আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের তাৎপর্য সমন্বিত ভগবদ্গীতা যথাযথ যাঁরা পাঠ করেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে জানতে পেরেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ এবং লীলা পুরুষোত্তম স্বয়ং ভগবান। গীতায় বিভিন্ন শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ যে পরম পুরষ ভগবান তার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন -
মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় (৭/৭)
অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে (১০/৮)
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ (১০/১২)
আমরা দেখতে পাই অষ্টাদশ অধ্যায় যুক্ত ভগবদ্গীতার বিভিন্ন উপদেশের মাধমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পরম ভক্ত ও সখা অর্জুনের মোহ মুক্ত করার জন্য বহুভাবে চেষ্টা করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে যুদ্ধ করতে বললেন, অর্থাৎ তাঁর শরণাগত হতে বললেন। কিন্তু অর্জুনের তাতে সংশয় দেখা দিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন না তাঁর প্রকৃতপক্ষে কি করা উচিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা বুঝতে পেরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মাঝখানে অর্জুনকে আত্মতত্ত¡-বিজ্ঞান প্রদান করলেন, যাতে অর্জুন মোহ থেকে মুক্ত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ পালন করেন। প্রকৃতপক্ষে অর্জুন ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সখা অর্থাৎ নিত্য পার্ষদ, তাই অর্জুনের মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ার কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। সমগ্র মায়াবদ্ধ জীবদের মায়া থেকে মুক্তির জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিত্যসখা অর্জুনকে নিমিত্ত করে এই ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথমে অর্জুনের নিকট কর্মের ব্যাখ্যা করলেনÑকর্ম, বিকর্ম ও অকর্ম। তিনি ‘অকর্ম’ অর্থাৎ নিষ্কাম কর্মের উপর গুরুত্ব আরোপ করলেন। তারপর তিনি জ্ঞানযোগের কথা বললেন। অর্থাৎ, ভগবৎ-তত্ত¡বিজ্ঞান লাভের মাধ্যমে জড় ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে কিভাবে ব্রহ্মের ধ্যান করা যায়। তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অষ্টাঙ্গ যোগের ব্যাখ্যা করলেনÑকিভাবে একজন যোগী যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম এবং অন্তিমে সমাধির স্তরে উপনীত হয়ে হৃদয়ে অবস্থিত অন্তর্যামী পরমাত্মার দর্শন লাভ করতে পারেন।
সর্ব পরিশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কি উপদেশ দান করলেন? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ \
“সমস্ত রকমের ধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত রকম পাপকর্মের ফল থেকে মুক্ত করে উদ্ধার করব। তুমি তার জন্য চিন্তা করো না।” (গীতা ১৮/৬৬) এই শ্লোকে ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর শরণাগত হতে বললেন। সর্বধর্মান পরিত্যজ্য বলতে কর্মফল প্রদানকারী কর্মকাণ্ডীয় কর্মই কেবল ত্যাগ নয়, এমন কি মুমুক্ষুদের জ্ঞানযোগ এবং সিদ্ধিকামীদের অষ্টাঙ্গযোগকেও ত্যাগ করতে বলেছেন। কারণ, কর্মকাণ্ডের প্রতি আসক্ত হলে স্বর্গসুখের বাসনা, জ্ঞানের প্রতি আসক্ত হলে ব্রহ্মে লীন হয়ে যাওয়ার বাসনা এবং অষ্টাঙ্গযোগের প্রতি আসক্ত হলে অনিমা, লঘিমা, ঈশিতা, বশিতা, প্রাপ্তি আদি জড়-জাগতিক সিদ্ধি লাভের প্রতি বাসনা জাগ্রত হয়, ফলে মানব জীবনের পরম প্রাপ্তি যে কৃষ্ণপ্রেম তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সেই সম্বন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্ত উদ্ধবকে বলেছেন-
ন সাধয়তি মাং যোগো ন সাংখ্যং ধর্ম উদ্ধব।
ন স্বাধ্যায়স্তপস্ত্যাগো যথা ভক্তির্মমোর্জিতা \
“হে প্রিয় উদ্ধব! অষ্টাঙ্গযোগ, সাংখ্যযোগ, বেদ অধ্যয়ন, তপশ্চর্যা অথবা ত্যাগের মাধ্যমে আমাকে লাভ করা যায় না, একমাত্র আমার প্রতি শুদ্ধ ভক্তি অর্জন করে আমার ভক্ত অতি সহজেই আমাকে লাভ করতে পারে।”
সুতরাং কর্ম, জ্ঞান ও অষ্টাঙ্গ-যোগের দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে শরণাগতি হয় না, তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সব রকমের ধর্ম পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণরূপে তাঁর শরণাগত হতে বলেছেন। অর্থাৎ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ভক্তিযোগের মাধ্যমে তাঁর শরণাগত হতে বলেছেন। লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে কিভাবে শরণাগত হতে হবে, সেটিই হচ্ছে ভগবদ্গীতায় অর্জুনের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুহ্যতম উপদেশ এবং তা হচ্ছেÑ
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যামী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে \
“সর্বদাই আমার স্মরণ কর, আমার ভক্ত হও, আমাকে পূজা কর এবং আমাকে প্রণাম কর। যদি তুমি তা কর, তবে নিঃসন্দেহে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে। আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি, কেন না তুমি আমার প্রিয় সখা।” (গীতা ১৮/৬৫) সমগ্র মানব সমাজের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই গুহ্যতম বাণী যথাযথভাবে পালন করা। অর্থাৎ ভক্তিযোগের আশ্রয় গ্রহণ করে চিন্ময় কৃষ্ণলোকে লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যাওয়া। একবার কেউ সনাতন চিন্ময় ভগবৎ ধামে ফিরে গেলে, তাকে আর জন্ম-মৃত্যুময় ভৌতিক জগতে ফিরে আসতে হয় না।
প্রথমে অর্জুনও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ পালন করতে অস্বীকৃত হয়েছিলেন। পরিশেষে শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় অর্জুন সংশয় ও মোহ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন এবং তিনি সম্পূর্ণরূপে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শরণাগত হয়েছিলেন। তখন অর্জুন বলেছিলেনÑ
নষ্টো মোহ স্মৃতির্লব্ধা ত্বৎপ্রসাদান্ময়াচ্যুত।
স্থিতোহস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব \
“হে প্রিয় কৃষ্ণ! হে অচ্যুত! আমার মোহ দূরীভূত হয়েছে। তোমার কৃপায় আমার স্মৃতিশক্তি আমি পুনরায় ফিরে পেয়েছি। আমি এখন সম্পূর্ণরূপে সংশয় থেকে মুক্ত এবং তোমার উপদেশ মতো কাজ করতে আমি প্রস্তুত।” (গীতা ১৮/৭৩) শেষ পর্যন্ত অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে যুদ্ধ করেছিলেন। বহু অধার্মিক রাজাদের ধ্বংস করে ধর্মরাজ্য স্থাপনে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের কৃপার ফলে অর্জুুন পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্তরূপে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। যিনি অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন, তিনি এই জীবনে পরম সৌভাগ্যশালী তো হবেনই এবং পরবর্তী জীবনে চিত-জগতে কৃষ্ণলোকে ফিরে গিয়ে নিত্যকাল শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গলাভ করবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
দ্বাপর যুগ শেষ হয়ে এখন কলিযুগ চলছে। কলির প্রভাবে মানুষ ক্রমশ অধিক থেকে অধিকতর অধঃপতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। নেশা, মাংসাহার, জুয়া ও অবৈধ স্ত্রীসঙ্গের প্রতি মানুষের আসক্তি বৃদ্ধির ফলে ধর্মের তিনটি অঙ্গÑতপস্যা, শৌচ ও দয়া একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়, অর্থাৎ একমাত্র সত্যের অস্তিত্ব রয়েছে। ভয়ংকর কলির দ্বারা এভাবেই দ্রুত করালগ্রস্ত হওয়ার দরুন মানুষ আর কেউই ধর্মের অনুশাসন গ্রহণ করতে চায় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরম গুহ্যতম নির্দেশ-‘আমার শরণাগত হও’ মায়ামোহাচ্ছন্ন হয়ে সকলেই তা ভুলতে বসেছে। কলির ভয়ংকর তাণ্ডব নৃত্যের প্রভাবে অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ পারমার্থিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মানব-জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছে। মানুষ আহার, নিদ্রা ও স্ত্রীসঙ্গে আসক্ত হয়ে তাদের শাশ্বত, চিন্ময় স্বরূপকে ভুলে গিয়ে অনিত্য, নশ্বর জড় শরীরকেই তাদের স্বরূপ বলে মনে করতে থাকে। এই নিদারুণ শৌচনীয় অবস্থা থেকে উদ্ধারের পথ তাদের কে দেখাবে ? যার তার কথা তো মানুষ শুনবে না। সুহৃদং সর্বভূতানাম্Ñভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সমগ্র জীবকুলের একমাত্র পরম উপকারী বন্ধু। যদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবার এই কলিযুগে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর পাদপদ্মে শরণাগত হবার পন্থা প্রদর্শন করেন, তবেই মায়াবদ্ধ জীবেরা ভক্তিমার্গের পন্থা গ্রহণ করবে, নচেৎ আশা নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকেও তাঁর একান্ত শরণাগত শুদ্ধ ভক্ত অধিকতর পরদুঃখে দুঃখী। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঠিক করলেন, ভগবৎ-ভক্তির পন্থা আচরণের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি ভক্তশ্রেষ্ঠ শ্রীমতী রাধিকার ভাব ও কান্তি অবলম্বন করে ভক্তরূপে এই কলিযুগে শচীগর্ভসিন্ধু থেকে অবতীর্ণ হবেন। তিনি হচ্ছেন কলিযুগের মহাবদান্য অবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি পাঁচশো কুড়ি বছর পূর্বে কলিযুগের যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন প্রবর্তন করবার জন্য এই শ্রীধাম মায়াপুরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছেÑ
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য রাধাকৃষ্ণ নহে অন্য,
রূপানুগজনের জীবন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে স্বয়ং রাধা-কৃষ্ণের মিলিত প্রকাশ, সেই সম্বন্ধে শ্রীল স্বরূপ গোস্বামীর কড়চায় বর্ণিত হয়েছে-
রাধা কৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতির্হ্লাদিনীশক্তিরস্মা-
দেকাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ।
চৈতন্যাখ্যাং প্রকটমধুনা তদ্দ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং
রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্ \
“শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়ের বিকার-স্বরূপা; সুতরাং শ্রীমতী রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। এই জন্য তাঁরা (শ্রীমতি রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণ) একাত্মা; কিন্তু একাত্মা হলেও তাঁরা অনাদিকাল থেকে গোলোকে পৃথক দেহ ধারণ করে আছেন। এখন (কলিযুগে) সেই দুই দেহ পুনরায় একত্রে যুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে প্রকট হয়েছেন। শ্রীমতী রাধারানীর এই ভাব ও কান্তিযুক্ত শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যকে আমি আমার প্রণতি নিবেদন করি।” (চৈঃ চঃ আদি ১/৫)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে অবতরণের কারণ প্রসঙ্গে বিদগ্ধমাধবে (প্রথমাঙ্কে দ্বিতীয় শ্লোক) শ্রীল রূপ গোস্বামী উল্লেখ করেছেনÑ
অনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণাবতীর্ণঃ কলৌ
সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্।
হরিঃ পুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ\
“পূর্বে যা অর্পিত হয়নি, সেই উন্নত ও উজ্জ্বল রসময়ী নিজের ভক্তিসম্পদ দান করার জন্য যিনি করুণাবশত কলিযুগে অবতীর্ণ হয়েছেন, স্বর্ণ থেকেও সুন্দর দ্যুতিসমূহ দ্বারা সমুদ্ভাসিত সেই শচীনন্দন শ্রীহরি সর্বদা তোমাদের হৃদয়-কন্দরে স্ফুরিত হোন।” লীলা পুরুষোত্তম ভগবান কলিযুগের যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন প্রবর্তন ও প্রচারের জন্য এই কলিযুগে যে অবতীর্ণ হবেন, তা শ্রীমদ্ভাগবত, পুরাণ, উপনিষদ আদি বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে পরিদৃষ্ট হয়। পূর্বের কোনও প্রকার যোগ্যতা ছাড়া অকাতরে, নির্বিচারে, সকলকে দুর্লভ কৃষ্ণপ্রেম প্রদানের জন্যই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাই শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে‘মহাবদান্য অবতার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীধাম মায়াপুরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ফাল্গুনী পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণচ্ছলে হরিনাম সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই শ্রীধাম মায়াপুরে যে-মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন, ঠিক সে সময়ে চন্দ্রগ্রহণের পরিসমাপ্তি হওয়াতে লক্ষ লক্ষ বৈদিক ব্রাহ্মণ ও হিন্দুরা উচ্চস্বরে বৈদিক মন্ত্র পাঠ ও সংকীর্তন করে সকলে গঙ্গাস্নান করছিল। আর সেই হরিনামের চিন্ময় শব্দতরঙ্গে দশদিক আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছিল। এভাবেই মহাপ্রভু অত্যন্ত সুকৌশলে কলিযুগের যুগধর্ম সংকীর্তনের সূচনা করেন। শিশুকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ক্রন্দনের ছলে হরিনাম কীর্তন করাতেন। শিশুকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মাঝে মধ্যে হঠাৎ কেঁদে উঠতেন। তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা বিন্নিভাবে তাঁর ক্রন্দন থামাবার চেষ্টা করতেন, কিন্ত তিনি তাতে আরও বেশি কান্না করতেন। কিন্তু যেমাত্র হাত তালি দিয়ে সকলে মিলে উচ্চস্বরে-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে \
এই মহামন্ত্র কীর্তন করত, তৎক্ষণাৎ শিশু নিমাই তাঁর কান্না বন্ধ করে দিয়ে হাসতে হাসতে সকলের মুখের দিকে তাকাতেন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন দিব্যলীলা-বিলাস করছিলেন, তখন নবদ্বীপের সকলে তাঁকে নিমাই পণ্ডিত বলেই জানত। কিন্তু তিনি যে লীলা পুরুষোত্তম স্বয়ং ভগবান তা কেউ বুঝতে পারত না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গোপিকাশ্রেষ্ঠ শ্রীমতী রাধারানীর ভাব অঙ্গীকার করে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একদিন তিনি কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হয়ে ‘গোপী’ ‘গোপী’ এই নাম জপ করছিলেন। হঠাৎ তাঁর পড়–য়া ছাত্রগণ মহাপ্রভুর নিকটবর্তী হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তিনি কৃষ্ণনাম উচ্চারণ না করে গোপীনাম উচ্চারণ করছেন? মহাপ্রভু আবেশে রাগ প্রকাশ করে ঠেঙ্গা নিয়ে তাদের পিছনে তাড়া করলেন। পরিশেষে ছাত্ররা দলবদ্ধ হয়ে মহাপ্রভুকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অন্তর্যামী ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তা জানতে পারলেন। তিনি তখন ভাবতে লাগলেন, যদি এই সব ছাত্র তাঁর পাদপদ্মে অপরাধ করে, তবে কোনও দিনই তারা কৃষ্ণপ্রেম লাভ করতে পারবে না। অথচ শ্রীকৃষ্ণই মহাপ্রভুরূপে এসেছেন নির্বিচারে কৃষ্ণপ্রেম প্রদান করার জন্য। সকলেই যাতে তাঁকে শ্রদ্ধাভক্তি করে ব্রহ্মার দুর্লভ কৃষ্ণপ্রেম লাভ করতে পারে, তাই তিনি ঠিক করলেন গৃহস্থ-আশ্রম পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস-আশ্রম গ্রহণ করবেন। কারণ সন্ন্যাসীকে সকলেই শ্রদ্ধাভক্তি করে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছ থেকে সন্ন্যাস-ধর্ম গ্রহণ করে, শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের গৃহে শোকসন্তপ্তা ও বিরহবিধূরা শচীমাতা ও আপন প্রি
য় ভক্তদের সান্ত্বনা দানের পর শচীমায়ের অনুমোদন নিয়ে যখন জগন্নাথ পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরে এসে প্রেমে বিহŸল হয়ে শ্রীজগন্নাথদেবকে আলিঙ্গন করবার জন্য বিগ্রহের দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন, তখন গভীর ভাবের আবেগে মেঝেতে পতিত হয়ে মূর্ছাপ্রাপ্ত হলেন। নিকটেই বেদান্ত-দর্শনের ভারত বিখ্যাত দার্শনিক পণ্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি মহাপ্রভুর সর্বাঙ্গে এই প্রকার অলৌকিক সাত্তি¡ক বিকার দর্শন করে আশ্চার্যান্বিত হলেন এবং চিন্তা করলেন, মনুষ্য-শরীরে এই প্রকার সাত্তি¡ক প্রেমের বিকার কিভাবে প্রকাশ হতে পারে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শরীরে কোন প্রকার স্পন্দন দেখতে না পাওয়ায় সার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাপ্রভুকে তাঁর নিজের গৃহে এনে রেখেছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ পার্ষদ শ্রীল গোপীনাথ আচার্য সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে, মহাপ্রভু হচ্ছেন স্বয়ং ঈশ্বর। কিন্তু সার্বভৌম ভট্টাচার্য তা অস্বীকার করে গোপীনাথ আচার্যকে বললেন যে, তিনি কিসের ভিত্তিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ঈশ্বর বলে স্বীকার করছেন, তা ছাড়া কলিযুগে ভগবানের কোনও অবতার নেই। তখন গোপীনাথ আচার্য ঈশ্বরের অন্তর ও বহির লক্ষণ ব্যাখ্যা করে শাস্ত্রে যে কলিযুগে ভগবানের অবতার আছে, তা মহাভারত (দানধর্ম বিষ্ণুসহস্রনাম-স্তোত্র) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শোনালেনÑ
সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গো বরাঙ্গশ্চন্দনাঙ্গদী।
সন্ন্যাসকৃচ্ছমঃ শান্তো নিষ্ঠাশান্তিপরায়ণঃ \
“ভগবান তপ্ত কাঞ্চনের মতো অঙ্গকান্তি ধারণ করে (গৌরসুন্দর রূপে) অবতীর্ণ হবেন। তাঁর সুন্দর রূপ তপ্ত কাঞ্চনের মতো এবং চন্দনে চর্চিত। তিনি সন্ন্যাস-আশ্রম অবলম্বন করে কঠোরভাবে আত্মসংযমী হবেন এবং মায়াবাদী সন্ন্যাসীদের মতো নির্বিশেষবাদী না হয়ে তিনি ভগবৎ-ভক্তিতে নিষ্ঠাপরায়ণ হবেন এবং সংকীর্তন আন্দোলনের সূচনা করবেন।”
পরে সার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাপ্রভুকে সাতদিন ধরে বেদান্ত-দর্শন শ্রবণ করিয়েছিলেন। মহাপ্রভু তার ভ্রান্ত নির্বিশেষপর মায়াবাদী ব্যাখ্যা খণ্ডন করে বেদান্তের নির্ভুল সবিশেষ-তত্ত¡ ব্যাখ্যা করলেন এবং পরিশেষে তাঁকে ষড়ভুজরূপে দর্শন দান করে এক মহান ভক্তরূপে পরিণত করলেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাপ্রভুর কৃপা প্রাপ্ত হয়ে তাঁকে একশো শ্লোকদ্বারা বন্দনা করেছিলেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মতো অনেকেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুই যে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা জানতে পারেননি। কারণ ভগবানের কৃপা ছাড়া ভগবানকে জানা যায় না। শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র যে শচীসূতরূপে অবতীর্ণ হবেন তা ভবিষ্যৎ পুরাণেও উল্লেখ আছে-
অজায়ধ্বমজায়ধ্বজয়ধ্বং ন সংশয়ঃ।
কলৌ সংকীর্তনারম্ভে ভবিষ্যামি শচীসুতঃ \
“কলিযুগে সংকীর্তন আরম্ভে আমি শচীসূতরূপে জন্মগ্রহণ করব, জন্মগ্রহণ করব, জন্মগ্রহণ করব, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (আদি ৩/৪০) উল্লেখ আছেÑ
কলিযুগে যুগধর্মÑনামের প্রচার।
তথি লাগি’ পীতবর্ণ চৈতন্যাবতার \
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখনই অবতীর্ণ হন, তখনই তিনি নবদ্বীপের অন্তর্দ্বীপে অন্তর্গত এই শ্রীধাম মায়াপুরে শচীমায়ের গর্ভে অবতীর্ণ হন। তবে শ্রীকৃষ্ণের মতো তিনিও প্রতি কলিযুগে অবতীর্ণ হন না। তিনি ব্রহ্মার দিবসে অর্থাৎ এক হাজার চতুর্যুগের মধ্যে একবার মাত্র অবতীর্ণ হন। সেই সম্বন্ধে শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (আদি ৩/১০) উল্লেখ করা হয়েছে-
অষ্টাবিংশ চতুর্যুগে দ্বাপরের শেষে।
ব্রজের সহিত হয় কৃষ্ণের প্রকাশে \
“বৈবস্বত মন্বন্তরের অষ্টাবিংশ চতুর্যুগের দ্বাপরের শেষভাগে কৃষ্ণ নিজে ব্রজতত্তে¡র সমস্ত উপকরণ সহ প্রকাশ পান।” সেই প্রকার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও দ্বাপরের পরেই কলিতেই অবতীর্ণ হন। তিনি এসে কি করেন? অনর্পিত বস্তু প্রদান করেন, যা ভগবানের অন্য কোন অবতার ইতিপূর্বে প্রদান করেননি। তা হচ্ছে কৃষ্ণপ্রেম, বিশেষ করে ব্রজের পরকীয়া মাধুর্য প্রেম, যাকে উন্নতোজ্জ্বল রস বলা হয়েছে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন