ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
অর্জ্জুন উবাচ -
প্রকৃতিং পুরুষঞ্চৈব ক্ষেত্রং ক্ষেত্রজ্ঞমেবচ।
এতদ্ বেদিতুমিচ্ছামি জ্ঞানং জ্ঞেয়ঞ্চ কেশব।।১
অর্থঃ- (১) অর্জ্জুন কহিলেন - হে কেশব, প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ এবং জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইগুলি জানিতে আমি ইচ্ছা করি।
শ্রীভগবানুবাচ -
ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে।
এতদ্ যো বেত্তি তং প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্ বিদঃ।।২
অর্থঃ- (২) শ্রীভগবান্ কহিলেন, - হে কৌন্তেয়, এই দেহকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং যিনি এই ক্ষেত্রকে জানেন (অর্থাৎ ‘আমি’ ‘আমার’এইরূপ মনে করেন) তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা); ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবেত্তা পণ্ডীতগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন।
ক্ষেত্রজ্ঞঞ্চাপি মাং বিদ্ধি সর্ব্বক্ষেত্রেষু ভারত।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োর্জ্ঞানং যত্তজ্ জ্ঞানং মতং মম।।৩
অর্থঃ- (৩) হে ভারত, সমুদয় ক্ষেত্রে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, ইহাই আমার মত। অথবা ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই আমার (পরমেশ্বরের) জ্ঞান, ইহা সর্ব্বসম্মত।
তৎ ক্ষেত্রং যচ্চ যাদৃক্ চ যদ্ বিকারি যতশ্চ যৎ।
স চ যো যৎপ্রভাবশ্চ ত সমাসেন মে শৃণু।।৪
অর্থঃ- (৪) সেই ক্ষেত্র কি, উহা কি প্রকার, উহা কি প্রকার বিকার-বিশিষ্ট এবং ইহার মধ্যেও কি হইতে কি হয়, এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞ কে এবং তাহার প্রভাব কিরূপ, এই সকল তত্ত্ব সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর।
ঋষিভির্বহুধা গীতং ছন্দোভির্বিবিধৈঃ পৃথক্।
ব্রহ্মসূত্রপদৈশ্চৈব হেতুমদ্ভির্বিনিশ্চিতৈঃ।।৫
অর্থঃ- (৫) ঋষিগণ কর্ত্তৃক নানা ছন্দে পৃথক্ পৃথক্ নানা প্রকারে এই ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে। ব্রহ্মসূত্র-পদসমূহেও যুক্তিযুক্ত বিচারসহ নিঃ সন্দিগ্ধরূপে এই বিষয় ব্যাখ্যাত হইয়াছে।
ব্রহ্মসূত্র বলিতে বেদান্ত দর্শন বুঝায়। বিভিন্ন ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্ পৃথক্ অধ্যাত্মতত্ত্বের আলোচনা করিয়াছেন। যুক্তিযুক্ত বিচার বিতর্ক দ্বারা ঐ সকল বিভিন্ন মতের সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধান করিয়া বেদান্ত দর্শন রচিত হইয়াছে। এই শ্লোকে তাহাই বলা হইল। ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্ ভাবে যাহা আলোচনা করিয়াছেন, ব্রহ্মসূত্র তাহাই কার্য্যকারণহেতু দেখাইয়া নিঃসন্দিগ্ধরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছে। এই হেতু উহার অপর নাম উত্তর মীমাংসা এবং উহাতে ক্ষেত্রজ্ঞের বিচার আছে বলিয়া উহাকে শারীরক সূত্রও বলে (শরীর=ক্ষেত্র)। ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শন গীতার পরে রচিত হইয়াছে মনে করিয়া কেহ কেহ ‘ব্রহ্মসূত্র’ পদে ব্রহ্মপ্রতিপাদক সূত্র অর্থাৎ উপনিষদাদি এইরূপ অর্থ করেন। কিন্তু লোকমান্য তিলক প্রভৃতি আধুনিক পণ্ডিতগণের মত এই যে বর্ত্তমান মহাভারত, গীতা এবং বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র এই তিনই বাদরায়ণ ব্যাসদেবেরই প্রণীত। এই হেতু ব্রহ্মসুত্রকে ব্যাসসূত্রও বলে।
মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেবচ।
ইন্দ্রিয়াণি দশৈকঞ্চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরাঃ।।৬
ইচ্ছা দ্বেষঃ সুখং দুঃখং সংঘাতশ্চেতনাধৃতিঃ।।
এতৎ ক্ষেত্রং সমাসেন সবিকারমুদাহৃতম্।।৭
অর্থঃ- (৬-৭) ক্ষিতি আদি পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি (মহত্তত্ত্ব), মূল প্রকৃতি, দশ ইন্দ্রিয়, মন এবং রূপরসাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (পঞ্চতন্মাত্র) এবং ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা ও ধৃতি এই সমুদয়কে সবিকার ক্ষেত্র বলে।
অমানিত্বমদম্ভিত্বমহিংসা ক্ষান্তিরার্জবম্।
আচার্য্যোপাসনং শৌচং ধৈর্য্যমাত্মবিনিগ্রহঃ।।৮
ইন্দ্রিয়ার্থেষু বৈরাগ্যমনহঙ্কার এব চ।
জন্মমৃতুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম্।।৯
অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু।
নিত্যঞ্চ সমচিত্তত্বমিষ্টানিষ্টোপপত্তিষু।।১০
ময়ি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী।
বিবিক্ত-দেশসেবিত্বমরতির্জনসংসদি।।১১
অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্।
এতজ্ জ্ঞানমিতি প্রোক্তমজ্ঞানং যদতোহন্যথা।।১২
অর্থঃ- (৮-১২) শ্লাঘা-রাহিত্য, দম্ভ-রাহিত্য, অহিংসা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, শৌচ, সৎকার্য্যে একনিষ্ঠা, আত্মসংযম, বিষয়-বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা, জন্ম-মৃত্যু-জরাব্যাধিতে দুঃখ দর্শন, বিষয়ে বা কর্ম্মে অনাসক্তি, স্ত্রীপুত্রগৃহাদিতে মমত্ববোধের অভাব, ইষ্টানিষ্টলাভে সমচিত্ততা, আমাতে (ভগবান্ বাসুদেবে) অনন্যচিত্তে ঐকান্তিক ভক্তি, পবিত্র নির্জ্জন স্থানে বাস, প্রাকৃত জনসমাজে বিরক্তি, সর্ব্বতা অধ্যাত্মজ্ঞানের অনুশীলন (নিত্য আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা), তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন আলোচনা - এই সকলকে জ্ঞান বলা হয়; ইহার বিপরীত যাহা তাহা অজ্ঞান।
জ্ঞেয়ং যৎ তৎ প্রবক্ষ্যামি যজ্ জ্ঞাত্বাহমৃতমশ্নুতে।
অনাদিমৎপরং ব্রহ্ম ন সৎ তন্নাসদুচ্যতে।।১৩
অর্থঃ- (১৩) যাহা জ্ঞাতব্য বস্তু, যাহা জ্ঞাত হইলে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা যায়, তাহা বলিতেছি; তাহা আদ্যন্তহীন, আমার নির্ব্বিশেষ স্বরূপ ব্রহ্ম; তৎসন্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন।
সর্ব্বতঃ পাণিপাদং ত সর্ব্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্ব্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্ব্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।১৪
অর্থঃ- (১৪) সর্ব্বদিকে তাঁহার হস্তপদ, সর্ব্বদিকে তাঁহার চক্ষু, মস্তক ও মুখ, সর্ব্বদিকে তাহার কর্ণঃ এইরূপে এই লোকে সমস্ত পদার্থ ব্যাপিয়া তিনি অবস্থিত আছেন।
সর্ব্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্ব্বেন্দ্রিয়বিবর্জ্জিতম্।
অসক্তং সর্ব্বভূচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ।।১৫
অর্থঃ- (১৫) তিনি চক্ষুরাদি সমুদয় ইন্দ্রিয় বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ সর্ব্বেন্দ্রিয়বিবর্জ্জিত নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্ব্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সত্ত্বাদি গুণের ভোক্তা বা পালক।
বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ।
সুক্ষ্মত্বাৎ তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ তৎ।।১৬
অর্থঃ- (১৬) সর্ব্বভুতের অন্তরে এবং বাহিরেও তিন; চল এবং অচলও তিনি; সূক্ষ্মতাবশতঃ তিনি অবিজ্ঞেয়; এবং তিনি দূরে থাকিয়াও নিকটে স্থিত।
অবিভক্তঞ্চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।
ভূতভর্ত্তৃচ তজ্ জ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।১৭
অর্থঃ- (১৭) তিনি (তত্ত্বতঃ বা স্বরূপতঃ) অপরিচ্ছিন্ন হইলেও সর্ব্বভূতে ভিন্ন ভিন্ন বলিয়া প্রতীত হন। তাঁহাকে ভূতসকলের পালনকর্ত্তা, সংহর্ত্তা ও সৃষ্টিকর্ত্তা বলিয়া জানিবে।
জ্যোতিষামপি তজ্জ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্ব্বস্য বিষ্ঠিতম্।।১৮
অর্থঃ- (১৭) তিনি জ্যোতিসকলেরও (সূর্য্যাদিরও) জ্যোতিঃ; তিনি তমের অর্থাৎ অবিদ্যারূপ অন্ধকারের অতীত, তিনি বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয় তত্ত্ব, তিনি জ্ঞানের দ্বারা লভ্য, তিনি সর্ব্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন।
ইতি ক্ষেত্রং তথা জ্ঞানং জ্ঞেয়ঞ্চোক্তং সমাসতঃ।
মদ্ভক্ত এতদ্ বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে।।১৯
অর্থঃ- (১৯) এই প্রকারে ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় কাহাকে বলে সংক্ষেপে কথিত হইল। আমার ভক্ত ইহা জানিয়া আমার ভাব বা স্বরূপ বুঝিতে পারেন, বা আমার দিব্য প্রকৃতি প্রাপ্ত হন।
প্রকৃতিং পুরুঞ্চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি।
বিকারাংশ্চ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্রকৃতিসম্ভবান্।।২০
অর্থঃ- (২০) প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিও। দেহেন্দ্রিয়াদি বিকারসমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহাদি গুণসমূহ প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে জানিবে।
সাংখ্যমতে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ই অনাদি এবং স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব; কিন্তু বেদান্তী বলেন, প্রকৃতি স্বতন্ত্র নহে, উহা পরমেশ্বর হইতেই উৎপন্ন, পরমেশ্বরেরই শক্তি এবং এই হেতুই অনাদি। গীতায় ইহাদিগকেই অপরা ও পরা প্রকৃতি বলা হইয়াছে।
কার্য্যকারণকর্ত্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরুচ্যতে।
পুরুষং সুখদুঃখানাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচ্যতে।।২১
অর্থঃ- (২১) শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্ত্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিই কারণ, এবং সুখ, দুঃখ ভোগ বিষয়ে পুরুষই (ক্ষেত্রজ্ঞ) কারণ বলিয়া উক্ত হন।
পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙ্ ক্তে প্রকৃতিজান্ গুণান্।
কারণং গুণসঙ্গোহস্য সদসদ্ যোনিজন্মসু।।২২
অর্থঃ- (২২) পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এবং গুণসমূহের সংসর্গই পুরুষের সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের কারণ হয়।
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্ত্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃপরঃ।।২৩
অর্থঃ- (২৩) এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্ত্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলিয়া উক্ত হন।
সাংখ্য দর্শন যাহাকে স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব পুরুষ বলনে, তাহাকেই এস্থলে পরমপুরুষ পরমাত্মা বলা হইতেছে। সুতরাং এস্থলে সাংখ্য ও বেদান্তের সমন্বয় হইয়া গেল।
য এবং বেত্তি পুরুষং প্রকৃতিঞ্চ গুণৈঃসহ।
সর্ব্বথা বর্তমানোহপি ন স ভুয়োহভিজায়তে।।২৪
অর্থঃ- (২৪) যিনি এই প্রকার পুরুষতত্ত্ব এবং বিকারাদি গুণ সহিত প্রকৃতিতত্ত্ব অবগত হন, তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, পুনরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন।
ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি কেচিদাত্মানমাত্মনা।
অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্ম্মযোগেন চাপরে।।২৫
অর্থঃ- (২৫) কেহ কেহ স্বয়ং আপনি আপনাতেই ধ্যানের দ্বারা আত্ম দর্শন করেন। কেহ কেহ সাংখ্যযোগ দ্বারা এবং অন্য কেহ কেহ কর্ম্মযোগের দ্বারা আত্মাকে দর্শন করেন।
অন্যে ত্বেবমজানন্তঃ শ্রুত্বান্যেভ্য উপাসতে।
তেহপি চাতিতরন্ত্যেব মৃত্যুং শ্রুতিপরায়ণাঃ।।২৬
অর্থঃ- (২৬) আবার অন্য কেহ কেহ এইরূপ আপনা আপনি আত্মাকে না জানিয়া অন্যের নিকট শুনিয়া উপাসনা করেন।শ্রদ্ধাপূর্ব্বক উপদেশ শ্রবণ করিয়া উপাসনা করতঃ তাহারাও মৃত্যুকে অতিক্রম করেন।
ধ্যান, জ্ঞান, কর্ম্ম, ভক্তি - গীতা এই চারটি বিভিন্ন মার্গের উল্লেখ করিয়াছেন এবং ইহার যে কোন মার্গে সাধন আরম্ভ হউক না কেন, শেষে পরমেশ্বর প্রাপ্তি বা মোক্ষ লাভ হয়ই, ইহাই গীতার উদার মত। গীতোক্ত যোগ বলিতে ইহার ঠিক কোন একটা বুঝায় না। গীতা এই চারিটি মার্গের সমন্বয় করিয়া অপূর্ব্ব যোগধর্ম্মশিক্ষা দিয়াছেন। সেই যোগ কি তাহা পূর্ব্বে নানা স্থানে প্রদর্শিত হইয়াছে।
যাবৎ সংজায়তে কিঞ্চিৎ সত্ত্বং স্থাবরজঙ্গমম্।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞসংযোগাৎ তদ্ বিদ্ধি ভরতর্ষভ।।২৭
অর্থঃ- (২৭) হে ভরতর্ষভ, স্থাবর, জঙ্গম যত কিছু পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহা সমস্তই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগই জগৎ সৃষ্টি। একথা পূর্ব্বেও বলা হইয়াছে।
বেদান্ত মতে এ সংযোগকে অধ্যাস, ঈক্ষণ ইত্যাদি বলা হয়। এই অধ্যাসের ফলে ক্ষেত্রজ্ঞের ধর্ম্ম ক্ষেত্রে আরোপিত হয় এবং ক্ষেত্রের ধর্ম্ম ক্ষেত্রজ্ঞে আরোপিত হয়।
সমং সর্ব্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্।
বিনশ্যৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।।২৮
অর্থঃ- (২৮) যিনি সর্ব্বভূতে সমভাবে অবস্থিত এবং সমস্ত বিনষ্ট হইলেও যিনি বিনষ্ট হন না, সেই পরমেশ্বরকে যিনি সম্যগ্ দর্শন করিয়াছেন, তিনি যথার্থদর্শী।
ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বা প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি, একথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। এই সংযোগের মধ্যে যিনি বিয়োগ দর্শন করেন অর্থাৎ প্রকৃতি হইতে পুরুষের, বা দেহ হইতে আত্মার পার্থক্য দর্শন করেন, এবং সেই এক বস্তুই সর্ব্বত্র সমভাবে বিদ্যমান ইহা অনুভব করেন, তিনিই মুক্ত। এই শ্লোক এবং পরবর্ত্তী কয়েকটি শ্লোকে এই তত্ত্বই বিবৃত হইয়াছে।
সমং পশ্যন্ হি সর্ব্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্।।২৯
অর্থঃ- (২৯) যিনি সর্ব্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মাদ্বারা আত্মাকে হনন করেন না এবং সেই হেতু তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন।
প্রকৃত্যৈব চ কর্মাণি ক্রিয়মাণানি সর্ব্বশঃ।
যঃ পশ্যতি তথাত্মানমকর্ত্তারং স পশ্যতি।।৩০
অর্থঃ- (৩০) প্রকৃতিই সমস্ত প্রকারে সমস্ত কর্ম্ম করেন এবং আত্মা অকর্ত্তা, ইহা যিনি দর্শন করেন তিনিই যথার্থদর্শী।
যদা ভূতপৃথগ্ ভাবমেকস্থমনুপশ্যতি।
তত এব চ বিস্তারং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে তদা।।৩১
অর্থঃ- (৩১) যখন তত্ত্বদর্শী সাধক ভূতসমূহের পৃথক্ পৃথক্ ভাব, অর্থাৎ নানাত্বের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন।
জগতের নানাত্বের মধ্যে যিনি একমাত্র ব্রহ্মসত্ত্বাই অনুভব করেন, এবং সেই এক ব্রহ্ম হইতেই এই নানাত্বের অভিব্যক্তি ইহা যখন সাধক বুঝিতে পারেন, তখনই তাঁহার ব্রহ্মভাব লাভ হয়।
অনাদিত্বান্নির্গুণত্বাৎ পরমাত্মায়মব্যয়ঃ।
শরীরস্থোহপি কৌন্তেয় ন করোতি ন লিপ্যতে।।৩২
অর্থঃ- (৩২) হে কৌন্তেয়, অনাদি ও নির্গুণ বলিয়া এই পরমাত্মা অবিকারী; অতএব দেহে থাকিয়াও তিনি কিছুই করেন না এবং কর্ম্মফলে লিপ্ত হন না।
যথা সর্বগতং সৌক্ষ্ম্যাদাকাশং নোপলিপ্যতে।
সর্ব্বত্রাবস্থিতো দেহে তথাত্মা নোপলিপ্যতে।।৩৩
অর্থঃ- (৩৩) যেমন আকাশ সর্ব্ববস্তুতে অবস্থিত থাকিলেও অতি সূক্ষ্মতা হেতু কোন বস্তুতে লিপ্ত হয় না, সেরূপ আত্মা সর্ব্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও কিছুতেই লিপ্ত হয় না।
যেমন আকাশ সর্ব্বব্যাপী হইয়াও সুগন্ধ, দুর্গন্ধ, সলিল, পঙ্কাদির দোষ-গুণে লিপ্ত হয় না, সেইরূপ আত্মা সর্ব্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও দৈহিক দোষগুণে লিপ্ত হন না।
যথা প্রকাশয়ত্যেকঃ কৃৎস্নং লোকমিমং রবিঃ।
ক্ষেত্রং ক্ষেত্রী তথা কৃৎস্নং প্রকাশয়তি ভারত।।৩৪
অর্থঃ- (৩৪) হে ভারত, যেমন এক সূর্য্য সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেন, সেরূপ এক ক্ষেত্রজ্ঞ (আত্মা) সমস্ত ক্ষেত্র বা দেহকে প্রকাশিত করেন।
সূর্য্যের সহিত উপমার তাৎপর্য্য এই যে, যেমন এক সূর্য্য সকলের প্রকাশক অথচ নির্লিপ্ত, আত্মাও সেইরূপ।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োরেবমন্তরং জ্ঞানচক্ষুষা।
ভূতপ্রকৃতিমোক্ষঞ্চ যে বিদুর্যান্তি তে পরম্।।৩৫
অর্থঃ- (৩৫) যাহারা জ্ঞানচক্ষুদ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভেদ এবং ভূতপ্রকৃতি অর্থাৎ অবিদ্যা হইতে মোক্ষ কি প্রকার তাহা দর্শন করেন (জানিতে পারেন) তাহারা পরমপদ প্রাপ্ত হন।
ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসুপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগযোগো নাম ত্রয়োদশোহধ্যায়ঃ।।
ভিডিও গীতা কীর্তনঃ https://www.youtube.com/watch?v=nrN7q3Luh7M
সংগৃহীতঃhttp://geetabangla.blogspot.com/
অর্জ্জুন উবাচ -
প্রকৃতিং পুরুষঞ্চৈব ক্ষেত্রং ক্ষেত্রজ্ঞমেবচ।
এতদ্ বেদিতুমিচ্ছামি জ্ঞানং জ্ঞেয়ঞ্চ কেশব।।১
অর্থঃ- (১) অর্জ্জুন কহিলেন - হে কেশব, প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ এবং জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইগুলি জানিতে আমি ইচ্ছা করি।
শ্রীভগবানুবাচ -
ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে।
এতদ্ যো বেত্তি তং প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্ বিদঃ।।২
অর্থঃ- (২) শ্রীভগবান্ কহিলেন, - হে কৌন্তেয়, এই দেহকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং যিনি এই ক্ষেত্রকে জানেন (অর্থাৎ ‘আমি’ ‘আমার’এইরূপ মনে করেন) তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা); ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবেত্তা পণ্ডীতগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন।
ক্ষেত্রজ্ঞঞ্চাপি মাং বিদ্ধি সর্ব্বক্ষেত্রেষু ভারত।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োর্জ্ঞানং যত্তজ্ জ্ঞানং মতং মম।।৩
অর্থঃ- (৩) হে ভারত, সমুদয় ক্ষেত্রে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, ইহাই আমার মত। অথবা ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই আমার (পরমেশ্বরের) জ্ঞান, ইহা সর্ব্বসম্মত।
তৎ ক্ষেত্রং যচ্চ যাদৃক্ চ যদ্ বিকারি যতশ্চ যৎ।
স চ যো যৎপ্রভাবশ্চ ত সমাসেন মে শৃণু।।৪
অর্থঃ- (৪) সেই ক্ষেত্র কি, উহা কি প্রকার, উহা কি প্রকার বিকার-বিশিষ্ট এবং ইহার মধ্যেও কি হইতে কি হয়, এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞ কে এবং তাহার প্রভাব কিরূপ, এই সকল তত্ত্ব সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর।
ঋষিভির্বহুধা গীতং ছন্দোভির্বিবিধৈঃ পৃথক্।
ব্রহ্মসূত্রপদৈশ্চৈব হেতুমদ্ভির্বিনিশ্চিতৈঃ।।৫
অর্থঃ- (৫) ঋষিগণ কর্ত্তৃক নানা ছন্দে পৃথক্ পৃথক্ নানা প্রকারে এই ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে। ব্রহ্মসূত্র-পদসমূহেও যুক্তিযুক্ত বিচারসহ নিঃ সন্দিগ্ধরূপে এই বিষয় ব্যাখ্যাত হইয়াছে।
ব্রহ্মসূত্র বলিতে বেদান্ত দর্শন বুঝায়। বিভিন্ন ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্ পৃথক্ অধ্যাত্মতত্ত্বের আলোচনা করিয়াছেন। যুক্তিযুক্ত বিচার বিতর্ক দ্বারা ঐ সকল বিভিন্ন মতের সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধান করিয়া বেদান্ত দর্শন রচিত হইয়াছে। এই শ্লোকে তাহাই বলা হইল। ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্ ভাবে যাহা আলোচনা করিয়াছেন, ব্রহ্মসূত্র তাহাই কার্য্যকারণহেতু দেখাইয়া নিঃসন্দিগ্ধরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছে। এই হেতু উহার অপর নাম উত্তর মীমাংসা এবং উহাতে ক্ষেত্রজ্ঞের বিচার আছে বলিয়া উহাকে শারীরক সূত্রও বলে (শরীর=ক্ষেত্র)। ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শন গীতার পরে রচিত হইয়াছে মনে করিয়া কেহ কেহ ‘ব্রহ্মসূত্র’ পদে ব্রহ্মপ্রতিপাদক সূত্র অর্থাৎ উপনিষদাদি এইরূপ অর্থ করেন। কিন্তু লোকমান্য তিলক প্রভৃতি আধুনিক পণ্ডিতগণের মত এই যে বর্ত্তমান মহাভারত, গীতা এবং বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র এই তিনই বাদরায়ণ ব্যাসদেবেরই প্রণীত। এই হেতু ব্রহ্মসুত্রকে ব্যাসসূত্রও বলে।
মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেবচ।
ইন্দ্রিয়াণি দশৈকঞ্চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরাঃ।।৬
ইচ্ছা দ্বেষঃ সুখং দুঃখং সংঘাতশ্চেতনাধৃতিঃ।।
এতৎ ক্ষেত্রং সমাসেন সবিকারমুদাহৃতম্।।৭
অর্থঃ- (৬-৭) ক্ষিতি আদি পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি (মহত্তত্ত্ব), মূল প্রকৃতি, দশ ইন্দ্রিয়, মন এবং রূপরসাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (পঞ্চতন্মাত্র) এবং ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা ও ধৃতি এই সমুদয়কে সবিকার ক্ষেত্র বলে।
অমানিত্বমদম্ভিত্বমহিংসা ক্ষান্তিরার্জবম্।
আচার্য্যোপাসনং শৌচং ধৈর্য্যমাত্মবিনিগ্রহঃ।।৮
ইন্দ্রিয়ার্থেষু বৈরাগ্যমনহঙ্কার এব চ।
জন্মমৃতুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম্।।৯
অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু।
নিত্যঞ্চ সমচিত্তত্বমিষ্টানিষ্টোপপত্তিষু।।১০
ময়ি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী।
বিবিক্ত-দেশসেবিত্বমরতির্জনসংসদি।।১১
অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্।
এতজ্ জ্ঞানমিতি প্রোক্তমজ্ঞানং যদতোহন্যথা।।১২
অর্থঃ- (৮-১২) শ্লাঘা-রাহিত্য, দম্ভ-রাহিত্য, অহিংসা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, শৌচ, সৎকার্য্যে একনিষ্ঠা, আত্মসংযম, বিষয়-বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা, জন্ম-মৃত্যু-জরাব্যাধিতে দুঃখ দর্শন, বিষয়ে বা কর্ম্মে অনাসক্তি, স্ত্রীপুত্রগৃহাদিতে মমত্ববোধের অভাব, ইষ্টানিষ্টলাভে সমচিত্ততা, আমাতে (ভগবান্ বাসুদেবে) অনন্যচিত্তে ঐকান্তিক ভক্তি, পবিত্র নির্জ্জন স্থানে বাস, প্রাকৃত জনসমাজে বিরক্তি, সর্ব্বতা অধ্যাত্মজ্ঞানের অনুশীলন (নিত্য আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা), তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন আলোচনা - এই সকলকে জ্ঞান বলা হয়; ইহার বিপরীত যাহা তাহা অজ্ঞান।
জ্ঞেয়ং যৎ তৎ প্রবক্ষ্যামি যজ্ জ্ঞাত্বাহমৃতমশ্নুতে।
অনাদিমৎপরং ব্রহ্ম ন সৎ তন্নাসদুচ্যতে।।১৩
অর্থঃ- (১৩) যাহা জ্ঞাতব্য বস্তু, যাহা জ্ঞাত হইলে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা যায়, তাহা বলিতেছি; তাহা আদ্যন্তহীন, আমার নির্ব্বিশেষ স্বরূপ ব্রহ্ম; তৎসন্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন।
সর্ব্বতঃ পাণিপাদং ত সর্ব্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্ব্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্ব্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।১৪
অর্থঃ- (১৪) সর্ব্বদিকে তাঁহার হস্তপদ, সর্ব্বদিকে তাঁহার চক্ষু, মস্তক ও মুখ, সর্ব্বদিকে তাহার কর্ণঃ এইরূপে এই লোকে সমস্ত পদার্থ ব্যাপিয়া তিনি অবস্থিত আছেন।
সর্ব্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্ব্বেন্দ্রিয়বিবর্জ্জিতম্।
অসক্তং সর্ব্বভূচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ।।১৫
অর্থঃ- (১৫) তিনি চক্ষুরাদি সমুদয় ইন্দ্রিয় বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ সর্ব্বেন্দ্রিয়বিবর্জ্জিত নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্ব্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সত্ত্বাদি গুণের ভোক্তা বা পালক।
বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ।
সুক্ষ্মত্বাৎ তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ তৎ।।১৬
অর্থঃ- (১৬) সর্ব্বভুতের অন্তরে এবং বাহিরেও তিন; চল এবং অচলও তিনি; সূক্ষ্মতাবশতঃ তিনি অবিজ্ঞেয়; এবং তিনি দূরে থাকিয়াও নিকটে স্থিত।
অবিভক্তঞ্চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।
ভূতভর্ত্তৃচ তজ্ জ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।১৭
অর্থঃ- (১৭) তিনি (তত্ত্বতঃ বা স্বরূপতঃ) অপরিচ্ছিন্ন হইলেও সর্ব্বভূতে ভিন্ন ভিন্ন বলিয়া প্রতীত হন। তাঁহাকে ভূতসকলের পালনকর্ত্তা, সংহর্ত্তা ও সৃষ্টিকর্ত্তা বলিয়া জানিবে।
জ্যোতিষামপি তজ্জ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্ব্বস্য বিষ্ঠিতম্।।১৮
অর্থঃ- (১৭) তিনি জ্যোতিসকলেরও (সূর্য্যাদিরও) জ্যোতিঃ; তিনি তমের অর্থাৎ অবিদ্যারূপ অন্ধকারের অতীত, তিনি বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয় তত্ত্ব, তিনি জ্ঞানের দ্বারা লভ্য, তিনি সর্ব্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন।
ইতি ক্ষেত্রং তথা জ্ঞানং জ্ঞেয়ঞ্চোক্তং সমাসতঃ।
মদ্ভক্ত এতদ্ বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে।।১৯
অর্থঃ- (১৯) এই প্রকারে ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় কাহাকে বলে সংক্ষেপে কথিত হইল। আমার ভক্ত ইহা জানিয়া আমার ভাব বা স্বরূপ বুঝিতে পারেন, বা আমার দিব্য প্রকৃতি প্রাপ্ত হন।
প্রকৃতিং পুরুঞ্চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি।
বিকারাংশ্চ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্রকৃতিসম্ভবান্।।২০
অর্থঃ- (২০) প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিও। দেহেন্দ্রিয়াদি বিকারসমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহাদি গুণসমূহ প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে জানিবে।
সাংখ্যমতে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ই অনাদি এবং স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব; কিন্তু বেদান্তী বলেন, প্রকৃতি স্বতন্ত্র নহে, উহা পরমেশ্বর হইতেই উৎপন্ন, পরমেশ্বরেরই শক্তি এবং এই হেতুই অনাদি। গীতায় ইহাদিগকেই অপরা ও পরা প্রকৃতি বলা হইয়াছে।
কার্য্যকারণকর্ত্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরুচ্যতে।
পুরুষং সুখদুঃখানাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচ্যতে।।২১
অর্থঃ- (২১) শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্ত্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিই কারণ, এবং সুখ, দুঃখ ভোগ বিষয়ে পুরুষই (ক্ষেত্রজ্ঞ) কারণ বলিয়া উক্ত হন।
পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙ্ ক্তে প্রকৃতিজান্ গুণান্।
কারণং গুণসঙ্গোহস্য সদসদ্ যোনিজন্মসু।।২২
অর্থঃ- (২২) পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এবং গুণসমূহের সংসর্গই পুরুষের সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের কারণ হয়।
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্ত্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃপরঃ।।২৩
অর্থঃ- (২৩) এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্ত্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলিয়া উক্ত হন।
সাংখ্য দর্শন যাহাকে স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব পুরুষ বলনে, তাহাকেই এস্থলে পরমপুরুষ পরমাত্মা বলা হইতেছে। সুতরাং এস্থলে সাংখ্য ও বেদান্তের সমন্বয় হইয়া গেল।
য এবং বেত্তি পুরুষং প্রকৃতিঞ্চ গুণৈঃসহ।
সর্ব্বথা বর্তমানোহপি ন স ভুয়োহভিজায়তে।।২৪
অর্থঃ- (২৪) যিনি এই প্রকার পুরুষতত্ত্ব এবং বিকারাদি গুণ সহিত প্রকৃতিতত্ত্ব অবগত হন, তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, পুনরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন।
ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি কেচিদাত্মানমাত্মনা।
অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্ম্মযোগেন চাপরে।।২৫
অর্থঃ- (২৫) কেহ কেহ স্বয়ং আপনি আপনাতেই ধ্যানের দ্বারা আত্ম দর্শন করেন। কেহ কেহ সাংখ্যযোগ দ্বারা এবং অন্য কেহ কেহ কর্ম্মযোগের দ্বারা আত্মাকে দর্শন করেন।
অন্যে ত্বেবমজানন্তঃ শ্রুত্বান্যেভ্য উপাসতে।
তেহপি চাতিতরন্ত্যেব মৃত্যুং শ্রুতিপরায়ণাঃ।।২৬
অর্থঃ- (২৬) আবার অন্য কেহ কেহ এইরূপ আপনা আপনি আত্মাকে না জানিয়া অন্যের নিকট শুনিয়া উপাসনা করেন।শ্রদ্ধাপূর্ব্বক উপদেশ শ্রবণ করিয়া উপাসনা করতঃ তাহারাও মৃত্যুকে অতিক্রম করেন।
ধ্যান, জ্ঞান, কর্ম্ম, ভক্তি - গীতা এই চারটি বিভিন্ন মার্গের উল্লেখ করিয়াছেন এবং ইহার যে কোন মার্গে সাধন আরম্ভ হউক না কেন, শেষে পরমেশ্বর প্রাপ্তি বা মোক্ষ লাভ হয়ই, ইহাই গীতার উদার মত। গীতোক্ত যোগ বলিতে ইহার ঠিক কোন একটা বুঝায় না। গীতা এই চারিটি মার্গের সমন্বয় করিয়া অপূর্ব্ব যোগধর্ম্মশিক্ষা দিয়াছেন। সেই যোগ কি তাহা পূর্ব্বে নানা স্থানে প্রদর্শিত হইয়াছে।
যাবৎ সংজায়তে কিঞ্চিৎ সত্ত্বং স্থাবরজঙ্গমম্।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞসংযোগাৎ তদ্ বিদ্ধি ভরতর্ষভ।।২৭
অর্থঃ- (২৭) হে ভরতর্ষভ, স্থাবর, জঙ্গম যত কিছু পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহা সমস্তই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগই জগৎ সৃষ্টি। একথা পূর্ব্বেও বলা হইয়াছে।
বেদান্ত মতে এ সংযোগকে অধ্যাস, ঈক্ষণ ইত্যাদি বলা হয়। এই অধ্যাসের ফলে ক্ষেত্রজ্ঞের ধর্ম্ম ক্ষেত্রে আরোপিত হয় এবং ক্ষেত্রের ধর্ম্ম ক্ষেত্রজ্ঞে আরোপিত হয়।
সমং সর্ব্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্।
বিনশ্যৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।।২৮
অর্থঃ- (২৮) যিনি সর্ব্বভূতে সমভাবে অবস্থিত এবং সমস্ত বিনষ্ট হইলেও যিনি বিনষ্ট হন না, সেই পরমেশ্বরকে যিনি সম্যগ্ দর্শন করিয়াছেন, তিনি যথার্থদর্শী।
ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বা প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি, একথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। এই সংযোগের মধ্যে যিনি বিয়োগ দর্শন করেন অর্থাৎ প্রকৃতি হইতে পুরুষের, বা দেহ হইতে আত্মার পার্থক্য দর্শন করেন, এবং সেই এক বস্তুই সর্ব্বত্র সমভাবে বিদ্যমান ইহা অনুভব করেন, তিনিই মুক্ত। এই শ্লোক এবং পরবর্ত্তী কয়েকটি শ্লোকে এই তত্ত্বই বিবৃত হইয়াছে।
সমং পশ্যন্ হি সর্ব্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্।।২৯
অর্থঃ- (২৯) যিনি সর্ব্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মাদ্বারা আত্মাকে হনন করেন না এবং সেই হেতু তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন।
প্রকৃত্যৈব চ কর্মাণি ক্রিয়মাণানি সর্ব্বশঃ।
যঃ পশ্যতি তথাত্মানমকর্ত্তারং স পশ্যতি।।৩০
অর্থঃ- (৩০) প্রকৃতিই সমস্ত প্রকারে সমস্ত কর্ম্ম করেন এবং আত্মা অকর্ত্তা, ইহা যিনি দর্শন করেন তিনিই যথার্থদর্শী।
যদা ভূতপৃথগ্ ভাবমেকস্থমনুপশ্যতি।
তত এব চ বিস্তারং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে তদা।।৩১
অর্থঃ- (৩১) যখন তত্ত্বদর্শী সাধক ভূতসমূহের পৃথক্ পৃথক্ ভাব, অর্থাৎ নানাত্বের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন।
জগতের নানাত্বের মধ্যে যিনি একমাত্র ব্রহ্মসত্ত্বাই অনুভব করেন, এবং সেই এক ব্রহ্ম হইতেই এই নানাত্বের অভিব্যক্তি ইহা যখন সাধক বুঝিতে পারেন, তখনই তাঁহার ব্রহ্মভাব লাভ হয়।
অনাদিত্বান্নির্গুণত্বাৎ পরমাত্মায়মব্যয়ঃ।
শরীরস্থোহপি কৌন্তেয় ন করোতি ন লিপ্যতে।।৩২
অর্থঃ- (৩২) হে কৌন্তেয়, অনাদি ও নির্গুণ বলিয়া এই পরমাত্মা অবিকারী; অতএব দেহে থাকিয়াও তিনি কিছুই করেন না এবং কর্ম্মফলে লিপ্ত হন না।
যথা সর্বগতং সৌক্ষ্ম্যাদাকাশং নোপলিপ্যতে।
সর্ব্বত্রাবস্থিতো দেহে তথাত্মা নোপলিপ্যতে।।৩৩
অর্থঃ- (৩৩) যেমন আকাশ সর্ব্ববস্তুতে অবস্থিত থাকিলেও অতি সূক্ষ্মতা হেতু কোন বস্তুতে লিপ্ত হয় না, সেরূপ আত্মা সর্ব্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও কিছুতেই লিপ্ত হয় না।
যেমন আকাশ সর্ব্বব্যাপী হইয়াও সুগন্ধ, দুর্গন্ধ, সলিল, পঙ্কাদির দোষ-গুণে লিপ্ত হয় না, সেইরূপ আত্মা সর্ব্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও দৈহিক দোষগুণে লিপ্ত হন না।
যথা প্রকাশয়ত্যেকঃ কৃৎস্নং লোকমিমং রবিঃ।
ক্ষেত্রং ক্ষেত্রী তথা কৃৎস্নং প্রকাশয়তি ভারত।।৩৪
অর্থঃ- (৩৪) হে ভারত, যেমন এক সূর্য্য সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেন, সেরূপ এক ক্ষেত্রজ্ঞ (আত্মা) সমস্ত ক্ষেত্র বা দেহকে প্রকাশিত করেন।
সূর্য্যের সহিত উপমার তাৎপর্য্য এই যে, যেমন এক সূর্য্য সকলের প্রকাশক অথচ নির্লিপ্ত, আত্মাও সেইরূপ।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োরেবমন্তরং জ্ঞানচক্ষুষা।
ভূতপ্রকৃতিমোক্ষঞ্চ যে বিদুর্যান্তি তে পরম্।।৩৫
অর্থঃ- (৩৫) যাহারা জ্ঞানচক্ষুদ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভেদ এবং ভূতপ্রকৃতি অর্থাৎ অবিদ্যা হইতে মোক্ষ কি প্রকার তাহা দর্শন করেন (জানিতে পারেন) তাহারা পরমপদ প্রাপ্ত হন।
ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসুপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগযোগো নাম ত্রয়োদশোহধ্যায়ঃ।।
ভিডিও গীতা কীর্তনঃ https://www.youtube.com/watch?v=nrN7q3Luh7M
সংগৃহীতঃhttp://geetabangla.blogspot.com/
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন