শ্রীল এ,সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের সঙ্গে মাইক রবিনসনের কথোপকথন ১৯৭৬,আগষ্ট,লন্ডন।
মাইক রবিনসনঃ- হ্যাঁ, ঠিক আছে, কিন্তু আমরা যদি মনে করি যে মানুষের আত্মা নেই.....
শ্রীল প্রভুপাদঃ তা হলে আপনাকে বিশ্লেষণ করতে হবে জীবন্ত দেহ এবং মৃতদেহের মধ্যে কি পার্থক্য। তা আমি প্রথমেই বিশ্লেষণ করেছি। জীবনীশক্তি আত্মা যখনই দেহ থেকে চলে যায়, তখন সব চাইতে সুন্দর শরীরেরও কোন মূল্য থাকে না। যখন আর কেউ সেটি চায় না, তখন তা ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন আমি যদি আপনার চুল স্পর্শ করি , তা হলে আপনি রেগে যাবেন। সেটিই হচ্ছে জীবন্ত শরীরে আত্মা রয়েছে,মৃত শরীরে আত্মা নেই। যে মুহুুর্তে আত্মা দেহটি ছেড়ে চলে যায়, তখন আর দেহটির কোন গুরুত্ব থাকে না । তখন তা অর্থহীন হয়ে যায়। সেটি বোঝা খুবই সহজ। কিন্তু তথাকথিত সমস্ত বড় বড় বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিকদের সেটি বোঝার মতো বুদ্ধি নেই। আধুনিক সমাজ অত্যন্ত জঘন্য অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, এখন এমন একটা মানুষ নেই যার প্রকৃত মস্তিস্ক রয়েছে।
মাইক রবিনসনঃ- আপনি কি সেই সমস্ত বৈজ্ঞানিকদের কথা বলছেন, যারা জীবনের পারমার্থিক দিকটা বুঝতে পারে না?
শ্রীল প্রভুপাদঃ- হ্যাঁ, প্রকৃত বিজ্ঞান মানে জড় এবং চেতন, সব কিছু সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান।
মাইক রবিনসনঃ- কিন্তু আপনি পূর্বে তো একজন রসায়নবিৎ ছিলেন, তাই নয় কি?
শ্রীল প্রভুপাদঃ হ্যাঁ , প্রথম জীবনে আমি একজন রসায়নবিৎ ছিলাম। তবে একজন রসায়নবিৎ হতে খুব একটা বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয় না। সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যে কোন মানুষ তা হতে পারে।
মাইক রবিনসনঃ- তা হলে বলতে হয় আধুনিক বৈজ্ঞানিকেরা স্থুল বুদ্ধিসম্পন্ন হলেও বিজ্ঞানের গুরুত্ব রয়েছে।
শ্রীল প্রভুপাদঃ- জড় বিজ্ঞানের গুরুত্ব ততটুকুই-তার পূর্ণ গুরুত্ব নেই।
মাইক রবিনসনঃ- ও আচ্ছা। কয়েক মিনিট আগে যখন আমাদের মধ্যে মতভেদ হচ্ছিল তখন আপনি বলেছিলেন,“ শাস্ত্রের উদ্ধৃতি
দেওয়ার প্রয়োজন নেই; এটি সাধারণ জ্ঞানের বিষয়।” তা হলে আপনাদের এই ধর্মে শাস্ত্রের কি উপযোগিতা? তা কতটা গুরুপূর্ণ?
শ্রীল প্রভুপাদঃ- আমাদের ধর্ম একটি বিজ্ঞান। আমি যখন বলি যে , একটি শিশু বালকে পরিণত হয়, সেটি বিজ্ঞান, তা ধর্ম নয়। প্রতিটি শিশুই বালকে পরিণত হয়। এখানে ধর্মের কি কথা? আর একটি মানুষ যখন মারা যায় তখন তার দেহটি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়। এখানে ধর্মের কি প্রশ্ন উঠতে পারে? এটি বিজ্ঞান। আপনি খ্রীস্টান, হিন্দু অথবা মুসলমান যাই হোন, আপনার আত্মীয়ের যখন মৃত্যু হয়, তখন আপনি বলতে পারেন না, “আমরা খ্রীস্টান-আমি বিশ্বাস করি,তার মৃত্যু হয়নি”-সেটি হয় না । আপনি হিন্দু,মুসলমান, খ্রীস্টান যাই হোন ,তার মৃত্যু হয়েছে। দেহটির গুরুত্ব ততক্ষণ যতক্ষণ তাতে আত্মা আছে। আত্মা যখন তাতে থাকে না, তখন সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যায়। এই বিজ্ঞান সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তার ভিত্তিতেই আমরা মানুষকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করছি।
মাইক রবিনসনঃ- আমি যদি আপনার বক্তব্য ঠিক মতো বুঝে থাকি, তা হলে আমার মনে হয় আপনি শুদ্ধ বিজ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষকে শিক্ষা দিচ্ছেন। সেখানে ধর্মের অবকাশ কোথায়?
শ্রীল প্রভুপাদঃ-ধর্মও হল বিজ্ঞান, মানুষ ভ্রান্তিবশত ধর্মকে একটি বিশ্বাস বলে মনে করছে-“আমি বিশ্বাস করি এটি আমার ধর্ম।”(জনৈক ভক্তকে) অভিধানে ধর্ম কথাটা খুজে বের কর।
শিষ্যঃ- ধর্মের সংজ্ঞা দিয়ে অভিধানে বলা হয়েছে,“অলৌকিক শক্তি অথবা পরিচালককে স্বীকার করা , বিশেষ করে এক সবিশেষ ভগবানের বশ্যতা স্বীকার করা এবং উপযুক্ত মনোভাবের দ্বারা সেই স্বীকৃতিকে কার্যকর করা।”
শ্রীল প্রভুপাদঃ- হ্যাঁ, ধর্ম মানে হচ্ছে পরম নিয়ন্তার নির্দেশ পালন করা। তা হলে আপনি খ্রিস্টান হতে পারেন বা আমি হিন্দু হতে পারি, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের দুজনকেই স্বীকার করতে হবে যে, একজন পরম নিয়ন্তা রয়েছেন-সেটিই হচ্ছে ধর্ম। এমন নয় যে,“আমি বিশ্বাস করি পশুর আত্মা নেই” সেটি ধর্ম নয়। সেটি সব চাইতে অবিজ্ঞানসম্মত উক্তি। ধর্ম মানে পরম নিয়ন্তা সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান,-পরমেশ্বরকে জানা এবং তাঁর নির্দেশ পালন করা। সেটিই হচ্ছে ধর্ম। রাষ্ট্রে সৎ নাগরিক হচ্ছেন তিনি, যিনি সরকারকে জানেন এবং সরকারের আইন মেনে চলেন; আর অসৎ নাগরিক হচ্ছেন তিনি যিনি সরকারকে মানেন না। এইভাবে সরকারকে অস্বীকার করলে আপনি অসৎ নাগরিক হয়ে যান,তখন আপনি অর্ধামিক; আর আপনি যদি সৎ নাগরিক হন, তা হলে আপনি ধার্মিক।
মাইক রবিনসনঃ- জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনার কি বিশ্বাস? আমরা কেন বেঁচে আছি?
শ্রীল প্রভুপাদঃ- জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আনন্দ উপভোগ করা। কিন্তু এখন সকলে জীবনের এক অবাস্তব স্তরে রয়েছে এবং তাই আনন্দ উপভোগের পরিবর্তে তারা দুঃখ-ভোগ করছে- সর্বত্র আমরা দেখতে পাই জীবন সংগ্রাম। সকলেই সংগ্রামে রত। কিন্তু পরিণামে কি তারা আনন্দ উপভোগ করে? তারা শুধু দুঃখভোগ করতে করতেই মারা যায়। তাই জীবনের উদ্দেশ্য যদিও আনন্দ উপভোগ করা, কিন্তু বর্তমানে তাদের জীবন আনন্দময় নয়। কিন্তু আপনি যদি জীবনে চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তা হলে আপনি আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।
মাইক রবিণসনঃ- আপনি কি দয়া করে আমাকে বলবেন পারমার্থিক জীবনের স্তরগুলি কি কি? একজন নতুন ভক্তকে কিভাবে পারমার্থিক জীবনে অগ্রসর হতে হয়?
শ্রীল প্রভুপাদঃ- প্রথম স্তর হচ্ছে জিজ্ঞাসু স্তর। সেই স্তরে মানুষ প্রশ্ন করে,“কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন কি? সেই সম্বন্ধে আমি একটু পড়াশুনা করে দেখি!” এই স্তরকে বলা হয় শ্রদ্ধা। সেটি হচ্ছে শুরু। তারপর সে যদি ঐকান্তিক হয়, তা হলে যাঁরা এই জ্ঞানের অনুশীলন করেন, তাঁদের সঙ্গ করে। তারপর সে নিজেই মনে করে“আমিও ওদের মতো একজন হই না কেন?” তারপর সে যখন তাঁদের মতো হয়,তখন তার সমস্ত অনর্থ দূর হয়ে যায়। তখন বিশ্বাস সুদৃঢ় হয় এবং কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। এই সমস্ত ভক্তরা সিনেমা দেখতে যায় না কেন? এরা মাছ- মাংস খায় না কেন? কারণ তাদের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। এখন এই সমস্ত জিনিস তারা ঘৃণা করে। এই ভাবে ধীরে ধীরে প্রগতি হয়। প্রথমে শ্রদ্ধা, তার পর সাধুসঙ্গ তারপর অনর্থ-নিবৃত্তি, তারপর নিষ্ঠা,তারপর রুচি,তারপর ভগবৎ-উপলব্ধি এবং অবশেষে ভগবৎ -প্রেম। সেটিই যোগের পূর্ণতা। সেটিই সর্বোত্তম ধর্ম। এটি আমার বিশ্বাস বা আপনার বিশ্বাস জাতীয় কতগুলি অন্ধসংস্কার নয়। সেগুলি ধর্ম নয়, সেগুলি প্রতারণা। প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে সেই ধর্ম যা ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেটিই ধর্মের পূর্ণতা।
মাইক রবিনসনঃ- আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।
শ্রীল প্রভুপাদঃ- হরে কৃষ্ণ!
http://www.iskconbd.org/
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন