২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

দশম অধ্যায়ঃ বিভূতিযোগ

                                                   ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়

শ্রীভগবানুবাচ -

ভূয় এব মহাবাহো শৃণু মে পরমং বচঃ।
যত্তেহহং প্রীয়মাণায় বক্ষ্যামি হিতকাম্যয়া।।১


অর্থঃ- (১) শ্রীভগবান্‌ কহিলেন, - হে মহাবাহো, তুমি আমার বাক্য শ্রবণে প্রীতি লাভ করিয়াছ, আমি তোমার হিতার্থ পুনরায় উৎকৃষ্ট কথা বলিতেছি, তাহা শ্রবণ কর।


সপ্তম, অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে পরমেশ্বরের স্বরূপ বর্ণনপ্রসঙ্গে তাঁহার নানা ব্যক্ত রূপ বা বিভূতির কথা সংক্ষেপে বলা হইয়াছে। উহাইত এই অধ্যায়ে সবিস্তারে বলিবেন।

ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীণাঞ্চ সর্ব্বশঃ।।২


অর্থঃ- (২) কি দেবগণ, কি মহর্ষিগণ কেহই আমার প্রভাব বা উৎপত্তির বিষয় জ্ঞাত নহেন। কেননা আমি দেব ও মনুষ্যগণের সর্ব্বপ্রকারেই আদিকারণ।


ঋগ্‌বেদীয় নাসদীয় সূক্তের ঋষি আদি কারণ সন্বন্ধে ঠিক এই কথাই বলিয়াছে - ‘অর্বাগ্‌ দেবা অস্য বিসর্জ্জনেনাথ কো বেদ যত আবভূব’।।৬ (ঋক্‌ ১০।১।৯।৬), - দেবতারাও এই বিসর্গের (সৃষ্টির) পরে হইল। আবার উহা সেখান হইতে নিঃসৃত হইল তাহা কে জানিবে?

যো মামজমনাদিঞ্চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্।
অসংমূঢ়ঃ মর্ত্ত্যেষু সর্ব্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে।।৩


অর্থঃ- (৩) যিনি জানেন যে আমার আদি নাই, জন্ম নাই, আমি সর্ব্বলোকের মহেশ্বর, মনুষ্য মধ্যে তিনি মোহশূন্য হইয়া সর্ব্বপাপ হইতে মুক্ত হন।

বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ।
সুখং দুঃখং ভবোহভাবো ভয়ঞ্চাভয়মেবচ।।৪
অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোহযশঃ।
ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগ্ বিধাঃ।।৫


অর্থঃ- (৪-৫) বুদ্ধি, জ্ঞান, কর্ত্তব্য বিষয়ে অব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্য, দম, শম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, রাগদ্বেষাদি বিষয়ে সমচিত্ততা, সন্তোষ, তপঃ, দান এবং যশ ও অযশ - প্রাণিগণের এই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন ভাব (অবস্থা) আমা হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে।


তিনিই সকল অবস্থা, সকল ভাব, সকল বৃত্তির মূল কারণ। তাহাই এই দুইটি শ্লোকে বলা হইয়াছে।

মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্ব্বে চত্বারো মনবস্তথা।
মদ্ ভাবা মানসা জাতা যেষাং লোক ইমাঃ প্রজাঃ।।৬


অর্থঃ- (৬) ভৃগু প্রভৃতি সপ্তমহর্ষি, তাঁহাদের পূর্ব্ববর্ত্তী চারি জন মহর্ষি (অথবা সংকর্ষণাদি চতুর্ব্যুহ) এবং স্বায়ম্ভূবাদি মনুগণ,- ইহারা সকলেই আমার মানসজাত এবং আমার জ্ঞানৈশ্বর্য্যশক্তিসম্পন্ন; জগতের সকল প্রজা তাহাদিগ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।

এতাং বিভূতিং যোগঞ্চ মম যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
সোহবিকম্পেন যোগেন যুজ্যতে নাত্র সংশয়ঃ।।৭


অর্থঃ- (৭) যিনি আমার এই বিভূতি (ভৃগু, মন্বাদি) এবং যোগৈশ্বর্য্য যথার্থরূপে জানেন, তিনি মৎভক্তিলক্ষণ স্থির যোগ লাভ করেন এবং আমাতেই সমাহিতচিত্ত হন, তাহাতে সংশয় নাই।

আহং সর্ব্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্ব্বং প্রবর্ত্ততে।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ।।৮


অর্থঃ- (৮) আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ। আমা হইতে সমস্ত প্রবর্ত্তিত হয়; বুদ্ধিমান্‌গণ ইহা জানিয়া প্রেমাবিষ্ট হইয়া আমার ভজনা করেন।

মচ্চিত্তা মদ্ গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ।।৯


মদ্গতপ্রাণাঃ- মাং বিনা প্রাণান্‌ ধর্ত্তুমসমর্থাঃ (বিশ্বনাথ)।


অর্থঃ- (৯) যাহাদিগের চিত্তই আমাতেই অর্পিত, যাঁহারদের প্রাণ মদ্গত (আমাকে ভিন্ন যাঁহারা প্রাণ ধারণে অসমর্থ), এইরূপ ভক্তগণ পরস্পরকে আমার কথা বুঝাইয়া এবং সর্ব্বদা আমার কথা কীর্ত্তন করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করেন। তাঁহাদের আর কোন অভাব থাকে না, সুতরাং তাহারা পরম প্রেমানন্দ উপভোগ করিয়া থাকেন।

তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপুর্ব্বকম্।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে।।১০


অর্থঃ- (১০) যাঁহারা সতত আমাতে চিত্তার্পণ করিয়া প্রীতিপূর্ব্বক আমার ভজনা করেন সেই সকল ভক্তকে আমি ঈদৃশ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যদ্দারা তাঁহারা আমাকে লাভ করিয়া থাকেন।

তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা।।১১


অর্থঃ- (১১) আমার সেই ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহার্থই তাঁহাদের অন্তঃকরণে অবস্থিত হইয়া উজ্জ্বল জ্ঞানরূপ দীপদ্বারা তাহাদের অজ্ঞানান্ধকার বিনষ্ট করি।

পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভূম্।।১২
আহুস্ত্বামৃষয়ঃ সর্ব্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ঞ্চৈব ব্রবীষি মে।।১৩


অর্থঃ- (১২-১৩) অর্জ্জুন বলিলেন - আপনি পরব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র, ভৃগু প্রভৃতি ঋষিগণ, দেবর্ষি নারদ ও অসিত, দেবল এবং ব্যাস প্রভৃতি আপনাকে নিত্য-পুরুষ, স্বয়ংপ্রকাশ, আদিদেব, জন্মরহিত ও সর্ব্বব্যাপী বিভু বলেন। আপনি স্বয়ং আমাকে তাহাই বলিলেন।

সর্ব্বমেতদৃতং মন্যে যন্মাং বদসি কেষব।
নহি তে ভগবন্ ব্যক্তিং বিসুর্দ্দেবা ন দানবাঃ।।১৪


অর্থঃ- (১৪) হে কেশব! তুমি যাহা আমাকে বলিতেছ সে সকলই সত্য বলিয়া মানি; কারণ, হে ভগবন্‌! কি দেব কি দানব, কেহই তোমার প্রভাব (বা আবির্ভাবতত্ত্ব) জানেন না (আমি ক্ষুদ্র মনুষ্য, উহা কি বুঝিব?)

স্বয়মেবাত্মনাত্মানং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম।
ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে।।১৫


অর্থঃ- (১৫) হে পুরুষত্তম, হে ভূতভাবন, দেবদেব, হে জগৎপতে, তুমি আপনি আপন জ্ঞানে আপন স্বরূপ জান। (তোমার স্বরূপ আর কেহ জানে না)।

বক্তুমর্হস্যশেষেণ দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ।
যাভির্বিভুতিভির্লোকানিমাংস্ত্বং ব্যাপ্য তিষ্ঠসি।।১৬


অর্থঃ- (১৬) তুমি যে যে বিভূতি দ্বারা সর্ব্বলোক ব্যাপিয়া রহিয়াছ তাহা তুমিই বলিতে সমর্থ। সে সকল বিস্তৃতরূপে আমাকে কৃপাপূর্ব্বক বল।

কথং বিদ্যামহং যোগিংস্তাং সদা পরিচিন্তয়ন্।
কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্তয়োহসি ভগবন্ময়া।।১৭


অর্থঃ- (১৭) হে যোগিন্‌, কি প্রকারে সতত চিন্তা করিলে আমি তোমাকে জানিতে পারি? হে ভগবন্‌‌, আমি তোমাকে কোন্‌ কোন্‌ পদার্থে কি ভাবে চিন্তা করিব, তাহা বল।

বিস্তরেণাত্মনো যোগং বিভূতিঞ্চ জনার্দ্দন।
ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃন্বতো নাস্তি মেহমৃতম্।।১৮


অর্থঃ- (১৮) হে জনার্দ্দন! তুমি পুনরায় তোমার যোগৈশ্বর্য ও বিভূতি-সকল আমাকে বিস্তৃতরূপে বল। যেহেতু তোমার অমৃতোপম বচন শ্রবণ করিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না।

শ্রীভগবানুবাচ -

হন্ত তে কথয়িষ্যামি দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ।
প্রাধান্যতঃ কুরুশ্রেষ্ঠ নাস্ত্যন্তো বিস্তরস্য মে।।১৯


অর্থঃ- (১৯) শ্রীভগবান্‌ কহিলেন, আচ্ছা আমার প্রধান প্রধান দিব্য বিভূতিসকল তোমাকে বলিতেছি। কারণ আমার বিভূতি-বাহুল্যের অন্ত নাই। (সুতরাং সংক্ষেপে বলিতেছি।)

অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্ব্বভুতাশয়স্থিতঃ।
অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভুতানামন্ত এব চ।।২০


অর্থঃ- (২০) হে অর্জ্জুন, সর্ব্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা (প্রত্যক্‌ চৈতন্য) আমিই। আমিই সর্ব্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহার স্বরূপ (অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কর্ত্তা)।

আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবির শুমান্।
মরীচির্ম্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী।।২১


অর্থঃ- (২১) দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে আমি বিষ্ণু নামক আদিত্য। জ্যোতিস্কগণের মধ্যে আমি কিরণমালী সূর্য্য। মরুৎগণের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রগণের মধ্যে চন্দ্র।

বেদানাং সামবেদোহস্মি দেবানামস্মি বাসবঃ।
ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি ভূতানামস্মি চেতনা।।২২


অর্থঃ- (২২) বেদসমূহের মধ্যে আমি সামবেদ, দেবগণের মধ্যে আমি ইন্দ্র, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে আমি মন এবং ভূতগণের আমি চেতনা (জ্ঞানশক্তি)।


সাধারণতঃ বেদসমূহ মধ্যে ঋগ্বেদকেই প্রধান বলা হয় এবং ৯।১৭ শ্লোকে ‘ঋক্‌সামযজুরেব চ’ এই কথায় উহাকেই অগ্র স্থান দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু সামবেদ গান-প্রধান বলিয়া উহার আকর্ষণী শক্তি অধিক এবং ভক্তিমার্গে পরমেশ্বরের স্তবস্তুতিমূলক সঙ্গীতেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়। - ‘মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।’এই হেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্মাত্মক বেদ অপেক্ষা গানপ্রধান সামবেদেরেই শ্রেষ্ঠত্ব কথিত হইয়াছে।

রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্।
বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্।।২৩


অর্থঃ- (২৩) একাদশ রুদ্রের মধ্যে আমি শঙ্কর, যক্ষরক্ষোগণের মধ্যে আমি কুবের, অষ্ট বসুর মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্ব্বতগণের মধ্যে আমি সুমেরু।

পুরোধসাঞ্চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্মপতিম্।
সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ।।২৪


অর্থঃ- (২৪) হে পার্থ! আমাকে পুরোহিতগণের প্রধান বৃহস্পতি জানিও, আমি সেনানায়কগণের মধ্যে দেব সেনাপতি কার্ত্তিকেয় এবং জলাশয় সমূহের মধ্যে আমি সাগর।

মহর্ষীণাং ভৃগুরহং গিরামস্ম্যেকমক্ষরম্।
যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ।।২৫


অর্থঃ- (২৫) মহর্ষিগণের মধ্যে আমি ভৃগু, শব্দসকলের মধ্যে আমি একাক্ষর ওঁকার, যজ্ঞসকলের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর পদার্থের মধ্যে আমি হিমালয়।

অশ্বত্থঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাঞ্চ নারদঃ।
গন্ধর্ব্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্দানাং কপিলো মুনিঃ।।২৬


অর্থঃ- (২৬) আমি বৃক্ষসকলের মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্ব্বগণের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধপুরুষগণের মধ্যে কপিলমুনি।


উচ্চৈঃশ্রবসমশ্বানাং বিদ্ধিমামমৃতোদ্ভবম্।
ঐরাবতং গজেন্দ্রাণাং নরাণাঞ্চ নরাধিপম্।।২৭


অর্থঃ- (২৭) অশ্বগণের মধ্যে অমৃতার্থ সমুদ্র মন্থনকালে উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবাঃ বলিয়া আমাকে জানিও; এবং হস্তিগণের মধ্যে ঐরাবত এবং মনুষ্যগণের মধ্যে রাজা বলিয়া আমাকে জানিও।

আয়ুধানামহং বজ্র ধেনূনামস্মি কামধুক্।
প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বসু কঃ।।২৮


অর্থঃ- (২৮) আমি অস্ত্রসমুহের মধ্যে বজ্র, ধেনুগণের মধ্যে কামধেনু, আমি প্রাণিগণের উৎপত্তি হেতু কন্দর্প; এবং আমি সর্পগণের মধ্যে বাসুকি।

অনন্তসচাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্।
পিতৄণামর্য্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্।।২৯


অর্থঃ- (২৯) নাগগণের মধ্যে আমি অনন্ত, জলচরগণের মধ্যে আমি জলদেবতা বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে আমি অর্য্যমা, এবং ধর্ম্মাধর্ম্ম ফলদানের নিয়ন্তৃগণ মধ্যে আমি যম।

প্রহ্লাদশ্চাস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তামহম্।
মৃগাণাঞ্চ মৃগেন্দ্রোহহং বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্।।৩০


অর্থঃ- (৩০) দৈত্যগণের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, গ্রাসকারীদিগের মধ্যে আমি কাল, পশুগণের মধ্যে আমি সিংহ, পক্ষিগণের মধ্যে আমি গরুড়।


পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভূতামহম্।
ঝষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী।।৩১


অর্থঃ- (৩১) বেগবান্‌দিগের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারিগণের মধ্যে আমি দাশরথি রাম, মৎস্যগণের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমুহের মধ্যে আমি গঙ্গা।


সর্গাণামাদিরতশ্চ মধ্যঞ্চৈবাহমর্জ্জুন।
অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাং বাদঃ প্রবদতামহম্।৩২


অর্থঃ- (৩২) হে অর্জ্জুন, সৃষ্ট পদার্থ মাত্রেই আদি, মধ্য ও অন্ত (উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশকর্ত্তা) আমি, বিদ্যাসমূহের মধ্যে আমি আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা; তার্কিকগণের বাদ, জল্প ও বিতণ্ডা নামক তর্কসমূহের মধ্যে আমি বাদ (তত্ত্বনির্ণয়ার্থ বিচার)।


পূর্ব্বে ২০ শ্লোকে ‘আমি ভূত সকলের আদি, অন্ত ও মধ্য’এরূপ বলা হইয়াছে। উহা সচেতন সৃষ্টি সন্বন্ধে বলা হইয়াছে এবং এই শ্লোকে চরাচর সমগ্র সৃষ্টি সন্বন্ধেই এই কথা বলা হইল, ইহাই প্রভেদ।

অক্ষরাণামকারোহস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্যচ।
অহমেবাক্ষয়ঃ কালো ধাতাহং বিশ্বতোমুখঃ।।৩৩


অর্থঃ- (৩৩) অক্ষরসমূহের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব, আমিই অক্ষয় কালস্বরূপ, এবং আমিই সমুদয়কর্ম্মফলের বিধান-কর্ত্তা।

মৃত্যুঃ সর্ব্বহরশ্চাহমুদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্।
কীর্ত্তিঃ শ্রীর্ব্বাক্ চ নারীণাং স্মৃতির্ম্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা।।৩৪


অর্থঃ- (৩৪) সংহর্ত্তাদিগের মধ্যে আমি সর্ব্বসংহারক মৃত্যু, ভবিষ্য প্রাণিগণেরও আমি উদ্ভব স্বরূপ; নারীগণের মধ্যে আমি কীর্ত্তি, শ্রী, বাক্‌, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি, ক্ষমা - এই সকল দেবতাস্বরূপ, অর্থাৎ ঐ সকল আমারই বিভূতি।


কীর্ত্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, সেবা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা, মতি - দক্ষের এই দশ কন্যার ধর্মের সহিত বিবাহ হয়। এইজন্য ইহাদিগকে ধর্ম্মপত্নী বলে। উহার তিনটা এখানে উল্লিখিত হইয়াছে।

বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী চ্ছন্দসামহম্।
মাসানাং মার্গশীর্ষহহমৃতূনাং কুসুমাকরঃ।।৩৫


অর্থঃ- (৩৫) আমি সামবেদোক্ত মন্ত্রসকলের মধ্যে বৃহৎ সাম, ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের মধ্যে গায়ত্রী; আমি বৈশাখাদি দ্বাদশ মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাস, এবং ঋতুসকলের মধ্যে বসন্ত ঋতু।

দ্যূতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্।
জয়হস্মি ব্যবসায়োহস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্।।৩৬


অর্থঃ- (৩৬) আমি বঞ্চনাকারিগণের দ্যুতক্রীড়া (Gambling), আমি তেজস্বিগণের তেজ। বিজয়ী পুরুষের জয়, উদ্যোগী পুরুষের উদ্যম এবং সাত্ত্বিক পুরুষের সত্ত্বগুণ।

বৃষ্ণীণাং বাসুদেবোহস্মি পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ।
মুনীনামপ্যহং ব্যাসঃ কবীনামুশনাঃ।।৩৭


অর্থঃ- (৩৭) আমি বৃষ্ণিবংশীয়দিগের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডবগণের মধ্যে ধনঞ্জয়, মুনিগণের মধ্যে ব্যাস, কবিগণের মধ্যে শুক্রাচার্য্য।


যে শ্রেণীর যাহা প্রধান তাহাতেই ঐশ্বরিক শক্তির সমধিক বিকাশ এবং তাহাই বিভূতি বলিয়া গণ্য। এই হেতু বৃষ্ণিগণের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের বিভূতি। ব্যাসদেব মুনিগণের প্রধান। ইনি বেদ বিভাগ করেন এবং মহাভারত, ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণ সমস্ত রচনা করেন। আবার, ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্ত দর্শনের রচয়িতা বলিয়াও ইনি প্রসিদ্ধ। অথচ এই সকল গ্রন্থের রচনাকাল শত শত বৎসর ব্যবধান। এই হেতু অনেকে বলেন - এক ব্যাসই বহুবার জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। যোগিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠদেব লিখিয়াছেন যে, এক ব্যাসকেই বহুবার জন্মগ্রহণ করিতে দেখিয়াছেন। -“ইমং ব্যাসমুনিং তত্র দ্বাত্রিংশং সংস্মরাম্যহম্‌’’।

দণ্ডো দময়তামস্মি নীতিরস্মি জিগীষতাম্।
মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতামহম্।।৩৮


অর্থঃ- (৩৮) আমি শাসনকর্ত্তৃগণের দণ্ড, জয়েচ্ছু ব্যক্তিগণের সামাদি নীতি, গুহ্য বিষয়ের মধ্যে মৌন, এবং জ্ঞানিগণের জ্ঞান।


দণ্ড, রাজ্যশাসন বা সমাজশাসনের মুখ্য উপায়, এই হেতু উহা বিভূতি; মৌনাবলম্বন করিলে মনোভাব কিছুতেই ব্যক্ত হয় না, সুতরাং উহাই শ্রেষ্ঠ গোপনহেতু।


যচ্চাপি সর্ব্বভূতানাং বীজং তদহমর্জুন।
ন তদস্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভূতং চরাচরম্।।৩৯


অর্থঃ- (৩৯) হে অর্জ্জুন, সর্ব্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি, আমা ব্যতীত উদ্ভূত হইতে পারে চরাচরে এমন পদার্থ নাই।

নান্তোহস্তি মম দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ।
এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভূতের্বিস্তরো ময়া।।৪০


অর্থঃ- (৪০) হে পরন্তপ, আমার দিব্য বিভূতিসমূহের অন্ত নাই। আমি এই যাহা কিছু বিভূতি বিস্তার বলিলাম, তাহা আমার বিভূতিসকলের সংক্ষেপে বা দিগ্‌দর্শন মাত্র।

যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জ্জিতমেববা।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্।।৪১


অর্থঃ- (৪১) যাহা যাহা কিছু ঐশ্বর্য্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন অথবা অতিশয় শক্তিসম্পন্ন তাহাই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলিয়া জানিবে।

অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জ্জুন।
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ।।৪২


অর্থঃ- (৪২) অথবা হে অর্জ্জুন, তোমার এত বহু বিভূতিবিস্তার জানিয়া প্রয়োজন কি? (এক কথায় বলিতেছি) আমি এই সমস্ত জগৎ আমার একাংশ মাত্র দ্বারা ধারণ করিয়া অবস্থিত আছি।


ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসুপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে বিভূতি-যোগো নাম দশমোহধ্যায়ঃ।


ভিডিও গীতা কীর্তনঃ https://www.youtube.com/watch?v=cocfrJfCHe0


সংগৃহীতঃhttp://geetabangla.blogspot.com/
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।