০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সাত প্রকার স্ত্রী কথা ও বুদ্ধের উপদেশে সুজাতার আমূল পরিবর্তন

সুজাতা ছিলেন ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা। বিশাখার ছোট বোন সুজাতা ছোটকাল হতে অত্যন্ত মুখর দাম্ভিক ছিলেন। বিশাখার সহোদরা হলেও দু'বোনের মধ্যে স্বভাবের কোন মিল নেই। বড় বোন বিশাখা ধীরস্থির, বিদুষী, বিনীতা, শান্তশীলা ও বুদ্ধিমতি আর ছোটবোন সুজাতা ঠিক তার বিপরীত।
ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী কন্যা সুজাতাকে অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর বাড়ীতে বিবাহ কার্য্য সম্পন্ন করেন। সুজাতার পিতার অতুল ঐশ্বর্য্যের নিকট শ্বশুর অনাথপিণ্ডিকের সম্পত্তি কম হলেও উপেক্ষণীয় নয়। তবুও শ্বশুরকুলের বিত্ত সুজাতার মনকে সন্তোষ দিতে পারল না।

অনাথপিণ্ডিক জেতবন বিহার তৈরী করতে চুয়ান্ন কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করেন। তখন তিনি সেই সময় প্রতিদিন পাঁচশত ভিক্ষুসংঘকে পিণ্ডদান করতেন। কত কর্মচারী, দাস-দাসী রয়েছে! তবুও সুজাতার মন খুশী নয়। ধীরে ধীরে তার স্বভাব, আত্মগৌরব ও দাম্ভিকতা উন্মুখ হয়ে উঠল। পিতার সম্পত্তির গর্ব করে শ্বশুরকুলের প্রতি অমান্যতা, কর্কশ বাক্য আর উচ্চবাক্য প্রয়োগ করতে লাগল। সকলের শান্তি নষ্ট হল। শান্তিকামী সুখবিহারী অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর সুখ ভেঙ্গে গেল। তাদের সুখের সংসারে অশান্তির সূচনা হল। অনাথপিণ্ডিক চিন্তিত হলেন। পুত্রবধুর কুৎসা প্রচার রটানো কি অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর শোভা পায়? অগত্যা তিনি নীরবে থাকায় বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন।

একদিন অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠী তথাগত বুদ্ধকে ঘরে আহারের নিমন্ত্রণ করেন। তথাগত যথাসময়ে এসে সুসজ্জিত আসনে উপবেশন করলেন। এমন সময়ে অন্তঃপুরে কলহের উচ্চ শব্দ শুনতে পেয়ে বুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন। এতে শ্রেষ্ঠীর মুখ বিমর্ষ হইল। দুঃখের সাথে বললেন, ভগবান, আমার পুত্রবধু সুজাতাই যত অনর্থের মূল। ধনকুবের ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা কিনা, তাই তার এত অহংকার বেশী! সে শ্বশুর-শ্বাশুরীকে মান্য করে না, স্বামীকে অমান্য করে, অবহেলা করে। এমনকি প্রভু! আপনাকেও সম্মান প্রদর্শনে সে আগ্রহী নয় মনে করি। অন্যজনের কথাই বা কি! তথাগত সুজাতাকে আহ্বান করলেন। সুজাতা এসে বুদ্ধকে বন্দনা করে বসে পড়ল।

 বুদ্ধ বললেন, সুজাতা! আমি এখন তোমাকে পুরুষের সাত প্রকার ভার্য্যা সম্বন্ধে বলব; (১) বধকাসমা ভার্য্যা, (২) চৌরিসমা ভার্য্যা, (৩) আর্য্যাসমা ভার্য্যা, (৪) মাতৃসমা ভার্য্যা, (৫) ভগ্নিসমা ভার্য্যা, (৬) সখীসমা ভার্য্যা ও (৭) দাসীসমা ভার্য্যা - এই সাত প্রকার ভার্য্যার মধ্যে তুমি কোন প্রকারের ভার্য্যা? সুজাতা তখন বিনীতভাবে বললেন, প্রভু! আপনি সংক্ষেপে যা বললেন তা আমি বুঝলাম না। অনুগ্রহ করে আমাকে ভালভাবে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিন আমি যাতে বুঝতে পারি। বুদ্ধ তখন বললেন, শোন সুজাতা ----

(১) যে স্ত্রী প্রদুষ্টাচিত্তা, কলহ স্বভাবা, স্বামীর অমঙ্গলকারিনী, পরপুরুষে আসক্তা, নিজের স্বামীকে অবজ্ঞাকারিনী, স্বামীর ধনসম্পদ অপব্যয়কারিনী, অর্থ না পেলে অনর্থকারিনী, স্বামীকে হত্যা করার ভয় দেখায়, এমনকি হত্যা করতেও উন্মুখ হয়, তেমন স্ত্রীকে বধকাসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(২) যে স্ত্রী স্বামীর শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষি কর্মের দ্বারা উৎপন্ন ধন-সম্পদ উপভোগ করে, তবুও স্বামীর সম্পদ চুরি করার ইচ্ছা করে এবং অল্প হলেও চুরি করে, যেমন- রান্নার সময় ধৌত করার জন্য যে চাউল নেয়া হয়, তা হতেও চুরি করে। আর অন্যকিছুর কথাই বা কি? সেই রকম স্ত্রীকে চৌরিসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(৩) যে স্ত্রী নিষ্কর্মা আলস্যপরায়ণ, অধিক ভোজনকারিনী, আর্য্যের বস্তুর প্রতি অধিকার ও লোভ পরায়ণা, মুখরা, প্রচণ্ডা, দুর্ভাষিনী, বাক্যের উপর বাক্য প্রয়োগ করে, স্বামীকে অবজ্ঞা করে, জনমণ্ডলীকে পরাস্থ করার চেষ্টা করে, স্বামীর উৎসাহ উদ্যম অসহনশীলা। এই রকম স্ত্রীকে আর্য্যাসমা ভার্য্যা বলে।

(৪) স্বামীর সঞ্চিত ধন যে স্ত্রী রক্ষা করে, সর্বদা স্বামীর হিত কামনা করে ও উপকারিনী, মাতা পুত্রকে রক্ষার ন্যায় স্বামীকে রক্ষা করে, এই রকম স্ত্রীকে মাতৃসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(৫) জ্যেষ্ঠ সহোদরের প্রতি কনিষ্ঠ ভগ্নির আদর ও সম্মান প্রদর্শনের ন্যায় যে স্ত্রী স্বামীকে প্রতি আদর সম্মান করে, স্বামীর প্রতি লজ্জাবনতা ও স্বামীর প্রতি অনুবর্ত্তনী হয়। এই রকম স্ত্রীকে ভগ্নিসমা ভার্য্যা বলে।

(৬) দীর্ঘদিন পরে সখার আগমনে সখীর আনন্দিত হবার মত স্বামী দর্শনে যে স্ত্রী আনন্দিত হয় এবং কুল মর্যাদা রক্ষাকারিনী, শীলবতী ও পতিব্রতা হয়। সে স্ত্রীকে সখীসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(৭) যে স্ত্রী স্বামী শাসন-অনুশাসন এবং লাঠি হস্তে তর্জন-গর্জন করলেও যে স্ত্রীর চিত্ত দূষিত হয় না বা ক্রোধ হয় না, হিংসা উৎপন্ন হয় না বরং স্বামীর শাসন সহ্য করে এবং ক্রোধহীনা, শান্তশীলা ও স্বামীর আনুগত্য হয়। সে স্ত্রীকে দাসীসমা ভার্য্যা বলা হয়।

এই সাত প্রকার ভার্য্যা বিষয়ে বর্ণনা করার পর বুদ্ধ আরো বললেন “সুজাতা, যে সকল ভার্য্যা বধকা, চোরী ও আর্য্যাসমা হয়, মুখরা, প্রচণ্ডা, দুঃশীলা, লজ্জাহীনা হয় ও পরুষবাক্য প্রয়োগ করে, স্বামীকে অনাদর করে, অখাদ্য খাওয়ায়, স্বামী রোগগ্রস্থ হলে সেবা করে না, সেইসব স্ত্রী মৃত্যুর পর নরকে জন্ম নিয়ে দুঃসহ দুঃখ ভোগ করে। আর যেইসব স্ত্রী মাতৃসমা, ভগ্নিসমা, সখীসমা এবং দাসীসমা তারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গে উৎপন্ন হয়। সুজাতা, এই সপ্ত প্রকারের মধ্যে তুমি কোন প্রকারের ভার্য্যা? সুজাতা তখন বিনীত বাক্যে বললেন, প্রভু! অদ্য হতে আমাকে দাসীসমা ভার্য্যা বলে জানবেন। সুজাতা আবার বলে উঠল, প্রভু! আমি এতদিন অন্ধকারে আবৃত ছিলাম।

এখন আপনার দয়ায় আলোকের সন্ধান পেয়েছি। বাবার ঐশ্বর্য্যের অহঙ্কার আত্মভিমান এখন আমার ধ্বংস হয়েছে। আমার ভ্রান্তি নিরসন হয়েছে। ভগবান! মহান বৌদ্ধকুল পরিবারের কুলবধু হয়ে আমার বিচ্যুতির জন্য আমি এখন খুবই লজ্জিত, অনুতপ্ত। আপনার অমৃতবাণী আমার মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই বলে সুজাতা বুদ্ধের চরণ তলে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। আর শ্বশুর-শ্বাশুরীকে ও স্বামীর পায়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

সেই হতে সুজাতা ভদ্রা, বিনীতা, শান্তশীলা, প্রিয়ভাষিনী হলেন; মধুর মিষ্টি স্বরে সকলের প্রতি প্রাণে প্রীতি ও আনন্দ দান করতেন; ত্রিরত্নের উপাসিকা হয়ে দানে আত্মনিয়োগে রত থাকতেন, শীল সমাধিতে ও প্রজ্ঞায় অনুশীলনে তাঁর কুল মর্যাদার অক্ষুন্ন রাখতেন। অর্থাৎ সুজাতার বিভিন্ন গুণ বিদ্যমানে সবাই আনন্দমুখর হয়ে উঠল। সর্বজ্ঞ বুদ্ধের মহিমাময় প্রভাবেই সুজাতার এমন বর্ণনাতীত আমূল পরিবর্তন হল।

(c) Prithwish Ghosh
Share:

1 Comments:

Unknown বলেছেন...

আজকাল 40% বিয়ে ভেঙে যায় । কারণ কী ? সমাধান কী
? বুদ্ধদেব নাই । এখন কি করলে বিয়ে টিকবে ?

উত্তর : পাত্র পাত্রীর রাশিবিচার সভ্যতা শিক্ষা পছন্দ বিচারের প্রয়োজন। যথা:রূপ অর্থর মাপকাঠি ঠিক নয়।...সুধী জন কি বলেন জানার আগ্রহ রইলো।
--জে জয়দেব 21-06-2018

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।