২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

তৃতীয় অধ্যায়ঃ কর্মযোগ

................................ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়....................................

✴ ✴ ✴ ✴ ✴ শ্রীমদ্ভবদ্গীতার তৃতীয় অধ্যায় ✴ ✴ ✴ ✴ ✴


শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

অর্জুন উবাচ- জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দন ।

তৎ কিং কর্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব।।০১।।

অর্থ- অর্জুন বললেন-হে জনার্দন ! হে কেশব ! যদি তোমার মতে কর্ম অপেক্ষা ভক্তি-বিষয়িনী বুদ্ধি শ্রেয়তর হয়, তা হলে এই ভয়ানক যুদ্ধে নিযুক্ত হওয়ার জন্য কেন আমাকে প্ররোচিত করছ ?

আলোচনাঃ- পূর্ববর্তী অধ্যায়ের পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় সখা অর্জুনকে জড় জগতের দুঃখার্ণব থেকে উদ্ধার করবার জন্য, আত্মার স্বরূপ বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন এবং সেই সঙ্গে তিনি আত্মার সরূপ উপলব্ধি করবার পন্থাও বর্ণনা করেছেন- সে পথ হচ্ছে বুদ্ধিযোগ অর্থাৎ কৃষ্ণভাবনা। কখনো এই বুদ্ধিযোগরে কদর্থ করে একদল নিষ্কর্মা লোক কর্ম-বিমুখতার আশ্রম গ্রহণ করে। কৃষ্ণভাবনার নাম করে তারা নির্জনে বসে কেবল হরিরনাম জপ করে, কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ওঠার দূরাশা করে। কিন্তু যথাযথভাবে ভগবৎ-তত্ত্ব জ্ঞানের শিক্ষা লাভ না করে নির্জনে বসে কৃষ্ণনাম জপ করলে নিরীহ, অজ্ঞ লোকের সস্তা বাহবা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। অর্জুনও প্রথমে বুদ্ধিযোগ বা ভক্তিযোগকে কর্ম জীবন থেকে অবসর নেওয়ার নামান্তর বলে বিবেচনা করেছিলেন এবং মনে করেছিলেন, নির্জন অরণ্যে কৃচ্ছ্র সাধনা এবং তপশ্চর্যার জীবন-যাপন করেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি কৃষ্ণভাবনার অজুহাত দেখিয়ে সুকৌশলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে নিরস্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিষ্ঠাবান শিষ্যের মতো যখন তিনি তাঁর গুরুদেব ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর যথাকর্তব্য সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই তৃতীয় অধ্যায়ে তাঁকে কর্মযোগ বা ভগবৎ-চেতনাময় কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করে শোনান।





শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে ।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্ ॥২॥

অর্থ- তুমি যেন দ্ব্যর্থবোধক বাক্যের দ্বারা আমার বুদ্ধি বিভ্রান্ত করছ। তাই, দয়া করে আমাকে নিশ্চিতভাবে বল কোনটি আমার পক্ষে সবচেয়ে শ্রেয়স্কর।

আলোচনাঃ- ভগবদ্গীতার ভূমিকাস্বরূপ পূর্ববর্তী অধ্যায়ে, সাংখ্য-যোগ, বুদ্ধিযোগ, ইন্দ্রিয়-সংযম, নিষ্কাম-কর্ম, কনিষ্ঠ ভক্তের স্থিতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেগুলি সবই অসম্বদ্ধভাবে পরিবেশিত হয়েছিল। কর্মোদ্যোগ গ্রহণ এবং উপলব্ধির জন্য যথাযথ পন্থা-প্রণালী সম্পর্কিত বিশেষভাবে সুবিন্যস্ত নির্দেশবলী একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং ভগবানেরই ইচ্ছার ফলে অর্জুন সাধারণ মানুষের মত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাঁকে নানা রকম প্রশ্ন করেছেন, যাতে সাধারণ মোহাচ্ছন্ন মানুষেরাও ভগবানের উপদেশ-বাণীর যথাযথ অর্থ উপলব্ধি করতে পারে।

ভগবৎ-তত্ত্বের যথার্থ অর্থ না বুঝতে পেরে অর্জুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কুতার্কিকদের মতো কথার জাল বিস্তার করে ভগবান অর্জুনকে বিভ্রান্ত করতে চাননি, কিন্তু ভগবদ্ভক্তির অপ্রাকৃত প্রকৃতি বুঝতে না পারাব ফলে অর্জুন ভগবানের উপদেশের মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে, অর্জুনের মাধ্যমে ভগবান কৃষ্ণভাবনাময় পথ সুগম করে তোলার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, যাতে ভগবদ্গীতার রহস্য উপলব্দি করার জন্য যারা গভীরভাবে আগ্রহী, তাদের সুবিধা হয়।




শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

শ্রীভগবানুবাচ
লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাম্ ॥৩॥

অর্থ- পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে নিষ্পাপ অর্জুন ! আমি ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করেছি যে, দুই প্রকার মানুষ আত্ম-উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। কিছু লোক অভিজ্ঞতা লব্ধ দার্শনিক জ্ঞানের আলাচনার মাধ্যমে নিজেকে জানতে চান এবং অন্যেরা আবার তা ভক্তির মাধ্যমে জানতে চান।

আলোচনাঃ- দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩৯তম শ্লোকে ভগবান সাংখ্য-যোগ এবং কর্মযোগ বা বুদ্ধিযোগ, এই দুটি পন্থার ব্যাখ্যা করেছেন। এই শ্লোকে ভগবানন তারই বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। সাংখ্য-যোগ হচ্ছে চেতন এবং জড়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণমূলক বিষয়বস্তু। যে সমস্ত মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দার্শনিক তত্ত্বের মাধ্যমে জ্ঞানন আহরণ করতে চায়, তাদের জন্য এই পথ নির্ধারিত হয়েছে। অন্য পন্থাটি হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা বা বুদ্ধিযোগ। এই সম্বন্ধে ভগবান দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩৯তম এবং ৬১ তম শ্লোকে বলেছেন যে, এই বুদ্ধিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করলে অতি সহজেই কর্ম-বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় এবং এই যোগ অভ্যাস করলে অধঃপতিত হবার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না। ৬১তম শ্লোকে তার ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করাই হচ্ছে বুদ্ধিযোগ, এবং তার ফলে দুর্দমনীয় ইন্দ্রিয়গুলি অতি সহজেই সংযত হয়। তাই এই দুটি যোগই ধর্ম এবং দর্শনরূপে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।

ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মার মর্যাদা উপলব্ধি করাই হচ্ছে আত্ম- তত্ত্বজ্ঞানন বা কৃষ্ণভাবনামৃত। এই দুটি পথের চরম লক্ষ্য এক হলেও, একটি হচ্ছে অনুমানের ভিত্তিতে দার্শনিক বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে পরম সত্য পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা, আর অন্যটি হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পরম সত্য, পরমেশ্বর বলে উপলব্ধি করে তাঁর সঙ্গে আমাদের সনাতন সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা করা। এই দুটি পথ- 'জ্ঞানযোগ' এবং 'বুদ্ধিযোগের' মধ্যে বুদ্ধিযোগই শ্রেয়ঃ, কারণ, এই যোগে তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্র-সাধন করে কৃত্রিম উপায়ে ইন্দ্রিয় সংযম করতে হয় না। কেবল কৃষ্ণভাবনায় অনুপ্রাণিত হলে ইন্দ্রিয়গুলি আপনা থেকেই সংযত হয়ে যায় এবং কৃষ্ণভাবনার অমৃত প্রবাহ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে অন্তরকে কুলষমুক্ত করে। ভক্তি নিবেদনের পত্যক্ষ পদ্ধতিরূপে এই পথ সহজ এবং উচ্চস্তরের।





শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

ন কর্মণামনারম্ভান্ নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে ।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ॥৪॥

অর্থ- কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।

আলোচনাঃ- শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী বিধি নিষেধের আচরণ করার ফলে যখন অন্তর পবিত্র হয় এবং জড়-বন্ধন গুলি শিথিল হয়ে যায়, তখন মানুষ সর্বত্যাগী জীবন ধারায় সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করার যোগ্য হয়। অন্তর পবিত্র না হলে- সম্পূর্ণ কামনা বাসনা মুক্ত না হলে, সন্ন্যাস গ্রহণ করার কোনই মানে হয় না। মায়াবাদী জ্ঞানীরা মনে করে, সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করার মাত্রই তারা নারায়ণের সমের্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু তা অনুমোদন করছেন না। অন্তর পবিত্র না করে জড়-বন্ধন মুক্ত না হয়ে সন্ন্যাস নিলে তা কেবল সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাতেরই সৃষ্টি করেরে। পক্ষান্তরে, যদি কেউ ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করে, তবে তার বর্ণ এবং আশ্রমজনিত ধর্ম নির্বিশেষে সে ভগবানের কৃপা লাভ করে, ভগবান নিজেই এই কথা বলেছেন। 'স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।' এই ধর্মের স্বল্প আচরণ করলেও জড় জগতের মহা ভয় থেকে ত্রাণ পাওয়া যায়।






শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্টত্যকর্মকৃৎ ।
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ ॥৫॥

অর্থ- সকলেই মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহায়ভাবে কর্ম করতে বাধ্য হয়; তাই কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না।

আলোচনাঃ- কর্তব্যকর্ম না করে কেউই থাকতে পারে না। আত্মার ধর্মই হচ্ছে সর্বক্ষণ কর্মরত থাকা। আত্মার প্রভাবেই জড় দেহ প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। প্রকৃতপক্ষে জড় দেহটা নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ মাত্র, কিন্তু সেই দেহ অবস্থান করে আত্মা সর্বক্ষণ তাকে সজীব রাখার কর্তব্যকর্ম করে যাচ্ছে এবং এই কর্তব্যকর্ম থেকে সে এক মুহূর্তের জন্যও বিরত হতে পারে না। সর্বক্ষণ কর্তব্যকর্ম করার এই প্রবৃত্তিকে শ্রীকৃষ্ণ সেবায় নিয়োজিত করতে হয়, তা না হলে মায়ার প্রভাবেমোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব অনিত্য জড়জাগতিক কর্মে ব্যাপৃত হয়। জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে আত্মা জড়-গুনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তাই এই জড়-গুণের কুলষ থেকে মুক্ত হবার জন্য শাস্ত্রে নির্ধারতি ধর্মাচরণ করতে হয়। কিন্তু আত্মা যখন শ্রীকৃষ্ণের সেবায় স্বাভাবিক ভাবে নিয়োজিত হয়, তখন সে যা করে তার পক্ষে তা মঙ্গলময় হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে- ত্যক্ত্বা স্বধর্মং চরভাম্বুজং হরের্ভজন্নপক্কোহথ পতেত্ততো যদি।
যত্র ক্ক বাভদ্রমভূদমুষ্য কিং কো বার্থ আপ্তোহভজতাং স্বধর্মতঃ।।
যদি কেউ কৃষ্ণভাবনায় নিমগ্ন হয়, এবং তখন সে যদি শাস্ত্রনির্দেশিত বিধি-নিষেধগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না মেনেও চলে অথবা তার স্বধর্ম পালনও না করে, এমন কি সে যদি অধঃপতিত হয়, তা হলেও তার কোন রকম ক্ষতি বা পাপ হয় না। কিন্তু সে যদি শাস্ত্র-নির্দেশিত সমস্ত পুণ্যকর্ম আচরণ করে অথচ ভক্তি-সহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করে, তা হলে সেই সমস্ত পুণ্য কর্মের কোনই তাৎপর্য থাকে না। (ভাঃ ১/৫/১৭)

সুতরাং কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার জন্যই পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করা হয় যাতে আমাদের অন্তর পবিত্র হয়। তাই সন্ন্যাস আশ্রম অবলম্বন কর অথবা চিত্তশুদ্ধি-কর্মানুষ্ঠান করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণ-চেতনা লাভ করা। তা না হলে সব কিছুই নিরর্থক।






শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্ ।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমুঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে ॥৬॥

অর্থ- যে ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ, রস আদি ইন্দ্রিয়গুলি স্মরণ করে, সেই মুঢ় অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মিথ্যাচারী ভণ্ড বলা হয়ে থাকে।

আলোচনাঃ- অনেক মিথ্যাচারী আছে, যারা কৃষ্ণভাবনাময় সেবাকর্য করতে চায় না, কেবল ধ্যান করার ভান করে। কন্তু এতে কোন কাজ হয় না। কারণ, তারা তাদের কর্মেন্দ্রিয়গুলিকে রোধ করলেও মন তাদের সংযত হয় না। পক্ষান্তরে, মন অত্যন্ত তীব্রভাবে ইন্দ্রিয়-সুখের জল্পনা-কল্পনাকরতে থাকে। তারা লোক ঠকানোর দু' একটা তত্ত্বকথাও বলে। কিন্তু ভগবদ্গীতার এই শ্লোকে আমরা জানতে পারছি যে, তারা হচ্ছে সব চাইতে বড় প্রতারক। বর্ণাশ্রম ধর্মের আচরণ করেও মানুষ ইন্দ্রিয়-সুখ ভোগ করতে পারে, কিন্তু বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুসারে মানুষ যখন তার স্বধর্ম পালন করে, তখন ক্রমে ক্রমে তার চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং সে ভগবদ্ভক্তি লাভ করে। কিন্তু যে যোগী সেজে লোক ঠকায়, যে আসলে ত্যাগীর বেশ ধারণ করে ভোগের চিন্তায় মগ্ন থাকে, সে হচ্ছে সব চাইতে নিকৃষ্ঠ স্তরের প্রতারক। মাঝে মাঝে দু' একটা তত্ত্বকথা বলে সরল-চিত্ত সাধারণ মানুষের কাছে তার তত্ত্বজ্ঞানন জাহির করতে চায়, কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, সেগুলি তোতাপাখির মতো মুখস্থ জরা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মায়াশক্তির প্রভাবে ঐ ধরনের পাপচারী প্রতারকদের সমস্ত জ্ঞানন অপহরণ করে নেন।





শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন ।
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ সঃ বিশিষ্যতে ॥৭॥

অর্থ- কিন্তু যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ ।

আলোচনাঃ- সাধুর বেশ ধরে যথেচ্ছ জীবন যাপন ও ভোগতৃপ্তির জন্য লোক ঠকানোর চাইতে স্বকর্মে নিযুক্ত থেকে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন করা শত সহস্রগুণে ভাল। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে জড়-বন্ধন মুক্ত হয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়া। স্বার্থ গতি অর্থাৎ জীবনের প্রকৃত স্বার্থ হচ্ছে শ্রীবিষ্ণুর শ্রীচরণারবিন্দের আশ্রয় লাভ করা। বর্ণাশ্রম ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সেই চরম গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাওয়া।
ভগবৎ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্তব্যকর্ম করার ফলে একজন গৃহস্থও ভগবানের কাছে ফিরে যেতে পারে। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে সংযত জীবন যাপন করে কেউ যখন জড় জাগতিক কর্তব্যকর্ম করে, তখন তার কর্ম-বন্ধনে বদ্ধ হয়ে পড়ার কোন আশঙ্কা থাকে না, কারণ সে তখন আসক্তিরহিত হয়ে, সম্পূর্ণ নিঃস্পৃহভাবে তার কর্তব্যকর্ম করে চলে। এইভাবে সংযত ও নিঃস্পৃহ থাকার ফলে তার অন্তর পবিত্র হয় এবং ভগবানের সান্নিধ্য লাভ হয়। সংসার ত্যাগ করে মর্কট বৈরাগী হবার চাইতে সংসারে থেকে ভগবানের সেবা করা ভাল। যে সমস্ত ভন্ড-সাধু লোক ঠকাবার জন্য ধ্যান করার ভান করে, তাদের থেকে একজন কর্তব্যনিষ্ঠা মেথরও অনেক মহৎ।





শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণ ॥৮॥

অর্থ- তুমি শাস্ত্রক্তো কর্মের অনুষ্ঠান কর, কেন না কর্মত্যাগ থেকে কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না।

আলোচনাঃ- অনেক ভন্ড সাধু আছে, যারা জনসমক্ষে প্রচার করে বেড়ায় যে, তারা অত্যন্ত উচ্চ বংশজাত এবং কর্ম জীবনেও তারা অনেক সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু তা সসত্ত্বেও অধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনরে জন্য তারা সব কিছু ত্যাগ করেছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই রককম নামে সাধু হতে সাবধান করে দিয়েছিলেন।

অর্জুন ছিলেন গৃহস্থ এবং সেনাপতি, তাই শাস্ত্র নির্ধারিত গৃহস্থ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করাই ছিল তাঁর কর্তব্য। এই ধর্ম পালন করার ফলে জড়-বন্ধনে আবদ্ধ মানুষের মনন পবিত্র হয় এবং ফলে সে জড়-বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। তথাকথিত ত্যাগীরা, যারা দেহ প্রতিপালন করবার জন্যই ত্যাগের অভিনয় করে, ভগবান তাদের কোন রকম স্বীকৃতি দেননি, শাস্ত্রও তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

দেহ প্রতিপালন করার জন্যও মানুষকে কর্তব্যকর্ম করতে হয়। তাই জড়জাগতিক প্রবৃত্তিগুলিকে শুদ্ধ না করে, নিজের খেয়ালখুশি মতো কর্তব্যককর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। এই জড় জগতের প্রতত্যেকেরই নিশ্চয় জড়া প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব কুলষময় প্রবৃত্তি আছে, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনা আছে। সেই কুলষময় প্রবৃত্তিগুলিকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। শাস্ত্র-নির্দেশিত উপায়ে তা না করে কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করে এবং অন্যের সেবা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তথাকথিত অতীন্দ্রিয়বাদী যোগী হবার চেষ্টা করা কখনই উচিত নয়।






শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ ।
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর ॥৯॥

অর্থ- বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ। তাই, হে কৌন্তেয় ! ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তুমি তোমার কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদাই বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

আলোচনাঃ- যজ্ঞ বলতে ভগবান শ্রীবিষ্ণুকেই বোঝায়, তাই তাঁকে প্রীতি করার জন্যই সমস্ত যজ্ঞের অবুষ্টান করা হয়। বেদে বলা হয়েছে 'যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ'। তার ফলে আমরা জানতে পারি যে, নানা রকমকম আচার অনুষ্টানের মাধ্যমে যজ্ঞ করা আর সরারাসরিভাবে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সেবা করার পরিণাম একই-এই দুই অনুষ্টানের ফলে একই উদ্দেশ্যও সাধিত হয়।
সুতরাং এই শ্লোকে আমরা জানতে পারি যে, কৃষ্ণভাবনা চর্চা করার জন্য আমরা যে কর্তব্যকর্ম করি, তাও হচ্ছে যজ্ঞ। বর্ণাশ্রম ধর্মের উদ্দেশ্যও হচ্ছে ভগবানকে, শ্রীবিষ্ণুকে তুষ্ট করা। 'বর্ণাশ্রমাচারবতা পুরুষেণ পরঃ পুমান্। বিষ্ণুরারাধ্যতে........'(বিষ্ণু পুরাণ ৩/৮/৮)।
তাই শ্রীকৃষ্ণকে (অথবা শ্রীবিষ্ণুকে) সন্তুষ্ট করার জন্যই কর্তব্যকর্ম করা উচিত। এইভাবে যে ভগবানের সেবাপরায়ণ হয়েছে, সে আর কখনও জড়-বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের জন্য কর্ম না করেরে ভগবানের সেবায় সমস্ত কর্তব্যকর্ম করা উচিত। এইভাবে চর্চার ফলে শুধু যে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত থাকা যায়, তাই নয়-এ ছাড়া ভগবানের প্রতি অপ্রাকৃত প্রেমভক্তির সেবা চর্চার পর্যায়ে ক্রমশ উন্নীত হওয়া যায়, যার ফলে তাঁর সচ্চিদানন্দমশ পরমধামে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়।







শ্রীগোপালকৃষ্ণায় নমঃ
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুুদেবায়।।

সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্ ॥১০॥

অর্থ- সৃষ্টির প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা যজ্ঞাদি সহ প্রজাসকল সৃষ্টি করে বলেছিলেন- "এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও ৷ এই যজ্ঞ তোমাদের সমস্ত অভীষ্ট পূর্ণ করবে।"

আলোচনাঃ- জীবের পালনকর্তা বিষ্ণু এই জড়-জগতের সৃষ্টি করে মায়াবদ্ধ জীবদের নিজ ধামে ভগবানের কাছে ফিরে যাবার সুযোগ করে দিয়েছেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাদের যে নিত্য সম্পর্ক রয়েছে, সেই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই জীব এই প্রকৃতিতে পতিত হয়ে জড়-বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বেদের বাণী আমাদের এই শাশ্বত সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভগবদ্গীতাতে ভগবান বলেছেন- বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বদ্যেঃ', 'সমস্ত বেদে একমাত্র জানবার বিষয় হচ্ছে আমি।' বৈদিক মন্ত্রে বলা হয়েছে, 'পতিং বিশ্বস্যাত্মেশ্বরম্'- ' বিষ্ণু হচ্ছেন, সমস্ত জীবের ঈশ্বর, সমস্ত বিশ্ব চরাচরের ঈশ্বর'। শ্রীমদ্ভাগবতেও শ্রীশুকদেব গোস্বামী নানাভাবে বর্ণনা করেছেন যে, ভগবানই হচ্ছেন সব কিছুর প্রতি বা ঈশ্বর-
শ্রিয়ঃ পতির্যজ্ঞপতিঃ প্রজাপতির্ধিয়াং পতির্লোকপতির্ধরাপতিঃ। পতির্গতিশ্চান্ধকবৃষ্ণিসাত্বতাং প্রসীদতাং মে ভগবান্ সতাং পতিঃ।।
(ভাঃ ২/৪/২০)
ভগবান বিষ্ণু হচ্ছেন প্রজাপতি, তিনি সমস্ত জীবের পতি, তিনি সমস্ত সৌন্দর্যের পতি এবং তিনি সকলের ত্রাণকর্তা। তিনি এই জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন যাতে জীব যজ্ঞ অনুষ্টান করে তাঁকে তুষ্ট করতে পারে এবং তার ফলে তারা এই জড়-জগতে নিরুদ্বিগ্নভাবে সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তার পর এই জড় দেহ ত্যাগ করার পর, ভগবানের অপ্রাকৃত-লোকে প্রবেশ করতে পারে। অপার করুণাময় ভগবানের মায়াবদ্ধ জীবের জন্য এই সমস্ত আয়োজন করে রখেছেন। যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে জীব কৃষ্ণচেতনা লাভ করে এবং সর্ব বিষয়ে ভগবানের দিব্য গুণাবলী অর্জন করে। এই কলি যুগে সংকীত্তন যজ্ঞ অর্থাৎ সঙ্ঘবদ্ধভাবে উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের নাম-কীর্তন করার নির্দেশ বেদ দিয়েছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই সঙ্কীর্তন যজ্ঞের প্রবর্তন করে গেছেন যাতে এই যুগের সব জীবই এই জড়-বন্ধন মুক্ত হয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে পারে। সংকীর্তন যজ্ঞ এবং কৃষ্ণভাবনা একই সাথে চলবে। কলিযুগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে অবতরণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে সংকীর্তন যজ্ঞের প্রবর্তন করেন সে কথা শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় বলা হয়েছে,
কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং সঙ্গোপাঙ্গস্ত্রপার্ষদ্
যজ্ঞৈঃ সংকীর্তনপ্রায়ৈর্যজন্তি হি সুমেধসঃ।।
এই কলিযুগে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মনীষিরা সংকীর্তন যজ্ঞের দ্বারা পার্ষদযুক্ত ভগবান শ্রীগৌরহরির আরাধনা করবে। বেদে আর যে সমস্ত যাগযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে, সে গুলির অনুষ্টান করা এই কলি যুগে অনেকটা কষ্ট সাধ্যকর কিংবা সম্ভব নয়। কিন্তু সংকীর্তন যজ্ঞ এত সহজ এবং উচ্চস্তরের যে সকল উদ্দেশ্যে যে কেউ অনায়াসে এই যজ্ঞ অনুষ্টান করতে পারে।






দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্ত্ত বঃ ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ।।১১।।

অর্থ- এই যজ্ঞ দ্বারা তোমারা দেবগণকে (ঘৃতপ্রদানে) সংবর্ধনা কর, সেই দেবগণও (বৃষ্ট্যাদি দ্বারা) তোমাদিগকে সংবর্ধিত করুন; এই রূপে পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে।

আলোচনাঃ- ভগবান জড় জগতের দেখাশোনার ভার ন্যস্ত করেছেন বিভিন্ন দেব-দেবীর উপর। এই জড় জগতের প্রতিটি জীবের জীবন ধারনের জন্য আলো, বাতাস, জল আদির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ভগবানের তাই এই সমস্ত অকাতরে দান করেছেন এবং এই সমস্ত বিভিন্ন শক্তির তত্ত্বাবধান করার ভার তিনি দিয়েছেন বিভিন্ন দেব-দেবীর উপর, যাঁরা হচ্ছেন তাঁর দেহের বিভিন্ন অংশস্বরূপ। এই সমস্ত দেবদেবীর প্রসন্নতা ও অপ্রসন্নতা নির্ভর করে মানুষের যজ্ঞ অনুষ্টান করার উপর। ভিন্ন ভিন্ন যজ্ঞ ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর তুষ্টি সাধনের জন্য অনুষ্টিত হয়; কিন্তু তা হলেও সমস্ত যজ্ঞের যজ্ঞপতি এবং পরম ভোক্তারূপে শ্রী বিষ্ণুর আরাধনা করা হয়। ভগবদ্গীতাতেও বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা-ভোক্তারং যজ্ঞতপসাম্। তাই যজ্ঞপতির চরম তুষ্টবিধান করাই হচ্ছে সমস্ত যজ্ঞের প্রধান উদ্দেশ্য। এভাবে যজ্ঞ অনুষ্টান করলে ধন-ঐশ্বর্য লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু এই লাভগুলি যজ্ঞের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। যজ্ঞের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া। যজ্ঞ অনুষ্টানের ফলে সব রকমের কার্যকলাপ পরিশুদ্ধ হয়, তাই বেদে বলা হয়েছে- "আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাং বিপ্রমোক্ষঃ।।" যজ্ঞ অনুষ্টান করার ফলে খাদ্যসামগ্রী শুদ্ধ হয় এবং তখন সে মোক্ষ লাভের পথ খুঁজে পায়। এভাবেই জীবের চেতনা কলুষমুক্ত হয়ে কৃষ্ণভাবনার পথে অগ্রসর হয়। এই শুদ্ধ চেতনা সুপ্ত হয়ে গেছে বলেই আজকের জগৎ এই রকম বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।






ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙক্তে স্তেন এব সঃ ॥১২॥

অর্থ- যেহেতু, দেবগণ যজ্ঞাদিদ্বারা সংবর্ধিত হইয়া তোমাদিগকে অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু প্রদান করেন, সুতরাং তাহাদিগের প্রদত্ত অন্নপানাদি যজ্ঞাদি দ্বারা তাঁহাদিগকে প্রদান না করিয়া যে ভোহ করে সে নিশ্চয়ই চোর (দেবস্বাপহারী)।

আলোচনাঃ- জীবের জীবন ধারণ করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই ভগবান শ্রীবিষ্ণুরর নির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন দেব-দেবীরা সরবরাহ করছেন। তাই যজ্ঞ অনুষ্টান করে এই সমস্ত দেব-দেবীর তুষ্ট করতে শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্ত যজ্ঞেরর পরম ভোক্তা হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। যাদের ভগবান সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই, যারা অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন, বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে তাদের যজ্ঞ অনুষ্টান করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষেরা যে বিভিন্ন জড় গুণের দ্বারা প্রভাবিত, সেই অনুসারে বেদে বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন যাঁরা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত, তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণর আরাধনা করতে। আবার যারা মাংসাশী তাদের জড়া প্রকৃতির বীভৎস-রূপী কালীর পূজা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোটকথা, সমস্ত যজ্ঞের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ধীরে ধীরে জড় স্তর অতিক্রম করে অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হওয়া। আসলে আমাদের বুঝা উচিত যে এই মনুষ্য-সমাজে ভগবানের কৃপা দৃষ্টি ছাড়া একক ভাবে কোন কিছু করা সম্ভব নয়, যেমন মানব সমাজে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ফল-মূল, শাক-সবজি, দুধ, চিনি এগুলো সবই ভগবানের কৃপার ফল, সাথে আমাদের প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। আর এজন্যই ভগবান এই তৃতীয় অধ্যায় কর্মযোগে কর্মের প্রতি এতো গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের জীবন ধারনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, আলো, বাতাস, জল, খাদ্য অর্থাৎ সবই ভগবান আমাদের দিচ্ছেন।

অর্থাৎ আমাদের অগোচরে ভগবান আমাদের সমস্ত প্রয়োজনগুলি মিটিয়ে দিয়েছেন, যাতে আমরা আত্ম-উপলব্দ্ধির জন্য স্বচ্ছল জীবন যাপন করে জীবনের পরম লক্ষে পরিচালিত হতে পারি, অর্থাৎ যাকে বলা হয় জড়-জাগতিক জীবন-সংগ্রাম থেকে চিরতরে মুক্তি। আর জীবনের এই উদ্দেশ্যে সাধিত হয় যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে। সাধারণ লোকের অন্তত পঞ্চমহাযজ্ঞ নামক পাঁচটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা অবশ্যই কর্তব্য। এবার আসুন এই পঞ্চমহাযজ্ঞ সম্পর্কে আরেকটু গভীর ভাবে জানতে চেষ্টা করি-
১) ব্রহ্মযজ্ঞ (বা বেদাধ্যয়ন),
২) পিতৃযজ্ঞ (বা তর্পণ),
৩) দেবযজ্ঞ (হোম),
৪) ভূতযজ্ঞ (মনুষ্যেতর জীবের তৃপ্তিবিধান) এবং
৫) নৃযজ্ঞ (অতিথিপূজা)। অর্থাৎ প্রত্যেক মনুষ্য জীবনের জন্য এই পঞ্চমহাযজ্ঞ আবশ্যক, আর তবেই আমরা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হতে পারবো।

তবে পরবর্তীতে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সব চাইতে সহজ যজ্ঞ-সংকীর্তন যজ্ঞেরর প্রবর্তন করে গেছেন। এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান যে কেউ করতে পারে এবং তার ফলে কৃষ্ণভাবনার অমৃত পান করতে পারে। তাই আসুন সবাই মিলে বত্রিশ অক্ষরের এই হরির নাম মহা মন্ত্র মুখে উচ্চারণ করি-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।





যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ ॥১৩॥

অর্থ- ভগবাদ্ভক্তেরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহন করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।

আলোচনাঃ- গত পর্বের শ্লোকে আমরা আলোচনা করছি যে, সমাজিক-জীব হিসেবে আমাদের জীবন ধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন (আলো, বাতাস, জল, খাদ-শস্য, ফল-মূল ও শাক-সবজি) তার সবই ভগবান মিটিয়ে দিয়েছেন, যাতে আমরা আত্ম-উপলব্দ্ধির জন্য স্বচ্ছল জীবন যাপন করে জীবনের পরম লক্ষে পরিচালিত হতে পারি। তাছাড়া আমরা আলোচনা করছি পঞ্চমহাযজ্ঞ সম্পর্কে। এখন আমরা এই শ্লোকে আলোচনা করবো, ভগবানের দেওয়া সে প্রদত্ত খাদ্য আমাদের কিভাবে আহার করা উচিত।

এই শ্লোকের দ্বিতীয় শব্দটি হলো 'সন্তো' অর্থাৎ যে ভগবদ্ভক্ত কৃষ্ণভাবনামৃত পান করেছেন, তাঁকে বলা হয় সন্ত। তিনি সব সময় ভগবানের চিন্তায় মগ্ন। ব্রহ্মসংহিতাতে (৫/৮) তার বর্ণনা করে বলা হয়েছে- প্রমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তিবিলোচনেন সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি। যেহেতু সন্তগণ সদাসর্বদাই পরম পুরুষোত্তম ভগবান গোবিন্দ ( আনন্দ প্রদানকারী) অথবা মুকুন্দ (মুক্তিদাতা) অথবা শ্রীকৃষ্ণ (সর্বাকর্ষক পুরুষ)- এর ভক্তির প্রেমে মগ্ন থাকেন, সে জন্য তাঁরা ভগবানকে প্রথমে অর্পন না করে কোন কিছুই গ্রহণ করেন না। তাই, এই ধরনের ভক্তেরা শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, অর্চন আদি বিবিধ ভক্তির অঙ্গের দ্বারা সর্বক্ষণই কলুষতার দ্বারা প্রভাবিত হন না। অন্য সমস্ত লোকেরা, যারা আত্মতৃপ্তির জন্য নানা রকম উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত করে খায়, শাস্ত্রে তাদের চোর ও পাপী বলে গণ্য করা হয়েছে। যে মানুষ চোর ও পাপী সে কি করে সুখী হতে পারে? তা কখনই সম্ভব নয়। তাই সর্বতোভাবে সুখী হবার জন্য তাদের কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সং কীর্তন যজ্ঞ করার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে, এই পৃথিবীতে সুখ ও শান্তি লাভের কোন আশাই করা যায় না।






অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ ।
যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ ॥১৪॥

অর্থ- অন্ন খেয়ে প্রাণীগণ জীবন ধারণ করে৷ বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয় ৷ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়।

আলোচনাঃ- এই শ্লোকের আলোচনার অংশটুকু লিখতে গিয়ে মনে হলো পুরো বিষয়টির সারমর্ম খানিকটা জীববিজ্ঞানের খাদ্যশৃঙ্খলের মত। দেব-দেবী, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী জগৎ, উদ্ভিদ, খাদ্যদ্রব্য, ফল-মূল, শাক-সবজি, আলো-বাতাস, বৃষ্টি ইত্যাদি একটি শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে পরিচালিত হচ্ছে যার নিয়ন্ত্রণ কর্তা পরম করুণাময়ী সৃষ্টি কর্তা। শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ ভগবদ্গীতার ভাষ্যে লিখেছেন- যে ইন্দ্রাদ্যঙ্গতয়াবস্থিতং যজ্ঞং সর্বেশ্বরং বিষ্ণুমভ্যর্চ্য তচ্ছেষমশ্নন্তি তেন তদ্দেহ যাত্রাং সম্পাদয়ন্তি, তে সন্তঃ সর্বেশ্বরস্য যজ্ঞপরুষস্য ভক্তাঃ সর্বকিল্বিষৈরনাদিকালবৈবৃদ্ধৈরাত্মানুভব- প্রতিবন্ধকৈর্নিখিলৈঃ পাপর্বিমুচ্যন্তে। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন যজ্ঞপুরুষ, অর্থাৎ সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা হচ্ছেন তিনিই। তিনি হচ্ছেন সমস্ত দেব-দেবীরও ঈশ্বর। ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ আদি দেবতাদের ভগবান নিযুক্ত করেছেন জড় জগৎকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য এবং বেদে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিভাবে যজ্ঞ করার মাধ্যমে এই সমস্ত দেবতাদের সন্তুষ্ট করা যায়। এভাবে সন্তুষ্ট হলে তাঁরা আলো, বাতাস, জলাদি দান করেন, যার ফলে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়। আমরা জানি যে, ভগবানের আরাধনা করা হলে ভগবানের অংশ-বিশেষ দেব-দেবীরাও সেই সঙ্গে পূজিত হন। এই কারণে, কৃষ্ণভাবনাময় ভগবানের ভক্তেরা ভগবানকে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নিবেদন করে তারপর তা গ্রহণ করেন। তার ফলে দেহে চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়। এইভাবে যাঁরা অনুশীলন করেন, তাঁদেরকে ভগবদ্ভক্ত বলা হয়। খাদ্য-শস্য, শাক-সবজি, ফল-মূলই হচ্ছে মানুষের প্রকৃত আহার্য, আর পশুরা মানুষের উচ্ছিষ্ট ও ঘাস, লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে। অন্যদিকে, আকাশ থেকে বৃষ্টি হবার ফলে মাঠে ফসল হয়। এই বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ করেন ইন্দ্র, সূর্য আদি দেবতারা। এঁরা সকলেই হচ্ছেন ভগবানের আজ্ঞাবাহক ভৃত্য। তাই যজ্ঞ করে ভগবানকে তুষ্ট করলেই তাঁর ভৃত্যেরাও তুষ্ট হন এবং তাঁরা তখন সমস্ত অভাব মোচন করেন। তবে এই যুগের জন্য নির্ধারিত যজ্ঞ হচ্ছে সংকীর্তন যজ্ঞ, তাই অন্ততপক্ষে খাদ্য সরবরাহের অভাব-অনটন থেকে রেহাই পেতে গেলে, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে এই যজ্ঞ অনুষ্টান পালন করা।





কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্ ।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥১৫॥

অর্থ- যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।

আলোচনাঃ- পূর্বের শ্লোকে আলোচনার অংশে আমরা তুলে ধরছিলাম যে, দেব-দেবী, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী জগৎ, উদ্ভিদ, খাদ্যদ্রব্য, ফল-মূল, শাক-সবজি, আলো-বাতাস, বৃষ্টি ইত্যাদি একটি শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে পরিচালিত হচ্ছে যার নিয়ন্ত্রণ কর্তা পরম করুণাময়ী সৃষ্টি কর্তা। আর এই শ্লোকে আমরা আলোচনা করবো যজ্ঞাদি কর্ম, পবিত্র বেদ এবং অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান সম্পর্কে, যেখানে পরমেশ্বর ভগবান সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত। যজ্ঞার্থাৎ কর্মণঃ অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করার জন্যই যে কর্ম করা প্রয়োজন, সেই কথা এই শ্লোকটিতে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যজ্ঞপরুষ শ্রীবিষ্ণুর সন্তুষ্টির জন্যই যখন আমাদের কর্ম করতে হয়, তখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে বেদের নির্দেশ অনুসারে সমস্ত কর্ম সাধন করা। বেদে সমস্ত কর্মপদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে। যে কর্ম বেদে অনুমোদিত হয়নি, তাকে বলা হয় বিকর্ম বা পাপকর্ম। তাই বেদের নির্দেশ অনুসারে সমস্ত কর্ম করাটাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ, তাতে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত থাকা যায়। বেদের সমস্ত নির্দেশগুলি সরাসরি ভগবানের নিঃশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- অস্য মহতো ভূতস্য নিশ্বসিতমেতদ্ যদ্ ঋগ্বেদো যজুবদেঃ সামবেদোহথর্বাঙ্গিরসঃ। "ঋগ্বেদ, যহুবের্দ, সামবেদ ও অর্থর্ববেদ এই সবব কয়টি বেদই ভগবানের নিঃশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয়েছে।" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৫/১১) ভগবান সর্বশক্তিমান, তিনি নিঃশ্বাসের দ্বারাও কথা বলতে পারেন। ব্রহ্মসংহিতাতে বলা হয়েছে, সর্বশক্তিমান ভগবান তাঁর যে কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সব কয়টি ইন্দ্রিয়ের কাজ করতে পারেন।

প্রকৃতপক্ষে, ভগবান জড়া প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং তার ফলে সমস্ত বিশ্ব-চরাচরে প্রানের সঞ্চার হয়য়। আমাদের মনে রাখা উচিত, এই জড় জগতে প্রতিটি বদ্ধ জীবই জড় সুখ ভোগ করতে চায়। কিন্তু বৈদিক নির্দেশাবলী এমনভাবে রচিত হয়েছে যে, আমরা যেন আমাদের কিকৃত বাসনাগুলিকে পরিতৃপ্ত করতে পারি, তারপর তথাকথিত সুখভোগ পরিসমাপ্ত করে ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারি। জড় জগতের দুঃখময় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য ভগবান জীবকে এভাবে করুণ করেছেন। তাই, প্রতিটি জীবের কর্তব্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সংকীর্তন যজ্ঞ করা। যারা বৈদিক নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করতে পারে না, তারা যদি কৃষ্ণচেতনা বা কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারে তবে তারাও বৈদিক যজ্ঞের সমস্ত সফলগুলি প্রাপ্ত হবে।







এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি ॥১৬॥

অর্থ- হে অর্জুন ! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।

আলোচনাঃ- আলোচনার শুরুতে বলতে চাই যে, এই মানব জীবনে যজ্ঞ অনুষ্ঠান কতটা গুরত্বপূর্ণ তা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার কর্মযোগ নামক অধ্যায়ের শ্লোক গুলো এবং তাঁর অর্থ ও বিশ্লেষণ পাঠ না করে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব না। যেহেতু সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। বৈষয়িক জীবন-দর্শন অনুযায়ী, অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা অর্থ উপার্জন করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার যে অর্থহীন প্রচেষ্টা, তা অতি ভয়কংর পাপের জীবন বলে ভগবান তা পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই, যারা জড়-জাগতিক সুখ ভোগ করতে চায়, তাদের এই সমস্তত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা অবশ্য কর্তব্য।

একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন যে উপরের আলোচনা অংশের শেষ বাক্যটির মধ্যে আজকের শ্লোকের মূল তাৎপর্য বিদ্যমান। যেহেতু শ্লোকের অর্থ এমন যে, হে অর্জুন ! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন, যেসব ব্যক্তি শুধু জড়-জাগতিক সুখ ভোগ নিয়ে ব্যস্ত থাকে অথচ যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না তারা ক্রমশই অধঃপতিত হচ্ছে। অর্থাৎ যে সমস্ত মানুষ কামনা বাসনার বন্ধনে আবদ্ধ এবং ইন্দ্রিয়য়সুখ ভোগ করতে চায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের জন্য যজ্ঞের প্রবর্তন করেছেন। যাতে তারা তাদের পাপের ভার কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারে এবং ক্রমান্বয়ে সৎগতি লাভ হয়ে সাত্ত্বিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। আমরা জানি যে, যজ্ঞ-অনুষ্ঠান করতে করতে জীবের অন্তরে কৃষ্ণভক্তির সঞ্চার ঘটে। কিন্তু যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা সত্ত্বেও যদি জীবের অন্তরে কৃষ্ণভক্তির উদয় না হয়, তবে বুঝতে হবে তার মধ্যে একনিষ্ঠতা ও ভক্তির অভাব রয়েছে এবং উক্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠানটি কেবল উদ্দেশ্যহীন নৈতিক আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়। তাই প্রতিটি মানব জীবনের কর্তব্য হচ্ছে, বেদের নির্দেশগুলিকে কেবল নৈতিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমিত না রেখে, তার মাধ্যমে কৃষ্ণভক্তি লাভের চেষ্টা করা।

অন্তলগ্নে আরেকটি বিষয় বলতে চাই, অনেকের এই শ্লোক এবং শ্লোকের অর্থ-আলোচনা পাঠ করে মনে হতে পারে যে, ভগবান তাহলে যজ্ঞ অনুষ্ঠান পালন শুধু জড়-জাগতিক সুখ ভোগের আশা যারা করে তাদের জন্য বিধান করেছেন কিন্তু তা ভাবা নিতান্ত ভুল হবে। তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনারা যদি পূর্বের শ্লোক গুলির অর্থ পাঠ করেন তাহলে আপনাদের এই ভুল ভাবনাটা আশাকরি দূর হবে। বিশেষ করে এই অধ্যায়ের এগারতম শ্লোকের অর্থ বুঝলে যেখানে তিনি সকলের উদ্দেশ্য করে বলেছেন- এই যজ্ঞ দ্বারা তোমারা দেবগণকে (ঘৃতপ্রদানে) সংবর্ধনা কর, সেই দেবগণও (বৃষ্ট্যাদি দ্বারা) তোমাদিগকে সংবর্ধিত করুন; এই রূপে পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে।।







যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ ।
আত্মন্যেব চ সন্ত্তষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে ॥১৭॥

অর্থ-কিন্তু যে ব্যক্তি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁর কোন কর্তব্যকর্ম নেই।

আলোচনাঃ- যিনি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় এবং কৃষ্ণসেবায় যিনি সম্পূর্ণ মগ্ন, তাঁর অন্য কোন কর্তব্য নেই। কৃষ্ণভক্তি লাভ করার ফলে তাঁর অন্তরে সম্পূর্ণভাবে কলুষমক্ত হয়ে পবিত্র হয়েছে। হাজার হাজার যজ্ঞ অনুষ্ঠানেও যে ফল লাভ করা যায় না, কৃষ্ণভক্তির প্রভাবে তা মুহূর্তের মধ্যে সাধিত হয়। এভাবে চেতনা শুদ্ধ হলে জীবব পরমেশ্বরের সঙ্গে তাঁর নিত্যকালের সম্পর্ক উপলব্ধিই করতে পারে। তখন ভগবানের কৃপায় তাঁর কর্তব্যকর্ম স্বয়ং জ্ঞানালোকিত হয় এবং তাই তিনি আর বৈদিক নির্দেশ অনুসারে কর্তব্য-অকর্তব্যের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। এই রকম কৃষ্ণভক্ত জীবের আর জড় বিষয়াসক্তি থাকে না এবং কামিনী-কাঞ্চনের প্রতি তাঁর কোন মোহ থাকে না।







নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন ।
ন চাস্য সর্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ ॥১৮॥

অর্থঃ- আত্মনন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির এই জগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই প্রকার কর্ম না করারও কোন কারণ নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না।

আলোচনাঃ- যে মানুষ তার স্বরূপ উপলব্ধি করে জানতে পেরেছেন যে,তিনি হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস,তিনি আর সামাজিক কর্তব্য-অকর্তব্য এর গন্ডিতে আবদ্ধ থাকেন না। কারণ,তিনি তখন বুঝতে পারেন,শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাটাই হচ্ছে একমাত্র কর্তব্যকর্ম । অনেকে আত্মজ্ঞঅন লাভ করার নাম করে কর্মহীন আলস্যপূর্ণ জীবন-যাপন করে। কিন্তু পরবর্তী শ্লোকে ভগবান আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন,নিষ্কর্মা ,অলস লোকেরা কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারে না । কারন,কৃষ্ণভক্তি মানে হচ্ছে কৃষ্ণসেবা,শ্রীকৃষ্ণের দাসত্ব করা,তাই কৃষ্ণভক্ত একটি মূহুর্তকেও নষ্ট হতে দেন না । তিনি প্রতিমূহুর্তে ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। অন্যান্য দেব-দেবীদের পূজা করাটাও কর্তব্য বলে ভগবানের ভক্ত মনে করেন না । কারন, তিনি জানেন ,কেবল ভগবানের সেবা করলেই সকলের সেবা করা হয়।







তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর ।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ ॥১৯।।

অর্থঃ- অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর৷ অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে ৷

আলোচনাঃ- নির্বিশেষবাদী জ্ঞানী মুক্তি চান,কিন্তু ভক্ত কেবল পরম পুরুষ ভগবানকে চান । তাই সদগুরুর তত্ত্বাবধানে যখন কেউ ভগবানের সেবা করেন,তখন মানব জীবনের পরম উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে বললেন,কারন সেটি ছিল তাঁর ইচ্ছা। সৎ কর্ম করে অহিংসা ব্রত পালন করে ভাল মানুষ হওয়া টাই স্বার্থপর কর্ম,কিন্তু সৎ-অসৎ,ভাল-মন্দ,ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিচার না করে ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করাটাই হচ্ছে বৈরাগ্য । এটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম;ভগবান নিজেই সেই উপদেশ দিয়ে গেছেন।
বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান,যাগ-যজ্ঞ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্দ্রিয় উপভোগ জনিত অসৎ কর্মের কুফল থেকে মুক্ত হওয়া। কিন্তু ভগবানের সেবায় যে কর্ম সাধিত হয় ,তা অপ্রাকৃত কর্ম এবং তা শুভ-অশুভ কর্মবন্ধনের অতীত। কৃষ্ণভক্ত যথন কোন কর্ম করে; তা তিনি ফল ভেঅগ করার জন্য করেন না,তা তিনি করেন কেবল শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য। ভগবানের সেবা করার জন্য তিনি সব রকমের কর্ম করেন,কিন্তু সেই সমস্ত কর্ম থেকে তিনি সম্পূর্ন নিঃস্পৃহ থাকেন।





কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি ॥২০॥


অর্থঃ- জনক আদি রাজরাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন ৷ অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।

আলোচনাঃ- জনক রাজা আদি মহাজনেরা ছিলেন ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞানী,তাই বেদের নির্দেশ অনুসারে নানা রকম যাগ-যজ্ঞ করার বাধ্য বাধকতা তাঁদের ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকশিক্ষার জন্য তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমস্ত বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান করতেন। জনক রাজা ছিলেন সীতাদেবীর পিতা এবং শ্রীরামচন্দ্রের শ্বশুড়। ভগবানের অতি অন্তরঙ্গা ভক্ত হবার ফলে তিনি চিন্ময় জগতে অধিষ্ঠিত ছিলেন,কিন্তু যেহেতু তিনি মিথিলার রাজা ছিলেন,তাই তার প্রজাদের শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য তিনি শাস্ত্রোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তেমনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তার চিরন্তন সখা অর্জুনের পক্ষে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করার কোন দরকার ছিল না,কিন্তু সদুপদেশ ব্যর্থ হলে হিংসা অবলম্বনেরও প্রয়োজন আছে, এই কথা সাধারন লোকদের বোঝানোর জন্যই তাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে ,শান্তি স্থাপন করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল,এমন কি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেও বহু চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু দুরাত্মারা যুদ্ধ করতেই বদ্ধপরিকর। এই রূপ অবস্থায় যথার্থ কারণে হিংসার আশ্রয় নিয়ে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়াটাই অবশ্য কর্তব্য। যদিও কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তের জড় জগতের প্রতি কোন রকম স্পৃহা নেই,কিন্তু তবুও তিনি সাধারন মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য কর্তব্যকর্মগুলি সম্পাদন করেন। অভিজ্ঞ কৃষ্ণভক্ত এমনভাবে কর্ম করেন,যাতে সকলে তাঁর অনুগামী হয়ে ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে। সেই কথাই পরবর্তী শ্লোকে বলা হয়েছে।






যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে ॥২১॥

অর্থঃ- শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে ভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারই অনুসরণ করে।

আলচনাঃ- সাধারণ মানুষদের এমনই একজন নেতার প্রয়োজন ,যিনি নিজের আচারনের মাধ্যমে তাদেরকে শিক্ষা দিতে পারেণ। যে নেতা নিজেই ধুমপানের প্রতি আসক্ত,তিনি জনসাধারণকে ধূমপান থেকে বিরত হবার শিক্ষা দিতে পারেন না । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন,শিক্ষা দেওয়া শুরু করার আগেই শিক্ষকের সঠিক ভাবে আচারণ করা উচিত। এভাবেই যিনি শিক্ষা দেন,তাকে বলা হয় আচার্য অথবা আদর্শ শিক্ষক। তাই জনসাধারনকে শিক্ষা দিতে হলে শিক্ষককে অবশ্যইশাস্ত্রের আদর্শ অনুসরণ করে চলতে হবে।কেউ যদি মনগড়া কথা নিয়ে শিক্ষক হতে চায়,তাতে কোন লাভ তো হয়ই না বরং ক্ষতি হয়। মনুসংহিতা ও এই ধরনের শাস্ত্রে ভগবান নিখুঁত সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলাই শিক্ষা দিয়ে গেছেন এবং এই সমস্ত শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে সমাজকে গড়ে তোলাই হচ্ছে মানুষের কর্তব্য। এভাবেই নেতাদের শিক্ষা এই ধরনের আদর্শ শাস্ত্র অনুযায়ী হওয়া উচিত । যিনি নিজের উন্নতি কামনা করেন,তাঁর আর্দশ নীতি অনুসরণ করা উচিত,যা মহান আচার্যেরা অনুশীলন করে থাকেন।

শ্রীমদ্ভাগবতেও বলা হয়েছে,পূর্বতন মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জীবণযাপন করা উচিত,তা হলেই পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভ করা যায়। রাজা ,রাষ্ট্রপ্রধান,পিতা,শিক্ষক হচ্ছেন স্বাভাবিকভাবেই নিরীহ জনগনের পথপ্রদর্শক । জরসাধারণকে পরিচালনা করার মহৎ দায়িত্ব তাঁদের উপরে ন্যস্ত হয়েছে। তাই তাঁদের উচিত,শাস্ত্রের বানী উপলব্ধি করে,শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জনসাধারণকে পরিচালিত করেেএক আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা। এটি কোন কঠিন কাজ নয়,কিন্তু এর ফলে যে সমাজ গড়ে উঠবে,তাতে প্রতিটি মানুষের জীবণ সার্থক হবে।






ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন ।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি ॥২২॥

আর্থঃ- হে পার্থ ! এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই৷ তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।

আলোচনাঃ- আলোচনার শুরুতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই ত্রিভূবনে কোন কর্তব্য নেই বলতে গিয়ে সেই পরমেশ্বর অর্থাৎ বৈদিক শাস্ত্রে পুরুষোত্তম ভগবানের বর্ণনা করে বলা হয়েছে-
তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং
তং দেবতানাং পরমং চ দৈবতম্ ।
পতিং পতীণাং পরমং পরস্তাদ্
বিদাম দেবং ভুবনেশমীড্যম্ ।।
ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে
ন তৎ সমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে ।
পরাস্য শক্তিবিবিধৈব শ্রৃয়তে
স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ ।।
“ভগবান হচ্ছেন ঈশ্বরদেরও পরম ঈশ্বর এবং দেবতাদের পরম দেবতা । সকলেই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন।তিনি সকলকে ভিন্ন ভিন্ন শক্তি দান করেন;তাঁরা কেউই পরম ঈশ্বর নয়।তিনি সমস্ত দেবতাদের পূজ্য এবং তিনি হচ্ছেন সমস্ত পতিদের পরম পতি । তিনি হচ্ছেন জড়জগতের সমস্ত অধিপদি ও নিয়ন্তার অতীত,সকলের পূজ্য।তাঁর থেকে বড় আর কিছুই নেই,তিনি হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ।
“তার দেহ সাধারণ জীবের মতো নয়। তাঁর দেহ এবং তাঁর আত্মার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ।তিনি হচ্ছেন পূর্ণ,তাঁর ইন্দ্রিয়গুলো অপ্রাকৃত। তাঁর প্রতিটি ইন্দ্রিয়ই যে-কোন ইন্দ্রিয়ের কর্ম সাধন করতে পারে। তাঁর শক্তি অসীম ও বহুমুখী, তাই তাঁর সমস্ত কর্ম স্বাভাবিক ভাবেই সাধিত হয়ে যায়।” (শ্বেতাশ্বর উপনিষদ ৬/৭-৮)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত ঐশ্বর্যের অধীশ্বর এবং তিনি হচ্ছেন পরমতত্ত্ব,তাই তাঁর কোন কর্তব্য নেই। কর্মের ফল যাদের ভোগ করতে হয়, তাদের জন্যই কর্তব্যকর্ম করার নির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু এই ত্রিবুবনে যাঁর কিছুই কাম্য নেই তাঁর কোন কর্তব্যকর্ম নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভগবান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেছেন, কেন না দুর্বলদের রক্ষা করা ক্ষত্রিয়দের কর্তব্য। যদিও তিনি শাস্ত্রে বিধি-নিষেদের অতীত,কিন্তু তবুত্ত তিনি শাস্ত্রের নির্দেশ লংঘন করেন না ।





যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ ॥২৩॥

অর্থঃ- হে পার্থ ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।

আলোচনাঃ- আমরা জানি যে পারমার্থিক উন্নতি লাভের জন্য সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয় এবং এভাবে সমাজকে গড়ে তোলবার জন্য প্রতিটি সভ্য মানুষকে নিয়ম শৃঙ্খংলা অনুসরণ করে সুসংযত জীবন যাপন করতে হয়। এই সমস্ত নিয়মকানুনের বিধিনিষেধের অনুষ্ঠান কেবল বদ্ধ জীবদের জন্য,ভগবানের জন্য নয়। যেহেতু তিনি ধর্মনীতি প্রবর্তনের জন্য অবতরণ করেছিলেন।
ভগবান এখানে বলেছেন,যদি তিনি সমস্ত বিধি-নিষেদ আচরন না করে; তবে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলেই যথেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। শ্রীমদ্ভাগবত থেকে আমরা জানতে পারি, এই পৃথিবীতে অবস্থান করার সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঘরে-বাইরে সর্বত্র গৃহস্থোচিত সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেছিলেন।





উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্॥
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ॥২৪॥


অর্থঃ- আমি যদি কর্ম না করি, তা হলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হবে। আমি বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির কারণ হব এবং তার ফলে আমার দ্বারা সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হবে।

আলোচনাঃ- বর্ণসঙ্কর হবার ফলে অবাঞ্ছিত মানুষে সমাজ ভরে ওঠে এবং তার ফলে শান্তি-শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়। এই ধরনের সামাজিক উপদ্রব রোধ করার জন্য শাস্ত্রে নানা রকমের বিধি নির্দেশ দেয়া হয়েছে,যা অনুসরণ করার ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই শান্তিপ্রিয় এবং সুস্থ মনোভাবাপন্ন হয়ে ভগদ্ভক্তি লাভ করতে পারে । ভগবান যখন এই পৃথিবীতে অবতরণ করেন,তখন তিনি জীবের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য এই সমস্ত শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধের তাৎপর্য ও তাদের একান্ত প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষকে বুঝিয়ে দেন। ভগবান হচ্ছেন সমস্ত জগতের পিতা ,তাই জীব যদি বিপথগামী হয়ে পথভ্রষ্ট হয়,পক্ষান্তরে ভগবানই তার জন্য দায়ী হন। তাই,মানুষ যখন শাস্ত্রের অনুশাসন মেনে যথেচ্ছাচার করতে শুরু করে,তখন ভগবান নিজে অবতরণ করে পুনরায় সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন।

তেমনই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভগবানের পদাঙ্ক অনুসরণ করাই আমাদের কর্তব্য,ভগবাণকে অনুকরণ করা কোন অবস্থাতেই আমাদের উচিত নয়। অনুসরণ করা আর অনুকরণ করা একই পর্যাভুক্ত নয়। ভগবান তার শৈশবে গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরেছিলেন,কিন্তু তাঁকে অনুকরণ করে ভগবান হবার চেষ্টা করা মূর্খতারই নামান্তর। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে,তাঁকে অনুসরণ করে আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া,কোন অবস্থাতেই তাঁর অস্বাভাবিক লীলার অনুকরণ করা আমাদের কর্তব্য নয় ।





সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত ।
কুর্যাদ্ বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্ ॥২৫॥

অর্থঃ- হে ভারত ! অজ্ঞানীরা যেমন কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, তেমনই জ্ঞানীরা অনাসক্ত হয়ে, মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করবেন।

আলোচনাঃ- কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত এবং কৃষ্ণবিমুখ ভক্তের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে তাদের মনোবৃত্তির পার্থক্য। কৃষ্ণভাবনার উন্নতি সাধনের পক্ষে যা সহায়ক নয়,কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত সেই সমস্ত কর্ম করেন না। অবিদ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মায়ামুগ্ধ জীবের কর্ম আর কৃষ্ণভাবনাময় মানুষের কর্মকে অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে একই রকমের মনে হয়,কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় মানুষ তার কর্ম করে শ্রীকৃষ্ণের তৃপ্তি সাধন করার জন্য। তাই মানব-সমাজে কৃষ্ণভাবনাময় মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজন,কেন না তাঁরাই মানুষকে জীবনকে প্রকৃত গন্তব্যস্থলের দিকে পরিচালিত করতে পারেন।কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীব জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধির চক্রে পাক খাচ্ছে; সেই কর্মকে কিভাবে শ্রীকৃষের শ্রীচরণে অর্পণ করা যায়,তা কেবল তাঁরাই শেখাতে পারেন।






ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্ ।
জোষয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ ॥২৬॥

অর্থঃ- জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করবেন না। বরং, তাঁরা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করবেন।

আলোচনাঃ- বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদাঃ। সেটিই হচ্ছে বেদের শেষ কথা। বেদের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান,যাগ-যজ্ঞ আদি এমনকি জড় কার্যকলাপের সমস্ত নির্দেশাদির একমাত্র উদ্দেশ্যে হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা।যেহেতু বদ্ধ জীবেরা তাদের জড় ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির অতীত কোন কিছু জানে না,তাই তারা সেই উদ্দেশ্যে বেদ অধ্যয়ন করে। কিন্তু বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের বিধি-নিষেধের দ্বারানিয়ন্ত্রিত হয়ে সকাম কর্ম ও ইন্দ্রিয়-তর্পণের মাধ্যমে মানুষ ক্রমান্বয়ে কৃষ্ণভাবনায় উন্নীত হয়। তাই কৃষ্ণ-তত্ত্ববেত্তা কৃষ্ণভক্ত কখনই অপরের কার্যকলাপের মাধ্যমে শিক্ষা দেন,কিভাবে সমস্ত কর্মের ফল শ্রীকৃষ্ণের সেবায় উৎসর্গ করা যেতে পারে।
অভিজ্ঞ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত এমনভাবে আচরন করেন,যার ফলে ইন্দ্রিয়-তর্পণে রত দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন অজ্ঞ লোকেরাও উপলব্ধি করতে পারে,তাদের কি করা কর্তব্য । যদিও কৃষ্ণভাবনাহীন অজ্ঞ লোকদের কাজে বাধা দেওয়া উচিত নয়,তবে অল্প উন্নতিপ্রাপ্ত কৃষ্ণভক্ত বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানের বিধির অপেক্ষা না করে সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত হতে পারে। এই ধরনের ভাগ্যবান লোকের পক্ষে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের আচরণ করার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না,কারন শ্রীকৃষ্ণের সেবা করলে আর কোন কিছুই করার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। ভগবৎ-তত্ত্ববেত্তা সদগুরুর নির্দেশ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করলে সর্বকর্ম সাধিত হয়।





প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে ॥২৭॥

অর্থঃ- অন্ধকারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে 'আমি কর্তা'- এই রকম অভিমান করে।

আলোচনাঃ- কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত ও দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন বিষয়ী,এদের দুজনের কর্মকে আপাতদৃষ্টিতে একই পর্যায়ভুক্ত বলে মনে হতে পারে,কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে এক অসীম ব্যবধান রয়েছে । যে দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন,সে অহঙ্কারে মত্ত হয়ে নিজেকেই সব কিছুর কর্তা মনে করে। সে জানে না যে,তার দেহের মাধ্যমে যে সমস্ত কর্ম সাধিত হচ্ছে,তা সবই হচ্ছে প্রকৃতির পরিচালনায় এবং এই প্রকৃতি পরিচালিত হচ্ছে শ্রী ভগবানের নির্দেশ অনুসারে। জড়-জাগতিক মানুষ বুঝতে পারে না যে, সে সর্বতোভাবে ভগবানের নিয়ন্ত্রাধীন। অহঙ্কারের প্রভাবে বিমূঢ় যে আত্মা,সে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে ভাবে,সে স্বাধীনভাবে কর্ম করে চলছে,তাই সমস্ত কৃতিত্ব সে নিজেই গ্রহণ করে। এটিই হচ্ছে অজ্ঞাতার লক্ষণ। সে জানে না,এই স্থূল ও সূক্ষ্ণ দেহটি পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নির্দেশে জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি এবং সেই জন্যই কৃষ্ণ ভাবনায় অধিষ্ঠিত হয়ে তার দৈহিক ও মানসিক সমস্ত কাজই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করতে হবে। দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভুলে যায় যে,ভগবান হচ্ছেন হৃষীকেশ,অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্তা। বহুকাল ধরে তার ইন্দ্রিয়গুলি অপব্যবহারের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার ফলে মানুষ বাস্তবিকপক্ষে অহঙ্কারের দ্বারা বিমোহিত হয়ে পড়ে এবং তারই ফলে সে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার নিত্য সম্পর্কের কথা ভুলে যায়।





তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্মবিভাগয়োঃ ।
গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে ॥২৮॥

অর্থঃ- হে মহাবাহো ! তত্বজ্ঞ ব্যক্তি ভগবদ্ভক্তিমুখী কর্ম ও সকাম কর্মের পার্থক্য ভালভাবে অবগত হয়ে, কখনও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগাত্মক কার্যে প্রবৃত্ত হন না।

আলোচনাঃ- যিনি তত্ত্ববেত্তা,তিনি উপলব্ধি করেন যে জড়া প্রকৃতির সংস্রবে তিনি প্রতিনিয়ত বিব্রত হয়ে আছেন। তিনি জানেন যে,তিনি হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই জড়া প্রকৃতি তার প্রকৃত আলয় নয়। সচ্চিদানন্দময় ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে তিনি তাঁর প্রকৃত স্বরূপও জানেন। তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে,কোন না কোন কারণে তিনি দেহাত্মবুদ্ধিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন।তাঁর শুদ্ধ স্বরূপে তিনি হচ্ছেন ভগবানের নিত্য দাস এবং ভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় সমস্ত কর্ম করাই হচ্ছে তাঁর কর্তব্য।তাই তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কার্যকলাপে নিজেকে সম্পূর্নভাবে নিয়োজিত করেন এবং তার ফলে স্বভাবতই তিনি আনুষঙ্গিক অনিত্য জড় ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপের প্রতি অনাসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি জানেন যে,ভগবানের ইচ্ছার ফলেই তিনি জড় জগতে পতিত হয়েছেন,তাই এই দুঃখময় জড় জগতের কোন দুঃখকেই তিনি দুঃখ বলে মনে করেন না,পক্ষান্তরে তিনি তা ভগবানের আর্শীবাদে বলে মনে করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে,যিনি ভগবানের তিনটি প্রকাশ-ব্রহ্ম,পরমাত্মা ও ভগবান সম্বন্ধে জানেন,তাঁকে বলা হয় তত্ত্ববিদ্,কারন ভগবানের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্কের কথা তিনি জানেন ।






প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়া সজ্জন্তে গুণকর্মসু ।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ ॥২৯॥

অর্থঃ- জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে, অজ্ঞান ব্যক্তিরা জাগতিক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু তাদের কর্ম নিকৃষ্ট হলেও তত্বজ্ঞানী পুরুষেরা সেই মন্দবুদ্ধি ও অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণকে বিচলিত করেন না।

আলোচনাঃ- যারা অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন,তারা তাদেরজড় সত্তাকে তাদের স্বরূপ বলে মনে করে,তার ফলে তারা জড় উপাধির দ্বারা ভূষিত হয়। এই দেহটি জড়া প্রকৃতির উপহার । এই জড় দেহের সঙ্গে যারা গভীর ভাবে আসক্ত,তাদের বলা হয়ে মন্দ,অথার্ৎ তারা হচ্ছে আত্ম-তত্ত্বজ্ঞঅন রহিত অলস ব্যক্তি।
মূর্খ লোকেরা তাদের জড় দেহটিকে তাদের আত্মা বলে মনে করে; এই দেহটিকে কেন্দ্র করে যেসব মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে,তাদেরকে তারা আত্মীয় বলে স্বীকার করে,যে দেশে তারা জন্ম নিয়েছে অর্থাৎ যে দেশে তারা তাদের জড় দেহটি প্রাপ্ত হয়েছে, সেটি তাদের দেশ আর সেই দেশেকে তারা পূজা করে এবং তাদের অনুকূলে কতকগুলি সংস্কারের অনুষ্ঠান করাকে তারা ধর্ম বলে মনে করে। সমাজ সেবা,জাতীয়তাবাদ, পরমার্থবাদ আদি হচ্ছে এই ধরনের জড় উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিদের কতকগুলি আদর্শ। এই সমস্ত আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা নানা রকম জাগতিক কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা মনে করে,ভগবানের কথা হচ্ছে রূপকথা,তাই ভগবানকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় তাদের নেই। এই ধরনের মোহাচ্ছন্ন মানুষেরা অহিংসা-নীতি আদি দেহগত হিতকর কার্যে ব্রতী হয়,কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় না। পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করে যাঁরা তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ আত্মাকে জানতে,তাঁরা এই সমস্ত দেহসর্বস্ব মানুষদের কাজে কোন রকম বাধা দেন না,পক্ষান্তরে তাঁরা নিঃশ্বব্দে তাঁদের পারমার্থিক কর্ম ভগবানের সেবা করে চলেন।

যারা অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন,তারা ভগবদ্ভক্তির মর্ম বোঝে না।তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন,তাদের মনে ভগবদ্ভক্তির সঞ্চার করার চেষ্টা করে অনর্থক সময় নষ্ট না করতে। কিন্তু ভগবানের ভক্তরা ভগবানের চাইতেও বেশি কৃপালু,তাই তাঁরা নানা রকম দুঃখকষ্ট মহ্য করে,সমস্ত বিপদকে অগ্রাহ্য করে,সকলের অন্তরে ভগবদ্ভক্তির সঞ্চার করতে চেষ্টা করেন। কারণ,তাঁরা জানেন যে,মনুষ্যজন্ম লাভ করে ভগবদ্ভক্তি সাধন না করলে,সেই জন্ম সম্পূর্ন বৃথা।






ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা ।
নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ॥৩০॥

অর্থঃ- অতএব, হে অর্জুন ! আধ্যাত্মচেতনা-সম্পন্ন হয়ে তোমার সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ কর এবং মমতাশুন্য, নিষ্কাম ও শোকশূন্য হয়ে তুমি যুদ্ধ কর।

আলোচনাঃ- এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে ভগবদগীতার উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভগবান আদেশ করেছেন যে,সম্পূর্ণভাবে ভগবৎ-চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে কর্তব্যকর্ম করে যেতে হবে। সৈনিকেরা যেমন গভীর নিষ্টা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, মানুষের কর্তব্য হচ্ছে ঠিক তেমনভাবে ভগবানের সেবা করা। ভগবানের আদেশকে কখনও কখনও অত্যন্ত কঠোর বলে মনে হতে পারে,কিন্তু তাঁর আদেশ পালন করাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম। তাই,শ্রীকৃষ্ণের উপর নির্ভরশীল হয়ে তা আমাদের পালন করতেই হবে,কেননা সেটিই হচ্ছে জীবের স্বরূপ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করে মানুষ যদি সুখী হতে চেষ্টা করে,তবে তার সে চেষ্টা কোন দিনই সফল হবে না। ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করাই হচ্ছে জীবের কর্তব্য এবং সেই জন্য তাকে যদি সব কিছু ত্যাগ করতেও হয়,তবে তাই বিধেয়। ভাল-মন্দ,লাভ-ক্ষতি,সুবিধা-অসুবিধা কথা বিবেচনা না করে ভগবানের আদেশ পালন করাই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য। সেই জন্যই শ্রীকৃষ্ণে যেন সামরিক নেতারই মতোই অজুর্নকে যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্জুনের পক্ষে সেই নির্দেশ যাচাই করার কোন পথ ছিল না;তাঁকে সেই নির্দেশ মানতেই হয়েছিল ।

ভগবান হচ্ছেন সমস্ত আত্মার আত্মা; তাই যিনি নিজের সুখ-সুবিধার কথা বিবেচনা না করে যিনি সম্পূর্ণভাবে পরমাত্মার উপর নির্ভরশীল,অথবা পক্ষান্তরে,যিনি সম্পূর্নরূপে কৃষ্ণভাবনাময়, তিনিই হচ্ছেন অধ্যাত্মচেত । নিরাশীঃ মানে হচ্ছে,ভৃত্য যখন প্রভুর সেবা করে,তখন সে কোন কিছুই আশা করে না। খাজাঞ্চ লক্ষ লক্ষ টাকা গনণা করে,কিন্তু তার এক কপর্দকও সে নিজের বলে মনে করে না,কারণ সে জানে যে, সেই টাকা তার মালিকের। ঠিক তেমনই,এই জগতের সবকিছুই ভগবানের,তাই তাঁর সেবাতে সব কিছু অর্পণ করাই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য। আমরা যদি তা করি,তা হলে আমরা পরম শান্তি লাভ করতে পারি। সেটি হচ্ছে ময়ি অর্থাৎ “আমাকে” কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য। কেউ যখন এই প্রকার কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কর্ম করে,তখন নিঃন্দেহে সে কোন কিছুর উপর মালিকানা দাবি করে না। এই মনোবৃত্তিকে বলা হয় নির্মম,অর্থাৎ ‘কোন কিছুই প্রকাশ করি-যদি আমরা আমদের তথাকথিত আত্মীয়-স্বজনের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে ভগবানের নির্দেশকে অবজ্ঞা করি,তবে তা মূঢ়তারই নামান্তর। এই বিকৃত মনোবৃত্তি ত্যাগ করা অবশ্যই কর্তব্য। এভাবেই মানুষ বিগতজ্বর অর্থাৎ শোকশূন্য হতে পারে। গুণ ও কর্ম অনুসারে প্রত্যেকেরই কোন না কোন বিশেষ কর্তব্য আছে এবং কৃষ্ণভাবনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সেই কর্তব্য সম্পাদন করা প্রত্যেকের কর্তব্য। এই ধর্ম আচারণ করার ফলে আমরা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি।






যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ ।
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্মভিঃ ॥৩১॥

অর্থঃ- আমার নির্দেশ অনুসারে যে-সমস্ত মানুষ তাঁদের কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন এবং যাঁরা শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্য রহিত হয়ে এই উপদেশ অনুসরণ করেন, তাঁরাও কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন।

আলোচনাঃ- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অজুর্নকে যে আদেশ করেছেন,তা বৈদিক জ্ঞানের সারমর্ম,তাই সন্দেহাতীতভাবে তা শাশ্বত সত্য। বেদ যেমন নিত্য,শ্বাশত,কৃষ্ণভাবনার এই তত্ত্বও তেমন নিত্য,শ্বাশত। ভগবানের প্রতি ঈর্ষানিত না হয়ে এই উপদেশের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকা উচিত। তথাকথিত অনেক দার্শনিক ভগবদগীতার ভাষ্য লিখেছেন,কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস নেই। তাঁরা কোন দিনও গীতার মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন না এবং সকাম কর্মের বন্ধন থেকেও মুক্ত হতে পারবেন না। কিন্তু অতি সাধারণ কোন মানুষও যদি ভগবানের শ্বাশত নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধাবান হন,অথচ সমস্ত নির্দেশগুলিকে যথাযথভাবে পালন করতে অসর্মথ হয়,তবুত্ত সে অবধারিতভাবে কর্মের অনুশাসনের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে। ভক্তিযোগ সাধন করার প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ হয়ত ভগবানের নির্দেশ ঠিক ঠিকভাবে পালন নাও করতে পারে,কিন্তু যেহেতু সে এই পন্থার প্রতি বিরক্ত নয় এবং যদি সে নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা বিবেচনা না করে ঐকান্তিকভাবে ধীরে ধীরে শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনার পর্যায়ে অবশ্যই উন্নীত হবে।





যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্ ।
সর্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ ॥৩২॥

অর্থঃ- কিন্তু যারা অসূয়াপূর্বক আমার এই উপদেশ পালন করে না, তাদেরকে সমস্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিমূঢ় এবং পরমার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে।

আলোচনাঃ- কৃষ্ণভাবনাময় না হওয়ার ক্ষতি সর্ম্পকে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কর্মকর্তার নির্দেশ মানতে অবাধ্যতা করলে যেমন শাস্তি হয়,তেমনই পরম পুরুষোত্তম ভগবনের নির্দেশ অমান্য করলেও নিশ্চয়ই শাস্তি আছে। অমান্যকারী লোক,তাসে যতই উচ্চ স্তরের হোক,তার কান্ডজ্ঞানহীন বুদ্ধি-বিবেচনার জন্য তার নিজের স্বরূপ সর্ম্পকে,এমন কি পরমব্রহ্ম,পরমাত্মা ও পরম পুরুষোত্তম ভগবানের স্বরূপ সর্ম্পকেও সে অজ্ঞ। সুতরাং তার জীবনের পূর্ণতা লাভের কোনই আশা নেই ।








সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি ।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি ॥৩৩॥

অর্থঃ- জ্ঞানবান ব্যক্তিও তাঁর স্বভাব অনুসারে কার্য করেন, কারণ প্রত্যকেই ত্রিগুণজাত তাঁর স্বীয় স্বভাবকে অনুগমন করেন। সুতরাং নিগ্রহ করে কি লাভ হবে ?

আলোচনাঃ- কৃষ্ণভাবনার অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত না হতে পারলে জড়া প্রকৃতিরগুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। ভগবদগীতার সপ্তম অধ্যায়ে(৭/১৪) ভগবান সেই কথা প্রতিপন্ন করেছেন। তাই এমনকি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেও কেবলমাত্র ধারনাগত জ্ঞান অথবা দেহ থেকে আত্মাকে পৃথক করেও মায়ার বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। বহু তথাকথিত তত্ত্বাবিদ আছে,যারা ভগবৎ-তত্ত্বদর্শন লাভ করার অভিনয় করে,কিন্তু অন্তর তাদের সম্পূর্নভাবে মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন। তারা সম্পূর্নভাবে মায়ার গুণের দ্বারা আবদ্ধ। পুথিঁগত বিদ্যায় কেউ খুব পারদর্শী হতে পারে,কিন্তু বহুকাল ধরে মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে থাকার ফলে সে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। জীব সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে কেবল মাত্র কৃষ্ণভাবনার প্রভাবে এবং এই কৃষ্ণচেতনা থাকলে সংসার-ধর্ম পালন করেও জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।

তাই ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ না করে হটাৎ ঘর ,বাড়ি ছেড়ে তথাকথিক যোগী অথবা কৃত্রিম পরমার্থবাদী সেজে বসলে কোনই লাভ হয় না।তার থেকে বরং নিজ নিজ আশ্রমে অবস্থান করে কোন তত্তাববেত্ত্বার নির্দেশে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার চেষ্টা করা উচিত। এভাবেই ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার ফলে মানুষ মায়ামুক্ত হতে পারে।






ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ ॥৩৪॥

অর্থঃ- সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এভাবে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারণ তা পারমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।

আলোচনাঃ- যাদের মন কৃষ্ণ ভাবনায় উদয় হয়েছে, তাদের জড়জাগতিক ইন্দ্রিয় উপভোগের বাসনা থাকেনা। কিন্তু যাদের চেতনা শুদ্ধ হয়নি, তাদের কর্তব্য হচ্ছে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করা। তা হলেই পরমার্থ সাধনের পথে অগ্রসর হওয়া যায়। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে বিষয়ভোগ করার ফলে মানুষ জড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, কিন্তু শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করলে আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের দ্বারা আবদ্ধ হতে হয় না। যেমন যোনিসম্ভোগ করার বাসনা প্রতিটি বদ্ধ জীবেরই থাকে, তাই শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিবাহ করে দাম্পত্য জীবনযাপন করতে। বিবাহিত স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে অবৈধ সঙ্গ করতে শাস্ত্রে নিষেধ করা হয়েছে এবং অন্যসমস্ত স্ত্রীলোককে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু শাস্ত্রে এই সমস্ত নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মানুষ তা অনুসরন করতে চায় না, ফলে সে জড় বন্ধনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারে না। এই ধরনের বিকৃত বাসনাগুলি দমন করতে হবে, তা না হলে সেগুলি আত্ম-উপলব্ধির পথে দুরতিক্রম্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।

জড় দেহটি যতক্ষন আছে, ততক্ষণ তার প্রয়োজনগুলিও মেটাতে হবে, কিন্তু তা করতে হবে শাস্ত্রের বিধি-নিষেধ অনুসরণ করার মাধ্যমে। আর তা সত্ত্বেও আমাদের সর্তক থাকতে হবে, যাতে কোন রকম দুর্ঘটনা না ঘটে। রাজপথে যেমন দুর্ঘটনাগটার সম্ভাবনা থাকে তেমনি শাস্ত্রে বিধি নিষেধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করলেও প্রতি পদক্ষেপে অধঃপতিত হবার সম্ভাবনা থাকে। সেকারনে নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ আসক্তি সর্বতোভাবে বর্জনীয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসে তার সেবায় ব্রতী হলে, অচিরেই আমরা জড় সুখভোগ করার বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারি। তাই, কোন অবস্থাতেই ভগবানের সেবা থেকে বিরত হওয়া উচিত নয়। ইন্দ্রিয়সুখ বর্জন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় লাভ করা, তাই কোন অবস্থাতেই তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়।







শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ ॥৩৫॥

অর্থঃ- স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।

আলোচনাঃ- যাদের মনে কৃষ্ণভাবনার উদয় হয়েছে, তাদের আর জড়-জাগতিক ইন্দ্রিয় উপভোগের বাসনা থাকে না। কিন্তু যাদের চেতনা শুদ্ধ হয়নি, তাদের কর্তব্য হচ্ছে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করা। তা হলেই পরমার্থ সাধনের পথে অগ্রসর হওয়া যায়।

আলোচনার অন্তলগ্নে বলতে চাই যে, 'স্বধর্ম' অর্থ নিজের ধর্ম বা কর্তব্য কর্ম। যাহার যাহা কর্তব্য কর্ম তাহাই তাহার স্বধর্ম। এই 'স্বধর্ম' শব্দের নানারূপ ব্যাখ্যা আছে, সে সকল আলোচনা করিবার পূর্বে শ্রীভগবান্ 'স্বধর্ম' শব্দে কোন্ ধর্ম লক্ষ্য করিয়াছেন এবং অর্জুনই বা কি বুঝিয়াছেন তাহাই প্রধানতঃ দ্রষ্ঠব্য। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৩১, ৩২ শ্লোকে এ কথা স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে অর্জুনের পক্ষে যুদ্ধাদি ক্ষত্রিয়োচিত কর্মই স্বধর্ম। 'স্বধর্ম' 'সহজ কর্ম' 'স্বভাবনিয়ত কর্ম' এই সকল শব্দ গীতায় এবং মহাভারতে সর্বত্র একার্থকরূপেই ব্যবহৃত হইয়াছে। অষ্টাদশ অধ্যায়ে ব্রাহ্মণাদি চতুর্বর্ণেরও বর্ণ-ধর্ম বা স্বভাবনিয়ত ধর্ম কি তাহা বর্ণনা করিয়া তৎপর স্বধর্মপালনের কর্তব্যতা উপদিষ্ট হইয়াছে (১৮ ।৪১-৫৮)।

বি:দ্রঃ সকল সনাতনী ভক্ত-বৃন্দের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, আজ সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে প্রাচীন তম উৎসব 'রথ যাত্রা উৎসব' উপলক্ষে অর্থাৎ অদ্য দিবস থেকে সনাতন পরিবারে কর্তৃক আয়োজিত "আত্মানাং বিদ্ধি - নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র" নামক একটি ধারাবাহিক আলোচনা পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে যাহা সনাতন জ্ঞান পিপাসুদের জন্য সনাতনের ঐতিহাসিকতা থেকে শুরু করে সনাতনের শুদ্ধ ও সাত্ত্বিক জ্ঞান আহরণে সহযোগিতা করবে বলে আমার সনাতন পরিবারে পক্ষ থেকে আশাবাদী। আজকের গীতার শ্লোকে উল্লেখিত 'স্বধর্ম' নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা অতী শীঘ্রই সেখানে তুলে ধরা হবে।







অর্জুন উবাচ
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ঞ্চেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ ॥৩৬॥

অর্থঃ- অর্জুন বললেন- হে বার্ঞ্চেয় ! মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়?

শ্রীভগবানুবাচ
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ ॥৩৭॥

অর্থঃ-পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন ! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভূত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলে জানবে।

আলোচনাঃ- ৩৬ নং শ্লোকে অর্জুন ভাগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলিতে চাইলেন যে, তুমি বলিতেছ- ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী, উহার অধীন হইও না। বুঝিলাম, ভাল কথা। কিন্তু ইচ্ছা না থাকিলেও কে যেন বলপূর্বক ইন্দ্রিয়ের বশীভূত করায়, মনুষ্যকে স্বধর্মচ্যুত করায়, পাপে প্রবৃত্ত করায়। কাহার প্রেরণায় এইরূপ হয়?



ধুমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ ।
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ ॥৩৮॥

অর্থঃ- অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই জীবাত্মা বিভিন্ন মাত্রায় এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে।

আলোচনাঃ- জীব যখন জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসে , তখন তার অন্তরের শাশ্বত কৃষ্ণপ্রেম রজোগুণের প্রভাবে কামে পর্যবসিত হয় । টক তেঁতুলের সংস্পর্শে দুধ যেমন দই হয়ে যায় , তেমনই ভগবানের প্রতি আমাদের অপ্রাকৃত প্রেম কামে রূপান্তরিত হয়। তারপর , কামের অতৃপ্তির ফলে হৃদয়ে ক্রোধের উদয় হয় ; ক্রোধ থেকে মোহ এবং এভাবেই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে জীব জড় জগতের বন্ধনে স্থায়িভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই , কাম হচ্ছে জীবের সব চাইতে বড় শত্রু। এই কামই শুদ্ধ জীবাত্মাকে এই জড় জগতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে অনুপ্রাণিত করে। ক্রোধ হচ্ছে তমোগুণের প্রকাশ ; এভাবে প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের প্রভাবে কাম , ক্রোধ আদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ হয়। তাই , রজোগুণের প্রভাবকে তমোগুণে অধঃপতিত না হতে দিয়ে , যদি ধর্মাচরণ করার মাধ্যমে তাকে সত্ত্বগুণে উন্নীত করা যায়, তা হলে আমরা পারমার্থিক অনুশীলনের মাধ্যমে ক্রোধ আদি ষড় রিপুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি।

ভগবান তাঁর নিত্য-বর্ধমান চিদানন্দের বিলাসের জন্য নিজেকে অসংখ্য মূর্তিতে বিস্তার করেন। জীব হচ্ছে এই চিন্ময় অনন্দের আংশিক প্রকাশ। ভগবান তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ জীবকে আংশিক স্বাধীনতা দান করেছেন, কিন্তু যখন তারা সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে এবং ভগবানের সেবা না করে নিজেদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করতে শুরু করে, তখন তারা কামের কবলে পতিত হয়। ভগবান এই জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন যাতে বদ্ধ জীব তার এই কামোন্মুখী প্রবৃত্তিগুলিকে পূর্ণ করতে পারে। এভাবে তার সমস্ত কামন-বাসনাগুলিকে চরিতার্থ করতে গিয়ে জীব যখন সম্পূর্ণভাবে দিশাহারা হয়ে পড়ে, তখন সে তার স্বরূপের অন্বেষণ করতে শুরু করে। এই অন্বেষণ থেকেই বেদান্ত-সূত্রের সূচনা, যেখানে বলা হয়েছে, অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা-মানুষের কর্তব্য হচ্ছে পরতমতত্ত্ব অনুসন্ধান করা।

শ্রীমদ্ভাগবতে পরমতত্ত্বকে বর্ণনা করে বলা হয়েছে- জন্মাদ্যস্য যতোহন্বয়াদিতরতশ্চ, অর্থাৎ "সব কিছুর উৎস হচ্ছেন পরমব্রহ্ম।" সুতরাং কামেরও উৎস হচ্ছেন ভগবান। তাই, যদি এই কামকে ভগবৎ-প্রেমে রূপান্তরিত করা যায়, অথবা কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, কিংবা সব কিছু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করা যায়, তা হলে কাম ও ক্রোধ উভয়ই অপ্রাকৃত চিন্ময়রূপ প্রাপ্ত হয়। এভাবেই কামের সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধও শত্রুনিধন কার্যে প্রয়োগ করেছিলেন। এখানেও ভগবদ্গীতায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর সমস্ত ক্রোধ শক্রুবাহিনীর উপরে প্রয়োগ করে ভগবানেরই সন্তুষ্টি বিধানের কাজে লাগাতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের কাম ও ক্রোধকে যখন আমরা ভগবানের সাএবায় নিয়োগ করি, তখন্ত আরা আর শত্রু থাকে না, আমাদের বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়।





আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা ।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ ॥৩৯॥

অর্থঃ- কামরূপী চির শত্রুর দ্বারা জীবের শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয়। এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চিরঅতৃপ্ত।

আলোচনাঃ- মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, ঘি ঢেলে যেমন আগুনকে কখনও নেভানো যায় না, তেমনই কাম উপভোগের দ্বারা কখনই কামের নিবৃত্তি হয় না। জড় জগতে সমস্ত কিছুর কেন্দ্র হচ্ছে যৌন আকর্ষণ, তাই জড় জগৎকে বলা হয় 'মৈথুনাগার ' অথবা যৌন জীবনের শিকল। আমরা দেখেছি, অপরাধ করলে মানুষ কারাগারে আবদ্ধ হয়, তেমনই, যারা ভগবানের আইন অমান্য করে, তারাও যৌন জীবনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে এই মৈথুনাগারে পতিত হয়। ইন্দ্রয়-তৃপ্তিকে কেন্দ্র করে জড় সভ্যতার উন্নতি লাভের অর্থ হচ্ছে, বদ্ধ জীবদের জড় অস্তিত্বের বন্দীদশার মেয়াদ বৃদ্ধি করা। তাই, এই কাম হচ্ছে অজ্ঞানতার প্রতীক, যার দ্বারা জীবদের এই জড় জগতে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার সময় সাময়িকভাবে সুখের অনুভূতি হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই তথাকথিত সুখই হচ্ছে জীবের পরম শত্রু।




ইন্দ্রিয়াণি মন বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে ।
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ ॥৪০॥

অর্থঃ- ইন্দ্রিয়সমূহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল৷ এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।

তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ ।
পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ ॥৪১॥

অর্থঃ- অতএব, হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ কর।

আলোচনাঃ- ভগবান প্রথম থেকেই অর্জুনকে ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করবার উপদেশ দিয়েছেন যাতে তিনি পরম শত্রু কামকে জয় করতে পারেন, কারণ এই কামের প্রভাবে জীব আত্মজ্ঞান বিস্মৃত হয়ে তার স্বরূপ ভুলে যায়। এখানে জ্ঞান বলতে সেই জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে, যে জ্ঞান আমাদের প্রকৃত স্বরূপের কথা মনে করিয়ে দেয়, অর্থাৎ যে জ্ঞান আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের আত্মাই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত স্বরূপ --আমাদের জড় দেহটি একটি আবরণ মাত্র। বিজ্ঞান বলতে সেই বিশেষ জ্ঞানকে বোঝায়, যা ভগবানের সঙ্গে আমাদের নিত্য সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবেরা ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই তাদের ধর্ম হচ্ছে ভগবানের সেবা করা। এই উপলব্ধিকে বলা হয় কৃষ্ণভাবনামৃত। তাই, জীবনের শুরু থেকেই আমাদের উচিত কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া, যাতে আমরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণচেতনাময় হয়ে আমাদের জীবন সার্থক করে তুলতে পারি ।

প্রতিটি জীবের অন্তরে যে ভগবৎ- প্রেম আছে, তারই বিকৃত প্রতিবিম্ব হচ্ছে কাম । কিন্তু জীবনের শুরু থেকেই যদি আমরা ভগবানকে ভালবাসতে শিখি, তা হলে আমাদের স্বাভাবিক ভগবৎ-প্রেম আর কামে পর্যবসিত হতে পারে না। ভগবৎ-প্রেম কামে বিকৃত হয়ে গেলে, তখন তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন ।






ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্ত্ত সঃ ॥৪২॥

অর্থঃ- স্থূল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর তিনি (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।

আলোচনাঃ- কামের নানাবিধ কার্যকলাপের নির্গম পথ হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি । কামের সঞ্চয় হয় আমাদের দেহে , কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ হয় । তাই , সামগ্রিকভাবে জড় দেহের থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয় । আমাদের অন্তরে যখন উচ্চস্তরের চেতনার বিকাশ হয় অথবা কৃষ্ণচেতনার বিকাশ হয়, তখন এই সমস্ত নির্গম পথগুলি বন্ধ হয়ে যায়। অন্তরে কৃষ্ণভাবনার উন্মেষ হলে পরমাত্মা বা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আত্মা তার নিত্য সম্পর্ক অনুভব করে, তাই তখন আর তার জড় দেহের অনুভূতি থাকে না । দেহগত কার্যকলাপগুলি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ, তাই ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্ক্রিয় হলে, দেহও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু সেই অবস্থায় মন সক্রিয় থাকে, যেমন নিদ্রিত অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু মনেরও ঊর্ধ্বে হচ্ছে বুদ্ধি এবং বুদ্ধিরও ঊর্ধ্বে হচ্ছে আত্মা। তাই, আত্মা যখন পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়গুলি স্বাভাবিকভাবে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তাই, মন যদি সর্বতোভাবে নিরন্তর ভগবানের সেবায় নিয়োজিত থাকে, তখন ইন্দ্রিয়গুলির বিপদগামী হবার আর কোন সুযোগ থাকে না। আত্মার স্বরূপ সরাসরি উপলব্ধি করতে পারলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।





এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপংদুরাসদম্॥৪৩।।

অর্থঃ-হে মহাবীর অর্জুন ! নিজেকে জড় ইন্দ্রীয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর।

আলোচনাঃ- ভগবদ্গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে আমাদের স্বরূপ যে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নিত্যকালের দাস, সেই সত্য উপলব্ধি করতে পেরে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই অধ্যায়ে ভগবান বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, নির্বিশেষ ব্রহ্মে লীন হওয়া জীবনের চরম উদ্দেশ্য নয়। জড় জীবনে আমরা স্বাভাবিকভাবে কাম-প্রবৃত্তি ও জড়া প্রকৃতিকে ভোগ করবার প্রবৃত্তির দ্বারা প্রলোভিত হই। কিন্তু জড়া প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং জড় ইন্দ্রিয় উপভোগ করার বাসনা হচ্ছে বদ্ধ জীবের পরম শত্রু। কিন্তু কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার ফলে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারি । আমাদের প্রবৃত্তিগুলিকে মুহূর্তের মধ্যে সংযত করা সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদের অন্তরে কৃষ্ণভাবনার বিকাশ হবার ফলে আমরা অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হতে পারি, বুদ্ধির দ্বারা মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে ভগবানের শ্রীচরণারবিন্দে একাগ্র করতে পারি। এটিই হচ্ছে এই অধ্যায়ের মর্মার্থ। জড় জীবনের অপরিণত অবস্থায়, নানা রকম দার্শনিক জল্পনা - কল্পনা এবং তথাকথিত যৌগিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ইন্দ্রিয় -সংযমের প্রচেষ্টার দ্বারা আমরা অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হবার যতই চেষ্টা করি না কেন, পারমার্থিক জীবনধারার অগ্রগতির ক্ষেত্রে সেই সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। উন্নত বুদ্ধিযোগের দ্বারা কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করলেই পারমার্থিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে।

ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'কর্মযোগো' নাম তৃতীয়োঽধ্যায়ঃ সমাপ্ত।।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।





----------------------------------------------------------------------
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ অন্তে শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা-
----------------------------------------------------------------------

ওঁ যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্‌ ভবেৎ ।
পূর্ণং ভবতু ত্বৎ সর্বং ত্বৎ প্রসাদাৎ জনার্দ্দন ।।
মন্ত্র হীনং ক্রিয়া হীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন ।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তুমে ।।
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।