সুপ্রাচীন কাল থেকে সাংখ্যদর্শনের এই যে সুবিস্তৃত প্রভাব, তা সত্ত্বেও আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ দর্শনের মূল গ্রন্থ সংখ্যা যৎসামান্যই বলা যায়। মহর্ষি কপিলকে এ দর্শনের সূত্রকার বলা হলেও কপিল রচিত কোন সাংখ্যসূত্র গ্রন্থের খোঁজ পাওয়া যায় না। ‘তত্ত্বসমাস’ নামের ক্ষুদ্র একটি সূত্র-সংগ্রহ গ্রন্থকে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ ম্যাক্সমুলার সাংখ্যমতের প্রাচীনতম গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে এই তত্ত্বসমাসই মহর্ষি কপিলকৃত মূল সাংখ্যসূত্র। কিন্তু এই প্রস্তাব মানতে নারাজ ‘কীথ’, ‘গার্বে’ প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানেরা। একে তো তত্ত্বসমাসের প্রাচীনত্ব অনিশ্চিত, তার উপর সাংখ্যমতের প্রাচীন রূপটি সনাক্ত করার জন্য এই সংক্ষিপ্ত সূত্র-সংগ্রহের মূল্যও নগন্য। বিদ্বানদের মতে কেবলমাত্র ২২টি ক্ষুত্র ক্ষুদ্র সূত্রের এই সমষ্টিকে পূর্ণ গ্রন্থ না বলে গ্রন্থের বিষয়সূচিই বলা যায়।
.
এছাড়া কপিলের শিষ্য আসুরি এবং আসুরির শিষ্য পঞ্চশিখের রচিত কোন গ্রন্থেরও সন্ধান পাওয়া যায় না। হতে পারে তাদের রচিত গ্রন্থ এখন বিলুপ্ত। এক্ষেত্রে ষোড়শ শতাব্দির সাংখ্য দার্শনিক বিজ্ঞানভিক্ষুর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। সাংখ্যপ্রবচনসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যের ভূমিকায় ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু স্বয়ং বলেছেন-
‘কালার্কভক্ষিতং সাংখ্যশাস্ত্রং জ্ঞান-সুধাকরম্ ।কলাবশিষ্টং ভূয়োহপি পুরয়িষ্যে বচোহমৃতৈঃ।। (সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য)অর্থাৎ : সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যেও গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কলামাত্রই অবশিষ্ট আছে ; আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।
.
তবে ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সাংখ্যকারিকা’য় পঞ্চশিখ প্রণীত কপিলের উপদেশসমূহের এক বৃহৎ সংগ্রহ ‘ষষ্ঠিতন্ত্র’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়-
‘সপ্তত্যাং কিল যেহর্থাস্তেহর্থাঃ কৃৎস্নস্য ষষ্টিতন্ত্রস্য।আখ্যায়িকাবিরহিতাঃ পরবাদবিবর্জ্জিতাশ্চাপি।। (সাংখ্যকারিকা-৭২)অর্থাৎ : (পঞ্চশিখ রচিত) সমগ্র ষষ্টিতন্ত্রে যে সমস্ত বিষয় (বা তত্ত্ব)বর্ণিত, আখ্যায়িকা ও পরমত খণ্ডন ছাড়া, সেই সমস্ত তত্ত্বই সত্তরটি কারিকায় বলা হয়েছে।
.
মূলত ঈশ্বরকৃষ্ণ প্রণীত ‘সাংখ্যকারিকা’-ই বর্তমানে সাংখ্যশাস্ত্রের প্রাচীনতম নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। ষষ্ঠিতন্ত্র নামে যে বৃহৎ সংগ্রহ গ্রন্থ ছিলো,ঈশ্বরকৃষ্ণ সেই ষষ্ঠিতন্ত্রের কাহিনী ও প্রবাদসমূহ বর্জন করে দর্শনের আসল তত্ত্বকে সত্তরটি শ্লোকে গ্রথিত করেছেন। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে,-
‘এতে বোঝা যায় যে ষষ্ঠীতন্ত্র ছিলো বৌদ্ধ পিটক ও জৈন আগমের মতো এক বৃহৎ সাম্প্রদায়িক পিটক, যার মধ্যে বুদ্ধ ও মহাবীরের মতো কপিলের এবং সম্ভবত তাঁর শিষ্য আসুরির উপদেশ ও তত্ত্ব সংগৃহীত হয়েছিলো।’
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দির মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে ঈশ্বরকৃষ্ণ কর্তৃক ‘সাংখ্যকারিকা’ রচিত হয়েছে। সত্তরটি শ্লোকের সাহায্যে (মোট শ্লোকের সংখ্যা ৭২) এই গ্রন্থে সাংখ্যের সমুদয় তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে এই সাংখ্যকারিকা গ্রন্থটি ‘সাংখ্যসপ্ততি’ নামেও পরিচিত।
.
ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার উপর পরবর্তীতে বহু টীকাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। বর্তমানে প্রাপ্য গ্রন্থাদির মধ্যে পরমার্থ (খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক) মতান্তরে বিন্ধ্যবাসী কর্তৃক চীনা ভাষায় রচিত ‘সুবর্ণসপ্ততি’ সর্বপ্রাচীন টীকাগ্রন্থ বলে গৃহীত হয়েছে। চীনে সুরক্ষিত ভারতীয় বৌদ্ধ পরম্পরা থেকে জানা যায় যে, সুবর্ণসপ্ততির সাংখ্যমত খণ্ডনের জন্য সমকালীন বৌদ্ধ দার্শনিক বসুবন্ধু ‘পরমার্থসপ্ততি’ নামে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সাংখ্যকারিকার উপর রচিত অন্যান্য ভাষ্য বা বৃত্তি ও টীকাগ্রন্থের মধ্যে নবম শতকে রচিত বাচস্পতি মিশ্রের ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’, মাঠর রচিত ‘মাঠরবৃত্তি, অজ্ঞাত রচয়িতার ‘যুক্তিদীপিকা’ এবং গৌড়পাদ রচিত ‘গৌড়পাদভাষ্য’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
.
সাংখ্যদর্শনে ‘সাংখ্যপ্রবচনসূত্র’ নামে অপর একটি আকরগ্রন্থের নাম জানা যায়। এই গ্রন্থে সাংখ্যতত্ত্ব সমূহের তুলনামূলক বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। তার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানভিক্ষু ষোড়শ শতাব্দিতে ‘সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য’ নামে একটি ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর মতে সাংখ্যপ্রবচনসূত্রই মহর্ষি কপিল কৃত প্রাচীন সাংখ্য দর্শন। কিন্তু পণ্ডিতদের কাছে এই অভিমত যুক্তিগ্রাহ্য হয়নি। কেননা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ, ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতকে রচিত যে সকল সাংখ্য গ্রন্থ পাওয়া যায়, তার কোনটাতেই এই গ্রন্থের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি মাধবাচার্যও তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ এ গ্রন্থের উল্লেখ করেন নি। এ থেকে অনুমিত হয় যে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকই এই গ্রন্থের রচনাকাল। অনিরুদ্ধ ভট্ট এই গ্রন্থের উপর ‘সাংখ্যসূত্রবৃত্তি’ নামে একটি টীকাগ্রন্থ রচনা করেন। বিজ্ঞানভিক্ষুর ‘সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য’ ছাড়াও ‘সাংখ্যসার’ নামে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ রয়েছে।
.
এছাড়া সীমানন্দ প্রণীত ‘সাংখ্যতত্ত্ববিবেচন’, ভাবাগনেশ প্রণীত ‘সাংখ্যতত্ত্ব যথার্থদীপন’ হরিহরানন্দের ‘সাংখ্যতত্ত্বালোক’ অনিরুদ্ধের ‘সাংখ্যপ্রদীপ’,পঞ্চানন তর্করত্নের ‘পূর্ণিমাটীকা’ প্রভৃতি সাংখ্য দর্শনের উপর ব্যাখ্যামূলক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বর্ণিত সকল গ্রন্থই যথারীতি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। তবে বাচস্পতি মিশ্রের কৃত ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’-ই ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার উপর রচিত অতি বিস্তৃত, প্রাঞ্জল টীকাগ্রন্থ হিসেবে সর্বজনসমাদৃত।
.
সম্প্রদায়ের নামকরণ:
সাংখ্য সম্প্রদায়ের নামকরণের ব্যাপারে একাধিক মত প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে ‘সাংখ্য’ শব্দটি এসেছে ‘সংখ্যা’ থেকে। এই সম্প্রদায় যেহেতু তত্ত্বের সংখ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তাই এই সম্প্রদায়ের নাম ‘সাংখ্যসম্প্রদায়’। সাংখ্য মতে তত্ত্বের সংখ্যা পঞ্চবিংশতি বা পঁচিশ। এই পঞ্চবিংশতিতত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ হয়। কিন্তু অন্যেরা এই মতকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে করেন না। কেননা, প্রতিটি দর্শন সম্প্রদায়েই কতকগুলি নির্দিষ্ট তত্ত্ব স্বীকৃত এবং সেইগুলিকে সংখ্যার দ্বারা প্রকাশ করা যায়। যেমন, ন্যায়মতে ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান নিঃশ্রেয়সের হেতু। আবার বৈশেষিকমতে পদার্থের সংখ্যা সপ্ত বা সাত। এ কারণে কেউ কেউ মনে করেন, ‘সাংখ্য’ বলতে এখানে সম্যক-জ্ঞান (সাং+খ্য = সম্যক+জ্ঞান) বা যথার্থ জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে। সাংখ্যমতে জ্ঞান দ্বিবিধ- তত্ত্বজ্ঞান ও ব্যবহারিক জ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞান এ দর্শনে ‘বিবেকজ্ঞান’ নামে পরিচিত। বিবেকজ্ঞানের মাধ্যমে জীবের দুঃখনিবৃত্তি হয়। যেহেতু এ দর্শনে বিবেকজ্ঞানকেই মোক্ষের হেতু বলা হয়েছে, তাই এ দর্শনকে সাংখ্যদর্শন বলা হয়।
এখানে উল্লেখ্য, ব্যাপক অর্থে ‘সাংখ্য’ শব্দের দ্বারা যোগ দর্শনকেও নির্দেশ করা হয়। মহর্ষি কপিল সাংখ্যসূত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি, তাই সাখ্য সম্প্রদায় ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন বলে এই দর্শনকে ‘নিরীশ্বর সাংখ্য’ বলা হয়। অন্যদিকে যোগদর্শনে যেহেতু ঈশ্বর স্বীকৃত, তাই যোগদর্শনকে ‘সেশ্বর সাংখ্য’ বলা হয়।
ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের মতোই মূলত সাংখ্য ও যোগ দর্শন সমানতন্ত্র দর্শন। উভয় দর্শনে পার্থক্য সামান্যই। কপিলের সাংখ্য দর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয় তত্ত্বসমূহ, কিন্তু পতঞ্জলির যোগদর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয় যোগ।
(চলবে…)
=রণদীপম বসু=
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন