বাঙ্গালী সনাতন তথা হিন্দু ধর্মাবল্মীদের সবথেকে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গাপূজা। শরতে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শরৎকাল ঋতুর মধ্যে সবচেয়ে শান্ত নির্মল। কিভাবে বাংলায় প্রথম উদযাপিত হয়েছিল সেটি এবার দেখা যাক।
মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুসারে রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য প্রথম দূর্গা পূজা করেন। এদের মধ্যে রাজা সুরথ পুরাণ অনুযায়ী যার রাজধানী ছিল বলিপুর। মহিষাসুর মর্দিনী নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ (রামকৃষ্ণ বেদান্তমঠ, কলিকাতা) বলেছেন বলিপুর হল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বোলপুর, তাই বাংলার রাজা সুরথ প্রথম দূর্গা পূজা করেন। তবে ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায় বাংলার তৎকালীন ৮ লক্ষ টাকা ব্যায় করে প্রথম সাড়ম্বরে দূর্গা পূজা উদযাপন করেন। ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে যখন ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠারা বাংলা আক্রমণ করে তখন তারাও দূর্গা পূজা করেছিল, তবে তারা নাকি পূজা সম্পন্ন করতে পারেনি আলিবর্দি খাঁর পাল্টা আক্রমণের জন্য।
নদীয়ার বিখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দূর্গা পূজা করেছেন। কৃষ্ণচন্দ্রের পর কলকাতায় জাঁকজমক করে দূর্গা পূজা করেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব।
যাহোক এবার তাহিরপুরে রাজা কংস নারায়ণের প্রথম দূর্গা পূজা উদযাপনের ইতিহাসের দিকে নজর দেয়া যাক। রাজা গনেশের বহু বৎসর পর রাজা কংস নারায়ণের অভ্যুদয় ঘটে। কংস নারায়ণের আদিপুরুষ মনুসিংহতার বিখ্যাত টিকাকার কুলক ভট্ট। কুলক ভট্টই তাহিরপুরের রায় বংশের আদি পুরুষ। পরবর্তীকালে এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাজা কংস নারায়ণ। তাঁর আসল নাম ছিল মুকুন্দ, পরে তিনি কংস নারায়ণ নামটি গ্রহণ করেন।
সুর বংশের পতনের পর বাংলার মসনদে বসেন বিহারের শাসনকর্তা সুলেমান কররাণী। তিনি সামরিক কেন্দ্র স্থাপন করে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার উপর স্বাধীন প্রভুত্ব বিস্তার করেন। এসময় তরুণ কংস নারায়ণ নবাবের অধীনে ফৌজদারের পদে ছিলেন। এসময় দ্বিতীয় কালাপাহাড়ের আগমন ঘটে। তার অত্যাচারে বাংলায় হাহাকার পড়ে যায়। তখন কংস নারায়ণ এ অত্যাচারের প্রতিবিধানের জন্য সুলেমান কররাণীকে অনুরোধ করেন কিন্তু দুঃখজনকভাবে তিনি এতে কর্ণপাত করলেন না। এজন্য কংস নারায়ণ তার কর্ম ত্যাগ করলেন এবং এও জানিয়ে দিলেন তিনি কিছু না কিছু একটা করবেন। তারপর তিনি নাকি কিছুকাল নিরুদ্দেশ ছিলেন। সবার ধারণাও হয়েছিল কালাপাহাড় কর্তৃক সে নিহত হয়েছে।
এসময় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিজমার হিসাবের জন্য সম্রাট আকবর তোডরমলকে নির্দেশ দেন এবং তোডরমল কংস নারায়নকে নিয়ে একাজ শুরু করেন, পরে হঠাৎ সম্রাট আকবর তোডরমলকে বিশেষ কাজে দিল্লীতে ডেকে পাঠান এবং জমিজমা হিসাবের বাকি কাজ কংস নারায়ণ সূচারুরূপে সম্পন্ন করেন এবং সকল হিসাব-নকশা ইত্যাদি পাঠিয়ে দেন দিল্লীতে। সম্রাট তার কর্মদক্ষতায় খুশী হন। এসময় সবাই ভেবেছিল সে পরবর্তী সুবেদার নিযুক্ত হবেন কিন্তু সম্রাট তা না করে দূত মারফত কংস নারায়ণের জন্য নানাবিধ মূল্যবান খেলাত, “রাজা” খেতাব এবং সুবে বাংলার দেওয়ান হবার জন্য খবর পাঠান। এবার তিনি ব্যাথিত হন কারণ সব যোগ্যতা থাকার পরও সম্রাট হয়ত দিল্লীর বিশ্বস্ত কাউকে সুবেদার করবেন বলে ঠিক করেছেন। তাই তিনি শুধু তার দেয়া রাজা খেতাব ও খেলাত গ্রহণ করে দেওয়ান পদ ত্যাগ করে নিজের জন্মভুমি তাহিরপুরে গেলেন তার বিশাল জমিদারির উন্নতি সাধনের জন্য।
এসময় তার মনে একধরনের অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগল কারণ যে রাজবংশের জন্য তার এমন প্রতিষ্ঠা সেই রাজবংশের পতনের পিছনে তারও ভূমিকা রয়েছে। সে নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলেন। পরে তিনি বাংলার বিখ্যাত পণ্ডিতদের রাজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের জানালেন, যে বিভিন্ন কারনে আমি নিজেকে পাপী এবং অপরাধী মনে করছি। তাই পাপমুক্তি বা প্রায়শ্চিত্তের জন্য কোন মহাযজ্ঞে ব্রতী হতে চাই। আপনারা শাস্ত্র অনুমোদিত কোন মহাযজ্ঞের ব্যবস্থা আমাকে দিন।
বাসুদেবপুরে ভট্টাচার্যগণ বংশানুক্রমে তাহিরপুরে জমিদারদের কূল পুরোহিত ছিলেন। এ বংশে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রী। তিনি তখন বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, “শাস্ত্রে বিশ্বজিৎ, রাজসূয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ এই চার বিধি আছে, কিন্তু বিশ্বজিৎ এবং রাজসূয় যজ্ঞ শুধু সার্বভৌম সম্রাট করতে পারবে আপনি ভূ-স্বামী তাই এর অধিকারী নন। এ ছাড়া অশ্বমেধ এবং গোমেধ এ দুইটি কলিতে নিষিদ্ধ এবং ক্ষত্রিয়ের কর্ম তাই তাও সম্ভব নয়। কংস নারায়ণ বললেন তাহলে কলিতে কি আর কোন যজ্ঞের ব্যবস্থা নেই। তখন রমেশ শাস্ত্রী বলেন কলির মহাযজ্ঞ হচ্ছে দুর্গোৎসব। সকল জাতি এটি সম্পন্ন করতে পারে, এতে সকল যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়, সত্য যুগে প্রথম সুরথ রাজা এ যজ্ঞ করেছিলেন।
কিন্তু তার পর এটা শাস্ত্রেই আবদ্ধ আছে। তুমি যদি সাহস করে রাজসিকভাবে দুর্গোৎসব কর তাতে তোমার প্রায়শ্চিত্ত হবে এবং তুমি যদি রাজি থাক তাহলে আমি এর সকল বিধি ব্যাবস্থা করতে প্রস্তুত। সে অনুযায়ী কংস নারায়ণ রাজসিকভাবে কিংবদন্তী অনুযায়ী ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করে পূজা উদযাপন এবং সু-সম্পন্ন করেন। সেই সময় তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রী আধুনিক দুর্গা পূজা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন। তখনই বাংলায় প্রথম মূর্তিতে শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয় এবং তা বিপুল প্রতিষ্ঠা পায়।
একটি বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন কংস নারায়ণের সময় কৃত্তিবাস পণ্ডিতের আবির্ভাব হয়। তিনি ১৪৩৩ শকে নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজপণ্ডিত হবার জন্য কংস নারায়ণের রাজসভায় গিয়েছিলেন। শোনা যায় যে কংস নারায়ণের অনুরোধে কৃত্তিবাস বাংলায় রামায়ণ লিখেছিলেন কৃত্তিবাস ১৪৬০ শকে রামায়ণ লেখেন। পরে তার দেখাদেখি ভাদুরিয়ার জমিদার জগৎ নারায়ণ ঐ বৎসরই বসন্তকালে দুর্গোৎসব উদযাপন করেন।
তারপর ধীরে ধীরে এ পূজা বাংলায় ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এখন এ পূজা ব্যাপকতায় আর ব্যাপ্তিতে উৎসবে রূপ নিয়েছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মাকে নিয়ে মেতে ওঠেন।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১. মহিষাসুরমর্দ্দিণী দুর্গা, স্বামী প্রজ্ঞানান্দ, রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা
২. রাজা কংসনারায়ণ ও বঙ্গে প্রথম দূর্গোৎসব, মনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবর্তক, কার্তিক সংখ্যা (১৯৭৬)
লেখক: অগ্নি সম্পদ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন