• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

৩১ অক্টোবর ২০১৫

এ এক আজব শিব মন্দির

এ এক আজব মন্দির | প্রতিদিন সে মিলিয়ে যায় সমুদ্রের কোলে | আবার জেগে ওঠে সমুদ্র থেকে | মুখে মুখে নাম হয়ে গেছে ‘ ডিজঅ্যাপিয়ারিং টেম্পল‘ বা বিলীয়মান মন্দির | গুজরাতে বরোদা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কভি কম্বোই নামে একটি ছোট্ট শহরে আছে মহাদেবের এই মন্দির |

১৫০ বছরের এই মন্দিরের পোশাকি নাম স্তম্ভেশ্বর মন্দির | আরব সাগরের এক কোণে কাম্বে উপসাগরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই উপাসনালয় | জোয়ারের সময় সমুদ্রের নোনা জল গ্রাস করে নেয় তাকে | আবার ভাটার সময় ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে বেরিয়ে আসে মহাদেবের এই মন্দির |


রোজ একবার করে প্রায় সম্পূর্ণ জলের নীচে চলে যায় মন্দির | আবার ভাটায় বেরিয়ে আসে | সে দেখার মতো দৃশ্য | তিল তিল করে জল এসে ঢেকে দেয় তাকে | আবার একটু একটু করে জল সরে গিয়ে দৃশ্যমান হয় মন্দির | তখন ভক্তরা প্রবেশ করে পুজো অর্চনা সবই করে | এমনকী ঘুরেও বেড়ানো যায় মন্দির লাগোয়া জমিতে | কিন্তু জোয়ার আসার আগে খালি করে দেওয়া হয় মন্দির প্রাঙ্গণ | প্রকৃতি নিজেই এখানে শিবলিঙ্গের জল-অভিষেকের আয়োজন করে |
প্রতি অমাবস্যায় এখানে ধূমধাম করে শিবপুজো হয় | দুধের বদলে দেবতার অভিষেক হয় তেল দিয়ে | পুজোর পাশাপাশি ভক্তদের অন্যতম আকর্ষণ হল জোয়ার ভাটায় মন্দিরের লুকোচুরি খেলা দেখা | সেটি দেখতে হলে অবশ্য সারদিনই ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকতে হবে এখানে | জোয়ার ভাটায় মন্দিরের অদৃশ্য এবং দৃশ্যমান হওয়া দেখতে |


Collected from:  Rintu Kumar Chowdhury
Share:

২৭ অক্টোবর ২০১৫

রাশিয়াতে একমাত্র সনাতন ধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্মের প্রচার নিষেধ

রাশিয়ার রাস্তায় রাস্তায় চলছে কৃষ্ণ নাম প্রচার!!! অবাক লাগছে তাই না!!! “”হ্যাঁ”” এটা সেই দেশ। যে দেশে ‪হিন্দু‬ কেন ইসলাম ধর্মের ও প্রচার করার অনুমতি নেই!!!‪ইসকনের‬ সহযোগিতায় যখন রাশিয়াতে ‪‎গীতা‬ প্রচার হতো রাশিয়ান সরকার ভুল বুঝে সেটাও বন্ধ করে দিলো । পরে ইসকনের উর্ধ্বতন ভক্তদের সহযোগিতায় রাশিয়ান সরকার গীতাকে রির্চাস করে দেখল গীতাতে যা আছে পৃথিবীর আর কোন ধর্ম শাস্ত্রে পাওয়ার কল্পনাও করা যায় না!!! তখন রাশিয়ান সরকার একমাত্র ইসকনকে গীতা প্রচারের জন্য অনুমতি দিলো । আজকে সেই রাশিয়াতে একমাত্র সনাতন ধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্মের প্রচার নিষেধ। সকলে বলুন জয় গীতা!!!
Share:

২০ অক্টোবর ২০১৫

পূজা মানে পুষ্পকর্ম- ফুলটা মলিন হয়ে গেছে, এই যা ..!

‘হে হে...হিন্দুর দেবতা যদি সত্যি থাকবে তয় হেগো দেবী ঠেকায় না ক্যান? মানুষ ভাঙ্গে ক্যামনে? কই মুসলমানের মসজিদ কেউ তো ভাঙ্গতে পারে না?’ শিক্ষক-খেলার সাথী-সহকর্মী অনেকের মুখেই এসব কথা শুনে বড় হয়েছি এবং এখন মধ্যবয়সেও একই কথা শুনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাসে প্রবীণ শিক্ষক অনায়াসে বলে ফেলেন, ‘ভালোই তো হইছে, রামুর ভাঙ্গা-চুরা কয়খান টিনের ঘর ভাঙ্গনের পর সেইহানে নতুন বিল্ডিং হইছে। হ্যাগো তো লাভই হইছে। লাভ হইছে না?’ এসব শুনেও না শোনার ভান করে থাকার অভ্যাস আজন্মের। কিল খেয়ে কিল চুরি করে থাকার মতো। ভারতের আখলাকরা নিশ্চয়ই জানেন এই কিল খেয়ে কিল চুরি করার বিষয়টা। শহরে থাকার কারণে মা পূজা করেছেন ফুল, উলুধ্বনি এবং ঘণ্টা না বাজিয়েই। তাঁর বামপন্থী সন্তানেরাও পাত্তা দেয়নি কোনদিন।



নিত্য বছর প্রতিমা ভাঙ্গে। আমাদের অধিকাংশ সাংবাদিক অবশ্য গণমাধ্যমে ‘মূর্তি ভাঙ্গা’র খবর দেন। সম্ভবত ‘প্রতিমা’ আর ‘মূর্তি’র পার্থক্য তাঁরা জানেন না, তাঁদের হাউস থেকেও শেখানো হয় না। শুনেছি ১৯৭২ সালেও অষ্টমী পূজার দিন কোথাও প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়েছিলো। তবুও হিন্দুরা পূজা করেন। কোন প্রতিবাদ ছাড়াই। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, প্রতিমা আসলে ভাঙ্গা যায় না। যাঁরা বিশ্বাসী, প্রতিমা তাঁরা অন্তরে ধারণ করেন। তাই প্রতিমা ভাঙ্গলেও তাঁরা পূজা চালিয়ে যেতে পারেন। অনেক পরিবারে দুর্গা তাঁদের মেয়ে। বৎসরান্তে বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে।

পাবনা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় হিন্দু ধর্মের ক্লাস নিতেন যে অপর্ণাদি, তাঁর পৈতৃক বাড়ির পূজা দেখতে গিয়ে সে’কথা বুঝেছিলাম। আমাদের বাসায় অবশ্য সরস্বতী পূজা ছাড়া অন্য পূজার তেমন কোন আয়োজন ছিলো না। অতি সৎ সরকারী চাকুরে বাবা সব ভাইবোনকে দুর্গা পূজায় নতুন জামা দিতে পারতেন না। তখনো পূজার বোনাস শুরু হয়নি। আমরা ছোট দুই বোন জামা পেতাম, দিদি হাতে সেলাই করতো। একদিন বড় ভাইবোনদের প্রহরায় পূজা দেখতে যাওয়া ঘণ্টা দুয়েকের জন্য, আর পূজার খাওয়া-দাওয়া একদিন, বিশেষ করে বাবার অফিসের সহকর্মী এবং পাড়াপড়শিদের । এর বাইরে পূজা আমাদের কাছে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য দিদি আর দাদারা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল আর বুয়েট থেকে বাসায় ফিরতো। পূজা বলতে ওদের ঘরে ফেরার আনন্দটুকুই। আর পূজাসংখ্যা আনন্দবাজার, শারদীয় দেশ। এই তো!

প্রতিমা ভাঙ্গার অভিযোগে কোন মানববন্ধনে কোনদিন দাঁড়ানোর তাড়না বোধ করিনি। তবে, সাতক্ষীরা, পাথরঘাটা, বেগমগঞ্জ, কর্ণেই-গড়েয়া, দিনাজপুর, নাটোরে মানুষের জীবনের উপরে যখন শুধু একটি ধর্মে বিশ্বাসী হবার কারণে অমানবিক নির্যাতন নেমে এসেছে গত বছরগুলোতে, তখন সেইসব জনপদে গেছি, দেখে এসেছি নিজের চোখে তাঁদের ভয়। লিখেছিও এক-আধটু, তবে রামুর ঘটনার পরে যেভাবে লিখেছি, অতোটা নয়। ভেবেছি, আমি কেনো লিখবো এবিষয়ে? আমার বন্ধু, সহযোদ্ধারা লিখবেন।

কটা সময়ে বিশ্বাস করতাম, যাঁদের সাথে চলি-ফিরি, যাঁদের সাথে দেশের মানুষের তাবৎ দুঃখে পীড়িত হয়ে রাস্তায় দাঁড়াই, তাঁরা নিশ্চয় সমব্যথী। আমার সেই ঘোর ভুল ভেঙ্গেছে নিজের পয়সায়, কখনো সাথে বন্ধু-সহকর্মী রোবায়েত ফেরদৌসের পয়সায় আর উদ্যোগে মঞ্চ বানিয়ে লোক ডেকে নেমন্তন্ন করে বক্তৃতা দিতে ডাকার পর। তাঁরা বেশ গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা করেছেন, ‘বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। জামাত-শিবির এদেশে ঘৃণ্য রাজনীতি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা জয়লাভ করবোই। ওরা গুটিকয়েক। এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষ’ ইত্যাদি। কানে ধরেছি, আমি আর কোন মঞ্চ বানিয়ে কাউকে বক্তৃতা করার সুযোগ করে দেয়া তো দূরে থাক, আমাকে ডাকলেও আমি এধরণের কোন বক্তৃতামঞ্চের আশেপাশে যাই না অনেকদিন হলো। আমি পরিষ্কারভাবে বুঝেছি, গুটিকয়েক ধর্মান্ধ মানুষের কাজ এগুলো নয়।

আমাদের সমাজে-রাজনীতিতে-কাছের মানুষদের মধ্যেও এসব ঘটানোর পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলেই বছরের পর বছর এগুলো হতে পারছে। আর কিছু না হোক, বছরের পর বছর সব দেখেশুনেও যে নির্লিপ্তি এবং হাসিঠাট্টা করে পার করে দিচ্ছেন আমাদের বিদ্বৎ সমাজ, এটি প্রশ্রয়ের চেয়ে কিছু কম নয়। যাঁদের দেখছি প্রতিবাদ করছেন দীর্ঘকাল ধরে, এসব ঘটনা ঘটার পরে, দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তৈরি এমনই এক বিখ্যাত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলাম একবার, ‘আপনারা এদেশে থাকতে, এমন অবস্থায় এলো কীভাবে দেশ? যে প্রতিবাদ বছরের পর বছর চলার পরেও কোন পরিবর্তন হয় না, সেই প্রতিবাদ নিয়ে আমি সন্দিহান।’ সেই প্ল্যাটফর্মের সব বক্তারা নিজেদের অক্ষমতার কথা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এই স্বীকারে কী হয়? তাঁদের সমর্থিত রাজনৈতিক শক্তি-ই তো ক্ষমতায়। তবু কেনো এই নিরন্তর বলপ্রয়োগ থামে না?

আমি সত্যি-ই বিশ্বাস করি না, কোনদেশে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে, অর্পিত সম্পত্তি আইন বহাল রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা মুখে বলা চলে। এদেশের হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত মানুষেরা বেঁচে আছেন এদেশের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বদান্যতায়। যতদিন পর্যন্ত তাঁরা পাশের বাড়ির হিন্দু ব্যক্তির জমি বা দোকানের দিকে নজর না দিচ্ছেন, মন্দিরটা ভাঙ্গতে না চাইছেন, ততোদিন ঠিক আছে। কিন্তু একবার নজর দিলে আর রক্ষা নাই। রাষ্ট্রের কোন সুরক্ষা নেই। একটা সময়ে হিন্দু ভোটের দরকার হতো। জনসংখ্যা যখন ২৯ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে পৌঁছাতে পেরেছে, তখন তাঁদের ভোট কিছু মূল্য আর বহন করে না। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু-বৌদ্ধ-সাঁওতাল-চাকমা-গারো-মারমারা কী ভাবছেন, কিছু আসে যায় না। আমি বরাবর বলে এসেছি, এখনো মনে করি, এই দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা এই দেশে অন্য ধর্মের, অন্য জাতিসত্তার মানুষদের দেখতে চান কি না, দেখতে চাইলে কীভাবে কতোটা দেখতে চান, তার উপরেই নির্ভর করছে এখনো যাঁরা আছেন, তাঁরা থাকবেন, না কি এই দেশটি এক ধর্মাবলম্বী মানুষের দেশ হবে। কয়েকদিন আগে মহালয়া গেলো। যতোজন পোস্ট দিয়েছেন, প্রায় সবাই লিখেছেন, এটা একটা শৈশবস্মৃতি মাত্র। এই প্রজন্মের পরে স্মৃতিটুকুও আর থাকবে না। তখন দুখজাগানিয়া পোস্টও আর কেউ দেবে না।

আমাদের এতো এতো বুদ্ধিজীবী, নোবেল পাওয়া শান্তিবাদী, পদকপ্রাপ্ত শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-মানবাধিকার কর্মী কেউ কিছু বললেন না। এই বিষয়ে লেখাও বাদ দিয়েছি কয়েক বছর হলো, এমনকি খবরগুলোর দিকে তাকাই না পর্যন্ত। কারণ সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হিসেবে জানি, স্ট্যান্ডিং ম্যাটার পড়ার জিনিস না। তবুও আজ বোনপ্রতিম বন্ধু অদিতি কবির খেয়ার ফেসবুক দেয়ালে কয়েকদিন আগে শেয়ার করা দেবাশীষ দাসের এক পোস্ট দেখে দু’মিনিট সময় দিলাম।

তিনি লিখেছেন:
“আসুন গেল দুই মাসের প্রতিমা ভাঙার লিস্ট দেখুন ; উৎসব এর পরেও কি মনে আসে?
১.শেরপুরে ৪০ বছরের পুরনো মন্দিরের আসন্ন দুর্গাপূজার ৩ টি প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (শেরপুর নিউজ২৪ / তারিখ ১৩ই অক্টোবর ১৫) ২.ডিমলায় মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর (দৈনিক যুগান্তর/ ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৫) ৩.মধুখালীতে মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর (দৈনিক যুগান্তর/ ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০১৫) ৪.সাভারে একটি মন্দিরের কয়েকটি মূর্তি ভাংচুর (শীর্ষ নিউজ ডট কম ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫) ৫.হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা রামকৃষ্ণ সেবা আশ্রমের দুর্গাপূজার দু’টি মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (একুশে টেলিভিশন ) ৬.নাটোরে মন্দিরের ৫টি মূর্তি ভাংচুর (মানব কণ্ঠ ১০ অক্টোবর ২০১৫) ৭.ফরিদপুরে প্রতিমা ভাংচুর (বিডি নিউজ ২৪/ ২২ সেপ্টেম্বর) ৮.সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় আসন্ন দুর্গা পূজার জন্য তৈরি ১৫টি প্রতিমা ৯.ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। (বিডি নিউজ ২৪/ ৭ অক্টোবর ২০১৫) ১০.বড়লেখায় দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (সিলেটটুডে ২৪/ ১৩ অক্টোবর ২০১৫) ১১.নাটোরের বড়াইগ্রামে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর (আমাদের সময়ডট কম / ১০/১০/২০১৫) ১২.পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার পশ্চিম অলিপুরা গ্রামের একটি মন্দিরে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (হিন্দু ওয়াপ ডট কম/১১/১০/২০১৫) ১৩.সিরাজগঞ্জে মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর (বিএম দ্য রিপোর্ট ডট কম ০১/১০/২০১৫) ১৪. হিন্দু মন্দিরে হামলা,বগুড়ার গাবতলীতে কালি মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর (০২/০৯/২০১৫) ১৫.ভালুকায় মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুর (ভালুকা নিউজ ২৪ডট কম ১৩/১০/২০১৫) ১৬. কালিয়াকৈরে প্রতিমা ভাংচুর (চ্যানেল সেভেন ডট কম ১৩/১০/১৫) ১৭.রায়গঞ্জে প্রতিমা ভাংচুর (অনাবিল ডট কম ১৩/১০/২০১৫) ১৮. মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের পাঁছ বারইল গ্রামে মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা -(বিডি লাভ ২৪ / অগাস্ট ২০১৫) ১৯. মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নে প্রতাবনগর গ্রামে সার্বজনীন শিব মন্দিরের দু’টি মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (বাংলাদেশ প্রতিদিন অগাস্ট ২০১৫) ২০. মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নে প্রতাবনগর গ্রামে সার্বজনীন শিব মন্দিরের দু’টি মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (খবর বিতান ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫) ২১. বাগেরহাটে সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা (বাংলা পোস্ট ২৪ ১৩ অক্টোবর ২০১৫) ২২. দাকোপে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (বিডি নিউজ ২৪) ২৩. বাগেরহাটের মোল্লাহাটে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। (এপ্রিল ২০১৫, বাগেরহাট ইনফো ) ২৪. দিনাজপুরে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর (২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ / উত্তর বাংলা ডট কম ) ২৫. হালুয়াঘাটে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫/ ময়মনসিংহ বার্তা ) ২৬. কাউনিয়ার অপরাজিতা কুঞ্জ মন্দিরের দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (বরিশাল ওয়াচ ডট কম / অক্টোবর ২০১৫) .”

আমরা জানি, এটি চলমান এক প্রক্রিয়া। এর পরেও আরো আরো কতো প্রতিমা, কতো মন্দির ভাংলো। এই লেখাটি যখন লিখছি তখনো চোখের সামনে সাতক্ষীরায় তিনটি মন্দির ভাঙ্গার খবর। পূজা আর প্রতিমা ভাঙ্গাকে সমার্থক জেনেই এদেশের হিন্দুরা পূজা করেন। এইসব মানুষদের কোন অনুভূতি থাকতে পারে, আমাদের রাষ্ট্র আর সমাজ সে’কথা মনে করে না। যাঁরা সহানুভূতিশীল বলে দাবি করেন, তাঁরা বড়জোর ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকের ফেসবুকেই দেখছি লিখছেন, ‘নিন্দা জানাই’। কার কাছে জানাচ্ছেন তাঁরা নিন্দা? তবুও এই নোটটি লিখতাম না, দিন তিন/চারেক আগে একটি চিঠি না পেলে।

আমার এক প্রাক্তন ছাত্রী লিখেছেন আমাকে ইনবক্সে, “ম্যাডাম, আমাদের বংশানুক্রমে চলে আসা পারিবারিক পূজা এবার আর করা হলো না। এতো বেশি চাঁদা চাইছে এলাকার লোকজন, নানাভাবে ডিস্টার্ব করছে। মহালয়ার দুই সপ্তাহ আগে আমাদের ভূঁই-এর সব কলাগাছ কেটে রেখে গেছে। আমার ভাইটা বড় হয়েছে, ওর প্রাণের ভয়ও আছে। নিজেরা ঘরেই ঘট পাতবো ঠিক করেছি। বড়মা বলেছেন, পূজা তো পুষ্পকর্ম। দেবীর শ্রদ্ধা তো কমে যাবে না। উৎসব না হয় না-ই হলো। বাবা তো আগেই গেছেন আপনি জানেন, বড় জ্যেঠুও দেহ রেখেছেন বছর তিনেক হলো। কাকারা মনখারাপ করলেও মেনে নিয়েছেন। ভাইটাকে নিয়ে বড় চিন্তা হয়। একটাই ভাই। কথায় কথায় থ্রেট দেয় ওকে। ভারতে চলে যেতে বলে।” চিঠিটা পড়ার পর খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। আমার এই স্তব্ধ হয়ে থাকাটাও এক বিরাট ন্যাকামি। যেনো এই প্রথম শুনলাম এমন ঘটনা! নিজের ন্যাকামিতে লজ্জা পেয়ে একটু পরেই কলিম শরাফীর গান শুনে লজ্জা কাটিয়েছি সেদিন।

পূজা আসলেই পুষ্পকর্ম। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো। শুধু ফুলটা মলিন হয়ে গেছে। এই মলিন ফুলে শুভেচ্ছা জানানো যায় কি না, সত্যিই আর ঠিক বুঝতে পারছি না।

[ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]
Share:

১৯ অক্টোবর ২০১৫

দেবী দুর্গার মুখ দেখেন না ‘মহিষাসুরের বংশধররা’

শারদ উৎসবে বিশ্বব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পূজিত হন দেবী দুর্গা। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর দেশ ভারতেই এমন কিছু মানুষ আছে, দেবী দুর্গার মুখ দেখা যাদের কাছে পাপ! তাই দুর্গা পূজার কয়েক দিন প্রাণপণে তাঁরা চেষ্টা করেন যাতে দেবীর মূর্তি দেখতে না হয়। কারণ তাঁরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মনে করেন।
ঝাড়খন্ড এবং উত্তরাখন্ডের সীমান্তের আলিপুরদুয়ারা জেলার মাঝেরডাবরি এলাকার একটি গ্রাম অসুরা কিংবা ‘অসুর গ্রাম’। ‘তফশিলী উপজাতি’র অন্তর্গত আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় আট হাজার মানুষের বাস এখানে। পরম্পরা অনুযায়ী নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর দাবি করেন তাঁরা। এই সম্প্রদায়ের পদবীও ‘অসুর’। বহুকাল ধরে বংশপরম্পরায় আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর।

এই বিশ্বাস ব্যাখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ মার্কন্ডেয় পুরাণের আখ্যান অনুসরণ করেন তাঁরা। এই জনগোষ্ঠী মনে করেন, দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধ আসলে দেবতাদের ষড়যন্ত্র। তাই অসুরদের বংশধররা দুর্গাপূজার চারদিন মহিষাসুরের জন্য আলাদা পূজার আয়োজন করে। মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী এই সম্প্রদায় দুর্গাপূজার কয়েকদিন শোক দিবস পালন করেন।

হিন্দু পুরাণের বর্ণনা অনুসারে মহিষাসুর নিজেও একজন রাজার ছেলে। অসুররাজ রম্ভার ছেলে। মহাদেব শিবের বরে রম্ভা এবং মহিষরূপী শাপগ্রস্ত রাজকুমারী শ্যামলার মিলনেই জন্ম হয়েছিল মহিষাসুরের। তাঁর জন্মের পর দেবতা-অসুরের যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে নিহত হন রম্ভা।



এর প্রতিশোধ নিতে ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা শুরু করেন মহিষাসুর। কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন ব্রহ্মা। বরটি ছিল, ত্রিভুবনের কোনো পুরুষই তাঁকে পরাস্ত করতে পারবে না। এই বর পেয়ে আরো পরাক্রমশালী ও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন মহিষাসুর। স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন দেবতাদের। বিতাড়িত দেবতারা শিব ও বিষ্ণুর কাছে তাঁদের দুঃখের বিবরণ দেন। এরপরের ইতিহাস অবশ্য বহুল চর্চিত। দেবালোকেই দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। এরপরের টানা নয়দিনের যুদ্ধে মাতৃরূপী দুর্গার হাতে পরাভব ঘটে অসুররূপী মহিষাসুরের।

অবশ্য এসব পুরাণ কথার বাইরে গিয়ে তফশিলী উপজাতিদের ভাষা ও নৃতাত্তিক বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হরিপ্রসাদ মান্ডা। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে তিনি জানান, এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদি বসবাস ছিল ছোটনাগপুরের এলাকার মালভূমিতে। ব্রিটিশরা এঁদের চা বাগানের কাজে লাগিয়েছিল। সেই থেকে এঁরা থেকে গেছেন উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকায়।

অধ্যাপক হরিপ্রসাদ জানালেন, এই জনগোষ্ঠীর পদবিতে অসুর শব্দ এসেছে বংশপরম্পরায় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। এর নেপথ্যে কোনো লিখিত প্রমাণ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। জনশ্রুতিতে আস্থা রেখেই বংশপরম্পরায় চলে আসছে ধ্যানধারণা।

হরিপ্রসাদ আরো জানান, হিন্দুদের চতুর্বেদের অন্যতম ঋগ্বেদ এবং সামবেদের যুগে ‘অসুর’ বলতে বোঝানো হত শক্তিশালী পুরুষকে। পরে কালক্রমে সেই শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে ‘দানব’ বা ‘বিনাশী’ অর্থ প্রকাশ করে।

তবে দুর্গাপূজার সময় দেবীর মুখ না দেখার এই ঐতিহ্য কতদিন টিকে থাকবে সে নিয়েও সংশয়ে ‘অসুর’ সম্প্রদায়ের প্রবীণরা। কারণ সম্প্রদায়ের নবীন প্রজন্ম মানতে চায় না পুরোনো গল্প। এমনকি অনেকে গা ভাসান চিরাচরিত শারদোৎসবে। আশঙ্কা আর পরম্পরা নিয়ে এভাবেই উজান স্রোতে সাঁতার দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’।
Share:

১৮ অক্টোবর ২০১৫

আরবের সিঙহবাহিনী দেবী আল-লাত

বাঙলার দূর্গা ত’ সিঙহবাহিনী দেবী। সিঙহের পিঠে তিনি উপবিষ্টা। একটি মজার বিষয় কি আমরা জানি?প্রাক-ইসলামী যুগের আরবের তিন প্রধানা দেবীর প্রথম নামটি যার সেই আল-লাতের বাহন ছিল সিঙহ? কয়েকদিন আগেই নেটে বিচরণ করতে গিয়ে এটা দেখেছি। ক’দিন চুপচাপ ছিলাম। আজ লিখছি। তাই বলে এটা দাবি করছি না যে আল-লাতই দূর্গা বা দূর্গা আল-লাত। তবে প্রাচীন বা মধ্যযুগে ইহুদি-খ্রিষ্টান-ইসলামী একেশ্বরবাদের আগে প্যাগান ধর্ম সারা বিশ্বে ছিল।
অঞ্চল ভেদে আলাদা আলাদা দেবতা যেমন ছিল তেম্নি গ্রিসের কেউ আফগান বা গান্ধার সীমান্তে এসে ভারতের বাসুদেবের পূজা করছেন না বা ভারতীয় দেব-দেবীরা জাপানে গিয়ে শিন্তো ধর্মে একটু ভিন্ন চেহারা বা ভিন্ন নাম পায় নি তা’ ত’ নয়। সম্প্রতি নেটে এমনি অজানা কিছু তথ্য দেখলাম। এই তথ্যগুলো পড়লে আমরা বিভিন্ন ধর্মের আন্ত:সঙযোগ সূত্র পাব।
এবার আসুন দেখি আল-লাত সম্পর্কে নেটে কি আছে ঝটপট পড়ে নিই:
ইলাত অথবা আল-লাত
মক্কার তিন প্রধান দেবীর সর্বাগ্রগণ্যা। মেসোপটেমীয় পুরাণের পাতালের দেবী এরেশকিগালের আর একটি নাম আল-লাত। কার্থেজে তাকে আল্লাতু নামে ডাকা হতো।
পেট্রা এবঙ হার্টার মানুষেরা এই দেবীকে গ্রিক আথেনা এবঙ টাইকি আর রোমান দেবী মিনার্ভার সাথে একাসনে বসিয়ে পূজা করতো। গ্রিসে বহু ভাষাভাষী শিলালিপিগুলোয় আল-লাতকে ‌মহান দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নাবাতিয়ানরা আল-লাতকে হুবাল বা চন্দ্রদেবতার মা হিসেবে মনে করত। সে হিসেবে তিনি আরবের তিন প্রধান দেবীর আর একজন মানাতের শাশুড়ি। ভারতীয় বা গ্রিক দেব-দেবীদের মত আরবের দেব-দেবীরা নানা সম্পর্কে সম্পর্কিত ছিলেন বলেই দেখা যাচ্ছে। যেহেতু শেষ পর্যন্ত মানবীয় পরম কল্পনা থেকেই তাদের সৃষ্টি।
গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস এই দেবীকে আফ্রোদিতির সমতূল্য জ্ঞান করে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম অব্দে লেখেন:
এ্যাসিরীয়রা আফ্রোদিতেকে মিলিত্তা বলে, আরবরা বলেন আলিলাত এবঙ পার্সীরা মিথরা। ভারতীয় দেবতা মিত্রের সাথে এই দেবতার সঙযোগ আছে।

হেরোডোটাসের এই স্তবক একারণে গুরুত্বপূর্ণ যে আরব ব্যকরণের গুরুত্বপূর্ণ সর্বনাম আল (ইঙরেজি দ্য বা ফরাসী লো/লা বোঝাতে)এই দেবীর নামের সাথে যুক্ত। আবার প্রোটো-ইন্দো-ইরানীয় দেবতা মিত্রের সাথে এই দেবী সঙযুক্ত। হেরোডোটাসের মতে, প্রাচীন যুগের আরবরা মাত্র দু’জন দেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন:
আরবরা দায়োনিসাস এবঙ স্বর্গীয়া আফ্রোদিতি ছাড়া কাউকে দেবতা মানে না; এবঙ তারা বলে তারা দায়োনিসাসের কায়দায় চুল কাটে, মাথার চারপাশে চুল গোল করে কাটে। তারা আফ্রোদিতেকে আলিলাত বলে।
কোরানের সুরা ৫৩:১৯-২৩-এ আল-উজ্জা এবঙ মানাতের সাথে এই দেবীর নাম করা হয়েছে। ইসলামের শুরুর দিকের বই-পত্রে যেগুলোয় প্রাক-ইসলামী যুগের বিবরণ রয়েছে তেমন একটি বই কিতাব আল-আসনাম (রচয়িতা হিশাম ইবন আল-কলবি)-এ বলা হয়েছে যে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবরা বিশ্বাস করতো যে আল-লাত কাবায়বাস করেন এবঙ মন্দিরের ভেতরে তার একটি বিগ্রহ ছিল। উল্লেখ্য, আরবি কাবা শব্দের মূল অর্থ অতীতে ছিল মন্দির।
আল-লাতের সুরক্ষা ছিল থাকিফ গোত্রের বানু আত্তব ইবন মালিকের হাতে যিনি এই দেবীর উদ্দেশ্যে একটি সেৌধ গড়ে তোলেন। কুরাইশ গোত্র সহ সব আরবেরাই আল-লাতকে সম্মান করতেন এবঙ সন্তানদের জাইদ আল-লাত বা তায়িম আল-লাত বলে ডাকতেন। মুসলিম সৈন্যদের বিজয়ের পর প্রফেটের নির্দেশে যোদ্ধা আল-মুঘিরা ইবন-সুবাহ দেবী আল-লাতের মন্দির পুড়িয়ে এবঙ মাটিতে মিশিয়ে দেন। এই দেবীর বিশেষ পূজারী থাকিফ তখন ধর্মান্তরিত হন।
সিরিয়ার পালমিরায় সিঙহবাহিনী আল-লাতের বাহন সিঙহের মূর্তি
খ্রিষ্টিয় প্রথম শতাব্দীতে নির্মিত এই মূর্তি উচ্চতায় ৩.৫ মিটার এবঙ ১৫টন ভারি। দেবী আল-লাত রক্তপাত ঘটানো সমর্থন করতেন না। সিঙহটির বাম পায়ে খোদিত রয়েছে পালমিরেন অক্ষর: তবরক লত (আল-লাত তাকে আশীর্ব্বাদ করেন) মন দভ লিসদ (যে রক্তপাত ঘটায় না) দম ল হযব (এই অভয়াশ্রমে)।
সিঙহের এই মূর্তিটি ড. মিশেল গউলিকোয়োস্কির তত্ত্বাবধানে একদল পোলিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ১৯৭৭ সালে আবিষ্কার করেন। ২০১৫-এর ২৭ শে জুন আইসিস এই মূর্তিটি ধ্বঙস করে।

Written by: AUDITY FALGUNI GAYEN·
SUNDAY, OCTOBER 18, 2015
Share:

মূর্তি ভাঙা উৎসব!

এই সপ্তাহ থেকেই শুরু হবে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।

প্রায় দশ বছর দেশের বাহিরে থাকি। বিগত দশ বছরে বিভিন্ন সময়ে দেশে যাওয়া হলেও নানা কারণে শারদীয় এই উৎসবে কখনই দেশে যাওয়া হয়নি। দেশের পূজোর খবরা খবর রাখতে তাই দ্বারস্থ হতে হয় অনলাইন পত্রিকাগুলোর। আর সেটাই দাঁড়ালো কাল হয়ে।

গুগলে বাংলায় বাংলাদেশে দুর্গা পূজা অথবা প্রতিমা ইত্যাদি দিয়ে সার্চ দিলেই বেরিয়ে আসে সব অপ্রত্যাশিত সংবাদ। পূজার আনন্দের চেয়ে মূর্তি ও প্রতিমা ভাঙ্গার সংবাদে সয়লাব গুগল সার্চ ইঞ্জিন। কৌতূহলবশতঃ বিগত দুই আড়াই মাসের মন্দির ভাঙ্গা, প্রতিমা ভাংচুর সহ নানা ভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদগুলো একত্রে জড়ো করতে গিয়ে দেখি এই সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। এ যেন রীতিমত এক প্রতিযোগিতা। সাথে আরও একটি জিনিস উপলব্ধি করলাম যে বড় বড় নামীদামী সংবাদপত্রগুলো খুব সযত্নে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। হয়ত তাদের মনে মূর্তি ভাঙ্গা একটি মামুলি বিষয়। এ যেনো অনেকটা মশা মেরে হাত লাল না করার মতো ব্যাপার।

তবে অনলাইনের কিছু স্থানীয় পত্রিকা ও গুটি কয়েক জাতীয় পত্রিকার বরাত দিয়ে একটি সংকলন তৈরি করলাম যা নিম্নে দেওয়া হলো :

১. শেরপুরে ৪০ বছরের পুরনো মন্দিরের আসন্ন দুর্গাপূজার ৩ টি প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (শেরপুর নিউজ২৪ / তারিখ ১৩ই অক্টোবর ১৫)

২. ডিমলায় মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর (দৈনিক যুগান্তর/ ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৫)

৩. মধুখালীতে মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর (দৈনিক যুগান্তর/ ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০১৫)

৪. সাভারে একটি মন্দিরের কয়েকটি মূর্তি ভাংচুর (শীর্ষ নিউজ ডট কম ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫)

৫. হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা রামকৃষ্ণ সেবা আশ্রমের দুর্গাপূজার দু’টি মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (একুশে টেলিভিশন )

৬ .নাটোরে মন্দিরের ৫টি মূর্তি ভাংচুর (মানব কণ্ঠ ১০ অক্টোবর ২০১৫)

৭. ফরিদপুরে প্রতিমা ভাংচুর (বিডি নিউজ ২৪/ ২২ সেপ্টেম্বর)
৮. সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় আসন্ন দুর্গা পূজার জন্য তৈরি ১৫টি প্রতিমা ৯.ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। (বিডি নিউজ ২৪/ ৭ অক্টোবর ২০১৫)

১০.বড়লেখায় দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (সিলেটটুডে ২৪/ ১৩ অক্টোবর ২০১৫)

১১. নাটোরের বড়াইগ্রামে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (আমাদের সময়ডট কম / ১০/১০/২০১৫)

১২.পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার পশ্চিম অলিপুরা গ্রামের একটি মন্দিরে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (হিন্দু ওয়াপ ডট কম/১১/১০/২০১৫)

১৩. সিরাজগঞ্জে মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর (বিএম দ্য রিপোর্ট ডট কম ০১/১০/২০১৫)

১৪. হিন্দু মন্দিরে হামলা,বগুড়ার গাবতলিতে কালি মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর (০২/০৯/২০১৫)

১৫.ভালুকায় মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুর (ভালুকা নিউজ ২৪ডট কম ১৩/১০/২০১৫)

১৬. কালিয়াকৈরে প্রতিমা ভাংচুর (চ্যানেল সেভেন ডট কম ১৩/১০/১৫)

১৭.রায়গঞ্জে প্রতিমা ভাংচুর (অনাবিল ডট কম ১৩/১০/২০১৫)

১৮. মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের পাঁছ বারইল গ্রামে মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা -(বিডি লাভ ২৪ / অগাস্ট ২০১৫)

১৯. মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নে প্রতাবনগর গ্রামে সার্বজনীন শিব মন্দিরের দু’টি মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (বাংলাদেশ প্রতিদিন অগাস্ট ২০১৫)

২০. মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নে প্রতাবনগর গ্রামে সার্বজনীন শিব মন্দিরের দু’টি মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (খবর বিতান ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫)

২১. বাগেরহাটে সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা (বাংলা পোস্ট ২৪ ১৩ অক্টোবর ২০১৫)

২২. দাকোপে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (বিডি নিউজ ২৪)

২৩. বাগেরহাটের মোল্লাহাটে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। (এপ্রিল ২০১৫, বাগেরহাট ইনফো )

২৪. দিনাজপুরে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ / উত্তর বাংলা ডট কম )

২৫. হালুয়াঘাটে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫/ ময়মনসিংহ বার্তা )

২৬. কাউনিয়ার অপরাজিতা কুঞ্জ মন্দিরের দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর (বরিশাল ওয়াচ ডট কম / অক্টোবর ২০১৫) .

২৭. সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী বারোয়ারী মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। (দৈনিক আমার দেশ /১৪ অক্টোবর ২০১৫)

২৮. ময়মনসিংহের তারাকান্দায় ৫টি প্রতিমা ভাংচুর।(১৭ই অক্টোবর ২০১৫, ঢাকা নিউজ ২৪) (বাকি রয়েগেছে আরও অনেক )

যুদ্ধাপরাধীরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করেছিল, তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল এবং জোর করে কোথাও কোথাও ধর্মান্তরিত করেছিল। এসব আমাদের ইতিহাস। আমরা সব সময় এই গ্লানিকর ইতিহাসকে ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের উত্তরসূরিরা পূর্বসূরিদের কৃতকর্মের ইতিহাস ভুলে যেতে দেয় না।

হিন্দুদের ওপর অত্যাচারে বেশ সুবিধা তাদের। একে তো হিন্দুরা খুবই দুর্বল- সংখ্যা এবং সাহসের দিক থেকে, অন্যদিকে হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে দেশত্যাগ করাতে পারলে তাদের ফেলে রাখা সম্পদের অধিকারী হওয়ার হাতছানি থাকে।

২০০১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে এদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১৬.৮৩ মিলিয়ন। ২০১১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল ১৮.২ মিলিয়ন। কিন্তু ২০১১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় এই সংখ্যা ১২.৩ মিলিয়নে এসে দাঁড়ালো।

১৯৪৭, ১৯৫০, ১৯৬৪, ১৯৯০, ১৯৯২ ও ২০০১, সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় ঘটেছে। বাংলাদেশে ১৯৪৭ সালের পর থেকে আজ রাত অবধি অন্যধর্মের ওপর চলমান নির্যাতন ও নিপীড়নে আজ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-অন্যান্য বিশ্বাসের মানুষের সংখ্যা প্রায় দশ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনা হয়েছে। এটি বর্বর ক্রম: গণহত্যা বা এথনিক ক্লিনজিং যা স্পষ্টভাবেই মানবতা বিরোধী অপরাধ।

তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো গত দুইমাসে সারা বাংলাদেশ জুড়ে ঘটে যাওয়া এই সব সাম্প্রদায়িক ঘটনায় গ্রেফতার হয়নি একজনও। আর গ্রেফতার হলেও সেটা খুবই নগণ্য। এই বিচারহীনতা আর উস্কে দিচ্ছে এসব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠীকে। মুখে মুখে শুধু ধর্মীয় সহাবস্থান আর সম্প্রীতির ভুয়া বুলি তুললেও কোনো রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা নেই এই সমস্যা সমাধানের। হয়নি কোনো সুস্পষ্ট আইন। হয়নি কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত।

গত বছর তিনেক ধরে ধর্মানুভুতি শব্দটি সরকার এবং বিরোধী দলের সবচেয়ে মুখরোচক শব্দ হলেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভুতি নিয়ে কারো কোনো অনুভূতি নেই। কারণ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জানে যে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক শুধুই একটি বিশেষে দলের জন্য, সুতরাং এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যথার কারণ নেই। অন্যদিকে প্রগতিশীল স্যেকুলার ধ্বজাধারীরা ভাবছে আমাদের ভোট না দিয়ে এরা যাবে কোথায়।

যারা হিন্দুদের আক্রমণ করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বাড়িঘর, তাদের তো চিনতে কষ্ট হওয়ার কারণ নেই। তারা তো এ দেশেরই মানুষ। তাদের চিহ্নিত করে অপরাধের শাস্তি দেয়া কি একেবারেই অসম্ভব?

তবে কি কবির কথা মিথ্যা- মানুষ কি মানুষের জন্য নয়? রাষ্ট্র কি মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারছে না? গুটিকতক নরপশু আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক অস্তিত্বকে নষ্ট করে দেবে, আর আমাদের সরকার ও রাষ্ট্র শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে- এটাই কি আমাদের নিয়তি? মানুষ হয়ে আমরা মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারব না- এমন সমাজই কি আমাদের নিয়তি? এমন নিয়তিকে আমরা মেনে নিতে পারছি না।

আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ব্যাপারে ইন্ধন দান এবং হামলার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে যদি বিএনপি-জামাতকে দায়ী করা যায়, তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতা, ক্ষমতায় থেকেও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করা এবং উপরন্তু এই বিষয়টাকে ব্যবহার করে নোংরা রাজনীতির জন্য আওয়ামীলীগও কি দায় এড়াতে পারে?

অসীম চক্রবর্তী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক
http://www.sylhettoday24.com/opinion/details/8/250
Share:

সিন্ধু সভ্যতা


মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বৎসর বা তার আগে থেকে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকেই সিন্ধু সভ্যতা নামে অভিহিত করা হয়। আয়তনের বিচারে এই সভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে অনেক বড়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই সভ্যতার আয়তন সব মিলিয়ে প্রায় ১২,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। সম্প্রতি বাংলাদেশের উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে বিকশিত সভ্যতাকে এরই বর্ধিত অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তা যদি হয়, তবে এর আয়তন দাঁড়ায় পুরো ভারতবর্ষব্যাপী। ধারণা করা হয় এই সভ্যতা গড়ে তুলেছিল- ভারতে আগত দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মানুষ।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পাক-ভারত বিভাজনের সূত্রে, প্রাচীন ভারতবর্ষের সিন্ধু সভ্যতার বেশিরভাগ অংশই পড়েছে পাকিস্তানে। ভারতের পশ্চিমাংশে কিছু অঞ্চলে এর নমুনা পাওয়া গেছে। অবিভক্ত ভারতে এই সভ্যতার সন্ধনে যে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, সে কার্যক্রমের ধারাটি ১৯৪৭-উত্তর ভারত ও পাকিস্তানে অব্যাহত রয়েছে এবং সে সূত্রে আরও অনেক অঞ্চলে এই সভ্যতার নমুনা পাওয়া গেছে।

এই সভ্যতার অনুসন্ধানের সূত্রপাত ঘটেছিল খ্রিষ্ট্রীয় ১৮শ শতকের প্রথম দিকে। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে চার্লস ম্যাসন (জেমস লুইস) নামক 'ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি'র জনৈক সৈন্য, পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। এই যাত্রাকালে পাঞ্জাবের পশ্চিমে মন্টোগোমারি জেলার ইরাবতী (রাভি) নদীর পূর্ব তীরে হরপ্পায় একটি স্তূপ লক্ষ্য করেন। চার্লস ম্যাসন তাঁর ন্যারেটিভস অফ ভেরিয়াস জার্নিস ইন বালোচিস্তান, আফগানিস্তান অ্যান্ড দ্য পাঞ্জাব গ্রন্থে এই স্তূপকে  প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে সম্ভাবনাময় একটি অংশ হিসাবে ধারণা দিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলের স্তূপ নিয়ে কেউ আগ্রহ দেখান নি। 

১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জন ও উইলিয়াম ব্রান্টন (দু্‌ই ভাই) করাচি ও লাহোরের মধ্যে ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি লাইন স্থাপনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সূত্রে  তিনি রেললাইন স্থাপনের জন্য উপযুক্ত ব্যালাস্ট তৈরির উপকরণের সন্ধান করতে থাকেন।  স্থানীয় লোকদের মারফতে জানতে পারেন, স্থানীয় লোকেরা এই অঞ্চলের স্তূপ থেকে পোড়া ইট তুলে ঘর বাড়ি তৈরি করে থাকে। ইঞ্জিনিয়াররা রেললাইন স্থাপনের জন্য যে স্থান নির্ধারণ করেছিলেন, তার পাশেই একটি প্রাচীন নগরীর কথা জানতে পারেন। স্থানীয় লোকদের ভাষায় এই নগরীর নাম ছিল ব্রাহ্মণাবাদ। উল্লেখ্য এটি ছিল হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ। এর কিছুদিন পর,  উইলিয়াম ব্রান্টন এই স্থানের উত্তরে দ্বিতীয় স্তূপে একই ধরনের ইটের সন্ধান পান। সম্ভবত এই স্থানটি ছিল ময়েঞ্জোদারো। কথিত আছে এই ইট দিয়ে রেলপথের জন্য ব্যালাস্ট তৈরি করা হয়েছিল এবং লাহোর থেকে করাচি পর্যন্ত ৯৩ মাইল (১৫০ কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের রেলপথ স্থাপিতও হয়েছিল এই ব্যালাস্ট দিয়ে।
 
হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম নগর ধোলাভিরা-র ধ্বংসাবশেষ
এই সময়ে তৎকালনী ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৫৩ এবং ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকবার এই অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। ১৮৭২-৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কানিংহাম প্রথম হরপ্পা সিলমোহর প্রকাশ করেন। এই সিলমোহরে অঙ্কিত লিপি দেখে তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্মীলিপি। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে জে. ফ্লিট নামক অপর একজন গবেষক আরও কতকগুলি হরপ্পা সিলমোহর আবিষ্কার করেন। এতসব সব নমুনা পাওয়ার সূত্রে, তদানীন্তন ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধিকর্তা ডিরেক্টর জেনারেল জন মার্শাল এই অঞ্চলে খনন কাজে উৎসাহ বোধ করেন। অবশেষে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ মার্শালের তত্ত্বাবধানে ময়েঞ্জোদারো ও হরপ্পায় খনন কাজ শুরু হয়। এই অভিযানের সূত্রে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রত্নতত্ত্ববিদ্ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে ময়েঞ্জোদাড়ো স্তূপকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল হিসাবে সুনিশ্চিতভাবে ঘোষণা দেন। তিনি অবশ্য এই স্থানকে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বসস্তূপ ভেবেছিলেন। একই বৎসরে রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহানী হরপ্পাতে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ বলে অনুমান করেন। 

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই মহেঞ্জোদাড়োর অধিকাংশ প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল। এরপর ১৯৪৪ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের তদানীন্তন ডিরেক্টর স্যার মর্টিমার হুইলারের নেতৃত্বে অপর একটি দল এই অঞ্চলে খননকার্য চালায়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে

মেহেরগড়ের 
সভ্যতার 
 
আহমদ হাসান দানি, ব্রিজবাসী লাল, ননীগোপাল মজুমদার, স্যার মার্ক অরেল স্টেইন প্রমুখ এই অঞ্চলে খননকার্যে অংশ নিয়েছিলেন। ভারত বিভাগের পর সিন্ধু সভ্যতার অধিকাংশ প্রত্নস্থল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকারের পুরাতাত্ত্বিক উপদেষ্টা স্যার মর্টিমার হুইলার এই সব অঞ্চলে খননকার্য চালায়। পরবর্তী সময়ে সিন্ধু সভ্যতার সীমান্তবর্তী প্রত্নস্থলগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে পশ্চিমে বেলুচিস্তানের সুকতাগান ডোর এবং উত্তরে আফগানিস্তানের আমুদারিয়া বা অক্সাস নদীর তীরে শোর্তুগাই অঞ্চলে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক মিশন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বোলান নদীর তীরে মেহেরগড় নামক স্থানে আরও একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সন্ধান পান।  ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে Scientific American পত্রিকায় জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডৌ তাঁদের গবেষণাপত্রে জানান যে, খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে মেহেরগড়ের সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল এবং এই সভ্যতা সাতটি স্তরে বিকশিত হয়েছিল।

বিভিন্ন গবেষণাপত্রের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, এই অঞ্চলের সভ্যতার কালানুক্রমিক ক্রমবিকাশের ধারাটি নিচে উল্লেখ করা হলো। 
  • মেহেরগড় (প্রথম ধাপ) : খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ, প্রস্তরযুগ।
  • মেহেরগড় (দ্বিতীয় ধাপ) : খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩০০০ অব্দ, প্রস্তরযুগ।
  • মেহের গড়ের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ধাপ  এবং হরপ্পার সভ্যতার পত্তন : ৩০০০-২৯০০ অব্দ, প্রস্তর যুগ
  • মেহের গড়ের ষষ্ঠ, সপ্তম ধাপ  এবং হরপ্পার প্রথম ধাপ : খ্রিষ্টপূর্ব  ৯০০-২৮০০ অব্দ
  • মেহের গড়ের চতুর্থ, পঞ্চম ষষ্ঠ ধাপ  এবং হরপ্পার তৃতীয় ধাপ : খ্রিষ্টপূর্ব  ২৮০০-২৬০০ অব্দ।
  • হরপ্পার পরবর্তী বিকাশ : খ্রিষ্টপূর্ব  সর্বশেষ ধাপ ২৬০০-৩০০ অব্দ।
হরপ্পা সভ্যতার শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব  ৩০০০ অব্দের দিকে। একে বলা হয়, আদি হরপ্পা সভ্যতা। এই সময়ে মানুষ ইরাবতী নদীর তীরে বসবাস শুরু করেছিল। সম্ভবত মেহেরগড় থেকে আগত মানুষ এই অঞ্চলে নতুন নগর স্থাপন করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৯০০ অব্দের মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার সাথে আদি হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার বিশেষ মিল পাওয়া যায়। এই সভ্যতা পশ্চিমে হাকরা-ঘগ্গর নদী উপত্যকার সাথে এই সভ্যতার সাথে সম্পর্ক ছিল। মহেঞ্জোদাড়োর নিকটবর্তী অপর একটি স্থানের নাম কোট দিজি। এই অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০-২৬০০ একটি সভ্যতার নমুনা পাওয়া গেছে। একে হরপ্পার কোট দিজি পর্ব বা হরপ্পারর দ্বিতীয়ধাপ হিসাবেও বিবেচনা করা হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব 
২৬০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের ভিতরে হরপ্পার আশেপাশের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন নগর গড়ে উঠেছিল। ধারণা করা হয়, এই জাতীয় ছোটো বড়ো নগরীর সংখ্যা ছিল প্রায় সহস্রাধিক। এদের ভিতের উল্লেখযোগ্য নগরীগুলো সে সকল স্থানে পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো
 পাকিস্তানের হরপ্পা, গনেরিওয়ালা, মহেঞ্জোদাড়ো এবং ভারতের ধোলাবীরা, কালিবঙ্গান, রাখিগড়ি, রুপার, লোথাল ইত্যাদি।
Share:

হরপ্পা সভ্যতা



মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বৎসর বা তার আগে থেকে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকেই  সিন্ধু সভ্যতা নামে অভিহিত করা হয়। হরপ্পা সভ্যতা এই সিন্ধু সভ্যতার অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

হরপ্পা হলো
  বর্তমান পাকিস্তানের সাহিবাল (জেলা শহর) থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নদীর পুরনো খাদের কাছে অবস্থিত একটি স্থান। ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে একটি রেলস্টেশন ছিল। বর্তমানে এটি একটি ছোট পাকিস্তানি শহর।

এই সভ্যতার অনুসন্ধানের সূত্রপাত ঘটেছিল খ্রিষ্ট্রীয় ১৮শ শতকের প্রথম দিকে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে ধারবাহিক অনুসন্ধানের ফলে এই সভ্যতা সম্পর্কে বিস্ময়কর দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে। 

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ মার্শালের তত্ত্বাবধানে ময়েঞ্জোদারো ও হরপ্পায় খনন কাজ শুরু হয়। এই অভিযানের সূত্রে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রত্নতত্ত্ববিদ্ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে ময়েঞ্জোদাড়ো স্তূপকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল হিসাবে সুনিশ্চিতভাবে ঘোষণা দেন। তিনি অবশ্য এই স্থানকে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বসস্তূপ ভেবেছিলেন। একই বৎসরে রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহানী হরপ্পাতে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ বলে অনুমান করেন।  
 
ধারণা করা হয় মেহেরগড় অঞ্চলে ভারতবর্ষের আদি সভ্যতার সূত্রপাত ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ। সভ্যতার ইতিহাসে একে সাধারণভাবে প্রস্তরযুগ নামে অভিহিত করা হয়। সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে মেহেরগড় থেকে কিছু মানুষ নতুন বসতি গড়ে তুলেছিল হরপ্পা অঞ্চলে। এই সময়ে মানুষ ইরাবতী নদীর তীরে বসবাস শুরু করেছিল। সম্ভবত মেহেরগড় থেকে আগত মানুষ এই অঞ্চলে নতুন নগর স্থাপন করেছিল। কারণ, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৯০০ অব্দের মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার সাথে আদি হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার বিশেষ মিল পাওয়া যায়। পশ্চিমে হাকরা-ঘগ্গর নদী উপত্যকার সাথে এই সভ্যতার সাথে সম্পর্ক ছিল। ময়েঞ্জোদাড়োর নিকটবর্তী অপর একটি স্থানের নাম কোট দিজি। এই অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০-২৬০০ একটি সভ্যতার নমুনা পাওয়া গেছে। একে হরপ্পার কোট দিজি পর্ব বা হরপ্পারর দ্বিতীয়ধাপ হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ পর্যন্ত এই সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছিল হরপ্পা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে।
 
খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের ভিতরে হরপ্পার আশেপাশের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন নগর গড়ে উঠেছিল। ধারণ করা হয়, এই জাতীয় ছোটো বড়ো নগরীর সংখ্যা ছিল প্রায় সহস্রাধিক। এদের ভিতের উল্লেখযোগ্য নগরীগুলো সে সকল স্থানে পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো- পাকিস্তানের হরপ্পা, গনেরিওয়ালা, মহেঞ্জোদাড়ো এবং ভারতের ধোলাবীরা, কালিবঙ্গান, রাখিগড়ি, রুপার, লোথাল ইত্যাদি। 
 
হরপ্পা নগরীর আয়তন ছিল প্রায় আড়াই বর্গমাইল। অন্যান্য নগরগুলোর আয়তনও কম বেশি একই রকম। হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে যে শহরগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে, তা দেখে মনে হয়, হরপ্পাবাসীর একটি উন্নত নগর ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। রাস্তাঘাট পয়ঃপ্রণালী এবং গৃহায়ন ইত্যাদি দেখে মনে হয়- কোনো দক্ষ পৌর-প্রশাসনের অধীনে এই কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। মূল নগরীকে ঘিরে ছিল কৃষিখামার, গোচারণভূমি। 
 
হরপ্পা নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
রাস্তাঘাট :
নগরের ভিতরের প্রধান সড়কগুলো ছিল ৩৫ ফুট চওড়া, আর অপ্রধান সড়কগুলো ছিল ১০ ফুট চওড়া। এছাড়া ৫ ফুট চওড়া গলিগুলো ছিল একেবারে ঘরের সামনে দিয়ে। রাস্তাগুলো ছিল সোজা এবং উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম বরাবর। ফলে নগরের সার্বিক চেহারা দাঁড়িয়েছিল সরল সড়ক দ্বারা বেষ্টিত ছোটো ছোটো চৌকো ব্লকের সমন্বিত রূপে।

প্রতিরক্ষা:
হরপ্পাবাসীরা পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণের ভয় করতো। তাই তারা পশ্চিম দিকটা সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল ব্যাপকভাবে। পশ্চিম দিকে তারা গড়ে তুলেছিল নগরপ্রাচীর। আর প্রাচীরের পরে সৃষ্টি করেছিল গভীর পরিখা। এরপর তৈরি করেছিল সুরক্ষিত দূর্গ। দুর্গের দৈর্ঘ্য ছিল ১,২০০ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৬০০ ফুট। মূল দুর্গকে ঘিরে তৈরি করেছিল আরও একটি ৪০ ফুট উঁচু প্রতিরক্ষা দেয়াল ছিল। এ দেয়ালের উপকরণ ছিল কাদামাটি এবং কাঁচা ইট। দুর্গের বাইরের অংশে পোড়ানো ইটের দেয়ালটি ৪ ফুট পুরু আরেকটি অতিরিক্ত দেয়াল ছিল। দূর্গ প্রাচীর নির্মাণের ইটের আয়তন ছিল ১০x২০x৪০ ঘনসেন্টিমিটার।এছাড়া দুর্গের ভিতরে ছিল সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র।

হরপ্পার ঘরবাড়ি:হরপ্পাবাসীরা কৃষিক্ষেত্রে কেন্দ্রে নগরী গড়ে তুলেছিল। সেখানে অধিকাংশ ছিল সাধারণ মানুষ। ঘরবাড়ির নমুনা দেখে হরপ্পাবাসীর সামাজিক অবস্থান প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করেছেন, যে- হরপ্পায় তিন ধরনের মানুষ তিন ধরনের বাড়িতে বসবাস করতো।
 
 ১. সাধারণ বাড়ি : সমাজের সাধারণ মানুষ (সাধারণ শ্রমজীবী, সাধারণ কৃষক ইত্যাদি) এই জাতীয় বাড়িতে বসবাস করতো। এই বাড়ি গুলো নিতান্তই ছোট ছোট ছিল। এগুলো ছিল মূলত এক বা দুই কক্ষের বাড়ি।
২. অপেক্ষাকৃত বড় বাড়ি : সুপরিসর এই বাড়িগুলোতে থাকতো ধনী বণিক, সরকারি কর্মকর্তারা এবং অভিজাতশ্রেণির কিছু মানুষ।
৩. বড় সরকারি বাড়ি : সম্ভবত উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়ি, প্রশাসনিক কার্যালয়।

বড় বড় বাড়িগুলোর সামনে পিছনে আঙিনা ছিল। বাড়িতে কক্ষ সংখ্যা ছিল দুইয়ের অধিক। কোনো কোনো বাড়ি ছিল ১২ কক্ষ বিশিষ্ট। এ সব বাড়ির রাস্তার দিকে দরজা এবং জানালা ছিল না। দেয়াল থাকার কারণে রাস্তার থেকে বাড়ির ভিতের অংশ দেখা যেত না। অভিজাত বাড়িগুলো বাড়ি হতো দোতলা বা তিনতলা! 

নগরীর অধিকাংশ ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছিল কাদা মাটি বা অপোড়া ইট দিয়ে। বাড়ির দেয়ালে ব্যবহার করা হতো মাটির সাথে নলখাগড়া বা কাঠের টুকরো। ইটের দেওয়ালে ব্যবহৃত ইটগুলোর মাপ ছিল  জাতীয় ৭.৫x১৫x৩০ ঘন সেন্টিমিটার। দরজা জানালায় ব্যবহৃত হতো কাঠ বা শন জাতীয় উপকরণ দ্বারা তৈরিকৃত মাদুর। শক্ত মাটির ভিতের উপরে ঘন কাদার আস্তরণ দিয়ে মেঝে তৈরি করা হতো।  হরপ্পার ধ্বাংসাবশেষে কোনো বাড়ির ছাদ পাওয়া যায় নাই। তাই ধারণা করা হয়, বাড়ির ছাদ নির্মাণ করা হতো কাদা ও নলখাগড়ার মিশ্রণে পুরু করে আস্তরণ তৈরি করা হতো এবং এই আস্তরণের ভার রক্ষা করতো বড় বড় কাঠের আড়া।

হরপ্পার গণমানুষের ব্যবহারের জন্য তৈরি কূপ
প্রতি বাড়িতেই স্নানের ঘর ছিল। এছাড়া জনসাধারণের গণ-ব্যবহারের জন্য ছিল বড় বড় স্নানাগার। বাড়ি থেকে ব্যবহৃত পানি ও আবর্জনা নির্গমণের জন্য ছিল নর্দমা। নর্দমা যাতে টেকসই হয়, সে জন্য ব্যবহার করা হতো পাকা ইট বা পাথর। এই নর্দমা যুক্ত থাকতো নগরের প্রধান প্রধান নর্দমার সাথে। এই শহরের প্রধান প্রধান রাস্তার দুই পাশে দিয়ে প্রধান নর্দমাগুলো তৈরি করা হয়েছিল এবং সেগুলো যাতে শহরের জনস্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে, তার জন্য নর্দমাগুলো ঢাকার ব্যবস্থা ছিল। অধিকাংশ বাড়ির রান্নার ব্যবস্থা ছিল ঘরের ভিতরে । তাছাড়া প্রতিটি বাড়িতেই ছিল স্নানাগার। দোতালা বা তিনতলা বাড়ির দোতলায় ছিল স্নানাগার! অনেক বাড়ির ভিতরে প্রতিটি স্বতন্ত্র কূপ থেকে পানি তোলার ব্যবস্থা ছিল। আবার জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী সার্বজনীন কূপও ছিল।

হরপ্পাবাসীর জীবিকা :
হরপ্পা নগরীর চারপাশে ছিল কৃষিজমি। এই জমিতে উৎপন্ন হতো প্রধানত যব ও গম। ইরাবতীর নদীর তীরবর্তী হওয়ায়, তাদের ফসল ফলানো অনেকটা সহজ ছিল। এছাড়াও ছিল বনভূমি এবং চারণভূমি। ফলে হরপ্পাবাসীর অন্যতম পেশা ছিল কৃষিকাজ। সম্ভবত কৃষকরাই দুধ, মাংসের যোগান দিত। নৌপথে বাণিজ্য হতো অন্যান্য নগরীর সাথে। সেই সূত্রে বণিকশ্রেণিও ছিল। হরপ্পাবাসীরা বিপুল পরিমাণ শস্য উৎপন্ন করতো। এবং উদ্বৃত্ত শস্য সংরক্ষণের জন্য বিশাল একটি শস্যাগার তৈরি করেছিল। হরপ্পায় দুর্গের উত্তরে এই রকম একটি একটি শস্যাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার আয়তন ১৬৯ ফুটx১৩৫ বর্গফুট। এর কাছে ছিল পাথরের তৈরি একটি উচুঁ মঞ্চ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, ওই মঞ্চেই সম্ভবত শস্য মাড়াই করা হত। শস্যাগার সংলগ্ন কক্ষগুলি ছিল শ্রমিকদের বাসস্থান । 

মাটি, ব্রোঞ্জ, তামার কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছল হরপ্পায়। এরা তৈরি করতো নানা রকমের মাটির পাত্র। এসব পাত্রের গায়ে অঙ্কিত থাকতো চমৎকার সব নকশা। ব্রোঞ্জ বা তামার তৈরি কুঠার, বর্শা, ছোরা, তীর- ধনুক, গুলতি, ঢাল ইত্যাদি হরপ্পার অনেক জায়গায়ই পাওয়া গেছে। আর পাওয়া গেছে চমৎকার সব মাটির পুতুল। নৌপথে এসব সামগ্রী অন্য নগরে রফতানী করতো এমনটাই অনুমান করা যায়।

হরপ্পার প্রাণিকূল:
হরপ্পায় প্রচুর সিলমোহর পাওয়া গেছে। যাতে বিভিন্ন প্রাণির ছবি মুদ্রিত আছে। এই সূত্রে ধারণা করা যায়, হরপ্পাবাসীদের কাছে কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়, মহিষ,ভেড়া, হাতি এবং উট ছিল। এছাড়াও হরপ্পায় নানা ধরনের মাটির খেলনার ছাঁচ পাওয়া গিয়েছে। সেইও সাথে বেশ কিছু প্রাণীর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এই সূত্রে অনুমান করা যায়, হরপ্পাবাসী বাঘ, সিংহ, গরু, কুকুর, গাধা, বাঁদর এবং খরগোশ এসব পশুর সাথে পরিচিত ছিল। হরপ্পাসভ্যতায় ঘোড়ার পায়ের ছাপ থেকে অনুমান করা হয়েছে, এরা ঘোড়ার ব্যবহার জানতো।

হরপ্পাবাসীর আয়ুষ্কাল:
ময়েঞ্জোদারতে আবিষ্কৃত কবরের কঙ্কাল থেকে ধারণা করা হয়েছে, হরপ্পাবাসীর গড় আয়ু ছিল মাত্র ত্রিশ বৎসর। সম্ভবত হরপ্পাবাসীরা চিকিৎসা ব্যবস্থা ততটা উন্নত ছিল না। এরা মৃত মানুষের সরসরি কবর দিত বা প্রথমে মৃতদেহ পুড়িয়ে, পরে তার ভস্ম কবর দিত। কোনো কোনো কবরে মৃত ব্যক্তির ব্যবহার্য দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে।
 
হরপ্পাবাসীর ধর্ম :
ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি অংশ হরপ্পা সভ্যতার সূত্রে এসেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশের পর সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বসতি স্থাপন করেছিল। আর্যদের দেবতার সাথে হরপ্পার আদি দেবদেবীর সংমিশ্রণে পৌরাণিক কথকথার সৃষ্টি হয়েছিল। বেদে দেবদেবীর সংখ্যা খুব বেশি নেই।

 হরপ্পায় পাওয় স্বস্তিকা
আর্যদের স্বস্তিকা চিহ্ন, ভারতে প্রবেশ করেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে হরপ্পাতে তার প্রচলন ছিল। সেক্ষেত্রে স্বস্তিকা আর্যরা হরপ্পাবাসীদের কাছ থেকে পেয়েছিল কিনা প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার একথাও বলা যায়, হরপ্পাবাসীদের সাথে ইরানি-আর্যদের সম্পর্ক ছিল, সেই সূত্রে ভারতে আর্যদের বহু আগে স্বস্তিকা চিহ্ন ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল হরপ্পবাসীদের মাধ্যমে।

ময়েঞ্জোদারো-তে প্রাপ্ত রাজমূর্তি
হরপ্পায় যে রাজমূর্তিটি পাওয়া গেছে, তাকে অনেকে পুরোহিত বলেও দাবি করেন। যদিও প্রাচীন যুগে পুরোহিত এবং রাজা উভয়ে সমাজকে শাসন করতো। তবে এর থেকে অন্তত এটুকু উপলব্ধি করা যায় যে, হরপ্পায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু ছিল। 
 
হরপ্পায় প্রাপ্ত মাতৃদেবী
তবে সে সমাজে মাতৃদেবীর কদর ছিল। হরপ্পার মাতৃমূর্তি ছিল রঙহীন পক্ষান্তরে ময়েঞ্জোদারো-র মাতৃমূর্তি গুলোর বেশির ভাগই রঙ ছিল ছিল লাল। হরপ্পার মাতৃদেবীদের মাথায় আবরণ ছিল পিছন দিক থেকে বা মাথার উপর থেকে। এই দেবীর কোমরে আবরণ থাকলেও উপরের অংশ প্রায় নগ্ন। শরীরে প্রচুর অলঙ্কার দেখা যায়। মূর্তিগুলো পূর্ণ বা আবক্ষ উভয়ই রয়েছে।

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংস :
হরপ্পা এবং তৎসংলগ্ন বিশাল অঞ্চলজুড়ে যে সভ্যতা ধ্বংস কেন হয়েছিল, তার কোনো সুস্পষ্ট কারণ জানা যায় নি। তবে এই বিষয়ে কিছু কল্পকথা প্রচলিত আছে। যেমন-

১. আবহাওয়াগত পরিবর্তন বা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে আবাদী ভূমি অনুর্বর হয়ে পড়েছিল। এর ফলে এদের কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফলে খাদ্যাভাবের কারণে এই এলাকাবাসীরা এই স্থান ত্যাগ করেছিল। কিন্তু এই সভ্যতার সকল অঞ্চলে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল, এমনটা বিশ্বাস করা মুসকিল।

২. অসহনীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে খাদ্যাভাব-সহ নানাবিধ অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে জনসাধারণ অন্যত্র চলে গিয়েছিল। এই দাবিটিও গ্রহণ করা যায় না। কারণ, অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে একটি বিশালসংখ্যক মানুষ অন্যত্র চলে গেলেও কিছু লোক থেকেই যেতো।

৩. ইরানিদের হামলা-আক্রমণকে অনেকে অন্যতম কারণ হিসাবে বলে মনে করেন। ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখা যায় আর্য খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে ভারতে এসেছিল। কিন্তু হরপ্পা সভ্যতা টিকে ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বৎসর পর্যন্ত। এমন হতে পারে হালাকু খানদের মতো কোনো আক্রমণকারী নগরীর সমস্ত লোককে হত্যা করেছিল। এবং ভাগ্যবান কিছু লোক পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও এই অঞ্চলে আর ফিরে আসে নি।

তথ্যসূত্র :http://www.harappa.com/har/indus-saraswati.html
বাংলা বিশ্বকোষ (চতুর্থ খণ্ড)। নওরোজ কিতাবিস্তান। নবেম্বর, ১৯৭৬।
 
Share:

১৬ অক্টোবর ২০১৫

কেন আমি হিন্দু ?

আমি একজন হিন্দু, আমার জন্ম এক হিন্দু বাবা ও হিন্দু মায়ের ঘরে, তাই জন্মসূত্রে আমি একজন হিন্দু। আমার কোনো ধর্মীয় প্রবক্তা বা আমার কোনো নির্দিষ্ট একটি ধর্মগ্রন্থ নেই বরং আমার আছে শত শত, হাজার হাজার ধর্মীয় ও দার্শনিক গ্রন্থ। হিন্দু ধর্মকে বিশ্বের বর্তমান 'ধর্মমত'-গুলোর সাথে আপনি তুলনা করতে পারবেন না। কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও আপনি হিন্দু হতে পারেন। হিন্দু ধর্ম সেই সভ্যতার শুরু থেকেই চলে আসছে, টিকে আছে নানা প্রতিকূলতাকে ও সমালোচনাকে সাথে নিয়ে। আমি প্রতিনিয়ত মন্দিরে যেতাম না। আমি নিয়মিত ধর্মীয় আচার-নিষ্ঠা পালন করতাম না। কেউ আমার উপর কখনো চাপ প্রয়োগ করেনি এসব নিয়ম-নিষ্ঠা পালন করার জন্য। ছোটবেলায় ধর্মীয় উৎসবসমূহে অংশ নিতাম ও খুব উপভোগ করতাম। ঈশ্বর আমার বন্ধুর মতো। আমি ঈশ্বরকে ভয় পাই না। যদি আমি হিন্দুধর্মের কিছু আচার-নিষ্ঠাকে চ্যালেঞ্জও করি তবুও কেউ আমাকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারবে না বা প্রাণে মেরে ফেলবে না। কারণ একজন হিন্দু হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ও বস্তুনিষ্ঠভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি, কোনো প্রকার শর্তাবলী ছাড়াই। এমনকি প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেও পারি। আমাকে কেউ মেরে ফেলবে না। আসলে হিন্দুধর্ম কোনো ধর্মমত নয়, এক বিশ্বাস ও রীতি-নীতি। মানুষের সভ্য হবার পদ্ধতি ও 'মানুষ' হওয়ার সংস্কৃতি। এ কোনো এমন ধর্ম নয় যা কোনো এক ব্যক্তির দ্বারা প্রচারিত অথবা এর কোনো সংগঠিত সংঘ বা সমিতি নেই। হিন্দুধর্মে কোনো সংস্থাপণ বা কর্তৃত্বধারী গোষ্ঠী নেই।
আমাদের ঈশ্বর সম্পর্কে ভাবনা একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বরের মতো নয়। এ তো আমাদের কাছে ভাবনারও অতীত যে আমি একজন 'ব্যক্তির মতো ঈশ্বর'-এর আরাধনা করব -- যিনি কিনা এমন যে, মেঘের মাঝে লুকিয়ে থেকে তার পছন্দমত 'বার্তাবাহক'-এর মাধ্যমে নির্দেশ দিচ্ছেন এমনভাবে যেন আমাদের তাকে উপাসনা করতেই হবে, আর না করলেই শাস্তি।
আসলে হিন্দুধর্ম হলো একজন ব্যক্তির ধর্ম, ব্যক্তির জন্য ধর্ম, ব্যক্তির দ্বারা ধর্ম যার শিকড় রয়েছে গীতার মতো ধর্মগ্রন্থে আর সাধনা রয়েছে চণ্ডীর মতো ধর্মগ্রন্থে। পুরো বিষয়টা হলো একজন ব্যক্তির ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো তার নিজস্ব ব্যক্তিগত মাধ্যমে, তার নিজস্ব মানসিকতা ও অন্তর্নিহিত বিবর্তনের মাধ্যমে। কেউ কাউকেও হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারবে না। এ কোন ধর্মমত নয়, বরং এক জীবনপ্রণালী, জীবনে চলার রীতি-নীতি সম্বলিত ব্যবস্থা। সকল কিছুই হিন্দুধর্মে গ্রহণযোগ্য কারণ, কোনো একক কর্তৃত্বধারী বা সংগঠন নেই যা এর ব্যবস্থাকে বাতিল ঘোষণা করবে বা এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন করবে। তাই একমাত্র এখানেই আপনি পাবেন জীবনের অর্থ। সৃষ্টির সকল কিছুকে ভালোবাসাই হলো পরম সত্য.......- ঈশ্বর বিরাজিত সকল কিছুতেই...... কিছুই ঈশ্বর থেকে দূরে নয় কারণ ঈশ্বর সকল কিছুতেই.... সকল জীব ও জড়কে ঈশ্বর জ্ঞানে সম্মান করা উচিত আমাদের...... এ'সবই হিন্দুধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়। এই কারণেই একে বলে সনাতন ধর্ম, চিরন্তন বিশ্বাস। এ এক ধর্ম নামক রীতি দ্বারা চালিত যার অর্থ 'জীবন চলা'-র প্রথা। হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নিজের প্রতি সৎ থাকা। এর কোনো একক ধ্যান-ধারণা নেই। এটি সকল কিছুর কাছেই উন্মুক্ত। হিন্দুরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে যিনি আবার নানা রূপধারণও করতে পারেন প্রয়োজন অনুযায়ী। হিন্দুদের কাছে ঈশ্বর সময়হীন ও আকারহীন। বর্তমান হিন্দুদের আদি পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করতেন চিরন্তন সত্য ও মহাজাগতিক নিয়ম-কানুনে। এইসব সত্য বা নিয়ম-কানুন সবার কাছে উন্মুক্ত যে এ সম্পর্কে আরো গভীরে যেতে চান। কিন্তু হিন্দুদের মাঝেও এমন অংশবিশেষ রয়েছে যারা কুসংস্কারেও বিশ্বাস করে। হিন্দুধর্মের দার্শনিক দিকগুলো এসব কুসংস্কারকে ভুল প্রমাণ করে। কেউ কাউকেও হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারবে না এ কোনো ধর্মমত নয়, এ'টা একমাত্র 'ধর্ম'।
অভারতীয়রা হিন্দু শব্দটির জন্ম দেয় সিন্ধু নদের উপত্যকায় উৎপত্তির জন্য। এর ফলে ওই অঞ্চলের মানুষদের তখন হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
ধর্মমতগুলো এক 'মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রী'-তে রূপান্তরিত হয়ে যা বিবাহ-ধর্মান্তর এসবের মাধ্যমে নিজের গোষ্ঠীর লোকসংখ্যা বাড়িয়ে 'মার্কেট শেয়ার' বাড়াতে চাইছে।
কিন্তু আমি একজন হিন্দু। আমি মানি - 'অহিংসা পরমো ধর্ম' - অসহিংসতা হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্তব্য। আমি একজন হিন্দু কারণ হিন্দুধর্ম অহিংসতার ডাক দেয়। আমি একজন হিন্দু কারণ আমি আমার মনকে কোনো বিশ্বাস ব্যবস্থার সাথে শর্ত জুড়ে দিই না। আমি একজন হিন্দু কারণ হিন্দুধর্ম হচ্ছে জগতের প্রথম উৎপন্নিত ব্যবস্থা যা মানুষকে 'মানুষ' হ'তে শিখায়। কিন্তু কোনও একজন হিন্দু পুরুষ/মহিলা, যে তার জন্মগত ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, সে তার নিজস্ব আদর্শ, সংস্কৃতি ও জীবনের মূল্যবোধকে মূল্য দেয় না।

লিখেছেনঃ প্রীতিশ ঘোষ (বারাসাত , পশ্চিমবঙ্গ হতে
)

Share:

১৪ অক্টোবর ২০১৫

দুর্গা - ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শ্রীকৃষ্ণ এবং দুর্গা এই বঙ্গদেশের প্রধান আরাধ্য দেবতা। ইঁহাদিগের পূজা না করে এমত হিন্দু প্রায় বঙ্গদেশে নাই। কেবল পূজা নহে, কৃষ্ণভক্তি ও দুর্গাভক্তি এ দেশের লোকের সর্বকর্মব্যাপী হইয়াছে। প্রভাতে উঠিয়া শিশুরাও “দুর্গা দুর্গা” বলিয়া

গাত্রোত্থান করে। যে কিছু লেখা পড়া আরম্ভ করিতে হইলে, আগে দুর্গা নাম লিখিতে হয়। “দুর্গে” “দুর্গে” “দুর্গতিনাশিনি” ইত্যাদি শব্দ অনেকের প্রতিনিঃশ্বাসেই নির্গত হয়। আমাদের প্রধান পর্বাহ দুর্গোৎসব। সেই উৎসব অনেকের জীবনমধ্যে প্রধান কর্ম বা প্রধান আনন্দ। সম্বৎসর তাহারই উদ্যোগে যায়। পথে পথে কালীর মঠ। অমাবস্যায় অমাবস্যায় কালীপূজা। কোন গ্রামে পীড়া আরম্ভ হইলে রক্ষাকালীপূজা। কাহারও কিছু অশুভ সম্ভাবনা হইলেই চণ্ডীপাঠ —অর্থাৎ কালীর মহিমা কীর্তন। ইঁহার প্রীত্যর্থে পূর্ববঙ্গে অনেক প্রাচীন বিজ্ঞ ব্যক্তিও মদ্যপান ও অন্যান্য কুৎসিত কর্মে রত। ফলে এই দেবী বঙ্গদেশ শাসন করিতেছেন। ডাকাইতেরা ইঁহার পূজা না দিয়া ডাকাইতি করে না।
এই দেবী কোথা হইতে আসিলেন? ইনি কে? আমাদিগের হিন্দু ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলিবার কারণ এই যে, এই ধর্ম বেদমূলক। যাহা বেদে নাই, তাহা হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত কি না সন্দেহ। যদি হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে কোন গুরুতর কথা বেদে না থাকে, তবে হয় বেদ অসম্পূর্ণ, না হয় সেই কথা হিন্দুধর্মান্তর্গত নহে। বেদ অসম্পূর্ণ ইহা আমরা বলিতে পারি না, কেন না তাহা হইলে হিন্দু ধর্মের মূলোচ্ছেদ করিতে হয়। তবে দ্বিতীয় পক্ষই এমন স্থলে অবলম্বনীয় কি না, তাহা হিন্দুদিগের বিচার্য।

দুর্গার কথা বেদে আছে কি? সকল হিন্দুরই কর্তব্য যে এ কথার অনুসন্ধান করেন। আমরা অদ্য তাঁহাদের এ বিষয়ে কিছু সাহায্য করিব।

অনেকেই জানেন যে বেদ একখানি গ্রন্থ নয়। অথবা চারি বেদ চারিখানি গ্রন্থ মাত্র নহে। কতকগুলিন মন্ত্র, কতকগুলিন “ব্রাহ্মণ” নামক গ্রন্থ, এবং কতকগুলিন উপনিষদ্ লইয়া এক একটি বেদ সম্পূর্ণ। তন্মধ্যে মন্ত্রই বেদের শ্রেষ্ঠাংশ বলা যাইতে পারে।

ইহা একপ্রকার নিশ্চিত যে কোন বৈদিক সংহিতায় এই দেবীর বিশেষ কোন উল্লেখ নাই। ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, বায়ু, সোম, অগ্নি, বিষ্ণু, রুদ্র, অশ্বিনীকুমার প্রভৃতি দেবতার ভূরি ভূরি উল্লেখ ও স্তুতিবাদ আছে; পুষণ, অর্যমন প্রভৃতি এক্ষণে অপরিচিত অনেক দেবতার উল্লেখ আছে, কিন্তু দুর্গা বা কালী বা তাঁহার অন্য কোন নামের বিশেষ উল্লেখ নাই।

ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের অষ্টমাষ্টকে “রাত্রি পরিশিষ্টে” একটি দুর্গা-স্তব আছে মাত্র। কিন্তু তাহাতে যদিও দুর্গা নাম ব্যবহৃত হইয়াছে, তথাপি তাঁহাকে আমাদের পূজিতা দুর্গা বলা যাইতে পারে না। উহা রাত্রি-স্তোত্র মাত্র। সন্দিহান পাঠকের সন্দেহ ভঞ্জনার্থ, আমরা উহা উদ্ধৃত করিলাম --

আরাত্রি পার্থিবং রজঃ পিতুরপ্রায়ি ধামভিঃ।
দিবঃ সদাংসি বৃহতী বিতিষ্ঠসে ত্বেষাং বর্ততে তমঃ || ১ ||
যে তে রাত্রি নৃচাক্ষসো যুক্তাসো নবতির্নব।
অশীতিঃ সন্ত্বষ্টা উতো তে সপ্ত সপ্ততীঃ || ২ ||
রাত্রিং প্রপদ্যে জননীং সর্বভূতনিবেশনীং।
ভদ্রাং ভগবতীং কৃষ্ণাং বিশ্বস্য জগতো নিশাং || ৩ ||
সম্বেশনীং সংযমনীং গ্রহনক্ষত্রমালিনীম্।
প্রপন্নোহং শিবাং রাত্রিং
ভদ্রে পারং অশীমহি ভদ্রে পারং অশীমহি ওঁ নমঃ || ৪ ||
স্তোষ্যামি প্রযতো দেবীং শরণ্যাং বহ্বৃচপ্রিয়াং।
সহস্রসংমিতাং দুর্গাং জাতবেদসে সুনবাম সোমম্ || ৫ ||
শান্ত্যর্থং তদ্বিজাতীনামৃষিভিঃ সোমপাশ্রিতাঃ (সমুপাশ্রিতাঃ?)
ঋগ্বেদে ত্বং সমুৎপন্নারাতীয়তো নিদহাতি বেদঃ || ৬ ||
যে ত্বাং দেবি প্রপদ্যন্তে ব্রাহ্মণাঃ হব্যবাহিনাং।
অবিদ্যা বহুবিদ্যা বা স নঃ পর্ষদতিদুর্গানি বিশ্বাঃ || ৭ ||
অগ্নিবর্ণাং শুভাং সৌম্যাং কীর্তয়িষ্যন্তি যে দ্বিজাঃ।
তান তারয়তি দুর্গানি নাবেব সিন্ধুং দুরিতাত্যগ্নিঃ || ৮ ||
দুর্গেষু বিষমে ঘোরে সংগ্রামে রিপুসঙ্কটে।
অগ্নিচোরনিপাতেষু দুষ্টগ্রহনিবারণে || ৯ ||
দুর্গেষু বিষমেষু ত্বাং সংগ্রামেষু বনেষু চ।
মোহয়িত্বা প্রপদ্যন্তে তেষাং মে অভয়ং কুরু তেষাং মে অভয়ং
কুরু ওঁ নমঃ || ১০ ||
কেশিনীং সর্বভূতানাং পঞ্চমীতি চ নাম চ।
সা মাং সমা নিশা দেবী সর্বতঃ পরিরক্ষতু সর্বতঃ
পরিরক্ষতু ওঁ নমঃ || ১১ ||
তামগ্নিবর্ণান্তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ || ১২ ||
দুর্গা দুর্গেষু স্থানেষু সন্নোদেবীরভীষ্টয়ে।
য ইমং দুর্গাস্তবং পুণ্যং রাত্রৌ রাত্রৌ সদা পঠেৎ।
রাত্রি কুশিকঃ সৌভরো রাত্রিস্তবো গায়ত্রী রাত্রিসূক্তং জপেন্নিত্যং
তৎকালমুপপদ্যতে || ১৩ ||
এই সংস্কৃত এক এক স্থানে অত্যন্ত দুরূহ, এজন্য আমরা ইহার অনুবাদে সাহসী হইলাম না। ডাক্তার জন মিয়োর কৃত ইংরেজি অনুবাদের অনুবাদ নিম্নে লিখিলাম। তাঁহার অনুবাদও সন্তোষজনক নহে।

“হে রাত্রি! পার্থিব রজঃ তোমার পিতার কিরণে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। হে বৃহতি! তুমি দিব্যালয়ে থাক, অতএব তমঃ বর্তে। যে নরদর্শকেরা তোমাতে যুক্ত তাহারা নবনবতি বা অষ্টাশীতি বা সপ্তসপ্ততি হউক (অর্থ কি?) সর্বভূতনিবেশনী, জননী, ভদ্রা, ভগবতী, কৃষ্ণা, এবং বিশ্বজগতের নিশাস্বরূপ রাত্রিকে প্রাপ্ত হই। সকলের প্রবেশকারিণী শাসনকত্রী (?) গ্রহনক্ষত্রমালিনী, মঙ্গলযুক্তা রাত্রিকে আমি প্রাপ্ত হইয়াছি; হে ভদ্রে! আমরা যেন পারে যাই, আমরা যেন পারে যাই, ওঁ নমঃ। দেবী, শরণ্যা বহ্বৃচপ্রিয়া, সহস্রাতুল্যা দুর্গাকে আমি যত্নে তুষ্ট করি। আমরা জাতবেদাকে (অগ্নি) সোমদান করি। দ্বিজাতিগণের শান্ত্যর্থ তুমি ঋষিদিগের আশ্রয় (?) ঋগ্বেদে তুমি সমুৎপন্না অগ্নি অরাতিদিগের দহন করেন (?) দেবি! যে ব্রাহ্মণেরা, অবিদ্যা হউন, বা বহুবিদ্যা হউন, তোমার কাছে আসেন, তিনি (?) আমাদের সকল বিপদে ত্রাণ করিবেন। যে ব্রাহ্মণেরা অগ্নিবর্ণা, শুভা, সৌম্যাকে কীর্তিত করিবে, সমুদ্রে নৌকার ন্যায় অগ্নি তাহাদিগকে বিপদ হইতে পার করিবেন। বিপদে ঘোর বিষম সংগ্রামে, সঙ্কটে বিষয় বিপদে সংগ্রামে, বনে অগ্নিনিপাতে, চোরনিপাতে, দুষ্টগ্রহ নিবারণে, তোমার কাছে আসে, এ সকল হইতে আমাকে অভয় কর! এ সকল হইতে আমাকে অভয় কর! ওঁ নমঃ। যিনি সর্বভূতের কেশিনী, পঞ্চমী নাম যাঁর, সেই দেবী প্রতিরাত্রে সকল হইতে পরিরক্ষণ করুন‌! সকল হইতে আমাকে পরিরক্ষণ করুন! ওঁ নমঃ। অগ্নিবর্ণা তপের দ্বারা জ্বালাবিশিষ্টা, বৈরোচনী কর্মফলে জুষ্টা, দুর্গাদেবীর শরণাগত হই, হে সুবেগবতি! তোমার বেগকে নমস্কার। দুর্গাদেবী বিপদস্থলে আমাদের মঙ্গলার্থ হউন। এই পবিত্র দুর্গা স্তব যে রাত্রে সদা পাঠ করিবে—রাত্রি, কুশিক, সৌভর, রাত্রিস্তব, গায়ত্রী, যে রাত্রিসূক্ত নিত্য জপ করে যে তৎকাল প্রাপ্ত হয়।”

ইহার সকল স্থলে অনুবাদ হইয়া উঠে নাই, এবং যাহা অনুবাদ হইয়াছে তাহার সকল স্থলের কেহ অর্থ করিতে পারে না। কিন্তু এত দূর বুঝা যাইতেছে যে, যদি এই দেবী আমাদের পূজিতা দুর্গা হয়েন, তবে দুর্গা রাত্রির অন্যেতর নাম মাত্র। ইহা ভিন্ন যজুর্বেদের (বাজসনেয়) সংহিতায় এক স্থানে অম্বিকার উল্লেখ আছে। কিন্তু সেখানে অম্বিকা শিবের ভগিনী, যথা --

“এষ তে রুদ্র ভাগঃ স্বস্রা অম্বিকয়া ত্বং জুষস্ব স্বাহা ।।”
আর কোন সংহিতায় কোথাও দুর্গার কোন নামের কোন উল্লেখ নাই।

তৎপরে ব্রাহ্মণ। কোন ব্রাহ্মণে কোন নামে ইঁহার কোন উল্লেখ নাই। তারপর উপনিষদ্। উপনিষদে দুর্গার নাম কোথাও নাই; এক স্থানে উমা হৈমবতী, আর এক স্থানে কালী করালী নামে উল্লেখ আছে। ঐ দুইটি স্থানই আমরা ক্রমশঃ উদ্ধৃত করিতেছি।

প্রথম, কেনোপনিষদে আছে --

“অথ ইন্দ্রম্ অব্রুবন্ মঘবন্নেতদ্বিজানীহি কিমেতদ্‌যক্ষমিতি। তথেতি তদভ্যদ্রবত্তস্মাত্তিরোদধে। স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীম্। তং হোবাচ কিমেতদ্যক্ষমিতি। সা ব্রহ্মেতি হোবাচ ব্রহ্মণো বা এতদ্বিজয়ে মহীয়ধ্বমিতি। ততো হৈব বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি”

“তাঁহারা তখন ইন্দ্রকে বলিলেন, “মঘবন্ এ যক্ষ কি জানুন।” ইন্দ্র “তাই” বলিয়া তাহার কাছে গেলেন, সে অন্তর্ধান হইল।

সেই আকাশে বহুশোভমানা উমা হৈমবতী নামক স্ত্রীলোকের নিকট আসিলেন। তাঁহাকে বলিলেন, “কি এ যক্ষ?” তিনি কহিলেন, “এ ব্রহ্মা, ব্রহ্মার এই বিজয়ে আপনারা মহৎ হউন।” তাহাতে জানিলেন যে, ইতি ব্রহ্ম।”

ইহার অর্থ কি, আমরা বুঝিতে পারিব না, কিন্তু সায়নাচার্য বুঝিয়াছিলেন সন্দেহ নাই। সায়নাচার্য এই উমা হৈমবতীকে ব্রহ্মজ্ঞান বলেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকান্তর্গত এক স্থানে সোম শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, “হিমবৎপুত্র্যা গৌর্যা ব্রহ্মবিদ্যাভিমানিরূপত্বাৎ গৌরীবাচকো উমাশব্দো ব্রহ্মবিদ্যাং উপলক্ষয়তি। অতএব তলবকারোপনিষদি (ইহারই নামান্তর কেনোপনিষদ্) ব্রহ্মবিদ্যামূর্তিপ্রস্তাবে ব্রহ্মবিদ্যামূর্তিঃ পঠ্যতে। বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীং তাং হোবাচ ইতি। তদ্বিষয়তয়া তয়া উময়া সহিতবর্তমানত্বাৎ সোমঃ।”

তবে কেনোপনিষদের উমা হৈমবতী ব্রহ্মবিদ্যামাত্র। মহাভারতীয় ভীষ্মপর্বে অর্জুনকৃত একটি দুর্গাস্তব আছে, তাহাতে দুর্গাকে “ব্রহ্মবিদ্যা” বলা হইয়াছে। যথা—

ত্বং ব্রহ্মবিদ্যা বিদ্যানাং মহানিদ্রা চ দেহিনাং।
দ্বিতীয়, মুণ্ডকোপনিষদে এক স্থানে কালী ও করালী নামের উল্লেখ আছে। কিন্তু সে কোন দেবীর নাম বলিয়া উল্লিখিত হয় নাই --- অগ্নির সপ্তজিহ্বার নামের মধ্যে কালী ও করালী দুইটি নাম, ইহাই কথিত আছে, যথা --

কালী করালী চ মনোজবা চ সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা।
স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরূপী চ দেবী লোলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বা।।
কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী, এবং বিশ্বরূপী এই সাতটি অগ্নির জিহ্বা।

ইহা ভিন্ন বেদে আর কোথাও দুর্গা, কালী, উমা, অম্বিকা প্রভৃতি কোন নামে এই দেবীর কোন উল্লেখ নাই।

তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দুর্গাগায়ত্রী আছে। তাহা এই --

কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারী ধীমহি। তন্নো দুর্গীঃ প্রচোদয়াৎ।

পাঠক দেখিবেন, স্ত্রীলিঙ্গান্ত দুর্গা শব্দের পরিবর্তে পুংলিঙ্গান্ত দুর্গী শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। ইহার জন্য সায়নাচার্য লিখিয়াছেন, “লিঙ্গাদিব্যত্যয়ঃ সর্বত্র ছান্দসো দ্রষ্টব্য।” তিনি কাত্যয়ন শব্দের এই ব্যাখ্যা করেন, “কৃতিং বস্তে ইতি কত্যো রুদ্রঃ। স এবায়নং যস্য সা কাত্যায়নী। অথবা কতস্য ঋষিবিশেষস্য অপত্যং কাত্যঃ।” কন্যাকুমারীর এই রূপ ব্যাখ্যা করেন, “কুৎসিতং অনিষ্টং মায়রতি ইতি কুমারী, কন্যা দীপ্যমানা চাসৌ কুমারী চ কন্যাকুমারী।”

এতদ্ভিন্ন ঋগ্বেদান্তর্গত রাত্রিপরিশিষ্ট হইতে যে দুর্গাস্তব উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহার ১২ সংখ্যক শ্লোক ঐ তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দ্বিতীয় অনুবাকে অগ্নিস্তবে আছে। তাহাতে দুর্গার উল্লেখ আছে, দেখা গিয়াছে। কৈবল্যোপনিষদে “উমা সহায়ম্” বলিয়া মহাদেবের উল্লেখ আছে। কৈবল্যোপনিষদ্ অপেক্ষাকৃত আধুনিক। ঐস্থলে আশ্বলায়ন বক্তা। ওয়েবর বলেন তৈত্তিরীয় আরণ্যের অষ্টাদশ অনুবাদকে “উমাপতয়ে” শব্দ আছে -- কিন্তু ঐ বচন আমরা দেখি নাই। উপনিষদে বা আরণ্যকে আর কোথাও দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
এক্ষণে জিজ্ঞাস্য, আমাদিগের পূজিত দুর্গা কি রাত্রি, না মহাদেবের ভগিনী, না ব্রহ্মবিদ্যা, না অগ্নিজিহ্বা?


ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
[‘বঙ্গদর্শন’, জ্যৈষ্ঠ ১২৮০, পৃ. ৪৯-৫৩]

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

আসুন গেল দুই মাসের প্রতিমা ভাংগার লিস্ট দেখুন ; উৎসব এর পরেও কি মনে আসে?

১.শেরপুরে ৪০ বছরের পুরোনো মন্দিরের আসন্ন দূর্গাপুজার ৩ টি প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বত্তরা। (শেরপুর নিউজ২৪ / তারিখ ১৩ই অক্টোবর ১৫)
২.ডিমলায় মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর (দৈনিক যুগান্তর/ ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৫) ৩.মধুখালীতে মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর (দৈনিক যুগান্তর/ ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০১৫) ৪.সাভারে একটি মন্দিরের কয়েকটি মূর্তি ভাংচুর (শীর্ষ নিউজ ডট কম ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫)
৫.হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা রামকৃষ্ণ সেবা আশ্রমের দুর্গাপূজার দু’টি মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (একুশে টেলিভিশন )
৬.নাটোরে মন্দিরের ৫টি মূর্তি ভাংচুর (মানব কন্ঠ ১০ অক্টোবর ২০১৫) ৭.ফরিদপুরে প্রতিমা ভাংচুর (বিডি নিউজ ২৪/ ২২ সেপ্টেম্বর)
৮.সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় আসন্ন দুর্গা পূজার জন্য তৈরি ১৫টি প্রতিমা ৯.ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। (বিডি নিউজ ২৪/ ৭ অক্টোবর ২০১৫)
১০.বড়লেখায় দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (সিলেটটুডে ২৪/ ১৩ অক্টোবর ২০১৫)
১১.নাটোরের বড়াইগ্রামে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর (আমাদের সময়ডট কম / ১০/১০/২০১৫)
১২.পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার পশ্চিম অলিপুরা গ্রামের একটি মন্দিরে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। (হিন্দু ওয়াপ ডট কম/১১/১০/২০১৫) ১৩.সিরাজগঞ্জে মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর (বিএম দ্য রিপোর্ট ডট কম ০১/১০/২০১৫) ১৪. হিন্দু মন্দিরে হামলা,বগুড়ার গাবতলীতে কালি মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর (০২/০৯/২০১৫)
১৫.ভালুকায় মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুর (ভালুকা নিউজ ২৪ডট কম ১৩/১০/২০১৫) ১৬. কালিয়াকৈরে প্রতিমা ভাংচুর (চ্যানেল সেভেন ডট কম ১৩/১০/১৫) ১৭.রায়গঞ্জে প্রতিমা ভাংচুর (অনাবিল ডট কম ১৩/১০/২০১৫)
১৮. মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের পাঁছ বারইল গ্রামে মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর করেছে দূবৃর্ত্তরা -(বিডি লাভ ২৪ / অগাস্ট ২০১৫)
 ১৯. মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নে প্রতাবনগর গ্রামে সার্বজনীন শিব মন্দিরের দু’টি মুর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (বাংলাদেশ প্রতিদিন অগাস্ট ২০১৫)
২০. মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নে প্রতাবনগর গ্রামে সার্বজনীন শিব মন্দিরের দু’টি মুর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা (খবর বিতান ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫)
 ২১. বাগেরহাটে সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা (বাংলা পোস্ট ২৪ ১৩ অক্টোবর ২০১৫)
 ২২. দাকোপে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর (বিডি নিউজ ২৪)
২৩. বাগেরহাটের মোল্লাহাটে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। (এপ্রিল ২০১৫, বাগেরহাট ইনফো )
২৪. দিনাজপুরে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর (২২ সেপ্টম্বর ২০১৫ / উত্তর বাংলা ডট কম ) ২৫. হালুয়াঘাটে দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর (৭ সেপ্টম্বর ২০১৫/ ময়মনসিংহ বার্তা )
 ২৬. কাউনিয়ার অপরাজিতা কুঞ্জ মন্দিরের দূর্গা প্রতিমা ভাংচুর (বরিশাল ওয়াচ ডট কম / অক্টোবর ২০১৫) .

Collected from: Hindu Yoddha - হিন্দু যোদ্ধা
Share:

১৩ অক্টোবর ২০১৫

হিন্দু হবার অপরাধে

আপনি মুক্তিযোদ্ধা? আপনি বিচারক?  আপনি আইনজীবি? আপনি শিক্ষক? আপনি লেখক? আপনি কবি? আপনি সাংবাদিক? আপনি ব্যবসায়ী? আপনি নারী? এমনকি আপনি আওয়ামীলীগ করেন? কিছুতেই কিছু যায় আসে না, কারন আপনি হিন্দু। বাংলাদেশে হিন্দু হয়ে জন্মগ্রহণ করা একটি আজন্ম পাপ। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক:

এক
ফরিদপুরের সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের কথা মনে আছে? তিনি একজন খ্যাতিমান নির্যাতিত সাংবাদিক, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, তিনি বিএনপি জামায়াতের হামলায় পা হারিয়েছেন। বাংলাদেশের আইনে আছে কোনো পঙ্গু মানুষকে গ্রেফতার করা হলেও হাতকড়া পড়ানো যাবে না। কিন্তু কিসের কী? বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে শুধুমাত্র একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস এর কারনে তাকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে রিমান্ডে পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এই লোকটি আওয়ামীলীগের আজন্ম বন্ধু, হিতৌষী, তাতে কি? তিনি রেহাই পান নি। তিনি বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামীলীগ দুই আমলেই নিগৃহীত হলেন।

দুই
প্রবীর শিকদার গ্রেফতার হয়েছেন কার কারনে? শেখ হাসিনার মেয়ের শ্বশুর ফরিদপুরের খন্দকার মোশাররফ হোসেন এর কারনে। একথা সবাই জানেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। কয়েক দিন আগে সেই মন্ত্রী আবার আরেকটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটালেন। মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের একজন কৌসুলি রানা দাশগুপ্তকে (হিন্দু ধর্মের অনুসারি) তিনি প্রকাশ্য জনসভায় হুমকি দিলেন। তিনি বিচারকের চোখ তুলে নিতে চেয়েছেন।

তিন
ইদানিংকালে বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক কবি-লেখক-ব্লগার হত্যাকান্ডের ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত। অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, এবং নিলয়কে হত্যা করা হয়েছে। এমন খবর প্রায় সব মিডিয়াতেই এসেছে, হিন্দু ব্লগারদের হত্যা করলে নাকি বাংলাদেশের মুস্লিম ধর্মপ্রান পাবলিকের প্রতিক্রিয়া কম হবে, তাই এদেরকে টার্গেট করা হয়েছে।

চার
নববর্ষে টিএসসি’র ঘটনা মনে আছে? কিভাবে নারীদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল? কারন একটি বিশেষ গোষ্ঠী বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে থাকে। আমার স্পস্ট মনে আছে, এক সময় দুর্গা পুজায় হিন্দু মেয়েরা বেশ সুন্দর নতুন পোষাকে সাজ-গোজ করে এক পুজা-মন্ডপ থেকে আরেক পুজা মন্ডপে ঘুরে বেড়াতো। হঠাৎ করে এক সময় রাতের বেলা কারেন্ট চলে যেত। তখনই পুজা মন্ডপের আশ-পাশ থেকে কান্নার রোল শোনা যেত। ফলাফল, প্রতিবছর দুর্গা পুজার পর কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেত। এখনো যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত।

পাঁচ
কিছু দিন আগের কথা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে কেন হিন্দু প্লেয়ার নেয়া হলো? সৌম্য সরকারকে এতো পছন্দ করার কী আছে? লিটন দাশকে কেন নেয়া হলো? এসব কথা চায়ের দোকানে ব্যাপক ভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাদের অপরাধ, তারা হিন্দু। আমি কোনো ভাবেই ভেবে পাই না, সৌম্য কিংবা লিটন দাশ কিভাবে এতো বড় মাপের খেলোয়াড় হলো? আমার কিশোর বয়সের কথা আমি ভুলে যাবো কি করে? মহল্লার খেলার মাঠে আমার সঙ্গীরা হিন্দু ছেলেদেরকে ‘মালু’ বলে গালি দিত। ক্যাচ ফেলে দিলে বলতো, ‘এই শালা মালু, ক্যাচ ফেলে দিলি ক্যা?’ আবার ক্যাচ ধরলে অপর পক্ষ বলতো, ‘এই শালা মালু ক্যাচ ধরলি ক্যা?’ আমি হিন্দু ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, মায়া লাগতো, কস্টও লাগতো। তারপর একদিন আর সেই হিন্দু ছেলেরা আমাদের সাথে খেলতে আসতো না।

ছয়
বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে। কারন কি? আমরা কি তা জানি না? যে যেভাবে পারছে দিনে রাতে ভারতে পাড়ি জম্মাচ্ছে। নিজের জন্মভুমি থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতের কোনো এক জায়গায় ‘ঘটি’ কিংবা ‘বাঙ্গাল’ এর মতো এক অসহনীয় জীবন কাটাচ্ছে।

এই যে এতগুলি ঘটনা বললাম, তাদের একটাই দোষ। তারা জন্মের আগেই ভুল করে হিন্দু হয়ে বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করে ফেলেছে। এতো বড় অপরাধের শাস্তি তারা সারা জীবন ধরে পাচ্ছে। অথচ এই হিন্দু মানুষগুলিও একদিন মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। এখন তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি দেশ চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? ‘আমার এ দেশ সব মানুষের। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমানের’। তাই না? তাহলে কেন প্রবীর শিকদার নিগৃহীত হচ্ছেন? তাহলে কেন বিচারক রানা দাশগুপ্তকে ভারতের এজেন্ট বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে? তাহলে কেন লেখক, ব্লগারকে হিন্দু হবার কারনে বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে? তাহলে কেন প্রতিবছর পুজা মন্ডপে হামলা হচ্ছে? তাহলে কেন সৌম্য কিংবা লিটন দাশকে প্রিয় খেলোয়াড় বলা যাবে না? তাহলে কেন বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যা কমে যাচ্ছে? বাংলাদেশ নাকি অসাম্প্রদায়িক, সামাজিক সম্প্রীতির দেশ! এত বড় ফালতু কথা আর যে বিশ্বাস করে করুক, আমি করি না। আমাদের সবার অভিজ্ঞতায় শত শত উদাহরন জমা আছে, আরো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা জমা হচ্ছে। প্রতিদিনই।

ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিংগাপুর
( প্রকাশিত : ২০১৫-১০-১২ ১৬:৪৭:৫২)
তথ্যসুত্রঃ  www.sylhettoday24.com

 http://www.sylhettoday24.com/opinion/details/8/246?utm_campaign=shareaholic&utm_medium=facebook&utm_source=socialnetwork
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।