০৯ মে ২০১৯

বিষ্ণু পুরানে সৃষ্টিতত্ত্ব

 প্রথমে এ বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পুর্বে এই মহাবিশ্বে কিছুই ছিল না সম্পূর্ন শূন্য ছিল। সেই শূন্যতার সৃষ্টি মহাজ্যোতি পূঞ্জ থেকে। সেই জ্যোতি ধীরে ধীরে মানুষ রূপ ধারন করে। সেই আদি পূরুষ হচ্ছে ভগবান নারায়ন।  তারপর নারায়ন যোগ নিদ্রায় মগ্ন হয়। সেই যোগ নিদ্রা থেকে ব্রহ্মজল নির্গত হয় ও ক্ষীর সাগরের তৈরী হয়। এরপর শ্রী নারায়নের নাভী থেকে একটি পদ্মফুলের কলি সৃষ্টি হয় এবং নারায়নের একটি প্রতিরুপ গিয়ে ঐ পদ্মফুলকে প্রস্ফুটিত করে।



ঐ পদ্মথেকে ব্রহ্মার সৃষ্টি হয়। এরপর নারায়নের ভ্র থেকে একটি রুদ্রাক্ষের সৃষ্টি হয়। পরে নারায়নের একটি প্রতিরূপ গিয়ে তার বিষ্ফোরন ঘটিয়ে শিবের সৃষ্টি করে। এরপর ব্রহ্মা ও শিব নারায়নের স্তুতি করে ও তাঁদের পরিচয় জানতে চান, তাঁরা বলেন হে জগদীশ জন্ম যখন দিয়েছেন পরিচয়ও দিন। তখন শ্রী নারায়ন মধুর হাসি হেসে বলেন আমিও যা আপনারাও তা। আমার প্রতিরূপ আপনারা। হে পঞ্চমুখি আপনি ব্রহ্মা (ব্রহ্মা প্রথমে পাঁচ মুখ বিশিষ্ট ছিল এরপর শিব ত্রিশূল দিয়ে একবার ব্রহ্মার একটি মস্তক কাটেন ও ব্রহ্মার পূজা নিশিদ্ধ করেন) আর হে জটাধারী হে ত্রিনেত্রেশ্বর আপনি শিব। আমরা.তিনজন ত্রিদেব।

শ্রী নারায়নের এই উত্তরের পর ব্রহ্মা ও শিব তাঁদের জন্মের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। তখন শ্রী নারায়ন বললেন, হে ব্রহ্মা, হে মহেশ্বর এই সংসারে জন্ম নিলে তাকে কর্মও করতে হয়। আপনাদেরও কর্ম করতে হবে। হে ব্রহ্মা আপনি সৃষ্টিকর্তা আপনি সৃষ্টি করবেন। আর হে মহেশ্বর আপনি সংহার কর্তা আপনি সংহার করবেন। আর আমি নারায়ন যখন নিরাকার রূপ থেকে সাকার রূপ ধারন করেছি তখন আমাকেও কর্মকরতে হবে। আমি বিষ্ণু রুপে জগতের পালন করব। হে ব্রহ্মা আপনি গিয়ে সৃষ্টি রচনার প্রারম্ভ করুন।

এরপর ব্রহ্মা ও শিব প্রস্হান করলেন। এরপর শ্রীবিষ্ণু শেষ নাগের শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রনব মন্ত্র 'ওঁ' এর উচ্চরন করলেন। তখন তাঁর বাম হাত থেকে মা মহালক্ষী আবির্ভূত হলেন। তখন মা মহালক্ষী শ্রী নারানকে বললেন হে পরমশ্রেষ্ঠ আপনি নিজেই তো সম্পূর্ন ছিলেন, তবে আমায় কেন সৃষ্টি করলেন? তখন শ্রী বিষ্ণু মধুর হাসি হেসে.বললেন আমি জানি আমি সম্পূর্ন আমি সেই প্রদীপের মত পূর্ণ যার থেকে অন্য প্রদীপ জ্বালালেও তার পূর্ণ আলো পূর্ণই থাকে। তবু হে প্রিয়া, চাঁদযেমন চাঁদনী ছাড়া, ফুল যেমন সুগন্ধ ছাড়া, সূর্য যেমন তেজ ছাড়া অপূর্ণ তেমনি আমিও তোমাকে ছাড়া অপূর্ণ। আর আজ থেকে আমি ঘোষনা করছি যে কোন পুরুষ নারীকে ছাড়া সম্পূর্ণ হবে না, আর এই সম্পূর্নতাই নতুন প্রজন্মকে জন্ম দিবে। আর তোমাকেও একটি বর দিচ্ছি আমার নাম আজ থেকে লক্ষীপতি এবং আমার নারায়ন নামের পূর্বে তোমার নাম যুক্ত হবে। আমার নাম আজ থেক লক্ষীনারায়ন।

 তখন মা লক্ষী বললেন,.তোমায় কোটি কোটি প্রনাম শ্রীহরি। এবার আমার কাজ বলে দাও। শ্রীবিষ্ণু বল্লেন তুমি আমার প্রেরণা। আমি তোমার কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই সৃষ্টি পালন করব। আর তুমি ব্রহ্মা সৃষ্ট প্রানীদের উপর ধনের বর্ষা করবে। এরপর শ্রীনারায়ন ব্রহ্মার কাজে সহায়তার জন্য যোগ নিদ্রায় মগ্ন হলেন এবং যোগের মাধ্যমে ব্রহ্মাকে শক্তি প্রদান করতে থাকলেন। ভগাবান শ্রী বিষ্ণুর এবং ব্রক্ষার শক্তি একত্রিত হয়েও সৃষ্টি রচনার কাজ অগ্রসর হচ্ছিল না। এটাও প্রকৃত পক্ষে শ্রীবিষ্ণুর লীলারই অংশ ছিল। 

এদিকে সৃষ্টি রচনার কাজ এগোচ্ছে না দেখে ব্রক্ষা বিষ্ণুর শরনাপন্ন হলেন। তখন বিষ্ণু যোগ নিদ্রা মগ্ন ছিলেন। ব্রক্ষা গিয়ে বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। বিষ্ণু স্তবে খুশি হয়ে চোখ  খুললেন। ব্রক্ষা বিষ্ণুকে বললেন হে ক্ষীরসাগর বাসী কমল নয়ন রক্ষা কর। বিষ্ণু  তাঁর সুমধুর হাসি হেসে বললেন, শান্ত হোন আদি প্রজাপতি, শান্ত হন। অধীরতা ত্রিদেবের মাঝে শোভা পায় না। ব্রক্ষা বললেন কিভাবে শান্ত হব জগদীশ বলুন। আমি সৃষ্টি করার জন্য জন্ম নিয়েছি। কিন্তু আমার এবং আপনার শক্তি মিলেও তো এই মহান কার্যকে রূপ দিতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে তো আমার জন্ম বৃথা হয়ে যাবে। আমাকে এই সংকট থেকে বাঁচান প্রভু। নারায়ন হাসলেন, বললেন,  আপনি সৃষ্টি কর্তা, আমি পালন কর্তা কিন্তু আমরা ছাড়াও আর একজন আছে যাঁর কাছে একটা মহান কাজের দায়িত্ব আছে। মহাদেব।  আপনি তাঁর কাছে যান। তিনি আপনাকে সহায়তা করবে। আর তখনি সৃষ্টি রচনার কাজ সার্থক হবে। কারন সৃষ্টির অর্থই জন্ম পালন এবং ধ্বংস। তিনি সংহার কর্তা। তাঁর শক্তিই সৃষ্টি রচনাতে সাহায্য করবে। শ্রীবিষ্ণুর আদেশে ব্রক্ষা শিবের কাছে গেলেন এবং তাঁকে শ্রীবিষ্ণুর কথা ও অনুরোধ জানালেন। শিব তখন যোগের মাধ্যমে শিব এবং শিবা এই দুই খন্ডে ভাগ হয়ে গেলেন। এই শিবাই আদি  শক্তি। এরপর ত্রিদেবের একত্রিত.শক্তি দিয়ে নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্লহ, জীব ও.জড় তৈরী করলেন। 

এদিকে বিষ্ণু যখন যোগনিদ্রা মগ্ন থেকে ব্রক্ষাকে শক্তি দিচ্ছিলেন তখন তাঁর কান থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুটো অসুর জন্ম নিল। তারা প্রচন্ড শক্তিশালী ছিল। তারা সামনে ব্রক্ষাকে পেয়ে আক্রমন করল। ব্রক্ষা তাদের কাছ থেকে পালিয়ে বিষ্ণুর শ্মরণে এলেন এবং বিষ্ণু তাদের গদাপ্রহারে হত্যা করলেন। গদার আঘাতে এই বিশালদেহী অসুরদের মেদ ছড়িয়ে পরল। তখন বিষ্ণুর আদেশে ব্রক্ষা এই মেদ বা চর্বি দিয়ে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। এজন্য পৃথিবীর অপর নাম মেদিনী।

সমগ্র জড় জগৎ সৃষ্টির পর ব্রক্ষা তাঁর চার হাত থেকে চারজন ছোট ছেলেকে তৈরী করলেন। তাদের নাম সনদ, সনাতন,সনন্দন ও সনদকুমার। ব্রক্ষা তাদের সৃষ্টি পরিচালনা ও বংশবিস্তার করতে আদেশ দিলেন। কিন্তু তাদের ইচ্ছার অভাব ছিল তাই তারা এতে অপারগতা প্রকাশ করে। যার ফলে ব্রক্ষা ক্রুদ্ধ হয় এবং তাদের দূর করে দেন ব্রক্ষলোক থেকে। এবার ব্রক্ষা ভাবলেন সৃষ্টি রচনার আগে প্রয়োজন ভাল শিক্ষকের তাই.তিনি সপ্তর্ষিকে তৈরী করলেন। এরপর তৈরী করলেন ব্রক্ষার মানসপুত্র দক্ষ এবং নারদকে। তিনি দক্ষকে প্রজাপতি নিযুক্ত করলেন এবং দেবর্ষি নারদকে ভগবত ভক্তি প্রচারের নির্দেশ দিলেন। এবার তৈরী করলেন মনু ও শতরুপাকে। এই মনু ও শতরুপাই আমাদের আদি পিতামাতা।

এরপর ব্রক্ষার মনে হলো যে তিনি এই মহান সৃষ্টি রচনা করেছেন। তাঁর মনে অহংকার তৈরী হল। তখন শিব দেখলেন এই অহংকার ঠিক না এতে করে সৃষ্টিতেও অরাজকতা তৈরী হবে তাই তিনি ব্রক্ষার নিকটে গেলেন। কিন্তু ব্রক্ষার অহংকার এতটা চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল যে শিব শত চেষ্টা করেও বোঝাতে পারলেন না ব্রক্ষাকে। ব্রহ্মা একসময় শিবের অপমান করতে শুরু করলেন। তখন শিব ক্রুদ্ধ হয়ে মহারুদ্র রুপ ধারন করে তাঁর ত্রিশুল ব্রহ্মার দিকে নিক্ষেপ করলেন যা ব্রক্ষার একটি মস্তক কেটে ফেলল। ব্রহ্মাকে শিব সব ধরনের পূজা অর্চনা থেকে বহিস্কার করলেন। ব্রহ্মা মস্তক কাটার পরে ভগবান সদা শিবের স্বরূপ চিনলেন।

তিনি শিবের স্তব করতে লাগলেন। শিব খুশি হলেন। তিনি বললেন ব্রহ্মাকে, হে আদি প্রজাপতি অহংকার পতনের মুল। আপনার পন্ঞ্চম মাথাটি ছিল অহংকারের স্বরুপ যা আমি কেটে ফেলেছি। আপনার অহংকার সমূলে নাশ হয়েছে। এটা বলে শিব অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। ব্রহ্মার পুত্রদের মধ্যে সপ্তর্ষি এবং নারদ বুঝেছিলেন যে শিব ব্রহ্মার মঙ্গলেই তাঁর মাথা কেটেছেন। এই মাথাটা না কাটলে অহংকারের কারনে ব্রহ্মা ত্রিদেব হওয়ার মর্যাদা হারাতেন। কিন্তু ব্রহ্মাপুত্র দক্ষ এটা বুঝলেন না। তিনি শিবকে শত্রু ভাবতে লাগলেন।

(অপমাপ্ত)

পরমকরুনাময় সচ্চিদানন্দ গোলোকপতি ভগবান শ্রীহরি ও তাঁর একান্ত হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধার চরণকমলে সবার মঙ্গলময়, কল্যাণময়, সুন্দরময় আর শান্তিময় জীবনের প্রার্থনা আমাদের।  

(দেবেন্দ্র)

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে!!"

!!জয় শ্রীহরি!! জয় রাধে!!

!!জয় হোকসৃষ্টি তত্ত্বের!!

Post Courtesy : Sagar Bhowmick
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।