২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ সাংখ্যযোগ

................................ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়....................................
✴ ✴ ✴ ✴ ✴ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ সাংখ্যযোগ ✴ ✴ ✴ ✴ ✴


সঞ্জয় উবাচ- তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ ॥১॥

অর্থ- সঞ্জয় বললেন, অর্জুনকে এভাবে অনুতপ্ত, ব্যাকুল ও অশ্রুসিক্ত দেখে, কৃপায় আবিষ্ট হয়ে মধুসূদন বা শ্রীকৃষ্ণ এই কথাগুলি বললেন।

আলোচনাঃ- আমরা জানি যে, জাগতিক করুণা, শোক ও চোখের জল হচ্ছে প্রকৃত সত্তার অজ্ঞানতার বহিঃপ্রকাশ। শ্বাশ্বত আত্মার জন্য করুণার অনুভব হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধি। এই শ্লোকে ‘মধুসূদন’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণ মধু নামক দৈত্যকে হত্যা করেছিলেন এবং এখানে অর্জুন চাইছেন, অজ্ঞতারূপ যে দৈত্য তাঁকে তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত রেখেছে, তাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হত্যা করুন। মানুষকে কিভাবে করুণা প্রদর্শন করতে হয়, তা কেউই জানে না। যে মানুষ ডুবে যাচ্ছে, তার পরনের কাপড়ের প্রতি করুণা প্রদর্শন করাটা নিতান্তই অর্থহীন। তেমনই, যে মানুষ ভবসমুদ্রে পতিত হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, তার বাইরের আবরণ জড় দেহটিকে উদ্ধার করলে তাকে উদ্ধার করা হয় না। এই কথা যে জানে না এবং যে জড় দেহটির জন্য শোক করে, তাকে বলা হয় শূদ্র, অর্থাৎ যে অনর্থক শোক করে। অর্জুন ছিলেন ক্ষত্রিয়, তাই তাঁর কাছ থেকে এই ধরনের আচরণ আশা করা যায় না। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মানুষের শোকসন্তপ্ত হৃদয়কে শান্ত করতে পারেন, তাই তিনি অর্জুনকে ভগবদগীতা শোনালেন। গীতার এই অধ্যায়ে জড় দেহ ও চেতন আত্মার সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনার মাধ্যমে পরম নিয়ন্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন- আমাদের স্বরূপ কি, আমাদের প্রকৃত পরিচয় কি। পারমার্থিক তত্ত্বের উপলব্ধি এবং কর্মফলে নিরাসক্তি ছাড়া এই অনুভূতি হয় না।



শ্রীভগবানুবাচ, কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন ॥২॥

অর্থ- পুরুষোত্তম শ্রীভগবান বললেন- প্রিয় অর্জুন, এই ঘোর সংকটময় যুদ্ধস্থলে যারা জীবনের প্রকৃত মূল্য বোঝে না, সেই সব অনার্যের মতো শোকানল তোমার হৃদয়ে কিভাবে প্রজ্বলিত হল? এই ধরনের মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবে না, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি বিনষ্ট করবে।

আলোচনাঃ- শ্রীকৃষ্ণ ও পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন অভিন্ন। তাই সমগ্র ভগবদগীতায় তাঁকে ভগবান বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ভগবান হচ্ছেন পরম-তত্ত্বের চরম সীমা। পরমতত্ত্ব উপলব্ধির তিনটি স্তর রয়েছে- ব্রহ্ম অর্থাৎ নির্বিশেষ সর্বব্যাপ্ত সত্তা, পরমাত্মা অর্থাৎ প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজমান পরমেশ্বরের প্রকাশ এবং ভগবান অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পরমতত্ত্বের এই বিশ্লেষণ সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে(১/২/১১) বলা হয়েছে-
বদন্তি তৎ তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজজ্ঞানমদ্বয়ম।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দতে।।
“যা অদ্বয় জ্ঞান, অর্থাৎ এক অদ্বিতীয় বাস্তব বস্তু, জ্ঞানীরা তাকেই পরমার্থ বলেন। সেই পরমতত্ত্ব ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান- এই ত্রিবিধ সংজ্ঞায় অভিব্যক্ত হয়।” ব্রহ্মসংহিতাতে ব্রহ্মা নিজে বলেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই, এমন কি তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই। তিনিই হচ্ছেন আদি পুরুষ, অথবা গোবিন্দ নামে পরিজ্ঞাত ভগবান এবং তিনি হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সামনে আত্মীয়-পরিজনদের জন্য অর্জুনের এই শোক অত্যন্ত অশোভন, তাই ভগবান আশ্চর্যান্বিত হয়ে ব্যক্ত করেছেন, কুতঃ, “কোথা থেকে।” এই ধরনের ভাবপ্রবণতা পুরুষোচিত নয় এবং একজন সুসভ্য আর্যর কাছে থেকে এটি কখনই আশা করা যায় না। আর্য বলে তাকেই অভিহিত করা হয়, যিনি জীবনের মূল্য বোঝেন এবং যার সভ্যতা অধ্যাত্ম উপলব্ধির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। যে সমস্ত মানুষ তাদের দেহাত্মবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা কখনই উপলব্ধি করতে পারে না যে, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমতত্ত্ব বিষ্ণু বা ভগবানকে উপলব্ধি করা। তারা জড় জগতের বহিরঙ্গা রূপের দ্বারা মোহিত হয়, তাই তারা জানে না মুক্তি বলতে কি বোঝায়। জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জ্ঞান যাদের নেই, তাদেরকে বলা হয় অনার্য। যদিও অর্জুন ছিলেন ক্ষত্রিয়, তবুও যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে তিনি তাঁর স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হচ্ছিলেন। এই ধরনের কাপুরুষতা অনার্যের কাছে থেকেই কেবল আশা করা যায়। এভাবে কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত হলে আধ্যাত্মিক জীবনে অগ্রসর হওয়া যায় না, এমন কি পার্থিব জগতে কাউকে যশস্বী হওয়ার সুযোগও প্রদান করে না। আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি অর্জুনের এই তথাকথিত সহানুভূতিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনুমোদন করেননি।



ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ ॥৩॥

অর্থ- হে পার্থ! এই সম্মান হানিকর ক্লীবত্বের বশবর্তী হয়ো না। এই ধরনের আচরণ তোমার পক্ষে অনুচিত। হে পরন্তপ! হৃদয়ের এই ক্ষুদ্র দুর্বলতা পরিত্যাগ করে তুমি উঠে দাঁড়াও।

আলোচনাঃ- অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পিতা বসুদেবের ভগিনী পৃথার পুত্র, তাই তাঁকে এখানে ‘পার্থ’ নামে সম্বোধন করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ক্ষত্রিয়ের সন্তান যদি যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে, তখন বুঝতে হবে, সে কেবল নামে মাত্রই ক্ষত্রিয়; তেমনই, ব্রাহ্মণের সন্তান যখন অধার্মিক হয়, তখন বুঝতে হবে, সে কেবল নামে মাত্রই ব্রাহ্মণ। এই ধরনের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা তাদের পিতার অযোগ্য সন্তান। তাই, শ্রীকৃষ্ণ চাননি, অর্জুন অযোগ্য ক্ষত্রিয় সন্তান বলে কুখ্যাত হোন। অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রথের সারথি হয়ে নিজেই তাঁকে পরিচালিত করেছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও যদি অর্জুন যুদ্ধ না করেন, তবে তা হবে নিতান্ত অখ্যাতির বিষয়। তাই, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বললেন, এই রকম আচরণ করা তাঁর পক্ষে অশোভন। অর্জুন যুক্তি দেখিয়েছিলেন, অত্যন্ত সম্মানীয় ভীষ্ম ও নিজের আত্মীয়দের প্রতি উদার মনোভাবহেতু তিনি যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করবেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, এই ধরনের মহানুভবতা হৃদয়ের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু নয়। এই ধরনের ভ্রান্ত মহানুভবতাকে মহাজনেরা কখনই অনুমোদন করেননি। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের পরিচালনায় অর্জুনের মতো পুরুষের এই ধরনের মহানুভবতা, অথবা তথাকথিত অহিংসা পরিত্যাগ করা উচিত।




অর্জুন উবাচ, কথং ভীষ্মমহং সঙ্খ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন।
ইষুভিঃ প্রতিযোত্স্যামি পূজার্হাবরিসূদন ॥৪॥

অর্থ- অর্জুন বললেন- হে অরিসূদন! হে মধুসূদন! এই যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো পরম পূজনীয় ব্যক্তিদের কেমন করে আমি বাণের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব?

আলোচনাঃ- পিতামহ ভীষ্ম ও শিক্ষক দ্রোণাচার্যের মতো গুরুজনেরা সর্বদাই পূজনীয়। এমন কি যদি তাঁরা আক্রমণও করেন, তবুও তাঁদের প্রতি-আক্রমণ করা উচিত নয়। সাধারণ শিষ্টাচার হচ্ছে যে, গুরুজনদের প্রতি এমন কি মৌখিক তর্কযুদ্ধ করাও উচিত নয়। এমন কি তাঁদের আচরণ যদি কখনও রূঢ়ও হয়, তবুও তাঁদের প্রতি রূঢ়ভাবে আচরণ করা উচিত নয়। তা হলে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ করা অর্জুনের পক্ষে কি করে সম্ভব? শ্রীকৃষ্ণ কি কখনও তাঁর পিতামহ উগ্রসেন অথবা তাঁর গুরুদেব সান্দীপনি মুনিকে আক্রমণ করতে সমর্থ হবেন? অর্জুন যুদ্ধ থেকে বিরত হবার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে এই রকম যুক্তি প্রদর্শন করলেন।



গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান্ 
শ্রে যো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তগুরূনিহৈব ভুঞ্জীয ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্ ॥৫॥

অর্থ- আমার মহানুভব শিক্ষাগুরুদের জীবন হানি করে এই জগৎ ভোগ করার থেকে বরং ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করা ভাল। তাঁরা পার্থিব বস্তুর অভিলাষী হলেও আমার গুরুজন। তাঁদের হত্যা করা হলে, যুদ্ধলব্ধ সমস্ত ভোগ্যবস্তু তাঁদের রক্তমাখা হবে।

আলোচনাঃ- শাস্ত্রনীতি অনুসারে, যে গুরু জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে এবং ভাল-মন্দ বিচারবোধ হারিয়ে ফেলেছে, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত। দুর্যোধনের কাছ থেকে অর্থ-সাহায্য পেতেন বলে ভীষ্ম ও দ্রোণ তার পক্ষ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যদিও কেবলমাত্র আর্থিক সাহায্য পাবার ফলে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেয়া তাঁদের উচিত হয়নি। এই অনুচিত কাজ করার, তাঁরা পাণ্ডবদের পরমারাধ্য শিক্ষাগুরুর পদের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতি অর্জুনের শ্রদ্ধা কোন অংশে হ্রাস পায়নি এবং অর্জুন এই কথা ভেবে মনে মনে শিহরিত হয়েছেন যে, জাগতিক সুখ উপভোগ করার জন্য তাঁদের হত্যা করা হলে, সেই ভোগ হবে তাঁদের রুধিরমাখা।



ন চৈতদ্বিদ্মঃ কতরন্নো গরীযো
যদ্বা জযেম যদি বা নো জযেযুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্
তেঽবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ ॥৬॥

অর্থ- তাদের জয় করা শ্রেয়, না তাদের দ্বারা পরাজিত হওয়া শ্রেয়, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হত্যা করি, তা হলে আমাদের আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে না। তবুও এই রণাঙ্গনে তারা আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে।

আলোচনাঃ- আমরা জানি যে, যুদ্ধ করাটা যদিও ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, তবুও অর্জুন স্থির করতে পারছিলেন না যে, সেই অনর্থক হিংসাত্মক যুদ্ধে রত হবেন, না কি ভিক্ষা বৃত্তি গ্রহণ করে জীবন ধারণ করবেন। তিনি যদি তাঁর শত্রুদের পরাজিত না করেন, তা হলে ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না। আর তা ছাড়া, যুদ্ধে যে কোন পক্ষের জয় হবে, তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় হলেও(কারণ, তাঁদের দাবি ছিল ন্যায়সঙ্গত) ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের অবর্তমানে জীবন ধারণ করা তাঁদের পক্ষে নিতান্ত দুর্বিষহ হবে বলে অর্জুন মনে করেছিলেন। এদিক দিয়ে সেটিও তাঁদের পক্ষে এক রকম পরাজয়। অর্জুনের এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিবেচনা অবধারিতভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি কেবল মহৎ ভগবদ্ভক্তই ছিলেন না, তিনি গভীর তত্ত্বজ্ঞান-সম্পন্ন পুরুষ ছিলেন এবং তিনি তাঁর মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে সর্বতোভাবে সংযত করেছিলেন। যদিও তিনি রাজকীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে জীবন ধারণ করতে মনস্থ করেছিলেন। এর মাধ্যমেও আমরা দেখতে পাই যে, অন্তরে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অনাসক্ত। এই সমস্ত সদগুণাবলী এবং তাঁর গুরুদেব শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্ম-বাক্যের প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠা, এই দুইয়ের সমন্বয়ের ফলে তিনি ছিলেন প্রকৃত ধার্মিক। আমরা এখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, মুক্তি লাভের জন্য অর্জুন সম্পূর্ণরূপে যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। ইন্দ্রিয় যদি সংযত না হয়, তবে দিব্যজ্ঞান ও ভক্তি ছাড়া জড় জগতের বন্ধন থেকে কোন রকমেই মুক্ত হওয়া যায় না। অর্জুন এই সমস্ত গুণাবলীর দ্বারা ভূষিত ছিলেন এবং সেই সঙ্গে ছিল জাগতিক সম্পর্কিত অস্বাভাবিক গুণাবলী।



কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ ॥৭॥

অর্থ- কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি এবং আমার কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি ৷এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর, তা আমাকে বল। এখন আমি তোমার শিষ্য এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত ৷ দয়া করে তুমি আমাকে নির্দেশ দাও ।

আলোচনাঃ- প্রকৃতির প্রভাবে জড়-জাগতিক কর্মচক্রের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে সকলেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। জীবনের প্রতিটি প্রদক্ষেপে আমরা এই কিংকর্তব্যাবিমূঢ়তা অনুভব করি। তাই আমাদের সত্যদ্রষ্টা সদ্‌গুরুর শরণ নিতে হয় এবং তিনি আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন করবার পথে পরিচালিত করেন। আমাদের অনাকঙ্খিত জীবনের জটিল সমস্যাগুলি থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য সদ্‌গুরুর শরণাপন্ন হবার উপদেশ সমস্ত বৈদিক সাহিত্যে দেওয়া হয়েছে। জড়-জাগতিক ক্লেশ হচ্ছে দাবানলের মতো যা আপনা থেকেই জ্বলে উঠে, এই আগুন কেউ লাগায় না। ঠিক তেমনই, জগতের এমনই অবস্থা, যে, জীবনের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা সমাধানের জন্য এবং সেই সমাধানের বিজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করবার জন্য গুরু-পরস্পরার ধারায় ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন যে সদ্‌গুরু, তাঁর শরণাপন্ন হতে হবে। যে ব্যক্তি সদ্‌গুরু তিনি সর্ব বিষয়ে পারদর্শী। তাই, জড় জগতের মোহের দ্বারা আবদ্ধ না থেকে সদ্‌গুরুর শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এটিই হচ্ছে এই শ্লোকের তাৎপর্য। জড় জগতের মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন কে? যে মানুষ তার সমস্যাগুলি সম্বন্ধে অবগত নয়, সেই হচ্ছে মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩/৮/১০) মোহাচ্ছন্ন মানুষের বর্ণনা করে বলা হয়ছে- যো বা এতদক্ষরং গার্গ্যবিদিত্বাস্মাল্‌ লোকাৎ প্রৈতি স কৃপণঃ। "যে মানুষ তার মনুষ্য জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে না এবং আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি না করে কুকুর-বেড়ালের মতো এই জগৎ থেকে বিদায় নেয়, সেই হচ্ছে কৃপণ।" এই মানবজন্ম হচ্ছে একটি অমূল্য সম্পদ, কারণ, জীব এই জন্মের সদ্ব্যবহার করে জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে; তাই, যে এই অমূল্য সম্পদের সদ্ব্যবহার করে না, সে হচ্ছে কৃপণ। পক্ষান্তরে, যিনি যথার্থ বুদ্ধিমত্তা সহকারে মানব-জন্মের সদ্ব্যবহার করে জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করেন, তিনি হচ্ছে ব্রাহ্মণ। য এতদক্ষরং গার্গি বিদিত্বস্মাল্‌ লোকাৎ প্রৈতি স ব্রাহ্মণঃ।
যে কৃপণ সে পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি আদি জড় সম্বন্ধের প্রতি অত্যধিক আসক্ত হয়ে তার সময়ের অপচয় করে। মানুষ প্রায়ই এক ধরনের 'চর্মরোগের' দ্বারা আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী, পুত্র, পরিজন সমন্বিত পরিবারের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়ে। এই রোগকে 'চর্মরোগ' বলা হয়, কারণ দেহের ভিক্তিতে বা চর্মের ভিক্তিতে এই আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠে এবং এই বন্ধনের ফলে জীব অত্যন্ত ক্লেশদায়ক ভবযন্ত্রণা ভোগ করে। কৃপণ মনে করে, সে তার পরিবারের তথাকথিত আত্মীয়দের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে; নয়ত সে মনে করে, তার আত্মীয়স্বজন তাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে। এই ধরনের পারিবারিক বন্ধন এমন কি পশুদের মধ্যেও দেখা যায়, তারাও তাদের সন্তানদের যত্ন করে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা-সম্পন্ন অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন, আত্মীয়-পরিজনদের প্রতি তাঁর মমতা এবং তাদের মৃত্যর হাত থেকে রক্ষা করার বাসনাই ছিল তাঁর মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার কারণ। যদিও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর যুদ্ধ করার কর্তব্য তাঁকে সম্পাদন করতে হবে, কিন্তু তবুও কৃপণতা জনিত দুর্বলতার ফলে তিনি তাঁর সেই কর্তব্য সম্পাদন করতে পারছিলেন না। তাই তিনি পরম গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুনয় করছেন, তাঁর এই সমস্যার সমাধান করার উপায় প্রদর্শন করতে। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তাঁর শিষ্যরূপে আত্মসমর্পণ করেন। শ্রীকৃষ্ণকে তিনি তার বন্ধুরূপে সম্ভাষোণ করছেন না। গুরু ও শিষ্যের মধ্যে যে কথা হয়, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন অর্জুন তাই গভীর গুরুত্বের সঙ্গে পরম গুরু শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পরম তত্ত্বদর্শনের আলোচনা করতে চান। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবদ্‌গীতার তত্ত্ববিজ্ঞানের আদি গুরু এবং অর্জুন হচ্ছেন গীতার তত্ত্ব-উপলব্ধিকারী প্রথম শিষ্য। অর্জুন কিভাবে ভগবদ্‌গীতার জ্ঞান উপলব্ধি করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা ভগবদ্‌গীতাতেই করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গর্দভসদৃশ জড় পণ্ডিতেরা গীতার ব্যাখ্যা করে বলে, শ্রীকৃষ্ণ নামক কোন পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করার কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের অন্তঃস্থিত অপ্রকাশিত যে-তত্ত্ব, তাকে উপলব্ধি করাই হচ্ছে গীতার প্রকৃত শিক্ষা। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অনাদির আদিপুরুষ স্বয়ং ভগবান। তাঁর অন্তর আর বাইরের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই, তিনি সর্বব্যাপ্ত, সর্বশক্তিমান। কিন্তু এই জ্ঞান যার নেই, সেই মহামূর্খের পখে গীতার মর্ম উপলব্ধি করা কখনই সম্ভব নয়।



ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্
যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়ানাম্ ।
অবাপ্য ভূমাবসপত্নমৃদ্ধং
রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্ ॥৮॥

অর্থ- আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে শুকিয়ে দিচ্ছে যে শোক, তা দূর করবার কোন উপায় আমি খুঁজে পাচ্ছি না ৷ এমন কি স্বর্গের দেবতাদের মতো আধিপত্য নিয়ে সমৃদ্ধিশালী, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন রাজ্য এই পৃথিবীতে লাভ করলেও আমার এই শোকের বিনাশ হবে না।

আলোচনাঃ- আলোচনার শুরুতে শ্লোকটির তাৎপর্য বুঝার সুবিধার্থে একজন আদর্শ গুরুর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। এখানে অর্জুন যদিও তাঁর মতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াসে ধর্মগত ও নীতিগত যুক্তির অবতারণা করছিলেন, কিন্তু তবুও যেন তিনি তাঁর গুরু শ্রীকৃষ্ণের সাহায্য ছাড়া তাঁর প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন, যে সমস্যা তাঁর সমস্ত সত্তাকে দগ্ধ করছিল, তাঁর তথাকথিত জ্ঞানের সাহায্যে তিনি সেই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। তাই তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গুরুওরুপে বরণ করে তাঁর শরণাপন্ন হলেন। কেতাবী বিদ্যা, পাণ্ডিত্য, উচ্চপদ আদি জীবনের প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণের মতো গুরুর কৃপার ফলেই কেবল সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়। তাই, সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যে গুরু সর্বতোভাবে কৃষ্ণচেতনার অমৃত অস্বাদন করেছেন, তিনিই হচ্ছেন সদ্‌গুরু, কেন না তিনিই কেবল পারেন মানব-জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, যিনি কৃষ্ণ-তত্ত্ববেত্তা, তিনি ব্রাহ্মণই হন বা শুদ্রই হন, তিনিই কেবল পারেন গুরু হতে।
কিবা বিপ্র, কিবা ন্যাসী, শুদ্র কেনে নয়।
যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা, সেই ‘গুরু’ হয়।। (চৈঃ চঃ মধ্য ৮/১২৮)সুতরাং তত্ত্বজ্ঞানী না হলে সদ্‌গুরু হওয়া কখনই সম্ভব নয়। বৈদিক শাস্ত্রেও বলা হয়েছে-
ষট্‌কর্মনিপুণো বিপ্রো মন্ত্রতন্ত্রবিশারদঃ।
অবৈষ্ণবো গুরুর্ন স্যাদ্বৈষ্ণবঃ শ্বপচো গুরুঃ।।
“সমস্ত বৈদিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্রাহ্মণ যদি বৈষ্ণব না হন, অথবা যদি তিনি কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা না হন, তবে তিনি গুরু হবার যোগ্য নন। কিন্তু যদি নীচকূলোদ্ভত চণ্ডাল কৃষ্ণ-তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন বৈষ্ণব হন, তবে তিনি গুরু হতে পারেন” (পদ্ম পুরাণ)। জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি-এই চতুর্বিধ সমস্যা জড় অস্তিত্বকে সর্বদাই জর্জরিত করছে এবং ধনৈশ্বর্যের সঞ্চয় অথবা অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে কখনই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ সব রকমের জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ। সেই সমস্ত দেশ চরম অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করে ধনৈশ্বর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে জড় জীবনের যে সমস্ত সমস্যা তা কোন অংশেই লাঘব হয়নি। নানাভাবে তারা শাস্তি পাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের সেই সমস্ত প্রচেষ্টা সম্পুর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, কারণ শান্তি লাভ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ গ্রহণ করা, অর্থাৎ ভগবদ্‌গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবতের উপদেশ গ্রহণ করা, অথবা শ্রীকৃষ্ণের যথার্থ প্রতিনিধি সদ্‌গুরুর শরণ গ্রহণ করা। যদি অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য মানুষকে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক প্রমত্ততা জনিত শোক থেকে উদ্ধার করতে পারত, তবে অর্জুন বলতেন না যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন পৃথিবীর সাম্রাজ্য অথবা স্বর্গলোকের আধিপত্য লাভ করলেও তিনি শোকমুক্ত হতে পারবেন না। তাই তিনি কৃষ্ণভাবনার আশ্রয় অবলম্বন করেছিলেন এবং সুখ ও শান্তি লাভের সেটিই হচ্ছে পন্থা। অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য মানুষকে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় অথবা অন্তর্জাতিক প্রমত্ততা জনিত শোক থেকে উদ্ধার করতে পারত, তবে অর্জুন বলতেন না যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন পৃথিবীর সাম্রাজ্য অথবা স্বর্গলোকের আধিপত্য লাভ করলেও তিনি শোকমুক্ত হতে পারবেন না। তাই তিনি কৃষ্ণভাবনার আশ্রয় অবলম্বন করেছিলেন এবং সুখ ও শান্তি লাভের সেটিই হচ্ছে পন্থা। অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জড় জগতের উপর আধিপত্য প্রকৃতির অঙ্গুলিহেলনে মুহূর্তের মধ্যেই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। মানুষের গ্রহান্তরে যাবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা, যেমন চাঁদে যাবার জন্য অনুসন্ধান করছে, তাও প্রকৃতির এক ঘাতে সর্বতোভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভগবদ্‌গীতায় তা প্রতিপন্ন হয়েছে- ক্ষীণে পূণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি। “সমস্ত পূর্ণ্যকর্মের ফল শেষ হয়ে গেলে, চরম সুখ ও সমৃদ্ধিপূর্ণ জীবন থেকে নিতান্তই নিন্মস্তরের জীবনে পতিত হতে হয়।” কেবল দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই, আমরা যদি আমাদের মঙ্গলের জন্য সর্ববিধ শোকের নিরসন করতে চাই, তবে আমাদের অর্জুনের মতো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হতে হবে। সুতরাং অর্জুন যেমন শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে অনুরোধ করেছিলেন, প্রতিটি মানুষেরই উচিত সেভাবে ভগবানের শরণাগত হওয়া। সেটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থা।।

সঞ্জয় উবাচ, এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ ।
ন য্যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূঞ্চীং বভূব হ ॥৯॥

অর্থ- সঞ্জয় বললেন, এভাবে মনোভাব ব্যক্ত করে গুড়াকেশ অর্জুন তখন হৃষীকেশকে বললেন,"হে গোবিন্দ! আমি যুদ্ধ করব না" , এই বলে তিনি মৌন হলেন।

আলোচনাঃ- ধৃতরাষ্ট্র যখন শুনলেন, অর্জুন যুদ্ধ না করে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে জীবন ধারণ করবেন, তখন তিনি মনে মনে খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে নিরাশ করার মানসে সঞ্জয় তাঁকে জানিয়ে দিলেন, অর্জুন হচ্ছেন পরন্তপঃ অর্থাৎ শত্রুর বিনাশকারী। যদিও অর্জুন পারিবারিক বন্ধনের মোহের বশবতী হয়ে সাময়িকভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তার পরই তিনি পরম গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মনিবেদন করে তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন। এর থেকে বোঝা যায়, অর্জুন শীঘ্রই পারিবারিক বন্ধনের মোহ থেকে মুক্ত হয়ে আত্মজ্ঞান বা কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করবেন এবং ভগবানের নির্দেশে সেই যুদ্ধে রত হয়ে নির্মমভাবে শত্রু সংহার করবেন। এভাবে ক্ষণস্থায়ী যে আশার আনন্দে ধৃতরাষ্ট্রের বুক ভরে উঠেছিল, তা অচিরেই অন্তর্হিত হল।




তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত ॥
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ ॥১০॥

অর্থ- হে ভরতবংশীয় ধৃতরাষ্ট্র ! সেই সময় স্মিত হেসে, শ্রীকৃষ্ণ উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে এই কথা বললেন।

আলোচনাঃ- দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু হৃষীকেশ ও গুড়াকেশের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছিল। বন্ধু হিসাবে তাঁরা দুজনেই ছিলেন সমপর্যায়ভুক্ত, কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন স্বচ্ছাকৃতভাবে অপরের শিষ্যত্ব বরণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ সেই সময় হাসছিলেন, কারণ তাঁর বন্ধু তাঁর শিষ্য হতে মনস্থ করেছিলেন। তিনি পরমেশ্বর, তাই প্রভুরূপে তিনি সকলেরই নিয়ন্তা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর ভক্তের বাসনা অনুয়ায়ী তাঁদের বন্ধু, পুত্র ও প্রেমিক হতে সম্মত হন। কিন্তু তাঁর ভক্ত যখন তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করে তাঁকে গুরু হিসাবে গ্রহণ করেন, তখন তিনি তৎক্ষনাৎ গুরুর ভূমিকা গ্রহণ করে গুরুবৎ গাম্ভীর্য সহকারে উপদেশ দেন। এখানে আমরা দেখতে পাই, গুরু ও শিষ্যের মধ্যে কথোপকথন হয়েছিল প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে দুই সেনানীর মাঝখানে, যার ফলে সেই কথা শ্রবণ করে সকলেই লাভবান হতে পেরেছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, ভগবদ্‌গীতার বাণী কোন বিশেষ ব্যক্তি, সমাজ অথবা সম্প্রদায়ের জন্য নয়। এই বাণী সকলের জন্য এবং শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলেই এর যথার্থ মর্ম হৃদয়ঙ্গম করে ভগবানের চরণে শরণাগতি লাভ করতে পারে।




শ্রীভগবান্‌ উবাচ, অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে। গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ ॥১১॥

অর্থ- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- তুমি প্রাজ্ঞের মতো কথা বলছ, অথচ যে বিষয়ে শোক করা উচিত নয়, সে বিষয়ে শোক করছ। যাঁরা যথার্থই পণ্ডিত তাঁরা কখনও জীবিত অথবা মৃত কারও জন্যই শোক করেন না।

আলোচনাঃ- শিষ্যরূপে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পন করা মাত্রই ভগবান আচার্যের ভূমিকা গ্রহণ করে, অর্জুনের ভুল সংশোধন করার জন্য পরোক্ষভাবে তাঁকে মহামূর্খ বলে শাসন করতে লাগলেন। ভগবান তাঁকে বললেন, “তুমি প্রাজ্ঞের মতো কথা বলছ, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান তোমার নেই। যিনি জ্ঞানী তিনি জানেন দেহ কি ও আত্মা কি, তাই তিনি জীবিত অথবা মৃত কোন অবস্থাতেই দেহের জন্য শোক করেন না। পরবর্তী অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, প্রকৃত জ্ঞান হচ্ছে সেই জ্ঞান যা জড় দেহ ও চেতন আত্মার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে করিয়ে দেয়। অর্জুন যুক্তি দেখাচ্ছিলেন যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তার থেকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তিনি জানতেন না, জড় পদার্থ, আত্মা ও ভগবৎ-সম্বন্ধীয় জ্ঞান ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করার চাইতেইও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর যেহেতু তাঁর সেই জ্ঞান ছিল না, তাই তাঁর পক্ষে পাণ্ডিত্যপূর্ণ যুক্তি দেখানো অনুচিত। যেহেতু তিনি পরম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন না, তাই তিনি অনর্থক শোক করেছিলেন। জড় দেহের জন্ম হয় এবং এক সময় না এক সময় তার বিনাশ হবেই, কিন্তু আত্মা, অবিনশ্বর তার কখনই বিনাশ হয় না। তাই, জড় দেহটি আত্মার মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই আত্মাই হচ্ছে জীবের প্রকৃত সত্ত্বা, তাই দেহের বিনাশ হবার ভয়ে শোক করা নিত্যান্তই মূর্খতা। এই সত্য সম্বন্ধে যিনি অবগত তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত জ্ঞানী এবং তিনি কোন অবস্থাতেই জড় দেহের জন্য শোক করেন না।




ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ॥১২॥

অর্থ- এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত রাজারা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে না ।

আলোচনাঃ- বেদ, কঠ উপনিষদ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে, কৃত কর্ম এবং তার ফল অনুসারে জীব যদিও বিভিন্ন অবস্থায় পতিত হয়, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান সর্ব অবস্থাতেই তাদের পালন করেন। সেই পরমেশ্বর ভগবান পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন। যে সমস্তু মহাত্মা অন্তরে ও বাইরে সেই একই পরমেশ্বর ভগবানকে দেখতে পান, তাড়াই কেবল পূর্ণতা লাভ করে শাশ্বত শান্তি লাভ করতে পারেন।
নুত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্‌
একো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্‌।
তমাআত্মস্থং যেমনুপশ্যন্তি ধীরাস্‌
তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষাম্‌।।
(কঠ উপনিষদ ২/২/১৩) “যিনি নিত্যের মধ্যে পরম নিত্য, চেতনের মধ্যে পরম চেতন এবং যিনি এক হয়েও সকলের কামনা পূর্ণ করেন, যাঁরা ধীর তাঁরা অন্তরের অন্তস্তলে সর্বদাই তাঁকে দর্শন করেন এবং শাশ্বত শান্তি অনুভব করেন। কিন্তু যারা তাঁর ভজন করে না, তারা কখনই তা লাভ করতে পারে না।”

এই বৈদিক তত্ত্বজ্ঞান যা ভগবান অর্জুনকে দান করলেন, তা তিনি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে দান করলেন, যারা নিজেদের মহাপণ্ডিত বলে জাহির, করতে চায়, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে যারা এক-একজন মহামূর্খ। ভগবান স্পষ্টভাবে বলছেন, তিনি অর্জুন ও সেই যুদ্ধক্ষেত্রে সুমবেত সমস্ত রাজারা সকলেই শাশ্বত স্বতন্ত্র জীব এবং ভগবান সমস্ত জীবকে তাদের বদ্ধ ও মুক্ত উভয় অবস্থাতেই প্রতিপালন করেন। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন পরম স্বতন্ত্র পুরুষ এবং ভগবানের নিত্য পার্ষদ অর্জুন এবং সেখানে সমবেত সমস্ত রাজারা হচ্ছেন স্বতন্ত্র শাশ্বত ব্যক্তি। এমন নয় যে, পূর্বে তাঁরা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতে থাকবেন না। তাঁদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পূর্বে বর্তমান ছিল এবং ভবিষ্যতেও নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্তমান থাকবে। তাই, কারও জন্য শোক করা নিতান্তই নিরর্থক।
মায়াবাদীরা বলে থাকে যে, মুক্তির পর স্বতন্ত্র আত্মা মায়ার আবরণমুক্ত হয়ে নির্বিশেষ ব্রহ্মে বিলীন হয়ে যায় এবং তখন আর আত্মার নিজস্ব সত্তা থাকে না –এই মতবাদ পরম শাস্ত্রজ্ঞ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে অনুমোদন করেননি। তা ছাড়া কেবল বন্ধদশায় আমরা ব্যক্তিস্বতন্ত্র্য অনুভব করি। সেই মতবাদও ভগবান এখানে অনুমোদন করেননি। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে স্পষ্টভাবে বলছেন, ভগবানের নিজের এবং অন্য সকলের অস্তিত্ব শাশ্বত, কারও স্বতন্ত্র সত্তার বিনাশ কখনই হয় না- এই কথা উপনিষদেও বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত এই সমস্ত কথা প্রামাণিক, কারণ তিনি কখনই মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হন না। জীবের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যদি সর্ব অবস্থায় বজায় না থাকত, তবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কখনই বলতেন না যে, ভবিষ্যতেও কখনও এর বিনাশ হবে না। মায়াবাদী তার্কিকেরা বলতে পারে, শ্রীকৃষ্ণ যে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছেন তা চিন্ময় স্বাতন্ত্র্য নয়, তা হচ্ছে জড় স্বাতন্ত্র। কিন্তু এই যুক্তি মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজের সম্বন্ধে যে স্বাতন্ত্র্যর কথা বলেছেন, সেটি কি ধরনের স্বাতন্ত্র্য? শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, তিনি অতীতেও ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও থকবেন। তিনি নানাভাবে তাঁর অঙ্গকান্তি। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অপ্রাকৃত স্বাতন্ত্র্য সব সময়ই বজায় রেখে গেছেন; যদি তাঁকেও সীমিত সাধারণ চেতনাবিশিষ্ট বদ্ধ জীবাত্মা বলে মনে করা হয়, তবে ভগবদ্‌গীতাকে কখনই পরম তত্ত্বজ্ঞান সমন্বিত শাস্ত্র হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। সীমিত জ্ঞানবিশিষ্ট, ভ্রান্তিপূর্ণ সাধারণ মানুষ কখনই পরম তত্ত্বজ্ঞানের শিক্ষা দিতে পারে না। ভগবদ্‌গীতা সাধারণ কাব্যগ্রন্থ নয়। সাধারণ মানুষের লেখা কোন বইয়ের সঙ্গেই ভগবদ্‌গীতার তুলনা করা চলে না। শ্রীকৃষ্ণকে যদি কেউ সাধারণ মানুষ বলে মনে করে, তবে তার কাছে ভগবদ্‌গীতার কোনই তাৎপর্য থাকতে পারে না। 

মায়াবাদী তার্কিকেরা বলে থাকে, প্রচলিত রীতি অনুসারে এই শ্লোকে বহু বচনের ব্যবহার করা হয়েছে এবং তা জড় দেহটিকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু পূর্ববতী শ্লোকে জড় দেহগত পরিচয়কে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করার পর, প্রচলিত রীতি অনুসারে সেই জড় দেহগত পরিচয়কেই আবার অনুমোদন করা শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে কি করে সম্ভব? তাই স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, অপ্রাকৃত স্তরেও জীব স্বতন্ত্র আত্মারূপে বর্তমান থাকে। এই কথা রামানুজাচার্য আদি মহৎ আচার্যেরা স্বীকার করে গেছেন। ভগবদ্‌গীতার মতো মহৎ শাস্ত্রকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা তাদের নেই। ভগবদ্ভক্তিহীন মানুষেরা ভগবদ্‌গীতা পাঠ করা মৌমাছির মধুর বোতল চাটার মতোই নিরর্থক। বোতল না খুললে যেমন মধুর সাদ পাওয়া যায় না, তেমনই ভগবানের ভক্ত না হলে ভগবদ্গীতার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায় না, তেমনই ভগবানের ভক্ত না হলে ভগবদ্‌গীতার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায় না। এই কথা চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে। ভগবানের অস্তিত্বে যে অবিশ্বাস করে, তার পক্ষে ভগবদ্‌গীতা স্পর্শ করাও সম্ভব নয়। তাই, মায়াবাদীরা গীতার যে ভাষ্য দিয়ে থাকে, তা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত এবং তা মানুষকে বিপথগামী করে। তাই, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মায়াবাদীদের ভাষ্য পড়তে অথবা শুনতে নিষেধ করে গেছেন। কারণ, মায়াবাদী-ভাষ্যের দ্বারা একবার প্রভাবিত হলে গীতার অন্তর্নিহিত তত্ত্বকে আর উপলব্ধি করতে পারা যায় না। যদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে উল্লেখ করে, তা হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশের কোন আবশ্যকতা থাকে না। স্বতন্ত্র আত্মার বহুবচন ও ভগবান চিরন্তন সত্য এবং তা বেদে প্রতিপন্ন হয়েছে, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।




দেহিনোঽস্মিন্যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।১৩।।

অর্থ- দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোনও দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।

আলোচনাঃ- যেহেতু প্রত্যেকটি জীব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র আত্মা, কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই প্রত্যেকেই তার দেহ পরিবর্তন করে চলেছে, তার ফলে কখনও সে শিশু, কখনও কিশোর, কখনও যুবক এবং কখনও বৃদ্ধ। এভাবে সে নানা রূপ ধারণ করছে। কিন্তু জীবের প্রকৃত সত্তা আত্মার কোনও পরিবর্তন হয় না। এক সময় দেহটি যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন আত্মা সেই দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহ ধারণ করে। মৃত্যুর পর জড় অথবা চিন্ময় আর একটি দেহ প্রাপ্ত হওয়া যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য আদি আত্মীয়-পরিজনের জন্য শোক করা অর্জুনের পক্ষে নিতান্তই নিরর্থক। বরং, তাঁদের মৃত্যুর কথা ভেবে শোক করার পরিবর্তে তাঁর আনন্দিত হওয়া উচিত ছিল, কারণ মৃত্যু হলে তাঁরা তাঁদের জরাগ্রস্ত বৃদ্ধদেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ প্রাপ্ত হবেন এবং নবশক্তি লাভ করবেন। পূর্বকৃত কর্মের ফল অনুসারে জীব নতুন দেহ প্রাপ্ত হয় এবং নানা রকম সুখ ও দুঃখ ভোগ করে থাকে। তাই ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো মহাত্মারা যে দেহত্যাগের পর জড় জগতের বন্ধনমুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধাম বৈকুণ্ঠে ফিরে যাবেন, অথবা স্বর্গলোকে দিব্য দেহ প্রাপ্ত হয়ে নানা রকম সুখভোগ করবেন, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং তাঁদের মৃত্যুতে শোক করার কোনও কারণই ছিল না। 

যে মানুষ জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ এবং পরা ও অপরা উভয় প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত, তাঁকে বলা হয় ধীর। এই প্রকার মানুষ জড় দেহের পরিবর্তনের জন্য কখনও শোক করেন না।

আত্মাকে খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করা যায় না এই যুক্তিতে, আত্মা ও পরমাত্মার একত্ব সম্বন্ধে মায়াবাদীদের যে মতবাদ, তা গ্রহণযোগ্য নয়। পরমাত্মাকে খণ্ড খণ্ড করে বিভক্ত করার ফলে যদি জীবাত্মার উদ্ভব হত, তবে পরমাত্মা হতেন পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত পরমাত্মা যে অপরিবর্তনীয় তার পরিপন্থি। গীতাতে ভগবান বলেছেন, পরমেশ্বরের অংশ জীবাত্মা সনাতন এবং তাকে বলা হয় ক্ষর; অর্থাৎ, তার জড়া প্রকৃতিতে পতিত হবার প্রবণতা থাকে। জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ এবং জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার পরেও সে পরমাত্মার অংশরূপেই বর্তমান থাকে। তবে মুক্ত হবার পর সে সৎ, চিৎ ও আনন্দময় দেহপ্রাপ্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে ভগবানের সাহচর্য লাভ করে। জলে যখন আকাশের প্রতিফলন দেখা যায়, তখন তাতে সূর্য, চন্দ্র, এমন কি তাঁরাদেরও পর্যন্ত দেখা যায়। তাঁরাগুলিকে জীবাত্মার সঙ্গে তুলনা করা চলে এবং সূর্য অথবা চন্দ্রকে পরমেশ্বরের সঙ্গে তুলনা করা চলে। অর্জুন হচ্ছেন স্বতন্ত্র অণুচৈতন্য-বিশিষ্ট জীবাত্মা এবং বিভুচৈতন্য পরমাত্মা হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। জীবাত্মা ও পরমাত্মা সমপর্যায়ভুক্ত নয়, চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথমেই আমরা তা দেখতে পাব। অর্জুন যদি শ্রীকৃষ্ণের সমপর্যায়ভুক্ত হতেন এবং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের ঊর্ধ্বতন না হতেন তা হলে তাঁদের মধ্যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠা কখনই সম্ভব হত না। তাঁরা দুজনেই যদি মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হতেন, তা হলে একজন উপদেষ্টা এবং অন্য জন উপদেশ গ্রহণকারী হওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। এই প্রকার উপদেশ অর্থহীন হয়ে পড়ে, কারণ মায়ায় কবলিত কেউ প্রামাণিক উপদেষ্টা হতে পারে না। এই অবস্থান আমাদের স্বীকার করতে হবে, যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, যিনি জীব থেকে অতি ঊর্ধ্বে অবস্থিত আর অর্জুন হছে বিস্মরণশীল আত্মা, যে মায়ার দ্বারা মোহিত।




মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত ॥১৪॥

অর্থ- হে কৌন্তেয় ! ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয় ৷ সেগুলি ঠিক যেন শীত এবং গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো । হে ভরতকুল-প্রদীপ ! সেই ইন্দ্রিয়্জাত অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর।

আলোচনাঃ- মানব জীবনের প্রকৃত কর্তব্য সম্পাদন করতে হলে মানুষকে সহনশীলতার মাধ্যমে বুঝতে হবে, সুখ ও দুঃখ কেবল ইন্দ্রিয়ের বিকার মাত্র। শীতের পর যেমন গ্রীস্ম আসে, তেমনই পর্যায়ক্রমে সুখ ও দুঃখ আসে। সত্যকে উপলব্ধি করে দুঃখে ও সুখে অবিচলিত থাকাই মানুষের কর্তব্য। বেদে নির্দেশ দেওয়া আছে, খুব সকালে স্নান করা উচিত। যে শাস্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে, সে মাঘ মাসের প্রচণ্ড শীতেও খুব ভোরে স্নান করতে ইতস্তত করে না। তেমনই, গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমেও গৃহিনীরা রান্না করা থেকে বিরত থাকেন না। আবহাওয়া যুদ্ধ করাটাই হচ্ছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এবং কর্তব্যের খাতিরে তাকে যদি তার আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়, তবুও সে তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত হতে পারে না। শাস্ত্র-নির্ধারিত অনুশাসন মেনে চলাটাই হচ্ছে সভ্য মানুষের লক্ষণ। এই অনুশাসন মেনে চলার ফলে মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ হয় এবং সে তখন ভগবৎ-তত্বজ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়। এই জ্ঞানের প্রভাবে তার হৃদয়ে ভগবদ্ভক্তির সঞ্চার হয় এবং ভগবানের প্রতি তার এই আনন্তিক ভক্তি তাকে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে।

★এই শ্লোকে অর্জুনকে কৌন্তেয় ও ভারত নামে সম্বোধন করাটা খুবই তাৎপর্য্যপূর্ণ। তাঁকে কৌন্তেয় নামে সম্বোধন করার মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মাতৃকুলের মহান রক্তের সম্পর্ক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং ভারত নামে সম্বোধন করে তাঁর পিতৃকুলের মহত্ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উভয় দিক থেকে তিনি বিচ্যুত হন না। তাই, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে জানিয়ে দিলেন, তাঁর বংশ-গৌরবের কথা স্মরণ করে তাঁকে যুদ্ধ করতেই হবে।




যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে ॥১৫॥

অর্থ- হে পুরুষশ্রেষ্ঠ (অর্জুন) ! যে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ ও দুঃখকে সমান জ্ঞান করেন এবং শীত ও উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না, তিনিই মুক্তি লাভের প্রকৃত অধিকারী।

আলোচনাঃ- যে মানুষ সুখে-দুঃখে সম্পূর্ণ অবিচলিত থেকে তাঁর পারমার্থিক উন্নতি সাধন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তিনি অনায়াসে সেই ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের যোগ্য হন। বর্ণাশ্রম-ধর্মের চতুর্থ আশ্রম সন্ন্যাস অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ পথ। কিন্তু যে মানুষ তাঁর জিবনকে সার্থক করে তুলতে চান, তিনি সমস্ত রকম অসুবিধা সত্ত্বেও এই সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন না। সন্ন্যাস-আশ্রম গ্রহণ করলে মানুষকে তার সব রকম পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করতে হয়। স্ত্রী, পুত্র, পরিজনের এই বন্ধনমুক্ত হওয়া খুবই কষ্টকর। কিন্তু যিনি এই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেন, নিঃসন্দেহে তাঁর পারমার্থিক জীবন সার্থক হয়ে ওঠে এবং অচিরেই তিনি ভগবৎ-দর্শন লাভ করেন। ঠিক তেমনই, অর্জুনকে তাঁর ক্ষাত্রধর্ম পালন করার উপদেশ দিয়ে ভগবান তাঁকে ক্ষাত্রধর্ম পালন করার উপদেশ দিয়ে ভগবান তাঁকে বললেন, এই ধর্মযুদ্ধে তাঁর আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে যুদ্ধ করা যদিও অত্যন্ত দুঃখদায়ক এবং কষ্টসাপেক্ষ, কিন্তু তবুও তাঁর কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করবার জন্য তাঁর দেহজাত আত্মীয়তার বন্ধন থেকে তাঁকে মুক্ত হতে হবে এবং যুদ্ধ করতে হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, ঘরে তখন তাঁর যুবতী স্ত্রী এবং বৃদ্ধ মাতা ছিলেন। তাঁদের দেখাশোনা করার জন্য কেউই ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মহত্তর উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্য তিনি তাঁদের পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস-ধর্ম গ্রহণ করেন। মায়ার বন্ধন মুক্ত হবার এই হচ্ছে উপায়।




নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ ॥১৬॥

অর্থ- যাঁরা তত্ত্বদ্রষ্টা তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, অনিত্য জড় বস্তুর স্থায়িত্ব নেই এবং নিত্য বস্তু আত্মার কখনও বিনাশ হয় না। তাঁরা উভয় প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

আলোচনাঃ- প্রতি মূহুর্তে এই জড় দেহের পরিবর্তন হচ্ছে- এই দেহের কোনই স্থায়িত্ব নেই। আধুনিক চিকিৎসা- বিজ্ঞানের সাহায্যেও জানা যায়, বিভিন্ন জীবকোষের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ফলে প্রতি মূহূর্তে জীবদেহের অবিরাম পরিবর্তন হচ্ছে, তাঁর ফলে জীবদেহ শিশু অবস্থা থেকে ক্রমে ক্রমে পূর্ণ যৌবনে বিকশিত হয় এবং অবশেষে বৃদ্ধ অবস্থায় উপনীত হয়। কিন্তু দেহ ও মনের সব রকম পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও জীবের প্রকৃত সত্তা আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। জড় দেহ ও সনাতন আত্মার মধ্যে এটিই হচ্ছে পার্থক্য। দেহের প্রকৃতিই হচ্ছে চির-পরিবর্তনশীল আর আত্মা হচ্ছে চিরশাশ্বত-সনাতন। এই সিদ্ধান্ত নির্বিশেষবাদী ও সবিশেষবাদী উভয় শ্রেণীর তত্ত্বদ্রষ্টারা স্বীকার করেছেন। বিষ্ণু পুরাণে (২/১২/৩৮) বলা হয়েছে, শ্রীবিষ্ণু ও তাঁর ধামসকল স্বতঃস্ফুর্ত চিন্ময় জ্যোতির দ্বারা উদ্ভাসিত (জ্যোতীংষি বিষ্ণূর্ভুবানানি বিষ্ণূঃ)। তত্ত্বদর্শী মহাজনেরা যথাক্রমে সৎ, অসত-নিত্য ও অনিত্য বলতে চেতন ও জড় বস্তুকেই উল্লেখ করেন।

মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন বন্ধ জীবের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এটিই হচ্ছে সর্বপ্রথম উপদেশ। জীব হচ্ছে ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই সে ভগবানের নিত্যদাস। এই জ্ঞান উপলব্ধি করা হলেই অজ্ঞানতার আবরণ উন্মোচিত হয় এবং সে তখন ভগবানের সঙ্গে উপাস্য আর উপাসকের সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। পূর্ণের সঙ্গে অংশের যে সম্পর্ক, ভগবানের সঙ্গে জীবের সেই সম্পর্ক-ভগবান হচ্ছেন পূর্ণ, আর জীব তার অংশ। বেদান্তসুত্র ও শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, ভগবান হচ্ছেন সব কিছুর উৎস- সব কিছুই উদ্ভুত হয়েছে ভগবানের থেকে। ভগবানের থেকে উদ্ভুত এই প্রকৃতিতে পরা ও অপরা এই দুটি স্তর আছে। জীব ভগবানের পরা প্রকৃতির অন্তর্গত। সপ্তম অধ্যায়ে এই সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। শক্তি ও শক্তিমানের মধ্যে যদিও কোন ভেদ নেই, তবুও শক্তিমান হচ্ছেন শক্তির নিয়ন্তা। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন শক্তিমান এবং শক্তি বা প্রকৃতি সর্ব অবস্থাতেই তাঁর নিয়ন্ত্রাণাধীন। তাই, প্রভু ও ভৃত্য অথবা গুরু ও শিষ্যের সম্পর্কের মতো জীবসমূহ পরমেশ্বর ভগবানের অধীন। মায়ার অন্ধকারে যখন জীব আচ্ছন্ন থাকে, তখন সে ভগবৎ-তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারে না। ভগবান তাই জীবকে মায়ান্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে সত্য দর্শন করাবার জন্য এই ভগবদ্‌গীতার শিক্ষা দান করেন।




অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্ ।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি ॥১৭॥

অর্থ- যা সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, তাকে তুমি অবিনাশী বলে জানবে৷ সেই অব্যয় আত্মাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।

আলোচনাঃ- এই শ্লোকে আরও স্পষ্টভাবে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই আত্মা সারা দেহ জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। যে-কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, সমগ্র দেহ জূড়ে কি বিস্তৃত হয়ে আছে –সেটি হচ্ছে চেতনা। প্রয়তেকেই তার দেহের সুখ ও বেদনা সম্বন্ধে সচেতন। চেতনার এই বিস্তার প্রত্যেকের তার নিজের দেহেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু একজনের দেহের অনুভূতি অন্য আর কেউ অনুভব করতে পারে না। এর থেকে বোঝা যায়, এক-একটি দেহ হচ্ছে এক-একটি স্বতন্ত্র আত্মার মূর্তরূপ এবং স্বতন্ত্র চেতনার মাধ্যমে আত্মার উপস্থিতির লক্ষণ অনুভূত হয়। এই আত্মার আয়তন কেশাগ্রের দশ সহস্ত্র ভাগের একভাগের সমান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৫/৯) প্রতিপন্ন করা হয়েছে-
বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায় কল্পতে।।
“কেশাগ্রকে শতভাগে ভাগ করে তাকে আবার শতভাগে ভাগ করলে তার যে আয়তন হয়, আত্মার আয়তনও ততখানি।“ সেই রকম অনুরূপ একটি শ্লোকে বলা হয়েছে-
কেশাগ্রশতভাগস্য শতাংশসদৃশাত্মকঃ।
জীবঃ সূক্ষ্মস্বরুপোহয়ং সংখ্যাতীতী হি চিৎকণঃ।।
“অসংখ্য যে চিৎকণা রয়েছে, তার আয়তন কেশাগ্রের দশ সহস্র ভাগের এক ভাগের সমান।”
সুতরাং এর থেকে আমরা বুঝতে পারিম জীবাত্মা হচ্ছে এক-একটি চিৎকণা, যার আয়তন পরমাণুর থেকেও অনেক ছোট এবং এই জীবাত্মা বা চিৎকণা সংখ্যাতীত। এই অতি সুক্ষ্ম চিৎকণাগুলি জড় দেহের ও চেতনার মূল তত্ত্ব। কোন ওষুধের প্রভাব যেমন দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, এই চিৎ-স্ফুলিঙ্গের প্রভাবও তেমনই সারা দেহ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। আত্মার এই প্রবাহ চেতনারূপে সমগ্র দেহে অনুভূত হয় এবং সেটিই হচ্ছে আত্মার উপস্থিতির প্রমাণ। সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে, জড় দেহে যখন চেতনা থাকে না, তখন তা মৃত দেহে পরিণত হয় এবং কোন রকম জড় প্রচেষ্টার দ্বারাই আর সেই দেহে চেতনা ফিরিয়ে আনা যায় না। এর থেকে বোঝা যায়, চেতনার উদ্ভব জড় পদার্থের সংমিশ্রণের ফলে হয় না, তা হয় আত্মার থেকে। চেতনা হচ্ছে আত্মার স্বাভাবিক প্রকাশ। আত্মার পারমাণবিক পরিমাপ সম্বন্ধে মূণ্ডক উপনিষদে (৩/১/৯) বলা হয়েছে- এষোহণুরাত্মা চেতসা বেদিতব্যো যস্মিন্‌ প্রাণঃ পঞ্চধা সংবিবেশ।প্রাণৈশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং যস্মিন্‌ বিশুদ্ধে বিভবত্যেষ আত্মা।। আত্মা পরমাণুসদৃশ এবং শুদ্ধ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তাকে অনুভব করা যায়। পরমাণুসদৃশ এই আত্মা পঞ্চবিধ বায়ুতে (প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান ও উদান) ভাসমান থেকে হৃদয়ে অবস্থান করে এবং জীবাত্মার সমগ্র দেহে তার প্রভাব বিস্তার করে। আত্মা যখন এই পঞ্চবিধ জড় বায়ুর কলুষিত প্রভাব থেকে পবিত্র হয়, তখন তার অপ্রাকৃত গুণাবলীর প্রকাশ হয়।



অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ।
অনাশিনোঽপ্রমেযস্য তস্মাদ্যুধ্যস্ব ভারত ॥১৮॥

অর্থ- অবিনাশী, অপরিমেয় ও শাশ্বত আত্মার জড় দেহ নিঃসন্দেহে বিনাশশীল। অতএব হে ভারত! তুমি শাস্ত্রবিহিত স্বধর্ম পরিত্যাগ না করে যুদ্ধ কর।

আলোচনাঃ- জড় দেহের ধর্মই হচ্ছে বিনাশ প্রাপ্ত হওয়া। জড় দেহ এই মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, নয়তো একশ বছর পর ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু একদিন না একদিন এর ধ্বংস হবেই। অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আত্মাকে টিকিয়ে রাখার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আত্মা এত সূক্ষ্ম যে, তাকে দেখাই যায় না, সুতরাং কোন শত্রুই তাকে হত্যা করতে পারে না। পূর্ববর্তী শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, আত্মা এত সূক্ষ্ম যে, তাকে পরিমাপ করাও অসম্ভব। সুতরাং দেহ ও আত্মা এই দুই তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে জীবের স্বরূপ বিচার করলে তখন আর কোন অনুশোচনা থাকতে পারে না, কারণ মানুষের প্রকৃত স্বরূপ আত্মা চিরশাশ্বত এবং কোন অবস্থাতেই তার বিনাশ হয় না, আর জড় দেহ হচ্ছে অনিত্য, একদিন না একদিন যখন তার ধ্বংস হবেই, তখন কোনভাবেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য অথবা চিরকালের জন্য দেহটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে সমগ্র আত্মার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ এক-একটি জড় দেহ প্রাপ্ত হয়। সেই জন্যই শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবনযাপন করা উচিত। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করার ফলে উপযুক্ত দেহ প্রাপ্ত হয়ে জীবাত্মা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। বেদান্ত-সুত্রে আত্মাকে আলোক বলে সম্বোধন করা হয়েছে, কারণ সে হচ্ছে পরম আলোকের অংশ। সূর্যের আলোক যেমন সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে প্রতিপালন করে, তেমনই আত্মার আলোকেও জড় দেহকে প্রতিপালন করে। দেহে আত্মা থাকে বলেই দেহটিকে এত সুন্দর বলে মনে হয়, কিন্তু আত্মা ব্যতীত দেহের কোনই গুরুত্ব নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন, দেহাত্মবুদ্ধি পরিত্যাগ করে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য যুদ্ধ করতে।



য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে ॥১৯॥

অর্থ- যিনি জীবাত্মাকে হন্তা বলে মনে করেন কিংবা যিনি একে নিহত বলে ভাবেন তাঁরা উভয়েই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানেন না। কারণ আত্মা কাউকে হত্যা করেন না এবং কারও দ্বারা নিহত হন না।

অলোচনাঃ- যখন কোন দেহধারী জীব মারাত্মক অস্ত্রের দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়, তখন জানতে হবে যে, দেহের মধ্যে আত্মার মৃত্যু হয় না। আত্মা তখন আর সেই দেহে বাস করতে পারে না। বাস করার অনুপযোগী বলে আত্মা তখন সেই দেহটি ত্যাগ করে। যারা মূর্খ, তারা আত্মার এই দেহত্যাগ করাকে আত্মার মৃত্যু বলে মনে করে। কিন্তু পরবর্তী শ্লোকে আমরা জানতে পারব- আত্মা এত সূক্ষ্ম যে, কোন অস্ত্রের দ্বারাই তাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া আত্মা চিরশ্বাশ্বত ও চিন্ময় হবার ফলে, কোন অবস্থাতেই তার বিনাশ হয় না। যার মৃত্যু হয় অথবা মৃত্যু হয়েছে বলে মনে হয়, তা হচ্ছে জড় দেহটি মাত্র। অবশ্য তা বলতে এটি বোঝায় না যে, দেহটিকে হত্যা করলে কোন অন্যায় হয় না। বেদে নির্দেশ দেওয়া আছে, মা হিংস্যাৎ সর্বা ভূতানি- কোন জীবের প্রতি হিংসা করো না। কারও জীবের আত্মিক সত্তাকে হত্যা করা যায় না, এই উপলব্ধি হওয়ার ফলে প্রাণীহত্যায় উৎসাহ লাভ করা উচিত নয়। বিনা কারণে অন্যায়ভাবে যখন পশু হত্যা করা হয়, তখন তাতে অবশ্যই পাপ হয়। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে যেমন রাষ্ট্রের আইন অনুসারে হত্যাকারী শাস্তি পায়, ভগবানের আইনেও তেমনই তার জন্য শাস্তি পেতে হয়। সনাতন-ধর্মকে রক্ষা করার জন্য ভগবান অর্জুনকে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, তিনি কখনই অর্জুনকে তাঁর খেয়ালখুশি মতো হত্যা করতে আদেশ দেননি।



ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥২০॥

অর্থ- আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, 
অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।

আলোচনাঃ- গুণগতভাবে পরমাত্মা ও তাঁর পরমাণুসদৃশ অংশ জীবাত্মার মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। জড় দেহের যেমন পরিবর্তন হয়, আত্মার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। তাই আত্মাকে বলা হয় কূটস্থ, অর্থাৎ কোন কালে, কোন অবস্থায় তার কোন পরিবর্তন হয় না। জড় দেহে ছয় রকমের পরিবর্তন দেখা যায়। মাতৃগর্ভে তার জন্ম হয়, তার বৃদ্ধি হয়, কিছুকালের জন্য স্থায়ী হয়, তা কিছু ফল প্রসব করে, ক্রমে ক্রমে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অবশেষে তার বিনাশ হয়। আত্মার কিন্তু এই রকম কোন পরিবর্তনই হয় না। আত্মার কখনও জন্ম হয় না, কিন্তু, যেহেতু সে জড় দেহ ধারণ করে, তাই সেই দেহটির জন্ম হয়। যার জন্ম হয়, তার মৃত্যু অবধারিত। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। তেমনই আবার, যার জন্ম হয় না তার কখনই মৃত্যু হতে পারে না। আত্মার কখনও জন্ম হয় না, তাই তার মৃত্যুও হয় না, আর সেই জন্য তার অতীত, বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সে নিত্য, শাশ্বত ও পুরাতন, অর্থাৎ কবে যে তার উদ্ভব হয়েছিল তার কোনও ইতিহাস নেই। আমরা দেহ-চেতনার দ্বারা প্রভাবিত, তাই আমরা আত্মার জন্ম-ইতিহাস খুঁজে থাকি। কিন্তু যা নিত্য, শাশ্বত, তার তো কোনও শুরু থাকতে পারে না। দেহের মতো আত্মা কখনও জরাগ্রস্ত হয় না। তাই, বৃদ্ধ অবস্থাতেও মানুষ তার অন্তরে শৈশব অথবা যৌবনের উদ্যমতা অনুভব করে। দেহের পরিবর্তন কখনই আত্মাকে প্রভাবিত করে না। জড় দেহের মাধ্যমে যেমন সন্তান-সন্ততি উৎপন্ন হয়, আত্মা কখনও তেমনভাবে অন্য কোনও আত্মা উৎপাদন করে না। দেহজাত সন্তান-সন্ততিরা প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন ভিন্না আত্মা। স্ত্রী-পুরুষের দেহের মিলনের ফলে আত্মা নতুন দেহ প্রাপ্ত হয় বলে, সেই আত্মাকে কোন বিশেষ স্ত্রী-পুরুষের সন্তান বলে মনে হয়। আত্মার উপস্থিতির ফলে দেহের বৃদ্ধি হয়, কিন্তু আত্মার কখনও বৃদ্ধি বা কোন রকম পরিবর্তন হয় না। 

এভাবেই আমার উপলব্ধি করতে পারি, দেহে যে ছয় রকমের পরিবর্তন হয়, আত্মা তার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। কঠ উপনিষদেও (১/২/১৮) গীতার এই শ্লোকের মতো একটি শ্লোক আছে- ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ । অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।। এই শ্লোকটির সঙ্গে ভগবদগীতার শ্লোকটির পার্থক্য কেবল এখানে ‘বিপশ্চিৎ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞানী অথবা জ্ঞানের সহিত। আত্মা পূর্ণ জ্ঞানময়, অথবা সে সর্বদাই পূর্ণচেতন। তাই, চেতনাই হচ্ছে আত্মার লক্ষণ। এমন কি আত্মাকে হৃদয়ের মধ্যে দেখা না গেলেও চেতনার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। অনেক সময় মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবার ফলে অথবা অন্য কোন কারণে সূর্যকে দেখা যায় না, কিন্তু সূর্যের আলো সর্বদাই সেখানে রয়েছে এবং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এখন দিনের বেলা। ভোরের আকাশে যখনই একটু আলোর আভাস দেখতে পাওয়া যায়, তখনই আমরা বুঝতে পারি, আকাশে সূর্যের উদয় হচ্ছে। ঠিক তেমনই, মানুষই হোক বা পশুই হোক, কীট-পতঙ্গই হোক বা উদ্ভিদই হোক, একটুখানি চেতনার বিকাশ দেখতে পেলেই আমরা তাদের মধ্যে আত্মার উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। আত্মার সচেতনতা ও পরমাত্মার সচেতনতার মধ্যে অবশ্য অনেক পার্থক্য রয়েছে, কারণ পরমাত্মা হচ্ছেন সর্বজ্ঞ। তিনি সর্ব অবস্থায় ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে অবগত। স্বতন্ত্র জীবের চেতনা বিস্মৃতিপ্রবণ, সে যখন তার সচ্চিদানন্দময় স্বরূপের কথা ভুলে যায়, তখন সে শ্রীকৃষ্ণের পরম উপদেশ থেকে শিক্ষা ও আলোক প্রাপ্ত হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বিস্মরণশীল জীবের মতো নন। যদি তাই হত, কৃষ্ণের ভগবদগীতার উপদেশাবলি অর্থহীন হয়ে পড়ত। 

আত্মা দুই রকমের- অণু আত্মা ও পরমাত্মা বা বিভু-আত্মা। কঠ উপনিষদে(১/২/২০) তার বর্ণনা করে বলা হয়েছে- অণেরণীয়ান্মহতো মহীয়ান আত্মাস্য জন্তোর্নিহিতো গুহায়াম ।তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো ধাতুঃ প্রসাদান্মহিমানমাত্মনঃ ।। “পরমাত্মা ও জীবাত্মা উভয়েই বৃক্ষসদৃশ জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত। যিনি সব রকমের জড় বাসনা ও সব রকমের শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনি কেবল ভগবানের কৃপার ফলে আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমাত্মারও উৎস, যা পরবর্তী অধ্যায়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। আর অর্জুন হচ্ছেন তাঁর প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে আত্মবিস্মৃত জীবাত্মা; তাই তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অথবা তাঁর সুযোগ্য প্রতিনিধি সদগুরুর কাছ থেকে এই পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে হয়।




বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যযম্।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতযতি হন্তি কম্ ॥২১॥

অর্থ- হে পার্থ! যিনি এই আত্মাকে অবিনাশী, শাশ্বত, জন্মরহিত ও অক্ষয় বলে জানেন, তিনি কিভাবে কাউকে হত্যা করতে বা হত্যা করাতে পারেন?

আলোচনাঃ- সব কিছুরই যথার্থ উপযোগিতা আছে এবং যিনি পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন, তিনি জানেন কোন জিনিস কোথায় এবং কিভাবে নিয়োগ করলে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হবে। আর সব কিছুর মতো হিংসারও যথার্থ উপযোগিতা আছে এবং যিনি যথার্থ জ্ঞানী, তিনি জানেন কোথায়, কখন, কিভাবে হিংসার প্রয়োগ করতে হয়। বিচারক যখন আসামীকে খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ড দেন, তখন হিংসাত্মক কাজ করেছেন বলে বিচারককে কেউ অভিযুক্ত করে না। তার কারণ, তিনি বিচারের রীতি অনুযায়ী এই দণ্ড দেন। মানব-সমাজের শ্রেষ্ঠ নীতিশাস্ত্র ‘মনুসংহিতাতে’ খুনীকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার নির্দেশ দেওয়া আছে। কারণ, এই শাস্তি পাবার ফলে সেই খুনির মহাপাপের ভার লাঘব হয়, পরবর্তী জীবনে তাকে আর তার ফলভোগ করতে হয় না। সুতরাং রাজা যখন খুনীকে প্রাণদণ্ড দেন, তখন তার মঙ্গলের জন্যই তা দেওয়া হয়। তেমনই, শ্রীকৃষ্ণ যখন যুদ্ধ করবার আদেশ দেন, তখন আমরা সহজেই বুঝতে পারি, চরম বিচারের জন্যই তিনি এই হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাই, অর্জুনের কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের নির্দেশ পালন করা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম করুণাময়, তাই আপাতদৃষ্টিতে তাঁর কার্যকলাপ হিংসাত্মক বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে তাঁর আশীর্বাদ। তেমনই, তাঁর নির্দেশে যখন হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করা হয়, তখন সেই হিংসা আশীর্বাদে পরিণত হয়। আর তা ছাড়া, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, মানুষের প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে তার আত্মা এবং সেই আত্মাকে কখনও হত্যা করা যায় না। সুতরাং, সুবিচারমূলক প্রশাসনের স্বার্থে ঐ ধরনের হিংসাত্মক কার্যকলাপের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শল্য-চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেন রোগ সারাবার জন্য, রোগীকে মেরে ফেলবার জন্য নয়। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান, তাঁর আদেশ অনুসারে যুদ্ধ করার ফলে অর্জুনের কোনও পাপ হবার সম্ভাবনা নেই, উপরন্তু তাতে সমগ্র মানব-সমাজের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হওয়াটাই স্বাভাবিক।




বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥২২॥

অর্থ- মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন।

আলোচনাঃ- পারমাণবিক জীবাত্মা যে এক দেহ ছেড়ে আর এক দেহ ধারণ করে, তা সর্বজনস্বীকৃত তথ্য। তবু আধুনিক যুগের কিছু বৈজ্ঞানিকেরা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, অথচ হৃদয় থেকে কেমন করে শক্তি সঞ্চালিত হয় তা বোঝাতে পারে না। কিন্তু তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, প্রতি মুহূর্তে দেহের পরিবর্তন হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের ফলেই দেহে শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য দেখা দেয়। বার্ধক্যের পর আত্মা অন্য দেহ ধারণ করে। এই সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই (২/১৩) বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

পরমাত্মার কৃপার ফলেই অণু আত্মা ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়। বন্ধু যেমন বন্ধুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে, পরমাত্মাও তেমন অণু আত্মার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। মুণ্ডক উপনিষদ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আত্মা ও পরমাত্মাকে একই গাছে বসে থাকা দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি (জীবাত্মা) সেই গাছের ফল খাচ্ছে, অন্য পাখিটি (শ্রীকৃষ্ণ) তাঁর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। এই দুটি পাখি গুণগতভাবে যদিও এক, তবুও তাদের একজন সেই জড়-জাগতিক গাছের ফলের আকর্ষণে আবদ্ধ, আর অন্য জন একান্ত সুহৃদের মতো তার কার্যকলাপ কেবল পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সাক্ষীরূপ পাখি, আর অর্জুন হচ্ছেন ফল আহারে রত পাখি। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু, তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্য জন হচ্ছেন ভৃত্য। জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে তার এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই এক গাছ থেকে আর এক গাছে অর্থাৎ এক দেহ থেকে আর এক দেহে সে ঘুরে বেড়ায়। এই জড় দেহরূপ বৃক্ষে জীবাত্মা কঠোর সংগ্রাম করছে, কিন্তু যে মুহূর্তে সে অন্য পাখিটিকে পরম গুরুরূপে গ্রহণ করতে সম্মত হয়, যেভাবে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ লাভের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছিলেন, তৎক্ষণাৎ অধীন পাখিটি সমস্ত শোক থেকে মুক্ত হয়। মুণ্ডক উপনিষদে (৩/১/২) ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৪/৭) প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে – 
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ ।।
“দুটি পাখি একই গাছে বসে আছে, কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত সে গাছের ফলের ভোক্তারূপে সর্বদাই শোক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখিটির দিকে ফিরে তাকায়, তবে তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত শোকের অবসান হয়, কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।” অর্জুন তাঁর নিত্যকালের বন্ধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে ভগবদগীতার তত্ত্ব জানতে পেরেছেন। এভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করার ফলে তিনি ভগবানের পরম মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন এবং সমস্ত শোক থেকে মুক্ত হন।

ভগবান এখানে অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন, তাঁর বৃদ্ধ পিতামহ, শিক্ষক আদি আত্মীয়-পরিজনদের জন্য শোক না করতে। পক্ষান্তরে, সেই ধর্মযুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করার ফলে তাঁদের দেহগত কর্মফল জনিত সমস্ত পাপ থেকে তাঁরা মুক্ত হবেন বলে, আনন্দিত হওয়া উচিত। যজ্ঞবেদিতে অথবা ধর্মযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করলে তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায় এবং তার ফলে উচ্চতর জীবন লাভ হয়। সুতরাং, অর্জুনের শোক করবার কোনই কারণ ছিল না।




নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদযন্ত্যাপো ন শোষযতি মারুতঃ ॥২৩॥

অর্থ- আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না।

আলোচনাঃ- তরবারি, আগ্নেয় অস্ত্র, পর্জন্যাস্ত্র, বায়বীয় অস্ত্র আদি কোন রকমের অস্ত্রশস্ত্রই আত্মাকে হত্যা করতে পারে না। এই শ্লোকে বোঝা যায়, মহাভারতের যুগে আধুনিক যুগের মতো আগ্নেয়াস্ত্র তো ছিলই, আর তা ছাড়া জল, বায়ু, আকাশ আদির তৈরি অস্ত্রের ব্যবহারও ছিল। আধুনিক যুগের পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রগুলি এক রকমের আগ্নেয়াস্ত্র, কিন্তু তথাকথিতভাবে বিজ্ঞানের উন্নতি হলেও জল, বায়ু, আকাশ আদির দ্বারা নির্মিত অস্ত্রের ব্যবহার আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। মহাভারতের যুগে জলীয় অস্ত্রের দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্রকে খণ্ডন করা হত- যা আজকের বৈজ্ঞানিকদের কল্পনারও অতীত। সেই যুগের বীরেরা যে-সমস্ত অদ্ভুত ঝটিকা অস্ত্রের ব্যবহার জানতেন, তা আধুনিক বৈজ্ঞানিকেরা কল্পনাও করতে পারে না। অগ্নি, জল, বায়ু, আকাশ আদির এত সমস্ত অস্ত্র না থাকলেও, কোন বৈজ্ঞানিক অস্ত্রের দ্বারাও আত্মাকে হত্যা করা যায় না। 
মায়াবাদীরা বোঝাতে পারেন না কেমন করে জীবাত্মা নিতান্তই অজ্ঞতার ফলে জড় অস্তিত্ব লাভ করে এবং তার ফলে মায়াশক্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আত্মাকে যেমন অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, তেমনই আত্মাকে তার উৎস পরমাত্মার থেকেও কখনও বিচ্ছিন্ন করা যায় না ; বরং, স্বতন্ত্র জীবাত্মাগুলি পরমাত্মার শাশ্বত ভিন্নাংশ। যেহেতু সনাতন জীবাত্মা পরমাণুসদৃশ, তাই ভগবানের বহিরঙ্গা মায়াশক্তির দ্বারা তাদের আচ্ছাদিত হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায় এবং এভাবে তারা ভগবানের ভগবানের সান্নিধ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, ঠিক যেমন আগুনের স্ফুলিঙ্গ, যদিও আগুনের সঙ্গে তা গুনগতভাবে এক ও অভিন্ন, কিন্তু আগুনের থেকে বেরিয়ে এলেই তা নিভে যায় এবং তখন আর তার মধ্যে আগুনের বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায় না। তেমনই পরমাণুসদৃশ জীবাত্মা ভগবৎ-বিমুখ হয়ে পড়লে মায়াশক্তির দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে এবং তার প্রকৃত স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে পড়ার ফলে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করতে থাকে। বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে, জীবাত্মা পরমাত্মার বিভিন্নাংশ। ভগবদগীতাতেও বলা হয়েছে, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মারা এই সম্পর্ক নিত্য শাশ্বত। সুতরাং, মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার পরও জীবাত্মা স্বতন্ত্র স্বরূপেই বিদ্যমান থাকে, যা অর্জুনের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশেই সুস্পষ্ট উপলব্ধি হয়। ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার পর অর্জুন মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তা বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে এক হয়ে যাননি।



অচ্ছেদ্যোঽযমদাহ্যোঽযমক্লেদ্যোঽশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোঽযং সনাতনঃ ॥২৪॥

অর্থ- এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোস্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন।

আলোচনাঃ- পারমাণবিক আত্মার এই সমস্ত গুণাবলী নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, সে অবশ্যই পরমাত্মার পরমাণুসদৃশ অংশ এবং সে নিত্যকাল অপরিবর্তিতভাবে একই পরমাণুরূপে চিরকাল বর্তমান থাকে। অদ্বৈতবাদীরা বলে থাকেন, মায়ামুক্ত হলে জীবাত্মা পরমাত্মায় পরিণত হয়, সেই তত্ত্ব এই শ্লোকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। মায়ামুক্ত হবার পর জীবাত্মা ইচ্ছা করলে ভগবানের দেহনির্গত ব্রহ্মজ্যোতিতে চিৎকণারূপে বিরাজ করতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিমান জীবাত্মারা ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করে ভগবানের সাহচর্য লাভ করে। এখানে সর্বগত(‘সর্বব্যাপ্ত’) শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ, কেন না কোন সন্দেহ নেই যে, ঈশ্বরের সৃষ্টির সর্বত্রই আত্মা বিরাজ করছে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, এমন কি আগুনেও জীবাত্মা রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আগুনে আত্মা নেই, কিন্তু এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, আগুন আত্মাকে দহন করতে পারে না। এর থেকে বোঝা যায়, সূর্যলোকেও সেখানকার উপযোগী দেহ ধারণ করে জীবাত্মা রয়েছে। সূর্যলোকে যদি জীব না থাকত, তা হলে সর্বগত, অর্থাৎ ‘সর্বত্র আত্মার গতি’ কথাটি ব্যবহার করা হত না।



অব্যক্তোঽয়মচিন্ত্যোঽয়মবিকার্যোঽয়মুচ্যতে।
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি ॥২৫॥

অর্থ- এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী বলে শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। অতএব এই সনাতন স্বরূপ অবগত হয়ে দেহের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।

আলোচনাঃ- পূর্বে বলা হয়েছে, জড়-জাগতিক বিচারে আত্মার আয়তন এত সূক্ষ্ম যে, সবচেয়ে শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও তাকে দেখা যায় না, তাই সে অদৃশ্য। আত্মার অস্তিত্বকে পরীক্ষামূলকভাবে বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করা যায় না, এর একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে শ্রুতি-প্রমাণ বা বৈদিক জ্ঞান। আত্মার অস্তিত্ব আমারা সব সময়েই অনুভব করতে পারি। আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কারও মনেই কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তাই এই বৈদিক সত্যকে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে, কারণ এ ছাড়া আর কোন উপায়েই আত্মার অস্তিত্বের এই নিগুঢ় তত্ত্বকে জানতে পারা যায় না। উচ্চতর কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করে আমাদের অনেক কিছুকেই স্বীকার করতে হয়। আমাদের পিতৃপরিচয় যেমন মায়ের কাছ থেকে জানা ছাড়া আর কোন উপায়েই জানতে পারা যায় না এবং মায়ের প্রদত্ত পিতৃপরিচয়কে যেমন আমরা অস্বীকার করতে পারি না, আত্মা সম্বন্ধেও তেমন বৈদিক জ্ঞান বা শ্রুতি-প্রমাণ ছাড়া আর কোন উপায়েই জানা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, মানুষের সীমিত ইন্দ্রিয়লব্ধ জড় জ্ঞানের দ্বারা কখনই আত্মার তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায় না। বেদে বলা হয়েছে আত্মা হচ্ছে চেতন। আত্মার থেকেই সমস্ত চেতনের প্রকাশ হয়। এই সত্যকে আমরা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারি। তাই যারা বুদ্ধিমান, তাঁরা এই বৈদিক সত্যকে স্বীকার করেন। দেহের পরিবর্তন হলেও আত্মার কখনও কোন পরিবর্তন হয় না। চির-অপরিবর্তনীয় আত্মা চিরকালই বিভুচৈতন্য পরমাত্মার পরমাণুসদৃশ অংশরূপেই বিদ্যমান থাকে। পরমাত্মা অসীম- অনন্ত এবং আত্মা পরমাণুসদৃশ। আত্মার কখনও কোন রকম পরিবর্তন হয় না, তাই সে চিরকালই পরমাণুসদৃশই থাকে। তার পক্ষে বিভুচৈতন্য-বিশিষ্ট পরমাত্মা বা ভগবান হওয়া কখনই সম্ভব নয়। বেদে নানা রকমভাবে বারবার এই কথার উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে আমরা আত্মার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারি। কোনও তত্ত্বকে নির্ভুলভাবে ও সম্যকরূপে বুঝতে হলে, সেই জন্য তার পুনরাবৃত্তি দরকার।




অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি ॥২৬॥

অর্থ- হে মহাবাহো ! আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মার বারবার জন্ম হয় এবং মৃত্যু হয়, তা হলেও তোমার শোক করার কোন কারণ নেই।

আলোচনাঃ প্রায় বৌদ্ধদের মতো কিছু দার্শনিক আছে, যারা আত্মার দেহাতীত স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা মানতে চায় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন ভগবদ্‌গীতা বলেন, সেই যুগেও এই ধরনের নাস্তিক ছিল, তাদের বলা হত লোকায়তিক ও বৈভাষিক। এই সমস্ত দার্শনিকদের মতবাদ হচ্ছে, জড় পদার্থের সমন্বয়ের কোন এক বিশেষ পরিণিত অবস্থায় প্রাণের উদ্ভব হয়। আধুনিক জড় বিজ্ঞানী ও জড়বাদী দার্শনিকেরাও এই মতবাদ পোষণ করে। তাদের মতে, দেহটি হচ্ছে কতকগুলি জড় উপাদানের সমন্বয় মাত্র এবং কোনও এক পর্যায়ে জড় উপাদান ও রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে প্রাণের লক্ষণ বিকশিত হয়। এন্‌থ্রোপোলজি বা নৃবিজ্ঞান এই মতবাদের ভিক্তিতে প্রচলিত হয়েছে। আধুনিক যুগে, বিশেষ করে আমেরিকাতে এই মতবাদ ও বৌদ্ধধর্মের নিরীশ্বরবাদের ভিক্তির উপর অনেক নকল ধর্ম গজিয়ে উঠেছে।
বৈভাষিক দার্শনিকদের মতো অর্জুন যদি আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করতেন, তা হলেও তাঁর শোক করার কোন কারণ ছিল না। কিছু পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থের বিনাশের জন্য কেউ শোক করে না এবং তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত হয় না। পক্ষান্তরে, আধুনিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক যুদ্ধবিগ্রহে শত্রু জয় করার উদ্দেশ্যে কত টন টন রাসায়নিক উপাদান তো নষ্টই হচ্ছে। বৈভাষিক দর্শন অনুসারে, দেহের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত আত্মার বিনাশ হয়। সুতরাং, অর্জুন যদি বৈদিক মতবাদকে অস্বীকার করে আত্মাকে নশ্বর বলে মনে করতেন অর্থাৎ দেহের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও বিনাশপ্রাপ্ত হয় বলে মনে করতেন, তা হলেও তাঁর অনুশোচনা করার কোনই কারণ ছিল না। এই মতবাদ অনুয়ায়ী, যেহেতু ঘটনাচক্রে জড় পদার্থ থেকে প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য জীবের উদ্ভব হচ্ছে এবং প্রতি মুহূর্তেই এই রকম অসংখ্য জীব বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছে, তাই এর জন্য দুঃখ করার কোনই কারণ নেই। এই মতবাদের ফলে যেহেতু পুনর্জন্মের কোন প্রশ্নই ওঠে না, তাই অর্জুনের পিতামহ, আচার্য আদি আত্মীয়-পরিজনদের হত্যাজনিত পাপের ফল ভোগ করারও কোন ভয় নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিদ্রুপ সহকারে অর্জুনকে মহাবাহু, অর্থাৎ যাঁর বাহুদ্বয় মহাশক্তি-সম্পন্ন বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ, অন্ততপক্ষে তিনি বৈদিক জ্ঞানের বিরোধী বৈভাষিকদের মতবাদ স্বীকার করেননি এবং তার ফলে তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি ক্ষত্রিয়, এই বর্ণ-বিভাগ বৈদিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং যে এই বৈদিক বর্ণাশ্রম-ধর্ম মেনে চলে, সে বৈদিক নির্দেশ অনুয়ায়ী আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।



জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি ॥২৭॥
অর্থ- যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী। অতএব অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়।
আলোচনাঃ- পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে কোন বিশেষ দেহপ্রাপ্ত হয়ে আত্মা জন্মগ্রহণ করে। আর সেই দেহের মাধ্যমে কিছুকাল জড় জগতে অবস্থান করার পর, সেই দেহের বিনাশ হয় এবং তার কর্মের ফল অনুযায়ী সে আবার আর একটি নতুন দেহ ধারণ করে জন্মগ্রহণ করে। এভাবেই আত্মা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে থাকে। সে যাই হোক, এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র অনর্থক যুদ্ধ, হত্যা ও হিংসাকে কোন প্রকারেই অনুমোদন করে না। কিন্তু তবুও মানব-সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য হিংসা, হত্যা ও যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং তা যখন সমাজের মঙ্গলের জন্য সাধিত হয়, তখন তা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।
ভগবানের ইচ্ছার ফলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আয়োজিত হয়েছিল বলে তা সম্পূর্ণ অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং ন্যায়সঙ্গত কারণে যুদ্ধ করাটা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। যেহেতু তিনি সঠিকভাবে কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠান করছিলেন, তাই তাঁর আত্মীয়-স্বজনের বিয়োগে কেন তিনি ভীত অথবা শোকান্বিত হবেন? কর্তব্যকর্ম থেকে ভ্রষ্ট হলে পাপ হয় এবং অর্জুন যে স্বজন-হত্যার পাপের ভয়ে ভীত হচ্ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে সেই পাপ তাঁর হত যদি তিনি যুদ্ধে বিমুখ হয়ে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করতেন। এই ধর্মযুদ্ধ থেকে বিরত থাকলেও মৃত্যুর হাত থেকে তিন তাঁর অথাকথিত আত্মীয়-স্বজনদের রক্ষা করতে পারতেন না। প্রকৃতির বিধান অনুসারে একদিন না একদিন তাদের মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু অর্জুন যদি তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত হয় পথভ্রষ্ট হয়ে পড়তেন, তা হলে তাঁর মান, মর্যাদা ধূলিসাৎ হত।




অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত ।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা ॥২৮॥

অর্থ- হে ভারত! সমস্ত সৃষ্ট জীব উৎপন্ন হওয়ার আগে অপ্রকাশিত ছিল, তাদের স্থিতিকালে প্রকাশিত থাকে এবং বিনাশের পর আবার অপ্রকাশিত হয়ে যায়। সুতরাং, সেই জন্য শোক করার কি কারণ ?

আলোচনাঃ- আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী উভয় মতবাদকে মেনে নিলেও শোকের কোন কারণ নেই। যারা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না, বৈদিক মতাবলম্বীরা তাদের নাস্তিক বলে অভিহিত করে। তবুও এমন কি যদি তর্কের খাতিরে এই নাস্তিক মতবাদকে সত্য বলে গ্রহণ করা হয়, তা হলেও অনুশোচনা করার কোনই কারণ নেই। কারণ, জড়ের মধ্য থেকে প্রাণের উদ্ভব হয়ে যদি তা আবার জড়ের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়, তবে সেই অনিত্য বস্তুর জন্য শোক করা নিতান্তই নিরর্থক। আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা ছেড়ে দিলেও সৃষ্টির পূর্বে জড় উপাদানগুলি থাকে অব্যক্ত। এই সুক্ষ্ম অব্যক্ত থেকে আকারের প্রকাশ হয়, যেমন আকাশ থেকে বায়ুর উদ্ভব হয়, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল এবং জল থেকে মাটির উদ্ভব হয়। এই মাটি থেকে নানা রূপের উদ্ভব হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- ইট, সিমেন্ট, চুন, বালি, লোহা আদি সবই মাটি। সেই মাটি থেকে যখন একটি প্রাসাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে মিশে যায়। যে বস্তু দিয়ে প্রাসাদটি গড়া হয়েছিল, তার অণু-পরমাণুগুলির কোন পরিবর্তন হয় না। শক্তি সংরক্ষণের নীতি বর্তমানই থাকে, কেবল সময়ের প্রভাবে তার রূপের প্রকাশ হয় এবং অন্তর্ধান হয়- সেটিই হচ্ছে পার্থক্য। সুতরাং, এই আবির্ভাব ও অন্তর্ধানের জন্য শোক করার কি কারণ থাকতে পারে? যে-কোনভাবেই হোক না কেন, এমন কি অব্যক্ত অবস্থাতেও বস্তুর বিনাশ হয় না। আদিতে ও অন্তে জড়ের রূপ থাকে না, কেবল মধ্য তার রূপ ও গুণের প্রকাশ হয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়। সুতরাং, এর ফলে কোন জড়-জাগতিক পার্থক্য সুচিত হয় না।

আর আমরা যদি ভগবদ্‌গীতায় উক্ত বৈদিক সিদ্ধান্তকে মেনে নিই, অর্থাৎ অন্তবন্ত ইমে দেহাঃ-এই জড় দেহটি কালের প্রভাবে বিনষ্ট হবে, নিত্যস্যোক্তাঃ শারীরিণঃ- কিন্তু আত্মা চিরশাশ্বত, তা হলে আমাদের আর বুঝতে আসুবিধা হয় না যে, দেহটি একটি পোশাকের মতো। তাই এই পোশাকটির পরিবর্তনের জন্য কেন আমরা শোক করব? আত্মার নিত্যতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে দেখলে সহজেই বুঝতে পারা যায়, জড় দেহের যথার্থই কোন অস্তিত্ব নেই-এটি অনেকটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে যেমন কখনও আমরা দেখি, আকাশে উড়ছি অথবা রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে আছি, কিন্তু যখন ঘুম ভেঙ্গে যায়, তখন বুঝতে পারি, আমরা আকাশেও উড়িনি অথবা রাজা হয়ে সিংহাসনেও বসিনি। আমাদের জড় অস্তিত্বটিও তেমনই আমাদের মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কারের বিকার। বৈদিক জ্ঞান আমাদের দেহের অনিত্যতার পরিপ্রেক্ষিতে আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করতে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং, কেউ আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করুক অথবা আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করুক না কেন, যে-কোন অবস্থাতেই জড় দেহ বিনাশের জন্য শোক করার কারণ নেই।




আশ্চর্যবত্পশ্যতি কশ্চিদেন-
মাশ্চর্যবদ্বদতি তথৈব চান্যঃ ।
আশ্চর্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি
শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিত্ ॥২৯॥

অর্থ- কেউ এই আত্মাকে আশ্চর্যবৎ দর্শন করেন, কেউ আশ্চর্যভাবে বর্ণনা করেন এবং কেউ আশ্চর্য জ্ঞানে শ্রবণ করেন, আর কেউ শুনেও তাকে বুঝতে পারেন না। 

আলোচনাঃ- উপনিষদের তত্ত্বজ্ঞানের ভিত্তির উপর গীতোপনিষদ অধিষ্ঠিত, তাই এই শ্লোকের ভাব কঠ উপনিষদের (১/২/৭) শ্লোকটিতেও দেখা যায়-
শ্রবণয়াপি বহুভির্যো ন লভ্যঃ শ্রিন্বন্তোহপি বহবো যং ন বিদ্যুঃ । আশ্চর্যো বক্তা কুশলোহস্য লব্ধাশ্চর্যো জ্ঞাতা কুশলানুশিষ্টঃ ।। সত্য ঘটনা হচ্ছে যে, পারমাণবিক আত্মা বিশালাকার পশুর দেহে, বিশাল বটবৃক্ষে, আবার অতি ক্ষুদ্র জীবাণু যারা লক্ষ কোটি সংখ্যায় মাত্র এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাতেও থাকতে পারে, তাদের দেহেও অবস্থান করে, এটি অতি আশ্চর্যের কথা। যে সমস্ত মানুষ সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন এবং যাদের চিন্তাধারা সংযম ও তপশ্চর্যার প্রভাবে পবিত্র হয়নি, তারা কখনই পারমাণবিক জীবাত্মার বিস্ময়কর স্ফুলিঙ্গ রহস্য উপলব্ধি করতে পারে না। এমন কি বৈদিক জ্ঞানের মহান প্রবক্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মাকে পর্যন্ত ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান দান করেছিলেন, তিনি নিজে এসে সেই জ্ঞান দান করার পরেও তার মর্ম তারা উপলব্ধি করতে পারে না। স্থুল জড় পদার্থের দ্বারা অতি মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে পড়ার ফলে বর্তমান যুগের অধিকাংশ মানুষ কল্পনা করতে পারে না, পরমাণুর চাইতেও অনেক ছোট যে আত্মা, তা কি করে তিমি মাছের মতো বৃহৎ জন্তুর দেহে, আবার জীবাণুর মতো অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর দেহে উপস্থিত থেকে তাতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারে। তাই, মানুষ আত্মার কথা শুনে অথবা আত্মার কথা অনুমান করে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়। মায়াশক্তির প্রভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে, মানুষ তাদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধন করতে এতই ব্যস্ত যে, আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে কোন রকম চিন্তা করার সময় তাদের নেই। এমন কি যদিও এই কথাটি সত্য যে, এই আত্ম-উপলব্ধি ছাড়া জীবন-সংগ্রামে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাই শোচনীয় পরাজয়ে পর্যবসিত হবে। অনেকেই হয়ত আত্মজ্ঞান লাভ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে না, ফলে জড়-জাগতিক ক্লেশের পীড়নে তারা অহরহ নির্যাতিত হয় এবং তার থেকে মুক্ত হবার কোন উপায় খুঁজে পায় না। 

অনেক সময় কিছু মানুষ আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার প্রয়াসী হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাধুসঙ্গ বলে মনে করে একদল মূর্খের সঙ্গ লাভ করে ভাবতে শেখে যে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই-মায়ামুক্ত হলেই জীবাত্মা পরমাত্মাতে পরিণত হয়। এমন মানুষ খুবই বিরল যিনি জীবাত্মা, পরমাত্মা, তাঁদের নিজ নিজ কার্যকলাপ ও পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক এবং অন্যান্য পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্ব বুঝতে পারেন। আরও বিরল হচ্ছে সেই মানুষকে খুঁজে পাওয়া, যিনি এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং যিনি বিভিন্ন রূপের মধ্যে আত্মার অবস্থানের বর্ণনা দিতে সক্ষম। যদি কেউ আত্মার এই জ্ঞানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে, তা হলেই তার জন্ম সার্থক হয়।
মানবজন্ম লাভ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করে মায়ামুক্ত হয়ে চিৎ-জগতে ফিরে যাওয়া। এই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে অন্যান্য মতবাদের দ্বারা বিপথগামী না হয়ে মহত্তম প্রবক্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত ভগবদ্গীতার বাণীর যথাযথ মর্ম উপলব্ধি করা এবং তাঁর শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করা। বহু জন্মের পুণ্যের ফলে এবং বহু তপস্যার বলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মানুষ সর্ব কারণের কারণ পরমেশ্বর রূপে উপলব্ধি করতে পারে এবং তাঁর চরণে আত্মনিবেদন করতে সমর্থ হয়। অনেক সৌভাগ্যের ফলে মানুষ সদ্গুরুর সন্ধান পায়, যার অহৈতুকী কৃপার ফলে সে ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারে।




দেহী নিত্যমবধ্যোঽয়ং দেহে সর্বস্য ভারত ।
তস্মাত্সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি ॥৩০॥

অর্থ- হে ভারত! প্রাণীদের দেহে অবস্থিত আত্মা সর্বদাই অবধ্য। অতএব কোন জীবের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।

আলোচনাঃ- আত্মার অবিনশ্বরতার কথা প্রতিপন্ন করে ভগবান আবার উপসংহারে অর্জুনকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। দেহ অনিত্য, কিন্তু আত্মা নিত্য, তাই দেহের বিনাশ হলে তা নিয়ে শোক করবার কোন কারণ থাকতে পারে না। অতএব পিতামহ ভীষ্ম ও আচার্য দ্রোণ নিহত হবেন বলে ভয়ে ও শোকে যুদ্ধ করতে বিমুখ হয়ে স্বধর্ম পরিত্যাগ করা ক্ষত্রিয় বীর অর্জুনের উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক উপদেশামৃতের উপর আস্থা রেখে, প্রত্যেকের বিশ্বাস করতে হবে যে, জড় দেহ থেকে ভিন্ন আত্মার অস্তিত্ব রয়েছে, এই নয় যে, আত্মা বলে কোন বস্তু নেই, অথবা রাসায়নিক পদার্থের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে জাগতিক পরিপক্কতার কোন এক বিশেষ অবস্থায় চেতনার লক্ষণগুলির বিকাশ ঘটে। অবিনশ্বর আত্মার মৃত্যু হয় না বলে নিজের ইচ্ছামতো হিংসার আচরণ করাকে কখনই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না, কিন্তু যুদ্ধের সময় হিংসার আশ্রয় নেওয়াতে কোন অন্যায় নেই, কারণ সেখানে তার যথার্থ প্রয়োজনীয়তা আছে। এই প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আমাদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী বিবেচিত হয় না, তা হয় ভগবানের বিধান অনুসারে।




স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি ।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োঽন্যত্ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ॥৩১॥

অর্থ- ক্ষত্রিয়রূপে তোমার স্বধর্ম বিবেচনা করে তোমার জানা উচিত যে, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করার থেকে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই। তাই, তোমার দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়।

আলোচনাঃ- চতুর্বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণকে বলা হয় ক্ষত্রিয়। এদের কাজ হচ্ছে রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করা। ‘ক্ষৎ’ কথাটির অর্থ হচ্ছে আঘাত। আঘাত বা বিপদ থেকে (ত্রায়তে-ত্রাণ করে) যে ত্রাণ করে, সে হচ্ছে ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়েরা অস্ত্রচালনা শিক্ষালাভ করে তাতে পারদর্শিতা লাভ করত। তাদের এই শিক্ষার একটি অঙ্গ হচ্ছে, বনে গিয়ে হিংস্র পশু শিকার করা। এভাবে অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে ক্ষত্রিয় সন্তান বনে গিয়ে হিংস্র বাঘকে যুদ্ধে আহবান করত এবং শুধু তলোয়ার হাতে সেই বাঘের সাথে যুদ্ধ করে তাকে নিধন করত। তারপর সেই বাঘকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সঙ্গে সৎকার করা হত। এই প্রথা আজও জয়পুরের ক্ষত্রিয় রাজপরিবারে প্রচলিত আছে। ক্ষত্রিয়েরা শত্রুকে যুদ্ধে আহ্বান করে তার প্রাণ সংহার করতে দ্বিধা করে না। রাজ্যশাসন ও প্রজাপালনের জন্য এই প্রথার প্রয়োজন অপরিহার্য। তাই, ক্ষত্রিয়েরা সরাসরিভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে পারে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে অহিংসার পথ অবলম্বন করা কূটনীতি হতে পারে, কিন্তু তা কখনই নীতিগত পন্থা নয়। নীতিশাস্ত্রে আছে—

আহবেষু মিথোহন্যোন্যং জিঘাংসন্তো মহীক্ষিতঃ
যুদ্ধমানাঃ পরং শক্ত্যা স্বর্গং যান্ত্যপরাঙ্মুখাঃ ।
যজ্ঞেষু পশবো ব্রহ্মন হন্যন্তে সততং দ্বিজৈঃ
সংস্কৃতাঃ কিল মন্ত্রৈশ্চ তেহপি স্বর্গমবাপ্নুবন।।

“কোন রাজা অথবা ক্ষত্রিয় যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ঈর্ষান্বিত শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামে রত হন, মৃত্যুর পর তিনি স্বর্গলোকে গমন করেন, তেমনই ব্রাহ্মণ যজ্ঞে পশুবলি দিলে স্বর্গ লাভ করেন।” তাই, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে হত্যা করা এবং যজ্ঞে পশুবলি দেওয়াকে হিংসাত্মক কার্য বলে গণ্য করা হয় না, কারণ এই ধর্ম অনুষ্ঠানের ফলে সকলেই লাভবান হয়। যজ্ঞে উৎসর্গীকৃত পশু জৈব বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্নত থেকে উন্নততর জীব দেহ ধারণ না করে, সরাসরিভাবে মনুষ্যশরীর প্রাপ্ত হয় এবং সেই যজ্ঞের ফলে দেবতারা তুষ্ট হয়ে মর্ত্যবাসীদের ধনঐশ্বর্য দান করেন। সুতরাং, ধর্মাচরণ করলে এভাবে সকলেই লাভবান হয়।

স্বধর্ম দুই রকমের। জড় বন্ধনমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জীবকে শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী তার দেহের ধর্ম পালন করতে হয় এবং তার ফলে সে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। মুক্ত অবস্থায় জীব তার অপ্রাকৃত স্বরূপে অধিষ্ঠিত থাকে। তখন আর তার দেহাত্মবুদ্ধি থাকে না, তাই তখন তাকে জড়-জাগতিক অথবা দেহগত আচার অনুষ্ঠান করতে হয় না। শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী, বদ্ধ অবস্থায় দেহাত্মবুদ্ধির স্তরে জীবের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চারটি স্তর থাকে এবং তাদের স্ব-স্ব ধর্ম থাকে এবং এই ধর্ম আচরণ করা অবশ্য কর্তব্য। ভগবান নিজেই গুণ ও কর্ম অনুসারে এই স্বধর্ম নির্ধারিত করেছেন এবং এই সম্বন্ধে চতুর্থ অধ্যায়ে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে। দেহগত স্বধর্মকে বলা হয় বর্ণাশ্রম-ধর্ম অথবা মানুষের পারমার্থিক উন্নতি লাভের উপায়। বর্ণাশ্রম-ধর্ম অথবা জড়া প্রকৃতির নির্দিষ্ট গুণ অনুসারে প্রাপ্ত দেহটির দ্বারা অনুষ্ঠিত বিশেষ কর্তব্যকর্মের স্তর থেকে মানব-সভ্যতা শুরু হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ কর্তব্যকর্মের স্তর থেকে মানব-সভ্যতা শুরু হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উচ্চ-কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসারে এই বর্ণাশ্রম-ধর্ম আচরণ করার ফলে মানুষ ক্রমে ক্রমে উচ্চ থেকে উচ্চতর জীবন প্রাপ্ত হয়ে অবশেষে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়।




যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্ ।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়া পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্ ॥৩২॥

অর্থ- হে পার্থ! স্বর্গদ্বার উন্মোচনকারী এই প্রকার ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না চাইতেই যে সব ক্ষত্রিয়ের কাছে আসে, তাঁরা সুখী হন।

আলোচনাঃ- অর্জুন যখন বলেছিলেন, “এই যুদ্ধে কোন লাভ নেই। এই পাপের ফলে আমাকে অনন্তকাল ধরে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।” তখন জগতের পরম শিক্ষাগুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন যে, তাঁর এই ভক্তি তাঁর মূর্খতার পরিচায়ক। তাঁর স্বধর্ম- ক্ষাত্রধর্ম ত্যাগ করে অহিংস নীতি অবলম্বন করা তাঁর পক্ষে অনুচিত। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় যদি অহিংস নীতি অবলম্বন করে, তবে তাকে একটি বড় মূর্খ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। পরাশর-স্মৃতিতে ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি বর্ণনা করেছেন-
ক্ষত্রিয়ো হি প্রজা রক্ষন শস্ত্রপাণিঃ প্রদণ্ডয়ন ।
নির্জিতা পরসৈন্যাদি ক্ষিতিং ধর্মেণ পালয়েৎ ।।
“সব রকম দুঃখ-দুর্দশা থেকে রক্ষা করে প্রজা-পালন করাই হচ্ছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এবং সেই কারণে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য তাঁকে অস্ত্রধারনপূর্বক দণ্ডদান করতে হয়। তাই তাঁকে বিরোধী ভাবাপন্ন রাজার সৈন্যদের বলপূর্বক পরাজিত করতে হয় এবং এভাবেই ধর্মের দ্বারা তাঁর পৃথিবী পালন করা উচিত।”

সব দিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখলে দেখা যায়, অর্জুনের যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার কোনই কারণ ছিল না। যুদ্ধে যদি তিনি জয়লাভ করতেন, তবে তিনি রাজ্যসুখ ভোগ করতেন, আর যদি যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হত, তবে তিনি স্বর্গলোকে উন্নীত হতেন-যেখানে তাঁর জন্য দ্বার ছিল অবারিত। যুদ্ধ করলে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি লাভবান হত।




অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি ।
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি ॥৩৩॥

অর্থ- তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তা হলে তোমার স্বীয় ধর্ম এবং কীর্তি থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পাপ ভোগ করবে।

আলোচনাঃ অর্জুনের বীরত্বের খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। তিনি মহাদেবের মতো দেবতাদেরও যুদ্ধে পরাস্ত করেছেন। কিরাতরূপী মহাদেবকে যুদ্ধে পরাস্ত করলে, সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে পাশুপত নামক এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র দান করেন। তাঁর অস্ত্রশিক্ষা গুরু দ্রোণাচার্যও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন এবং এমন একটি অস্ত্র দান করেন, যার দ্বারা তিনি দ্রোণাচার্যকেও পর্যন্ত হত্যা করতে পারতেন। তাঁর ধর্মপিতা দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁকে তাঁর বীরত্বের জন্য পুরস্কৃত করেন। এভাবে অর্জুনের বীরত্বের খ্যাতি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সুবিদিত ছিল। তাই তিনি যদি যুদ্ধবিমুখ হয়ে যুদ্ধ পরিত্যাগ করতেন, তবে তিনি কেবল তাঁর ক্ষাত্রধর্মেরই যে অবহেলা করতেন তা নয়, সেই সঙ্গে তাঁর বীরত্বের গৌরবও নষ্ট হত এবং তাঁকে নরকগামী হতে হত। পক্ষান্তরে, যুদ্ধ করার জন্য অর্জুনকে নরকে যেতে হত না, বরং যুদ্ধ না করার জন্যই তাঁকে নরকে যেতে হত।




অকীর্তিং চাপি ভূতানি কথযিষ্যন্তি তেঽব্যযাম্ ।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্তির্মরণাদতিরিচ্যতে ॥৩৪॥

অর্থ- সমস্ত লোক তোমার কীর্তিহীনতার কথা বলবে এবং যে-কোন মর্যাদাবান লোকের পক্ষেই এই অসম্মান মৃত্যু অপেক্ষাও অধিকতর মন্দ।

আলোচনাঃ- অর্জুনের বন্ধু ও উপদেষ্টারূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছেন, যুদ্ধ না করলে তার ফলাফল কি হবে। ভগবান বলছেন, “অর্জুন! যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই যদি তুমি যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ কর, তবে সকলে বলবে- তুমি কাপুরুষ। তোমার মতো যশস্বী ও মহানুভব বীরের পক্ষে এই কুখ্যাতির চাইতে মৃত্যুবরণ করা শ্রেয়। তাই, প্রাণরক্ষার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করার চাইতে যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করা অনেক ভাল। তার ফলে, তুমি আমার বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করবে এবং সমাজে তোমার সুনামও অক্ষুণ্ণ থাকবে।”
এভাবেই ভগবান অর্জুনকে বোঝালেন, যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করার চাইতে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করা অনেক শ্রেয়।
ভয়াদ্রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ |
যেষাং চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্ ॥৩৫॥

অর্থ- সমস্ত মহারথীরা মনে করবেন যে, তুমি ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছ এবং তুমি যাদের কাছে সম্মানিত ছিলে, তারাই তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করবে।

আলোচনাঃ- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর মতামত ব্যক্ত করে বললেন, “অর্জুন! তুমি মনে করো না যে, দুর্যোধন, কর্ণ আদি রথী-মহারথীরা মনে করবে, তুমি করুণার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধ করতে বিমুখ হয়েছ। তারা বলবে, তুমি প্রাণভয়ে ভীত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছ। ফলে, তোমার প্রতি তাদের যে উচ্চ ধারণা আছে, তা নস্যাৎ হবে।”

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ।।



অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ ।
নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্ ॥৩৬॥

অর্থ- তোমার শত্রুরা তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করে বহু অকথ্য কথা বলবে। তার চেয়ে অধিকতর দুঃখদায়ক তোমার পক্ষে আর কি হতে পারে।

আলোচনাঃ- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের অভাবনীয় হৃদয়-দৌর্বল্য দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, এই ধরনের মনোভাব কেবল অনার্যদেরই শোভা পায়। অর্জুনের মতো ক্ষত্রিয়-বীরের পক্ষে তা সম্পূর্ণ অসঙ্গত। তাই তিনি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে অর্জুনকে বোঝালেন, অর্জুনের মতো ক্ষত্রিয়ের হৃদয়ে এই অনার্যচিত দৌর্বল্যের কোন স্থান নেই।



হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্ ।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয় ॥৩৭॥

অর্থ- হে কুন্তীপুত্র! এই যুদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গ লাভ করবে, আর জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে। অতএব যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে উত্থিত হও।

আলোচনাঃ- তোমার জয়েও লাভ, পরাজয়েও লাভ। অর্থাৎ, যুদ্ধে যদি অর্জুনের জয় সুনিশ্চিত না-ও হত, তবু সেই যুদ্ধ তাঁকে করতেই হত। কারণ, সেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলেও, তিনি স্বর্গলোকেই উন্নীত হতেন। 

#এই অধ্যায়ের ৩০ শ্লোক পর্যন্ত শ্রীভগবান্ জ্ঞানগর্ভ আত্মতত্ত্বের উপদেশ দিয়াছেন। কিন্তু আত্মতত্ত্ব অতি দুর্জ্ঞেয়, উহা কেবল উপদেশে অধিগত হয় না, আর অধিগত না হইলে শোক-মোহও বিদূরিত হয় না। তাই ৩১-৩৭ শ্লোকে সহজ কথায় বুঝাইলেন যে, স্বধর্মের দিক্ দয়া দেখিলেও অর্জুনের এই ধর্ম্যযুদ্ধ করাই কর্তব্য। ইহাতে বিরত হলে লোক নিন্দ, জয় হলে পৃথিবী ভোগ, পরাজয় হইলেও স্বর্গপ্রাপ্তি। কিন্তু লোক নিন্দার ভয়ে, পৃথিবী ভোগের জন্য বা স্বর্গলাভে জন্য যে ধর্মপালন তাহা বড় শ্রেষ্ঠ ধর্ম নহে।।




সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি ॥৩৮

অর্থ- সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি ও জয়-পরাজয়কে সমান জ্ঞান করে তুমি যুদ্ধের নিমিত্ত যুদ্ধ কর, তা হলে তোমাকে পাপভাগী হতে হবে না।

আলোচনাঃ- ভগবান এখানে স্পষ্টভাবে অর্জুনকে বলেছেন, জয়-পরাজয়ের বিবেচনা না করে কেবল কর্তব্যের খাতিরে যুদ্ধ করার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। কারণ, ভগবানের ইচ্ছা অনুসারেই এই যুদ্ধ আয়োজিত হয়েছে। কৃষ্ণভাবনাময় কার্যকলাপের সময় সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় আদি জাগতিক ফলাফলের বিবেচনা করা নিরর্থক। কারণ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্য যে কর্মই করা হোক না কেন, তা জাগতিক ফলাফলের অতীত- সে সমস্ত কর্মই অপ্রাকৃত কর্ম। যে মানুষ তার ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধন করার জন্য কর্ম করে, তার সেই কর্মের জন্য তাকে শুভ অথবা অশুভ ফল ভোগ করতে হয়। কিন্তু যে মানুষ ভগবানের সেবায় নিজেকে সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছেন, তাঁর কারও প্রতি কোন কর্তব্য বাকি থাকে না এবং কারও প্রতি তাঁর আর কোন ঋণও থাকে না। স্বয়ং ভগবান ছাড়া আর কেউ তাঁর কর্মের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারে না। সাধারণ অবস্থায় প্রতিটি কর্মের জন্য মানুষকে কারও না কারও কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয়, কিন্তু ভগবানের সাবেয় নিজেকে উৎসর্গ করে কর্ম করলে আর সেই সমস্ত বন্ধন থাকে না।

শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে-
দেবর্ষিভূতাপ্তনৃণাং পিতৃণাং
ন কিঙ্করো নায়মৃণী চ রাজন্‌।
সর্বত্মানা যঃ শরণং শরণ্যং
গতো মুকুন্দং পরিহৃত্য কর্তম্‌।।
“যিনি শ্রীকৃষ্ণ বা মুকুন্দের চরণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, অন্যান্য সমস্ত কর্তব্যকর্ম পরিত্যাগ করলেও তিনি দেবতা, ঋষি, জনসাধারণ, আত্মীয়স্বজন বা প্রিতৃপুরুষ, কারও কাছেই ঋণী নন।”(ভাঃ ১১/৫/৪১) কোন রকম ফলাফলের বিচার না করে শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মনিবেদন করাটাই যে মানব-জীবনের পরম কর্তব্য, সেই কথা ভগবান সংক্ষেপে অর্জুনকে জানিয়ে দিলেন। এই শ্লোকে অর্জুনের প্রতি এটিই পরোক্ষ ইঙ্গিত এবং পরবর্তী শ্লোকে ভগবান এই বিষয়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করবেন।।

এষা তেহবিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু ।
বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি ॥৩৯॥

অর্থ- হে পার্থ ! আমি তোমাকে সাংখ্য-যোগের কথা বললাম ৷ এখন ভক্তিযোগ সম্বন্ধিনী বুদ্ধির কথা শ্রবণ কর, যার দ্বারা তুমি কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে।

আলোচনাঃ- নিরুক্তি বা বৈদিক অভিধান অনুযায়ী সংখ্যা কথাটির অর্থ হচ্ছে, যা কোন কিছুর বিশদ বিবরণ দেয় এবং সাংখ্য বলতে সেই দর্শনকে বোঝায় যা আত্মার স্বরূপ বর্ণনা করে। আর 'যোগ' হচ্ছে ইন্দ্রয়গুলিকে দমন করার পন্থা।অর্জুনের যুদ্ধ না করার কারণ ছিল ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের ইচ্ছা। তাঁর পরম কর্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে অর্জুন যুদ্ধ করতে নারাজ হলেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন, ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান এবং অনান্য আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে রাজ্যসুখ ভোগ করার চাইতে অহিংসার পথ অবলম্বন করা অধিকতর সুখদায়ক হবে। উভয় ক্ষেত্রেই অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের ইচ্ছা। আত্মীয়-স্বজনদের পরাজিত করে রাজ্যসুখ ভোগ করা এবং তাদের জীবিত দেখে তাদের সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা, এই দুই ক্ষেত্রেই ইন্দ্রিয়ের সুখভোগই হচ্ছে একমাত্র কারণ। এভাবেই অর্জুন তাঁর জ্ঞান ও কর্তব্য বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে এই চিন্তাধারা অবলম্বন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাই অর্জুনকে বুঝাতে চেয়েছিলেন, তাঁর পিতামহকে হত্যা করলেও, তিনি তাঁর পিতামহের আত্মাকে কখনই বিনাশ করতে পারবেন না, কারণ প্রতিটি জীব এবং ভগবান সনাতন ও স্বতন্ত্র। পূর্বেও এরা সকলেই এদের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে বর্তমান ছিল, বর্তমানেও এরা আছে এবং ভবিষ্যতেও এরা থাকবে। প্রতিটি স্বতন্ত্র জীবের স্বরূপ হচ্ছে তার চিরশাশ্বত আত্মা। বিভিন্ন সময়ে সে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের দেহ ধারণ করে, যা হচ্ছে পোশাকের মতো। তাই, জড় দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার পরেও জীবের স্বাতন্ত্র্য বর্তমান থাকে।

বুদ্ধিযোগের অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হয়ে ভগবানের সেবা করা। ভগবানের তৃপ্তিসাধন করার জন্য ভগবদ্ভক্ত যখন বুদ্ধিযোগের মাধ্যমে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করেন, সেই কর্তব্যকর্ম যতই কষ্টকর হোক না কেন, ভগবৎ-ভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকার ফলে তিনি তখন অপ্রাকৃত আনন্দে মগ্ন থাকেন। ভগবানের এই সেবার ফলে অনায়াসে অপ্রাকৃত অনুভূতির আস্বাদ পাওয়া যায় এবং ভগবানের কৃপারর ফলে কোন রকম বাহ্যিক প্রচেষ্টা ছাড়াই হৃদয়ে দিব্যজ্ঞানের প্রকাশ হয় এবং এভাবে তিনি মুক্তিলাভ করে পূর্ণতা প্রাপ্ত হন। কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম ও সকাম কর্মের মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ রয়েছে, বিশেষ করে "পারিবারিক ও জাগতিক সুখলাভের নিমিত্ত ইন্দ্রয়-তর্পনের বিষয়ে। তাই বুদ্ধিযোগ হচ্ছে অপ্রাকৃত গুণসম্পন্ন কর্ম, যা আমাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।।



নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে ।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ ॥৪০॥

অর্থ- ভক্তিযোগের অনুশীলন কখনও ব্যর্থ হয় না এবং তার কোনও ক্ষয় নেই। তার সল্প অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠাতাকে সংসাররূপ মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করে। 

আলোচনাঃ- নিজের সুখ-সুবিধার কথা বিবেচনা না করে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম বা শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাই হচ্ছে সবচেয়ে মহৎ কাজ। কেউ যদি একটু একটু করেও ভগবানের সেবা করতে শুরু করে, তাতেও কোন ক্ষতি নেই এবং ভগবানের এই সেবা যত নগণ্যই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই তা বিফলে যায় না। জড়-জাগতিক স্তরে যে কোন কাজকর্ম যতক্ষণ পর্যন্ত সুসম্পন্ন না হচ্ছে, ততক্ষণ তার কোন তাৎপর্যই থাকে না। কিন্তু অপ্রাকৃত কর্ম বা ভগবৎ-সেবা সুসম্পন্ন না হলেও, বিফলে যায় না। তার সুফল চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। ভগবানের সেবা একবার যে শুরু করেছে, তার আর বিপথগামী হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। এক জন্মে যদি তার ভগবদ্ভক্তি সম্পূর্ণ নাও হয়, তবে তার পরের জন্মে সে যেখানে শেষ করেছিল সেখান থেকে আবার শুরু করবে। এভাবেই ভগবদ্ভক্তির ফল চিরস্থায়ী থাকে বলে ক্রমান্বয়ে জীবকে মায়ামুক্ত করে। শ্রীমদ্ভাগবতে অজামিলের কাহিনীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, খানিকটা ভগবদ্ভক্তি সাধন করে, অধঃপতিত হওয়া সত্ত্বেও সে ভগবানের অহৈতুকী কৃপা লাভ করে উদ্ধার পেয়ে যায়। এই সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৫/১৭) একটি সুন্দর শ্লোক আছে -
ত্যক্ত্বা স্বধর্মং চরণাম্বুজং হরে-
র্ভজন্নপক্বোহথ পতেত্ততো যদি ।
যত্র ক্ব বাভদ্রমভুদমুষ্য কিং
কো বার্থ আপ্তোহভজতাং স্বধর্মতঃ ।।
“যদি কেউ তার স্বীয় কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করে ভগবানের শ্রীচরণাম্বুজের সেবা করে এবং সেই ভগবৎ-সেবা সম্পূর্ণ না করে অধঃপতিত হয়, তাতে ক্ষতি কি? আর যদি কেউ জড়-জাগতিক সমস্ত কর্তব্যকর্ম সুসম্পন্ন করে তাতে তার কি লাভ?” কিংবা, যেমন খ্রিষ্টধর্মীরা বলে থাকেন, “কোনও মানষ সমগ্র পৃথিবী লাভ করেও যদি তার শাশ্বত আত্মাকেই হারিয়ে ফেলে, তবে তার কি লাভ?”

জড় দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে সব রকম জড় জাগতবিক প্রচেষ্টা এবং সেই সমস্ত প্রচেষ্টালব্ধ ফল, সব কিছুরই বিনাশ ঘটে। কিন্তু ভগবানের সেবায় মানুষ যে সব কাজকর্ম করে, তার ফলে সে আবার আরও ভালভাবে ভগবানের সেবা করবার সুযোগ পায়, এমন কি দেহের বিনাশ হলেও। ভগবানের সেবাকার্য সম্পূর্ণ না করে যদি কেউ দেহত্যাগ করে, তবে পরজন্মে সে আবার মনুষ্যজন্ম লাভ করে। সৎ ব্রাহ্মণ অথবা প্রতিপত্তিশালী সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম লাভ করে সে আবার তার অসম্পূর্ণ ভগবদ্ভক্তিকে সম্পূর্ণ করে ভগবানের কাছে ফিরে যাবার সুযোগ পায়। কৃষ্ণভাবনাময় কর্মে আত্মনিয়োগ করার এই হচ্ছে অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য।




ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন ।
বহুশাখা হ্যনন্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্ ॥৪১॥

অর্থ- যারা এই পথ অবলম্বন করেছে তাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একনিষ্ঠ। হে কুরুনন্দন, অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিদের বুদ্ধি বহু শাখাবিশিষ্ট ও বহুমুখী। 

আলোচনাঃ- কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত নিঃশঙ্কচিত্তে বিশ্বাস করেন যে, ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করলে, ভগবান তাঁকে এই জড় জগতের বন্ধনমুক্ত করে ভগবৎ-ধামে তাঁর নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। এই বিশ্বাসকে বলা হয় ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি। শ্রীচৈতন্যচরিতমৃতে (মধ্য ২২/৬২) বলা হয়েছে-
'শ্রদ্ধা'-শব্দে-বিশ্বাস কহে সুদৃঢ় নিশ্চয় ।
কৃষ্ণে ভক্তি কৈলে সর্বকর্ম কৃত হয় ।।

বিশ্বাস মানে কোনও সুমহান বিষয়ে অবিচল আস্থা। সাধারণ অবস্থায় মানুষের নানা রকম দায়-দায়িত্ব থাকে। তার পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে, দেশের কাছে, তার কোন না কোন রকম কর্তব্য থাকে। এভাবে মনুষ্য-সমাজ সকলের কাছ থেকেই কোন না কোন রকম কর্তব্য দাবি করে থাকে। আর মানুষও তার পূর্বকৃত ভাল-মন্দ কর্মের ফল অনুসারে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। কিন্তু যখন মানুষ ভগবৎ-সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে, তখন আর তাকে সৎ কর্ম করে শুভ ফল লাভের প্রত্যাশী হতে হয় না, অথবা অসৎ কর্ম করে তার অশুভ ফল ভোগ করার ভয়ে ভীত হতে হয় না। কারণ, ভগবৎ-সেবা হচ্ছে অপ্রাকৃত কর্ম, তা ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভ, এই সব দ্বন্দ্বের অতীত।
ভক্তিযোগের সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হলে জড় জগতের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক থাকে না - একেই বলে বৈরাগ্য। ভগবদ্ভক্তির বিকাশ হতে থাকলে, ভগবানের কৃপার ফলেই এক সময় এই স্তরে উপনীত হওয়া যায়।

কৃষ্ণভাবনায় কোন ব্যক্তির নিশ্চয়াত্মিকা কৃষ্ণভক্তির ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞান। পরম তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করার পরই ভক্ত ভগবানের চরণে নিজেকে সমর্পণ করেন। বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ - একজন কৃষ্ণভাবনাময় ব্যক্তি দুর্লভ মহাত্মা এবং তিনি জ্ঞানের মাধ্যমে বুঝতে পারেন, বাসুদেব বা শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্ব কারণের মূল। কারণ, তিনিই হচ্ছেন সমস্ত কিছুর উৎস। গাছের গোড়ায় জল দিলে যেমন সারা গাছকেই জল দেওয়া হয়, তেমনই, সব কিছুর উৎস ভগবানের সেবা করলে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সমাজ, জাতি আদি সকলেরই সেবা করা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদি তুষ্ট হন, তা হলে সকলেই সন্তুষ্ট হবেন। 
সদগুরুর সুদক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং তাঁর নির্দেশ অনুসারে ভক্তিযোগের অনুশীলন করাই হচ্ছে মানব-জীবনের পরম কর্তব্যকর্ম। সদগুরু হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সুযোগ্য প্রতিনিধি। তিনি তাঁর শিষ্যের মনোভাব বুঝতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী তিনি তাকে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেন। তাই, সুষ্ঠুভাবে ভক্তিযোগ সাধন করতে হলে ভগবানের প্রতিনিধি গুরুদেবের নির্দেশ শিরোধার্য করে এবং তাঁর আদেশকে জীবনের একমাত্র কর্তব্য বলে মনে করে তা পালন করতে হবে।




যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতি বাদিনঃ ॥৪২॥
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্ ।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি ॥৪৩॥

অর্থ- বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ, উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদি সকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই। 

আলোচনাঃ- সাধারণত মানুষ অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন এবং তাদের মূর্খতার ফলে তারা বেদের কর্মকাণ্ডে বর্ণিত সকাম কর্মের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ভোগ ও ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ স্বর্গলোকে গিয়ে ইন্দ্রিয়ের চরম তৃপ্তিসাধন করাই হচ্ছে তাদের পরম কাম্য। বেদে স্বর্গলোকে যাবার জন্য নানা রকম যজ্ঞের বিধান দেওয়া আছে, তার মধ্যে 'জ্যোতিষ্টোম' যজ্ঞ বিশেষভাবে ফলপ্রদ। বাস্তবিকই যে মানুষ স্বর্গলোকে যেতে চায়, তার পক্ষে এই সমস্ত যজ্ঞগুলি সম্পাদন করা অবশ্য কর্তব্য। তাই অল্পবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুসষেরা মনে করে, এটিই হচ্ছে বৈদিক জ্ঞানের চরম শিক্ষা। এই প্রকার অনভিজ্ঞ লোকেদের পক্ষে একাগ্রচিত্তে ভগবদ্ভক্তি সাধন করা সম্ভবপর হয় না। মূর্খ যেমন বিষ-বৃক্ষের ফল দেখে লালায়িত হয়, তেমনই অপরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা স্বর্গলোকের ঐশ্বর্যের দ্বারা প্রলোভিত হয়ে তা ভোগ করবার বাসনায় লালায়িত হয়।

বেদের কর্মকাণ্ডে উল্লেখ আছে- অপাম সোমমমৃতা অভূম। এ ছাড়া আরও উল্লেখ আছে- অক্ষয্যং হ বৈ চাতুর্মাস্যযাজিনঃ সুকৃতং ভবতি। এর মানে, চাতুর্মাস্য ব্রত পালন করলে মানুষ স্বর্গলোকে গিয়ে সোমরস পান করে অমরত্ব লাভ করে এবং চিরকালের জন্য সুখী হতে পারে। এমন কি এই পৃথিবীতেও বহু লোক আছে, যারা সোমরস পান করার জন্য নিতান্ত উৎসুক। কারণ, সোমরস পান করে বল ও বীর্য বর্ধন করে কিভাবে আরও বেশী করে ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগ করতে পারবে, সেটিই তাদের একমাত্র কাম্য। এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এরা ভগবানের কাছে ফিরে যেতে চায় না। এদের সীমিত বুদ্ধিতে এরা উপলব্ধি করতে পারে না যে, ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়ার যে আনন্দ, তার তুলনায় স্বর্গসুখ নিতান্তই তুচ্ছ। তাই, তারা আড়ম্বরপূর্ণ বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হয়। এই ধরণের লোকেরা অত্যন্ত ইন্দ্রিয়-পরায়ণ, তাই তারা ইন্দ্রিয়-সুখের চরম স্তর স্বর্গলোকের অতীত যে আর কিছু থাকতে পারে, তা বুঝতে পারে না। মনে করে, স্বর্গের নন্দন-কাননে সোমরস পান করে অপরূপ রূপসী অপ্সরাদের সঙ্গ করে ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগই হচ্ছে চরম প্রাপ্তি। এই প্রকার দৈহিক সুখ নিঃসন্দেহে ইন্দ্রিয়জাত, তাই যারা এই প্রকার জাগতিক অস্থায়ী সুখের প্রতি আসক্ত, তারা নিজেদেরকে পার্থিব জগতের প্রভু বলে মনে করে।





ভোগৈশ্বর্যপ্রশক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে ॥৪৪॥

অর্থ- যারা ভোগ ও ঐশ্বর্যসুখে একান্ত আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মূঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধি সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয় না। 

আলোচনাঃ চিত্ত যখন একাগ্র হয়,তখন তাকে বলা হয় সমাধি। বৈদিক অভিধান নিরুক্তিতে বলা হয়েছে, “সম্যগাধীয়তেহস্মিন্নাত্মতত্ত্বযাথাত্ম্যম্”- “মন যখন আত্মাকে উপলব্ধি করার জন্য একাগ্র হয়,তখন তাকে বলে সমাধি”। যে মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ উপলব্ধি করতে উৎসুক এবং যারা অনিত্য জড় জগতের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন,তাদের পক্ষে একাগ্রচিত্তে আত্ম-উপলব্ধি বা সমাধি লাভ করা অসম্ভব। মায়া তাদের এত গভীরভাবে বেঁধে রেখেছে যে,তাদের পক্ষে সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া দুস্কর ।




ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন ।
নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্ ॥৪৫॥

অর্থ- বেদে প্রধানত জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণ সম্বন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে। হে অর্জুন ! তুমি সেই গুণগুলিকে অতিক্রম করে নির্গুণস্তরে অধিষ্ঠিত হও। সমস্ত দন্দ্ব থেকে মুক্ত হও এবং লাভ-ক্ষতি ও আত্মরক্ষার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে অধ্যাত্ম চেতনায় অধিষ্ঠিত হও। 

আলোচনাঃ- জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের প্রভাবে জড় জগতের প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই প্রতিক্রিয়া বা কর্মফল জীবকে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। বেদ সাধারণত সকাম কর্ম করার শিক্ষা দান করে, যার ফলে সাধারণ মানুষ জড় সুখ উপভোগ ও জড় ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধনের স্তর থেকে ক্রমশ আধোক্ষজ স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে। ভগবান তাঁর প্রিয় সখা ও প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন, বেদান্ত দর্শনের মর্ম উপলব্ধি করে পরা প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হতে। এই বেদান্ত দর্শনের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে- ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা, অর্থাৎ পরব্রহ্মের অনুসন্ধান করা। জড় জগতে প্রতিটি জীবই বেঁচে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম করছে। এই সমস্ত মায়াবদ্ধ জীবকে উদ্ধার করার জন্য ভগবান সৃষ্টির আদিতে বৈদিক জ্ঞান দান করেন, যাতে তারা বুঝতে পারে, কি রকম জীবনযাপন জিরিকে তারা এই জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তাদের প্রকৃত আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারবে। বেদের কর্মকাণ্ড নামক অধ্যায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিভাবে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে জাগতিক কামন-বাসনার তৃপ্তিসাধন করা যায়। এভাবে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি জনিত নানা রকম সুখভোগ করার পর জীব যখন বুঝতে পারে, জড় জগতের সমস্ত সুখই অনিত্য ও নিরর্থক, তখন তার মন পারমার্থিক তত্ত্ব অনুসন্ধানে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে। তাই বেদে কর্মকাণ্ডের পর উপনিষদে ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন উপনিষদগুলি হচ্ছে বিভিন্ন বেদের মর্মার্থ, যেমন গীতোপনিষদ বা ভগবদ্‌গীতা হচ্ছে পঞ্চম বেদ মহাভারতের সারাংশ। এই উপনিষদ্গুলির মাধ্যমে মানুষের পারমার্থিক জীবন শুরু হয়।

যতক্ষণ আমাদের জড় দেহ আছে, ততক্ষণ প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের প্রভাবে আমাদের কর্ম করতে হয় এবং তার ফল ভোগ করতে হয়। এটিই হচ্ছে কর্মবন্ধন। কিন্তু অপ্রাকৃত জগতে উত্তীর্ণ হাতে হলে এই যে সুখ-দুঃখ, শীতঁ-উষ্ণের দ্বন্দ্বভাব, তাতে অবিচলিত থেকে তার প্রভাবমুক্ত হতে হয় এবং তখন আর লাভ-ক্ষতির বিচারবোধ থাকে না। মন তখন আর অনুশোচনা ও অহঙ্কার দ্বারা বিমোহিত হয় না। এভাবেই জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে জীব যখন ভগবানের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে, তখনই সে পরা প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে তার সৎ, চিৎ ও আনন্দময় স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারে।




যাবানর্থ উদপানে সর্বতঃ সংপ্লুতোদকে ।
তাবান্ সর্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ ॥৪৬॥

অর্থ- ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে সমস্ত প্রয়োজন সাধিত হয়, সেগুলি বৃহৎ জলাশয় থেকে আপনা থেকেই সাধিত হয়ে যায়। তেমনই, ভগবানের উপাসনার মাধ্যমে যিনি পরব্রহ্মের জ্ঞান লাভ করে সব কিছুর উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেছেন, তাঁর কাছে সমস্ত বেদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। 

আলোচনাঃ- বেদের কর্মকাণ্ডে যে-সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ও যাগ-যজ্ঞের বিধান দেওয়া আছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবকে ক্রমশ আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে উৎসাহিত করা। ভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের পঞ্চদশ শ্লোকে (১৫/১৫) স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, বেদ অধ্যয়ন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্ব কারণের কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। এভাবে আমরা দেখতে পাই, আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার অর্থ হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে আমাদের নিত্য সম্পর্ক উপলব্ধি করা। ভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের সপ্তম শ্লোকে (১৫/৭) ভগবানের সঙ্গে জীবের সম্পর্কের ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, জীব হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ; তাই, জীবের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের সেবা করা তার অন্তরের শাশ্বত কৃষ্ণভাবনা জাগিয়ে তোলা। এটিই হচ্ছে বৈদিক জ্ঞানের চরম সত্য।

শ্রীমদ্ভাগবতে (৩/৩৩/৭) তার সমর্থনে বলা হয়েছে -
"হে ভগবান্, নিরন্তর যিনি আপনার নাম কীর্তন করেন, তিনি যদি চণ্ডালের মতো নীচকূলেও জন্মগ্রহণ করেন, তবুও তিনি অধ্যাত্ম-মার্গের অতি উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত। 
এই প্রকার মানুষ বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে বহু তপশ্চর্যা করেছেন এবং সমস্ত পুণ্যতীর্থে বহু স্নান করে তিনি বহুবার বেদ অধ্যয়ন করেছেন। এমন মানুষকে আর্যকুলে শ্রেষ্ঠ বলেই বিবেচনা করা হয়।"
সুতরাং বেদ থেকে আমরা বুঝতে পারি, যাগ-যজ্ঞ ও আচার-অনুষ্ঠান করে স্বর্গলোকে উন্নততর ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার শিক্ষা বৈদিক শাস্ত্র আমাদের দিচ্ছে না। বৈদিক শাস্ত্রের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি লাভ করা। বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশিত বিভিন্ন যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা, সমস্ত বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুশীলন করা এই যুগের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সমস্ত করার জন্য যে শক্তি, জ্ঞান, ঐষ্বর্য ও নিষ্ঠার প্রয়োজন, তা এই যুগের মানুষের নেই। 

তাই,শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই কলিযুগের অধঃপতিত মানুষদের উদ্ধার করার জন্য ভগবানের দিব্য নামের সংকীর্তন করার পথ প্রদর্শন করে গেছেন। মহাপণ্ডিত প্রকাশানন্দ সরস্বতী যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে জিজ্ঞেস করেন, যদিও তাঁকে সাক্ষাৎ নারায়ণ বলে মনে হয়, তবু বেদান্ত দর্শন পাঠ না করে তিনি কেন ভাবুকের মতো ভগবানের নাম কীর্তন করছেন। এর উত্তরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন, তাঁর গুরুদেব বুঝতে পারেন যে, তিনি অত্যন্ত মূর্খ, তাই তিনি তাঁকে শাসন করে উপদেশ দিলেন যে, বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়নে তাঁর অধিকার নেই। এই বলে তিনি তাঁকে কৃষ্ণমন্ত্র জপ করার নির্দেশ দিলেন। এই নাম জপ করতে করতে তিনি ভগবদ্ভক্তির ভাবে উন্মাদ হয়ে উঠলেন। এই কলিযুগে অধিকাংশ মানুষই মূর্খ। বেদান্ত দর্শন বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের নেই, তাই ভগবান বেদান্ত দর্শনের সারমর্ম ভগবদ্ভক্তির বার্তা বহন করে এনে, এই ভক্তি লাভ করার পথ প্রদর্শন করে গেলেন। নিষ্কলুষ চিত্তে নিরপরাধে ভগবানের নাম জপ করার মাধ্যমে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার আশীর্বাদ দিয়ে গেলেন। বৈদিক জ্ঞানের শেষ কথা হচ্ছে বেদান্ত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বেদান্ত দর্শনের প্রবক্তা। যে মহাত্মা নিরন্তর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন করে অসীম আনন্দ উপভোগ করেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত বেদান্ত-তত্ত্ববেত্তা। কারণ, সেটিই হচ্ছে বৈদিক অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের চরম উদ্দেশ্য।




কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি ॥৪৭॥

অর্থ- সধর্ম বিহিত কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু কোন কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। কখনও নিজেকে কর্মফলের হেতু মনে করো না, এবং কখনও স্বধর্ম আচরণ না করার প্রতিও আসক্ত হয়ো না। 

আলোচনাঃ- এখানে আমাদের তিনটি জিনিস সম্বন্ধে বিবেচনা করতে হবে- 
(১) কর্তব্যকর্ম, 
(২) খেয়ালখুশি মতো কর্ম এবং 
(৩) নৈষ্কর্ম্য। 

 👎কর্তব্যকর্ম হচ্ছে প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা বদ্ধ অবস্থায় জাগতিক কর্ম। 
 👎খেয়ালখুশি মতো কর্ম হচ্ছে শাস্ত্র অথবা গুরুদেবের অনুমোদন ব্যতীত কর্ম এবং 
 👎কর্তব্যকর্ম সম্পাদন না করাকে বলা হয় নৈষ্কর্ম্য।

ভগবান অর্জুনকে নিষ্কর্মা না হতে উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্যকর্ম করে যেতে। কারণ, মানুষ যখন তার কর্মফলের প্রত্যাশা করে, তখন সে কার্য-কারণে জড়িত হয়ে জড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এভাবেই সে কর্মের ফলস্বরূপ সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করে।

কর্তব্যকর্মকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- 
 👎বিধিবদ্ধ কর্ম, 
 👎সঙ্কটকালীন কর্ম ও 
 👎আকাঙ্ক্ষিত কর্ম। 

কোনও রকম ফলের প্রত্যাশা না করে শাস্ত্রের অনুশাসন অনুসারে বিধিবদ্ধ কর্তব্যকর্ম হচ্ছে সত্ত্বগুণের কর্ম। 
ফলের প্রত্যাশা করে যে কর্ম করা হয়, তা সত্ত্ব, রজ অথবা তম, যে গুণের প্রভাবেই করা হোক না কেন, তা অশুভ। কারণ, ফলের প্রত্যাশা করা মানেই কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। কর্তব্যকর্ম সকলকেই করতে হয়, কিন্তু কোন রকম ফলের প্রত্যাশা না করে নিরাসক্তভাবে সেই কর্ম করতে হয়; এই প্রকার ফলের আশাহীন কর্তব্যকর্ম নিঃসন্দেহে মুক্তির পথে চালিত করে। ভগবান তাই অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ফলাফল না ভেবে নিরাসক্ত ভাবে যুদ্ধ করে তাঁর কর্তব্যকর্ম করে যেতে। তাঁর যুদ্ধে যোগ না দেওয়াও ছিল অন্য এক প্রকারের আসক্তি। এই প্রকার আসক্তি কাউকে মুক্তির পথে চালিত করে না। হ্যাঁ বাচক অথবা না বাচক, যে-কোন প্রকার আসক্তিই বন্ধনের কারণ। কর্তব্যকর্ম থেকে নিষ্কর্মার মতো বিরত থাকা পাপ, তাই কর্তব্যবোধে যুদ্ধ করাই ছিল অর্জুনের পক্ষে মুক্তির একমাত্র শুভ পথ।




যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয় ।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে ॥৪৮॥

অর্থ- হে অর্জুন ! ফলভোগের কামনা পরিত্যাগ করে ভক্তিযোগস্থ হয়ে স্বধর্ম-বিহিত কর্ম আচরণ কর। কর্মের সিদ্ধি ও অসিদ্ধি সম্বন্ধে যে সমবুদ্ধি, তাকেই যোগ বলা হয়। 

আলোচনাঃ- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যোগে যুক্ত হয়ে কর্ম করার নির্দেশ দিচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যোগ বলতে কি বোঝায়? যোগের অর্থ হচ্ছে, সদা চিত্তচাঞ্চল্যকারী ইন্দ্রিয়াদি সংযম করে একাগ্রচিত্তে পরমেশ্বরের ধ্যান করা। পরমেশ্বর কে? সর্ব কারণের কারণ পরমেশ্বর হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এখানে যেহেতু তিনি নিজেই অর্জুনকে যুদ্ধ করতে আদেশ করছেন, সুতরাং সেই যুদ্ধের ফলাফলের প্রতি তাঁর আসক্ত হওয়া উচিত নয়। আর তার লাভ অথবা জয় নির্ভর করছে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছার উপর।

অর্জুনের কর্তব্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে যুদ্ধ করা। ভগবানের আদেশ পালন করাই হচ্ছে প্রকৃত যোগ এবং কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে এই যোগের অনুশীলন করা হয়। ভগবদ্ভক্তির প্রভাবেই কেবল অহঙ্কারমুক্ত হওয়া সম্ভব। ভগবানের দাসত্ব বা ভগবানের দাসের দাসত্ব বরণ করার ফলে অন্তরে ভগবদ্ভক্তির বিকাশ হয় এবং তখন বিজিতেন্দ্রিয় হয়ে যোগের সাধন করা সম্ভব হয়। অর্জুন ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং সেই হেতু শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে তিনি বর্ণাশ্রম-ধর্মের আচরণ করতেন। বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, বর্ণাশ্রম-ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীবিষ্ণুকে তুষ্ট করা। জড় জগতের নীতি হচ্ছে যে, কারওই নিজেকে সন্তুষ্ট করা উচিত নয়, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করা উচিত। তাই কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট না করে, তবে সে বর্ণাশ্রম-ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করতে পারে না। এভাবে ভগবান অর্জুনকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তাঁর নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাই হচ্ছে তাঁর একমাত্র কর্তব্য।




দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয় ।
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ ॥৪৯॥

অর্থ- হে ধনঞ্জয় ! বুদ্ধিযোগ দ্বারা ভক্তির অনুশীলন করে সকাম কর্ম থেকে দূরে থাক এবং সেই চেতনায় অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবানের শরণাগত হও ৷ যারা তাদের কর্মের ফল ভোগ করতে চায়, তারা কৃপণ। 

আলোচনাঃ- যে মানুষ বুঝতে পেরেছেন, তিনি ভগবানের নিত্যদাস, তিনি তখন তাঁর সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে ভক্তি সহকারে ভগবৎ-সেবায় ব্রতী হন। পূর্বে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে যে, বুদ্ধিযোগ হচ্ছে ভগবানের অপ্রাকৃত সেবা। এই সেবাই হচ্ছে সমস্ত জীবের যথার্থ কর্তব্যকর্ম। একমাত্র কৃপণেরাই তাদের স্বকর্মফল ভোগের বাসনা করে, ফলে তারা পুনরায় জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ভক্তিযুক্ত কর্ম ছাড়া আর সমস্ত কাজকর্মই ঘৃণ্য, কারণ সেই সমস্ত কাজকর্ম মানুষকে নিরন্তর জন্ম ও মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত করে। তাই কখনই কর্মফলের প্রত্যাশা করা উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করার জন্য কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে সমস্ত প্রকার কাজকর্ম করা উচিত। বহু কষ্ট স্বীকার করে অথবা অসীম সৌভাগ্যের ফলে অর্জিত সম্পদ কিভাবে ব্যয় করতে হয়, কৃপণ তা জানে না। সকলেরই উচিত, কৃষ্ণভাবনাময় কাজকর্মে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করা। তাতেই জীবনের সার্থকতা আসবে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত হতভাগ্য মানুষেরা এই অমূল্য সম্পদ পাওয়া সত্ত্বেও ভগবানের সেবায় ব্রতী না হয়ে, কৃপণের মতো এই অমূল্য সম্পদের অপচয় করে।




বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে ।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্ ॥৫০॥

অর্থ- যিনি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করেন, তিনি এই জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় থেকেই মুক্ত হন। অতএব, তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর৷ সেটিই হচ্ছে সর্বাঙ্গীণ কর্মকৌশল। 

আলোচনাঃ- স্মরণাতীত কাল ধরে প্রতিটি জীব তার শুভ ও অশুভ কর্মের ফল সঞ্চয় করছে। এই কর্মফলের জন্যই সে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হচ্ছে এবং জড়-জাগতিক ক্লেশের দ্বারা জর্জরিত হচ্ছে । অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলেই জীব তার স্বরূপ ভুলে গেছে । এই দুঃখদায়ক অবস্থা থেকে নিস্কৃতি পাবার উপায় হচেছ, গীতায় নির্দেশিত ভগবানের উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করে তার সেবায় নিজেকে সম্পূর্নভাবে উৎসর্গ করা । তা হলে আমাদের অজ্ঞতার আবরণ উন্মোচিত হবে এবং জন্ম-জন্মান্তরে কর্ম ও কর্মফলের প্রক্রিয়াকে পরিশুদ্ধ করে তোলার পন্থাস্বরূপ কৃষ্ণভাবনাময় কর্মে নিযুক্ত থাকেতে অর্জুনকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ।




কর্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ ।
জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্॥৫১॥

অর্থ- মনীষিগণ ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়ে কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হন। এভাবে তাঁরা সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার অতীত অবস্থা লাভ করেন।

আলোচনাঃ- জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা যেখানে নেই, মুক্ত পুরুষেরা সেখানেই অবস্থান করেন।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১৪/৫৮) বলা হয়েছে -

সমাশ্রিতা যে পদপল্লবং
মহৎপদং পুণ্যযশো মুরারেঃ।
ভবাম্বুধর্বৎসপদং পরং পদং
পদং পদং যদ্ বিপদাং ন তেষাম্ ।।

"পরমেশ্বর ভগবান, যিনি সব কিছুর আশ্রয় এবং যিনি মুক্তিদাতা মুকুন্দ নামে খ্যাত, তাঁর পদপল্লবরূপ তরণীর আশ্রয় যিনি গ্রহণ করেছেন, তিনি অনায়সে এই ভবসমুদ্র উত্তীর্ণ হন। তাঁর কাছে এই ভবসমুদ্র গোষ্পদতুল্য। পরং পদ বা যেখানে জড়-জাগতিক ক্লেশ নেই, অর্থাৎ বৈকুণ্ঠ হচ্ছে তাঁর গন্তব্যস্থল। যে জগতে প্রতি পদক্ষেপে বিপদ, সেখানে তিনি আবদ্ধ থাকতে চান না।"

আমাদের অজ্ঞতার জন্য আমরা বুঝতে পারি না যে, এই জড় জগতে প্রতি পদক্ষেপে দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। এখানে প্রতি পদক্ষেপেই বিপদ। কিন্তু অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা মনে করে, নানা রকম জাগতিক প্রচেষ্টার দ্বারা প্রকৃতির প্রতিকুলতার নিরসন করে তারা সুখী হবে। তারা জানে না, এই জড় জগতে কোন জীবই জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি আদি ক্লেশের থেকে রেহাই পেতে পারে না। কিন্তু যে মানুষ তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে বুঝতে পেরেছেন যে, তিনি ভগবানের নিত্যদাস, তিনি তখন ভক্তিযোগের পথ অবলম্বন করে ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার ফলে তিনি বৈকুণ্ঠলোকে উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করেন, যেখানে জড়-জাগতিক ক্লেশ এবং মৃত্যু ও কালের প্রভাব নেই। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভগবানের মহিমান্বিত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি। ভ্রান্তিবশত যে মানুষ মনে করে, ভগবান ও সে একই স্তরে অবস্থিত, অর্থাৎ যে মানুষ মনে করে, সে-ই ভগবান, তার পক্ষে ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করা কখনই সম্ভব নয়। অহঙ্কারের দ্বারা বিমূঢ় হয়ে সে নিজেকে সর্বকারনের কারণ বলে মনে করে জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে আরও গভীরভাবে নিমজ্জিত হয়। ভক্তিযুক্ত ভগবৎ-সেবা ছাড়া আর কোন উপায়েই জড় বন্ধন মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। এই ভগবৎ-সেবাকে বলা হয় কর্মযোগ বা বুদ্ধিযোগ, অথবা সরল ভাষায় একে বলা হয় ভক্তিযোগ।




যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি ।
তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ ॥৫২॥

অর্থ- এভাবে পরমেশ্বর ভগবানে অর্পিত নিষ্কাম কর্ম অভ্যাস করতে করতে য্খন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গভীর অরণ্যকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে, তখন তুমি যা কিছু শুনেছ এবং যা কিছু শ্রবণীয়, সেই সবের প্রতি সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ হতে পারবে। 

আলোচনাঃ- ভগবানের মহান ভক্তদের অনেক সুন্দর দৃষ্টান্ত আছে, যাঁরা কেবলমাত্র ভগদ্ভক্তি গ্রহণ করার ফলে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি উদাসীন হয়ে ওঠেন। যখন কোনও ব্যক্তি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে চিরশাশ্বত সম্পর্ক সম্বন্ধে অবগত হয়, সে স্বাভাবিক ভাবেই বৈদিক কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানের প্রতি সম্পূর্ণরূপে উদাসীন হয়, এমন কি সে যদি অভিজ্ঞ প্রাহ্মণও হয়।

মহাভাগবত ও গুরুপরম্পরা ধারায় আচার্য শ্রীমাধবেন্দ্রপুরী বলেছেন-

সন্ধ্যাবন্দন ভদ্রমস্তু ভবতো ভোঃ স্নান তুভ্যং নমো
ভো দেবাঃ পিতরশ্চ তর্পণবিধৌ নাহং ক্ষমঃ ক্ষম্যতাম্ ।
যত্র কাপি নিষদ্য যাদবকুলোত্তমস্য কংসদ্বিষঃ
স্মারং স্মারং অঘং হরামি তদলং মন্যে কিমন্যেন মে ।।

"হে ভগবান! ত্রিসন্ধ্যায় আমি তোমাকে বন্দনা করি, তোমার জয় হোক। হে দেবতাগণ! স্নানাতে আমি আর তোমাদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে পারি না। আমার এই অক্ষমতা তোমরা ক্ষমা করো। এখন আমি যেখানেই অবস্থান করি না কেন, আমি যদুকুলশ্রেষ্ঠ কংসারি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারি এবং তার ফলে আমি সমস্ত পাপবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি। আমার মনে হয়, এটিই আমার পক্ষে যথেষ্ট।" পারমার্থিক মার্গে যাঁরা কনিষ্ঠ অধিকারী, তাঁদের পক্ষে বেদের নির্দেশ অনুযায়ী বিবিধ আচার অনুষ্ঠান পালন করা একান্ত প্রয়োজন; যেমন- 
খুব সকালে স্নান করা, 
পিতৃ-পুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা,
ত্রিসন্ধ্যায় মন্ত্র উচ্চারণ করা আদি।

কিন্তু কৃষ্ণগত প্রাণ হয়ে যিনি ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করেন, তাঁকে আর কোন আচার-অনুষ্ঠানের বিধি পালন করতে হয় না, কারণ তিনি ইতিমধ্যেই সমস্ত সাধনার পরম সিদ্ধি লাভ করেছেন। শাস্ত্রে যে-সমস্ত তপশ্চর্যা, যাগযজ্ঞ, বিধি-নিষেধের আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের কৃপা লাভ করে তাঁর পদারবিন্দে সম্পূর্ণভাবে আত্মোৎসর্গ করা। তাই, ভগবানের সেবায় যিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তাঁকে আর সেই সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের শরণ নিতে হয় না। সেই রকম, বেদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি লাভ করা, সেই কথা না জেনে যারা অন্ধের মতো আচার-অনুষ্ঠান আদিতে নিয়োজিত হয়, তারা অনর্থক তাদের সময় নষ্ট করে চলেছে।




শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা ।
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাপ্স্যসি ॥৫৩॥

অর্থ- এভাবে পরমেশ্বর ভগবানে অর্পিত নিষ্কাম কর্ম অভ্যাস করতে করতে য্খন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গভীর অরণ্যকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে, তখন তুমি যা কিছু শুনেছ এবং যা কিছু শ্রবণীয়, সেই সবের প্রতি সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ হতে পারবে। 

আলোচনাঃ- জীব যখন সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদন করে, তখন তার সেই অবস্থাকে বলা হয় সমাধি; যিনি পূর্ণ সমাধিমগ্ন হয়েছেন, তিনি ব্রহ্ম-উপলব্ধি ও পরমাত্মা উপলব্ধির স্তর অতিক্রম করে সর্ব কারণের কারণ পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। অধ্যাত্ম-জ্ঞানের চরম পূর্ণতা হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে জীবের নিত্য দাসত্ব সম্পর্কের উপলব্ধি করা, তাই ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করাই হচ্ছে জীবের একমাত্র কর্তব্য। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করলে ভগবানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং তার ফলে ভগবানের প্রতিটি উপদেশের মর্ম যথাযথভাবে উপলব্ধি করা যায়। শ্রীকৃষ্ণ অথবা তাঁর প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেবের আদেশে ভগবানের সেবা করলে, অচিরেই তার ফল পাওয়া যায় এবং ভগবদ্ভক্তির মাধুর্য আস্বাদন করা যায়।




অর্জুন উবাচ, স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব ।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্ ॥৫৪॥

অর্থ- অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কেশব ! স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অচলাবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের লক্ষণ কি ? তিনি কিভাবে কথা বলেন, কিভাবে অবস্থান করেন এবং কিভাবেই বা তিনি বিচরণ করেন ? 

আলোচনাঃ- বিশেষ অবস্থা অনুযায়ী প্রতিটি মানুষেরই যেমন কোন না কোন লক্ষণ থাকে কৃষ্ণভাবনাময় মানুষেরও সেই রকম চলা, বলা, চিন্তাভাবনায় কতকগুলি প্রকৃতিগত লক্ষণ থাকে। একজন ধনীর কতকগুলি লক্ষণ দেখে যেমন বোঝা যায় সে ধনী, একজন রোগীর কতকগুলি লক্ষণ দেখে যেমন বোঝা যায় সে রোগী, একজন জ্ঞানীর লক্ষণ দেখে যেমন বোঝা যায় সে জ্ঞানী, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত ভাবনায় মগ্ন কোনও ভগবদ্ভক্তের কথা বলবার ধরন, চলার ভঙ্গি, চিন্তাধারা, মনোবৃত্তি আদি দেখে বোঝা যায়, তিনি হচ্ছেন ভগবদ্ভক্ত। ভগবদ্ভক্তের এই সমস্ত লক্ষণের বর্ণনা ভগবদগীতাতে পাওয়া যায়। এই লক্ষণগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তিনি কিভাবে কথা বলেন; কারণ, কথার মধ্যে দিয়েই সবচেয়ে গভীরভাবে মানুষের অন্তরের ভাবের প্রকাশ হয়। প্রবাদ আছে, মূর্খ যতক্ষণ পর্যন্ত তার মুখ না খুলছে, ততক্ষণ তার মূর্খতা প্রকাশ পায় না। বিশেষ করে ভাল পোশাকে সজ্জিত মূর্খ যতক্ষণ তার মুখ না খুলছে, তাকে চেনার উপায় নেই, কিন্তু যখনই সে মুখ খোলে, তখনই তার পরিচয় প্রকাশ পায়।
কৃষ্ণভাবনাময় মানুষের প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে, 
তিনি শ্রীকৃষ্ণ অথবা শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় বিষয় ছাড়া আর কোন কথাই বলেন না। অন্যান্য লক্ষণ তখন স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয় এবং তা নীচে বর্ণিত হয়েছে।




প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান্ ।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে ॥৫৫॥

অর্থ-পরমেশ্বর ভগবান বললেন-- হে পার্থ ! জীব য্খন মানসিক জল্পনা-কল্পনা থেকে উদ্ভূত সমস্ত মনোগত কাম পরিত্যাগ করে এবং তার মন যখন এভাবে পবিত্র হয়ে আত্মাতেই পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে, তখনই তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়। 

আলেচনাঃ- শ্রীমদ্ভাগবতে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ কৃষ্ণভাবনাময় মানুষ অর্থাৎ ভগবদ্ভক্তের মধ্যে মহৎ মুনি-ঋষিদের সমস্ত গুণাবলী পরিলক্ষিত হয়; আর যারা ভগবদ্ভক্ত নয়, তাদের মধ্যে কোন গুণই দেখা যায় না। কারণ, তারা তাদের সীমিত মনের জল্পনা-কল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করে থাকে। সুতরাং, এখানে যথার্থই বলা হয়েছে যে, জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে সৃষ্ট ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের সব রকমের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে হবে। কৃত্রিমভাবে এই ইচ্ছাকে কখনই সংবরণ করা যায় না। কিন্তু মানুষ যখন কৃষ্ণভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত করে, তখন কোন রকম বাহ্যিক প্রচেষ্টা ছাড়া আপনা থেকেই এই সমস্ত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা প্রশমিত হয়।
তাই মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য হচ্ছে দ্বিধাহীনভাবে ভক্তিযোগের পথ অবলম্বন করা, কেন না এই পথ অবলম্বন করার ফলে সে অচিরেই অপ্রাকৃত চেতনায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। যিনি মহাত্মা তিনি জানেন, তিনি হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যকালের দাস এবং এই সত্য উপলব্ধির ফলে তিনি নিত্যানন্দ অনুভব করেন। জড় জগৎকে ভোগ করার তুচ্ছ কোন বাসনাই তখন আর তাঁর থাকে না। তিনি তাঁর প্রকৃত স্বরূপে পরমেশ্বরের নিত্য সেবায় মগ্ন থেকে সদাই সুখে থাকেন।




দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে ॥৫৬॥

অর্থ- ত্রিতাপ দুঃখ উপস্থিত হলেও যাঁর মন উদ্বিগ্ন হয় না, সুখ উপস্থিত হলেও যাঁর স্পৃহা হয় না এবং যিনি রাগ, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত, তিনিই স্থিতধী অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞ। 

আলোচনাঃ- 'মুনি' তাঁকে বলা হয়, যিনি কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে নানা রকম অনুমান করবার জন্য মনকে নানাভাবে আলোড়িত করতে পারেন। তাই বলা হয় যে, 'নানা মুনির নানা মত।' কোন মুনির মত যদি অন্য মুনির থেকে স্বতন্ত্র না হয় তবে তাঁকে যথার্থ মুনি বলা যায় না। নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম্ (মহাভারত, বনপর্ব ৩১৩/১১৭)। কিন্তু ভগবান এখানে বলেছেন, স্থিতধীর্মুনি সাধারণ মুনিদের থেকে ভিন্ন। স্থিতধীর্মুনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন, কেন না তিনি জল্পনা-কল্পনামূলক সমস্ত কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি করেছেন। তাঁকে বলা হয় প্রশান্ত-নিঃশেষ-মনোরথান্তর (স্তোত্ররত্ন, ৪৩), অথবা যিনি জল্পনা-কল্পনার স্তর অতিক্রম করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, বসুদেব-তনয় ভগবান বাসুদেব বা শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সবকিছু (বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ)। তাঁকে বলা হয় মুনি, যাঁর মন একনিষ্ঠ।

এই ধরনের কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত জড় জগতের ত্রিতাপ ক্লেশের দুঃখ-দুর্দশাকে ভগবানের আশীর্বাদ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, তাঁর পূর্বকৃত অসৎ কর্মের ফলস্বরূপ আরও দুঃখ-দুর্দশা তাঁর একমাত্র প্রাপ্য, কিন্তু ভগবানের অহৈতুকী করুণার ফলে তাঁর সেই সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার ভার অনেক লাঘব হয়ে গেছে। তেমনই, যখন তাঁর সুখানুভূতি হয়, তখন তিনি নিজেকে সেই সুখের অযোগ্য বলেই মনে করেন, তিনি ভাবেন, ভগবানের কৃপাতেই তিনি ঐ রকম সুখপ্রদ অবস্থায় রয়েছেন এবং ভগবানের সেবায় তাই আরও বেশি করে আত্মনিয়োগ করতে পারছেন। ভগবানের সেবা করবার জন্য তিনি সব সময়ই সৎসাহসী ও তৎপর এবং কোন রকম আসক্তি বা বিরক্তি তাঁকে সেই সেবা থেকে বিরত করতে পারে না। নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করার আকাঙ্ক্ষাকে বলা হয় আসক্তি এবং এই ধরনের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা না থাকলে বলা হয় বিরক্তি। কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনায় অবিচলিত, তাঁর কোন কিছুর প্রতি আসক্তিও নেই, বিরক্তিও নেই, কেন না ভগবানের সেবায় তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছেন। তাই তাঁর কোন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি ক্রোধান্বিত হন না। সফল হন বা ব্যর্থই হন, তিনি তাঁর সংকল্পে সর্বদাই একনিষ্ঠ।




যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্ ।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ॥৫৭॥

অনুবাদ:- জড় জগতে যিনি সমস্ত জড় বিষয়ে আসক্তি রহিত, যিনি প্রিয় বস্তু লাভে আনন্দিত হন না এবং অপ্রিয় বিষয় উপস্থিত হলে দ্বেষ করেন না, তিনি পুর্ণ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। 

শ্রীল প্রভুপাদকৃত তাৎপর্যঃ জড় জগতে সব সময়ই নানা রকম উত্থান-পতন ঘটে চলেছে, সেগুলি কখনও শুভ বা অশুভ হতে পারে। যিনি এই ধরনের উত্থান-পতনে বিচলিত হন না যিনি ভাল-মন্দে প্রভাবিত হন না, তাঁকেই কৃষ্ণভাবনায় অবিচলিত বলে বিবেচনা করতে হবে। মানুষ জড় জগতে থাকলে সব সময়েই শুভ-অশুভ সম্ভাবনা থাকে, কারণ জড় জগৎটাই এই দ্বন্দ্বভাবের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় একনিষ্ঠ ভক্ত কখনই এই শুভ-অশুভ দ্বন্দ্বের দ্বারা প্রভাবিত হন না, কারণ তিনি সর্বদাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় মগ্ন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এই অনুরাগের ফলে তিনি জড় ইন্দ্রিয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ অপ্রাকৃত অবস্থায় অধিষ্ঠিত হন, যাকে পরিভাষায় বলা হয় 'সমাধি'।




যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ॥৫৮॥

অনুবাদ:- কূর্ম যেমন তার অঙ্গসমূহ তার কঠিন বহিরাবরণের মধ্যে সঙ্কুচিত করে, তেমনই যে ব্যাক্তি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, তাঁর চেতনা চিন্ময় জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত। 

শ্রীল প্রভুপাদকৃত তাৎপর্যঃ আত্ম-তত্ত্বজ্ঞানী, যোগী অথবা ভগবদ্ভক্তের লক্ষণ হচ্ছে, তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তার ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে পারেন। অধিকাংশ মানুষই তাদের ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করে অর্থাৎ তাদের ইন্দ্রিয়ের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। প্রকৃত যোগীকে এভাবে চিনতে পারা যায়। ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষধর সর্পের সঙ্গে তুলনা করা হয়। সাধারণ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি স্বেচ্ছাচারী, উচ্ছৃঙ্খল, কিন্তু সাপুড়ে যেমন সাপকে পোষ মানায়, যোগী বা ভগদ্ভক্ত ঠিক তেমনভাবে তাঁদের ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজের ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত করেন। তিনি তাদের কখনই স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে দেন না।

শাস্ত্রে কর্তব্য-অকর্ত্য, বিধি-নিষেধ সম্বন্ধে নানা রকম নির্দেশ দেওয়া আছে। এই সমস্ত বিধি-নিষেধের নির্দেশগুলি আচরণ করার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত না করতে পারলে, ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে ভগবদ্ভক্তি সাধন করা যায় না। এই সম্বন্ধে এখানে খুব সুন্দরভাবে কূর্মের উদাহরণ দেওয়া আছে কূর্ম যে-কোন সময় তার হাত, পা, মাথা আদি অঙ্গগুলি তার খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিতে পারে, আবার প্রয়োজন হলে তাদের বার করে আনতে পারে। ঠিক তেমনই, কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত ভগবানের বিশেষ প্রয়োজনেই তার ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রয়োগ করেন, আর অন্য সময় তাদের গুটিয়ে রাখেন। এবাবেই ইন্দ্রিয়-দমন করার মাধ্যমে একাগ্রচিত্তে ভগবানের সেবা করা যায়। অর্জুনকে এখানে সেভাবেই নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তিনি নিজের তৃপ্তি-সাধনের জন্য তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে কাজে না লাগিয়ে ভগবানের সেবায় তা নিয়োগ করেন। ভগবানের সেবায় কিভাবে সর্বদা ইন্দ্রিয়াদি নিয়োজিত রাখতে হয়, কূর্মের দৃষ্টান্ত দিয়ে তা বোঝানো হয়েছে। কূর্মের মতো ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।




বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ ।
রসবর্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে ॥৫৯॥

অর্থ- দেহবিশিষ্ট জীব ইন্দ্রিয় সুখ ভোগ থেকে নিবৃত হতে পারে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়। কিন্তু উচ্চতর স্বাধ আস্বাদন করার ফলে তিনি সেই বিষয়তৃষ্ণা থেকে চিরতরে নিবৃত্ত হন। 

আলোচনাঃ- অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত না হলে মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ পরিত্যাগ করতে পারে না। বিধি-নিষেধের দ্বারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হওয়ার পন্থা অনেকটা রোগীর বিশেষ ধরনের খাদ্যের প্রতি নিষেধাজ্ঞার মতো। রোগী সাধারণত এই সমস্ত বিধি-নিষেধ মানতে চায় না এবং তার রোগের জন্য এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য খেতে সাময়িকভাবে বিরত থাকলেও তার খাওয়ার লালসা কোনও অংশে কমে না। তেমনই, যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার ধারণা, ধ্যান আদি সমন্বিত অষ্টাঙ্গ-যোগের মতো কিছু পারমার্থিক পদ্ধতির দ্বারা যে ইন্দ্রিয় সংযম, তা উন্নত জ্ঞানহীন, অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনায় প্রগতি সাধনের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কন্দর্প-কোটি কমনীয় রুপকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তাঁর আর নিষ্প্রাণ জড় বস্তুর প্রতি কোন রকম রুচি থাকে না। তাই, অধ্যাত্ম-মার্গের প্রাথমিক স্তরেই কেবল বিধি-নিষেধের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে হয়, কিন্তু কৃষ্ণভানায় যতক্ষণ রুচি না হয়, ততক্ষণ এই বিধি-নিষেধ মঙ্গলজনক হয়। যখন কেউ প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি আপনা থেকেই ইতর বস্তুর প্রতি তাঁর রুচি হারিয়ে ফেলেন।




যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ ॥৬০॥

অর্থ- হে কৌন্তেয় ! ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান এবং ক্ষোভকারী যে, তারা অতি যত্নশীল বিবেকসম্পন্ন পুরুষের মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে। 

আলোচনাঃ- অনেক ঋষি, মুনি ও অধ্যাত্মবাদী আছেন, যাঁরা ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক সময় তাঁদের সংযমের বাঁধ ভেঙে যায় এবং তাঁরা ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে পড়েন। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের মতো যোগী, যিনি তাঁর মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করবার জন্য গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন, তিনিও স্বর্গের অপ্সরা মেনকার রূপে মুগ্ধ হয়ে কামান্ধ হয়ে অধঃপতিত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই রকম অনেক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর থেকে বোঝা যায়, কৃষ্ণভক্তি ছাড়া মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করা অত্যন্ত কঠিন। মনকে শ্রীকৃষ্ণে নিয়োজিত না করে, কেউই এই প্রকার জাগতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত হতে পারে না। 
একটি কার্যকর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে মহাসাধক ও ভগবদ্ভক্ত শ্রীযামুনাচার্য বলেছেন-
যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে
নবনবরসধামন্যুদ্যতং রন্তুমাসীৎ ।
তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্যমাণে
ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠীবনং চ ।।
"আমার মন এখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের সেবায় নিয়োজিত হয়েছে এবং আমি প্রতিনিয়তই নব নব অপ্রাকৃত রসের আস্বাদন করছি। এখন কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের কথা মনে হলেই আমার মন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে এবং আমি সেই চিন্তার উদ্দেশ্যে থুথু ফেলি।"

কৃষ্ণভক্তি এমনই এক অপ্রাকৃত আনন্দে পরিপূর্ণ যে, এর স্বাদ একবার পেলে জড় সুখভোগের প্রতি আর কোন আকর্ষণ থাকে না। নানা রকম সুস্বাদু খাবার খেয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি হলে যেমন আর আজেবাজে জিনিস খাবার ইচ্ছা থাকে না, তেমনই কৃষ্ণভক্তির স্বাদে পরিতৃপ্ত মন আর কিছুই চায় না। কৃষ্ণভক্তি আস্বাদন করার পর মন আপনা থেকেই শান্ত হযে যায় এবং কোন অবস্থাতেই তা আর বিচলিত হয় না। তাই আমরা দেখতে পাই, মহারাজ অম্বরীষকে বিনাশ করতে উদ্যত হলে, মহা-তেজস্বী মুনি দুর্বাসার প্রাণ বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং অবশেষে তিনি মহারাজ অম্বরীষের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে প্রাণ রক্ষা করেন।




তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ॥৬১॥

অর্থ- যিনি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরূপে সংয্ত করে আমার প্রতি উত্তমা ভক্তিপরায়ণ হয়ে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরূপে বশীভূত করেছেন, তিনিই স্থিতিপ্রজ্ঞ। 

আলোচনাঃ- ভক্তিযোগই যে শ্রেষ্ঠ যোগ তা এখানে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণভক্তি ছাড়া ইন্দ্রিয়কে সংযত করা যায় না। ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মহা-তেজস্বী দুর্বাসা মুনি অকারণে মহারাজ অম্বরীষের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর ইন্দ্রিয়-সংযম হারিয়ে ফেলেছিলেন। পক্ষান্তরে, মহারাজ অম্বরীষ দুর্বাসার মতো শক্তিশালী তপস্বী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। অন্তরে ভগবানের ধ্যানে মগ্ন থেকে তিনি দুর্বাসার সমস্ত অত্যাচার ও অপমান নীরবে সহ্য করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁর জয় হয়েছিল। 
শ্রীমদ্ভাগবতে(৯/৪/১৮-২০) বর্ণিত নিম্নোক্ত গুণাবলীর অধিকারী হবার ফলেই মহারাজ অম্বরীষ তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন-
স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়ো-
র্বাচাংসি বৈকুণ্ঠগুণানুবর্ণনে।
করৌ হরের্মন্দিরমার্জনাদিষু
শ্রুতিং চকারাচ্যুতসৎকথোদয়ে।।
মুকুন্দলিঙ্গালয়দর্শনে দৃশৌ
তদভৃত্যগাত্রস্পর্শেহঙ্গসঙ্গমম্ ।
ঘ্রাণং চ তৎপাদসরোজসৌরভে
শ্রীমত্তুলস্যা রসনাং তদর্পিতে।।
পাদৌ হরেঃ ক্ষেত্রপদানুসর্পণে
শিরো হৃষীকেশপদাভিবন্দনে।
কামং চ দাস্যে ন তু কামকাম্যয়া
যথোত্তমশ্লোকজনাশ্রয়া রতিঃ ।।
"মহারাজ অম্বরীষ তার মনকে শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের ধ্যানে, তাঁর বাণী দিয়ে বৈকুণ্ঠের গুণ বর্ণানায়, তাঁর হাত দিয়ে তিনি ভগবানের মন্দির মার্জনে, তাঁর কান দিয়ে ভগবানের লীলা শ্রবণে, তাঁর চোখ দিয়ে ভগবানের সচ্চিদানন্দময় রূপ দর্শনে, তাঁর দেহ দিয়ে ভক্তদেহ স্পর্শনে, তাঁর নাক দিয়ে ভগবানের শ্রীচরণে অর্পিত ফুলের ঘ্রাণ গ্রহণে, তাঁর জিহ্বা দিয়ে ভগবানকে অর্পিত তুলসীর স্বাদ আস্বাদনে, তাঁর পদদ্বয় দ্বারা যেখানে ভগবানের মন্দির বিরাজমান সেই সব তীর্থস্থানে ভ্রমণে, তাঁর মস্তক দিয়ে ভগবানকে প্রণতি নিবেদনে এবং তাঁর কামনা দিয়ে ভগবানের কামনা সম্পাদনে নিয়োজিত করেছিলেন। এই সমস্ত গুণাবলী তাঁকে ভগবানের মৎপর ভক্ত করে তোলে।"

এখানে মৎপর শব্দটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কিভাবে মৎপর হওয়া যায়, তা মহারাজ অম্বরীষের আচরণের মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। মৎপর পরম্পরায় আচার্য মহাপণ্ডিত শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ মন্তব্য করেছেন, মদ্ভক্তিপ্রভাবেন সর্বেন্দ্রিয়বিজয়পূর্বিকা স্বাত্মদৃষ্টিঃ সুলভেতি ভাবঃ। "ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার মাধ্যমেই কেবল ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পুর্ণরূপে সংযত করা যায়।" তা ছাড়া, কখনও কখনও আগুনের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়- "একটি আগুনের শিখা যেমন একটি ঘরের মধ্যে সব কিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারে, তেমনই যোগীর হৃদয়ে অবস্থিত ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁর অন্তর থেকে সব রকমের কলুষতা দহন করেন।" যোগসূত্রেও ধ্যানের প্রণালী বর্ণনা করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে ধ্যান করতে। শূন্যকে ধ্যান করার কোন কথাই বলা হয়নি। যে সমস্ত তথাকথিত যোগী শ্রীবিষ্ণু ছাড়া অন্য কিছুর ধ্যান করে, তারা কোন অলীক ছাযামূর্তির দর্শন করার আশায় অনর্থক সময় নষ্ট করে থাকে। কিন্তু যাঁরা পরমার্থ সাধনের প্রয়াসী, তাঁরা কেবল ভগবদ্ভক্তিই আকাঙ্ক্ষা করেন- সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। এটিই হচ্ছে যোগের প্রকৃত উদ্দেশ্য।




ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে ।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে ॥৬২॥
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ॥৬৩॥

অর্থ- ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয় । ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ, মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।

আলোচনাঃ যার অন্তরে ভগবদ্ভক্তির উদয় হয়নি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করা মাত্রই তার মনে আসক্তি জন্মায়। ইন্দ্রিয়গুলিকে সঠিকভাবে নিযুক্ত করা দরকার, তাই সেগুলিকে যখন ভগবানের প্রেমময় সেবায় নিয়োজিত করা না হয়, তখন সেই ইন্দ্রিয়গুলি জড়-জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য তৎপর হয় ওঠে। জড়-জগতের সকলেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়, এমন কি ব্রহ্মা এবং শিবও এর দ্বারা প্রভাবিত - স্বর্গলোকের অন্যান্য দেব-দেবীদের তো কোন কথাই নেই।

জড় জগতের এই গোলক-ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসবার একমাত্র উপায় হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হওয়া। এক সময় মহাদেব গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, পার্বতী যখন কামার্ত হয়ে তাঁর সঙ্গ কামনা করেন, তখন তাঁর ধ্যান ভঙ্গ হয় এবং তিনি পার্বতীর সঙ্গে মিলিত হন, ফলে কার্তিকের জন্ম হয়। ভগবানের একনিষ্ঠ ভক্ত ঠাকুর হরিদাসও এভাবে স্বয়ং মায়াদেবীর দ্বারা প্রলুব্ধ হন, কিন্তু ভগবানের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তির প্রভাবে তিনি অনায়াসে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। শ্রীযামুনাচার্যের লেখা পূর্বোক্ত শ্লোকের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, নিষ্ঠাবান ভক্ত ভগবানের দিব্য সাহচার্য লাভ করে এব অপ্রাকৃত আনন্দের স্বাদ লাভ করেন, যার ফলে তিনি জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ পরিহার করতে পারেন। ভগবদ্ভক্তির প্রভাবে মন আপনা থেকেই আসক্তি রহিত হয়ে পড়ে এবং হৃদয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয়। সেটিই হচ্ছে সাফল্যের রহস্য। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্তি ছাড়া জোর করে ইন্দ্রিয়-দমন করার চেষ্টা করলে তা কখনই ফলপ্রসূ হয় না, কারণ ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনায় মন উন্মত্ত হয়ে ওঠে।



রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্ ।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি ॥৬৪॥

অর্থ- সংযতচিত্ত মানুষ প্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক আসক্তি ও অপ্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে, তাঁর বশীভূত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করে ভগবানের কৃপা লাভ করেন। 

আলোচনাঃ ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, অষ্টাঙ্গ-যোগ, হঠযোগ আদি কৃত্রিম উপায়ে সাময়িকভাবে ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা সম্ভব হলেও, ভগবানের সেবায় তাদের নিযুক্ত না করলে, প্রতি মুহূর্তে মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় ভগবানের ভক্তকে আপাতদৃষ্টিতে ইন্দ্রিয়াসক্ত বলে মনে হলেও, ভগবানের প্রতি নির্মল ভক্তি লাভ করার ফলে ইন্দ্রিয়-পরায়ণ কার্যকলাপের প্রতি তাঁর কোন আসক্তি থাকে না। ভগবানের প্রতি ভালবাসা এতই গভীর যে, আর কোন কিছুর প্রতি তাঁর কোন রকম মোহ থাকে না। ভগবানের প্রেমামৃতের আস্বাদন অর্জন করার ফলে বিষয়-বিষের প্রতি তাঁর আর আসক্তি থাকে না।
ভগবানের ভক্তের একমাত্র চিন্তা হচ্ছে, কিভাবে তিনি ভগবানের সেবা করবেন, কিভাবে ভগবানকে তুষ্ট করবেন, এ ছাড়া আর কোন বিষয়েই তিনি চিন্তা করেন না। তাই তিনি সমস্ত রকমের আসক্তিও নিরাসক্তির অতীত। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুসারে কেবল তিনি তাঁর সমস্ত কর্তব্যকর্ম করেন। শ্রীকৃষ্ণ যদি চান, তবে তিনি এমন কাজও করেন, যার জন্য সারা জগৎ তাঁকে নিন্দা করতে পারে। আবার শ্রীকৃষ্ণ না চাইলে তিনি তাঁর অবশ্য করণীয় কর্মও পরিত্যাগ করেন। কর্তব্যকর্ম সাধন সাধারণত নির্ভর করে আমাদের ইচ্ছার উপরে, কিন্তু কৃষ্ণভক্ত কেবল ভগবানের নির্দেশ অনুসারে তাঁর কর্তব্যকর্ম করে চলেন। ভগবানের অহৈতুকী কৃপার ফলে ভক্ত এই ধরণের শুদ্ধ চেতনা লাভ করেন, যার ফলে কোন রকম জড় কলুষময়পরিবেশে তিনি সংশ্লিষ্ট থাকলেও কোন কলুষতা আর তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।



প্রসাদে সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে ।
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে ॥৬৫॥

অর্থ- চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তখন আর জড় জগতের ত্রিতাপ দুঃখ থাকে না ; এভাবে প্রসন্নতা লাভ করার ফলে বুদ্ধি শীঘ্রই স্থির হয়। 

নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা ।
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্ ॥৬৬॥

অর্থ- যে ব্যক্তি কৃষ্ণ ভাবনায় যুক্ত নয়, তার চিত্ত সংযত নয় এবং তার পারমার্থিক বুদ্ধি থাকতে পারে না। আর পরমার্থ চিন্তাশূন্য ব্যক্তির শান্তি লাভের কোন সম্ভাবনা নেই৷এই রকম শান্তিহীন ব্যক্তির প্রকৃত সুখ কোথায় ? 

আলোচনাঃ- ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত না করলে কোন মতেই শান্তি পাওয়া যেতে পারে না। ভগবান নিজেই পঞ্চম অধ্যায়ে (৫/২৯)
প্রতিপন্ন করেছেন যে, যখন কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, কৃষ্ণই হচ্ছে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার একমাত্র ভোক্তা, তিনিই সমস্ত বিশ্ব-চরাচরের অধীশ্বর এবং তিনিই সমস্ত জীবের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু, তবেই সে প্রকৃত শান্তি লাভ করতে পারে। তাই, যে কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়, তার জীবনের কোন চরম উদ্দেশ্যই থাকে না। জীবনের চরম উদ্দেশ্য কি, তা না জানাই তার সমগ্র অশান্তির কারণ। কিন্তু কেউ যখন বুঝতে পারে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম ভোক্তা, অধীশ্বর ও সর্বভূতের পরম সুহৃদ, তখন তার মন শ্রীকৃষ্ণের সেবায় একাগ্র হয়ে ওঠে এবং তার ফলে সে প্রকৃত শান্তি লাভ করে। তাই, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ রহিত হয়ে যে তার সময় অতিবাহিত করে, সে যতই লোক দেখানো তথাকথিত শান্তি ও পারমার্থিক প্রগতির বুলি আওড়াক না কেন, সে সর্বদাই দুঃখ-দুর্দশায় পীড়িত ও অশান্ত। কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে একটি স্বয়ং-প্রকাশিত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, যা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একমাত্র সম্বন্ধ গড়ে তোলার মাধ্যমেই লাভ করা যায়।



ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে ।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি ॥৬৭॥

অর্থ- প্রতিকূল বায়ু নৌকাকে যেমন অস্থির করে, তেমনই সদা বিচরণকারী যে কোন একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণেও মন অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞাকে হরণ করতে পারে। 

আলেচনাঃ- ভগবদ্ভক্ত যদি তাঁর সব কয়টি ইন্দ্রিয়কে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত না করেন, যদি তাঁর কোন একটি ইন্দ্রিয়ও জড় সুখ উপভোগ করার প্রয়াসী হয়, তা হলেও তাঁর মন ভগবানের শ্রীচরণকমল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, ফলে তাঁর পারমার্থিক উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। মহারাজ অম্বরীষের ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে আমরা শিক্ষা পাই, তাঁর মতো আমাদেরও সব কয়টি ইন্দ্রিয়কে ভগবানের সেবায় নয়োজিত করতে হবে। তা হলেই মন একাগ্র হয় ভগবানের শ্রীচরণে সমাধিস্থ হবে, কেন না সেইটিই হচ্ছে মনকে নিয়ন্ত্রণ করার যথার্থ কৌশল।


তস্মাদ্ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্বশঃ ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ॥৬৮॥

অর্থ- সুতরাং, হে মহাবাহো ! যাঁর ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত হয়েছে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। 

আলোচনাঃ কেবলমাত্র কৃষ্ণভাবনা অথবা ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময়ী সেবায় সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়-তর্পণের বেগগুলিকে দমন করা যায়। যেমন উচ্চতর শক্তি প্রয়োগ করে শত্রুদের দমন করা যায়, ইন্দ্রিয়গুলিকে তেমনই উপায়ে দমন করতে হয়-কোনও মানবিক প্রচেষ্টায় তা হয় না। সেগুলিকে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত রাখার মাধ্যমেই তা সম্ভব। এই সত্য যিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, কৃষ্ণভাবনাই মানুষকে পরিশুদ্ধ বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা এনে দেয় এবং কোন সদগুরুর পথনির্দেশ মতোই সেই পদ্ধতির অনুশীলন করতে হয়, তাঁকেই বলা হয় সাধক, অর্থাৎ তিনি জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার যোগ্য পাত্র।



শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী ।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ ॥৬৯॥

অর্থ- সমস্ত জীবের পক্ষে যা রাত্রিস্বরূপ, স্থিতপ্রজ্ঞ সেই রাত্রিতে জাগরীত থেকে আত্ম-বুদ্ধিনিষ্ঠ আনন্দকে সাক্ষাৎ অনুভব করেন। আর যখন সমস্ত জীবেরা জেগে থাকে, তত্ত্বদর্শী মুনির নিকট তা রাত্রিস্বরূপ। 

আলোচনাঃ- এই জগতে দুই রকমের বুদ্ধিমান লোক আছে। এক ধরনের বুদ্ধিমান লোক ইন্দ্রিয় ভোগতৃপ্তির উদ্দেশ্যে বৈষয়িক ব্যাপারে খুব উন্নতি লাভ করে, আর অন্য ধরনের বুদ্ধিমানেরা আত্মানুসন্ধানী এবং আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভের চেষ্টায় সদা জাগ্রত। আত্নমানুসন্ধানী সাধু বা চিন্তাশীল মানুষের কাজকর্ম জড়-জাগতিক ভাবে আচ্ছন্ন মানুষদের কাছে যেন রাত্রির অন্ধকার বলে মনে হয়। আত্ম-উপলব্ধি সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্যই জড়-জাগতিক মানুষেরা তেমন রাত্রির অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু তত্ত্বদর্শী মুনি জড়-জাগতিক মানুষদের রাত্রিতে সজাগ থাকেন। সেই সময় সাধুজন আধ্যাত্মিক চর্চায় ক্রমশ অগ্রগতির পথে অপ্রাকৃত আনন্দ উপলব্ধি করেন, আর তখন সংসারী লোক রাত্রিতে ঘুমিয়ে থেকে নানা রকম ইন্দ্রিয় উপভোগের স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্নে সে কখনও নিজেকে সুখী মনে করে, কখনও ঘুমের ঘোরে দুঃখীও মনে করে। এই সমস্ত জড়-জাগতিক সুখ-দুঃখের প্রতি আত্মানুসন্ধানী ব্যক্তি সর্বদাই উদাসীন থাকেন। তিনি জড়-জাগতিক প্রতিক্রিয়ায় সম্পূর্ণ নিস্পৃহ থেকে আত্ম-উপলব্ধির কাজে সচেষ্ট থাকেন।


শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং
সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ ।
তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে
সঃ শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী ॥৭০॥

অর্থ- বিষয়কামী ব্যক্তি কখনো শান্তি লাভ করে না। জলরাশি যেমন সদা পরিপূর্ণ এবং স্থির সমুদ্রে প্রবেশ করেও তাকে ক্ষোভিত করতে পারে না, কামসমূহও তেমন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিতে প্রবিষ্ট হয়েও তাঁকে বিক্ষুব্ধ করতে পারে না, অতএব তিনিই শান্তি লাভ করেন৷ 

আলেচনাঃ যদিও মহাসমুদ্র সব সময় জলে পূর্ণ থাকে এবং বর্ষার সময় নদীবাহিত হয়ে আরও জল সমুদ্রে প্রবেশ করে, কিন্তু সমুদ্রের কোনও পরিবর্তন হয় না স্থির থাকে; সমুদ্র তখনও বিক্ষুব্ধ হয় না, এমন কি বেলাভূমি অতিক্রম করে প্লাবিত হয় না কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন কৃষ্ণভক্তও সর্ব অবস্থাতেই তেমনই অবিচল থাকেন। যতক্ষণ মানুষ জড় দেহ নিয়ে আছে, ততক্ষণ ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য দেহের চাহিদাও থাকবেই। কিন্তু ভগবানের ভক্ত তাঁর পূর্ণতার জন্য এই সমস্ত কামনা-বাসনার দ্বারা কখনই বিচলিত হন না। কারণ, কৃষ্ণভক্তের কোন কিছুরই অভাব নেই, ভগবান তাঁর সমস্ত অভাব মোচন করেছেন। তাই তিনি সমুদ্রের মতো-নিজের মধ্যেই সর্বদা পরিপূর্ণ। ইন্দ্রিয়ের নদী বেয়ে কামনা-বাসনার যত জলই তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করুক, তাঁর হৃদয় সমুদ্রের মতোই অবিচলভাবে পরিপূর্ণ থাকে। এটিই হচ্ছে ভগবদ্ভক্তিের লক্ষণ-জড় জগতের ভোগবাসনার প্রতি তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন, যদিও বাসনাগুলি তাঁর মধ্যে রয়েছে। ভগবানের সেবায় গভীরভাবে মগ্ন থাকার ফলে তিনি যে শান্তি লাভ করেছেন, তা সমুদ্রের মতোই অতলস্পর্শী। কোন কিছুই তাঁকে আর বিচলিত করতে পারে না। পক্ষন্তরে, অন্যেরা, এমন কি যারা মুক্তির আকাঙ্ক্ষী-জাগতিক সাফল্যের অকাঙ্ক্ষীদের কি আর কাথা, তারাও সর্বদাই অশান্ত। সকাম কর্মী, মুক্তিকামী ও সিদ্ধিকামী যোগী-সকলেই অশান্ত, যেহেতু তাদের অপূর্ণ বাসনা। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত ভগবানের সেবায় সর্বতোভাবে পরম শান্তি লাভ করে থাকেন, তাঁর কোন বাসনাই অপূর্ণ থাকে না। বাস্তবিকপক্ষে, তিনি এমন কি জড় জগতের তাথাকথিত বন্ধন থেকে মুক্তির কামনাও করেন না কৃষ্ণভক্তদের কোন জড় কামনা থাকে না, তাই তাঁরা সম্পূর্ণরূপে শান্ত।।



শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

বিহায় কামান্ যঃ সর্বান্ পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ ।
নির্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি ॥৭১॥

অর্থ- যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে জড় বিষয়ের প্রতি নিঃস্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমত্ত্ববোধ রহিত হয়ে বিচরণ করেন, তিনিই প্রকৃত শান্তি লাভ করে। 

আলোচনাঃ নিষ্কাম হওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য কোন কিছু কামনা না করা। পক্ষান্তরে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সেবা করার কামনাই হচ্ছে নিষ্কামনা। এই জড় দেহটিকে বৃথাই আমাদের প্রকৃত সত্তা বলে না ভেবে এবং জগতের কোনও কিছুর উপরে বৃথা মালিকানা দাবি না করে, শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস রূপে নিজের যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করাটাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার পরিশুদ্ধ পর্যায়। এই পরিশুদ্ধ পর্যায়ে যে উন্নীত হতে পারে, সে বুঝতে পারে, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সব কিছুর অধীশ্বর, তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করবার জন্য সব কিছুই তাঁর সেবায় উৎসর্গ করা উচিত। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন নিজের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে নারাজ হয়েছিলেন, কিন্তু ভগবানের কৃপার ফলে তিনি যখন পরিপূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হলেন, তখন ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে তিনি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন।

নিজের জন্য যুদ্ধ করার ইচ্ছা অর্জুনের ছিল না, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছার কথা জেনে সেই একই অর্জুন যথাসাধ্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। ভগবানকে সন্তুষ্ট করার বাসনাই হচ্ছে বাসনা রহিত হওয়ার একমাত্র উপায়। কোন রকম কৃত্রিম উপায়ে কামনা-বাসনাগুলিকে জয় করা যায় না। জীব কখনই ইন্দ্রিয়নুভুতিশূন্য অথবা বাসনা রহিত হতে পারে না। তবে ইন্দ্রিয়ানুভুতি ও কামনাবাসনার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য সে তাদের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে। জড়-জাগতিক বাসনাসূন্য মানুষ অবশ্যই বোঝেন যে, সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের (ঈশাবাস্যমিদং সর্বম্) এবং সেই জন্য তিনি কোন কিছুর উপরেই মালিকানা দাবি করেন না। এই পারমার্থিক জ্ঞান আত্মউপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত । অর্থাৎ, তাখন যথাযথভাবে বোঝা যায় যে, চিন্ময় স্বরূপে প্রত্যেকটি জীব শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাই জীবের নিত্য স্থিতি কখনই শ্রীকৃষ্ণের সমকক্ষ বা তাঁর চেয়ে বড় নয়। কৃষ্নভাবনামৃতের এই সত্য উপলব্ধি করাই হচ্ছে প্রকৃত শান্তি লাভের মূল নীতি।।



শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি ।
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রহ্মনির্বাণমৃচ্ছতি ॥৭২॥

অর্থ-এই প্রকার স্থিতিকেই ব্রাহ্মীস্থিতি বলে। হে পার্থ ! যিনি এই স্থিতি লাভ করেন, তিনি মোহপ্রাপ্ত হন না । জীবনের অন্তিম সময়ে এই স্থিতি লাভ করে, তিনি এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেন। 

আলোচনাঃ- কৃষ্ণভাবনামৃত অর্থাৎ ভগবৎ-পরায়ণ দিব্য জীবন এক মুহুর্তের মধ্যে লাভ করা সম্ভব, আবার লক্ষ-কোটি জীবনেও তার নাগাল পাওয়া সম্ভন না হতেও পারে। এই জীবন লাভ করতে হলে কেবল পরম সত্যকে উপলব্ধি করে তাকে গ্রহণ করতে হবে। খট্বাঙ্গ মহারাজ তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মুহুর্ত পূর্বে ভগবানের চরণানবিন্দে আত্মোৎসর্গ করার ফলে জীবনের সেই পর্যায়ে উনীত হয়েছেলেন। নির্বাণ কথাটির অর্থ হচ্ছে জড় জীবনের সমাপ্তি। বৌদ্ধদের মতে জড় জীবনের সমাপ্তি হলে আত্মা অসীম শূন্যতায় বিলীন হয়ে যায়। ভগবদগীতা কিন্তু আমাদের সেই শিক্ষা দেয় না।

এই জড় জীবনের সমাপ্তি হবার পরে আমাদের প্রকৃত জীবন শুরু হয়। এই জড়-জাগতিক জীবনধারা পরিসমাপ্ত করতে হবে, সেই কথাটি জানাই স্থূল জড়বাদীর পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু যিনি পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি জানেন যে, এই জড় জীবনের পরেও আর একটি জীবন আছে। এই জীবনের পরিসমাপ্তির পূর্বে, সৌভাগ্যক্রমে কেউ যদি কৃষ্ণভাবনাময় হয়, তবে সে তৎক্ষণাৎ ব্রহ্মনির্বাণ স্তর লাভ করে। ভগবৎ-ধাম ও ভগবৎসেবার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই্ যেহেতু উভয়ই চিন্ময়, তাই ভক্তিযোগে ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময়ী সেবায় নিয়োজিত হওয়াই হচ্ছে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তি। জড় জগতের সমস্ত কর্মই ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য সাধিত হয়, কিন্তু চিন্ময় জগতের সমস্ত কর্মই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার জন্য সাধিত হয়। এমন কি এই জীবনে কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মপ্রাপ্তি হয় এবং যিনি কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন, তিনি নিঃসন্দেহে ইতিমধ্যেই ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেছেন। ব্রহ্ম হচ্ছে জড় বস্তুর ঠিক বিপরীত। তাই ব্রাহ্মী স্থিতি বলতে বোঝায় 'জড়-জাগতিক স্তরের অতীত'। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা নিবেদনকে ভগবদগীতায় মুক্ত স্তররূপে স্বীকার করা হয়েছে (স গুনান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে)। তাই, জড় বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে ব্রাহ্মী স্থিতি।

ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'সাংখ্যযোগো' নাম দ্বিতীয়োঽধ্যায়ঃ।।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।


----------------------------------------------------------------------
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ অন্তে শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা-
----------------------------------------------------------------------
ওঁ যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্‌ ভবেৎ ।
পূর্ণং ভবতু ত্বৎ সর্বং ত্বৎ প্রসাদাৎ জনার্দ্দন ।।
মন্ত্র হীনং ক্রিয়া হীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন ।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তুমে ।।

⚠ ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করে আরো বেশী মানুষের কাছে পৌছাতে সাহায্য করবেন । 





Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।