০৯ অক্টোবর ২০১২

শ্রীভগবানকে নারদের অভিশাপ


লীলাময় ভাগবান শ্রীহরি একাধিকবার অভিশাপের শিকার হন। এক কল্পে জলন্ধর দৈত্যের উপদ্রবে দেবতারা নাজেহাল। তখন শিব গেলেন যুদ্ধ করতে। তিনিও জলন্ধরকে পরাজিত করতে পারেননি। কারণ জলন্ধরের স্ত্রী
ছিল সতী সাধ্বী নারী। তখন শ্রীহরি ছল করে জলন্ধরের স্ত্রীর সতীধর্ম নষ্ট করেন। সেই নারী যখন ভগবানের ছলনা বুঝতে পারলেন, তিনি তখন ভগবানকে অভিশাপ দেন।
আরেকবার শঙ্খচূড় নামক অসুরও তাঁর স্ত্রী তুলসীর জন্য অবধ্য ছিলেন। দেবলোকের মঙ্গলের জন্য তিনি তুলসীর সতীত্ব হরণ করেন। তুলসী ছিলেন ভগবদ্ভক্ত। কিন্তু ভগবানের ছলনা বুঝতে পেরে তিনিও শ্রী হরিকে পাষাণ রূপ প্রাপ্তের জন্য অভিশপ্ত করেন। ভগবান তা-ই শিরোধার্য করে নারায়ণ শিলাতে পরিণত হলেন। উপরন্তু, তুলসীর ভগবদ্ভক্তির মাহাত্ম্যের জন্য তিনি জন্মে জন্মে শ্রীভগবানের শ্রীচরণ কমলে স্থান পান।
কিন্তু যদি শোনা যায় যে, দেবর্ষি নারদ ভগবানকে অভিশাপ দিয়েছেন! তাহলে চমকে উঠতে হয়। কিন্তু ঘটনা তাই। নারদ দক্ষ কর্তৃক ‘যাযাবর’ বৃত্তির অভিশাপ পেয়েছিলেন। হিমালয়ের গঙ্গার তীরে এক মনোরম আশ্রম দেখে নারদের ভালো লাগল। তিনি পর্বত-নদী-কান্তারের অনবদ্য দৃশ্য অবলোকন করে রমাকান্ত ভগবানের শ্রীচরণে অনুরাগ জন্মাল। শ্রীচরণ স্মরণ হওয়াতেই তিনি শাপমুক্ত হলেন। তারপর সেই মনোমুগ্ধকর আশ্রমে তিনি সমাধিস্থ হলেন।
নারদের এই সমাধি দেখে ইন্দ্রের ভয় হল। তিনি ভাবলেন, নারদ হয়তো তপোবলে তাঁর ইন্দ্রত্ব (স্বর্গের রাজপদ) কেঁড়ে নেবেন। ইন্দ্র কামদেবকে আদেশ করলেন, “যাও! তোমার সঙ্গী-সাথী নিয়ে দেবর্ষি নারদের সমাধি ভঙ্গ করো।” মীন কেতু কামদেব “যথা আজ্ঞা” বলে তাঁর আদেশ পালনের জন্য তৎপর হলেন।
মদন সেই আশ্রমে বসন্ত সৃষ্টি করলেন। নানা রঙের ফুল ফুটল । কোকিল গান গাইল । ভ্রমর গুঞ্জন করল। শীতল মৃদু -মন্দ সুগন্ধি বাতাস বইল । উর্বশী, রম্ভা প্রমূখ অপ্সরাগণ নানা ভঙ্গিতে শরীর আন্দোলিত করে নৃত্য পরিবেশন করল। চির যুবতী দেব ললনাদের লাস্যময়ী দেহ - বল্লরী আন্দোলিত হল। কামকলায় নিপুণ অপ্সরাদের ছলা-কলায় নারদের সমাধি ভঙ্গ হল না। তখন তারা অভিশাপের ভয় পেল। সকলে দেবর্ষি নারদের চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করল। নারদ সকলকে ক্ষমা করে দিলেন।
দেবর্ষি নারদের এই ঘটনায় খুব অহঙ্কার হল। তিনি কৈলাসে গিয়ে শিবকে বেশ গর্বের সঙ্গে এই ঘটনা বর্ণনা করলেন। শিব বললেন, আপনি এটা যেভাবে আমাকে বর্ণনা করলেন, তা কখনও ভগবান শ্রীহরিকে বলবেন না। কিন্তু নারদের শিবের উপদেশ ভালো লাগল না। তিনি বীণায় হরি গুণগান করতে করতে ক্ষীরসমুদ্রে গেলেন, যেখানে শ্রীহরি নারায়ণ রূপে বাস করেন।
নারায়ণ দেবর্ষি নারদকে আপ্যায়ন করে বসিয়ে কুশল বিনিময় করলেন। দেবর্ষি নারদ হল শ্রী ভগবানের পরম ভক্ত। কিন্তু ভগবান তো অন্তর্যামী। তবুও গর্বের সঙ্গে নারদ কামদেবের পরাজয়ের ঘটনা নারায়ণকে বললেন। নারায়ণ বললেন, “তোমাকে স্মরণ করলেই অন্যের কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ দূরীভূত হয়ে যায়। তো কামদেব পরাজিত হয়েছেÑ এটা আর এমন কি কথা? একথা শুনে নারদের আরও অহঙ্কার বৃদ্ধি পেল। তারপর নারদ বিদায় নিলেন। তখন শ্রীনারায়ণ অপূর্ব এক লীলা করলেন। তিনি ভক্ত নারদের মঙ্গলের জন্য তাঁর মায়াশক্তিকে নির্দেশ দিলেন নারদকে মোহিত করতে।
নারদ দেখলেন এক অপূর্ব নগর, যেখানে সুন্দর সব নর-নারী বাস করছে। সবাই যে মদন আর রতি। সেই নগরের রাজা শিলানিধি। বিশাল তাঁর সামরিক সজ্জা। প্রচুর ভোগৈশ্বর্যে পরিপূর্ণ সেই নগর। নারদ পুরবাসীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে, রাজকন্যা বিশ্বমোহিনীর স্বয়ম্বরা হবে। সেই উপলক্ষে বহু রাজা রাজবাড়িতে সমাগত। নারদও তামাসা দেখতে গেলেন। রাজা শিলানিধি নারদকে পাদ্যার্ঘ্য দিয়ে পূজা করলেন। তারপর রাজকন্যাকে দেখিয়ে এর দোষ-গুণ বিচার করতে বললেন। নারদ বিশ্ববিমোহিনীর অপরূপ সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে গেলেন। রাজাকে শুধু বললেন, এই কন্যা সুলক্ষণা। আর মনে মনে নারদ চিন্তা করলেন, এই কন্যার পাণি গ্রহণ যে করবে সে ত্রিলোকে পূজিত হবে। তাকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। অতএব, এই কন্যাকে পাওয়ার জন্য নারদ চিন্তা করতে করতে বাইরে এলেন। নারদ এতটাই মোহগ্রস্ত হলেন যে, তিনি স্বয়ং শ্রীহরিকে স্মরণ করলেন। ভগবানকে স্মরণ মাত্রই তিনি উপস্থিত হলেন। নারদ বললেন, “ভগবান, এই কন্যাকে আমার চাই-ই চাই। আর সেজন্য তোমার রূপ আমাকে দাও।” ভগবান বললেন, “তথাস্তু”।
যথাসময়ে স্বয়ম্বর সভা শুরু হল। শিব তাঁর দুইজন অনুচরকে নারদের কাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে ব্রাহ্মণের বেশে পাঠিয়েছিলেন। ভগবান স্বয়ং-ও রাজবেশ ধারণ করে উপস্থিত। বিশ্ববিমোহিনী নারদের দিকে দৃষ্টিপাতই করলেন না। স্বয়ং ভগবানকে বরমাল্যে বরণ করলেন। এই দৃশ্য দেখে নারদ ক্রোধে থর থর করে কাঁপতে লাগলেন। এদিকে রাজবেশধারী ভগবান বিশ্ববিমোহিনীকে নিয়ে চলে গেলেন। নারদের অস্থির মতি লক্ষ্য করে শিবের অনুচর বলল, “ঠাকুর, দর্পণে একবার নিজের মুখটা দেখ।” নারদ তখন স্থির জলে নিজ প্রতিবিম্ব দেখে আঁতকে উঠলেন। আরে! এ-তো বাদরের মুখ। নারদ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। নারদ অহর্নিশি যাঁর নাম গুণগান করে, সেই পরমেশ্বর কিনা নারদকে ছলনা করলেন! তিনি তক্ষুণি বৈকুণ্ঠের দিকে ছুটলেন। পথেই শ্রী ভগবানের দর্শন পেলেন। সঙ্গে ল²ী এবং বিশ্ববিমোহিনী। নারদ ক্রোধে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “তুমি পরের ভালো দেখতে পার না। তুমি হিংসুক! কপট! সমুদ্র মন্থনে উৎপন্ন বিষ তুমি সরলমতি শিবকে পান করিয়েছিলে। আর কৌস্তভমণি ও ল²ীকে নিয়ে তুমি বৈকুণ্ঠে চলে গেলে। তোমার মতো কুটিল স্বভাব ও স্বার্থপর আর দ্বিতীয় কেউ নেই। তোমাকে শাসন করার কেউ নেই। তাই যা ইচ্ছা তা-ই কর। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, যে বিরহে আমি জ্বলছি, সেই বিরহে তুমিও কাতর হবে। আর যে মর্কট মুখ আমাকে দিয়ে ছলনা করেছ, সেই বাঁদরই তোমার সহায়তাকারী বন্ধু হবে। শ্রীভগবান ভক্তের অভিশাপ মাথা পেতে নিলেন। আর তখনই নারদের উপর আরোপিত মায়াজাল অপসারিত করলেন। নারদ সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলেন, ল²ী বা বিশ্ববিমোহিনী কেউ কোথাও নেই। নারদ অপরাধ বুঝতে পেয়ে শ্রীভগবানের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। ভগবান বললেন, “তুমি শ্রীশঙ্করের শরণ নাও, তাহলে শান্তি পাবে। যাও, আমি রাম অবতারে পৃথিবীতে লীলা করবো। সীতা বিরহে কাতর হব এবং বানর সেনার সাহায্যে সীতা উদ্ধার করব। তুমি আমার পরম ভক্ত, তোমার অভিশাপের মর্যাদা আমি রাখব। তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই তোমার অহঙ্কার চুর্ণ করার জন্যই আমি মায়ার দ্বারা তোমাকে মোহাচ্ছন্ন করেছিলাম।”
(উৎস: রামচরিত মানস)
 লিখেছেন -শ্রী গৌরকিশোর দাস ব্রহ্মচারী
সংগ্রহে - অমিত সরকার শুভ
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।