তন্ত্র সাধনা একটা নেশা, যে কোনও কিছুর চেয়েও মারাত্মক নেশা। সাধারণে ভাবেন তান্ত্রিকেরা নেশা-ভাঙ করে, মাঝে মাঝে বেশ্যা এনে ফুর্তি করে, পঞ্চ ম-কারের সাধনা মানে মদ ও মহিলা ভোগ, তান্ত্রিকেরা সমাজে থাকতে পারে না, বা তাদের আলাদা একটা সমাজই আছে ইত্যাদি। আসলে তা মোটেই নয়, তন্ত্রশাস্ত্রে মানুষ প্রথম অবস্থায় পশু। প্রথম স্তরের যে মানুষ, স্ত্রী শক্তির সঙ্গত ছাড়া তার এক পাও উপরে ওঠার জো নেই, শক্তিকে আশ্রয় করেই তাকে এগোতে হয়। কারণ, পুরুষ শক্তির সঙ্গে প্রকৃতি শক্তির মিলন সম্পূর্ণ না-হলে সৃষ্টি হয় না। আর, পঞ্চ ম-কার এই পশু-স্তরের আচার। এই আচার শুধু তন্ত্রে নেই; ছাল চামড়া ছাড়ালে আমাদের আজকের তথাকথিত সভ্য সমাজেও দেখতে পাবেন। তন্ত্রে যা 'নিয়মানুগ', সমাজে তা ছাড়া গরু, অনিয়ন্ত্রিত, অপরিমিত, অমার্জিত --- তন্ত্রে এটা উপরে ওঠার রাস্তা, লোক-সমাজে তা নামার।
তান্ত্রিকেরা পারেন বাহ্যিক বিশ্বের পাশ কাটাতে, তাঁরা উৎকট সাধনে দিনের পর দিন কাটান। এ ভাবেই শেখেন ব্রহ্মাণ্ডের কোনও কিছুতেই ভয় না পেতে, জিততে শেখেন কামভাব, শেখেন গা ঘিনঘিন করা জিনিসকেও ঘেন্না না করতে। মন থেকে বাহ্যিক টানগুলো কেটে গেলেই তান্ত্রিক পূর্ণ জ্ঞান পান। তখন ওই পঞ্চ ম-কারের মানেই বদলে যায়।
-
সাধকদের কাছে মদ উত্তেজক নয় ----
মদ্য --
‘ব্রহ্মরন্ধ্র হতে যেই সুধা ঝরে অনিবার
পিয়ে মাতে সদানন্দে সেই মদ্যসাধক সার’।
মাংস --
‘মা শব্দে রসনা বুঝ, বাক্য তারই অংশ হয়,
সেই বাক্য রসনার অতি প্রিয় সুনিশ্চয়,
সে বাক্য ভক্ষণ করে বাকসংযত যেই,
নির্বাক সেই মহাসাধু মাংসের সাধক সেই’।
মৎস্য -----
ঈড়া-পিঙ্গলা ও সুষুম্নার ত্রিবেণীতে
যে সাধক সাঁতরে থাকে সুস্থ্য চিতে,
সে সাধক জানিবে ব্রহ্মময়ীর বৎস
সাধনায় সিদ্ধ হয়ে হয়েছে মৎস্য।
আর মৈথুন, তখন—
‘মৈথুন পরম তত্ত্ব সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কারণ,
ব্রহ্ম আর তাঁর শক্তির নাইকো বারণ,
তাহাতে হইলে সিদ্ধি সুদুর্লভ লভে ব্রহ্মজ্ঞান
এই মৈথুনে রত যেই সে মৈথুনের সাধক প্রধান।’
-
পার্থিব ভোগ-বাধা কাটিয়ে পরম শক্তির সঙ্গে এক, একাত্ম হয়ে যাওয়ার রাস্তা খুলে দেয় তন্ত্র। এ কাজে তার সহায় প্রকৃতিরই এক অমোঘ নিয়ম— রোজ এক খাবার খেলে কিছু দিনেই তা বিস্বাদ লাগে, রুচি হয় না। যাঁরা এই রুচি হারিয়ে খাদ্যের সারাৎসারটা বুঝতে পারেন, তাঁরা তন্ত্রাদর্শে প্রথমে বীর সাধক, পরে দেবতা।
তন্ত্র কল্পনায় আমাদের মেরুদণ্ডের আগাগোড়া একটি অতি সূক্ষ্ম পথ আছে। সেই পথই প্রাণের পথ বা নাড়ী। চোখের পলক ফেলতে যতটা সময় লাগে, সেই সময়ে ওই নাড়ী বরাবর প্রাণের যে কত বার ঊর্ধ্ব-অধঃ যাতায়াত হয়, তা ভাবা যায় না। তন্ত্রে এই প্রাণশক্তিকে ‘মা’ আর তাঁর গতিক্রিয়াকে নৃত্য বলা হয়েছে। অর্থাৎ মা নাচ্ছেন, সে নাচের বিরাম নেই। এই প্রাণশক্তির পথ ধরে এগোলে মেরুদণ্ডের একেবারে শেষ প্রান্তের উপরে একটি সূক্ষ্ণ ছিদ্র পথ পাওয়া যায়, যাকে বলে মূলাধার চক্র। লিঙ্গমূলে রয়েছে আর একটি ছিদ্র বা দ্বার। তান্ত্রিক নাম— স্বাধিষ্ঠান চক্র। সেই রকমই হৃৎপিণ্ডের সমসূত্রে মেরু পথে রয়েছে অনাহত চক্র। শরীরের গোপন শক্তির আরও কত উৎস! কণ্ঠের সমানে আছে বিশুদ্ধাক্ষ চক্র। যেখানে মেরুদণ্ড আরম্ভ, চলতি কথায় আমরা বলি দুই ভ্রূর মধ্যে, তাকে বলা হয় আজ্ঞা বা প্রজ্ঞা চক্র। তার উপরে পরমাত্মার রাজ্য— সহস্রার। তান্ত্রিক সাধনে এই ছয় চক্র ভেদ করা সম্ভব হলে জীব আত্মা পরমাত্মায় মিলিত হয়।
স্থুল ভাবের পশুপ্রবৃত্তিসম্পন্ন প্রথম স্তরের মানুষে এই জীবাত্মা প্রাণশক্তিকে অবলম্বন করে সাড়ে তিন পাক দিয়ে সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে, মূলাধার চক্রে অতি সূক্ষ্ণ দেহে থাকে। চৈতন্য বা সম্যক জ্ঞান পেলে জীবাত্মা পূর্ণ বিকশিত হয়। মূলাধার চক্রের গাঁট যাদের খোলে, তারা ঈশ্বরের টানে ছটফট করতে শুরু করে। গিয়ে ঠেকে প্রথমে স্বাধিষ্ঠান, পরে মণিপুর-চক্রে। এই অবধিই যা কিছু বিত্তবাসনার টান। প্রথমের এই তিন চক্র ছাড়ানোই ভীষণ কষ্টের। ব্যাপারটা আরও ভাল বুঝিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বলেছেন ‘‘যখন সংসারে মন থাকে, তখন, লিঙ্গ, গুহ্য ও নাভি মনের বাসস্থান, মনের চতুর্থ ভূমি হৃদয়, তখন প্রথম চৈতন্য হয়েছে। তখন আর নীচের দিকে মন যায় না। মনের পঞ্চম ভূমি কণ্ঠ। মন যার কণ্ঠে উঠেছে, তার ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোনও কথা শুনতে বা বলতে ভাল লাগে না। মনের ষষ্ঠ ভূমি কপাল। সেখানে অহর্নিশি ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন হয়। শিরোদেশে সপ্তম ভূমি। সেখানে মন গেলে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন মেলে।’’ এটাই তন্ত্র-সাধনা। এ বিদ্যা পুরোপুরি গুরুমুখী। গুরু সহায় না হলে প্রতি পদে পা হড়কানোর ভয়।
----- তন্ত্র সাধনা মূল শক্তি দেয়, বাইরের নয়, ভিতরের। শক্তি চালনার ক্ষমতা পেলে নিজেকে সামলানো বড়ই কঠিন। তা ছাড়া, প্রতি পদে থাকে প্রলোভন। অর্থ, ক্ষমতা সব শক্তিই দেন কালী। অনেক সাধক তখন চার হাত-পায় ভোগে লেগে যায়, প্রবৃত্তি তার ঘাড়ে চেপে বসে। ফলও হয় মারাত্মক। যেখানে সেখানে শক্তি প্রয়োগ করে শেষে এক দিন শক্তি বিলকুল উবে গিয়ে জীবনটাই মিছে হয়ে যায়। এমন পচা কাদায় পড়ে যে, আর ওঠার ক্ষমতা থাকে না। প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টাও যেখানে বিফল। এ পথ খেলুড়ে বা হঠকারীদের জন্য নয়। -- লাল-কালো শালু পরে, গলায় রুদ্রাক্ষ মালা দিয়ে, কপালে লাল সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে, 'জয় জয় তারা' আওয়াজ করে তারাপীঠে বসত করে সিদ্ধিলাভ হয় না, মনই হ'ল একমাত্র তীর্থ। মনঃসংযম হ'ল তান্ত্রিকের সর্বপ্রধান অস্ত্র।
তান্ত্রিকেরা পারেন বাহ্যিক বিশ্বের পাশ কাটাতে, তাঁরা উৎকট সাধনে দিনের পর দিন কাটান। এ ভাবেই শেখেন ব্রহ্মাণ্ডের কোনও কিছুতেই ভয় না পেতে, জিততে শেখেন কামভাব, শেখেন গা ঘিনঘিন করা জিনিসকেও ঘেন্না না করতে। মন থেকে বাহ্যিক টানগুলো কেটে গেলেই তান্ত্রিক পূর্ণ জ্ঞান পান। তখন ওই পঞ্চ ম-কারের মানেই বদলে যায়।
-
সাধকদের কাছে মদ উত্তেজক নয় ----
মদ্য --
‘ব্রহ্মরন্ধ্র হতে যেই সুধা ঝরে অনিবার
পিয়ে মাতে সদানন্দে সেই মদ্যসাধক সার’।
মাংস --
‘মা শব্দে রসনা বুঝ, বাক্য তারই অংশ হয়,
সেই বাক্য রসনার অতি প্রিয় সুনিশ্চয়,
সে বাক্য ভক্ষণ করে বাকসংযত যেই,
নির্বাক সেই মহাসাধু মাংসের সাধক সেই’।
মৎস্য -----
ঈড়া-পিঙ্গলা ও সুষুম্নার ত্রিবেণীতে
যে সাধক সাঁতরে থাকে সুস্থ্য চিতে,
সে সাধক জানিবে ব্রহ্মময়ীর বৎস
সাধনায় সিদ্ধ হয়ে হয়েছে মৎস্য।
আর মৈথুন, তখন—
‘মৈথুন পরম তত্ত্ব সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কারণ,
ব্রহ্ম আর তাঁর শক্তির নাইকো বারণ,
তাহাতে হইলে সিদ্ধি সুদুর্লভ লভে ব্রহ্মজ্ঞান
এই মৈথুনে রত যেই সে মৈথুনের সাধক প্রধান।’
-
পার্থিব ভোগ-বাধা কাটিয়ে পরম শক্তির সঙ্গে এক, একাত্ম হয়ে যাওয়ার রাস্তা খুলে দেয় তন্ত্র। এ কাজে তার সহায় প্রকৃতিরই এক অমোঘ নিয়ম— রোজ এক খাবার খেলে কিছু দিনেই তা বিস্বাদ লাগে, রুচি হয় না। যাঁরা এই রুচি হারিয়ে খাদ্যের সারাৎসারটা বুঝতে পারেন, তাঁরা তন্ত্রাদর্শে প্রথমে বীর সাধক, পরে দেবতা।
তন্ত্র কল্পনায় আমাদের মেরুদণ্ডের আগাগোড়া একটি অতি সূক্ষ্ম পথ আছে। সেই পথই প্রাণের পথ বা নাড়ী। চোখের পলক ফেলতে যতটা সময় লাগে, সেই সময়ে ওই নাড়ী বরাবর প্রাণের যে কত বার ঊর্ধ্ব-অধঃ যাতায়াত হয়, তা ভাবা যায় না। তন্ত্রে এই প্রাণশক্তিকে ‘মা’ আর তাঁর গতিক্রিয়াকে নৃত্য বলা হয়েছে। অর্থাৎ মা নাচ্ছেন, সে নাচের বিরাম নেই। এই প্রাণশক্তির পথ ধরে এগোলে মেরুদণ্ডের একেবারে শেষ প্রান্তের উপরে একটি সূক্ষ্ণ ছিদ্র পথ পাওয়া যায়, যাকে বলে মূলাধার চক্র। লিঙ্গমূলে রয়েছে আর একটি ছিদ্র বা দ্বার। তান্ত্রিক নাম— স্বাধিষ্ঠান চক্র। সেই রকমই হৃৎপিণ্ডের সমসূত্রে মেরু পথে রয়েছে অনাহত চক্র। শরীরের গোপন শক্তির আরও কত উৎস! কণ্ঠের সমানে আছে বিশুদ্ধাক্ষ চক্র। যেখানে মেরুদণ্ড আরম্ভ, চলতি কথায় আমরা বলি দুই ভ্রূর মধ্যে, তাকে বলা হয় আজ্ঞা বা প্রজ্ঞা চক্র। তার উপরে পরমাত্মার রাজ্য— সহস্রার। তান্ত্রিক সাধনে এই ছয় চক্র ভেদ করা সম্ভব হলে জীব আত্মা পরমাত্মায় মিলিত হয়।
স্থুল ভাবের পশুপ্রবৃত্তিসম্পন্ন প্রথম স্তরের মানুষে এই জীবাত্মা প্রাণশক্তিকে অবলম্বন করে সাড়ে তিন পাক দিয়ে সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে, মূলাধার চক্রে অতি সূক্ষ্ণ দেহে থাকে। চৈতন্য বা সম্যক জ্ঞান পেলে জীবাত্মা পূর্ণ বিকশিত হয়। মূলাধার চক্রের গাঁট যাদের খোলে, তারা ঈশ্বরের টানে ছটফট করতে শুরু করে। গিয়ে ঠেকে প্রথমে স্বাধিষ্ঠান, পরে মণিপুর-চক্রে। এই অবধিই যা কিছু বিত্তবাসনার টান। প্রথমের এই তিন চক্র ছাড়ানোই ভীষণ কষ্টের। ব্যাপারটা আরও ভাল বুঝিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বলেছেন ‘‘যখন সংসারে মন থাকে, তখন, লিঙ্গ, গুহ্য ও নাভি মনের বাসস্থান, মনের চতুর্থ ভূমি হৃদয়, তখন প্রথম চৈতন্য হয়েছে। তখন আর নীচের দিকে মন যায় না। মনের পঞ্চম ভূমি কণ্ঠ। মন যার কণ্ঠে উঠেছে, তার ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোনও কথা শুনতে বা বলতে ভাল লাগে না। মনের ষষ্ঠ ভূমি কপাল। সেখানে অহর্নিশি ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন হয়। শিরোদেশে সপ্তম ভূমি। সেখানে মন গেলে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন মেলে।’’ এটাই তন্ত্র-সাধনা। এ বিদ্যা পুরোপুরি গুরুমুখী। গুরু সহায় না হলে প্রতি পদে পা হড়কানোর ভয়।
----- তন্ত্র সাধনা মূল শক্তি দেয়, বাইরের নয়, ভিতরের। শক্তি চালনার ক্ষমতা পেলে নিজেকে সামলানো বড়ই কঠিন। তা ছাড়া, প্রতি পদে থাকে প্রলোভন। অর্থ, ক্ষমতা সব শক্তিই দেন কালী। অনেক সাধক তখন চার হাত-পায় ভোগে লেগে যায়, প্রবৃত্তি তার ঘাড়ে চেপে বসে। ফলও হয় মারাত্মক। যেখানে সেখানে শক্তি প্রয়োগ করে শেষে এক দিন শক্তি বিলকুল উবে গিয়ে জীবনটাই মিছে হয়ে যায়। এমন পচা কাদায় পড়ে যে, আর ওঠার ক্ষমতা থাকে না। প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টাও যেখানে বিফল। এ পথ খেলুড়ে বা হঠকারীদের জন্য নয়। -- লাল-কালো শালু পরে, গলায় রুদ্রাক্ষ মালা দিয়ে, কপালে লাল সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে, 'জয় জয় তারা' আওয়াজ করে তারাপীঠে বসত করে সিদ্ধিলাভ হয় না, মনই হ'ল একমাত্র তীর্থ। মনঃসংযম হ'ল তান্ত্রিকের সর্বপ্রধান অস্ত্র।
(c) Prithwish Ghosh
1 Comments:
এতোগুহ্যগুরুমুখীতত্ত্ব নেটে দেওয়া উচিত হয়নি... কারণ সাধারণে বিনা গুরুতে অনুশীলন করতে গেলে মৃত্যু বা মস্তিস্ক বিকৃতি অনিবার্য|
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন