পাপ ভারাক্রান্ত পৃথিবীর বেদনায় বেদনার্থ হইয়া দ্বাপরে প্রার্থনা করেছিলেন ব্রম্মা আর কলির যুগে শ্রী অদ্বৈতাচার্য। শ্রী অদ্বৈতাচার্য শ্রীহট্র নিবাসী একজন শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ও নৈষ্ঠিক ব্রাক্ষন ছিলেন।সদাশিবের অবতার হিসাবে তাঁর পরিচিতি ছিল। নবদ্বিপের শান্তিপুরে শ্রী অদ্বৈতাচার্য বসবাস করতেন। তিনি প্রতিদিন মদন গোপালের পাদপদ্মে গঙ্গাজল তুলসী দিয়ে বলিতেন-“প্রভূ মদন গোপাল তুমি ধরার বুকে নামিয়া আস। সত্য ধর্ম সংস্থাপন কর”।
তিনি দূর চিত্তে বলতেন- “করাইবো কৃষ্ণ সর্ব নয়ন গোচর,তবে সে অদ্বৈত নাম কৃষ্ণের কিংকর”ভক্তের ডাকে ভগবান সাড়া দিলেন। একদিন শ্রী অদ্বৈতাচার্য গঙ্গার তীরে বসিয়া মদন গোপাল বলে কাঁদতে ছিলেন। হঠাৎ দেখিলেন একটি তুলসী পত্র স্রোতের বিপরীত দিকে ভাসিয়া চলিছে। তিনি বিস্মিত হলেন এবং তুলসী পত্রের অনুগমন করিলেন। নদীয়ার গঙ্গার ঘাটে তখন অগনিত নরনারী স্নান করছিলেন। উক্ত তুলসী পত্রটি শ্রী হট্রনিবাসী উপেন্দ্র মিশ্রের পুত্র জগন্নাথ মিশ্রের সহধর্মিনী এবং নীলাম্বর চক্রবর্তীর কন্যা শচীদেবীর নাভিমূলে এসে ঠেকিয় স্থির হলো। শ্রী অদ্বৈতাচার্য বুঝিলেন মদন গোপাল এই ভাগ্যবতী রমনীর গর্ভেই আসিবেন। শ্রী চৈতন্য গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূ মাতৃগর্ভ সিন্ধুতে আসেন শ্রী হট্র(সিলেট) জেলার ঢাকা দক্ষিন গ্রামে। জগন্নাথ মিশ্রের মাতৃদেবী শোভাময়ী স্বপ্নে দেখেন তাঁর পুত্রবধুর গর্ভে স্বয়ং নারায়ন আবির্ভূত হবেন। তিনি গঙ্গাতীরে জন্মিবেন।
স্বপ্ন দেখে শোভাময়ী দেবী পূত্র ও পুত্রবধুকে নবদ্বিপে পাঠাইয়া দিলেন। এবং যাবার সময় বলেছিলের যিনি আসিবেন তাঁকে আমায় দেখাইও। মহাপ্রভূ শচী দেবীর দশম গর্ভের সন্তান। শচী দেবী ও জগন্নাথ মিশ্রও সপ্নে দেখেছিলেন-শচী কহে-“ মুঞি দেখো আকাশ উপরে,দিব্য মূর্তি লোক সব যেন স্তুতি করে”।
উভয়েই প্রতিক্ষায় থাকলেন সেই উন্নতসত্তা মহাপুরুষের শুভ আবির্ভাবের জন্য। কিন্তু কোথায় সেই মহাপুরুষ! দশ মাস-এগারো মাস-বার মাস গিয়ে তের মাস চলিল। শচীদেবীর জনক প্রখ্যাত জ্যোতিষি নীলাম্বর চক্রবর্তী গনিয়া কহিলেন, এই মাসেই শুভ লগ্নে এক সুলক্ষন পুত্র জন্মিবে।
আবির্ভাবঃ– ফাল্গুন মাস নব-বসন্ত দোল পূর্নিমা তিথি। এই দিনটিতে প্রতি বছরই পূর্নচন্দ্র তাঁর অমল-ধবল-স্নিগ্ধ কিরনে ধরনীকে স্নান করিয়ে দেয়ার জন্য স্বগর্বে উদিত হন। কিন্তু ৮৯২ বঙ্গাব্দের ২৩ ফাল্গুন(১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ) শনিবারে যেনো চন্দ্রের পূর্নতা, স্নিগ্ধতা,শুভ্রতা, সকলই কোন অদ্বিতীয় অভিমর্ত্য চন্দ্রের নিকট তিরস্কৃত। ভূলোকের চন্দ্রের পূর্নতা গোলকের চন্দ্রের পূর্নতার নিকট পরাভূত। এ সত্য প্রচারের জন্য অকলঙ্ক শ্রী চেতন্য গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূর আবির্ভাবের পূর্বে জগচ্চন্দ্র রাহুগ্রস্থ হয়ে পড়ল অর্থাৎ চন্দ্র গ্রহন হল। বিশ্বের চতুর্দিকে হরি নামের ধ্বনি উঠল। কর্মকোলাহল রেখে সবাই খোল করতাল নিয়ে হরিনাম কীর্ত্তন
করছে। হরি নামে মুখরিত চারিদিক এ সময়ে সিংহলগ্নে সিংহ রাশিতে শ্রীশচীর গর্ভসিন্ধু হতে শ্রী মায়া পুরে পূর্ন শশী আনিন্দ্য সুন্দর অমৃত পুরুষ উদিত হলেন। অচৈতন্য বিশ্বে চৈতন্য সঞ্চার হলো। মায়া মরুতে অমৃত মন্দাকিনী প্রবাহিত হলো। অবিরল ধারায় হরি কির্ত্তন সুধাসঞ্জীবনী বর্ষিত হওয়ায বিশ্বের হরিকির্ত্তন-দুর্ভিক্ষ-দুঃখ বিদূরিত শান্তিপুরে শ্রী অদ্বৈতাচার্য ও ঠাকুর হরিদাসসহ সকল ভক্তবৃন্দ আনন্দে নূত্য করলেন।
ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করে পরবর্তীকালে বিশ্বম্ভর, নিমাই ও শ্রী চৈতন্য নামের মধ্য দিয়ে বাঙালি সমাজের অবহেলিত মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হবেন এটা কে বুঝতে পেরেছিলেন? শ্রী চৈতন্য গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূ ১৪৯১ থেকে ১৪৯৭ পর্যন্ত শাস্ত্রীয় বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
আনুমানিক ১৫০৫ সাল থেকে তাঁর অধ্যাপনার সূচনা ঘটে। ১৫০৮ সালে গয়াধামে ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষাগ্রহণের পর নবদ্বীপে ফিরে বপ্রকাশ ও সংকীর্তন আরম্ভ করেন তিনি। ১৫০৯ সালের শেষদিকে সংকীর্তনাদির অবসান ঘটিয়ে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন ১৫১০ সালে। এরপর তিনি রাঢ়, নীলাচল, বঙ্গদেশ, বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী, শান্তিপুর প্রভৃতি জায়গায় ভ্রমণ করে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। ১৫৩৩ সালের ২৯ জুন তিনি দেহান্তরী হন।
গুপ্ত বৃন্দাবনঃ-মহাপ্রভু কলিযুগে যুগধর্ম প্রচার করার জন্য অবতরণ করবেন শ্রীজগন্নাথের আঙ্গিনায়, তাই লীলাক্ষেত্র বিস্তার ও লীলাপার্ষদ সাজানোর আয়োজন চলছে চারিদিকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লীলা সহচর হয়ে জন্ম হয়েছে দেব-দেবী ও ঋষিকল্প অনেক মহাজনদের। কারণ তাঁরা লীলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ভগবানের আগমনকে স্বাগত জানাবার জন্য ধরাধামে নেমে এসেছেন আগে ভাগেই। গৌরাঙ্গ লীলার শুভ বাস্তবায়নের জন্য শ্রীহট্টের ঢাকাদক্ষিণেও জন্ম নিলেন লীলা সহচরের। ‘শ্রী’ শব্দের অর্থ ‘ভক্তি ঐশ্বর্য’, আর ‘হট্ট’ শব্দের অর্থ ‘মিলনমেলা’।
তাই শ্রীহট্ট নামটি হল ভক্তের মিলন মেলা। এ হাটে আসে অনেকেই কেনাবেচা করতে। এখানে অমূল্য প্রেমধন ‘শ্রী’ সম্পদ বিনামূল্যে বিক্রি হয়।আর এধন বিক্রি করবেন কষিত-কাঞ্চন-বর্ণধারী গৌর হরি। তাই শ্রীহট্টে মিলায়েছেন আগাম মেলা। এটিই শ্রীহট্ট নামের বৈশিষ্ট্য। আর ঢাকাদক্ষিণের ‘দক্ষিণ’ হওয়ার তাৎপর্য হল- কৃষ্ণের বামে রাই কিশোরী ব্রজের যুগলরূপের বিগ্রহ। আর কৃষ্ণের দক্ষিণে অবস্থান নিয়ে গৌরহরি যেন কৃষ্ণকে ঢেকে অর্থাৎ দ্বাপর লীলা আবরণ করে মধুময় নবদ্বীপ লীলা বিহার করছেন। তাছাড়া এই গৌরলীলা মাধুর্য আস্বাদনে যমের দক্ষিণ দুয়ারটিও বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে- এই তো ঢাকাদক্ষিণ নামের সার্থকতা। সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু একবার মহাপ্রভুকে শান্তিপুরে শ্রীল অদ্বৈত আচার্যের বাড়ীতে নিয়ে আসেন এবং শোকাতুরা জননী শচীদেবীকে পুত্রের দর্শনের জন্য সেখানে নিয়ে আসা হয়। মা এবং ছেলের অপূর্ব মিলনের আনন্দের মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসী নিমাই মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খান অদ্বৈতের গৃহে। মা জানেন নিমাই সন্ন্যাসী হয়েছে ঠিকই কিন্তু সংসারের কাজ এখনও তাঁর বাকি আছে- গর্ভাশয়ে থাকাবস্থায় তাঁর ঠাকুর-মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এখনও অপূর্ণ রয়েছে। শোভাদেবী আজও হয়তো তাঁর চোখ খুঁইয়ে নাতীর দর্শন আশায় কোনরকমে জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাই মা শচীদেবী তাঁকে ঢাকা দক্ষিণে ফিরে গিয়ে তাঁর ঠাকুরমার শেষ ইচ্ছাটি পূর্ণ করার জন্য সন্ন্যাসী নিমাইকে নির্দেশ দিলেন।
বললেন-তোমার পিতামহী আমাকে বলেছিলেন, হে ভাগ্যবতি! তোমার এই গর্ভবাস হতে যে পরম পুরুষ উদয় হবেন, তাঁকে দেখবার জন্য বিশেষ উৎকণ্ঠিতায় আছি। অতএব তাঁকে শীঘ্রই আমার নিকট পাঠাবে। আমি তাঁর মহাবাক্য স্বীকার করে, তোমাকে গর্ভে নিয়ে নবদ্বীপে এসেছিলাম। অতএব এখন তোমাকে আমার প্রতিশ্রুতি বাক্য পালন করতে হবে। অর্থাৎ এখান হতেই তোমাকে পিতামহীর সাথে মিলবার জন্য যেতে হবে।
১৫১০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে মায়ের কথামত মহাপ্রভু তাঁর পিতামহীকে দর্শন দেবার জন্য ঢাকাদক্ষিণে আসতে মনস্থ করলেন। মহাপ্রভু মাতৃবাক্য শ্রবণ করে স্বীয় অচিন্তনীয় শক্তিপ্রভাব বিস্তার করে গুপ্তলীলা সহকারে পিতামহী সদনে যাবার জন্য উপক্রম করলেন। শ্রীহট্টের ঢাকাদক্ষিণে যাবার পথে তিনি প্রথমে তাঁর পূর্বপুরুষের নিবাসস্থল শ্রী হট্রের বালাগঞ্জের বরুঙ্গাতে পদার্পণ করলেন। সেখানে তিনি হলচাষরত গো-মোচন করলেন এবং গো- মুখে হরিনাম উচ্চারিত করে গো-মুক্ত করলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু আদিতে প্রপিতামহ শ্রীপাদ মধুকর মিশ্রের বাসভূমি বরগঙ্গা (বুরুঙ্গা) নামক স্থানে পদার্পণ করলেন। তথায় কৃষকগণকে মধ্যাহ্ন সময়ে হালচাষ করতে দেখে, করুণানিধির হৃদয় গো-গণের প্রতি সদয় হল। তিনি তখন কৃষকগণকে বললেন, মধ্যাহ্নকালে চাষ করা মহা পাপ। তোমরা গো-মোচন কর। এই আদেশ শ্রবণ করে রামদাস নামক জনৈক কৃষক সন্ন্যাসবেশী শ্রীগৌরাঙ্গকে বলল, ধান্যক্ষেত্রে অতি অল্প জল রয়েছে। সেইজন্য আজই এই জমি চাষ করা প্রয়োজন। এরর্প শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হল সমীপে গমন করলেন।
শ্রীমন্মহাপ্রভু গোপৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করে হরিধ্বনি করতে লাগলেন। তাঁর শ্রীমুখোচ্চারিত শ্রীহরিধ্বনি শ্রবণ করে গো-সকলও মধুময় হরিধ্বনি করতে লাগল। কৃষকেরা প্রায় জলশূন্য কৃষিক্ষেত্রের জন্য বড়ই ব্যস্ত ছিল, কিন্তু সেই ধান্যক্ষেত্রটি সহসা জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। চাষীগণ এইসব অলৌকিক ঘটনা দেখে শীঘ্র গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীগণকে এই অদ্ভুত কথা বললেন। তাহা শ্রবণান্তে, সেই গ্রামস্থ মিশ্রবংশীয় জনগণ সেখানে এসে শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে তাঁর প্রপিতামহ শ্রীপাদ মধুকর মিশ্রের বাড়িতে আনয়ন করলেন। মহাপ্রভুর এরূপ অলৌকিক ভাব দেখে তাঁরা অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে সাক্ষাৎ নারায়ণজ্ঞানে যথোচিত সেবা করলেন।
এখান থেকে মহাপ্রভু তাঁর পিতৃনিবাস তথা পিতামহ উপেন্দ্র মিশ্রের ঢাকাদক্ষিণের ঠাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ১৫১০ সালের চৈত্রমাসের কোন এক রবিবারে ছুটে আসেন ঢাকাদক্ষিণের গুপ্ত বৃন্দাবন ধামে। তাঁর পিতামহী শোভাদেবী অধীর আগ্রহে নাতীর দর্শন আশায় পথ চেয়ে বসেছিলেন। তাঁর দীর্ঘদিনের আশা আজ ফলবতী হতে চলল ধর্মপরায়ণা শ্রীল উপেন্দ্র মিশ্রের পতœী বৃদ্ধা শ্রীমতি শোভাদেবী, সর্বদাই মনে মনে চিন্তা করতেন যে, আমি কখন আমার নাতীকে দেখতে পাব। মহাপ্রভু গর্ভাবস্থায় তাঁর চিন্ময়ী দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন পিতার ঢাকাদক্ষিণের নিবাসস্থানটি। আজ তিনি সেই স্মৃতি বিজরিত শান্তির নীড়ে আবার ফিরে এসেছেন। ঘুরেফিরে দেখছেন বাড়ীর চারিদিক। হঠাৎ শ্রীল পরমানন্দ মিশ্রের পতœী সুশীলাদেবীর নজর পড়ল সন্ন্যাসীর দিকে। কি দিব্যকান্তি চেহারা! আজানুলম্বিত বাহু, সুঠাম পূর্ণদেহী নবীন দণ্ডধারী গৌর তনু! দেখলে মন জুরিয়ে যায় একেবারে। সুশীলাদেবী মুগ্ধনয়নে ভাল করে দেখে নিলেন সন্ন্যাসীকে। পরে দর্শন আশা কিঞ্চিৎ প্রশমিত করে তিনি শ্বাশুড়ী শোভাদেবীকে এই শুভ সংবাদটি দেবার জন্য গৃহাভ্যন্তরে চলে এলেন। সংবাদ পেয়ে শোভাদেবী গৃহাভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন নবীন সন্ন্যাসীকে। শোভাদেবীর মনে আনন্দ আর ধরে না। যে স্বপ্নের প্রাণপুরুষকে দেখার জন্য এতদিন যাঁর তৃষিত নয়ন অপেক্ষা করছিল, সেই প্রাণের ঠাকুর সাক্ষাৎ নারায়ণ আজ তাঁর নয়ন-মন আলো করে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরই সামনে। একি অদ্ভুত অপার আনন্দ! সেই বৃদ্ধা শ্রীমতি শোভাদেবী, গৃহ হতে বের হয়ে এসে শ্রীনারায়ণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকে দেখে স্বয়ং ঈশ্বর এখানে এসেছেন এই কথা মনে ভেবে বড়ই প্রফুল্লা হলেন। তারপর তিনি তাঁকে বসতে আসন দিলেন এবং ধর্মপরায়ণা বৃদ্ধা সাশ্রুনয়নে, পুলকিত শরীরে, ধীরে ধীরে মধুর বাক্যে তাঁর স্তব করলেন। নররূপধারী পদ্মপলাশলোচন সচ্চিদানন্দবিগ্রহ স্বর্ণবর্ণ বিষ্ণুকে নমস্কার। হে পুরুষোত্তম! তোমাকে নমস্কার। হে বাঞ্ছিতপ্রদ ভগবান্! তোমাকে প্রণাম করি। ঠাকুরমা দেখছেন সন্ন্যাসীকে, কিন্তু তিনি দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় আদরের নাতীকে। নিশ্চয়ই নারায়ণরূপী এই সন্ন্যাসী তাঁর নাতীর খবর রাখেন। তাই অস্থিরচিত্তে শোভাদেবী এই একটি জিঙ্গাসা নিয়ে সন্ন্যাসীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি সন্ন্যাসীর মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন স্বপ্নে দেখা সেই প্রাণময় শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটি।
কিন্তু তিনি আজ দেখছেন কৃষ্ণতনু মূর্তির বদলে তাঁর সামনে গৌরতনু এক নবীন সন্ন্যাসীর দিব্য মূর্তি। তিনি নাতীর কাছে প্রশ্ন ছিলেন, “তোমাকে আমি তো মাতৃগর্ভে এমনরূপে দেখিনি, তোমার মুরলীধারী নবীন-নটবর বেশ শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটি তুমি কোথায় লুকালে!” প্রভু আর কি করেন, সরল বিশ্বাসী ঠাকুর মা শোভাদেবীকে গৌরা-কৃষ্ণরূপ যুগল মূর্তিতে দর্শন দান করে ধন্য করলেন। মহাপ্রভু পিতামহী শোভাদেবীর অন্তরের ভাব বুঝে তাঁকে দিব্যচক্ষু দান করে চাক্ষুষভাবে দেখিয়ে দিলেন তাঁর আপন স্বরূপটি। জগদীশ্বর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু পিতামহীর সেই কথা শ্রবণান্তে কৃপা করে তাঁকে আপন পরিচয় প্রদান করলেন। সুশীলাদেবী সন্ন্যাসীবেশী এক সুন্দর মহাপুরুষকেই দেখলেন, কিন্তু শোভাদেবী তাঁর মধ্যে দেখলেন সাক্ষাৎ ভগবানকেই। ভক্তের কাছে লুকাতে পারেননি তিনি, ভক্তবৎসল ভগবান্ সন্ন্যাসীবেশের মধ্যেই শোভাদেবীকে দেখালেন তাঁর ভগবৎ স্বরূপটি আর সুশীলাদেবী সন্ন্যাসবেশীকে দেখলেন। তিনি শোভাদেবীকে বললেন, “আমি সেই তো সেই- যিনি তোমার ঘরের নিমাই, তিনিই আবার দ্বাপরের কৃষ্ণ কানাই।” শোভাদেবী ও মহাপ্রভুর ভক্তিপূর্ণ এই ভাববিলাস তাঁর অন্য নাতী প্রদ্যুম্ন মিশ্র সাক্ষাৎ দর্শন করে গর্ভানিষ্ঠান সময়ে, যেরূপে শোভা দেবীর প্রতি দৈববাণী করেছিলেন, তাহাই প্রদর্শিত হল।
পরম ভক্তিমতী বৃদ্ধা, শ্রীগৌরাঙ্গ ও শ্রীকৃষ্ণ, এই দুইরূপ দেখে বিস্মিত ও পুলকিত হয়ে বললেন, হে ভগবান! তোমাকে নমস্কার। মহাপ্রভু শোভাদেবীকে বলেন, “কষ্ট নিও না ঠাকুর মা, আমার এই যুগলমূর্তি ঠাকুর বাড়ির দেবালয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নিত্য পূজার্চনা করবে। আমার বংশের সন্তানেরা শ্রী হট্রের ঢাকাদক্ষিণের দেবালয়ের গৌরবেই আবহমানকাল বেঁচে থাকবে। শ্রী হট্র তথা ঢাকাদক্ষিণ আজ থেকে গুপ্ত বৃন্দাবন বলে পরিচিত হবে। আমি নিত্যকাল এখানে লীলা করব। “বাসুদেব ঘোষ কহে করি জোড় হাত, যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই গন্নাথ”আসলে কৃষ্ণরূপটি বৃন্দাবনের আর গৌররূপটি নবদ্বীপের। দ্বাপর শেষে কলিতে তাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। কলি এসেছে, তাই দ্বাপরের কৃষ্ণের প্রয়োজন এবার চৈতন্যে সীমায়িত হয়েছে। কাজেই প্রেমের রাজা শ্রীচৈতন্যই বামা নায়িকা শ্রীরাধার মত বেদনাভারে প্রাণকৃষ্ণকে খুঁজতে খুঁজতে নামের বাহারে পাগলপারা হয়ে সকলকে প্রেম দান করছেন আর শ্রীমুখে বলছেন, “গোকুলের যে প্রেম হলো নাকো সারা নদীয়ায় তা হবে সারা।”রাধার যে প্রেম কৃষ্ণকে ঘিরে, দ্বাপরে তা পূর্ণ হয় নি, তাই অন্তঃ-কৃষ্ণ বহিঃ-রাধা হয়ে রাধাভাবে আবিষ্ট হয়ে গৌর সুন্দর একই অঙ্গে দুইরূপ হয়ে আস্বাদন করছেন আপনি আপনাকে। এই তো গৌর হরি, কলির প্রেমরতন, দ্বাপরের কৃষ্ণ-কানাই। আমরা তাঁর ভাবগ্রাহী যুগলতনুর রস আস্বাদনের আশায় পথ চেয়ে বসে রই। “স্মরনেরে নব গৌরচন্দ্র মাধব মনোহারী।” পরমাত্মা পূর্ণব্রহ্ম সনাতন দ্বাপরে এসেছিলেন কৃষ্ণ হয়ে, এবার এসেছেন গৌরতনু গৌরহরি হয়ে এই গৌরতনু শ্রীরাধার ভাবকান্তি হৃদয়ে ধারণ করে গৌরহরি হয়েছেন।
কৃষ্ণই রাধা, রাধাই কৃষ্ণ; ভাববিলাসে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে অনন্য রসব্যঞ্জন করেন, আবার ঘনায়িত প্রেমবিগ্রহ হয়ে আপামর ভক্তসঙ্গে প্রেমরসনির্যাস আস্বাদন করেন এবং প্রেমধন্য হয়ে ঐ অপ্রাকৃত রস ভক্তের মাঝে বিতরণ করেন এই রঙ্গমঞ্চের লীলানটবর গৌরসুন্দর নরবপু ধারণ করে সর্বোত্তম নরলীলা করবার জন্য এবার এসেছেন ধরার ধূলায় নেমে। মহাপ্রভু ও তাঁর পার্ষদগণ এক অভিনব প্রেমের উদার দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলেন পৃথিবীর পাপাসক্ত মানুষের পানে। সে দৃষ্টিতে ছিল প্রাণঢালা প্রেম আর প্রাণপুটিত রসমাধুর্যপূর্ণ অমিয় রসধারা। তিনি পুরাণ-প্রাণ পুরুষ, অনন্য প্রেমের ঠাকুর। তিনি তাঁর অপূর্ব কৃষ্ণকথামৃত দান করে কলিহত জীবের ত্রাণকর্তা হিসেবে আপনার জনের মত মানুষের কাতারে নেমে এসেছেন। নাম আর প্রেমের মালা গেঁথে তিনি জগতের গলায় পরিয়ে দিয়েছেন অমূল্য এক বরণমালা।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন- “এই গুপ্ত ভাবসিন্ধু, ব্রহ্মা না পায় একবিন্দু,হেন ধন বিলাইল সংসারে”।
Post Courtesy: Sagar Bhowmick
তিনি দূর চিত্তে বলতেন- “করাইবো কৃষ্ণ সর্ব নয়ন গোচর,তবে সে অদ্বৈত নাম কৃষ্ণের কিংকর”ভক্তের ডাকে ভগবান সাড়া দিলেন। একদিন শ্রী অদ্বৈতাচার্য গঙ্গার তীরে বসিয়া মদন গোপাল বলে কাঁদতে ছিলেন। হঠাৎ দেখিলেন একটি তুলসী পত্র স্রোতের বিপরীত দিকে ভাসিয়া চলিছে। তিনি বিস্মিত হলেন এবং তুলসী পত্রের অনুগমন করিলেন। নদীয়ার গঙ্গার ঘাটে তখন অগনিত নরনারী স্নান করছিলেন। উক্ত তুলসী পত্রটি শ্রী হট্রনিবাসী উপেন্দ্র মিশ্রের পুত্র জগন্নাথ মিশ্রের সহধর্মিনী এবং নীলাম্বর চক্রবর্তীর কন্যা শচীদেবীর নাভিমূলে এসে ঠেকিয় স্থির হলো। শ্রী অদ্বৈতাচার্য বুঝিলেন মদন গোপাল এই ভাগ্যবতী রমনীর গর্ভেই আসিবেন। শ্রী চৈতন্য গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূ মাতৃগর্ভ সিন্ধুতে আসেন শ্রী হট্র(সিলেট) জেলার ঢাকা দক্ষিন গ্রামে। জগন্নাথ মিশ্রের মাতৃদেবী শোভাময়ী স্বপ্নে দেখেন তাঁর পুত্রবধুর গর্ভে স্বয়ং নারায়ন আবির্ভূত হবেন। তিনি গঙ্গাতীরে জন্মিবেন।
স্বপ্ন দেখে শোভাময়ী দেবী পূত্র ও পুত্রবধুকে নবদ্বিপে পাঠাইয়া দিলেন। এবং যাবার সময় বলেছিলের যিনি আসিবেন তাঁকে আমায় দেখাইও। মহাপ্রভূ শচী দেবীর দশম গর্ভের সন্তান। শচী দেবী ও জগন্নাথ মিশ্রও সপ্নে দেখেছিলেন-শচী কহে-“ মুঞি দেখো আকাশ উপরে,দিব্য মূর্তি লোক সব যেন স্তুতি করে”।
উভয়েই প্রতিক্ষায় থাকলেন সেই উন্নতসত্তা মহাপুরুষের শুভ আবির্ভাবের জন্য। কিন্তু কোথায় সেই মহাপুরুষ! দশ মাস-এগারো মাস-বার মাস গিয়ে তের মাস চলিল। শচীদেবীর জনক প্রখ্যাত জ্যোতিষি নীলাম্বর চক্রবর্তী গনিয়া কহিলেন, এই মাসেই শুভ লগ্নে এক সুলক্ষন পুত্র জন্মিবে।
আবির্ভাবঃ– ফাল্গুন মাস নব-বসন্ত দোল পূর্নিমা তিথি। এই দিনটিতে প্রতি বছরই পূর্নচন্দ্র তাঁর অমল-ধবল-স্নিগ্ধ কিরনে ধরনীকে স্নান করিয়ে দেয়ার জন্য স্বগর্বে উদিত হন। কিন্তু ৮৯২ বঙ্গাব্দের ২৩ ফাল্গুন(১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ) শনিবারে যেনো চন্দ্রের পূর্নতা, স্নিগ্ধতা,শুভ্রতা, সকলই কোন অদ্বিতীয় অভিমর্ত্য চন্দ্রের নিকট তিরস্কৃত। ভূলোকের চন্দ্রের পূর্নতা গোলকের চন্দ্রের পূর্নতার নিকট পরাভূত। এ সত্য প্রচারের জন্য অকলঙ্ক শ্রী চেতন্য গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূর আবির্ভাবের পূর্বে জগচ্চন্দ্র রাহুগ্রস্থ হয়ে পড়ল অর্থাৎ চন্দ্র গ্রহন হল। বিশ্বের চতুর্দিকে হরি নামের ধ্বনি উঠল। কর্মকোলাহল রেখে সবাই খোল করতাল নিয়ে হরিনাম কীর্ত্তন
করছে। হরি নামে মুখরিত চারিদিক এ সময়ে সিংহলগ্নে সিংহ রাশিতে শ্রীশচীর গর্ভসিন্ধু হতে শ্রী মায়া পুরে পূর্ন শশী আনিন্দ্য সুন্দর অমৃত পুরুষ উদিত হলেন। অচৈতন্য বিশ্বে চৈতন্য সঞ্চার হলো। মায়া মরুতে অমৃত মন্দাকিনী প্রবাহিত হলো। অবিরল ধারায় হরি কির্ত্তন সুধাসঞ্জীবনী বর্ষিত হওয়ায বিশ্বের হরিকির্ত্তন-দুর্ভিক্ষ-দুঃখ বিদূরিত শান্তিপুরে শ্রী অদ্বৈতাচার্য ও ঠাকুর হরিদাসসহ সকল ভক্তবৃন্দ আনন্দে নূত্য করলেন।
ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করে পরবর্তীকালে বিশ্বম্ভর, নিমাই ও শ্রী চৈতন্য নামের মধ্য দিয়ে বাঙালি সমাজের অবহেলিত মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হবেন এটা কে বুঝতে পেরেছিলেন? শ্রী চৈতন্য গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূ ১৪৯১ থেকে ১৪৯৭ পর্যন্ত শাস্ত্রীয় বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
আনুমানিক ১৫০৫ সাল থেকে তাঁর অধ্যাপনার সূচনা ঘটে। ১৫০৮ সালে গয়াধামে ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষাগ্রহণের পর নবদ্বীপে ফিরে বপ্রকাশ ও সংকীর্তন আরম্ভ করেন তিনি। ১৫০৯ সালের শেষদিকে সংকীর্তনাদির অবসান ঘটিয়ে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন ১৫১০ সালে। এরপর তিনি রাঢ়, নীলাচল, বঙ্গদেশ, বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী, শান্তিপুর প্রভৃতি জায়গায় ভ্রমণ করে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। ১৫৩৩ সালের ২৯ জুন তিনি দেহান্তরী হন।
গুপ্ত বৃন্দাবনঃ-মহাপ্রভু কলিযুগে যুগধর্ম প্রচার করার জন্য অবতরণ করবেন শ্রীজগন্নাথের আঙ্গিনায়, তাই লীলাক্ষেত্র বিস্তার ও লীলাপার্ষদ সাজানোর আয়োজন চলছে চারিদিকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লীলা সহচর হয়ে জন্ম হয়েছে দেব-দেবী ও ঋষিকল্প অনেক মহাজনদের। কারণ তাঁরা লীলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ভগবানের আগমনকে স্বাগত জানাবার জন্য ধরাধামে নেমে এসেছেন আগে ভাগেই। গৌরাঙ্গ লীলার শুভ বাস্তবায়নের জন্য শ্রীহট্টের ঢাকাদক্ষিণেও জন্ম নিলেন লীলা সহচরের। ‘শ্রী’ শব্দের অর্থ ‘ভক্তি ঐশ্বর্য’, আর ‘হট্ট’ শব্দের অর্থ ‘মিলনমেলা’।
তাই শ্রীহট্ট নামটি হল ভক্তের মিলন মেলা। এ হাটে আসে অনেকেই কেনাবেচা করতে। এখানে অমূল্য প্রেমধন ‘শ্রী’ সম্পদ বিনামূল্যে বিক্রি হয়।আর এধন বিক্রি করবেন কষিত-কাঞ্চন-বর্ণধারী গৌর হরি। তাই শ্রীহট্টে মিলায়েছেন আগাম মেলা। এটিই শ্রীহট্ট নামের বৈশিষ্ট্য। আর ঢাকাদক্ষিণের ‘দক্ষিণ’ হওয়ার তাৎপর্য হল- কৃষ্ণের বামে রাই কিশোরী ব্রজের যুগলরূপের বিগ্রহ। আর কৃষ্ণের দক্ষিণে অবস্থান নিয়ে গৌরহরি যেন কৃষ্ণকে ঢেকে অর্থাৎ দ্বাপর লীলা আবরণ করে মধুময় নবদ্বীপ লীলা বিহার করছেন। তাছাড়া এই গৌরলীলা মাধুর্য আস্বাদনে যমের দক্ষিণ দুয়ারটিও বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে- এই তো ঢাকাদক্ষিণ নামের সার্থকতা। সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু একবার মহাপ্রভুকে শান্তিপুরে শ্রীল অদ্বৈত আচার্যের বাড়ীতে নিয়ে আসেন এবং শোকাতুরা জননী শচীদেবীকে পুত্রের দর্শনের জন্য সেখানে নিয়ে আসা হয়। মা এবং ছেলের অপূর্ব মিলনের আনন্দের মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসী নিমাই মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খান অদ্বৈতের গৃহে। মা জানেন নিমাই সন্ন্যাসী হয়েছে ঠিকই কিন্তু সংসারের কাজ এখনও তাঁর বাকি আছে- গর্ভাশয়ে থাকাবস্থায় তাঁর ঠাকুর-মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এখনও অপূর্ণ রয়েছে। শোভাদেবী আজও হয়তো তাঁর চোখ খুঁইয়ে নাতীর দর্শন আশায় কোনরকমে জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাই মা শচীদেবী তাঁকে ঢাকা দক্ষিণে ফিরে গিয়ে তাঁর ঠাকুরমার শেষ ইচ্ছাটি পূর্ণ করার জন্য সন্ন্যাসী নিমাইকে নির্দেশ দিলেন।
বললেন-তোমার পিতামহী আমাকে বলেছিলেন, হে ভাগ্যবতি! তোমার এই গর্ভবাস হতে যে পরম পুরুষ উদয় হবেন, তাঁকে দেখবার জন্য বিশেষ উৎকণ্ঠিতায় আছি। অতএব তাঁকে শীঘ্রই আমার নিকট পাঠাবে। আমি তাঁর মহাবাক্য স্বীকার করে, তোমাকে গর্ভে নিয়ে নবদ্বীপে এসেছিলাম। অতএব এখন তোমাকে আমার প্রতিশ্রুতি বাক্য পালন করতে হবে। অর্থাৎ এখান হতেই তোমাকে পিতামহীর সাথে মিলবার জন্য যেতে হবে।
১৫১০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে মায়ের কথামত মহাপ্রভু তাঁর পিতামহীকে দর্শন দেবার জন্য ঢাকাদক্ষিণে আসতে মনস্থ করলেন। মহাপ্রভু মাতৃবাক্য শ্রবণ করে স্বীয় অচিন্তনীয় শক্তিপ্রভাব বিস্তার করে গুপ্তলীলা সহকারে পিতামহী সদনে যাবার জন্য উপক্রম করলেন। শ্রীহট্টের ঢাকাদক্ষিণে যাবার পথে তিনি প্রথমে তাঁর পূর্বপুরুষের নিবাসস্থল শ্রী হট্রের বালাগঞ্জের বরুঙ্গাতে পদার্পণ করলেন। সেখানে তিনি হলচাষরত গো-মোচন করলেন এবং গো- মুখে হরিনাম উচ্চারিত করে গো-মুক্ত করলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু আদিতে প্রপিতামহ শ্রীপাদ মধুকর মিশ্রের বাসভূমি বরগঙ্গা (বুরুঙ্গা) নামক স্থানে পদার্পণ করলেন। তথায় কৃষকগণকে মধ্যাহ্ন সময়ে হালচাষ করতে দেখে, করুণানিধির হৃদয় গো-গণের প্রতি সদয় হল। তিনি তখন কৃষকগণকে বললেন, মধ্যাহ্নকালে চাষ করা মহা পাপ। তোমরা গো-মোচন কর। এই আদেশ শ্রবণ করে রামদাস নামক জনৈক কৃষক সন্ন্যাসবেশী শ্রীগৌরাঙ্গকে বলল, ধান্যক্ষেত্রে অতি অল্প জল রয়েছে। সেইজন্য আজই এই জমি চাষ করা প্রয়োজন। এরর্প শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হল সমীপে গমন করলেন।
শ্রীমন্মহাপ্রভু গোপৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করে হরিধ্বনি করতে লাগলেন। তাঁর শ্রীমুখোচ্চারিত শ্রীহরিধ্বনি শ্রবণ করে গো-সকলও মধুময় হরিধ্বনি করতে লাগল। কৃষকেরা প্রায় জলশূন্য কৃষিক্ষেত্রের জন্য বড়ই ব্যস্ত ছিল, কিন্তু সেই ধান্যক্ষেত্রটি সহসা জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। চাষীগণ এইসব অলৌকিক ঘটনা দেখে শীঘ্র গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীগণকে এই অদ্ভুত কথা বললেন। তাহা শ্রবণান্তে, সেই গ্রামস্থ মিশ্রবংশীয় জনগণ সেখানে এসে শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে তাঁর প্রপিতামহ শ্রীপাদ মধুকর মিশ্রের বাড়িতে আনয়ন করলেন। মহাপ্রভুর এরূপ অলৌকিক ভাব দেখে তাঁরা অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে সাক্ষাৎ নারায়ণজ্ঞানে যথোচিত সেবা করলেন।
এখান থেকে মহাপ্রভু তাঁর পিতৃনিবাস তথা পিতামহ উপেন্দ্র মিশ্রের ঢাকাদক্ষিণের ঠাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ১৫১০ সালের চৈত্রমাসের কোন এক রবিবারে ছুটে আসেন ঢাকাদক্ষিণের গুপ্ত বৃন্দাবন ধামে। তাঁর পিতামহী শোভাদেবী অধীর আগ্রহে নাতীর দর্শন আশায় পথ চেয়ে বসেছিলেন। তাঁর দীর্ঘদিনের আশা আজ ফলবতী হতে চলল ধর্মপরায়ণা শ্রীল উপেন্দ্র মিশ্রের পতœী বৃদ্ধা শ্রীমতি শোভাদেবী, সর্বদাই মনে মনে চিন্তা করতেন যে, আমি কখন আমার নাতীকে দেখতে পাব। মহাপ্রভু গর্ভাবস্থায় তাঁর চিন্ময়ী দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন পিতার ঢাকাদক্ষিণের নিবাসস্থানটি। আজ তিনি সেই স্মৃতি বিজরিত শান্তির নীড়ে আবার ফিরে এসেছেন। ঘুরেফিরে দেখছেন বাড়ীর চারিদিক। হঠাৎ শ্রীল পরমানন্দ মিশ্রের পতœী সুশীলাদেবীর নজর পড়ল সন্ন্যাসীর দিকে। কি দিব্যকান্তি চেহারা! আজানুলম্বিত বাহু, সুঠাম পূর্ণদেহী নবীন দণ্ডধারী গৌর তনু! দেখলে মন জুরিয়ে যায় একেবারে। সুশীলাদেবী মুগ্ধনয়নে ভাল করে দেখে নিলেন সন্ন্যাসীকে। পরে দর্শন আশা কিঞ্চিৎ প্রশমিত করে তিনি শ্বাশুড়ী শোভাদেবীকে এই শুভ সংবাদটি দেবার জন্য গৃহাভ্যন্তরে চলে এলেন। সংবাদ পেয়ে শোভাদেবী গৃহাভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন নবীন সন্ন্যাসীকে। শোভাদেবীর মনে আনন্দ আর ধরে না। যে স্বপ্নের প্রাণপুরুষকে দেখার জন্য এতদিন যাঁর তৃষিত নয়ন অপেক্ষা করছিল, সেই প্রাণের ঠাকুর সাক্ষাৎ নারায়ণ আজ তাঁর নয়ন-মন আলো করে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরই সামনে। একি অদ্ভুত অপার আনন্দ! সেই বৃদ্ধা শ্রীমতি শোভাদেবী, গৃহ হতে বের হয়ে এসে শ্রীনারায়ণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকে দেখে স্বয়ং ঈশ্বর এখানে এসেছেন এই কথা মনে ভেবে বড়ই প্রফুল্লা হলেন। তারপর তিনি তাঁকে বসতে আসন দিলেন এবং ধর্মপরায়ণা বৃদ্ধা সাশ্রুনয়নে, পুলকিত শরীরে, ধীরে ধীরে মধুর বাক্যে তাঁর স্তব করলেন। নররূপধারী পদ্মপলাশলোচন সচ্চিদানন্দবিগ্রহ স্বর্ণবর্ণ বিষ্ণুকে নমস্কার। হে পুরুষোত্তম! তোমাকে নমস্কার। হে বাঞ্ছিতপ্রদ ভগবান্! তোমাকে প্রণাম করি। ঠাকুরমা দেখছেন সন্ন্যাসীকে, কিন্তু তিনি দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় আদরের নাতীকে। নিশ্চয়ই নারায়ণরূপী এই সন্ন্যাসী তাঁর নাতীর খবর রাখেন। তাই অস্থিরচিত্তে শোভাদেবী এই একটি জিঙ্গাসা নিয়ে সন্ন্যাসীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি সন্ন্যাসীর মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন স্বপ্নে দেখা সেই প্রাণময় শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটি।
কিন্তু তিনি আজ দেখছেন কৃষ্ণতনু মূর্তির বদলে তাঁর সামনে গৌরতনু এক নবীন সন্ন্যাসীর দিব্য মূর্তি। তিনি নাতীর কাছে প্রশ্ন ছিলেন, “তোমাকে আমি তো মাতৃগর্ভে এমনরূপে দেখিনি, তোমার মুরলীধারী নবীন-নটবর বেশ শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটি তুমি কোথায় লুকালে!” প্রভু আর কি করেন, সরল বিশ্বাসী ঠাকুর মা শোভাদেবীকে গৌরা-কৃষ্ণরূপ যুগল মূর্তিতে দর্শন দান করে ধন্য করলেন। মহাপ্রভু পিতামহী শোভাদেবীর অন্তরের ভাব বুঝে তাঁকে দিব্যচক্ষু দান করে চাক্ষুষভাবে দেখিয়ে দিলেন তাঁর আপন স্বরূপটি। জগদীশ্বর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু পিতামহীর সেই কথা শ্রবণান্তে কৃপা করে তাঁকে আপন পরিচয় প্রদান করলেন। সুশীলাদেবী সন্ন্যাসীবেশী এক সুন্দর মহাপুরুষকেই দেখলেন, কিন্তু শোভাদেবী তাঁর মধ্যে দেখলেন সাক্ষাৎ ভগবানকেই। ভক্তের কাছে লুকাতে পারেননি তিনি, ভক্তবৎসল ভগবান্ সন্ন্যাসীবেশের মধ্যেই শোভাদেবীকে দেখালেন তাঁর ভগবৎ স্বরূপটি আর সুশীলাদেবী সন্ন্যাসবেশীকে দেখলেন। তিনি শোভাদেবীকে বললেন, “আমি সেই তো সেই- যিনি তোমার ঘরের নিমাই, তিনিই আবার দ্বাপরের কৃষ্ণ কানাই।” শোভাদেবী ও মহাপ্রভুর ভক্তিপূর্ণ এই ভাববিলাস তাঁর অন্য নাতী প্রদ্যুম্ন মিশ্র সাক্ষাৎ দর্শন করে গর্ভানিষ্ঠান সময়ে, যেরূপে শোভা দেবীর প্রতি দৈববাণী করেছিলেন, তাহাই প্রদর্শিত হল।
পরম ভক্তিমতী বৃদ্ধা, শ্রীগৌরাঙ্গ ও শ্রীকৃষ্ণ, এই দুইরূপ দেখে বিস্মিত ও পুলকিত হয়ে বললেন, হে ভগবান! তোমাকে নমস্কার। মহাপ্রভু শোভাদেবীকে বলেন, “কষ্ট নিও না ঠাকুর মা, আমার এই যুগলমূর্তি ঠাকুর বাড়ির দেবালয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নিত্য পূজার্চনা করবে। আমার বংশের সন্তানেরা শ্রী হট্রের ঢাকাদক্ষিণের দেবালয়ের গৌরবেই আবহমানকাল বেঁচে থাকবে। শ্রী হট্র তথা ঢাকাদক্ষিণ আজ থেকে গুপ্ত বৃন্দাবন বলে পরিচিত হবে। আমি নিত্যকাল এখানে লীলা করব। “বাসুদেব ঘোষ কহে করি জোড় হাত, যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই গন্নাথ”আসলে কৃষ্ণরূপটি বৃন্দাবনের আর গৌররূপটি নবদ্বীপের। দ্বাপর শেষে কলিতে তাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। কলি এসেছে, তাই দ্বাপরের কৃষ্ণের প্রয়োজন এবার চৈতন্যে সীমায়িত হয়েছে। কাজেই প্রেমের রাজা শ্রীচৈতন্যই বামা নায়িকা শ্রীরাধার মত বেদনাভারে প্রাণকৃষ্ণকে খুঁজতে খুঁজতে নামের বাহারে পাগলপারা হয়ে সকলকে প্রেম দান করছেন আর শ্রীমুখে বলছেন, “গোকুলের যে প্রেম হলো নাকো সারা নদীয়ায় তা হবে সারা।”রাধার যে প্রেম কৃষ্ণকে ঘিরে, দ্বাপরে তা পূর্ণ হয় নি, তাই অন্তঃ-কৃষ্ণ বহিঃ-রাধা হয়ে রাধাভাবে আবিষ্ট হয়ে গৌর সুন্দর একই অঙ্গে দুইরূপ হয়ে আস্বাদন করছেন আপনি আপনাকে। এই তো গৌর হরি, কলির প্রেমরতন, দ্বাপরের কৃষ্ণ-কানাই। আমরা তাঁর ভাবগ্রাহী যুগলতনুর রস আস্বাদনের আশায় পথ চেয়ে বসে রই। “স্মরনেরে নব গৌরচন্দ্র মাধব মনোহারী।” পরমাত্মা পূর্ণব্রহ্ম সনাতন দ্বাপরে এসেছিলেন কৃষ্ণ হয়ে, এবার এসেছেন গৌরতনু গৌরহরি হয়ে এই গৌরতনু শ্রীরাধার ভাবকান্তি হৃদয়ে ধারণ করে গৌরহরি হয়েছেন।
কৃষ্ণই রাধা, রাধাই কৃষ্ণ; ভাববিলাসে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে অনন্য রসব্যঞ্জন করেন, আবার ঘনায়িত প্রেমবিগ্রহ হয়ে আপামর ভক্তসঙ্গে প্রেমরসনির্যাস আস্বাদন করেন এবং প্রেমধন্য হয়ে ঐ অপ্রাকৃত রস ভক্তের মাঝে বিতরণ করেন এই রঙ্গমঞ্চের লীলানটবর গৌরসুন্দর নরবপু ধারণ করে সর্বোত্তম নরলীলা করবার জন্য এবার এসেছেন ধরার ধূলায় নেমে। মহাপ্রভু ও তাঁর পার্ষদগণ এক অভিনব প্রেমের উদার দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলেন পৃথিবীর পাপাসক্ত মানুষের পানে। সে দৃষ্টিতে ছিল প্রাণঢালা প্রেম আর প্রাণপুটিত রসমাধুর্যপূর্ণ অমিয় রসধারা। তিনি পুরাণ-প্রাণ পুরুষ, অনন্য প্রেমের ঠাকুর। তিনি তাঁর অপূর্ব কৃষ্ণকথামৃত দান করে কলিহত জীবের ত্রাণকর্তা হিসেবে আপনার জনের মত মানুষের কাতারে নেমে এসেছেন। নাম আর প্রেমের মালা গেঁথে তিনি জগতের গলায় পরিয়ে দিয়েছেন অমূল্য এক বরণমালা।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন- “এই গুপ্ত ভাবসিন্ধু, ব্রহ্মা না পায় একবিন্দু,হেন ধন বিলাইল সংসারে”।
Post Courtesy: Sagar Bhowmick
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন