১১-ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সন। শিকাগো বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনের প্রাঙ্গন। গৈরিক বসনধারী দীর্ঘকায় এক পুরুষ মঞ্চে উঠে বললেন - “I thank you in the name of the millions of Hindu people of all classes and sects." দূর সাগরের পারে আমেরিকায় জনসমাজের সম্মূখে তিনি হিন্দুধর্মকে পরিচিত করালেন - "I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religion as true." গম্ভীর মন্দ্র স্বরের বলিষ্ঠ ভঙ্গীতে স্ত্রোত্র উচ্চারণের মাধ্যমে তিনি তাঁর ভগবৎ বিশ্বাসের কথা শোনালেন উপস্থিত শ্রোতৃমন্ডলীকে - “As the different streams having their sources in different places all mingle their water in the sea, O Lord, the different paths which men take through different tendencies, various though they appear, crooked or straight, all lead to Thee." পৌত্তলিকতার বাইরে হিন্দুধর্মের মূলকথা যে পরধর্মসহিষ্ণুতা ও মনুষ্যত্বের ভজনা, সেই কথাই বিশ্ববাসীর সামনে বলে রাখলেন, - “I fervently hope that the bell that tolled this morning in honor of this convention may be the death-knell of all fanaticism, of all persecution with the sword or with the pen, and of all uncharitable feelings between persons wending their way to the same goal." এই ব্যক্তি আর কেউই নন - তিনি পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবশিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ।
যদিও বিবেকানন্দই সেই ব্যক্তি যিনি আমেরিকার বুকে হিন্দুধর্মকে সরাসরি পরিচিত করিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকেই একথা মনে করেন যে হিন্দুধর্মের চর্চা অভিবাসীদের মাধ্যমে এদেশে ছিল প্রায় এর জন্মলগ্ন থেকেই। যদিও এই ধারণার বাস্তব ভিত্তি কতটা, সেটা তর্কসাপেক্ষ। তবে আমেরিকানদের সঙ্গে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় আরও অনেক আগে। তৎকালীন আমেরিকার বিদ্বৎসমাজের দুই প্রতিভূ - Ralph Waldo Emerson এবং Henry David Thoreau - শ্রীমৎভাগবত গীতা নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করছিলেন সেই সময়। সেই সময়কার বিভিন্ন চিঠিপত্র ও পত্রপত্রিকায় এই দুই লেখক ভবগত গীতা সম্পর্কে তাঁদের গবেষণালব্ধ চিন্তা ও সমীক্ষার অনেক নিদর্শন রেখে গেছেন। “Over Soul” নামে একটি প্রবন্ধে Ralph-এর চিন্তায় বেদিক দর্শনের প্রভাব পরিস্কার লক্ষ্যণীয়। তাঁরা দুজনেই একমত হয়ে বলেছিলেন গীতা এশীয় সংস্কৃতির এক অনবদ্য অবদান। গীতার দার্শনিক মূল্য যেমন অনস্বীকার্য্য, তেমনি আত্মোপলব্ধি, আত্মনুসন্ধান ও আত্মসংযম অভ্যাসের ক্ষেত্রেও গীতার তাৎপর্য্য অপরিসীম। শিকাগোর বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনের প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা এসব।
বিশ্ব ধর্মসম্মেলনোত্তর স্বামী বিবেকান্দের উদ্যোগই আমেরিকার বুকে হিন্দুধর্মকে পরিচিত করানোর প্রথম সংঘবদ্ধ উদ্যোগ একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। মন্দির তখন আমেরিকাতে ছিল না। শিকাগোর মহাসম্মেলনের পর স্বামীজী আরও বছর দুই এদেশে কাটিয়েছিলেন এবং বস্টন, ডেট্রয়েট, নিউ ইয়র্ক প্রভৃতি অঞ্চলে বক্তৃতা করেছিলেন। ১৮৯৪ সালে স্বামীজী নিউ ইয়র্কে ‘বেদান্ত সোসাইটি’ স্থাপন করলেন। বলা চলে এইটি আমেরিকার বুকে হিন্দু মন্দির স্থাপনের প্রথম ধাপ। সেই সময় এদেশীও অভিবাসীদের মধ্যে বেদান্ত-দর্শনের চর্চাই ছিল এই সোসাইটির উদ্দেশ্য। এর অব্যবহিত পরেই বাবা প্রেমানন্দ সরস্বতী আমেরিকায় থেকে প্রায় বছর পাঁচেক ধরে হিন্দু ধর্মের শিক্ষা নিয়ে বক্তৃতা করলেন এবং অবশেষে ‘কৃষ্ণসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করলেন। স্বামী পরমানন্দ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিউ ইর্য়ক বেদান্ত সোসাইটির দায়িত্বভার নিয়ে এলেন এবং শেষ পর্য্যন্ত বস্টন এবং লস এঞ্জেলেস-এ বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন।
বলা হয়ে থাকে যে আমেরিকার প্রথম হিন্দু মন্দির স্থাপিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিস্কোতে। বেদান্ত সোসাইটির উদ্যোগে। তারপর আরও দুটি মন্দিরের কথা জানা যায়। ১৯৩৮ সালে হলিউড মন্দির ও ১৯৫৬ সালে সান্টা বারবারা মন্দির। যেহেতু এই সব মন্দিরগুলো স্থাপিত হয়েছিল বেদান্ত সোসাইটির তত্বাবধানে, এদের মূল লক্ষ্য ছিল বেদান্ত দর্শন এবং হিন্দু শাস্ত্র পঠন পাঠন। বেদান্তের শিক্ষার প্রধান কথা আত্মোপলব্ধি এবং মূল মন্ত্র হল মানুষই ঈশ্বর। পৌত্তলিক বিগ্রহ পূজা বেদান্তের লক্ষ্য নয়। তাই হিন্দু ধর্মবালম্বী যে সব সম্প্রদায় শিব, বিষ্ণু, নারায়ণ ইত্যাদি বহুরুপে ঈশ্বরের ভজনায় অভ্যস্ত, তাদের স্বদেশীয় মন্দিরের ধারনার সঙ্গে বেদান্তের ধারণার তফাৎ রয়েই গেল। অভাব পূরণ হল না। দেশের মত অপরূপ স্থাপত্য- ভাস্কর্য্যের মহিমামন্ডিত বিগ্রহ মন্দির গঠনের ইচ্ছা অভিবাসীদের মনে জেগে রইল তখনকার মত। সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না কেন না সেইরকম মন্দির গড়বার জন্য যে বিপুল অর্থ ও লোকবল দরকার, আমেরিকায় তখনও তা ছিল না। অভিবাসী হিন্দুর সংখ্যা তখনও আমেরিকায় নগন্যই বলা চলে।
১৯৬৫ সালে Immigration and Nationality Services (INS) Act চালু হওয়ার পর আমেরিকায় অভিবাসনের দরজা যেন খুলে গেল। ছাত্র, গবেষক, শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে এদেশে আসতে শুরু করলেন এবং এদেশেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন। এদের সঙ্গে সঙ্গেই সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচারকেরাও। আবারও বলা ভাল এই প্রচার যতটা না ছিল আমেরিকার মূল স্রোতের মধ্যে হিন্দু র্ধম ও দর্শন সম্বন্ধে উৎসাহ জাগিয়ে তোলা, ততটা ছিল এদেশীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণের প্রয়োজনীয়তা মেটানো। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কে এসে পৌছালেন স্বামী প্রভুপাদ। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন - ISKCON- International Society for Krishna Consciousness.
সনাতন ভারতীয় হিন্দু ভাবধারায় মূলতঃ দু’টি দিক দেখা যায়। প্রথমটি - ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ এবং দ্বিতীয়টি, প্রতিষ্ঠানিক এবং পূজারী নির্ভর ধর্মাচরণ এবং পূজাবিধি। প্রথমটির কোন প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। দ্বিতীয়টির জন্য দেবস্থান বা মন্দির এবং পুরোহিত দরকার। আমেরিকাতেও হিন্দু ধর্ম-প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোটামুটি এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বেদান্ত সোসাইটির মত আর যে সব প্রতিষ্ঠান এখানে যোগাভ্যাস, ধ্যান এবং হিন্দু শাস্ত্র পঠন পাঠনের ব্যবস্থা রেখেছে তারা প্রথম শ্রেণীভূক্ত।
১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকাতে প্রধানতঃ এই ধারারই প্রচলন দেখা গেছে। ১৯৬৫ সালের পর প্রতিষ্টিত ইস্কন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের প্রথম ক্ষেত্র বলা যেতে পারে। চৈতন্য-অনুসারী কৃষ্ণ-প্রেম ও ভক্তিই এদের মূল দর্শন। কৃষ্ণই প্রধান বিগ্রহ। এদের বেশীর ভাগ ভক্তকুলই উত্তর ভারতীয়। যদিও এদের বেশ কিছু সংখ্যক অভারতীয় ভক্ত সম্প্রদায় আছেন। ভক্তরা মন্দিরে মিলিত হয়ে ‘হরেকৃষ্ণ’ মন্ত্রোচ্চারণ, ভক্তি-সঙ্গীত গায়ন এবং আরতি ও পূজাপাঠের মাধ্যমে ঈশ্বরের আশীর্বাদ অভিলাষী। আরতি-গান -কীর্তনের পর প্রসাদ বিতরণ। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে ধর্মীয় ও তাত্বিক অনুশাসন সম্পর্কিত বক্তৃতাও চলে।
১৯৬৫ সালের পর থেকে, বিশেষ করে গত শতকের আশির দশকের পর থেকে অসংখ্য প্রযুক্তিবিদ এবং ছাত্র ভারত থেকে এদেশে এসেছেন। তার সঙ্গে আছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। এই বিপুল সংখ্যক হিন্দু অভিবাসীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিকভাবে সচ্ছল। দেশের মাটি থেকে বহুদূরে থাকার জন্যই তারা স্বদেশের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান ও ধর্মাচরণ বিধির জন্য আকর্ষণ বোধ করেন। মূলতঃ এই শ্রেণীর উদ্যোগেই আমেরিকায় একের পর এক মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে। পরিসংখ্যান বলে যে সারা উত্তর আমেরিকা জুড়ে হিন্দু মন্দিরের সংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে চারশো। বোর্ড অফ ট্রাষ্টি পরিচালিত এই সব মন্দিরের পূজা-বিধির ভার ন্যাস্ত থাকে দেশ থেকে আগত পূজারী বা পুরোহিতের উপর। অধিকাংশ মন্দিরের স্থাপত্য ভাস্কর্য্য ও বাহ্যিক শোভায় দেশের বিশিষ্ট মন্দিরের অনুকরন দেখা যায়। এই শ্রেণীর প্রথম মন্দির পিটসবার্গের শ্রী ভেস্কটেশ মন্দির। স্থাপিত জুন, ১৯৭৬ সালে। তার পরের বছরই নিউ ইয়র্কের ফ্লাশিং-এ প্রতিষ্ঠা হল শ্রী গণপতি দেবস্থানম। ১৯৮১-তে ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যালিব্যু হিন্দু মন্দির। এরই প্রায় সমসাময়িক লিভারমুরের (ক্যালিফোর্নিয়া) শিব-বিষ্ণু মন্দির। ১৫-ই জুন, ১৯৮৫।
মন্দির বলতে প্রথমেই ধর্মাচরণের স্থান মনে আসে। মন্দির মানে দেবস্থান, দেবতার বাসগৃহ। পূজা-অর্চনা ছাড়া আর কিছু মন্দিরের আওতায় আসে না। দেশের প্রেক্ষিতে এই ধারণা সর্বাংশে সত্য হলেও আমেরিকার হিন্দু মন্দিরে দু’টি অন্য মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রথমতঃ মন্দিরের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দ্বিতীয়তঃ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন। একথা বলে রাখা ভাল আমেরিকায় হিন্দু মন্দিরের এই বিপুল সংখ্যা কিন্তু কোনভাবেই প্রমান করে না যে হিন্দু ধর্ম বা বিশ্বাস আমেরিকার মূলস্রোতে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। বরঞ্চ বলা যেতে পারে এইসব মন্দির ও তাদের কার্য্যকলাপ বিপুল সংখ্যাক ভারতীয় হিন্দু অভিবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে যে শূন্যতা ছিল তা পূরণে সর্মথ হয়েছে। অবশ্য সারা আমেরিকা জুড়ে মন্দিরের প্রসার ও বিস্তারের ফলে আমেরিকার মূলস্রোতে হিন্দু ধর্ম যে কিছুটা হলেও পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেটা স্বীকার না করলে মিথ্যা ভাষণ হবে। তার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ২০০৭-এর ১২ই জুলাই আমেরিকার সিনেটে প্রথম হিন্দু শাস্ত্র থেকে প্রার্থনা ও মন্ত্রোচ্চারণ। প্রার্থনা পরিচালনা করেছিলেন Rajan Zed, নেভাডার এক হিন্দু ধর্মযাজক। আমেরিকার ২১৮ বছরের সিনেটের ইতিহাসে এ রকম ঘটনার নজির আর নেই।
যাই হোক, আমেরিকার পটভূমিতে এই মন্দিরগুলি প্রধানত চারটি দায়িত্ব পালন করে থাকেঃ
১) নিজেদের শেকড় ও সংস্কৃতি সম্বদ্ধে জনচেতনা গড়ে তোলার এবং সেই ভিত্তির উপর এক নতুন চিন্তা ও দর্শনের উদ্ভবের পথ সুগম করে তোলা।
২) অপেক্ষাকৃত তরুণ সমাজের কাছে শাশ্বত হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির বিশ্বাস ও অনুশাসনগুলিকে সহজবোধ্য উপায়ে তুলে ধরা যাতে করে ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গোঁড়া ধর্মীয় প্রচেষ্ঠাকে চিনে নেওয়া যায়।
৩) হিন্দু ধর্মের আদর্শকে আমেরিকার প্রেক্ষিতে ব্যবহার করে এখানকার জনজীবনের সমস্যার গভীর অসুসন্ধান ও সমাধানের পথনির্দেশ।
৪) হিন্দু ধর্মের মানবিক ও দার্শনিক চিন্তাভাবনার সাথে অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের মেলবদ্ধনের প্রচেষ্টা।
একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যে মন্দিরগুলি এখানে যতটাই ধর্মীয় উৎসব-অনুশাসনের চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হয়, ঠিক ততটাই ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় বেশীরভাগ মন্দির কমিটির সঙ্গে ÔCultural Center' কথাটির ব্যবহার এই ধারণাকে সমর্থন করে। প্রায়শই দেখা যায় মন্দিরের একটি নিজস্ব কম্যুনিটি হল থাকে যা কিনা মন্দিরের নিজস্ব ব্যবহারের বাইরে অন্যান্য সংস্থার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ ক্যালফোর্নিয়ার সাভিনেল হিন্দু মন্দির ও কালচারাল সেন্টার, লিভারমুর শিব-বিষ্ণু মন্দিরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। লিভারমুর মন্দির সংস্থা-তে সংস্কৃত ভাষা ও যোগ ব্যায়াম শিক্ষার ব্যবস্থাও রেখেছে। স্যান লিয়ান্ড্রোর বদরিকাশ্রম তাদের প্রাঙ্গন উন্মুক্ত রেখেছেন নৃত্য-গীত ও অন্যান্য শিল্পকলার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে। পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় আলোচনার পাশাপাশি এখানে নিয়মিত সাঙ্গীতিক ও নৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। খরা-বন্যা-ভূমিকম্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় এইসব মন্দিরগুলি ত্রাণের ব্যবস্থা করে সাহায্যের হাত বাড়ায়। সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশেই হোক বা ছেড়ে আসা দেশে। অনেক মন্দির ভারতের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্কুল চালায় বা চালানোতে সাহায্য করে।
হিন্দু ধর্মে ধর্মীয় অনুসাশন এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক-দৈনন্দিন জীবন এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে একটিকে অন্যের থেকে আলাদা করাই ভার। আমেরিকার হিন্দু মন্দিরগুলি এই মেলবন্ধনের কাজটি প্রায় নিখুঁত ভারসাম্য রেখে করে চলেছে। তাই ফ্রিমন্ট মন্দির যখন রথযাত্রার আয়োজন করে, সেখানে জগন্নাথ পূজো ছাপিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মেলামেশার দিকটি আগে চলে আসে। লিভারমুরের দূর্গাপূজোয় বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশিষে যোগদান এবং আনুষঙ্গিক সাংস্কৃতিক চর্চা এটিকে দেবস্থানের বাইরে এক মিলন মেলায় পরিণত করে। একথা অল্পবিস্তর আমেরিকার প্রায় অধিকাংশ মন্দির সম্বন্ধেই প্রযোজ্য।
পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি আমেরিকার মন্দিরগুলি জ্ঞান ও মুক্ত চিন্তার বিকাশে আরও সক্রিয় হবে এই আশা রাখি। স্বদেশের অনেক মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয় অসংখ্য গলি-ঘুঁজি ও গুহা-অন্ধকার পেরিয়ে। আমেরিকার হিন্দু মন্দিরগুলির গর্ভগৃহ তুলনায় অনেক সুগম। মন্দিরের অন্দরমহল প্রশস্ত ও অনেক উন্মুক্ত। সুপবন বয়ে যাবার সুযোগ অনেক। সেই সুপবন হিন্দু মন্দির ছাপিয়ে সমস্ত মানুষের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে আন্দোলিত করুক-মুক্ত চিন্তার ভূমি আমেরিকার হিন্দু মন্দিরগুলির সেটাই হবে সার্থকতার নিদর্শন।
তথ্যসূত্রঃ
১. Excerpt from Swami Vivekananda's speech in Chicago, 1893.
২. Wood, Angela, "Hindu Temple"
৩. Pechilis, Karen, "The pattern of Hinduism and Hindu Temple building in the U.S"
৪. Kolapen, Mahalingum, "Hindu Temple in North America: A Celebration of Life."
লিখেছেনঃ প্রদোষ কান্তি সরকার
প্রবাসের সংগঠন ‘সংস্কৃতি’র কর্ণধার ও প্রবাসের নাট্য আন্দোলনের পুরোধা।
ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া
নভেম্বর ২, ২০০৯
যদিও বিবেকানন্দই সেই ব্যক্তি যিনি আমেরিকার বুকে হিন্দুধর্মকে সরাসরি পরিচিত করিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকেই একথা মনে করেন যে হিন্দুধর্মের চর্চা অভিবাসীদের মাধ্যমে এদেশে ছিল প্রায় এর জন্মলগ্ন থেকেই। যদিও এই ধারণার বাস্তব ভিত্তি কতটা, সেটা তর্কসাপেক্ষ। তবে আমেরিকানদের সঙ্গে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় আরও অনেক আগে। তৎকালীন আমেরিকার বিদ্বৎসমাজের দুই প্রতিভূ - Ralph Waldo Emerson এবং Henry David Thoreau - শ্রীমৎভাগবত গীতা নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করছিলেন সেই সময়। সেই সময়কার বিভিন্ন চিঠিপত্র ও পত্রপত্রিকায় এই দুই লেখক ভবগত গীতা সম্পর্কে তাঁদের গবেষণালব্ধ চিন্তা ও সমীক্ষার অনেক নিদর্শন রেখে গেছেন। “Over Soul” নামে একটি প্রবন্ধে Ralph-এর চিন্তায় বেদিক দর্শনের প্রভাব পরিস্কার লক্ষ্যণীয়। তাঁরা দুজনেই একমত হয়ে বলেছিলেন গীতা এশীয় সংস্কৃতির এক অনবদ্য অবদান। গীতার দার্শনিক মূল্য যেমন অনস্বীকার্য্য, তেমনি আত্মোপলব্ধি, আত্মনুসন্ধান ও আত্মসংযম অভ্যাসের ক্ষেত্রেও গীতার তাৎপর্য্য অপরিসীম। শিকাগোর বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনের প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা এসব।
বিশ্ব ধর্মসম্মেলনোত্তর স্বামী বিবেকান্দের উদ্যোগই আমেরিকার বুকে হিন্দুধর্মকে পরিচিত করানোর প্রথম সংঘবদ্ধ উদ্যোগ একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। মন্দির তখন আমেরিকাতে ছিল না। শিকাগোর মহাসম্মেলনের পর স্বামীজী আরও বছর দুই এদেশে কাটিয়েছিলেন এবং বস্টন, ডেট্রয়েট, নিউ ইয়র্ক প্রভৃতি অঞ্চলে বক্তৃতা করেছিলেন। ১৮৯৪ সালে স্বামীজী নিউ ইয়র্কে ‘বেদান্ত সোসাইটি’ স্থাপন করলেন। বলা চলে এইটি আমেরিকার বুকে হিন্দু মন্দির স্থাপনের প্রথম ধাপ। সেই সময় এদেশীও অভিবাসীদের মধ্যে বেদান্ত-দর্শনের চর্চাই ছিল এই সোসাইটির উদ্দেশ্য। এর অব্যবহিত পরেই বাবা প্রেমানন্দ সরস্বতী আমেরিকায় থেকে প্রায় বছর পাঁচেক ধরে হিন্দু ধর্মের শিক্ষা নিয়ে বক্তৃতা করলেন এবং অবশেষে ‘কৃষ্ণসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করলেন। স্বামী পরমানন্দ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিউ ইর্য়ক বেদান্ত সোসাইটির দায়িত্বভার নিয়ে এলেন এবং শেষ পর্য্যন্ত বস্টন এবং লস এঞ্জেলেস-এ বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন।
বলা হয়ে থাকে যে আমেরিকার প্রথম হিন্দু মন্দির স্থাপিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিস্কোতে। বেদান্ত সোসাইটির উদ্যোগে। তারপর আরও দুটি মন্দিরের কথা জানা যায়। ১৯৩৮ সালে হলিউড মন্দির ও ১৯৫৬ সালে সান্টা বারবারা মন্দির। যেহেতু এই সব মন্দিরগুলো স্থাপিত হয়েছিল বেদান্ত সোসাইটির তত্বাবধানে, এদের মূল লক্ষ্য ছিল বেদান্ত দর্শন এবং হিন্দু শাস্ত্র পঠন পাঠন। বেদান্তের শিক্ষার প্রধান কথা আত্মোপলব্ধি এবং মূল মন্ত্র হল মানুষই ঈশ্বর। পৌত্তলিক বিগ্রহ পূজা বেদান্তের লক্ষ্য নয়। তাই হিন্দু ধর্মবালম্বী যে সব সম্প্রদায় শিব, বিষ্ণু, নারায়ণ ইত্যাদি বহুরুপে ঈশ্বরের ভজনায় অভ্যস্ত, তাদের স্বদেশীয় মন্দিরের ধারনার সঙ্গে বেদান্তের ধারণার তফাৎ রয়েই গেল। অভাব পূরণ হল না। দেশের মত অপরূপ স্থাপত্য- ভাস্কর্য্যের মহিমামন্ডিত বিগ্রহ মন্দির গঠনের ইচ্ছা অভিবাসীদের মনে জেগে রইল তখনকার মত। সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না কেন না সেইরকম মন্দির গড়বার জন্য যে বিপুল অর্থ ও লোকবল দরকার, আমেরিকায় তখনও তা ছিল না। অভিবাসী হিন্দুর সংখ্যা তখনও আমেরিকায় নগন্যই বলা চলে।
১৯৬৫ সালে Immigration and Nationality Services (INS) Act চালু হওয়ার পর আমেরিকায় অভিবাসনের দরজা যেন খুলে গেল। ছাত্র, গবেষক, শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে এদেশে আসতে শুরু করলেন এবং এদেশেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন। এদের সঙ্গে সঙ্গেই সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচারকেরাও। আবারও বলা ভাল এই প্রচার যতটা না ছিল আমেরিকার মূল স্রোতের মধ্যে হিন্দু র্ধম ও দর্শন সম্বন্ধে উৎসাহ জাগিয়ে তোলা, ততটা ছিল এদেশীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণের প্রয়োজনীয়তা মেটানো। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কে এসে পৌছালেন স্বামী প্রভুপাদ। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন - ISKCON- International Society for Krishna Consciousness.
সনাতন ভারতীয় হিন্দু ভাবধারায় মূলতঃ দু’টি দিক দেখা যায়। প্রথমটি - ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ এবং দ্বিতীয়টি, প্রতিষ্ঠানিক এবং পূজারী নির্ভর ধর্মাচরণ এবং পূজাবিধি। প্রথমটির কোন প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। দ্বিতীয়টির জন্য দেবস্থান বা মন্দির এবং পুরোহিত দরকার। আমেরিকাতেও হিন্দু ধর্ম-প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোটামুটি এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বেদান্ত সোসাইটির মত আর যে সব প্রতিষ্ঠান এখানে যোগাভ্যাস, ধ্যান এবং হিন্দু শাস্ত্র পঠন পাঠনের ব্যবস্থা রেখেছে তারা প্রথম শ্রেণীভূক্ত।
১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকাতে প্রধানতঃ এই ধারারই প্রচলন দেখা গেছে। ১৯৬৫ সালের পর প্রতিষ্টিত ইস্কন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের প্রথম ক্ষেত্র বলা যেতে পারে। চৈতন্য-অনুসারী কৃষ্ণ-প্রেম ও ভক্তিই এদের মূল দর্শন। কৃষ্ণই প্রধান বিগ্রহ। এদের বেশীর ভাগ ভক্তকুলই উত্তর ভারতীয়। যদিও এদের বেশ কিছু সংখ্যক অভারতীয় ভক্ত সম্প্রদায় আছেন। ভক্তরা মন্দিরে মিলিত হয়ে ‘হরেকৃষ্ণ’ মন্ত্রোচ্চারণ, ভক্তি-সঙ্গীত গায়ন এবং আরতি ও পূজাপাঠের মাধ্যমে ঈশ্বরের আশীর্বাদ অভিলাষী। আরতি-গান -কীর্তনের পর প্রসাদ বিতরণ। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে ধর্মীয় ও তাত্বিক অনুশাসন সম্পর্কিত বক্তৃতাও চলে।
১৯৬৫ সালের পর থেকে, বিশেষ করে গত শতকের আশির দশকের পর থেকে অসংখ্য প্রযুক্তিবিদ এবং ছাত্র ভারত থেকে এদেশে এসেছেন। তার সঙ্গে আছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। এই বিপুল সংখ্যক হিন্দু অভিবাসীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিকভাবে সচ্ছল। দেশের মাটি থেকে বহুদূরে থাকার জন্যই তারা স্বদেশের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান ও ধর্মাচরণ বিধির জন্য আকর্ষণ বোধ করেন। মূলতঃ এই শ্রেণীর উদ্যোগেই আমেরিকায় একের পর এক মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে। পরিসংখ্যান বলে যে সারা উত্তর আমেরিকা জুড়ে হিন্দু মন্দিরের সংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে চারশো। বোর্ড অফ ট্রাষ্টি পরিচালিত এই সব মন্দিরের পূজা-বিধির ভার ন্যাস্ত থাকে দেশ থেকে আগত পূজারী বা পুরোহিতের উপর। অধিকাংশ মন্দিরের স্থাপত্য ভাস্কর্য্য ও বাহ্যিক শোভায় দেশের বিশিষ্ট মন্দিরের অনুকরন দেখা যায়। এই শ্রেণীর প্রথম মন্দির পিটসবার্গের শ্রী ভেস্কটেশ মন্দির। স্থাপিত জুন, ১৯৭৬ সালে। তার পরের বছরই নিউ ইয়র্কের ফ্লাশিং-এ প্রতিষ্ঠা হল শ্রী গণপতি দেবস্থানম। ১৯৮১-তে ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যালিব্যু হিন্দু মন্দির। এরই প্রায় সমসাময়িক লিভারমুরের (ক্যালিফোর্নিয়া) শিব-বিষ্ণু মন্দির। ১৫-ই জুন, ১৯৮৫।
মন্দির বলতে প্রথমেই ধর্মাচরণের স্থান মনে আসে। মন্দির মানে দেবস্থান, দেবতার বাসগৃহ। পূজা-অর্চনা ছাড়া আর কিছু মন্দিরের আওতায় আসে না। দেশের প্রেক্ষিতে এই ধারণা সর্বাংশে সত্য হলেও আমেরিকার হিন্দু মন্দিরে দু’টি অন্য মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রথমতঃ মন্দিরের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দ্বিতীয়তঃ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন। একথা বলে রাখা ভাল আমেরিকায় হিন্দু মন্দিরের এই বিপুল সংখ্যা কিন্তু কোনভাবেই প্রমান করে না যে হিন্দু ধর্ম বা বিশ্বাস আমেরিকার মূলস্রোতে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। বরঞ্চ বলা যেতে পারে এইসব মন্দির ও তাদের কার্য্যকলাপ বিপুল সংখ্যাক ভারতীয় হিন্দু অভিবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে যে শূন্যতা ছিল তা পূরণে সর্মথ হয়েছে। অবশ্য সারা আমেরিকা জুড়ে মন্দিরের প্রসার ও বিস্তারের ফলে আমেরিকার মূলস্রোতে হিন্দু ধর্ম যে কিছুটা হলেও পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেটা স্বীকার না করলে মিথ্যা ভাষণ হবে। তার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ২০০৭-এর ১২ই জুলাই আমেরিকার সিনেটে প্রথম হিন্দু শাস্ত্র থেকে প্রার্থনা ও মন্ত্রোচ্চারণ। প্রার্থনা পরিচালনা করেছিলেন Rajan Zed, নেভাডার এক হিন্দু ধর্মযাজক। আমেরিকার ২১৮ বছরের সিনেটের ইতিহাসে এ রকম ঘটনার নজির আর নেই।
যাই হোক, আমেরিকার পটভূমিতে এই মন্দিরগুলি প্রধানত চারটি দায়িত্ব পালন করে থাকেঃ
১) নিজেদের শেকড় ও সংস্কৃতি সম্বদ্ধে জনচেতনা গড়ে তোলার এবং সেই ভিত্তির উপর এক নতুন চিন্তা ও দর্শনের উদ্ভবের পথ সুগম করে তোলা।
২) অপেক্ষাকৃত তরুণ সমাজের কাছে শাশ্বত হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির বিশ্বাস ও অনুশাসনগুলিকে সহজবোধ্য উপায়ে তুলে ধরা যাতে করে ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গোঁড়া ধর্মীয় প্রচেষ্ঠাকে চিনে নেওয়া যায়।
৩) হিন্দু ধর্মের আদর্শকে আমেরিকার প্রেক্ষিতে ব্যবহার করে এখানকার জনজীবনের সমস্যার গভীর অসুসন্ধান ও সমাধানের পথনির্দেশ।
৪) হিন্দু ধর্মের মানবিক ও দার্শনিক চিন্তাভাবনার সাথে অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের মেলবদ্ধনের প্রচেষ্টা।
একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যে মন্দিরগুলি এখানে যতটাই ধর্মীয় উৎসব-অনুশাসনের চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হয়, ঠিক ততটাই ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় বেশীরভাগ মন্দির কমিটির সঙ্গে ÔCultural Center' কথাটির ব্যবহার এই ধারণাকে সমর্থন করে। প্রায়শই দেখা যায় মন্দিরের একটি নিজস্ব কম্যুনিটি হল থাকে যা কিনা মন্দিরের নিজস্ব ব্যবহারের বাইরে অন্যান্য সংস্থার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ ক্যালফোর্নিয়ার সাভিনেল হিন্দু মন্দির ও কালচারাল সেন্টার, লিভারমুর শিব-বিষ্ণু মন্দিরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। লিভারমুর মন্দির সংস্থা-তে সংস্কৃত ভাষা ও যোগ ব্যায়াম শিক্ষার ব্যবস্থাও রেখেছে। স্যান লিয়ান্ড্রোর বদরিকাশ্রম তাদের প্রাঙ্গন উন্মুক্ত রেখেছেন নৃত্য-গীত ও অন্যান্য শিল্পকলার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে। পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় আলোচনার পাশাপাশি এখানে নিয়মিত সাঙ্গীতিক ও নৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। খরা-বন্যা-ভূমিকম্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় এইসব মন্দিরগুলি ত্রাণের ব্যবস্থা করে সাহায্যের হাত বাড়ায়। সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশেই হোক বা ছেড়ে আসা দেশে। অনেক মন্দির ভারতের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্কুল চালায় বা চালানোতে সাহায্য করে।
হিন্দু ধর্মে ধর্মীয় অনুসাশন এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক-দৈনন্দিন জীবন এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে একটিকে অন্যের থেকে আলাদা করাই ভার। আমেরিকার হিন্দু মন্দিরগুলি এই মেলবন্ধনের কাজটি প্রায় নিখুঁত ভারসাম্য রেখে করে চলেছে। তাই ফ্রিমন্ট মন্দির যখন রথযাত্রার আয়োজন করে, সেখানে জগন্নাথ পূজো ছাপিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মেলামেশার দিকটি আগে চলে আসে। লিভারমুরের দূর্গাপূজোয় বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশিষে যোগদান এবং আনুষঙ্গিক সাংস্কৃতিক চর্চা এটিকে দেবস্থানের বাইরে এক মিলন মেলায় পরিণত করে। একথা অল্পবিস্তর আমেরিকার প্রায় অধিকাংশ মন্দির সম্বন্ধেই প্রযোজ্য।
পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি আমেরিকার মন্দিরগুলি জ্ঞান ও মুক্ত চিন্তার বিকাশে আরও সক্রিয় হবে এই আশা রাখি। স্বদেশের অনেক মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয় অসংখ্য গলি-ঘুঁজি ও গুহা-অন্ধকার পেরিয়ে। আমেরিকার হিন্দু মন্দিরগুলির গর্ভগৃহ তুলনায় অনেক সুগম। মন্দিরের অন্দরমহল প্রশস্ত ও অনেক উন্মুক্ত। সুপবন বয়ে যাবার সুযোগ অনেক। সেই সুপবন হিন্দু মন্দির ছাপিয়ে সমস্ত মানুষের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে আন্দোলিত করুক-মুক্ত চিন্তার ভূমি আমেরিকার হিন্দু মন্দিরগুলির সেটাই হবে সার্থকতার নিদর্শন।
তথ্যসূত্রঃ
১. Excerpt from Swami Vivekananda's speech in Chicago, 1893.
২. Wood, Angela, "Hindu Temple"
৩. Pechilis, Karen, "The pattern of Hinduism and Hindu Temple building in the U.S"
৪. Kolapen, Mahalingum, "Hindu Temple in North America: A Celebration of Life."
লিখেছেনঃ প্রদোষ কান্তি সরকার
প্রবাসের সংগঠন ‘সংস্কৃতি’র কর্ণধার ও প্রবাসের নাট্য আন্দোলনের পুরোধা।
ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া
নভেম্বর ২, ২০০৯
1 Comments:
সুন্দর একটি তথ্যবহুল পোষ্ট
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন