাড়ির আরোহী থেকে দ্রুতগতিতে গমন করেন, যদিও জীব বা গাড়ির চালক একই মানুষ হতে পারেন। তেমনই, পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে জড়া প্রকৃতি কোন নির্দিষ্ট জীবের জন্য কোন বিশেষ রকমের দেহ তৈরি করেন যাতে সে তার অতীতের বাসনা অনুসারে কর্ম করতে পারে। জীব স্বাধীন বা স্বতন্ত্র নয়। নিজেকে কখনই পরম পুরুষোত্তম ভগবান থেকে স্বাধীন বলে মনে করা উচিত নয়।জীব সর্বদাই ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই তার কর্তব্য হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা এবং সেটিই হচ্ছে পরবর্তী শ্লোকের নির্দেশ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তম্-এব শরণম্ গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাম্ শান্তিম্ স্থানম্ প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্।। ৬২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভারত! সর্বোতভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।
তাৎপর্যঃ তাই প্রতিটি জীবের কর্তব্য, সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন যে পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তাঁর শরণাগত হওয়া এবং তার ফলে জীব জড় জগতের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে
নিষ্কৃত লাভ করে। তাই আত্ম-সমর্পণের ফলে জীব যে কেবল এই জীবনের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়, তাই নয়, পরিণামে সে পরমেশ্বর ভগবানকে লাভ করে। চিৎ-জগৎ সম্বন্ধে বর্ণনা করে বৈদিক শাস্ত্রে ( ঋক্ বেদ ১-২২-২০) বলা হয়েছে --তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদম্। যেহেতু সমস্ত সৃষ্টিই ভগবানের রাজ্য, তাই জাগতিক সব কিছুই প্রকৃতপক্ষে চিন্ময়, কিন্তু পরম পদম্ বলতে বিশেষ
করে ভগবানের নিত্য ধামকে বোঝানো হচ্ছে, যাকে বলা হয় চিৎ- জগৎ বা বৈকুন্ঠলোক।
ভগবদ্ গীতায় পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সর্বস্য চাহং সন্নিবিষ্ট -- ভগবান সকলের হৃদয়ে বিরাজমান। তাই, হৃদয়ের অন্তস্তলে বিরাজমান পরমাত্মার কাছে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করা। শ্রীকৃষ্ণকে অর্জন ইতিমধ্যে পরমেশ্বর বলে মেনে নিয়েছেন। দশম অধ্যায়ে তাঁকে পরং ব্রহ্ম পরং ধাম রূপে স্বীকার করা হয়েছে। অর্জুন কেবল তাঁর ব্যক্তিগত অভিঙ্গতার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং সমস্ত জীবের পরম ধাম বলে গ্রহণ করছেন, তাই নয়, নারদ, অসিত,দেবল, ব্যাস আদি সমস্ত মহাত্মারাও যে শ্রীকৃষ্ণকে সেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, তিনি সেই কথা উল্লেখ করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ইতি তে জ্ঞানম্-আখ্যাতম্ গুহ্যাৎ গুহ্যতরম্ ময়া।
বিমৃশ্য-ত্রতৎ-অশেষেণ যথা-ইচ্ছাসি তথা কুরু।।৬৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এভাবেই আমি তোমাকে গুহ্য থেকে গুহ্যতর জ্ঞান বর্ণনা করলাম। তুমি তা সম্পূর্ণরূপে বিচার করে যা ইচ্ছা হয় তাই কর।
তাৎপর্যঃ ভগবান ইতিমধ্যেই অর্জুনের কাছে ব্রহ্মভূত সম্বন্ধে জ্ঞানের বিশ্লেষণ করেছেন। যিনি ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি প্রসন্ন : তিনি কখনও অনুশোচনা করেন না, বা কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করেন না। গুহ্য তত্ত্ব লাভ করার ফলে তা সম্ভব হয়। পরমাত্মা সম্বন্ধে জ্ঞানের রহস্যও শ্রীকৃষ্ণ উন্মোচিত করেছেন। এটিও ব্রহ্মজ্ঞান, কিন্তু এটি উচ্চতর।
এখানে যথেচ্ছসি তথা কুরু কথাটির অর্থ হচ্ছে --" যা ইচ্ছা হয় তাই কর"-- ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ভগবান জীবের ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপ করেন না। ভগবদ্ গীতায় ভগবান সর্বোতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন কিভাবে জীবের মান উন্নত করা যায়।
অর্জনকে প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপদেশ হচ্ছে, হৃদি-অন্তঃস্থ পরমাত্মার কাছে আত্মসমর্পণ করা। যথার্থ বিবেচনার মাধ্যমে পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হতে সম্মত হওয়া উচিত। তা মানব-জীবনের পরম সিদ্ধির স্তর কৃষ্ণভাবনামৃতের অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। যুদ্ধ করবার জন্য অর্জুন সরাসরিভাবে পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা আদিষ্ট হয়েছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করাটা সমস্ত জীবের পরম স্বার্থ। এটি পরমেশ্বর ভগবানের স্বার্থ নয়। আত্মসমর্পণের পূর্বে বুদ্ধি দিয়ে এই সম্বন্ধে যথাসাধ্য বিচার করার স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে; পরম পুরুষোত্তম ভগবানর নির্দেশ গ্রহণ করার সেটিই হচ্ছে উত্তম পন্থা। এই নির্দেশ শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি সদ্ গুরুর কাছ থেকেও প্রাপ্ত হওয়া যায়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্বগুহ্যতমম্ ভূয়ঃ শৃণু মে পরমম্ বচঃ।
ইষ্টঃ-অসি মে দৃঢ়ম্-ইতি ততঃ বক্ষ্যামি তে হিতম্।।৬৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- তুমি আমার কাছ থেকে সবচেয়ে গোপনীয় পরম উপদেশ শ্রবণ কর। যেহেতু তুমি আমার অতিশয় প্রিয়, সেই হেতু তোমার হিতের জন্যই আমি বলছি।
তাৎপর্যঃ ভগবান্ অর্জুনকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা হচ্ছে গুহ্য ( ব্রহ্মজ্ঞান) এবং গুহ্যতর ( সকলের হৃদয়ের অন্তস্তলে বিরাজমান পরমাত্মার জ্ঞান) আর এখন তিনি দান করছেন গুহ্যতম জ্ঞান-- পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ কর। নবম অধ্যায়ের শেষে তিনি বলেছেন, মন্মনাঃ -- সর্বদা আমার কথা চিন্তা কর। ভগবদ্ গীতার মূল শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে এখানে সেই নির্দেশেরই পুনরুক্তি করা হয়েছে। ভগবদ্ গীতার সারাংশরূপ এই যে পরম শিক্ষা, তা শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় শুদ্ধ ভক্ত ছাড়া সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পারে না। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের এটিই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ যা বলছেন, তা হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের সারাতিসার এবং তা কেবল অর্জুনের কাছেই গ্রহণীয় নয়, সমস্ত জীবের পক্ষেই তা গ্রহণীয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মন্মনাঃ ভব মদ্ভক্তঃ মদ্ যাজী মাম্ নমস্কুরু।
মাম্-এব-এষাসি সত্যম্ তে প্রতিজানে প্রিয়ঃ-অসি মে।।৬৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- তুমি আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। এই জন্য আমি তোমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
তাৎপর্যঃ তত্ত্বজ্ঞানের গুহ্যতম অংশ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্ত হওয়া এবং সর্বদাই তাঁর চিন্তা করে তাঁর জন্য কর্ম সাধন করা। পেশাধারী ধ্যানী হওয়া উচিত নয়। জীবনকে এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত, যাতে সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা যায়। সর্বক্ষণ এমনভাবে কাজকর্ম করা উচিত, যাতে সমস্ত দৈনিন্দিন কার্যকলাপগুলি শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে অনুষ্ঠান করা যায়। জীবনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা উচিত যাতে
দিনেন চব্বিশ ঘন্টাই শ্রীকৃষ্ণের কথা ছাড়া আর অন্য কোন চিন্তারই উদয় না হয়। ভগবান এখানে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, যিনি এভাবেই শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনা লাভ করেছেন, তিনি অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণের ধামে ফিরে যাবেন, যেখানে তিনি শ্রীকৃষ্ণের মুখোমুখি হয়ে তাঁর সঙ্গ লাভ করতে পারবেন। তত্ত্বজ্ঞানের এই গূঢ়তম অংশটি অর্জুনকে বলা হয়েছে, কারণ তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয় বন্ধু। অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলেই শ্রীকৃষ্ণের পরম বন্ধুতে পরিণত হতে পারেন এবং অর্জুনের মতো সার্থকতা অর্জন করতে পারেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মাম্-একম্ শরণম্ ব্রজ।
অহম্ ত্বাম্ সর্ব-পাপেভ্যঃ মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।৬৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবো। তুমি শোক করো না।
তাৎপর্যঃ ভগবান নানা রকম জ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, নানা রকম ধর্মের বর্ণনা করেছেন , ব্রহ্মজ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, পরমাত্মা জ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, সমাজ জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ এবং আশ্রমের বর্ণনা করেছেন, সন্ন্যাস আশ্রমের জন্য, বৈরাগ্য জ্ঞান, মন ও ইন্দ্রিয়-দমন, ধ্যান আদি সব কিছুরই বর্ণনা করেছেন। তিনি বিবিধ উপায়ে নানা রকম ধর্মের বর্ণনা করেছেন। এখন ভগবদ্ গীতার সারাংশ বিশ্লেষণ করে ভগবান বলেছেন যে, অর্জুনের উচিত যে সমস্ত ধর্মের কথা তাঁর কাছে ব্যাখ্যা করা হয়েছে,তা সবই পরিত্যাগ করা,
তাঁর উচিত কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়া। সেই শরণাগতি তাঁকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবে, কেন না ভগবান নিজেও তাঁকে রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, যিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনিই কেবল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে পারেন। এভাবেই কেউ মনে করতে পারে যে, যদি নে সে সব রকমের পাপ থেকে মুক্ত হচ্ছে, সে ভগবানের শরণাগতি পন্থা গ্রহণ করতে পারে না। সেই সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত না হয়েও থাকে, কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে তিনি আপনা হতেই সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হবেন। পাপ নিজেকে মুক্ত করবার জন্য অন্য কোন কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। আমাদের উচিত শ্রীকৃষ্ণকে সমস্ত জীবের পরম পরিত্রাতা বলে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করা। শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে আমাদের উচিত তাঁর প্রতি শরণাগত হওয়া।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ইদম্ তে ন-অতপস্কায় ন-অভক্তায় কদাচন।
ন চ-অশুশ্রূষবে বাচ্যম্ ন চ মাম্ যঃ-অভ্যসূয়তি।।৬৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যারা সংযমহীন, অভক্ত, পরিচর্যাহীন এবং আমার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন, তাদেরকে কখনও এই গোপনীয় জ্ঞান বলা উচিত নয়।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তপশ্চর্যা করেনি, যে কখনও ভক্তিযোগে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার প্রচেষ্টা করেনি, যে কখনও শুদ্ধ ভক্তের পরিচর্যা করেনি এবং বিশেষ করে যারা শ্রীকৃষ্ণকে একটি ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মনে করে অথবা যারা শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, তাদেরকে কখনও এই গুহ্যতম্ জ্ঞানের কথা শোনানো উচিত নয়। অনেক সময় দেখা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরাও শ্রীকৃষ্ণের পূজা করছে ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এবং ভগবদ্ গীতা পাঠ করার পেশা গ্রহণ করে ভগবদ্ গীতার ভ্রান্ত বিশ্লেষণ করছে অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু যিনি যথার্থই শ্রীকৃষ্ণকে জানতে আগ্রহী, তাঁকে অবশ্যই ভগবদ্ গীতার এই সমস্ত ভাষাগুলি বর্জন করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে যারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত, ভগবদ্ গীতার যথার্থ উদ্দেশ্য তাদের বোধগম্য হয় না। এমন কি বিষয়াসক্তি ত্যাগ করে বৈদিক শাস্ত্র নির্দেশিত সংযত জীবন যাপন করছে, যদি সে কৃষ্ণভক্ত না হয়, তা হলে সেও শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। এমন কি যে কৃষ্ভক্তির অভিনয় করে, কিন্তু ভক্তিযুক্ত কৃষ্ণসেবায় যুক্ত নয়, সেও শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক শুদ্ধ ভক্তের কাছ থেকে শ্রীকৃষ্ণকে না জেনে ভগবদ্ গীতার ব্যাখা করার চেষ্টা করা উচিত নয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যঃ ইদম্ পরমম্ গুহ্যম্ মৎ-ভক্তেষু-অভিধাষ্যতি।
ভক্তিম্ ময়ি পরাম্ কৃত্বা মাম্-এব-এষ্যতি-অসংশয়ঃ।।৬৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললন- যিনি আমার ভক্তদের মধ্যে এই পরম গোপনীয় গীতাবাক্য উপদেশ করেন, তিনি অবশ্যই পরা ভক্তি লাভ করে নিঃসংশয়ে আমার কাছে ফিরে আসবেন।
তাৎপর্যঃ সাধারণত ভক্তসঙ্গে ভগবদ্ গীতা আলোচনা করার উপদেশ দেওয়া হয়, কারণ অভক্তেরা না পারে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে, না পারে ভগবদ্ গীতার মর্ম উপলদ্ধি করতে। যাঁরা শ্রীকৃষ্ণের স্বরুপে শ্রীকৃষ্ণকে স্বীকার করতে চায় না এবং ভগবদ্ গীতাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে চায় না, তাদের কখনই নিজের ইচ্ছামতো ভগবদ্ গীতার বিশ্লেষণ করে অপরাধী হওয়া উচিত নয়। ভগবদ্ গীতার অর্থ
তাঁদেরই বিশ্লেষণ করা উচিত, যাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। এটি কেবল ভক্তদের বিষয়বস্তু, দার্শনিক জল্পনা- কল্পনাকারীদের জন্য নয়। যিনি ঐকান্তিকভাবে ভগবদ্ গীতাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন, তিনি ভক্তিযোগে উন্নতি সাধন করে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি লাভ করবেন। এই শুদ্ধ ভক্তির ফলে তিনি নিঃসন্দেহে ভগবৎ-ধামে ফিরন যাবেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন চ তস্মাৎ-মনুষ্যেষু কশ্চিৎ-মে প্রিয়কৃত্তমঃ।
ভবিতা ন চ মে তস্মাৎ-অন্যঃ প্রিয়তরঃ ভুবি।।৬৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এই পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে তাঁর থেকে অধিক প্রিয়কারী আমার কেউ নেই এবং তাঁর থেকে অন্য কেউ আমার প্রিয়তর হবে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অধ্যেষ্যতে চ যঃ ইমম্ ধর্ম্যম্ সংবাদম্-আবয়োঃ।
জ্ঞান-যজ্ঞেন তেন-অহম্-ইষ্টঃ স্যাম্-ইতি মে মতিঃ।।৭০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আর যিনি আমাদের উভয়ের এই পবিত্র কথোপকথন অধ্যয়ন করবেন, তাঁর সেই জ্ঞান যজ্ঞের দ্বারা আমি পূজিত হব। এই আমার অভিমত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শ্রদ্ধাবান্-অনসূয়ঃ-চ শৃণুয়াৎ-অপি যঃ নরঃ।
সঃ-অপি মুক্তঃ শুভান্-লোকান্ প্রাপ্নুয়াৎ পূণ্যকর্মণাম্।। ৭১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শ্রদ্ধাবান ও অসূয়া-রহিত যে মানুষ গীতা শ্রবণ করেন, তিনিও পাপমুক্ত হয়ে পূণ্য কর্মকারীদের শুভ লোকসমূহ লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ের সপ্তষষ্টিতম শ্লোকে ভগবান স্পষ্টভাবে ভগবৎ-বিদ্বেষী মানুষদের কাছে গীতার বাণী শোনাতে নিষেধ করেছেন। পক্ষান্তরে বলা যায়, ভগবদ্ গীতা কেবল ভক্তদের জন্য। কিন্তু কখনও কখনও দেখা যায় যে, ভগবদ্ভক্ত জনসাধারণের কাছে গীতা পাঠ করছেন, যেখানে সবকয়টি শ্রোতাই ভক্ত নন। তাঁরা কেন প্রকাশ্যভাবে পাঠ করেন? সেই কথার ব্যাখা করে এখানে বলা হয়েছে যে, যদিও সকলেই ভক্ত নয়, তবুও অনেকে আছেন যাঁরা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ নন। তাঁরে বিশ্বাস করেন যে , তিনিই হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। এই ধরনের মানুষেরা সাধু-বৈষ্ণবের কাছ থেকে ভগবানের কথা শ্রবণ করার ফলে তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন এবং তারপর যেখানে সাধু- মহাত্মারা অবস্থান করেন, সেই লোক প্রাপ্ত হন। সুতরাং, কেবল ভগবদ্ গীতা শ্রবণ করার ফলে, এমন কি যে ব্যক্তি শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি লাভের প্রয়াসী নন, তিনিও পূণ্যকর্মের ফল লাভ করেন। এভাবেই ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত সকলকেই সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার এবং ভগবদ্ভক্ত হওয়ার সুযোগ দান করেন।
সাধারণত যাঁরা পাপমুক্ত, যাঁরা পূণ্যবান, তাঁরা সহজেই কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করেন। এখানে পূণ্যকর্মণাম্ শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর দ্বারা বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত অশ্বমের যজ্ঞের মতো মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের উল্লেখ্ করা হয়েছে, যেমন যাঁরা ভক্তিযোগ সাধন করে পূণ্য অর্জন করেছেন, কিন্তু শুদ্ধ নন, তাঁরা যেখানে ধ্রুব মহারাজ তত্ত্বাবধান করছেন, সেই ধ্রুবলোক লাভ করেন। ধ্রুব মহারাজ হচ্ছেন ভগবানের একজন মহান ভক্ত, তিনি যে গ্রহে বাস করেন, তাকে বলা হয় ধ্রুবলোক বা ধ্রুবতারা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
কচ্চিৎ-ত্রতৎ শ্রুতম্ পার্থ ত্বয়া-ত্রকাগ্রেণ চেতসা।
কচ্চিৎ-অজ্ঞান-সম্মোহঃ প্রণষ্টঃ-তে ধনঞ্জয়।। ৭২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! হে ধনঞ্জয়! তুমি ত্রকাগ্রচিত্তে এই গীতা শ্রবণ করেছ কি? তোমার অজ্ঞান-জনিত মোহ বিদূরিত হয়েছে কি?
তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনের গুরুর মতো আচরণ করছিলেন। তাই, সমগ্র ভগবদ্ গীতার যথাযথ অর্থ অর্জুন উপলব্ধি করতে পেরেছেন কি না তা জিঙ্গেস করা কর্তব্য বলে তিনি মনে করেছিলেন। অর্জুন যদি তাঁর অর্থ ঠিক মতো না বুঝতেন, তা হলে ভগবান কোন বিশেষ বিষয় বা সম্পূর্ণ ভগবদ্ গীতা প্রয়োজন হলে আবার ব্যাখা করতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণ বা তাঁর প্রতিনিধি সদ্ গুরুর কাছ থেকে ভগবদ্ গীতা শ্রবণ করেন, তাঁর সমস্ত অজ্ঞনতা তৎক্ষণাৎ বিদূরিত হয়। ভগবদ্ গীতা কোন কবি বা সাহিত্যেকের লেখা সাধারন কোন গ্রন্থ নয়। তা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মূখনিঃসৃত বাণী। কেউ যদি সৌভাগ্যক্রমে শ্রীকৃষ্ণ বা তাঁর যথার্থ প্রতিনিধির কাছ থেকে এই বাণী শ্রবণ করেন, তিনি অবশ্যই মুক্ত পুরুষরূপে অজ্ঞনতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হন।
অর্জুন উবাচ
নষ্টঃ মোহঃ স্মৃতিঃ-লব্ধা তৎপ্রসাদাৎ-ময়া-অচ্যুত।
স্থিতঃ-অস্মি গত-সন্দেহঃ করিষ্যে বচনম্ তব।।৭৩।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে অচ্যুত! তোমার কৃপায় আমার মোহ দূর হয়েছে এবং আমি স্মৃতি লাভ করেছি। আমার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে এবং যথাজ্ঞানে অবস্থিত হয়েছি। এখন আমি তোমার আদেশ পালন করব।
তাৎপর্যঃ অর্জুনের আর্দশরূপ সমস্ত জীবেরই স্বরূপগত অবস্থায় পরেমশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করা উচিত। আত্মসংযম করা তাদের ধর্ম। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন যে , জীবের স্বরুপ হচ্ছে ভগবানের নিত্য দাস। সেই কথা ভুলে জীব জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু পরমেশ্বরের সেবা করার ফলে সে মুক্ত ভগবৎ দাসে পরিণত হয়। দাসত্ব করাটাই হচ্ছে জীবের স্বাভাবিক ধর্ম। হয় সে মায়ার দাসত্ব করে, নয় পরমেশ্বর ভগবানের দাসত্ব করে। সে যখন পরমেশ্বরের দাসত্ব করে, তখন সে তার স্বরুপে অধিষ্ঠিত থাকে, কিন্তু সে যখন বহিরঙ্গা মায়া শক্তির দাসত্ব বরণ করে, তখন সে অবশ্যই বদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব জড় জগতের দাসত্ব করে। সে তখন কামনা-বাসনার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তবু সে নিজেকে সমস্ত জগতের মালিক বলে মনে করে। একেই বলা হয় মায়া। মানুষ যখন মুক্ত হয়, তখন তার মোহ কেটে যায় এবং সে স্বেচ্ছায় পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হয়ে তাঁর ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করে।
সঞ্জয় উবাচ
ইতি-অহম্ বাসুদেবস্য পার্থস্য চ মহাত্মনঃ।
সংবাদম্-ইমম্-অশ্রৌষম্-অদ্ভুতম্ রোমহর্ষণম্।।৭৪।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- এভাবেই আমি কৃষ্ণ ও অর্জুন দুই মহাত্মার এই অদ্ভুত রোমাঞ্চকর সংবাদ শ্রবণ করেছিলাম।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্ গীতার শুরুতে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সচিব সঞ্জয়কে জিঙ্গাসা করলেন, " কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কি হল? " তাঁর গুরুদেব ব্যাসদেবের কৃপার ফলে সঞ্জয়ের হৃদয়ে সমস্ত ঘটনাগুলি প্রকাশিত হল। এভাবেই তিনি রণাঙ্গনের মূল ঘটনাগুলি ব্যাখা করলেন। এই বাক্যালাপ অর্পূব, কারণ পূর্বে দুজন অতি মহান পুরুষের মধ্যে এই রকম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কখনই হয়নি এবং ভবিষ্যতে হবে না। এটি অপূর্ব , কারণ পরম পুরুষোত্তম ভগবান তাঁর স্বরুপ ও তাঁর শক্তি সম্বন্ধে তাঁর অতি মহান ভক্ত অর্জুনের মতো জীবের কাছে বর্ণনা করেছেন। আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণকে জানবার জন্য অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করি, তা হলে আমাদের জীবন সুখদায়ক ও সার্থক হবে। সঞ্জয় তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং যেমনভাবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেভাবেই তিনি সেই কথোপকথন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করেন। এখন এখানে স্থির সিদ্ধান্ত করা হচ্ছে যে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্ত অর্জুন বর্তমান, সেখানে বিজয় অবশ্যম্ভবী।
সঞ্জয় উবাচ
ব্যাসপ্রসাদাৎ-শ্রুতবান্-ত্রতৎ গুহ্যম্-অহম্ পরম্।
যোগম্ যোগেশ্বরাৎ কৃষ্ণাৎ-সাক্ষাৎ-কথয়তঃ-স্বয়ম্।।৭৫।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- ব্যাসদেবের কৃপায়, আমি এই পরম গোপনীয় যোগ সাক্ষাৎ বর্ণনাকারী স্বয়ং যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করেছি।
তাৎপর্যঃ ব্যাসদেব ছিলেন সঞ্চয়ের গুরুদেব এবং সঞ্জয় এখানে স্বীকার করেছেন যে, ব্যাসদেবের কৃপার ফলে তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরেছেন। অথাৎ সরাসরিভাবে নিজের চেষ্টার দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারা যায় না। তাঁকে জানতে হয় গুরুদেবের কৃপার মাধ্যমে। ভগবৎ-তত্ত্ব দর্শনের উপলব্ধি যদিও সরাসরি, কিন্তু গুরুদেব হচ্ছেন তার স্বচ্ছ মাধ্যম। সেটিই হচ্ছে গুরু - পরস্পরার রহস্য। সদ্ গুরুর কাছে সরাসরিভাবে ভগবদ্ গীতা শ্রবণ করা যায়, যেমন অর্জুন শ্রবণ করেছিলেন। সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক অতীন্দ্রিয়বাদী ও যোগী রয়েছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন যোগেশ্বর। ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে- শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শরণাগত হও। যিনি তা করেন তিনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী। ষষ্ঠ অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে সেই সত্য প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে-- যোগীণামপি সর্বেষাম্।
নারদ মুনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের শিষ্য এবং ব্যাসদেবের গুরুদেব। তাই ব্যাসদেবও হচ্ছেন অর্জুনের মতো সৎ শিষ্য, কারণ তিনি গুরু-পরস্পরায় রয়েছেন আর সঞ্জয় হচ্ছেন ব্যাসদেবের শিষ্য। তাই ব্যাসদেবের আশীর্বাদে সঞ্চয়ের ইন্দ্রিয়গুলি নির্মল হয়েছে এবং তিনি সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন এবং তাঁর কথা শ্রবণ করতে পেরেছেন।
সঞ্জয় উবাচ
রাজন্ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য সংবাদম্-ইমম্-অদ্ভুতম্।
কেশব-অর্জুনয়োঃ পুণ্যম্ হৃষ্যামি চ মুহুর্মুহুঃ।।৭৬।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ স্মরণ করতে করতে আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছি।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্ গীতার উপলব্ধি ত্রতই দিব্য যে, কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন সম্বন্ধে অবগত হন, তখনই তিনি পবিত্র হন এবং তাঁদের কথা আর তিনি ভুলতে পারেন না। এটিই হচ্ছে ভক্ত- জীবনের চিন্ময় অবস্থা। পক্ষান্তরে বলা যায়, কেউ যখন নির্ভুল উৎস সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে
গীতা শ্রবণ করেন, তখনই তিনি পূর্ণ কৃষ্ণভাবনামৃত প্রাপ্ত হন। কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রভাবে উত্তরোত্তর দিব্যজ্ঞান প্রকাশিত হতে থাকে এবং পুলকিত চিত্তে জীবন উপভোগ করা যায়। তা কেবল ক্ষণিকের জন্য নয়, প্রতি মুহুর্তে সেই দিব্য আনন্দ অনুভূত হয়।
সঞ্জয় উবাচ
তৎ-চ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য রূপম্-অতি-অদ্ভুতম্ হরেঃ।
বিস্ময়ঃ মে মহান্ রাজন্ হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ।।৭৭।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণের সেই অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে আমি অতিশয় বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি এবং বারংবার হরষিত হচ্ছি।
তাৎপর্যঃ এখানে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, ব্যাসদেবের কৃপায় সঞ্জয় সেই রূপ দর্শন করতে পেরেছিলেন। এই কথা অবশ্য বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ পূর্বে কখনও এই রূপ দেখাননি। তা কেবল অর্জুনকে দেখানো হয়েছিল, তবুও শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তখন কতিপয় মহান ভক্ত তা দেখতে পেরেছিলেন এবং ব্যাসদেব হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের একজন মহান ভক্ত এবং তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের শক্ত্যাবেশ অবতার বলে গণ্য করা হয়। যে অদ্ভুত রূপ অর্জুনকে দেখানো হয়েছিল, ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য সঞ্জয়ের কাছে সেই রূপ প্রকাশ করেছিলেন এবং সেই রূপ স্মরণ করে সঞ্জয় পুনঃ পুনঃ বিস্ময়ান্বিত হয়েছিলেন।
সঞ্জয় উবাচ
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণঃ যত্র পার্থঃ ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীঃ-বিজয়ঃ ভূতিঃ-ধ্রুবা নীতিঃ-মতিঃ-মম।।৭৮।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত।
তাৎপর্যঃ ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের মাধ্যমে ভগবদ্ গীতা শুরু হয়। তিনি ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ আদি মহারথীদের সাহায্য প্রাপ্ত তাঁর পক্ষে সন্তানদের বিজয় আশা করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, বিজয়লক্ষ্মী তাঁর পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা করার পরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় বললেন," আপনি বিজয়ের কথা ভাবছেন, কিন্তু আমি মনে করি, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন রয়েছেন, সেখানে সৌভাগ্যলক্ষ্মীও থাকবেন।' তিনি সরাসরিভাবে প্রতিপন্ন করলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পক্ষের বিজয় আশা করতে পারেন না। অর্জুনের পক্ষে বিজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথের সারথির পদ বরণ করা আর একটি ঐশ্বর্যের প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণ ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ এবং বৈরাগ্য হচ্ছে তাদের মধ্যে একটি। এই প্রকার বৈরাগ্যের বহু নিদর্শন রয়েছে, কেন না শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন বৈরাগ্যেরও ঈশ্বর।
প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ হচ্ছিল দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে। অর্জুন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ছিলেন, তাই যুধিষ্ঠিরের বিজয় অর্নিবার্য ছিল। কে পৃথিবী শাসন করবে তা স্থির করার জন্য যুদ্ধ হচ্ছিল এবং সঞ্জয় ভবিষ্যৎ বাণী করলেন যে, যুধিষ্ঠিরের দিকে শক্তি স্থানান্তরিত হবে। ভবিষ্যৎ বাণী আরও বলা হল যে, যুদ্ধজয়ের পরে যুধিষ্ঠির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করবেন। কারণ তিনি কেবল ধার্মিক ও পূণ্যবানই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর নীতিবাদীও। তাঁর সারা জীবনে তিনি একটিও মিথ্যা কথা বলেননি।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ অন্তে শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা-
ওঁ যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্ ভবেৎ ।
পূর্ণং ভবতু ত্বৎ সর্বং ত্বৎ প্রসাদাৎ জনার্দ্দন ।।
মন্ত্র হীনং ক্রিয়া হীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন ।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তুমে ।।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা
অর্জুন উবাচ
সন্ন্যাসস্য মহাবাহো তত্ত্বম্-ইচ্ছামি বেদিতুম্।
ত্যাগস্য চ হৃষীকেশ পৃথক্-কেশিনিসূদন।। ১।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে মহাবাহো! হে হৃষীকেশ! হে কেশিনিসূদন! আমি সন্ন্যাস ও ত্যাগের
তত্ত্ব পৃথকভাবে জানতে ইচ্ছা করি।
তাৎপর্যঃ প্রকৃতপক্ষে ভগবদ্ গীতা সতেরটি অধ্যায়েই সমাপ্ত। অষ্টাদশ অধ্যায়টি হচ্ছে পূর্ব অধ্যায়গুলিতে আলোচিত বিভিন্ন বিষয়বস্তুর পরিপূরক সারাংশ। ভগবদ্ গীতার প্রতিটি অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গুরুত্ব সহকারে উপদেশ দিচ্ছেন যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলনই হচ্ছে জীবনের পরম লক্ষ্য। সেই একই বিষয়বস্তু জ্ঞানের গুহ্যতম পন্থারূপে অষ্টাদশ অধ্যায় সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ছয়টি অধ্যায়ে ভক্তিযোগের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে --যোগিনামপি সর্বষাম্-- " সমস্ত যোগীদের মধ্যে যিনি সর্বদাই তাঁর অন্তরে আমাকে চিন্তা করেন, তিনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ "। পূরবর্তী ছয়টি অধ্যায়ে শুদ্ধ ভক্তি, তার প্রকৃতি এবং তার অনুশীলনের বর্ণনা করা হয়েছে। শেষ ছয়টি অধ্যায়ে জ্ঞান, বৈরাগ্য, জড়া প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপ, অপ্রাকৃত প্রকৃতি ও ভগবৎ-সেবার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে সমস্ত কর্মের অনুষ্ঠান করা উচিত, যিনি ওঁ তৎ সৎ শব্দগুলির দ্বারা প্রকাশিত হয়েছেন, যা পরম পুরুষ শ্রীবিষ্ণুকেই নির্দেশ করে। ভগবদ্ গীতার তৃতীয় পর্যায়ে দেখানো হয়েছে যে, ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন ছাড়া আর কিছুই জীবনের চরম লক্ষ্য নয়। পূর্বতন আচার্যগণের দ্বারা এবং ব্রক্ষসূত্র বা বেদান্ত-সূত্রের উদ্ধৃতি সহকারে তা প্রতিপন্ন হয়েছে। কোন কোন নির্বিশেষবাদীরা মনে করেন যে বেদান্ত-সূত্রে একচেটিয়া অধিকার কেবল তাঁদেরই আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেদান্ত-সূত্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি হৃদয়ঙ্গম করা। কারণ
ভগবান নিজেই হচ্ছেন বেদান্ত-সূত্রের প্রণেতা এবং তিনিই হচ্ছেন বেদান্তবেত্তা। সেই কথা পঞ্চাদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটি শাস্ত্রের, প্রতিটি বেদেরই প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি। ভগবদ্ গীতায় সেই কথা বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ভগবদ্ গীতায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে সমগ্র বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্তসার বর্ণণা করা হয়েছে, তেমনই অষ্টাদশ অধ্যায়েও সমস্ত উপদেশের সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবদ্ গীতার দুইটি বিষয় ত্যাগ ও সন্ন্যাস সম্বন্ধে অর্জুন স্পষ্টভাবে জানতে চাইছেন। এভাবেই তিনি এই দুইটি শব্দের অর্থ সম্বন্ধে জিঙ্গাসা করেছেন
ভগবানকে সম্বোধন করে এখানে যে দুইটি শব্দ ' হৃষীকেশ ' ও ' কেশিনিসূদন ' ব্যবহার করা হয়েছে তা তাৎপর্যপূর্ণ। হৃষীকেশ হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অধিপতি শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন তাঁকে অনুরোধ করেছেন, সবকিছুর সারমর্ম এমন ভাবে বর্ণনা করতে যাতে তিনি তাঁর মনের সাম্যভাব বজায় রেখে অবিচলিত চিত্ত হতে পারেন। তবুও তাঁর মনে সন্দেহ রয়েছে এবং সন্দেহকে সব সময় অসুরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণকে তিনি বাকিটুকু প্রথম কমেন্টে দেওয়া
শ্রীভগবান্ উবাচ
কাম্যানাম্ কর্মনাম্ ন্যাসম্ কবয়ঃ বিদুঃ।
সর্ব-কর্ম-ফল-ত্যাগম্ প্রাহুঃ-ত্যাগম্ বিচক্ষণাঃ।। ২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- পণ্ডিতগণ কাম্য কর্মসমূহের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে জানেন এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ সমস্ত কর্মফল ত্যাগকে ত্যাগ বলে থাকেন।
তাৎপর্যঃ কর্মফলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত যে কর্ম, তা ত্যাগ করতে হবে। সেটিই হচ্ছে ভগবদ্ গীতার নির্দেশ। কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞান লাভের জন্য যে কর্ম, তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। পরবর্তী শ্লোকগুলিতে তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যজ্ঞ সম্পাদনের বিভিন্ন বিধি-বিধান বৈদিক শাস্ত্রে আছে। পুত্র লাভের জন্য অথবা স্বর্গ লাভের জন্য বিশেষ বিশেষ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে হয়, কিন্তু কামনার বশবর্তী হয়ে যজ্ঞ করা বদ্ধ করতে হবে। কিন্তু তা বলে, নিজের অন্তর পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠান অথবা পারমার্থিক বিজ্ঞানে উন্নতি লাভের জন্য যে সমস্ত যজ্ঞ, তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্যাজম্ দোষবৎ-ইতি-একে কর্ম প্রাহুঃ-মনীষিণঃ।
যজ্ঞ-দান-তপঃ-কর্ম ন ত্যাজম্-ইতি চ-অপরে।।৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এক শ্রেণীর মনীষীগণ বলেন যে, কর্ম দোষযুক্ত, সেই হেতু তা পরিত্যাজ্য। অপর এক শ্রেণীর পণ্ডিত যজ্ঞ, দান, তপস্যা প্রকৃতি কর্মকে অত্যাজ্য স্বিদ্ধান্ত করেছেন।
তাৎপর্যঃ বৈদিক শাস্ত্রে এমন অনেক কার্যকলাপের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন,যজ্ঞে পশুরবলি দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। আবার সেই সঙ্গে এটিও বলা হয়েছে যে, পশুহত্যা করা অত্যন্ত ঘৃণ্য কর্ম। যদিও যজ্ঞে পশুবলির নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পশুহত্যা করার কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। যজ্ঞে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশুটিকে নবজীবন দান করা। কখনও কখনও যজ্ঞে বলি দেওয়ার মাধ্যমে পশুটিকে নতুন পশুর জীবন দেওয়া হত এবং কখনও কখনও পশুটিকে তৎক্ষণাৎ মনুষ্য-জীবনে উন্নীত করা হত। কিন্তু এই সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলেন যে, পশুহত্যা সর্বতোভাবে বর্জন
করা উচিত,আবার কেউ বলেন যে, কোন বিশেষ যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া মঙ্গলজনক। যজ্ঞ সম্বন্ধে এই সমস্ত সন্দেহের নিরসন ভগবান নিজেই এখন করেছেন।
জানতে পরবর্তী পোস্টে চোখ রাখুন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
নিশ্চয়ম্ শৃণু মে তত্র ত্যাগে ভরতসত্তম।
ত্যাগঃ হি পুরুষব্যাঘ্র ত্রিবিধঃ সংপ্রকীর্তিতঃ।। ৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভরতসত্তম! ত্যাগ সম্বন্ধে আমার নিশ্চয় সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর। হে পুরুষোত্তম! শাস্ত্রে ত্যাগও তিন প্রকার বলে কীর্তিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ ত্যাগ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ থাকলেও, এখানে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রায় দিচ্ছেন, যা চরম সিদ্ধান্ত বলে গ্রহণ করা উচিত। যে যাই বলুন, বেদ হচ্ছে ভগবান প্রদত্ত নীতিবিশেষ। এখানে ভগবান নিজেই উপস্থিত থেকে যা বলছেন,তাঁর নির্দেশকে চরম বলে গ্রহণ করা উচিত। ভগবান বলেছেন যে, প্রকৃতির যে গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কর্ম ত্যাগ করা হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছু বিবেচনা করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যজ্ঞ-দান-তপঃ-কর্ম ন ত্যাজম্ কার্যম্-ত্রব তৎ।
যজ্ঞঃ দানম্ তপঃ-চ-ত্রব পাবনানি মণীষীণাম্।। ৫।।
অনুবাদঃ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্যাজ্য নয়, তা অবশ্যই করা কর্তব্য। যজ্ঞ, দান ও তপস্যা মণীষীদের পর্যন্ত পবিত্র করে।
তাৎপর্যঃ যোগীদের উচিত মানব-সমাজের উন্নিত সাধনের জন্য কর্ম সম্পাদন করা। মানুষকে পরমার্থের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী অনেক শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া আছে। দৃষ্টান্তস্বরুপ, বিবাহ অনুষ্ঠানকেও এই রকম একটি পবিত্র কর্ম বলে গণ্য করা হয়। তাকে বলা হয় 'বিবাহ-যজ্ঞ'। একজন সন্ন্যাসী, য়িনি সব কিছু ত্যাগ করেছেন এবং পারিবারিক সর্ম্পক ত্যাগ করেছেন, তাঁর পক্ষে কি বিবাহ অনুষ্ঠানে উৎসাহ দান করা উচিত? ভগবান এখানে বলেছেন যে, মানব-সমাজের মঙ্গলের জন্য যে যজ্ঞ, তা কখনই ত্যাগ করা উচিত নয়। বিবাহ যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে সংযত করে শান্ত করা, যাতে সে পরমার্থ সাধনের পথে এগিয়ে যেতে পারে। অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই ' বিবাহ-যজ্ঞ' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবন যাপন করা উচিত এবং তাদের এভাবেই অনুপ্রাণিত করা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের কর্তব্য। সন্ন্যাসীর কখনই স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, যারা জীবনের নিম্নস্তরে রয়েছে, যারা যুবক, তারা বিবাহ করে সহধর্মাণী গ্রহণ করা নিরস্ত থাকবে। শাস্ত্রে নির্দেশিত সব কয়টি যজ্ঞই পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় লাভ করার জন্যই সাধিত হয়। তাই, নিম্নতর স্তরে
সেগুলি বর্জন করা উচিত নয়। তেমনই হৃদয়কে নির্মল করার উদ্দেশ্যে দান করা হয়। পূর্বের বর্ণনা অনুযায়ী যোগ্য পাত্রে যদি দান করা হয়, তা হলে তা পারমার্থিক উন্নতির সহায়ক।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্রতানি-অপি তু কর্মাণি সঙ্গম্ ত্যক্ত্বা ফলানি চ।
কর্ত্যবনি-ইতি মে পার্থ নিশ্চিতম্ মতম্-উত্তমম্।। ৬।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! এই সমস্ত কর্ম আসক্তি ও ফলের আশা পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠান করা উচিত।
ইহাই আমার নিশ্চিত উত্তম অভিমত।
তাৎপর্যঃ যদিও সব কয়টি যজ্ঞই পবিত্র, তবুও তা অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে কোন রকম ফলের আশা করা উচিত নয়। পক্ষান্তরে বলা যায়,জাগতিক উন্নতি সাধনের জন্য যে সমস্ত যজ্ঞ, তা বর্জন করতে হবে। কিন্তু যে সমস্ত যজ্ঞ মানুষের অস্তিত্বকে পবিত্র করে এবং তাদের পারমার্থিক স্তরে উন্নীত করে, তা কখনই ত্যাগ করা উচিত নয়। কৃষ্ণভাবনায় ভগবদ্ভক্তি লাভের সহায়ক সব কিছুকে সর্বতোভাবে গ্রহণ করা উচিত। শ্রীমদ্ভগবতেও বলা হয়েছে, যে সমস্ত কার্যকলাপ ভগবদ্ভক্তি লাভের সহায়ক তা গ্রহণ করা উচিত। সেটিই হচ্ছে ধর্মের সর্বোচ্চ নীতি। ভগবদ্ভক্তি সাধনের যে কোন রকমের কার্য, যজ্ঞ বা দান ভগবদ্ভক্তের গ্রহণ করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণঃ ন-উপপদ্যতে।
মোহাৎ-তস্য পরিত্যাগ-তামসঃ পরিকীর্তিতঃ।।৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কিন্তু নিত্যকর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। মোহবশত তার ত্যাগ হলে, তাকে তামসিক ত্যাগ বলা হয়।
তাৎপর্যঃ জড় সুখ ভোগের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত কর্ম তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কিন্তু যে সমস্ত কর্ম মানুষকে পারমার্থিক ক্রিয়াকলাপে উন্নীত করে, যেমন ভগবানের জন্য রান্না করা, ভগবানকে ভোগ নিবেদন করা এবং ভগবৎ প্রসাদ গ্রহণ করা অনুমোদন করা হয়েছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সন্ন্যাসীর নিজের জন্য রাস্না করা উচিত নয়। নিজের জন্য রান্না করা নিষিদ্ধ, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের জন্য রান্না করতে কোন বাধা নেই। তেমনই, শিষ্যকে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবার জন্য সন্ন্যাসী বিবাহ-যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে পারেন। এই সমস্ত কর্মগুলিকে যদি কেউ পরিত্যাগ করে, তা হলে বুঝতে হবে যে, সে তমোগুণে কর্ম করছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দুঃখম্-ইতি-ত্রব যৎ কর্ম কায়-ক্লেশ-ভয়াৎ-ত্যজেৎ।
সঃ কৃত্বা রাজসম্ ত্যাগম্ ন-ত্রব ত্যাগ-ফলম্ লভেৎ।।৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যিনি নিত্যকর্মকে দুঃখজনক বলে মনে করে
দৈহিক ক্লেশের ভয়ে ত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই সেই রাজসিক ত্যাগ করে ত্যাগের ফল লাভ করেন না।
তাৎপর্যঃ অর্থ উপার্জন করাকে ফলশ্রয়ী সকাম কর্ম বলে মনে করে কৃষ্ণভক্তের অর্থ উপার্জন পরিত্যাগ করা উচিত নয়। কজকর্ম করে অর্থ উপার্জন করে সেই অর্থ যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করা হয়, অথবা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা যদি
পারমার্থিক কৃষ্ণভক্তির সহায়ক হয়, তা হলে সেই সমস্ত কর্মগুলি কষ্টদায়ক বলে তার ভয়ে সেগুলির অনুশীলন থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। এই ধরনের ত্যাগ রাজসিক মনোভাবাপন্ন।
রাজসিক কর্মের ফল সব সময় ক্লেশদায়ক হয়ে থাকে। সেই মনোভাব নিয়ে কেউ যদি কর্ম পরিত্যাগ করেন, তা হলে তিনি ত্যাগের যথার্থ সুফল কখনই অর্জন করেন না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
কার্যম্-ইতি-এব যৎ কর্ম নিয়তম্ ক্রিয়তে-অর্জুন।
সঙ্গম্ ত্যক্ত্বা ফলম্ চ-ত্রব সঃ ত্যাগঃ সাত্ত্বিকঃ মতঃ।।৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে অর্জুন! আসক্তি ও ফল পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে যে নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, আমার মতে সেই ত্যাগ সাত্ত্বিক।
তাৎপর্যঃ এমন মনোভাব নিয়ে সর্বদাই নিত্যকর্মে অনুষ্ঠান করা উচিত যেন ফলের প্রতি অনাসক্ত হয়ে কাজ করা হয়। এমন কি, কাজের ধরনের প্রতিও আনাসক্ত হওয়া উচিত। কৃষ্ণভাবনাময় কোন ভক্ত যদি কখনও কোন কারখানাতেও কাজ করেন, তখন তিনি কারখানার কাজের প্রতি আসক্ত হন না এবং কারখানার শ্রমিকদের প্রতিও আসক্ত হন না। তিনি কেবল শ্রীকৃষ্ণের জন্য কাজ করেন এবং যখন তিনি কর্মফল শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন, তখন তাঁর সেই কর্ম অপ্রাকৃত স্তরে অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন দ্বেষ্টি-অকুশলম্ কর্ম কুশলে ন-অনুষজ্জতে।
ত্যাগী সত্ত্ব-সমাবিষ্টঃ মেধাবী ছিন্ন-সংশয়ঃ।।১০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সত্ত্বগুণে আবিষ্ট, মেধাবী ও সমস্ত সংশয়-ছিন্ন ত্যাগী অশুভ কর্মে বিদ্বেষ বরেন না এবং শুভ কর্মে আসক্ত হন না।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ কৃষ্ণভাবনাময় বা সত্ত্বগুণময়, তিনি কাউকে বা শরীরের পক্ষে ক্লেশদায়ক কোন কিছুই ঘৃণা করেন না। তিনি শারীরিক দুঃখ-কষ্টের পরোয়া না করে যথাস্থানে ও যথাসময়ে তাঁর কর্তব্য পালন করে চলেন। ব্রক্ষভুত স্তরে অধিষ্ঠিত এই সমস্ত মানুষদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং তাঁদের কার্যকলাপ সর্ব প্রকারেই সন্দেহাতীত বলে জানতে হবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন হি দেহভৃতা শক্যম্ ত্যক্তুম্ কর্মাণি-অশেষতঃ।
যঃ-তু কর্ম-ফল-ত্যাগী সঃ ত্যাগী-ইতি-অভিধীয়তে।।১১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অবশ্যই
দেহধারী জীবের পক্ষে সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু যিনি সমস্ত কর্মফল পরিত্যাগী, তিনিই বাস্তবিক ত্যাগী বলে অভিহিত হন।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে যে,কেউ কখনও কর্ম ত্যাগ করতে পারে না। তাই, কর্মফল ভোগের আশা না করে যিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্য কর্ম করেন,যিনি সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত ত্যাগী। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের বহু সভ্য আছেন, যাঁরা অফিসে, কলকারখানায় অথবা অন্য জায়গায় খুব কঠোর পরিশ্রম করছেন এবং তাঁরা যা রোজগার করছেন, তা সবই সংঘকে দান করছেন। এই সমস্ত মহাত্মারাই যথার্থ সন্ন্যাসী। ত্রঁরাই যথার্থ ত্যাগের জীবন যাপন করছেন। এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিভাবে কর্মফল ত্যাগ করতে হয় এবং কি উদ্দেশ্য নিয়ে সেই কর্মফল ত্যাগ করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অনিষ্টম্-ইষ্টম্ মিশ্রম্ চ ত্রিবিধম্ কর্মণঃ ফলম্।
ভবতি-অত্যাগিনাম্ প্রেত্য ন তু সন্ন্যাসিনাম্ ক্বচিৎ।। ১২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যাঁরা কর্মফল ত্যাগ করেননি, তাঁদের পরলোকে অনিষ্ট, ইষ্ট ও মিশ্র-- এই তিন প্রকার কর্মফল ভোগ হয়। কিন্তু সন্ন্যাসীদের কখনও ফলভোগ করতে হয় না।
তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা অবগত হয়ে যে মানুষ কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করছেন, তিনি সর্বদাই মুক্ত। তাই তাঁকে মৃত্যুর পরে তাঁর কর্মফল-স্বরূপ সুখ বা দুঃখ কিছুই ভোগ করতে হয় না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
পঞ্চ-ত্রতানি মহাবাহো কারণানি নিবোধ মে।
সাংখ্যে কৃতান্তে প্রোক্তানি সিদ্ধয়ে সর্ব-কর্মণাম্।। ১৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে মহাবাহো! বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্তে সমস্ত কর্মের সিদ্ধির উদ্দেশ্যে এই পাঁচটি কারণ নির্দাষ্ট হয়েছে, আমার থেকে তা অবগত হও।
তাৎপর্যঃ প্রশ্ন হতে পারে যে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই যখন একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে, তা হলে কোনটিই ভোগ করতে হয় না? ভগবান বেদান্ত দর্শনের দৃষ্টান্ত দিয়ে এখানে বিশ্লেষণ করছেন কি করে তা সম্ভব। তিনি বলছেন যে, সমস্ত কার্যের পিছনে পাঁচটি কারণ আছে এবং সমস্ত কার্যের সাফল্যের পিছনেও এই পাঁচটি কারণ আছে বলে বিবেচনা করতে হবে। সাংখ্য কথাটির অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের বৃন্ত এবং বেদান্তকে
সমস্ত আর্চাযেরা জ্ঞানের চরম বৃন্ত বলে গ্রহণ করেছেন। এমন কি শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেদান্ত-সূত্রকে এভাবেই স্বীকার করেছেন। তাই, এই সমস্ত শাস্ত্রের গুরুত্ব ও প্রামাণিকতা যথাযথভাবে আলোচনা করা উচিত।
সব কিছুর চুড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ বা নিষ্পত্তি হচ্ছে পরমাত্মার ইচ্ছা। সেই সম্বন্ধে ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে -- সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ। তিনি সকলকে তার পূর্বের কর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নানা রকম কাজে নিযুক্ত করেছেন। অন্তর্যামীরূপে তিনি যে নির্দেশ দেন, সেই নির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণভাবনামৃত কর্ম করলে, এই জন্মে বা পরজন্মে কোন কর্মফল উৎপাদন করে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অধিষ্ঠানম্ তথা কর্তা করণম্ চ পৃথগ্ বিধম।
বিবিধাঃ-চ পৃথক্ চেষ্টাঃ দৈবম্ চ-ত্রব-অত্র পঞ্চমম্।।১৪।।
অনুবাদঃ অধিষ্ঠান অর্থাৎ দেহ, কর্তা, নানা প্রকার করণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ, বিবিধ প্রচেষ্টা ও দৈব অর্থাৎ পরমাত্মা --এই পাঁচটি হচ্ছে কারণ।
তাৎপর্যঃ অধিষ্ঠানম্ শব্দটির দ্বারা শরীরকে বোঝানো হয়েছে। শরীরের অভ্যন্তরস্থ আত্মা কর্মের ফলাদি সৃষ্টি করছেন এবং সেই কারণে তাঁকে বলা হয় কর্তা। আত্মাই যে জ্ঞাতা ও কর্তা, সেই কথা শ্রূতি শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। এষ হি দ্রষ্টা ( প্রশ্ন উপনিষদ ৪/৯)। বেদান্ত-সূত্রের জ্ঞোহত এব ( ২/৩/১৮) এবং কর্তা শাস্ত্রর্থবত্ত্বাৎ ( ২/৩/৩৩) শ্লোকেও তা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে কাজ করার যন্ত্র এবং ইন্দ্রিয়গুলির সহায়তায় আত্মা নানাভাবে কাজ করে। প্রতিটি কাজের জন্য নানা রকম প্রয়াস করতে হয়। কিন্তু সকলের সমস্ত কার্যকলাপ নির্ভর করে পরমাত্মার ইচ্ছার উপরে, যিনি সকলের হৃদয়ে বন্ধুরূপে বিরাজ করছেন। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন পরম কারণ। এই অবস্থায়, যিনি অন্তর্যামী পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ-সেবা করে চলছেন, তিনি স্বাভাবিকভাবেই কোন কর্মের বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ হন না। যাঁরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময়, তাঁদের কোন কর্মের জন্যই তাঁরা নিজেরা শেষ পর্যন্ত দায়ী হন না। সব কিছুই নির্ভর করে পরমাত্মার বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ইচ্ছার উপর।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শরীর-বাক্-মনোভিঃ-যৎ কর্ম প্রারভতে নরঃ।
নায্যম্ বা বিপরীতম্ বা পঞ্চ-ত্রতে তস্য হেতবঃ।।১৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শরীর,বাক্য ও মনের দ্বারা মানুষ যে কর্ম আরম্ভ করে, তা ন্যায্যই হোক অথবা অন্যায্যই হোক,এই পাঁচটি তার কারণ।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে উল্লিখিত 'ন্যায্য' এবং তার বিপরীত 'অন্যায্য' শব্দ দুটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ন্যায্য কর্ম শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং অন্যায্য কর্ম শাস্ত্রবিধির অবহেলা করে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু যে কাজই হোক না কেন, তার সম্যক্ অনুষ্ঠানের জন্য এই পঞ্চবিধ কারণ প্রয়োজন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তত্র-ত্রবম্ সতি কর্তারম্-আত্মানম্ কেবলম্ তু যঃ।
পশ্যতি-অকৃতবুদ্ধিত্বাৎ সঃ পশ্যতি দুর্মতিঃ।।১৬।।
অনুবাদঃ অতত্রব, কর্মের পাঁচটি কারণের কথা বিবেচনা না করে যে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে, বুদ্ধির অভাববশত সেই দুর্মতি যথাযথভাবে দর্শন করতে পারে না।
তাৎপর্যঃ কোন মূর্খ লোক বুঝতে পারে না যে, পরম বন্ধুরূপে পরমাত্মা তার হৃদয়ে বসে আছেন এবং তিনি তার সমস্ত কার্যকলাপ পরিচালনা করছেন। যদিও কর্মক্ষেত্র, কর্মকর্তা, প্রচেষ্টা ও ইন্দ্রিয়সমূহ --এই চারটি হচ্ছে জড় কারণ, কিন্তু পরম কারণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। সুতরাং চারটি জড় কারণকেই কেবল দেখা উচিত নয়, পরম নিমিত্ত যে কারণ, তাকেও দেখা উচিত। যে পরমেশ্বরকে দেখতে পায় না, সে নিজেকেই কর্তা বলে মনে করে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যস্য ন-অহংকৃতঃ ভাবঃ বুদ্ধিঃ-যস্য ন লিপ্যতে।
হত্বা-অপি সঃ ইমান্-লোকান্ হস্তি ন নিবধ্যতে।।১৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যাঁর অহঙ্কারের ভাব নেই এবং যাঁর বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি এই সমস্ত প্রাণীকে হত্যা করেও হত্যা করেন না এবং হত্যার কর্মফলে আবদ্ধ হন না।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে ভগবান অর্জুনকে বলছেন যে, যুদ্ধ না করার যে বাসনা তা উদয় হচ্ছে অহঙ্কার থেকে। অর্জুন নিজেকেই কর্তা বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু তিনি অন্তরে ও বাইরে পরম অনুমোদনের কথা বিবেচনা করেননি। কেউ যদি পরম অনুমোদন সম্বন্ধে অবগত হতে না পারে, তা হলে তিনি কেন কর্ম করবেন? কিন্তু যিনি কর্মের কারণ, নিজেকে কর্তা এবং পরমেশ্বর ভগবানকে পরম অনুমোদনকারী বলে জানেন, তিনি সব কিছু সুচারুভাবে করতে পারেন। এই ধরনের মানুষ কখনই মোহাচ্ছন্ন হন না। ব্যক্তিগত কার্যকলাপে এবং তার দায়িত্বেরর উদয় হয় অহঙ্কার, নাস্তিকতা অথবা কৃষ্ণভাবনার অভাব থেকে। যিনি পরমাত্মা বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের পরিচালনায় কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করে চলেছেন, তিনি যদি হত্যাও করেন, তা হলে তা হত্যা নয় এবং তিনি কখনই এই ধরনের হত্যা করার জন্য তার ফল ভোগ করনে না। কোন সৈনিক যখন তার সেনাপতির আদেশ অনুসারে শত্রুসৈন্যকে হত্যা করে, তখন তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। কিন্তু কোন সৈনিক যদি
তার নিজের ইচ্ছায় কাউকে হত্যা করে, তা হলে অবশ্যই বিচারলয়ে তার বিচার হবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
জ্ঞানম্ জ্ঞেয়ম্ ও পরিজ্ঞাতা ত্রিবিধা কর্ম-চোদনা।
করণম্ কর্ম কর্তা-ইতি ত্রিবিধঃ কর্ম-সংগ্রহঃ।।১৮।।
অনুবাদঃ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা--এই তিনটি কর্মের প্রেরণা ; করণ, কর্ম ও কর্তা-- এই তিনটি কর্মের আশ্রয়।
তাৎপর্যঃ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা-- এই তিনের অনুপ্রেরণায় আমাদের সমস্ত দৈনন্দিন কাজকর্ম সাধিত হয়। কাজের সহায়ক উপকরণাদি, আসল কাজটি এবং তার কর্মকর্তা--এদের বলা হয় কাজের উপাদান। মানুষের যে কোন কাজকর্মে এই উপাদানগুলি থাকে। কাজ করার আগে খানিকটা উদ্দীপনা থাকে, যাকে বলা হয় অনুপ্রেরণা। কাজটি ঘটবার আগে যে মীমাংসা উপনীত হওয়া যায়, তা হচ্ছে সূক্ষ্ম ধরনেরই কাজ। তারপর কাজটি ক্রিয়ার রূপ নেয়। প্রথমে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও ইচ্ছা -- এই সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ত্রবং তাকে বলা হয় উদ্দীপনা। কর্ম করার অনুপ্রেরণা যদি শাস্ত্র বা গুরুদেবের নির্দেশে থেকে আসে, তা হলে তা অভিন্ন। যখন অনুপ্রেরণা রয়েছে এবং কর্তা রয়েছে, তখন মনসহ ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে প্রকৃত কার্য সাধিত হয়। মন হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্র। যে কোন কার্যের সমস্ত উপাদানগুলিকে বলা হয় কর্মসংগ্রহ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
জ্ঞানম্ কর্ম চ কর্তা চ ত্রিধা-ত্রব গুণভেদতঃ।
প্রোচ্যতে গুণসংখ্যানে যথাবৎ-শৃণু তানি-অপি।১৯।।
অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা তিন প্রকার বলে কথিত হয়েছে। সেই সমস্তও যথাযথ রূপে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ চতুদর্শ অধ্যায়ের জড়া প্রকৃতির গুণের তিনটি বিভাগ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। সেই অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, সত্ত্বগুণ হচ্ছে জ্ঞাণোদ্ভাসিত, রজোগুণ হচ্ছে জড়- জাগতিক ও বৈষয়িক এবং তমোগুণ হচ্ছে আলস্য ও কর্ম বিমুখতার সহায়ক। জড়া প্রকৃতির সব কয়টি গুণই হচ্ছে বন্ধন। তাদের মধ্যে মুক্তি লাভ করা যায় না। এমন কি, সত্ত্বগুণের মধ্যেও মানুষ আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সপ্তদশ অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন গুণে অধিষ্ঠিত ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন পূজা পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্লোকে ভগবান প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রকমের জ্ঞান, কর্তা ও কর্ম সম্বন্ধে বর্ণনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্বভূতেষু যেন-একম্ ভাবম্-অব্যয়ম্-ঈক্ষতে।
অবিভক্তম্ বিভক্তেষু বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্।।২০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে এক অবিভক্ত চিন্ময় ভাব দর্শন হয়, অনেক জীব পরস্পর ভিন্ন হলেও চিন্ময় সত্তায় তারা এক, সেই জ্ঞানকে সাত্ত্বিক বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ যিনি দেবতা, মানুষ, পশু, পাখি, জলজ বা উদ্ভিজ্জ সমস্ত জীবের মধ্যেই এক চিন্ময় আত্মাকে দর্শন করেন, তিনি সাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী। প্রতিটি জীবের মধ্যে একটি চিন্ময় আত্মা রয়েছে, যদিও জীবগুলি তাদের পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের দেহ অর্জন করেছে। সপ্তম অধ্যায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, পরমেশ্বর ভগবানের পরা প্রকৃতি বা উৎকৃষ্ট শক্তি থেকেই প্রত্যেক জীবের দেহে জীবনী-শক্তির প্রকাশ ঘটে। এভাবেই প্রতিটি জীবদেহে জীনবীশক্তির-স্বরূপ এক উৎকৃষ্টা পরা প্রকৃতিকে দর্শন করাই হচ্ছে সাত্ত্বিক দর্শন। দেহের বিনাশ হলেও সেই জীবনী-শক্তিটি অবিনশ্বর। জড় দেহের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়। যেহেতু বদ্ধ জীবনে জড় অস্তিত্বের নানা রকম রূপ আছে, তাই জীবনীশক্তিকে ঐভাবে বহুধা বিভক্ত বলে মনে হয়। এই ধরনের নির্বিশেষ জ্ঞান হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধিরই একটি অঙ্গ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
পৃথক্ত্বনে তু যৎ-জ্ঞানম্ নানাভাবান্ পৃথগ্-বিধান্।
বেত্তি সর্বেষু ভূতেষু তৎ-জ্ঞানম্ বিদ্ধি রাজসম্।।২১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আত্মা অবস্থিত বলে পৃথকরূপে দর্শন হয়, সেই জ্ঞানকে রাজসিক বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ জড় দেহটি হচ্ছে জীব এবং
দেহটি নষ্ট হয়ে গেলে তার সঙ্গে সঙ্গে চেতনাও নষ্ট হয়ে যায় বলে যে ধারণা, তাকে বলা হয় রাজসিক জ্ঞান। সেই জ্ঞান অনুসারে দেহের বিভিন্নতার কারণ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন রকমের চেতনার প্রকাশ। এ ছাড়া পৃথক কোন আত্মা নেই, যার থেকে চেতনার প্রকাশ হয়। দেহটি হচ্ছে যেন সেই আত্মা এবং এই দেহের ঊর্ধ্বে পৃথক কোন আত্মা নেই। এই ধরনের জ্ঞান অনুসারে চেতনা হচ্ছে সাময়িক, অথবা স্বতন্ত্র কোন আত্মা নেই। কিন্তু সর্বব্যাপক এক আত্মা রয়েছে, যা পুর্ণ জ্ঞানময় এবং এই দেহটি হচ্ছে সাময়িক অজ্ঞনতার প্রকাশ, অথবা এই দেহের অতীত কোনও বিশেষ জীবত্মা অথবা পরমাত্মা নেই। এই ধরনের সমস্ত ধারণাগুলিকেই রজোগুণ-জাত বলে গণ্য করা হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তু কৃৎস্নবৎ-একস্মিন্ কার্যে সক্তম্-অহৈতুকম্।
অতত্ত্বার্থবৎ-অল্পম্ চ তৎ-তামসম্-উদাহৃতম্।।২২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আর যে জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত তত্ত্ব অবগত না হয়ে, কোন একটি বিশেষ কার্যে পরিপূর্ণের ন্যায় আসক্তির উদয় হয়, সেই তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ সাধারণ মানুষের 'জ্ঞান' সর্বদাই তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন, কারণ বদ্ধ জীবনে প্রত্যেক জীব তমোগুণে জন্মগ্রহণ করে থাকে। যে মানুষ শাস্ত্রীয় অনুশাসন মতে কিংবা শ্রীগুরুদেবের কাছ থেকে প্রামাণ্য সুত্রে জ্ঞানের বিকাশ সাধন করেনি, দেহ-সম্পর্কিত তার সেই জ্ঞান সীমাবদ্ধ। শাস্ত্রীয় অনুশাসন মতো কর্ম সাধনের কোন চিন্তাভাবনাই সে করে না। তার কাছে অর্থ-সম্পদই হচ্ছে ভগবান এবং জ্ঞান হচ্ছে দেহগত চাহিদার তৃপ্তিসাধন। পরম তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে এই ধরনের জ্ঞানের কোন সর্ম্পক নেই। এটি অনেকটা সাধারণ পশুর জ্ঞানের মতো--শুধুমাত্র আহার, নিদ্রা, আত্মরক্ষা ও মৈথুন সংক্রান্ত জ্ঞান। এই ধরণের জ্ঞানকে এখানে তমোগুণ-প্রসূত বলে অভিহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বলা যেতে পারে যে, এই দেহের উর্ধ্বে চিন্ময় আত্মা সংক্রান্ত যে জ্ঞান, তাকে বলা হয় সাত্ত্বিক জ্ঞান। মনোধর্ম ও জাগতিক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে যে সমস্ত মতবাদ ও ধারণা সম্পর্কিত জ্ঞান, তা হচ্ছে রজোগুণশ্রিত এবং কেবলমাত্র দেহসুুখ ভোগের উদ্দেশ্যে যে জ্ঞান, তা হচ্ছে তমোগুণাশ্রিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
নিয়তম্ সঙ্গরহিতম্-অরাগদ্বেষতঃ কৃতম্।
অফলপ্রেপ্সুনা কর্ম যৎ-তৎ-সাত্ত্বিকম্-উচ্যতে।।২৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ফলের কামনাশূন্য ও আসক্তি রহিত হয়ে রাগ ও দ্বেষ বর্জনপূর্বক যে নিত্যকর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়।
তাৎপর্যঃ শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুসারে সমাজের বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রম-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিধিবদ্ধ বৃত্তিমূলক কর্তব্যকর্মাদি অনাসক্তভাবে কর্তৃত্ববোধ বর্জন করে সম্পাদিত হলে এবং সেই কারণেই অনুরাগ অথবা বিদ্বেষমুক্ত হয়, পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি কিংবা আত্ম-উপভোগ রহিত হয়ে সম্পাদিত হলে, তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তু কামেপ্সুনা কর্ম সাহঙ্কারেণ বা পুনঃ।
ক্রিয়তে বহুলায়সম্ তৎ রাজসম্-উদাহৃতম্।।২৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কিন্তু ফলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ও অহঙ্কারযুক্ত হয়ে বহু কষ্টসাধ্য করে যে কর্মের অনুষ্ঠান হয়, সেই কর্ম রাজসিক বলে অভিহিত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অনুবন্ধম্ ক্ষয়ম্ হিংসাম্-অনপেক্ষ্য চ পৌরুষম্।
মোহাৎ-আরভ্যতে কর্ম যৎ-তামসম্-উচ্যতে।।২৫।।
অনুবাদঃভাবী বন্ধন, কর্ম জ্ঞানাদির ক্ষয়, হিংসা এবং নিজ সামর্থ্যের পরিণতির কথা বিবেচনা না করে মোহবশত যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে তামসিক কর্ম বলা হয়।
তাৎপর্য্যঃ রাষ্ট্রের কাছে বা পরমেশ্বর ভগবানের প্রতিনিধি যমদূতদের কাছে আমাদের সমস্ত কর্মের কৈফিয়ত দিতে হয়। দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্ম হয়ে থাকে ধ্বংসাত্মক, কারণ তা শাস্ত্র-নির্দেশিত ধর্মের অনুশাসনাদি ধ্বংস করে। অনেক ক্ষেত্রেই তা হিংসাভিত্তিক হয় এবং অন্য জীবকে কষ্ট দেয়। নিজের ব্যক্তিগত অভিঙ্গতার আলোকে এই ধরনের দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্ম হয়ে থাকে। একে বলা হয় মোহ এবং এই ধরনের সমস্ত মোহযুক্ত কাজই হচ্ছে তমোগুণ-জাত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মুক্তসঙ্গঃ-অনহংবাদী ধৃতি-উৎসাহ-সমন্বিতঃ।
সিদ্ধি-অসিদ্ধ্যোঃ-নির্বিকারঃ কর্তা সাত্ত্বিকঃ উচ্যতে।।২৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সমস্ত জড় আসক্তি থেকে মুক্ত, অহঙ্কারশূন্য, ধৃতি ও উৎসাহ সমন্বিত এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নির্বিকার --এরূপ কর্তাকেই সাত্ত্বিক বলা হয়।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত সর্বদাই প্রকৃতির জড় গুণগুলির অতীত। তাঁর উপরে ন্যস্ত হয়েছে যে সমস্ত কর্ম, সেগুলির ফলের আকাঙ্ক্ষা তিনি করেন না। কারণ, তিনি গর্ব ও অহঙ্কারের উর্ধ্বে বিরাজ করেন। তবুও সেই কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পুন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি সর্বদাই উৎসাহ নিয়ে কাজ করে চলেন। যে দুঃখ-দুর্দশা, বাধা-বিপত্তির সম্মূখীন তাঁকে হতে হয়, তার জন্য তিনি দুশ্চিন্তা করেন না। তিনি সর্বদাই উৎসাহী। তিনি সফলতা বা বিফলতা কোনটিরই পরোয়া করেন না। তিনি সুখ ও দুঃখ উভয়ের প্রতিই সমভাবাপন্ন। এই ধরনের কর্তা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
রাগী কর্মফল-প্রেপ্সুঃ-লুব্ধঃ হিংসাত্মকঃ-অশুচিঃ।
হর্ষশোকান্বিতঃ কর্তা রাজসঃ পরিকীর্তিতঃ।।২৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কর্মাসক্ত, কর্মফলে আকাঙ্ক্ষী, লোভী, হিংসাপ্রিয়, অশুচি, হর্ষ ও শোকযুক্ত যে কর্তা, সে রাজসিক কর্তা বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ বিশেষ কোন কর্মের প্রতি বা তার ফলের প্রতি কোন মানুষের গভীর আসক্ত হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে জড়-জাগতিক বিষয়াদি, ঘরবাড়ি ও স্ত্রী-পুত্রের প্রতি তাঁর অত্যধিক আসক্তি। এই ধরনের মানুষের উচ্চতর জীবনে উন্নীত হওয়ার কোন অভিলাষ নেই। তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এই পৃথিবীটিকে যতদূর সম্ভব জড়-জাগতিক পদ্ধতিতে আরামদায়ক করে তোলা। সে স্বভাবতই অত্যন্ত লোভী এবং সে মনে করে যে, যা কিছু সে লাভ করেছে তা সবই নিত্য এবং তা কখনই হারিয়ে যাবে না। এই ধরনেন মানুষ অত্যন্ত পরশ্রীকাতর এবং ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের জন্য যে কোন জঘন্য কাজ করতে প্রস্তুত। তাই, এই ধরনের মানুষ অত্যন্ত অশুচি এবং তার উপার্জন পবিত্র না অপিবত্র, সেই সম্বন্ধে সে পরোয়া করে না। তার কাজ যদি সফল হয়, তখন সে খুব খুশি হয় এবং তাঁর কাজ যদি বিফল হয়, তা হলে তার দুঃখের অন্ত থাকে না। এই ধরনের কর্তা রজোগুণে আচ্ছন্ন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অযুক্তঃ প্রাকৃতঃ স্তব্ধঃ শঠঃ নৈষ্কৃতিকঃ-অলসঃ।
বিষাদী দীর্ঘসূত্রী চ কর্তা তামসঃ উচ্যতে।। ২৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অনুচিত কার্যপ্রিয়, জড় চেষ্টাযুক্ত, অনস্র, শঠ, অন্যের অবমাননাকারী, অলস, বিষাদযুক্ত ও দীর্ঘসূত্রী যে কর্তা, তাকে তামসিক কর্তা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুসারে আমরা জানতে পারি কি ধরনের কর্ম করা উচিত এবং কি ধরনের কর্ম করা উচিত নয়। যারা এই সমস্ত অনুশাসন মানে না, তারা অনুচিত কর্মে প্রবৃত্ত হয়। এই ধরনের মানুষেরা সাধারনত বিষয়ী হয়। তারা প্রকৃতির গুণ অনুসারে কর্ম করে, কিন্তু শাস্ত্রের অনুশাসন অনুসারে কাজ করে না। এই ধরনের কর্মীরা সাধারণত খুব একটা ভদ্র হয় না। সাধারণত তারা অত্যন্ত ধূর্ত এবং অপরকে অপদস্থ করতে খুব পটু। তারা অত্যন্ত অলস, তাদেরকে কাজ করতে দেওয়া হলেও ঠিকমতো করে না এবং পরে করবো বলে তা সরিয়ে রাখে। তাই তাদের বিষণ্ণ বলে মনে হয়। তারা যে - কোন কার্য সম্পাদনে বিলম্ব করে; যে কাজটি এক ঘন্টার মধ্যে করা সম্ভব, তা তারা বছরের পর বছর ফেলে রাখে। এই ধরনের কর্মীরা তমোগুণে অধিষ্ঠিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
বুদ্ধেঃ-ভেদম্ ধৃতেঃ-চ-ত্রব গুণতঃ-ত্রিবিধম্ শৃণু।
প্রোচ্যমানম্-অশেষেণ পৃখক্ত্বেন ধনঞ্জয়।।২৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ধনঞ্জয়! জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ অনুসারে বুদ্ধির ও ধৃতির যে ত্রিবিধ ভেদ আছে, তা আমি বিস্তারিতভাবে ও পৃথকভাবে বলছি, তুমি শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির গুণ অনুসারে তিনটি ভাগে বিভক্ত জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা সম্বন্ধে বর্ণনা করে, ভগবান এখন একইভাবে কর্তার বুদ্ধি ও ধৃতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
প্রবৃত্তিম্ চ নিবৃত্তিম্ চ কার্য-অকার্যে ভয়-অভয়ে।
বন্ধম্ মোক্ষম্ চ যা বেত্তি বুদ্ধিঃ সা পার্থ সাত্ত্বিকী।।৩০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! যে বুদ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, কার্য ও অকার্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মুক্তি --- এই সকলের পার্থক্য জানতে পারা যায়, সেই বুদ্ধি সাত্ত্বিকী।
তাৎপর্যঃ কর্ম যখন শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়, তখন তাকে বলা হয় প্রবৃত্তি বা করণীয় কর্ম এবং যে কর্ম করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি, তা করা উচিত নয়। যে মানুষ শাস্ত্রের নির্দেশ সম্বন্ধে অবগত নয়, সে কর্ম এবং তার প্রতিক্রিয়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বুদ্ধির দ্বারা পার্থক্য নিরূপণের যে উপলব্ধির বিকাশ হয়, তা হচ্ছে সত্ত্বগুণাশ্রিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যয়া দর্মম্-অধর্মম্ চ কার্যম্ চ-অকার্যম্-ত্রব চ।
অযথাবৎ প্রজানাতি বুদ্ধিঃ সা পার্থ রাজসী।।৩১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে বুদ্ধির দ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য আদির পার্থক্য অসম্যক্ রূপে জানতে পারা যায়, সেই বুদ্ধি রাজসিকী।
শ্রীভগবান্ উবাচ্
অধর্মম্ ধর্মম্-ইতি যা মন্যতে তমসা-আবৃতা।
সর্বার্থান্ বিপরীতান্-চ বুদ্ধিঃ সা পার্থ তামসী।।৩২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্খ! যে বুদ্ধি অধর্মকে ধর্ম এবং সমস্ত বস্তুকে বিপরীত বলে মনে করে, তমসাবৃত সেই বুদ্ধি তামসিকী।
তাৎপর্যঃ তমোগুণশ্রিত বুদ্ধিবৃত্তি সব সময়ে য়েভাবে কাজ করা উচিত, তার বিপরীতটাই করে। যেগুলি আসলে ধর্ম নয়, সেগুলিকেই তারা ধর্ম বলে মেনে নেয়, আর প্রকৃত ধর্মকে বর্জন করে। তামসিক লোকেরা মহাত্মাকে মনে করে সাধারণ মানুষ, আর সাধারণ মানুষকে মহাত্মা বলে মেনে নেয়। সকল কাজেই তারা কেবল ভুল পথটি গ্রহণ করে। তাই, তাদের বুদ্ধি তমোগুণে আচ্ছন্ন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ধৃত্যা যয়া ধারয়তে মনঃ-প্রাণ-ইন্দ্রিয়-ক্রিয়াঃ।
যোগেন-অব্যভিচারিণ্যা ধৃতিঃ সা পার্থ সাত্ত্বিকী।।৩৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! যে অব্যভিচারিণী ধৃতি যোগ অভ্যাস দ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াসকলকে ধারণ করে, সেই ধৃতিই সাত্ত্বিকী।
তাৎপর্যঃ যোগ হচ্ছে পরমাত্মাকে জানার একটি উপায়। ধৃতি বা দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে যিনি পরম আত্মাতে ত্রকাগ্র হয়েছেন এবং মন, প্রাণ ও সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে পরমেশ্বরে একাগ্র করেছেন, তিনি ভক্তিযোগে কৃষ্ণভাবনার সঙ্গে যুক্ত। এই ধরনের ধৃতি সত্ত্বগুণাশ্রিত। এখানে অব্যভিচারিণ্যা কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই শব্দটির দ্বারা সেই সমস্ত মানুষদের কথা বলা হচ্ছে, যাঁরা কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা আর অন্য কোন কার্যকলাপের দ্বারা কখনই পথভ্রষ্ট হন না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যয়া তু ধর্মকামার্থান্ ধৃত্যা ধারয়তে-অর্জুন।
প্রসঙ্গেন ফলাকাঙ্ক্ষী ধৃতিঃ সা পার্থ রাজসী।।৩৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে অর্জুন! হে পার্থ! যে ধৃতি ফলাকাঙ্ক্ষার সহিত ধর্ম, অর্থ ও কামকে ধারণ করে, সেই ধৃতি রাজসী।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ সব রকম ধর্ম অনুষ্ঠান বা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সর্বদাই ফলের আকাঙ্ক্ষা করে, যার একমাত্র বাসনা হচ্ছে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করা এবং যার মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়গুলি এভাবেই নিযুক্ত হয়েছে, সে রজোগুণাশ্রিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যয়া স্বপ্নম্ ভয়ম্ শোকম্ বিষাদম্ মদম্-ত্রব চ।
ন বিমুঞ্চতি দুর্মেধা ধৃতিঃ সা পার্থ তামসী।।৩৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! যে ধৃতি স্বপ্ন, ভয়, শোক, বিষাদ, মদ আদিকে ত্যাগ করে না, সেই বুদ্ধিহীনা ধৃতিই তামসী।
তাৎপর্যঃ এমন সিদ্ধান্ত করা উচিত নয় যে, সাত্ত্বিক মানুষেরা স্বপ্ন দেখে না। এখানে স্বপ্ন বলতে বোঝাচ্ছে অত্যধিক নিদ্রা। সত্ত্ব, রজ বা তম যে গুণই হোক না কেন, স্বপ্ন সর্বদাই থাকে। স্বপ্ন দেখাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যারা বেশি না ঘুমিয়ে পারে না, যারা জড় জগৎকে ভোগ করার গর্বে গর্বিত না হয়ে পারে না, যারা জড় জগতে কর্তৃত্ব করার স্বপ্ন দেখছে এবং যাদের প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয় আদি সেভাবেই নিযুক্ত, তারা তমোগুণের ধৃতি দ্বারা আচ্ছন্ন বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সুখম্ তু-ইদানীম্ ত্রিবিধম্ শৃনু মে ভরতর্ষভ।
অভ্যাসাৎ রমতে যত্র দুঃখ-অন্তম্ চ নিগচ্ছতি।।৩৬।।
অনুবাদঃ হে ভারতর্ষভ! এখন তুমি আমার কাছে ত্রিবিধ সুখের বিষয় শ্রবণ কর। বদ্ধ জীব পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা সেই সুখে রমন করে এবং যার দ্বারা সমস্ত দুঃখের অন্তলাভ করে থাকে।
তাৎপর্যঃ বদ্ধ জীব বারবার জড় সুখ উপভোগ করতে চেষ্টা করে। এভাবেই সে চর্বিত বস্তু চর্বণ করে। কিন্তু কখন কখন এই ধরনের সুখ উপভোগ করতে করতে কোন মহাত্মার সঙ্গ লাভ করার ফলে সে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, বদ্ধ জীব সর্বদাই কোন না কোন রকমের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের চেষ্টায় রত থাকে। কিন্তু সাধুসঙ্গের প্রভাবে সে যখন বুঝতে পারে যে, তা কেবল একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি, তখন সে তার যথার্থ কৃষ্ণভাবনার জাগরিত হয়ে ওঠে। তখন সে এভাবেই আবর্তনশীল তথাকথিত সুখের কবল থেকে মুক্ত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তৎ-অগ্রে বিষম্ ইব পরিণামে-অমৃত-উপমম্।
তৎ-সুখম্ সাত্ত্বিকম্ প্রোক্তম্-আত্ম-বুদ্ধি-প্রসাদজম্।।৩৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে সুখ প্রথমে বিষের মতো কিন্তু পরিণামে অমৃততুল্য এবং আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির নির্মলতা থেকে জাত, সেই সুখ সাত্ত্বিক বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ আত্মজ্ঞান লাভের পথে মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করে ভগবানের প্রতি মনকে ত্রকাগ্র করবার জন্য নানা রকমের বিধি-নিষেধের অনুশীলন করতে হয়। এই সমস্ত বিধিগুলি অত্যন্ত কঠিন, বিষের মতো তিক্ত। কিন্তু কেউ যদি এই সমস্ত বিধিগুলির অনুশীলনের মাধ্যমে সাফাল্য অর্জন করে অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি প্রকৃত অমৃত পান করতে
শুরু করেন এবং জীবনকে যথার্থভাবে উপভোগ করতে পারেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
বিষয়-ইন্দ্রিয়-সংযোগাৎ-যৎ-তৎ-অগ্রে-অমৃতোপমম্।
পরিণামে বিষম্ ইব তৎ-সুখম্ রাজসম্ স্মৃতম্।।৩৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন-বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে সুখ প্রথমে অমৃতের মতো এবং পরিণামে বিষের মতো অনুভূত হয়, সেই সুখকে রাজসিক বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ একজন যুবক যখন একজন যুবতীর সান্নিধ্যে আসে, তখন যুবকটির ইন্দ্রিয়গুলি যুবতীটিকে দেখবার জন্য, তাকে স্পর্শ করবার জন্য এবং যৌন সম্ভোগ করবার জন্য তাকে প্ররোচিত করতে থাকে। এই ধরনের ইন্দ্রিয়সুখ প্রথমে অত্যন্ত সুখদায়ক হতে পারে, কিন্তু পরিণামে অথবা কিছু কাল পরে, তা বিষবৎ হয়ে উঠে। তারা একে অপরকে ছেড়ে চলে যায় অথবা তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তখন শোক, দুঃখ আদির উদয় হয়। এই ধরনের সুখ সর্বদাই রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের মিলনের ফলে উদ্ভুত যে সুখ, তা সর্বদাই দুঃখদায়ক এবং তা সর্বোতভাবে বর্জন করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-অগ্রে চ-অনুবন্ধে চ সৃখম্ মোহনম্-আত্মনঃ।
নিদ্রা-আলস্য-প্রমাদ-উত্থম্ তৎ-তামসম্-উদাহৃতম্।।৩৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে সুখ প্রথমে ও শেষে আত্মার মোহজনক এবং যা নিদ্রা,আলস্য ও প্রমাদ থেকে উৎপন্ন হয়, তা তামসিক সুখ বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ আলস্য ও নিদ্রার যে সুখ তা অবশ্যই তামসিক এবং যে জানে না কিভাবে কর্ম করা উচিত এবং কিভাবে কর্ম করা উচিত নয়, তাও তামসিক। তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন মানুষদের কাছে সবই মোহজনক। তার শুরুতেও সুখ নেই এবং পরিণতিতেও সুখ নেই। রজোগুণে আচ্ছন্ন মানুষদের বেলায় শুরুতে এক ধরনের ক্ষণিক সুখ থাকতে পারে এবং পরিণামে তা হয় দুঃখদায়ক, কিন্তু তামসিক মানুষদের বেলায় শুরু ও শেষ সর্ব অবস্থাতেই কেবল দুঃখ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন তৎ-অস্তি পৃথিব্যাম্ বা দিবি দেবেষু বা পুনঃ।
সত্ত্বম্ প্রকৃতিজৈঃ-মুক্তম্ যৎ-ত্রভিঃ স্যাৎ ত্রিভিঃ-গুণৈঃ।।৪০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এই পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে অথবা স্বর্গে দেবতাদের মধ্যে এমন কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, যে প্রকৃতিজাত এই ত্রিগুণ থেকে মুক্ত।
তাৎপর্যঃ ভগবান এখানে সারা জগৎ
জুড়ে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের যে সমষ্টিগত প্রভাব, তার সারমর্ম বিশ্লেষণ করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ব্রাক্ষণ-ক্ষত্রিয়-বিশাম্ শূদ্রাণাম্ চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাব-প্রভবৈঃ-গুণৈঃ।।৪১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পরন্তপ! স্বভাবজাত গুণ অনুসারে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদেব কর্মসমূহ বিভক্ত হয়েছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শমঃ দমঃ-তপ শৌচম্ ক্ষান্তি-আর্জবম্-ত্রব চ।
জ্ঞানম্ বিজ্ঞানম্-আস্তিক্যম্ ব্রক্ষ-কর্ম স্বভাবজম্।।৪২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান,
বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এগুলি ব্রাক্ষণদের স্বভাবজাত কর্ম।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শৌর্যম্ তেজঃ দাক্ষ্যম্ যুদ্ধে চ- অপি-অপলায়নম্।
দানম্-ঈশ্বর-ভাবঃ-চ ক্ষাত্রম্ কর্ম স্বভাবজম্।।৪৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে অপলায়ন, দান ও শাসন ক্ষমতা--এগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম।
শ্রীভগবান্ উবাচ
কৃষি-গোরক্ষ্য-বাণিজ্যম্ বৈশ্য-কর্ম স্বভাবজম্।
পরিচর্যা-আত্মকম্ কর্ম শূদ্রস্য-অপি স্বভাবজম্।।৪৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য এই কয়েকটি বৈশ্যের স্বভাবজাত কর্ম এবং পরিচর্যাত্মক কর্ম শূদ্রের স্বভাবজাত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
স্বে স্বে কর্মণি-অভিরতঃ সংসিদ্ধিম্ লভতে নরঃ।
স্বকর্ম-নিরতঃ সিদ্ধিম্ যথা বিন্দতি তৎ-শৃণু।।৪৫।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- নিজ নিজ কর্মে নিরত মানুষ সিদ্ধি লাভ করে থাকে। স্বীয় কর্মে যুক্ত মানুষ যেভাবে সিদ্ধি লাভ করে, তা শ্রবণ কর।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যতঃ প্রবৃত্তিঃ-ভূতানাম্ যেন সর্বম্-ইদম্ ততম্।
স্বকর্মণা তম্-অভ্যর্চ্য সিদ্ধিম্ বিন্দতি মানবঃ।।৪৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যাঁর থেকে সমস্ত জীবের পূর্ব বাসনারূপ প্রবৃত্তি হয়, যিনি ত্রই সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত
আছেন, তাঁকে মানুষ তার নিজের কর্মের দ্বারা অর্চন করে সিদ্ধি লাভ করে।
তাৎপর্যঃ পঞ্চদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সমস্ত জীবই পরমেশ্বর ভগবানের অণুসদৃশ অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ। এভাবেই ভগবান সমস্ত জীবের আদি উৎস। বেদান্তসূত্রে তার সত্যতা প্রতিপন্ন হয়েছে --জন্মাদ্যস্য যতঃ। সুতরাং, পরমেশ্বর ভগবান প্রত্যেকটি জীবের প্রাণের উৎস। ভগবদ্ গীতার সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে,পরমেশ্বর ভগবান তাঁর দুটি শক্তি--অন্তরঙ্গা শক্তি ও বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা সর্বব্যাপ্ত। তাই, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানকে তাঁর শক্তিসহ আরাধনা করা। সাধারণত বৈষ্ণব ভক্তেরা ভগবানকে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি সহ উপাসনা করেন। তাঁর বহিরঙ্গা শক্তি হচ্ছে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির বিকৃত প্রতিবিম্ব। বহিরঙ্গা শক্তিটি হচ্ছে পটভূমি, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান পরমাত্মা রূপে নিজেকে বিস্তার করে সর্বত্র বিরাজমান।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শ্রেয়ান্ স্বধর্মঃ বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বানুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তম্ কর্ম কুর্বন্-ন-আপ্নোতি কিল্বিষম্।।৪৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- উত্তম রূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা অসম্যক রূপে অনুষ্ঠিত স্বধর্মই শ্রেয়। মানুষ স্বভাব-বিহিত কর্ম করে কোন পাপ প্রাপ্ত হয় না।
তাৎপর্যঃ মানুষের স্বধর্ম ভগবদ্ গীতায় নির্দিষ্ট হয়েছে। পৃুর্ববর্তী শ্লোকগুলিতে
ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে যে,বিশেষ বিশেষ প্রকৃতির গুণ অনুসারে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্তব্যকর্ম নির্ধারিত হয়েছে। অপরের ধর্মকর্ম অনুকরণ করা কারও পক্ষে উচিত নয়। যে মানুষ স্বাভাবিকভাবে শূদ্রের কাজকর্ম করার প্রতি আকৃষ্ট, তার পক্ষে কৃত্রিমভাবে নিজেকে ব্রাক্ষণ বলে জাহির করা উচিত নয়। তার জন্ম যদি ব্রাক্ষণ পরিবারেও হয়ে থাকে, তা হলেও নয়। এভাবেই স্বভাব অনুসারে তার কর্ম করা উচিত। কোন কাজই ঘৃণ্য নয়, যদি তা পরমেশ্বর ভগবানের সেবার জন্য অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাক্ষণের বৃত্তিমূলক কর্তব্য অবশ্যই সাত্ত্বিক। কিন্তু কেউ যদি স্বভাবগতভাবে সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন না হয়, তা হলে তার ব্রাক্ষণের বৃত্তি অনুসরণ করা উচিত নয়। ক্ষত্রিয় বা শাসককে কত রকমের ভয়ানক কাজ করতে হয়। তাকে হিংসার আশ্রয় নিয়ে শক্র হত্যা করতে হয় এবং কুটনীতির খাতিরে কখনও কখনও তাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়। এই ধরনের হিংসা ও ছলনা রাজনীতির মধ্যে থাকেই। কিন্তু তা বলে ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম পরিত্যাগ করে ব্রাক্ষণের ধর্ম আচরণ করা উচিত নয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সহজম্ কর্ম কৌন্তেয় সদোষম্-অপি ন ত্যজেৎ।
সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেন-অগ্নিঃ-ইব-আবৃতাঃ।।৪৮।।
শ্রীভগবান্ উবাচঃ হে কৌন্তেয়! সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও ত্যাগ করা উচিত নয়। যেহেতু অগ্নি যেমন ধূমের দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই সমস্ত কর্মই দোষের দ্বারা আবৃত থাকে।
তাৎপর্যঃ মায়াবদ্ধ জীবনে সব কাজই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কুলষিত। ত্রমন কি কেউ যদি ব্রাক্ষণও হন, তা হলেও তাঁকে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হয় যাতে পশু বলি দিতে হয়। তেমনই, ক্ষত্রিয় যতই পুণ্যবান হোন না কেন, তাকে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। তিনি তা পরিহার করতে পারেন না। তেমনই, ত্রকজন বৈশ্য, তা তিনি যতই পুণ্যবান হোন না কেন, ব্যবসায়ে টিকে থাকতে হলে তাঁর লাভের অঙ্কটি তাঁকে কখনও লুকিয়ে রাখতে হয় অথবা কখনও তাঁকে কালোবাজারি
করতে হয়। এগুলি অবশ্যম্ভাবী। এগুলিকে পরিহার করা যায় না। তেমনই, কোন শূদ্রকে যখন কোন অসৎ
মনিবের দাসত্ব করতে হয়, তখন তাকে তার মনিবের আজ্ঞা পালন করতে হয়,যদিও তা করা উচিত নয়।
এই সমস্ত ক্রটি সত্ত্বেও, মানুষকে তার স্বধর্ম করে যেতে হয়, কেন না সেগুলি
তার নিজেরই স্বভাবজাত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অসক্তবুদ্ধিঃ সর্বএ জিতাত্মা বিগতস্পৃহঃ।
নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিম্ পরমাম্ সন্ন্যাসেন-অধিগচ্ছতি।।৪৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- জড় বিষয়ে আসক্তিশূন্য বুদ্ধি, সংযতচিত্ত ও ভোগস্পৃহাশূন্য ব্যক্তি স্বরূপগত কর্ম ত্যাগপূর্বক নৈষ্কর্মরূপ পরম সিদ্ধি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ যথার্থ ত্যাগের অর্থ হচ্ছে নিজেকে সর্বদা পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা। তাই মনে করা উচিত যে, কর্মফল ভোগ করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আমরা যেহেতু পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ, তাই আমাদের সমস্ত কর্মের প্রকৃত ভোক্তা হচ্ছেন ভগবান। সেটিই যথার্থ কৃষ্ণভাবনা । কৃষ্ণভাবনাময় নিয়োজিত মানুষ হচ্ছেন যথার্থ সন্ন্যাসী। এই মনোভাব অবলম্বন করার ফলে মানুষ যথার্থ শান্তি লাভ করতে পারেন। কারণ, তিনি তখন যথার্থভাবে পরমেশ্বর ভগবানের জন্য কাজ করেন। এভাবেই তিনি আর কোন রকম
বিষয়ে প্রতি আসক্ত হন না। তিনি তখন ভগবৎ সেবালব্ধ দিব্য আনন্দ ব্যতীত আর কোন রকম সুখভোগের প্রতি অনুরক্ত হন না। বলা হয় যে, সন্ন্যাসী তাঁর পূর্বকৃত সমস্ত কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত তথাকথিত সন্ন্যাস গ্রহণ না করেই, আপনা থেকেই এই মুক্ত স্তরে অধিষ্ঠিত হন। চিত্তবৃত্তির এই অবস্থাকে বলা হয় যোগারূঢ় বা যোগের সিদ্ধ অবস্থা। এই সম্বন্ধে তৃতীয় অধ্যায়ে প্রতিপন্ন হয়েছে, যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাৎ --যিনি আত্মাতেই তৃপ্ত, তাঁর কর্মফল ভোগের আর কোন ভয় থাকে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সিদ্ধিম্ প্রাপ্তঃ যথা ব্রহ্ম তথা-আপ্নোতি নিবোধ মে।
সমাসেন-এব কৌন্তেয় নিষ্ঠা জ্ঞানস্য যা পরা।।৫০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে কৌন্তেয়! নৈষ্কর্ম সিদ্ধি লাভ করে জীব যেভাবে জ্ঞানের পরা নিষ্ঠারূপ ব্রহ্মকে লাভ করেন, তা আমার কাছে সংক্ষেপে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনের কাছে বর্ণনা করেছেন কিভাবে মানুষ পরম পুরুষোত্তম ভগবানের জন্য সমস্ত কাজ করার মাধ্যমে কেবল তার বৃত্তিমূলক কর্মে যুক্ত থেকে অনায়াসে পরম সিদ্ধি স্তর লাভ করতে পারে।
শুদুমাত্র পরমেশ্বর ভগবানের তৃপ্তি সাধনের জন্য কর্মফল ত্যাগ করার মাধ্যমে অনায়াসে ব্রহ্ম-উপলব্ধির পরম স্তর লাভ করা যায়। সেটিই হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধির পন্থা। জ্ঞানের যথার্থ সিদ্ধি হচ্ছে শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনা লাভ করা, যা পূরবর্তী শ্লোকগুলিতে বর্ণনা করা হয়েছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
বুদ্ধ্যা বিশুদ্ধয়া যুক্তঃ ধৃত্যে-আত্মনম্ নিয়ম্য।
শব্দাদীন্ বিষয়ান্-ত্যক্ত্বা রাগ-দ্বেষৌ ব্যুদস্য চ।।৫১।।
বিবিক্তসেবী লঘ্বাশী যতবাক্-কার-মানসঃ।
ধ্যানযোগপরঃ নিত্যম্ বৈরাগ্যম্ সমুপাশ্রিতঃ।।৫২।।
অহঙ্কারম্ বলম্ দর্পম্ কামম্ ক্রোধম্ পরিগ্রহম্।
বিমুচ্য নির্মমঃ শান্তঃ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে।।৫৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে মনকে ধৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে, শব্দ আদি ইন্দ্রিয় বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে, রাগ ও দ্বেষ বর্জন করে, নির্জন স্থানে বাস করে, অল্প আহার করে, দেহ, মন ও বাক্ সংযত করে, সর্বদা ধ্যানযোগ যুক্ত হয়ে বৈরাগ্য আশ্রয় করে, অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ, পরিগ্রহ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে, মমত্ব বোধশূন্য শান্ত পুরুষ ব্রহ্ম- অনুভবে সর্মথ হন।
তাৎপর্যঃ বুদ্ধির সাহায্যে নির্মল হলে মানুষ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হন। এভাবেই মানুষ চিত্তবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সর্বদাই সমাধিস্থ থাকেন। তখন আর তিনি ইন্দ্রিয়-তর্পণের বিষয়ের প্রতি আসক্ত হন না এবং তখন তিনি তাঁর কাজকর্মে রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত হন। এই ধরনের নিরাসক্ত মানুষ স্বভাবতই নিরিবিলি জায়গায় থাকতে ভালবাসেন। তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করেন না এবং তিনি তাঁর দেহ ও মনের সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে রাখেন। তখন আর তাঁর মিথ্যা অহঙ্কার থাকে না, কারণ তিনি তখন তাঁর দেহকে তাঁর স্বরূপত বলে মনে করেন না। নানা রকম জড় পর্দাথ আহরণ করে তাঁর দেহটিকে স্থূল ও শক্তিশালী করে তোলার কোন বাসনাও তখন আর তার থাকে না। যেহেতু তখন আর তাঁর দেহাত্মবুদ্ধি থাকে না, তাই মিথ্যা দর্পও থাকে না। পরমেশ্বর ভগবানের কৃপায় মানুষ তখন যা পায়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন এবং ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের অভাব হলে ক্রুদ্ধ হন না। ইন্দ্রিয়সুখ বিষয় আহরণ করার কোনও রকম প্রচেষ্টা তিনি তখন করেন না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।
সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিম্ লভতে পরাম্।।৫৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তি কোন কিছুর জন্য শোক করেন না বা আকাঙ্ক্ষা করেন না। তিনি সমস্ত প্রাণীর প্রতি সমদর্শী হয়ে আমার পরা ভক্তি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ নির্বিশেষবাদীর কাছে ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া বা ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়াটা হচ্ছে শেষ কথা। কিন্তু সবিশেষবাদী বা শুদ্ধ ভক্তদের শুদ্ধ ভক্তিতে যুক্ত হবার জন্য আরও অগ্রসর হতে হয়। এর অর্থ হচ্ছে যে, শুদ্ধ ভক্তিযোগে যিনি ভগবানের সেবায় যুক্ত, তিনি ইতিমধ্যেই মুক্ত হয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মভূত হয়ে ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মভূত না হলে তাঁর সেবা করা যায় না। ব্রহ্ম- অনুভূতিতে সেবা ও সেবকের মধ্যে কোন ভেদ নেই, তবুও উচ্চতর চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের মধ্যে ভেদ রয়েছে।
জড় জীবনের ধারণা নিয়ে কেউ যখন ইন্দ্রিয়- তৃপ্তির জন্য কর্ম কররন, তাতে দুর্ভোগ থাকে। কিন্তু চিৎ- জগতে যখন কেউ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করেন, সেই সেবায় কোন দুর্ভোগ নেই। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত কোন কিছুর জন্য অনুশোচনা অথবা আকাঙ্ক্ষা করেন না। যেহেতু ভগবান পূর্ণ, তাই জীব যখন ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হন, তখন তিনিও পূর্ণতা প্রাপ্ত হন। তিনি তখন সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত নির্মল নদীর মতো। কৃষ্ণভক্ত যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কোন কিছুই চিন্তা করেন না। জড় -সুখভোগের প্রতি তাঁর আর কোন আসক্তি থাকে না। কারণ, তিনি জানেন যে, প্রতিটি জীবই হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ এবং তাই তারা নিত্য দাস। তিনি জড় জগতে কাউকেই উচ্চ অথবা নীচ বলে গণ্য করেন না। উচ্চ-নীচবোধ ক্ষণস্থায়ী এবং
এই ক্ষণস্থায়ী অনিত্য জগতের সঙ্গে ভক্তের কেন সর্ম্পক থাকে না। তাঁর কাছে পাথর আর সোনার একই দাম। এটিই হচ্ছে ব্রহ্মভূত স্তর এবং শুদ্ধ ভক্ত অনায়াসে এই স্তরে উন্নীত হতে পারেন। ভগবদ্ভক্তির এই পরম পবিত্র স্তরে পৌছলে, পরব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া বা ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নাশ করার ধারণা অত্যন্ত ঘৃন্য বলে মনে হয় এবং স্বর্গ লাভের আকাঙ্ক্ষাকে আকাসকুসুম বলে মনে হয়। তখন ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষদাঁত ভাঙা সাপের মতোই প্রতিভাত হয়। বিষদাঁত ভাঙা সাপের কাছ থেকে যেমন কোন রকম ভয় থাকে না, তেমনই ইন্দ্রিয়গুলি থেকে আর কোন ভয়ের আশাঙ্ক্ষা থাকে না, যখন তারা আপনা থেকেই যংযত হয়। জড় জগতর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যারা ভবরোগে ভুগছে, তাদের পক্ষে এই জগৎ দুঃক্ষময়। কিন্তু ভগবদ্ভক্তের কাছে সমগ্র জগৎটি বৈকুণ্ঠ বা চিৎ- জগতের মতো। এই জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষও ভক্তের কাছে একটি পিপীলিকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু , যিনি এই যুগে শুদ্ধ ভক্তি প্রচার করেছেন, তাঁর কৃপায় ভগবদ্ভক্তির এই পরম নির্মল স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ভক্ত্যা মাম্-অভিজানাতি যাবান্ যঃ চ অস্মি তত্ত্বতঃ।
ততঃ মাম্ তত্ত্বতঃ জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।৫৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ভক্তির দ্বারা কেবল স্বরূপগত আমি যে রকম হই, সেরূপে আমাকে কেউ তত্ত্বত জানতে পারেন। এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বত জেনে, তার পরে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।
তাৎপর্যঃ অভক্তেরা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কখনই জানতে পারে না। মনোধর্ম প্রসূত জল্পনা-কল্পনার দ্বারাও তাঁকে জানেত পারা যায় না। কেউ যদি পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে চায়, তা হলে তাকে শৃদ্ধ ভক্তের তত্ত্ববধানে শুদ্ধ ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে পরম পুরুষোত্তম ভগবান সম্বন্ধীয় তত্ত্বজ্ঞান তার কাছে সর্বদাই আচ্ছাদিত থেকে যাবে। ভগবদ্ গীতায় (৭-২৫) আগেই বলা হয়েছে, নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য-- তিনি সকলের কাছে প্রকাশিত হন না। কেবল পণ্ডিতের দ্বারা অথবা মনোধর্ম -প্রসূত
জল্পনা-কল্পনার দ্বারা কেউ ভগবানকে জানতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযেগে যিনি ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, তিনিই কেবল শ্রীকৃষ্ণকে তত্ত্বত জানতে পারেন। এই জ্ঞান লাভে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কোন সাহায্য করতে পারে না।
কৃষ্ণতত্ত্বের বিজ্ঞান সম্বন্ধে যিনি পূর্ণরূপে অবগত হয়েছেন, তিনিই শ্রীকৃষ্ণের আলয় চিন্ময় ভগবৎ - ধামে প্রবেশ করার যোগ্য হন। ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার অর্থ স্বাতন্ত্র্যহীন হওয়া নয়। সেই স্তরেও ভগবৎ- সেবা রয়েছে এবং যেখানে ভক্তিযুক্ত ভগবৎ- সেবা রয়েছে, সেখানে অবশ্যই ভগবান, ভক্ত ও ভক্তিযোগের পন্থা রয়েছে। এই প্রকার জ্ঞানের কখনও বিনাশ হয় না, এমন কি মুক্তির পরেও বিনাশ হয় না।মুক্তির অর্থ হচ্ছে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্ব-কর্মাণি-অপি সদা কুর্বাণঃ মৎ-ব্যপাশ্রয়ঃ।
মৎ-প্রসাদাৎ-অবাপ্নোতি শাশ্বতম্ পদম্-অব্যয়ম্।।৫৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আমার শুদ্ধ ভক্ত সর্বদা সমস্ত কর্ম করেও আমার প্রসাদে নিত্য অব্যয় ধাম লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ মদ্ ব্যাপাশ্রয় কথাটির অর্থ হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের আশ্রয়। জড় কলুষমুক্ত হবার জন্য শুদ্ধ ভক্ত পরমেশ্বর ভগবান বা তাঁর প্রতিনিধি গুরুদেবের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করেন। শুদ্ধ ভক্তের ভগবৎ সেবার কোন সময়-সীমা নেই। তিনি সর্বদাই চব্বিশ ঘন্টা পূর্ণরূপে ভগবানের নির্দেশ অনুসারে ভগবানের সেবায় যুক্ত। যে ভক্ত এভাবেই কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, ভগবান তাঁর প্রতি অত্যন্ত সদয়। সমস্ত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও পরিণামে তিনি ভগবৎ-ধামে কৃষ্ণলোকে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর ভগবৎ - ধাম প্রাপ্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। সেই পরম ধামে কোন পরিবর্তন নেই। সেখানে সবকিছুই নিত্য, অবিনশ্বর ও পূর্ণ জ্ঞানময়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরঃ।
বুদ্ধিযোগম্-উপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততম্ ভব।।৫৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- তুমি বুদ্ধির দ্বারা সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে, বুদ্ধিযোগের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক সর্বদাই মদ্গতচিত্ত হও।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কেউ যখন কর্ম করেন, তখন তিনি নিজেকে সমস্ত জগতের প্রভু বলে মনে করে কাজ করেন না। তিনি কাজ করেন সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের
দ্বারা পরিচালিত, তাঁর একান্ত অনুগত দাসরূপে। দাসের কোনও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকে না। তিনি কাজ করেন কেবল তাঁর প্রভুর আদেশ অনুসারে। পরম প্রভুর দাসরূপে যিনি কর্ম করছেন, তাঁর লাভ অথবা ক্ষতির প্রতি কোন রকম আসক্তি থাকে না। তিনি কেবল তাঁর প্রভুর আদেশ অনুসার বিশ্বস্ত ভৃতোর মতো তাঁর কর্তব্য করে চলেন। এখন, কেউ তর্ক করতে পারেন যে, শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিগত তত্ত্ববধানে অর্জুন কর্ম করছিলেন, কিন্তু এখন শ্রীকৃষ্ণ এখানে নেই, তখন কিভাবে কর্ম করা উচিত? কেউ যদি এই গ্রন্থে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে অথবা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধির নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে, তা হলে তার ফল একই। এই শ্লোকে মৎপরঃ সংস্কৃত শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবা ছাড়া জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য নেই এবং এভাবেই কর্ম করার সময় একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা উচিত--" এই বিশেষ কাজটি করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ আমাকে নিযুক্ত করেছেন। " এভাবে কাজ করলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে হবে। এটিই হচ্ছে যথার্থ কৃষ্ণভাবনা। এখানে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, খামখেয়ালীর বশে যা ইচ্ছা তাই করে ফলটি শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করা উচিত নয়। সেই ধরনের কাজকর্ম কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবা নয়। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে কর্মম করা উচিত। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রীকৃষ্ণের এই নির্দেশ গুরু-পারম্পর্যে সদ্ গুরুর মাধ্যমে পাওয়া যায়। তাই গুরুর আদেশ পালন করাটাই জীবনের মূখ্য কর্তব্য বলে গ্রহণ করা উচিত। কেউ যদি সদ্ গুরুর আশ্রয় প্রাপ্ত হন এবং তাঁর নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে চলেন, তা হলে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তজীবনে তাঁর সিদ্ধি অনিবার্য।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মচ্চিত্তঃ সর্ব-দুর্গাণি মৎ-প্রসাদাৎ-তরিষ্যসি।
অথ চেৎ-ত্বম-অহঙ্কারাৎ শ্রোষসি বিনঙ্ক্ষ্যসি।।৫৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এভাবেই মদ্গতচিত্ত হলে তুমি আমার প্রসাদে সমস্ত প্রতিবন্ধক থেকে উত্তীর্ণ
হবে। কিন্তু তুমি যদি অহঙ্কার-বশত আমার কথা না শোন, তা হলে বিনষ্ট হবে।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভগবদ্ভক্ত তাঁর জীবন ধারণের জন্য যে সমস্ত কর্তব্যকর্ম, তা সম্পন্ন করবার জন্য অনর্থক উদ্বিগ্ন হন না। সব রকমের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা থেকে এই মহা মুক্তির কথা মূর্খ লোকেরা বুঝতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে যিনি কর্ম করেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অতি অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হন। তাঁর যে বন্ধু তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে সর্বক্ষণ তাঁর সেবা করে চলছেন, তাঁর সমস্ত সুখ-সুবিধার দিকে তিনি তখন দৃষ্টি রাখেন এবং নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করেন। কখনই নিজেকে জড়া প্রকৃতির নিয়মের বন্ধন থেকে মুক্ত বলে মনে করা উচিত নয়,অথবা আমাদের নিজেদের্ম ইচ্ছামতো কাজকর্ম করবার স্বাধীনতা আমাদের আছে বলে মনে করা উচিত নয়। প্রত্যকেই জড় জগতের কঠোর আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু যখনই তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কাজকর্ম করতে শুরু করেন, তখনই তিনি জড় জগতের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হন। খুব সর্তকতার সঙ্গে আমাদের মনে রাখা উচিত, কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবানের সেবা যে করছে না, সে এই জড় জগতের ঘূর্ণিপাকে, জন্ম-মৃত্যৃর সমুদ্রে নিমজ্জিত হচ্ছে। কোন বদ্ধ জীবই জানে না কি করা তাঁর উচিত এবং কি করা তাঁর উচিত নয়। কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনাময় কৃষ্ণভক্ত, তিনি কোন কিছুর পরোয়া না করে তাঁর কাজকর্ম করে চলেন। কারণ তাঁর অন্তর থেকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রতিটি কাজকর্মে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তিঁর গুরুদেব তা অনুমোদন করেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-অহঙ্কারম্-আশ্রিত্য ন যোৎস্যে ইতি মন্যসে।
মিথ্যা-এষঃ ব্যবসায়ঃ-তে প্রকৃতিঃ-ত্বাম্ নিযোক্ষ্যতি।। ৫৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যদি অহঙ্কারকে আশ্রয় করে 'যুদ্ধ করব না'
এরূপ মনে কর, তা হলে তোমার সংকল্প মিথ্যাই হবে। কারণ, তোমার প্রকৃতি তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবে।
তাৎপর্যঃ অর্জুন ছিলেন যুদ্ধবিশারদ এবং ক্ষত্রিয়ের প্রকৃতি নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই যুদ্ধ করাটাই ছিল তাঁর কর্তব্য। কিন্তু মিথ্যা অহঙ্কারের ফলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর গুরু, পিতামহ ও বন্ধুদের হত্যা করলে তাঁর পাপ হবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেকে তাঁর সমস্ত কর্মের কর্তা বলে মনে করেছিলেন, কেন এই সমস্ত কর্মের শুভ ও অশুভ ফলগুলি তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবান যে সেখানে উপস্থিত থেকে তাঁকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, সেটি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। সেটিই হচ্ছে বদ্ধ জীবের
বিস্মৃতি। কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ --সেই অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান নির্দেশ দেন এবং মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তার জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য ভক্তিযোগে ভগবানের সেই নির্দেশগুলি পালন করা। ভগবান যেভাবে মানুষের ভবিতব্য নিরূপণ করতে পারেন, সেই রকম আর কেউ পারে না। তাই পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের
নির্দেশ বা তাঁর প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেবের নির্দেশ কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। কোন রকম ইতস্তত না
করে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের আদেশ পালন করা উচিত। তা হলে সর্ব অবস্থাতেই নিরাপদে থাকা যায়।
।।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-অহঙ্কারম্-আশ্রিত্য ন যোৎস্যে ইতি মন্যসে।
মিথ্যা-এষঃ ব্যবসায়ঃ-তে প্রকৃতিঃ-ত্বাম্ নিযোক্ষ্যতি।। ৫৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যদি অহঙ্কারকে আশ্রয় করে 'যুদ্ধ করব না'
এরূপ মনে কর, তা হলে তোমার সংকল্প মিথ্যাই হবে। কারণ, তোমার প্রকৃতি তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবে।
তাৎপর্যঃ অর্জুন ছিলেন যুদ্ধবিশারদ এবং ক্ষত্রিয়ের প্রকৃতি নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই যুদ্ধ করাটাই ছিল তাঁর কর্তব্য। কিন্তু মিথ্যা অহঙ্কারের ফলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর গুরু, পিতামহ ও বন্ধুদের হত্যা করলে তাঁর পাপ হবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেকে তাঁর সমস্ত কর্মের কর্তা বলে মনে করেছিলেন, কেন এই সমস্ত কর্মের শুভ ও অশুভ ফলগুলি তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবান যে সেখানে উপস্থিত থেকে তাঁকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, সেটি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। সেটিই হচ্ছে বদ্ধ জীবের
বিস্মৃতি। কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ --সেই অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান নির্দেশ দেন এবং মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তার জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য ভক্তিযোগে ভগবানের সেই নির্দেশগুলি পালন করা। ভগবান যেভাবে মানুষের ভবিতব্য নিরূপণ করতে পারেন, সেই রকম আর কেউ পারে না। তাই পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের
নির্দেশ বা তাঁর প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেবের নির্দেশ কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। কোন রকম ইতস্তত না
করে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের আদেশ পালন করা উচিত। তা হলে সর্ব অবস্থাতেই নিরাপদে থাকা যায়।
।।
শ্রীভগবান্ উবাচ
স্বভাবজেন কৌন্তেয় নিবদ্ধঃ স্বেন কর্মণা।
কর্তুম্ ন-ইচ্ছসি যৎ-মোহাৎ করিষ্যসি-অবশঃ-অপি তৎ।।৬০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে কৌন্তেয়! মোহবশত তুমি এখন যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করছ না, কিন্তু তোমার নিজের স্বভাবজাত কর্মের দ্বারা বশবর্তী হয়ে অবশভাবে তুমি তা করতে প্রবৃত্ত হবে।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কেউ যদি কর্ম করতে রাজি না হয়, তা হলে সে প্রকৃতির যে গুণে অবস্থিত, সেই গুণ অনুসারে কর্ম করতে বাধ্য হয়। প্রত্যকেই প্রকৃতির গুণের বিশেষ সংমিশ্রণের দ্বারা প্রভাবিত এবং সেভাবেই কাজকাজ করছে। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে নিজেকে নিযুক্ত করে, সে মহিমান্বিত হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাম্ হৃদ্দেশে-অর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্র-আরূঢ়ানি মায়য়া।।৬১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপে যন্ত্রে আরোহণ বরিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।
তাৎপর্যঃ অর্জুন পরম জ্ঞাতা ছিলেন না এবং যুদ্ধ করা বা না করা সম্বন্ধে তাঁর বিবেচনা তাঁর সীমিত বিচার শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, জীবাত্মাই সর্বেসর্বা নয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবান বা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা রূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে অবস্থান করে তাদের পরিচালনা করেন। দেহত্যাগ করার পর জীব তার অতীতের কথা ভুলে যায়। কিন্তু পরমাত্মা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞাতারূপে তার সমস্ত কর্মের সাক্ষী থাকেন। তাই, জীবের সমস্ত কর্মগুলি পরমাত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়। জীবের যা পাপ্য তা সে প্রাপ্ত হয় এবং পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে জড়া প্রকৃতিজাত এক-একটি দেহে আরূঢ় হয়ে এই জড় জগতে ভ্রমণ করে থাকে। জীব যখনই একটি জড় শরীর প্রাপ্ত হয়, তখনই তাকে সেই শরীরের ধর্ম অনুসারে কর্ম করতে হয়। যেমন, কোন মানুষ যখন একটি দ্রুতগামী গাড়িতে বসে থাকেন, তখন তিনি মন্থরগ্রামী গাড়ির আরোহী থেকে দ্রুতগতিতে গমন করেন, যদিও জীব বা গাড়ির চালক একই মানুষ হতে পারেন। তেমনই, পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে জড়া প্রকৃতি কোন নির্দিষ্ট জীবের জন্য কোন বিশেষ রকমের দেহ তৈরি করেন যাতে সে তার অতীতের বাসনা অনুসারে কর্ম করতে পারে। জীব স্বাধীন বা স্বতন্ত্র নয়। নিজেকে কখনই পরম পুরুষোত্তম ভগবান থেকে স্বাধীন বলে মনে করা উচিত নয়।জীব সর্বদাই ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই তার কর্তব্য হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা এবং সেটিই হচ্ছে পরবর্তী শ্লোকের নির্দেশ।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তম্-এব শরণম্ গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাম্ শান্তিম্ স্থানম্ প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্।। ৬২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভারত! সর্বোতভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।
তাৎপর্যঃ তাই প্রতিটি জীবের কর্তব্য, সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন যে পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তাঁর শরণাগত হওয়া এবং তার ফলে জীব জড় জগতের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে
নিষ্কৃত লাভ করে। তাই আত্ম-সমর্পণের ফলে জীব যে কেবল এই জীবনের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়, তাই নয়, পরিণামে সে পরমেশ্বর ভগবানকে লাভ করে। চিৎ-জগৎ সম্বন্ধে বর্ণনা করে বৈদিক শাস্ত্রে ( ঋক্ বেদ ১-২২-২০) বলা হয়েছে --তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদম্। যেহেতু সমস্ত সৃষ্টিই ভগবানের রাজ্য, তাই জাগতিক সব কিছুই প্রকৃতপক্ষে চিন্ময়, কিন্তু পরম পদম্ বলতে বিশেষ
করে ভগবানের নিত্য ধামকে বোঝানো হচ্ছে, যাকে বলা হয় চিৎ- জগৎ বা বৈকুন্ঠলোক।
ভগবদ্ গীতায় পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সর্বস্য চাহং সন্নিবিষ্ট -- ভগবান সকলের হৃদয়ে বিরাজমান। তাই, হৃদয়ের অন্তস্তলে বিরাজমান পরমাত্মার কাছে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করা। শ্রীকৃষ্ণকে অর্জন ইতিমধ্যে পরমেশ্বর বলে মেনে নিয়েছেন। দশম অধ্যায়ে তাঁকে পরং ব্রহ্ম পরং ধাম রূপে স্বীকার করা হয়েছে। অর্জুন কেবল তাঁর ব্যক্তিগত অভিঙ্গতার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং সমস্ত জীবের পরম ধাম বলে গ্রহণ করছেন, তাই নয়, নারদ, অসিত,দেবল, ব্যাস আদি সমস্ত মহাত্মারাও যে শ্রীকৃষ্ণকে সেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, তিনি সেই কথা উল্লেখ করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ইতি তে জ্ঞানম্-আখ্যাতম্ গুহ্যাৎ গুহ্যতরম্ ময়া।
বিমৃশ্য-ত্রতৎ-অশেষেণ যথা-ইচ্ছাসি তথা কুরু।।৬৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এভাবেই আমি তোমাকে গুহ্য থেকে গুহ্যতর জ্ঞান বর্ণনা করলাম। তুমি তা সম্পূর্ণরূপে বিচার করে যা ইচ্ছা হয় তাই কর।
তাৎপর্যঃ ভগবান ইতিমধ্যেই অর্জুনের কাছে ব্রহ্মভূত সম্বন্ধে জ্ঞানের বিশ্লেষণ করেছেন। যিনি ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি প্রসন্ন : তিনি কখনও অনুশোচনা করেন না, বা কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করেন না। গুহ্য তত্ত্ব লাভ করার ফলে তা সম্ভব হয়। পরমাত্মা সম্বন্ধে জ্ঞানের রহস্যও শ্রীকৃষ্ণ উন্মোচিত করেছেন। এটিও ব্রহ্মজ্ঞান, কিন্তু এটি উচ্চতর।
এখানে যথেচ্ছসি তথা কুরু কথাটির অর্থ হচ্ছে --" যা ইচ্ছা হয় তাই কর"-- ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ভগবান জীবের ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপ করেন না। ভগবদ্ গীতায় ভগবান সর্বোতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন কিভাবে জীবের মান উন্নত করা যায়।
অর্জনকে প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপদেশ হচ্ছে, হৃদি-অন্তঃস্থ পরমাত্মার কাছে আত্মসমর্পণ করা। যথার্থ বিবেচনার মাধ্যমে পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হতে সম্মত হওয়া উচিত। তা মানব-জীবনের পরম সিদ্ধির স্তর কৃষ্ণভাবনামৃতের অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। যুদ্ধ করবার জন্য অর্জুন সরাসরিভাবে পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা আদিষ্ট হয়েছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করাটা সমস্ত জীবের পরম স্বার্থ। এটি পরমেশ্বর ভগবানের স্বার্থ নয়। আত্মসমর্পণের পূর্বে বুদ্ধি দিয়ে এই সম্বন্ধে যথাসাধ্য বিচার করার স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে; পরম পুরুষোত্তম ভগবানর নির্দেশ গ্রহণ করার সেটিই হচ্ছে উত্তম পন্থা। এই নির্দেশ শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি সদ্ গুরুর কাছ থেকেও প্রাপ্ত হওয়া যায়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্বগুহ্যতমম্ ভূয়ঃ শৃণু মে পরমম্ বচঃ।
ইষ্টঃ-অসি মে দৃঢ়ম্-ইতি ততঃ বক্ষ্যামি তে হিতম্।।৬৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- তুমি আমার কাছ থেকে সবচেয়ে গোপনীয় পরম উপদেশ শ্রবণ কর। যেহেতু তুমি আমার অতিশয় প্রিয়, সেই হেতু তোমার হিতের জন্যই আমি বলছি।
তাৎপর্যঃ ভগবান্ অর্জুনকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা হচ্ছে গুহ্য ( ব্রহ্মজ্ঞান) এবং গুহ্যতর ( সকলের হৃদয়ের অন্তস্তলে বিরাজমান পরমাত্মার জ্ঞান) আর এখন তিনি দান করছেন গুহ্যতম জ্ঞান-- পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ কর। নবম অধ্যায়ের শেষে তিনি বলেছেন, মন্মনাঃ -- সর্বদা আমার কথা চিন্তা কর। ভগবদ্ গীতার মূল শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে এখানে সেই নির্দেশেরই পুনরুক্তি করা হয়েছে। ভগবদ্ গীতার সারাংশরূপ এই যে পরম শিক্ষা, তা শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় শুদ্ধ ভক্ত ছাড়া সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পারে না। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের এটিই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ যা বলছেন, তা হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের সারাতিসার এবং তা কেবল অর্জুনের কাছেই গ্রহণীয় নয়, সমস্ত জীবের পক্ষেই তা গ্রহণীয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মন্মনাঃ ভব মদ্ভক্তঃ মদ্ যাজী মাম্ নমস্কুরু।
মাম্-এব-এষাসি সত্যম্ তে প্রতিজানে প্রিয়ঃ-অসি মে।।৬৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- তুমি আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। এই জন্য আমি তোমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
তাৎপর্যঃ তত্ত্বজ্ঞানের গুহ্যতম অংশ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্ত হওয়া এবং সর্বদাই তাঁর চিন্তা করে তাঁর জন্য কর্ম সাধন করা। পেশাধারী ধ্যানী হওয়া উচিত নয়। জীবনকে এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত, যাতে সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা যায়। সর্বক্ষণ এমনভাবে কাজকর্ম করা উচিত, যাতে সমস্ত দৈনিন্দিন কার্যকলাপগুলি শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে অনুষ্ঠান করা যায়। জীবনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা উচিত যাতে
দিনেন চব্বিশ ঘন্টাই শ্রীকৃষ্ণের কথা ছাড়া আর অন্য কোন চিন্তারই উদয় না হয়। ভগবান এখানে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, যিনি এভাবেই শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনা লাভ করেছেন, তিনি অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণের ধামে ফিরে যাবেন, যেখানে তিনি শ্রীকৃষ্ণের মুখোমুখি হয়ে তাঁর সঙ্গ লাভ করতে পারবেন। তত্ত্বজ্ঞানের এই গূঢ়তম অংশটি অর্জুনকে বলা হয়েছে, কারণ তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয় বন্ধু। অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলেই শ্রীকৃষ্ণের পরম বন্ধুতে পরিণত হতে পারেন এবং অর্জুনের মতো সার্থকতা অর্জন করতে পারেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মাম্-একম্ শরণম্ ব্রজ।
অহম্ ত্বাম্ সর্ব-পাপেভ্যঃ মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।৬৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবো। তুমি শোক করো না।
তাৎপর্যঃ ভগবান নানা রকম জ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, নানা রকম ধর্মের বর্ণনা করেছেন , ব্রহ্মজ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, পরমাত্মা জ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, সমাজ জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ এবং আশ্রমের বর্ণনা করেছেন, সন্ন্যাস আশ্রমের জন্য, বৈরাগ্য জ্ঞান, মন ও ইন্দ্রিয়-দমন, ধ্যান আদি সব কিছুরই বর্ণনা করেছেন। তিনি বিবিধ উপায়ে নানা রকম ধর্মের বর্ণনা করেছেন। এখন ভগবদ্ গীতার সারাংশ বিশ্লেষণ করে ভগবান বলেছেন যে, অর্জুনের উচিত যে সমস্ত ধর্মের কথা তাঁর কাছে ব্যাখ্যা করা হয়েছে,তা সবই পরিত্যাগ করা,
তাঁর উচিত কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়া। সেই শরণাগতি তাঁকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবে, কেন না ভগবান নিজেও তাঁকে রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, যিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনিই কেবল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে পারেন। এভাবেই কেউ মনে করতে পারে যে, যদি নে সে সব রকমের পাপ থেকে মুক্ত হচ্ছে, সে ভগবানের শরণাগতি পন্থা গ্রহণ করতে পারে না। সেই সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত না হয়েও থাকে, কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে তিনি আপনা হতেই সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হবেন। পাপ নিজেকে মুক্ত করবার জন্য অন্য কোন কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। আমাদের উচিত শ্রীকৃষ্ণকে সমস্ত জীবের পরম পরিত্রাতা বলে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করা। শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে আমাদের উচিত তাঁর প্রতি শরণাগত হওয়া।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ইদম্ তে ন-অতপস্কায় ন-অভক্তায় কদাচন।
ন চ-অশুশ্রূষবে বাচ্যম্ ন চ মাম্ যঃ-অভ্যসূয়তি।।৬৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যারা সংযমহীন, অভক্ত, পরিচর্যাহীন এবং আমার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন, তাদেরকে কখনও এই গোপনীয় জ্ঞান বলা উচিত নয়।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তপশ্চর্যা করেনি, যে কখনও ভক্তিযোগে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার প্রচেষ্টা করেনি, যে কখনও শুদ্ধ ভক্তের পরিচর্যা করেনি এবং বিশেষ করে যারা শ্রীকৃষ্ণকে একটি ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মনে করে অথবা যারা শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, তাদেরকে কখনও এই গুহ্যতম্ জ্ঞানের কথা শোনানো উচিত নয়। অনেক সময় দেখা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরাও শ্রীকৃষ্ণের পূজা করছে ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এবং ভগবদ্ গীতা পাঠ করার পেশা গ্রহণ করে ভগবদ্ গীতার ভ্রান্ত বিশ্লেষণ করছে অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু যিনি যথার্থই শ্রীকৃষ্ণকে জানতে আগ্রহী, তাঁকে অবশ্যই ভগবদ্ গীতার এই সমস্ত ভাষাগুলি বর্জন করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে যারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত, ভগবদ্ গীতার যথার্থ উদ্দেশ্য তাদের বোধগম্য হয় না। এমন কি বিষয়াসক্তি ত্যাগ করে বৈদিক শাস্ত্র নির্দেশিত সংযত জীবন যাপন করছে, যদি সে কৃষ্ণভক্ত না হয়, তা হলে সেও শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। এমন কি যে কৃষ্ভক্তির অভিনয় করে, কিন্তু ভক্তিযুক্ত কৃষ্ণসেবায় যুক্ত নয়, সেও শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক শুদ্ধ ভক্তের কাছ থেকে শ্রীকৃষ্ণকে না জেনে ভগবদ্ গীতার ব্যাখা করার চেষ্টা করা উচিত নয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যঃ ইদম্ পরমম্ গুহ্যম্ মৎ-ভক্তেষু-অভিধাষ্যতি।
ভক্তিম্ ময়ি পরাম্ কৃত্বা মাম্-এব-এষ্যতি-অসংশয়ঃ।।৬৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললন- যিনি আমার ভক্তদের মধ্যে এই পরম গোপনীয় গীতাবাক্য উপদেশ করেন, তিনি অবশ্যই পরা ভক্তি লাভ করে নিঃসংশয়ে আমার কাছে ফিরে আসবেন।
তাৎপর্যঃ সাধারণত ভক্তসঙ্গে ভগবদ্ গীতা আলোচনা করার উপদেশ দেওয়া হয়, কারণ অভক্তেরা না পারে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে, না পারে ভগবদ্ গীতার মর্ম উপলদ্ধি করতে। যাঁরা শ্রীকৃষ্ণের স্বরুপে শ্রীকৃষ্ণকে স্বীকার করতে চায় না এবং ভগবদ্ গীতাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে চায় না, তাদের কখনই নিজের ইচ্ছামতো ভগবদ্ গীতার বিশ্লেষণ করে অপরাধী হওয়া উচিত নয়। ভগবদ্ গীতার অর্থ
তাঁদেরই বিশ্লেষণ করা উচিত, যাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। এটি কেবল ভক্তদের বিষয়বস্তু, দার্শনিক জল্পনা- কল্পনাকারীদের জন্য নয়। যিনি ঐকান্তিকভাবে ভগবদ্ গীতাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন, তিনি ভক্তিযোগে উন্নতি সাধন করে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি লাভ করবেন। এই শুদ্ধ ভক্তির ফলে তিনি নিঃসন্দেহে ভগবৎ-ধামে ফিরন যাবেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ন চ তস্মাৎ-মনুষ্যেষু কশ্চিৎ-মে প্রিয়কৃত্তমঃ।
ভবিতা ন চ মে তস্মাৎ-অন্যঃ প্রিয়তরঃ ভুবি।।৬৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- এই পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে তাঁর থেকে অধিক প্রিয়কারী আমার কেউ নেই এবং তাঁর থেকে অন্য কেউ আমার প্রিয়তর হবে না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অধ্যেষ্যতে চ যঃ ইমম্ ধর্ম্যম্ সংবাদম্-আবয়োঃ।
জ্ঞান-যজ্ঞেন তেন-অহম্-ইষ্টঃ স্যাম্-ইতি মে মতিঃ।।৭০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আর যিনি আমাদের উভয়ের এই পবিত্র কথোপকথন অধ্যয়ন করবেন, তাঁর সেই জ্ঞান যজ্ঞের দ্বারা আমি পূজিত হব। এই আমার অভিমত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শ্রদ্ধাবান্-অনসূয়ঃ-চ শৃণুয়াৎ-অপি যঃ নরঃ।
সঃ-অপি মুক্তঃ শুভান্-লোকান্ প্রাপ্নুয়াৎ পূণ্যকর্মণাম্।। ৭১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শ্রদ্ধাবান ও অসূয়া-রহিত যে মানুষ গীতা শ্রবণ করেন, তিনিও পাপমুক্ত হয়ে পূণ্য কর্মকারীদের শুভ লোকসমূহ লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ের সপ্তষষ্টিতম শ্লোকে ভগবান স্পষ্টভাবে ভগবৎ-বিদ্বেষী মানুষদের কাছে গীতার বাণী শোনাতে নিষেধ করেছেন। পক্ষান্তরে বলা যায়, ভগবদ্ গীতা কেবল ভক্তদের জন্য। কিন্তু কখনও কখনও দেখা যায় যে, ভগবদ্ভক্ত জনসাধারণের কাছে গীতা পাঠ করছেন, যেখানে সবকয়টি শ্রোতাই ভক্ত নন। তাঁরা কেন প্রকাশ্যভাবে পাঠ করেন? সেই কথার ব্যাখা করে এখানে বলা হয়েছে যে, যদিও সকলেই ভক্ত নয়, তবুও অনেকে আছেন যাঁরা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ নন। তাঁরে বিশ্বাস করেন যে , তিনিই হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। এই ধরনের মানুষেরা সাধু-বৈষ্ণবের কাছ থেকে ভগবানের কথা শ্রবণ করার ফলে তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন এবং তারপর যেখানে সাধু- মহাত্মারা অবস্থান করেন, সেই লোক প্রাপ্ত হন। সুতরাং, কেবল ভগবদ্ গীতা শ্রবণ করার ফলে, এমন কি যে ব্যক্তি শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি লাভের প্রয়াসী নন, তিনিও পূণ্যকর্মের ফল লাভ করেন। এভাবেই ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত সকলকেই সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার এবং ভগবদ্ভক্ত হওয়ার সুযোগ দান করেন।
সাধারণত যাঁরা পাপমুক্ত, যাঁরা পূণ্যবান, তাঁরা সহজেই কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করেন। এখানে পূণ্যকর্মণাম্ শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর দ্বারা বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত অশ্বমের যজ্ঞের মতো মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের উল্লেখ্ করা হয়েছে, যেমন যাঁরা ভক্তিযোগ সাধন করে পূণ্য অর্জন করেছেন, কিন্তু শুদ্ধ নন, তাঁরা যেখানে ধ্রুব মহারাজ তত্ত্বাবধান করছেন, সেই ধ্রুবলোক লাভ করেন। ধ্রুব মহারাজ হচ্ছেন ভগবানের একজন মহান ভক্ত, তিনি যে গ্রহে বাস করেন, তাকে বলা হয় ধ্রুবলোক বা ধ্রুবতারা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
কচ্চিৎ-ত্রতৎ শ্রুতম্ পার্থ ত্বয়া-ত্রকাগ্রেণ চেতসা।
কচ্চিৎ-অজ্ঞান-সম্মোহঃ প্রণষ্টঃ-তে ধনঞ্জয়।। ৭২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে পার্থ! হে ধনঞ্জয়! তুমি ত্রকাগ্রচিত্তে এই গীতা শ্রবণ করেছ কি? তোমার অজ্ঞান-জনিত মোহ বিদূরিত হয়েছে কি?
তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনের গুরুর মতো আচরণ করছিলেন। তাই, সমগ্র ভগবদ্ গীতার যথাযথ অর্থ অর্জুন উপলব্ধি করতে পেরেছেন কি না তা জিঙ্গেস করা কর্তব্য বলে তিনি মনে করেছিলেন। অর্জুন যদি তাঁর অর্থ ঠিক মতো না বুঝতেন, তা হলে ভগবান কোন বিশেষ বিষয় বা সম্পূর্ণ ভগবদ্ গীতা প্রয়োজন হলে আবার ব্যাখা করতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণ বা তাঁর প্রতিনিধি সদ্ গুরুর কাছ থেকে ভগবদ্ গীতা শ্রবণ করেন, তাঁর সমস্ত অজ্ঞনতা তৎক্ষণাৎ বিদূরিত হয়। ভগবদ্ গীতা কোন কবি বা সাহিত্যেকের লেখা সাধারন কোন গ্রন্থ নয়। তা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মূখনিঃসৃত বাণী। কেউ যদি সৌভাগ্যক্রমে শ্রীকৃষ্ণ বা তাঁর যথার্থ প্রতিনিধির কাছ থেকে এই বাণী শ্রবণ করেন, তিনি অবশ্যই মুক্ত পুরুষরূপে অজ্ঞনতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হন।
অর্জুন উবাচ
নষ্টঃ মোহঃ স্মৃতিঃ-লব্ধা তৎপ্রসাদাৎ-ময়া-অচ্যুত।
স্থিতঃ-অস্মি গত-সন্দেহঃ করিষ্যে বচনম্ তব।।৭৩।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে অচ্যুত! তোমার কৃপায় আমার মোহ দূর হয়েছে এবং আমি স্মৃতি লাভ করেছি। আমার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে এবং যথাজ্ঞানে অবস্থিত হয়েছি। এখন আমি তোমার আদেশ পালন করব।
তাৎপর্যঃ অর্জুনের আর্দশরূপ সমস্ত জীবেরই স্বরূপগত অবস্থায় পরেমশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করা উচিত। আত্মসংযম করা তাদের ধর্ম। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন যে , জীবের স্বরুপ হচ্ছে ভগবানের নিত্য দাস। সেই কথা ভুলে জীব জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু পরমেশ্বরের সেবা করার ফলে সে মুক্ত ভগবৎ দাসে পরিণত হয়। দাসত্ব করাটাই হচ্ছে জীবের স্বাভাবিক ধর্ম। হয় সে মায়ার দাসত্ব করে, নয় পরমেশ্বর ভগবানের দাসত্ব করে। সে যখন পরমেশ্বরের দাসত্ব করে, তখন সে তার স্বরুপে অধিষ্ঠিত থাকে, কিন্তু সে যখন বহিরঙ্গা মায়া শক্তির দাসত্ব বরণ করে, তখন সে অবশ্যই বদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব জড় জগতের দাসত্ব করে। সে তখন কামনা-বাসনার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তবু সে নিজেকে সমস্ত জগতের মালিক বলে মনে করে। একেই বলা হয় মায়া। মানুষ যখন মুক্ত হয়, তখন তার মোহ কেটে যায় এবং সে স্বেচ্ছায় পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হয়ে তাঁর ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করে।
সঞ্জয় উবাচ
ইতি-অহম্ বাসুদেবস্য পার্থস্য চ মহাত্মনঃ।
সংবাদম্-ইমম্-অশ্রৌষম্-অদ্ভুতম্ রোমহর্ষণম্।।৭৪।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- এভাবেই আমি কৃষ্ণ ও অর্জুন দুই মহাত্মার এই অদ্ভুত রোমাঞ্চকর সংবাদ শ্রবণ করেছিলাম।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্ গীতার শুরুতে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সচিব সঞ্জয়কে জিঙ্গাসা করলেন, " কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কি হল? " তাঁর গুরুদেব ব্যাসদেবের কৃপার ফলে সঞ্জয়ের হৃদয়ে সমস্ত ঘটনাগুলি প্রকাশিত হল। এভাবেই তিনি রণাঙ্গনের মূল ঘটনাগুলি ব্যাখা করলেন। এই বাক্যালাপ অর্পূব, কারণ পূর্বে দুজন অতি মহান পুরুষের মধ্যে এই রকম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কখনই হয়নি এবং ভবিষ্যতে হবে না। এটি অপূর্ব , কারণ পরম পুরুষোত্তম ভগবান তাঁর স্বরুপ ও তাঁর শক্তি সম্বন্ধে তাঁর অতি মহান ভক্ত অর্জুনের মতো জীবের কাছে বর্ণনা করেছেন। আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণকে জানবার জন্য অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করি, তা হলে আমাদের জীবন সুখদায়ক ও সার্থক হবে। সঞ্জয় তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং যেমনভাবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেভাবেই তিনি সেই কথোপকথন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করেন। এখন এখানে স্থির সিদ্ধান্ত করা হচ্ছে যে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্ত অর্জুন বর্তমান, সেখানে বিজয় অবশ্যম্ভবী।
সঞ্জয় উবাচ
ব্যাসপ্রসাদাৎ-শ্রুতবান্-ত্রতৎ গুহ্যম্-অহম্ পরম্।
যোগম্ যোগেশ্বরাৎ কৃষ্ণাৎ-সাক্ষাৎ-কথয়তঃ-স্বয়ম্।।৭৫।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- ব্যাসদেবের কৃপায়, আমি এই পরম গোপনীয় যোগ সাক্ষাৎ বর্ণনাকারী স্বয়ং যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করেছি।
তাৎপর্যঃ ব্যাসদেব ছিলেন সঞ্চয়ের গুরুদেব এবং সঞ্জয় এখানে স্বীকার করেছেন যে, ব্যাসদেবের কৃপার ফলে তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরেছেন। অথাৎ সরাসরিভাবে নিজের চেষ্টার দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারা যায় না। তাঁকে জানতে হয় গুরুদেবের কৃপার মাধ্যমে। ভগবৎ-তত্ত্ব দর্শনের উপলব্ধি যদিও সরাসরি, কিন্তু গুরুদেব হচ্ছেন তার স্বচ্ছ মাধ্যম। সেটিই হচ্ছে গুরু - পরস্পরার রহস্য। সদ্ গুরুর কাছে সরাসরিভাবে ভগবদ্ গীতা শ্রবণ করা যায়, যেমন অর্জুন শ্রবণ করেছিলেন। সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক অতীন্দ্রিয়বাদী ও যোগী রয়েছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন যোগেশ্বর। ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে- শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শরণাগত হও। যিনি তা করেন তিনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী। ষষ্ঠ অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে সেই সত্য প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে-- যোগীণামপি সর্বেষাম্।
নারদ মুনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের শিষ্য এবং ব্যাসদেবের গুরুদেব। তাই ব্যাসদেবও হচ্ছেন অর্জুনের মতো সৎ শিষ্য, কারণ তিনি গুরু-পরস্পরায় রয়েছেন আর সঞ্জয় হচ্ছেন ব্যাসদেবের শিষ্য। তাই ব্যাসদেবের আশীর্বাদে সঞ্চয়ের ইন্দ্রিয়গুলি নির্মল হয়েছে এবং তিনি সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন এবং তাঁর কথা শ্রবণ করতে পেরেছেন।
সঞ্জয় উবাচ
রাজন্ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য সংবাদম্-ইমম্-অদ্ভুতম্।
কেশব-অর্জুনয়োঃ পুণ্যম্ হৃষ্যামি চ মুহুর্মুহুঃ।।৭৬।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ স্মরণ করতে করতে আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছি।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্ গীতার উপলব্ধি ত্রতই দিব্য যে, কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন সম্বন্ধে অবগত হন, তখনই তিনি পবিত্র হন এবং তাঁদের কথা আর তিনি ভুলতে পারেন না। এটিই হচ্ছে ভক্ত- জীবনের চিন্ময় অবস্থা। পক্ষান্তরে বলা যায়, কেউ যখন নির্ভুল উৎস সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে
গীতা শ্রবণ করেন, তখনই তিনি পূর্ণ কৃষ্ণভাবনামৃত প্রাপ্ত হন। কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রভাবে উত্তরোত্তর দিব্যজ্ঞান প্রকাশিত হতে থাকে এবং পুলকিত চিত্তে জীবন উপভোগ করা যায়। তা কেবল ক্ষণিকের জন্য নয়, প্রতি মুহুর্তে সেই দিব্য আনন্দ অনুভূত হয়।
সঞ্জয় উবাচ
তৎ-চ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য রূপম্-অতি-অদ্ভুতম্ হরেঃ।
বিস্ময়ঃ মে মহান্ রাজন্ হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ।।৭৭।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণের সেই অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে আমি অতিশয় বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি এবং বারংবার হরষিত হচ্ছি।
তাৎপর্যঃ এখানে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, ব্যাসদেবের কৃপায় সঞ্জয় সেই রূপ দর্শন করতে পেরেছিলেন। এই কথা অবশ্য বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ পূর্বে কখনও এই রূপ দেখাননি। তা কেবল অর্জুনকে দেখানো হয়েছিল, তবুও শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তখন কতিপয় মহান ভক্ত তা দেখতে পেরেছিলেন এবং ব্যাসদেব হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের একজন মহান ভক্ত এবং তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের শক্ত্যাবেশ অবতার বলে গণ্য করা হয়। যে অদ্ভুত রূপ অর্জুনকে দেখানো হয়েছিল, ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য সঞ্জয়ের কাছে সেই রূপ প্রকাশ করেছিলেন এবং সেই রূপ স্মরণ করে সঞ্জয় পুনঃ পুনঃ বিস্ময়ান্বিত হয়েছিলেন।
সঞ্জয় উবাচ
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণঃ যত্র পার্থঃ ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীঃ-বিজয়ঃ ভূতিঃ-ধ্রুবা নীতিঃ-মতিঃ-মম।।৭৮।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত।
তাৎপর্যঃ ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের মাধ্যমে ভগবদ্ গীতা শুরু হয়। তিনি ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ আদি মহারথীদের সাহায্য প্রাপ্ত তাঁর পক্ষে সন্তানদের বিজয় আশা করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, বিজয়লক্ষ্মী তাঁর পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা করার পরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় বললেন," আপনি বিজয়ের কথা ভাবছেন, কিন্তু আমি মনে করি, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন রয়েছেন, সেখানে সৌভাগ্যলক্ষ্মীও থাকবেন।' তিনি সরাসরিভাবে প্রতিপন্ন করলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পক্ষের বিজয় আশা করতে পারেন না। অর্জুনের পক্ষে বিজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথের সারথির পদ বরণ করা আর একটি ঐশ্বর্যের প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণ ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ এবং বৈরাগ্য হচ্ছে তাদের মধ্যে একটি। এই প্রকার বৈরাগ্যের বহু নিদর্শন রয়েছে, কেন না শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন বৈরাগ্যেরও ঈশ্বর।
প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ হচ্ছিল দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে। অর্জুন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ছিলেন, তাই যুধিষ্ঠিরের বিজয় অর্নিবার্য ছিল। কে পৃথিবী শাসন করবে তা স্থির করার জন্য যুদ্ধ হচ্ছিল এবং সঞ্জয় ভবিষ্যৎ বাণী করলেন যে, যুধিষ্ঠিরের দিকে শক্তি স্থানান্তরিত হবে। ভবিষ্যৎ বাণী আরও বলা হল যে, যুদ্ধজয়ের পরে যুধিষ্ঠির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করবেন। কারণ তিনি কেবল ধার্মিক ও পূণ্যবানই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর নীতিবাদীও। তাঁর সারা জীবনে তিনি একটিও মিথ্যা কথা বলেননি।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ অন্তে শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা-
ওঁ যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্ ভবেৎ ।
পূর্ণং ভবতু ত্বৎ সর্বং ত্বৎ প্রসাদাৎ জনার্দ্দন ।।
মন্ত্র হীনং ক্রিয়া হীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন ।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তুমে ।।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন