০৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র


আমরা সবাই হিন্দু হয়েও মাঝেমধ্যেই শাস্ত্র নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পরি, একদল বলে শাস্ত্রে অমুক লেখা আছে, আরেকদল অন্য শাস্ত্রের মাধ্যমেই অমুক শাস্ত্রবচন খণ্ডন করে। এই ব্যাপারটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর, কোনকোন শাস্ত্র মানবো আর কোনপ্রকার মানবোনা, এইনিয়ে বির্তক থেকেই যায়।
আসলে হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুধর্মের পথ চলা।এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে অসংখ্য ঋষিরা তাদের ধর্মপিপাষার থেকে ঈশ্বর সম্পর্কিয় যে উপলব্ধি গ্রন্থের আকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন সেগুলিই আমাদের ধর্মীয় শাস্ত্র।তাদের মধ্যে অনেকেই ঈশ্বর উপলব্ধির নূতন নূতন পথ দেখিয়ে গেছে।হিন্দুশাস্ত্রের গ্রন্থ অনেক ও বিচিত্র।বিভিন্ন স্তরের মানুষেকে বিভিন্নভাবে ধর্মের শিক্ষা দিতে হয় বলে হিন্দুদের শাস্ত্র গ্রন্থের সংখ্যা বেড়েগেছে।তবে সবার আগে মনে রাখতে হবে এই বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রের মূল হলো বেদ।
হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ গুলি নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক।
‪#‎বেদ‬:- হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ।ঋষিদের সাক্ষাৎ উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত বলে বেদের অপর নাম শ্রুতি, সব হিন্দুশাস্ত্রের প্রমাণ নির্ভর করে এই শ্রুতির উপর। পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থের অপেক্ষায় বেদ প্রাচীন। সংস্কৃতে "বিদ্" ধতুর অর্থ জানা।এই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন বলে বেদ শব্দের মূল অর্থ জ্ঞান।
বেদ চারখানি ঋক্‌, সাম,যজুঃ ও অথর্ব বেদ।আবার প্রত্যেক বেদের দুটি ভাগ সংহিতা ও ব্রাহ্মণ।সংহিতা ভাগে আছে মন্ত্র বা স্তোত্র, এবং ব্রাহ্মণভাগে আছে তাদের অর্থ ও ব্যবহারের নির্দেশ।
বৈদিকযুগে প্রতিমাপূজা ছিল না।মন্ত্র দ্বারা অগ্নিতে আহুতি দেওয়াই ছিল সেযুগের ঈশ্বর আরাধনার রীতি।এই বৈদিক কর্মকে যজ্ঞ বলা হয়।বেদের ব্রহ্মণভাগে অনেক ধরনের যজ্ঞের কথা উল্লেখ আছে।সংহিতাভাগের মন্ত্রগুলি এই সমস্ত যজ্ঞের সময় পাঠ করা হয়।কোন যজ্ঞে কখন কিভাবে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা দরকার তা ব্রহ্মণ থেকে জানা যায়।
‪#‎উপনিষদঃ‬-
বেদের কিছু অংশের নাম উপনিষদ।বেদের শেষের দিকে আছে বলে অথবা বেদের সারাংশ বলে এর অপর নাম বেদান্ত।
বেদের যে অংশে যাজ্ঞযজ্ঞের কথা উল্লেখ আছে তাকে কর্মকাণ্ড বলে।উপনিষদ অংশের মুখ্য আলোচ্য বিষয় পারমার্থিক জ্ঞান(ব্রহ্মজ্ঞান)। তাই উপনিষদ গুলিকে জ্ঞানকাণ্ড বলা হয়।
ব্রহ্ম কোথায় এবং কিভাবে আছেন,মানুষ ও জগতের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ কি, তাঁকে জানবার উপায় কি এবং প্রয়োজন বা কি এসমস্ত কথা উপনিষদ থেকে জানা যায়।
উপনিষদ অনেক।প্রত্যেকটি বেদেই কতগুলি উপনিষদ আছে।এদের মধ্যে ১১টি উল্লেখযোগ্য--- ঈশ,কেন,কঠ,প্রশ্ন,মুণ্ডক,মাণ্ডূক্য,ঐতরেয়,তৈত্তিরীয়,ছান্দোগ্য,বৃহদারণ্যক ও শ্বেতাশ্বতর।
‪#‎স্মৃতিঃ‬-
হিন্দুরা কিভাবে জীবন যাপন করবে তার নির্দেশ মনু, যাজ্ঞবল্ক্যরা গ্রন্থ রচনা করে গেছেন,হিন্দুদের পারিবারিক জীবনে কি কি অনুষ্ঠান করা উচিৎ এইসব এই গ্রন্থে লেখা আছে।
বর্ণ অনুযায়ী হিন্দুদের কি কাজ করা উচিৎ, কি কাজ করা উচিৎ নয়, তার উল্লেখ আছে।স্মৃতিগুলি সম্পূর্ণ ভাবেই শ্রুতিমূলক।তবে সামাজিক পরিবর্তনের অনুযায়ী বিধিনিষেধ ব্যবস্থাগুলি পরিবর্তন হয়েছে এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গেও নতুন নতুন স্মৃতি রচনা হয়েছে।যেমন একসময় বঙ্গদেশের হিন্দুসমাজ রঘুনন্দনের স্মৃতির দ্বারা প্রভাবিত ছিল।বর্তমানে আমাদের সমাজ স্মৃতির সমাজ থেকে বহুদূরে।
‪#‎দর্শনঃ‬-
বেদবাক্যের উপর নির্ভর করে ঈশ্বর তত্ত্ব নিয়ে ৬টি স্বতন্ত্র মতবাদের সৃষ্টি। একসঙ্গে এদের ষড়দর্শন বলে।জৈমিনি,ব্যাস,কপিল,পতজ্ঞলি,গৌতম ও ক্ণাদ, এদের রচিত দর্শন গুলি যথাক্রমে পূর্বমীমাংসা,উত্তরমীমাংসা,সাংখ্য,যোগ,ন্যায় ও বৈশেষিক।
পূর্বমীমাংসায় বেদের কর্মকাণ্ড এবং উত্তরমীমাংসায় জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে আলোচনা আছে।ব্যাসদেবের রচিত দর্শনকে বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র বলা হয়।
‪#‎পুরাণ‬
দর্শনগুলি খুব কঠিন। এইগুলি কেবল পণ্ডিতদের পাঠ্য আমাদের মত সাধারণের কাছে কঠিন। জনসাধারণের জন্য হিন্দুঋষিরা পুরাণ নামে এক শ্রেণীর শাস্ত্র রচনা করেন।সরল ও মনোরম ধর্ম শিক্ষা।নানারকম গল্প ও রূপের মাধ্যমে হিন্দুদের প্রাচীন ইতিহাসের আভাস এর থেকে পাওয়া যায়।পুরাণ আঠারখানা তাছাড়া উপ-পুরাণও আছে।
‪#‎রামায়ণ‬ ও মহাভারতঃ-
পুরাণের মত হিন্দুদের সহজ জনপ্রিয় দুটি অতিপ্রয়োজনীয় শাস্ত্র রামায়ণ ও মহাভারত।বাল্মীকি ও ব্যাসদেব যথাক্রমে এই দুইখানি মহাকাব্যের রচয়িতা।এদের ইতিহাসের পর্যায়ে ফেলা হয়।
‪#‎গীতাঃ‬-
মহাভারতের একটি অংশের নাম গীতা।যুদ্ধের প্রক্কালে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন কে যে তত্ত্ব উপদেশ প্রদান করেন সেই অংশটি শ্রীমদ্ভগবদগীতা নামে প্রসিদ্ধ। উপনিষদ যেমন বেদের সার, গীতাকেও তেমন উপনিষদের সার বলা যায়।হিন্দু শাস্ত্রগুলির মধ্যে গীতাই সর্বপেক্ষা জনপ্রিয়।
প্রস্থানত্রয়ঃ-
উপনিষদ,বেদান্তদর্শন ও গীতাকে একসঙ্গে প্রস্থানত্রয় বলে।প্রস্থানত্রয় হিন্দুদের প্রধান শাস্ত্র বলে গণ্য।প্রস্থানত্রয়কে কেন্দ্র করে হিন্দুধর্মের প্রধান সম্প্রদায় গুলির মতবাদ গড়ে উঠেছে।সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আচার্যরা এর উপর নানান ব্যাখা দিয়েছেন - দ্বৈত,অদ্বৈত,বিশিষ্টাদ্বৈত এইসকল।
তন্ত্রঃ-
ঈশ্বর কে আদ্যাশক্তিরূপে চিন্তা করে তন্ত্র ধারনা তৈরি।তন্ত্রগু

লি সাধারণত শিব ও পার্বতীর নানান কথোপকথন আকারে রচিত।কিছুর প্রশ্নকর্ত্রী পার্বতী এবং উত্তরদাতা মহাদেব, এবং অন্যগুলির প্রশ্নকর্তা শিব এবং উত্তরদাত্রী পার্বতী।প্রথমগুলিকে আগম বলে এবং শেষের গুলিকে নিগম। ৬৪ তন্ত্র আছে, এর মধ্যে --- মহানির্বাণ,কুলার্ণব,কুলসার,প্রপঞ্চসার,তন্ত্ররাজ,রুদ্রযামল,ব্রহ্মযামল,বিষ্ণুযামল অন্যতম।
‪#‎পঞ্চরাত্র‬ সংহিতা ও শৈব আগমঃ-
বৈষ্ণবদের পঞ্চরাত্রসংহিতা ও শৈবদের শৈবাগম তন্ত্রজাতীয় শাস্ত্র।এই শাস্ত্রগুলির দাবি এই যে, বেদ অপেক্ষা পঞ্চরাত্র সংহিতা ও শৈব আগম এই যুগে(কলিযুগের) বেশী উপযোগী। আগে শাস্ত্রেগুলির মত এরা বেদমূলক নয়,তবে বেদের সঙ্গে স্পষ্ট কোন বিরোধ নেই(তবে ফেসবুকে এর পালনকারিরা বেদ বিরোধী প্রচার করেন)
প্রায় ২১৫ খানা আলাদা আলাদা পঞ্চরাত্রসংহিতা গ্রন্থের কথা শোনা যায়, --- ঈশ্বর, পৌষ্কর,পরম, সাত্বত, বৃহৎব্রহ্ম ও জ্ঞানামৃতসারসংহিতা(প্রথমখানি যামুনাচার্য,পরের তিনখানি শ্রীরামানুজাচার্য উল্লেখ করে গেছেন, শেষটি নারদপঞ্চরাত নামে পরিচিত)।
২৮ টি শৈব আগমের কথা জানা যায়,তবে বর্তমানে ২০টির কিছুকিছু অংশ পাওয়া যায় মাত্র।
শ্রীশংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদের প্রভাবে এরা অনেকাংশ বৈদান্তিক মতে ফিরে এসেছেন।
(হিন্দুধর্ম থেকে)
Courtesy: Sumit Bhattacharya
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।