“রবি বর্মার চিত্রকর্মগুলো দেখে পুরোটা সকালই কাটিয়ে দিলাম। স্বীকার করতেই হয় যে ওগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই চিত্রগুলো আমাদের দেখায় যে আমাদের নিজস্ব গল্প, ছবি ও এর অভিব্যক্তি আমাদের কতটা আপন। কিছু কিছু চিত্রকর্মে গঠনের অনুপাত হয়তো ঠিক নেই কিন্তু তাতে কী এসে যায়! সামগ্রিক অর্থে এই চিত্রকর্মগুলোর প্রভাব থেকেই যায়”।
১৮৪৮ সালের ২৯শে এপ্রিল রাজা রবি বর্মার জন্ম হয় ভারতের কেরালা রাজ্যের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল তৎকালীন ‘ত্রাভানকোর’ এর ‘কিলিমানুর’ রাজপ্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নীলকান্থন ভট্টতিরিপদ ও মাতা উমাম্বা থামপুরত্তি। তার পরিবারের আবহাওয়া ছিল শিল্পমনা। কবি, শিল্পীতে ভরপুর এই বংশ-পরম্পরায় রবি’র শিল্পমন খুব একটা অদ্ভূত কিছু ছিলো না বটে, কিন্তু তারপরও ছোটবেলায় রবি’র ছবি আঁকাআঁকির ব্যাপারটি দুরন্তপনা বলেই গণ্য হয়েছিলো। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকেই তার ছবি আঁকার নেশা তাকে সবার কাছে পরিচিত করে তোলে। তাদের বাড়ির দেয়াল ভরে ওঠতো তার আঁকা পশুপাখির ছবিতে, হাটবাজারে, পথেঘাটে বহমান নিত্যদিনের জীবনযাত্রার দৃশ্যে।
তার সৃজনশীলতা ও শৈল্পিক অভিব্যক্তি খুব সাধারণ ছবিতেও স্পষ্ট হয়ে ওঠতো। বাড়ির সবাই যখন তার এই অন্যরকম দুরন্তপনায় কিছুটা বিরক্ত বোধ করছে, তখন তার কাকা রাজা রাজা বর্মাই ছিলেন যিনি রবির শিল্পীসত্ত্বাকে আরো বিকশিত করার পথে নিয়ে যান। রাজা বর্মা নিজেও তাঞ্জোরের শিল্পী ছিলেন। তিনি তার ভ্রাতুষ্পুত্রের চিত্রশিল্পে প্রথম শিক্ষক হন, তিনি তাকে শিল্পের খাতায় নিয়ম-কানুনের হাতেখড়ি করান এবং তার একান্ত পৃষ্ঠপোষকতায়ই রবি বর্মার চিত্রশিল্পীজীবনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষণ শুরু হয়। ১৪ বছর বয়সে রাজা রবি বর্মা জলরঙ্গে ছবি আঁকতে শেখেন থিরুবনান্তপূরম রাজপ্রাসাদের রাজ চিত্রকর রামা স্বামী নাইড়ুর কাছ থেকে।
সে সময়ে তৈলচিত্রের ব্যাপারটি ছিলো ছবি আঁকার জন্য অত্যন্ত নতুন একটি মাধ্যম। একজন ব্যক্তিই তৈলচিত্র সম্পর্কে খুব ভাল করে জানতেন, জানতেন কীভাবে তেলরঙ্গে চিত্র রূপ নেয়। ব্যক্তিটি ছিলেন মাদুরাই প্রদেশের রামা স্বামী নাইকার। রবি বর্মা তার কাছ থেকেই তৈলচিত্রে দীক্ষা নিতে মনস্থ করেন, কিন্তু বলিহারি! নাইকার তাকে কিছুতেই প্রশিক্ষণ দান করতে চাইলেন না! নাইকার ছিলেন একজন ঈর্ষান্বিত শিল্পী, যিনি রবি’র মধ্যে তার ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পান।
এ সময় গল্পে অবতীর্ন হন আরেক চরিত্র, নাইকারেরই এক ছাত্র অরূমুঘম পিল্লাই। নাইকারের এই ছাত্র তার শিক্ষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে রাজা রবি বর্মাকে তেল রঙ্গে ছবি আঁকা শেখাতে শুরু করেন। এর সাথে ডাচ চিত্রশিল্পী থিওডর জনসনও যুক্ত হন রবি বর্মার শিক্ষকতালিকায়। থিওডর জনসন মূলত একজন পোর্ট্রেটশিল্পী ছিলেন এবং তিনি রাজা আইল্যাম থিরূনাম এর পোর্ট্রেট আঁকতে ভারতে এসেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে, বহু ভুল করার পর, ভুল শোধরানো মোড়ের পর রবি বর্মা তেলরঙ্গে ছবি আঁকায় সিদ্ধহস্ত হলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরপর তিনিও রাজকীয় জুটি আইল্যাম থিরূনাম ও তার পত্নীর একটি পোর্ট্রেট আঁকেন। বলা হয়ে থাকে এই পোর্ট্রেট তার শিক্ষক থিওডর জনসনের আঁকা পোর্ট্রেটটির চাইতেও মোহনীয় ছিলো! একেই বোধহয় বলে একেবারে ‘গুরুমারা বিদ্যে’!
চিত্রকর রাজা রবি বর্মা তার শিল্পকে শুধু শিক্ষকপ্রাপ্ত জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। সুনির্মল বসুর কবিতাটির মতই রবি বর্মাও বিশ্বাস করতেন, “বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র……”। ভারতীয় উপমহাদেশের অগণিত সঙ্গীত, কথাকলি নৃত্য ও প্রাচীন গাথা থেকে তিনি খুঁজে নিয়েছেন তার জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাবার উৎস এবং সময়ে সময়ে সে জ্ঞান ঢেলে দিয়েছেন রং-তুলিতে ছোঁয়ানো তার ক্যানভাসে।
যখন ভারতের মানুষ ব্রিটিশ রীতি-নীতিতে ক্রমেই নিমজ্জিত হচ্ছিলো এবং নিজেদের সংস্কৃতিতে প্রশংসনীয় কিছু থাকতে পারে তাও ভুলে যাচ্ছিলো, ভারতীয় সংস্কৃতিকে সেসময় রক্ষার ভার যারা নিয়েছিলেন, তার মধ্যে রাজা রবি বর্মার নাম অবশ্যই থাকা উচিত। এক রাজা ইউরোপীয় চিত্রশিল্পের দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে রবি বর্মাকে নির্দেশ দেন সেসব চিত্রকর্মের অনুলিপি প্রস্তুত করতে। রবি বর্মা তা অস্বীকার করেন এবং তাকে বলেন যে ভারতীয় সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করতে বাইরে থেকে কোন অনুলিপি তৈরী করতে হবেনা, ভারতের মাঠেঘাটে প্রাচীনকাল থেকেই ছড়িয়ে আছে শিল্পের সহস্র উপাদান। শুধু সেগুলোকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলবার বিলম্বমাত্র! এর জের ধরে তিনি ভ্রমণ করেন সমগ্র ভারতবর্ষ এবং যখন তার মনে হয় ভারতীয় সাহিত্যের সাথে মিল রয়েছে ভারতের লোকেদের জীবনবোধের, জীবনদর্শনের এবং সর্বোপরি তাদের জীবনযাপনের। তখনই তিনি একের পর এক পৌরাণিক কাহিনীর খন্ড দৃশ্য তার চিত্রাবলীতে প্রকাশ করতে থাকেন। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের সাহিত্য… ভারতবাসীর সঙ্গে যা জড়িয়ে থেকেছে বহুকাল ধরে, তার দৃশ্যমান রূপ দেখতে পারলো তারা, রবি বর্মার ক্যানভাসের মধ্য দিয়ে।
রাজা রবি বর্মা বিবাহিত ছিলেন, তার স্ত্রী ছিলেন পুরুরুত্তাথি ভাগীরথী…মাভেলিকরার রাজপরিবারের মেয়ে। তাদের সর্বমোট পাঁচ সন্তান ছিল।
আমরা আগেই দেখেছি যে তার অধিকাংশ ছবিই ছিলো পৌরাণিক কাহিনী ও চরিত্র নিয়ে, কিন্তু তার খ্যাতি অর্জনে এই ছবিগুলোর পাশাপাশি অবদান রেখেছে বহু রাজা-মহারাজা ও অভিজাতশ্রেণীর নিখুঁত পোর্ট্রেটগুলোও। ১৮৭০ থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত রবি বর্মা মনোনিবেশ করেন পোর্ট্রেট আঁকার প্রতি এবং লাভ করেন সুদূরপ্রসারী খ্যাতি। ১৮৭৩ সালে ঘটে তার শিল্পীজীবনের স্বীকৃতির শুরু, মাদ্রাস চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে প্রথম পুরষ্কার লাভের মধ্য দিয়ে। সেই একই বছরে ভিয়েনা প্রদর্শনীতেও প্রথম পুরষ্কার পেয়ে খ্যাতির সীমানা পৌঁছে যায় দেশ থেকে এবার বিদেশে। এরপর শিকাগো কলাম্বিয়ান প্রদর্শনীতে গিয়ে তিনটি স্বর্ণপদক অর্জনের মধ্য দিয়ে রাজা রবি বর্মার নাম যুক্ত হয়ে যায় বিশ্ববিখ্যাতদের তালিকায়ও। ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন, রাজা রবি বর্মাকে ‘কায়সার-ই-হিন্দ’ স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। তার খ্যাতির বিড়ম্বনা হিসেবে একবার কিলিমানুর পোস্ট অফিসে দেশ-বিদেশের অগণিত চিঠির বন্যা বয়ে গিয়েছিলো!
তিনি ছিলেন তার জীবনকালে প্রথম আধুনিক ভারতীয় চিত্রশিল্পী। তাকে ‘আধুনিক ভারতীয় দৃশ্য সংস্কৃতির জনক’ও বলা হয়েছে। ইউরোপীয় শিল্পের প্রকৃতিবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ভারতের প্রকৃতি থেকে নির্যাস নিয়ে যান তার শিল্পে। যা তার চোখে সুন্দর ছিলো, তিনি সে সৌন্দর্যকে সেঁচে আনতে চাইতেন… সম্পূর্ণরূপে ঢেলে দিতে চাইতেন ক্যানভাসে। সৌন্দর্যেরে পূজারী এই চিত্রকর সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে এতটাই বদ্ধপরিকর ছিলেন যে প্রায়ই ভুলে বসতেন স্থান-কাল-পাত্র! যে সৌন্দর্য তার চোখকে মুগ্ধ করেছে, তাকে স্থায়ী রূপ না দেয়া পর্যন্ত শান্ত হতে পারতো না তার শিল্পীমন! তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনকিছুর সৌন্দর্যই চিরস্থায়ী হয়না…কিন্তু শিল্প চিরস্থায়ী হয়।
ভারতের আপামর জনগণকে শিল্পের কাছাকাছি আনতে, সংস্কৃতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করতে রাজা রবি বর্মা এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার চিত্রকর্মগুলো যেন শুধু একটি নির্দিষ্ট অভিজাত গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের উঁচু-নিচু সকল স্তরে। বিশেষজ্ঞরা তার চিত্রকর্ম সম্পর্কে কী মতামত দেন তারচাইতেও বেশি তিনি ভাবতেন আপামর জনতা তার চিত্রকর্মগুলোকে কতটা নিজেদের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারে, কতটা আপন ভাবতে পারে তা নিয়ে…তাই তিনি একটি পথ বেছে নিলেন যাতে করে তার শিল্প পৌঁছে যাবে প্রতিটি মানুষের কাছে। সেই বেছে নেয়া পথটি ছিল ‘মুদ্রণ শিল্প’, এবং এও বলা হয়ে থাকে যে মুদ্রণ শিল্পকলায় সর্বাপেক্ষা সফল শিল্পী ছিলেন কেরালার রাজা রবি বর্মা। ১৮৯৪ সালে তিনি একটি লিথোগ্রাফি ছাপাখানা স্থাপন করেন ও তার আঁকা ছবিগুলোর প্রতিলিপি বাংলাসহ সারা ভারতে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রবি বর্মার কাছে এই ছিলো তার সাফল্য, এই ছিলো তার পরম অর্জন।
৫৮ বছর বয়সে রাজা রবি বর্মা ত্রাভানকোরের কিলিমানুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। কেরালা সরকার তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ‘রাজা রবি বর্মা পুরষ্কারম’ প্রবর্তন করেছে। শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য বার্ষিকভাবে এই পুরষ্কারটি দেয়া হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র:https://en.m.wikipedia.org>wiki>raja_ravi_varma
www.thefamouspeople.com
Film: ‘Rangrasiya’
Book: Art nationalism in colonial India, Partha Mitter
ছবি উৎস:
www.webneel.com
লেখকঃAnindeta Chowdhury
সংগ্রহঃ https://roar.media
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন