হতাশা হলো সমস্ত মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এবং মারাত্বক। তাই এই সমস্যা এবং এর সমাধান সর্ম্পকে জানা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। কারণ এটি আমাদের নিজের বা আমাদের প্রিয় ব্যক্তির জীবনে আসতে পারে।
কিছু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানঃ ---
১) পৃথিবীর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ মানসিক বির্পযয়ে ভূগছে এবং এর সর্ব প্রধান কারন হল হতাশা। (WHO 2001)
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯ কোটি মানুষ হতাশায় ভূগছে।
২) প্রতি ৫ জন বয়স্কদের মধ্যে ১ জনের হতাশাজনিত সমস্যা রয়েছে।
৩) প্রতি ৮ জন তরুনের মধ্যে ১ জনের হতাশাজনিত সমস্যা রয়েছে।
৪) ১-২ কোটি মানুষ প্রতি বছর আত্মহত্যার চেষ্টা করে যাদের মধ্যে ১০ লাখই সফল হয় এবং এর ৪ ভাগের ৩ অংশ ঘটে হতাশার কারনে ।
৫) ১৯৯০-২০০৩ পর্যন্ত বছরগুলোতে যুব সমাজে আত্মহত্যা প্রায় ৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে । যাদের বয়স মাত্র ১৫-২৫ এবং এর ২০ ভাগ ঘটে হতাশার কারনে ।
৬) হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিদের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৪৩০ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার ব্যয় হয় ।
হতাশার সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও উপর্সগঃ ---
অক্সফোর্ড অভিধান অনুসারে, “হতাশা হল চরম বিষন্নতা বা অবসাদগ্রস্থ জৈবিক অবস্থা যার কিছু বৈশিষ্ট্য হল অসহায়ত্ব, অতৃপ্তি, কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেমন : জীবনি শক্তি, পৌরুষ এবং তেজ হ্রাশ পাওয়া ।
হতাশার কিছু উপর্সগ হল উদ্বিগ্নতা, অপূর্ণতা বা শূন্যতায় ভোগা, অসহায়ত্ব, বিষাদ ইত্যাদি । হতাশা, খাওয়া ও ঘুমানোর অভ্যাসকেও অনিয়মিত, বিশৃঙ্খল করে দেয় । ফলশ্রুতিতে, হতাশাগ্রস্থ মানুষর হয় ওজন বেড়ে যায় না হয় কমে যায় এবং হয় তারা অতিরিক্ত ঘুমায় না হয় মোটেই ঘুমায় না । কেউ যখন নিজেকে দোষী এবং মূল্যহীন মনে করে জীবনের কোনকিছুতেই স্বাদ পায় না ও আত্মহত্যার পরিকল্পনায় রত হয় । তখন তাকে ইউনিপোলার (unipolar) নামক হতাশার শিকার বলে গন্য করা হয়।
কেউ যখন চরম অসহায়ত্বে বিষাদগ্রস্থ হয় এবং বেশিরভাগ সময়ে প্রলাপ বকতে থাকে তখন তাকে বাইপোলার (Bipolar) নামক হতাশার শিকার বলে গন্য করা হয় । এ ধরনের হতাশার প্রধান উপর্সগ হল যে ব্যাক্তি অত্যন্ত দুঃখেও হাসতে থাকে এবং কৃত্রিমভাবে আনন্দ প্রকাশ করে, প্রলাপ বকে । এর সাথে আছে ক্রোধপ্রবনতা, অনিদ্রা, নেশাসক্তি, ভুলে যাওয়া, অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, অত্যাধিক যৌনবাসনা, অত্যাধিক শক্তি ও অস্বাভাবিক আচরন ।
বৈজ্ঞানিক প্রগতি-সমাধান নয়ঃ ---
গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, যা আরাম আয়েশের, সুখ-স্বাচ্ছন্দের সর্বোচ্চ বস্তু সরবরাহ করছে| কিন্তু মানুষের গুণের কোন পরিবর্তন খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্ট্যসাধ্য।
টেলিফোনে আগে ডায়েল করে যোগাযোগ করতে হতো, কিন্ত এখন তা ইন্টারনেট টাচস্ক্রিন মুঠোফোনে পরিনত হয়েছে । পঞ্চাশ এর দশকে টেলিভিশনের কন্ট্রোলের উদ্ভাবন ছিল এক মহান অর্জন । এই রিমোট কন্ট্রোলের মাত্র দুটো বাটন ছিল; একটা চ্যালেন পাল্টানোর জন্য ও অপরটা কাজ করার জন্য এবং টিভি সেটকে সঠক স্থানে বসাতে হত । হয়ত দেখা যেত অর্ধেকের বেশি সময় টা কাজ করত না । কিন্ত বর্তমানে ছোট একটা রিমোট কন্ট্রোল দিয়েই কমপক্ষে দুইশটার মত চ্যালেন অনায়াসে ঘুরে আসা যায় । চিকিৎসা প্রযুক্তি বর্তমানে এতই উন্নত যে ক্যান্স্যার, লেপ্রসির মত মারাত্বক ব্যধিও এখন উপশমযোগ্য । সড়ক এবং আকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত । এমনও দিন ছিল যখন সেনাবাহিনীর জেনারেলদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের সম্মুখে অবস্থান করতে হত । কিন্ত আজ সেনাবাহিনীর এমন অবিশ্বাস্য, বৈজ্ঞানিক, উপগ্রহ-নিয়ন্তিত অস্ত্র আছে যে তারা এক দেশ থেকে অন্যদেশে যুদ্ধ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রন করতে পারে।
এখন একটা প্রশ্ন থেকে যায়, “আদৌ কি আনুপাতিক হারে জীবন যাত্রার গুণগত মান বেড়েছে ?” এর উত্তর হল একটা মর্মান্তিক ‘না’ ।
মাদকতা, ধর্ষন, অপরাধ-প্রবনতাও সমান তালেই বেড়েই চলছে । আমেরিকার সর্ববৃহৎ ব্যয়খাত হল অপরাধ দমন কার্যক্রমগুলো । ওখানে ৫০ শতাংশেরও অধিক কয়েদী বড় বড় অপরাধ, সন্ত্রাসের সাথে জড়িত এবং সাজা প্রাপ্ত। কিন্তু এমন এক সময় ছিল যখন মানুষ তাদের দরজা খোলা রেখেই বাইরে যেত এবং নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা মুক্ত থাকত । বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা কখনও শোনা যেত না এবং এরকমের ঘটনা ঘটলে তা গনমাধ্যমগুলোতে সংবাদ আকারে ছড়িয়ে পড়ত । কিন্ত এখন যুক্তরাষ্টের প্রায় ৭০ শতাংশের মত দম্পতি ৩ বছরেই বিচ্ছেদ ঘটায় । চিকিৎসাক্ষেত্রে সবরকম উন্নতি সত্ত্বেও মানুষের গড় আয়ূ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে । ভ্রুণ হত্যা একটি নিয়মে পরিনত হয়েছে । কিছু কিছু দেশে, গড়ে ৩ টি শিশুর ১টিকে মাতৃগর্ভেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । শুধু কিছু সংখ্যক মানুষের বিলাসিতার ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির সম্মুখিন । যার ফলে ওজন স্তর ধ্বংস হচ্ছে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন ঝুকিপূর্ণ হতে যাচ্ছে ।
যখন প্রভুপাদ (ইসকন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য) বার্কলির (Barkley) ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান (যা বিশ্বের অন্যতম সর্ব্বোশ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়) তিনি সেখানে একটা টাওয়ার দেখতে পান, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ, হতাশা, একাকিত্বের কারনে আত্মহত্যা করে । এইভাবেই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সকল প্রকার প্রগতি সত্বেও উদ্বেগ এবং হতাশা আমাদের নিত্য সঙ্গী । সকল রাষ্ট্রই আমেরিকাকে অনুসরণ করার প্রয়াস চালাচ্ছে । কারন, এটিই হচ্ছে সবচেয়ে ধনী রাষ্ট । যদি আমরা একটি পয়সা নিই, তাহলে তাতে দুটো পিঠ দেখতে পাব যার একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি বিবেচনা করতে পারব না । তেমনি বিজ্ঞানের এবং প্রযুক্তির ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়, এটি আমাদের চেতনাকে শূন্যতা, মেকি এবং কৃত্রিমতায় পরিপূর্ণ করে দিচ্ছে এবং ভয়ানক দুর্ভোগের দিকে চালিত করছে ।
হতশা-কারনসমূহ:
এখন মানুষের মন উগ্র পারিপার্শ্বিক বস্তুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষকে এখন গভীর চিন্তা ও মননের জন্য অবকাশ দেওয়া হয় না । জীবনযাত্রা এত গতিসম্পন্ন হয়েছে যে সবকিছুই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে ।
উদাহরন: আগেরকার দিনে মানুষ চলচ্চিত্র দেখতে যেত এবং অভিনেতা এবং অভনেত্রীদের প্রশংসা করত । কিন্তু বর্তমানে চলচ্চিত্রগুলো এতই যান্ত্রিক হয়েছে যে মানুষ তাতে অভিনয় নয়, প্রযুক্তির কারুকাজগুলোই দেখে (বিভিন্ন 3D ইফেক্ট, এনিমেশন ইত্যাদি)।
টেলিভিশনে এখন একদেশে বসে অন্যদেশের অনুষ্ঠান উপভোগ করা যায় । এই ধরনের অনুষ্ঠান এবং খবরাখবর মানুষের মনকে বিক্ষিপ্ত করছে ।
এই ধরনের যান্ত্রিক প্রভাবের ফলে, আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলা নিতান্তই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে । যার ফল প্রবল নীতিহীনতা, হতাশা ও একাকিত্ত্বতা এবং এগুলো মনের স্বাভাবিক কার্যকলাপে ভীষনভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করে । এ অবস্থায় কেউ যখন অন্য কারো সাথে ব্যক্তিক সম্পর্ক গড়তে চায় তখন সে ভয়ানক হতাশার মুখোমুখি হয় । কারণ প্রবল যান্ত্রিকতার দরুন জীবন হয়ে দাঁড়ায় অর্থহীন ও শূন্য । সেই বিরক্ত মনের ফল মানসিক বিশৃঙ্খলা, অপরাধ, যুদ্ধ ও গণহত্যা ।
উদাহরণ ১ঃ চিকিৎসাবিদ্যায় সাইকো নিউরো ইমিউনোলজি (Psycho Neuro immunology) নামে একটি শাখা আছে, যা শরীরের ওপর মনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে । মস্তিস্কের নিউরো ট্রান্সমিটারগুলো (Neuro Transmitter) মানসিক চাপ, অতৃপ্তি ও শূন্যতার ফলে শরীরের বিভিন্ন কোষে বার্তা প্রেরণ করে যা পরবর্তীতে মারাত্মক ব্যধি ঘটায় । ১৯৯৫ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০ জন চিকিৎসকদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । সেখানে “সুস্থতার জন্য পারমার্থিকতা” বিষয়ক একটি সেমিনারে শারীরিক সুস্থতার জন্য মনের সমস্যার সমাধানই একমাত্র উপায় হিসেবে ফুটে উঠে ।
উদাহরণ ২ঃ ধনাঢ্য এবং উন্নত দেশগুলোতে মানুষের মন, মাঝে মাঝে এতই বিরক্ত হয় যে তারা শিশুদেরকে অপহরন ও নির্যাতন করার পর নির্মমভাবে হত্যা করে । ওখানে তাদেরকে ডাকা হয় Serial Killer, এবং এটা এখন একটা রীতিতে (Fashion) পরিণত হয়েছে । এমন কি এখন শিশুদেরকে দেখা যায় তারা তাদের শিক্ষকদের হ্ত্যা করতে অস্ত্র নিয়ে ক্লাসে ঢুকছে ।
উদাহরণ ৩ঃ একটি গবেষনায় এই রোগে আক্রান্ত কিছু রোগীকে দুইটি দলে ভাগ করা হয় । এক দলকে ঔষধি গুণহীন কিছু পিল (Pill) সেবন করতে দেওয় হয় এবং অপরটিকে কোন পিলও দেওয়া হয় না । দেখা যায় যাদেরকে পিল দেওয়া হয়েছিল তাদের অধিকাংশ দ্রুত আরোগ্য লাভ করেছে যদিও পিলগুলো ছিল ঔষধি গুণহীন । কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিল যে পিলগুলো তাদেরকে সুস্থ করে তুলবে ।
তাই, দেখা যায় যখন একজন রোগী প্রচন্ড মানসিক চাপ ও হতাশাগ্রস্থ থাকে তখন সবচেয়ে ভালো ওষুধও রোগের নিরাময় ঘটাতে ব্যর্থ হয় ।
ভগবদগীতায় আমাদের মনের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ ও তার সমাধান ব্যাখ্যা করা হয়েছে । পরবর্তী পর্বে তা আলোচনা করা হবে ।
(শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী মহারাজের প্রবচন হতে সংক
Shusanta Banda
লিত বাংলা অনুবাদ) (চলবে......)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন