১৩ অক্টোবর ২০১৫

হিন্দু হবার অপরাধে

আপনি মুক্তিযোদ্ধা? আপনি বিচারক?  আপনি আইনজীবি? আপনি শিক্ষক? আপনি লেখক? আপনি কবি? আপনি সাংবাদিক? আপনি ব্যবসায়ী? আপনি নারী? এমনকি আপনি আওয়ামীলীগ করেন? কিছুতেই কিছু যায় আসে না, কারন আপনি হিন্দু। বাংলাদেশে হিন্দু হয়ে জন্মগ্রহণ করা একটি আজন্ম পাপ। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক:

এক
ফরিদপুরের সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের কথা মনে আছে? তিনি একজন খ্যাতিমান নির্যাতিত সাংবাদিক, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, তিনি বিএনপি জামায়াতের হামলায় পা হারিয়েছেন। বাংলাদেশের আইনে আছে কোনো পঙ্গু মানুষকে গ্রেফতার করা হলেও হাতকড়া পড়ানো যাবে না। কিন্তু কিসের কী? বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে শুধুমাত্র একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস এর কারনে তাকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে রিমান্ডে পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এই লোকটি আওয়ামীলীগের আজন্ম বন্ধু, হিতৌষী, তাতে কি? তিনি রেহাই পান নি। তিনি বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামীলীগ দুই আমলেই নিগৃহীত হলেন।

দুই
প্রবীর শিকদার গ্রেফতার হয়েছেন কার কারনে? শেখ হাসিনার মেয়ের শ্বশুর ফরিদপুরের খন্দকার মোশাররফ হোসেন এর কারনে। একথা সবাই জানেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। কয়েক দিন আগে সেই মন্ত্রী আবার আরেকটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটালেন। মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের একজন কৌসুলি রানা দাশগুপ্তকে (হিন্দু ধর্মের অনুসারি) তিনি প্রকাশ্য জনসভায় হুমকি দিলেন। তিনি বিচারকের চোখ তুলে নিতে চেয়েছেন।

তিন
ইদানিংকালে বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক কবি-লেখক-ব্লগার হত্যাকান্ডের ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত। অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, এবং নিলয়কে হত্যা করা হয়েছে। এমন খবর প্রায় সব মিডিয়াতেই এসেছে, হিন্দু ব্লগারদের হত্যা করলে নাকি বাংলাদেশের মুস্লিম ধর্মপ্রান পাবলিকের প্রতিক্রিয়া কম হবে, তাই এদেরকে টার্গেট করা হয়েছে।

চার
নববর্ষে টিএসসি’র ঘটনা মনে আছে? কিভাবে নারীদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল? কারন একটি বিশেষ গোষ্ঠী বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে থাকে। আমার স্পস্ট মনে আছে, এক সময় দুর্গা পুজায় হিন্দু মেয়েরা বেশ সুন্দর নতুন পোষাকে সাজ-গোজ করে এক পুজা-মন্ডপ থেকে আরেক পুজা মন্ডপে ঘুরে বেড়াতো। হঠাৎ করে এক সময় রাতের বেলা কারেন্ট চলে যেত। তখনই পুজা মন্ডপের আশ-পাশ থেকে কান্নার রোল শোনা যেত। ফলাফল, প্রতিবছর দুর্গা পুজার পর কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেত। এখনো যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত।

পাঁচ
কিছু দিন আগের কথা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে কেন হিন্দু প্লেয়ার নেয়া হলো? সৌম্য সরকারকে এতো পছন্দ করার কী আছে? লিটন দাশকে কেন নেয়া হলো? এসব কথা চায়ের দোকানে ব্যাপক ভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাদের অপরাধ, তারা হিন্দু। আমি কোনো ভাবেই ভেবে পাই না, সৌম্য কিংবা লিটন দাশ কিভাবে এতো বড় মাপের খেলোয়াড় হলো? আমার কিশোর বয়সের কথা আমি ভুলে যাবো কি করে? মহল্লার খেলার মাঠে আমার সঙ্গীরা হিন্দু ছেলেদেরকে ‘মালু’ বলে গালি দিত। ক্যাচ ফেলে দিলে বলতো, ‘এই শালা মালু, ক্যাচ ফেলে দিলি ক্যা?’ আবার ক্যাচ ধরলে অপর পক্ষ বলতো, ‘এই শালা মালু ক্যাচ ধরলি ক্যা?’ আমি হিন্দু ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, মায়া লাগতো, কস্টও লাগতো। তারপর একদিন আর সেই হিন্দু ছেলেরা আমাদের সাথে খেলতে আসতো না।

ছয়
বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে। কারন কি? আমরা কি তা জানি না? যে যেভাবে পারছে দিনে রাতে ভারতে পাড়ি জম্মাচ্ছে। নিজের জন্মভুমি থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতের কোনো এক জায়গায় ‘ঘটি’ কিংবা ‘বাঙ্গাল’ এর মতো এক অসহনীয় জীবন কাটাচ্ছে।

এই যে এতগুলি ঘটনা বললাম, তাদের একটাই দোষ। তারা জন্মের আগেই ভুল করে হিন্দু হয়ে বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করে ফেলেছে। এতো বড় অপরাধের শাস্তি তারা সারা জীবন ধরে পাচ্ছে। অথচ এই হিন্দু মানুষগুলিও একদিন মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। এখন তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি দেশ চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? ‘আমার এ দেশ সব মানুষের। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমানের’। তাই না? তাহলে কেন প্রবীর শিকদার নিগৃহীত হচ্ছেন? তাহলে কেন বিচারক রানা দাশগুপ্তকে ভারতের এজেন্ট বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে? তাহলে কেন লেখক, ব্লগারকে হিন্দু হবার কারনে বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে? তাহলে কেন প্রতিবছর পুজা মন্ডপে হামলা হচ্ছে? তাহলে কেন সৌম্য কিংবা লিটন দাশকে প্রিয় খেলোয়াড় বলা যাবে না? তাহলে কেন বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যা কমে যাচ্ছে? বাংলাদেশ নাকি অসাম্প্রদায়িক, সামাজিক সম্প্রীতির দেশ! এত বড় ফালতু কথা আর যে বিশ্বাস করে করুক, আমি করি না। আমাদের সবার অভিজ্ঞতায় শত শত উদাহরন জমা আছে, আরো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা জমা হচ্ছে। প্রতিদিনই।

ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিংগাপুর
( প্রকাশিত : ২০১৫-১০-১২ ১৬:৪৭:৫২)
তথ্যসুত্রঃ  www.sylhettoday24.com

 http://www.sylhettoday24.com/opinion/details/8/246?utm_campaign=shareaholic&utm_medium=facebook&utm_source=socialnetwork
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।