• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৮ নভেম্বর ২০১৫

কালীকবচম্

ভৈরব উবাচ --
কালিকা য়া মহাবিদ্যা কথিতা ভুবি দুর্লভা ।
তথাপি হৃদয়ে শল্যমস্তি দেবি কৃপাং কুরু ॥ ১
কবচন্তু মহাদেবি কথয়স্বানুকম্পয়া ।
য়দি নো কথ্যতে মাতর্ব্বিমুঞ্চামি তদা তনুং ॥ ২


শ্রীদেব্যুবাচ -----
শঙ্কাপি জায়তে বত্স তব স্নেহাত্ প্রকাশিতং ।
ন বক্তব্যং ন দ্রষ্টব্যমতিগুহ্যতরং মহত্ ॥ ৩
কালিকা জগতাং মাতা শোকদুঃখবিনাশিনী ।
বিশেষতঃ কলিয়ুগে মহাপাতকহারিণী ॥ ৪
কালী মে পুরতঃ পাতু পৃষ্ঠতশ্চ কপালিনী ।
কুল্লা মে দক্ষিণে পাতু কুরুকুল্লা তথোত্তরে ॥ ৫
বিরোধিনী শিরঃ পাতু বিপ্রচিত্তা তু চক্ষুষী ।
উগ্রা মে নাসিকাং পাতু কর্ণৌ চোগ্রপ্রভা মতা ॥ ৬
বদনং পাতু মে দীপ্তা নীলা চ চিবুকং সদা ।
ঘনা গ্রীবাং সদা পাতু বলাকা বাহুয়ুগ্মকং ॥ ৭
মাত্রা পাতু করদ্বন্দ্বং বক্ষোমুদ্রা সদাবতু ।
মিতা পাতু স্তনদ্বন্দ্বং য়োনিমণ্ডলদেবতা ॥ ৮
ব্রাহ্মী মে জঠরং পাতু নাভিং নারায়ণী তথা ।
ঊরু মাহেশ্বরী নিত্যং চামুণ্ডা পাতু লিঞ্গকং ॥ ৯
কৌমারী চ কটীং পাতু তথৈব জানুয়ুগ্মকং ।
অপরাজিতা চ পাদৌ মে বারাহী পাতু চাঞ্গুলীন্ ॥ ১০
সন্ধিস্থানং নারসিংহী পত্রস্থা দেবতাবতু ।
রক্ষাহীনন্তু য়ত্স্থানং বর্জ্জিতং কবচেন তু ॥ ১১
তত্সর্ব্বং রক্ষ মে দেবি কালিকে ঘোরদক্ষিণে ।
ঊর্দ্ধমধস্তথা দিক্ষু পাতু দেবী স্বয়ং বপুঃ ॥ ১২
হিংস্রেভ্যঃ সর্ব্বদা পাতু সাধকঞ্চ জলাধিকাত্ ।
দক্ষিণাকালিকা দেবী ব্যপকত্বে সদাবতু ॥ ১৩
ইদং কবচমজ্ঞাত্বা য়ো জপেদ্দেবদক্ষিণাং ।
ন পূজাফলমাপ্নোতি বিঘ্নস্তস্য পদে পদে ॥ ১৪
কবচেনাবৃতো নিত্যং য়ত্র তত্রৈব গচ্ছতি ।
তত্র তত্রাভয়ং তস্য ন ক্ষোভং বিদ্যতে ক্বচিত্ ॥ ১৫

--------- কালীকুলসর্ব্বস্বে কালীকবচং সম্পূর্ণম্ .......

Written by: Prithish Gosh
Share:

২৭ নভেম্বর ২০১৫

পঞ্চ দেবতার পূজার মন্ত্র

আসুন জেনে নেই পঞ্চ দেবতার পূজার মন্ত্র । পঞ্চ দেবতা হলেন – গণেশ , শিব , কৌষিকী বা জয়দুর্গা , বিষ্ণু ও সূর্য দেবতা ।

গণেশের ধ্যান
----------------
ওঁ খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরং প্রস্যন্দম্মদগন্ধলুব্ধ মধুপব্যালোলগন্ডস্থলম্ ।
দন্তাঘাত বিদারিতারিরুধিরৈঃ সিন্দুরশোভাকরং , বন্দেশৈল সুতাসুতং গণপতিং সিদ্ধিপ্রদং কামদম্ ।।
-
মন্ত্র -- ওঁ গাং গণেশায় নমঃ
-
গণেশের প্রণাম
------------------
ওঁ দেবেন্দ্র- মৌলি- মন্দার মকরন্দ কণারুণাঃ ।
বিঘ্নং হরন্তু হেরম্বচরণাম্বুজরেণবঃ ।।
========================================
শিবের ধ্যান
----------------
ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতসং রত্নাকল্লোজ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্ ।
পদ্মাসীনং সমস্তাৎ স্ততমমরগণৈ র্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং , বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চাবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্ ।।
-
মন্ত্র -- ওঁ নমঃ শিবায়
-
শিবের প্রনাম মন্ত্র
------------------
ওঁ নমস্তভ্যঃ বিরূপাক্ষ নমস্তে দিব্যচক্ষুসে নমঃ ।
পিণাকহস্তায় বজ্রহস্তায় বৈ নমঃ ।।
নমত্রিশূলহস্তায় দন্ড পাশাংসিপাণয়ে ।
নমঃ স্ত্রৈলোক্যনাথায় ভূতানাং পতয়ে নমঃ ।।
ওঁ বানেশ্বরায় নরকার্ণবতারনায় , জ্ঞানপ্রদায় করুণাময়সাগরায় ।
কর্পূরকুন্ডবলেন্দুজটাধরায় , দারিদ্রদুঃখদহনায় নমঃ শিবায় ।।
ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে ।
নিবেদয়ানি চাত্মানংত্তৃংগতিপরমেশ্বরঃ ।।
=====================================================
জয়দুর্গার ধ্যান
-------------
ওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাম্ ।
শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্ ।
সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবনমখিলং তেজসা পুরয়ন্তীম্ ।
ধ্যায়েদ্ দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ ।।
-
মন্ত্র -- ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা
-
প্রনাম মন্ত্র
----------
ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বাথসাধিকে ।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি! নমোহস্তুতে ।।
====================================================
বিষ্ণুর ধ্যান
------------------
ওঁ উদ্যৎকোটিদিবাকরাভমনিশং শঙ্খং গদাং পঙ্কজং চক্রং বিভ্রতমিন্দিরা-বসুমতী-সংশোভিপার্শ্বদ্বয়ম্ ।
কোটিরাঙ্গদহারকুন্ডলধরং পীতাম্বরং কৌস্তভোদ্দীপ্তং বিশ্বধরং স্ববক্ষসি লসচ্ছ্রীবৎসচিহ্নং ভজে ।।
-
মন্ত্র --ওঁ নমো বিষ্ণবে
-
ভগবান বিষ্ণুর প্রণাম
------------------
ওঁ নমো ব্রাহ্মণ্যদেবায় গো- ব্রাহ্মণ্যহিতায় চ ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ ।।
পাপোহহং পাপকর্মাহং পাপাত্মা পাপসম্ভবঃ ।
ত্রাহি মাং পুন্ডরীকাক্ষং সর্বপাপহরো হরি ।।
======================================================
সূর্য এর ধ্যান
------------------
ওঁ রক্তাম্বুজাসনমশেষগুণৈসিন্ধুং, ভানুং সমস্তজগতামধিপং ভজামি ।
পদ্মদ্বয়াভয়বরান্ দধতং করাব্জৈ- র্মাণিক্যমৌলিমরুণাঙ্গরুচিং ত্রিনেত্রম্ ।।
-
মন্ত্র -- হ্রাং হ্রীং সঃ ওঁ নমো ভগবতে শ্রীসূর্য্যায়
-
সূর্যের প্রণাম
------------------
ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম ।
ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্ ।।

Written by:  Prithwish Ghosh
Share:

জ্যোতিষ বিদ্যাকে বেদের চক্ষুও বলা হয়

জ্যোতিষ হলো সেই বিদ্যা, যার দ্বারা আকাশে অবস্থিত গ্রহ স্থিতির দ্বারা অতীত, ভবিষৎ এবং বর্তমান সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি। জ্যোতিষ শাস্ত্রের অপর নাম জ্যোতিঃ শাস্ত্র। জ্যোতি শাস্ত্রের অর্থ হলো যে শাস্ত্র জীবনে আলো দেয়, প্রকাশ দেয় অর্থাৎ জ্যোতি দেয়।
.
জ্যোতিষের উৎপত্তি কবে হয়েছে এ সম্বন্ধে নিশ্চিত রূপে কিছু বলা না গেলে ও, বিশ্বের প্রাচীন গ্রন্থ বেদে জ্যোতিষের উল্লেখ আছে। জ্যোতিষ বেদেরই অংগ। বেদের ছয়টি অঙ্গ ----১) শিক্ষা ,২) কল্প, ৩) ব্যাকারণ, ৪) নিরুক্ত, ৫) ছন্দ ও ৬) জ্যোতিষ। জ্যোতিষ বিদ্যাকে বেদের চক্ষুও বলা হয়।
জ্যোতিষের উপযোগিতা বলতে গেলে এই বিশ্বসংসারের প্রতিটা মানুষ বা প্রানী গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাবের অধীন। তাদের জন্ম কোষ্ঠী অনুযায়ী প্রতিটা মানুষ পৃথক প্রকৃতির, কেউ সুন্দর কেউ অসুন্দর, কেউ মন্দ বুদ্ধি কেউ অল্প বুদ্ধ্ি, প্রত্যেকের কোষ্ঠির গ্রহ সম্নবয় অনুযায়ী তার জীবনে সুখ দুঃখের উদয় হয়। যেরূপ ঔষধি সেবন করে রোগ দূর করা যায় বা কম করা যায় সেইরূপ মানুষের জ্যোতিষিও বিশ্লেশন দ্বারা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে মানুশ সুস্থ সুখী জীবন লাভ করতে পারে। কেবল মাত্র অদৃষ্টের উপর বসে না থেকে এবিদ্যা ভাগ্য ও কর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। দৈনিক জীবনে জ্যোতিষের প্রয়োজনীয়তা অসাধারন। বিবাহ, সন্তান, ব্যবসা, চাকরী, যাত্রা, ভবন নির্মান ইত্যাদি প্রতিটা মহত্ত্বপুর্ণ জ্যোতিষ শাস্ত্রের মার্গদর্শন মানুষের জীবনে সহায়ক হয়।
জ্যোতিষের মুখ্যত দুইটি ধারা --- ১) গণিত জ্যোতিষ (Astronomy) ২) ফলিত জ্যোতিষ(Astrology)।তাই যে বিদ্যার দ্বারা মহাকাশ, নক্ষত্র ও গ্রহদের গতি অবস্থান ও চরিত্র জানা যায় সেই বিদ্যাকে গণিত জ্যোতিষ বলা হয়, আর যে বিদ্যার দ্বারা গ্রহদের অবস্থান সাপেক্ষে মানুষের জীবনে সুখ-দু:খের অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎ এর অনুমান করা হয় সেই বিদ্যাকে ফলিত জ্যোতিষ বলা হয়।
আমাদের আকাশ অনন্ত কোটি নক্ষত্র দ্বারা গঠিত। কিছু কিছু নক্ষত্র সূর্যের থেকেও কয়েক গুন বড়। যারা আমাদের থেকে এত দূরে অবস্থিত যে তাদের আলো আমাদের পৃথিবীতে পৌছাতে কয়েক বছর লেগে যায়। যদিও আলোর গতিবেগ ১,৮৬,০০০ মাইল প্রতি সেকেন্ড।
অন্য তারা গুলোর মাঝেই একটি মন্ডল আছে যা সৌর মন্ডল নামে খ্যাত। যার মাঝে সুর্য আছে এবং তার চারি দিকে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ যেমন বুধ, শুক্র, বৃহ:স্পতি ইত্যাদি ঘুর্ণায়মান। এই সব গ্রহ গুলি সুর্যের শক্তিতেই তার চারিদিকে ঘুর্ণয়মান, সুর্যের পরিমন্ডলের বাইরে এরা যেতে পারবে না। সেই জন্য এই পরিমন্ডল কে সুর্য মন্ডল বা সৌর মন্ডল বলা হয়। আমাদের সম্পুর্ন ফলিত জ্যোতিষ এই সৌরমন্ডলের উপর আধারিত।

Written by :  Prithwish Ghosh
Share:

ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বরের মন্দির

ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বর। একদা কলিঙ্গ রাজধানী ইতিহাস প্রসিদ্ধ ভুবনেশ্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অতীত ইতিহাসের সাক্ষী মন্দিরগুলিই প্রধান আকর্ষণ। পাঁচশোরও বেশি মন্দির আছে মন্দিরনগরী ভুবনেশ্বরে। এরমধ্যে উল্লেখ্য- সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত পরশুরামেশ্বর মন্দির, অষ্টম শতকে তৈরি বৈতাল মন্দির, দশম-একাদশ শতকে গড়ে ওঠা মুক্তেশ্বর মন্দির। এরই সমসাময়িক রাজারানি, ব্রহ্মেশ্বর এবং লিঙ্গরাজ মন্দির। মন্দিরগুলির গায়ের ওড়িশি ভাস্কর্যের অপরূপ শিল্পকলা দর্শককে মুগ্ধ করবে।
১০০০ খ্রীষ্টাব্দে রাজা ললাট কেশরী লিঙ্গরাজ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। বিশাল এই মন্দিরপ্রাঙ্গণে একসময় ১০৮টি মন্দির ছিল। মূল মন্দিরের উচ্চতা ১৬৫ফুট। মন্দির প্রাঙ্গণটির দৈর্ঘ্য ৫২০ ফুট ও প্রস্থ ৪৬৫ ফুট। গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি চক্রাকার লিঙ্গরাজ মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার তিনটি। কলিঙ্গ স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী মন্দিরটি বিমান, জগমোহন, নাটমন্দির ও ভোগমন্দিরে এই চারঅংশে বিভক্ত। মন্দির ও প্রাচীরের গাত্র ফুল, লতাপাতা প্রভৃতি সূক্ষ্ম কারুকার্য মন্ডিত। মন্দিরমধ্যে গণেশ, কার্তিক, পার্বতীর মূর্তি রয়েছে।
মন্দিরের কাছেই বিন্দু সরোবর। এই সরোবরকে ঘিরে গল্পকথা রয়েছে। পার্বতীর তৃষ্ণা মেটানোর জন্য শিব সমস্ত নদনদীর কাছে অনুরোধ করেন বিন্দু বিন্দু জল দেওয়ার জন্য। সেই বিন্দু বিন্দু জল থেকেই এই সরোবরের সৃষ্টি। কথিত আছে, এই সরোবরে স্নান করলে সর্বপাপ মুক্ত হওয়া যায়। চন্দনযাত্রার সময় লিঙ্গরাজ এই সরোবরে স্নান করেন।
বিন্দু সরোবরের পূর্বপাড়ে অনন্ত বাসুদেব মন্দির। প্রাচীন এই বিষ্ণুমন্দিরটি সম্ভবত ১২৭৮-এ অনঙ্গ ভীমদেবের কন্যা চন্দ্রাদেবী নির্মাণ করেন। মন্দিরের কারুকার্য দেখার মতো।
সিদ্ধারণ্য বা সিদ্ধঅরণ্যটি একসময়ে আম্রকানন বলে পরিচিত ছিল। এখন কেদারগৌরী বা গৌরীকুন্ডের প্রস্রবণটি পুণ্যপুকুর নামে খ্যাত। এখানে রয়েছে নবম শতকে তৈরি মুক্তেশ্বর মন্দিরটি। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মিশ্র প্রভাবের ভাস্কর্যে গড়া দেবমূর্তিগুলো দেখার মতো। এখানে সিদ্ধেশ্বর মন্দিরে গণেশের দন্ডায়মান মূর্তিটি অসাধারণ। মুক্তেশ্বরের বিপরীতে ৬৫০ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি পরশুরামেশ্বর মন্দির। কেদারেশ্বর মন্দিরটি ষষ্ঠ শতকের। কেদারেশ্বরে দুধগঙ্গার জলে নানা ব্যাধির উপশম হয় বলে বিশ্বাস।
সিদ্ধারণ্যের কাছে সুন্দর এক বাগিচার মধ্যে রাজারানি মন্দির। একাদশ শতাব্দীতে তৈরি সূক্ষ্ম কারুকার্য মন্ডিত এই মন্দির ৫৮ ফুট উঁচু। দেওয়ালে, থামে, কুলুঙ্গিতে নানা দেবদেবী, সুন্দরী নারীমূর্তির বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছোট ছোট কাজ দেখার মতো। কথিত আছে, রাজা উদ্যত কেশরী তাঁর রানির ইচ্ছেয় এই মন্দির গড়েন, নাম দেন রাজারানি।

Written by :  Prithwish Ghosh
Share:

কোণারক

ওড়িশার মন্দির ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নিঃসন্দেহে কোণারকের সূর্যমন্দির। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাতেও
রয়েছে এর নাম। প্রায় একহাজার বছরের স্থাপত্যের ইতিহাসের শেষ পর্যায়ে অসাধারণ এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল আর কেই বা ছিলেন এর স্রষ্টা তা নিয়ে ইতিহাসে, পুরাণে, গল্পকথায় নানান কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুরাণ মতে,
কৃষ্ণপুত্র শাম্ব পিতার অভিশাপে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হওয়ার পর চন্দ্রভাগা নদীর তীরে সূর্যের আরাধনা করেন। ১২ বছর সাধনা করার পর তাঁর রোগমুক্তি হয়। এরপর শাম্ব একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করেন। পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার ও ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরত্বে এই মন্দির। মোটামুটিভাবে, গঙ্গরাজবংশের রাজা নরসিংহদেব লাঙ্গুলীয় পুরন্দর কেশরী (১২৩৮-৬৪)-র আমলেই বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয় বলে অনেকেই মনে করেন। তবে এর প্রায় তিনশ বছর পরে মুঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল-ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে কোণারকের সূর্যমন্দিরের যে উল্লেখ পাওয়া যায় সেই বর্ণনা পড়লে মনে হয় মন্দিরটি আরও প্রাচীন। খুব সম্ভব পুরনো মন্দিরের ওপর নরসিংহদেব নতুন মন্দিরটি তৈরি করান।

কলিঙ্গ স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ওড়িশার মন্দিরগুলির চারটি অংশ - ভোগমন্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন ও দেউল। কোণারকের মন্দিরে এই নীতি পুরোপুরি মানা হয়
রথারূঢ় সূর্য এই মন্দিরের উপাস্য দেবতা। মন্দিরটিও তাই যেন গড়া রথের আদলেই। উপাস্য ভাস্করমূর্তিটি মুসলিম আক্রমনের সময়েই তৎকালীন সম্রাট মুকুন্দদেব পুরীর মন্দিরে স্থানান্তরিত করেন। রথের দুটি অংশ - মূল অংশ অর্থাৎ যেখানে রথী বসেন, তা হল বড়দেউল। আর সারথির অংশটাই জগমোহন। সূর্যের এই রথের মোট ৭টি অশ্ব- সপ্তাহের সাতবার নির্দেশ করে। একেকদিকে ১২টি করে মোট চব্বিশটি চক্র। একএকটি চক্র এক এক পক্ষকাল। এই প্রকান্ড রথটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬৬মি, প্রস্থে সবচেয়ে চওড়া অংশে ৩০.৫মি। জগমোহনের উচ্চতা ৩৯মি। মূল মন্দিরটি ছিল অন্ততঃ ৭৭মি উচ্চ।
জগমোহনের পূর্বদিকে যে সিঁড়ি আছে তার প্রত্যেকদিকে দুটি করে মোট চারটি চক্র আছে। দক্ষিণ দিকে ছিল চারটি রথাশ্ব। তার ভিতর দুটির মাথা আছে- দ্বিতীয়টির অনেকটাই এখনো অক্ষত আছে। চক্রগুলি মোটামুটি একই রকম, যদিও কারুকাজে তফাত আছে। রথচক্রগুলির ব্যাস ২.৭৪মি, এতে আটটি বড় স্পোক এবং আটটি ছোট স্পোক আছে। বড় স্পোকগুলির মাঝে মোট আটটি এবং চক্রের মাঝে একটি গোলাকার অংশ রয়েছে। তাতে স্ত্রী, পুরুষ, মিথুনচিত্র, দেবদেবীর মূর্তি খোদিত রয়েছে।
সবার নিচে উপান অংশে আছে হাতির সারি, শিকারের দৃশ্য, শোভাযাত্রার দৃশ্য। উপানের ওপরের অংশের ভিতর পাটায় জীবজন্তুর চিত্র ও নানান নকশা কাটা। তলজঙ্ঘাতে কিছু দূরে স্তম্ভের কুলুঙ্গিতে নানান দৃশ্য। দুটি স্তম্ভের মাঝে কখনও দুটি বা তিন-চারটি খাড়া পাথর। এই খাড়া পাথর গুলিতেও নানা ভাস্কর্যের নিদর্শন- মিথুনমূর্তি, অলসকন্যা, বিরাল অথবা নাগমূর্তি। তলজঙ্ঘার ওপরে বন্ধনের তিনটি অংশে নানান নকশা কাটা। উপর জঙ্ঘাতে, নিচের তলজঙ্ঘার স্তম্ভের ওপর আবার একটি করে পদ্মশীর্ষ অর্ধস্তম্ভ, তলজঙ্ঘার মূর্তিগুলির ঠিক ওপর ওপর এখানেও একসারি মূর্তি।
ওপর জঙ্ঘার ওপরে বড়ণ্ডি অংশও অক্ষত নেই। এর কিছুটা ঝোলা বারান্দার মত বাইরে বেরিয়ে আছে। তার গায়ে অপরূপ নকশাকাটা। জগমোহনের তিনদিকে তিনটি দরজা। পূর্বদিকে সিংহদ্বার। তিন দরজার পর বিস্তৃত চাতাল শেষে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। চতুর্থদিক অর্থাৎ পশ্চিমদিকে বড় দেউলে যাবার দ্বার। জগমোহনটি পঞ্চরথ পীড় দেউল বা ভদ্রদেউল। বাড় অংশে পাঁচ ভাগ- পা-ভাগ, তল জঙ্ঘা, বন্ধন, উপর জঙ্ঘা এবং বরণ্ডি। পা-ভাগের ওপরে তল-জঙ্ঘায় দুই জোড়া করে অর্ধস্তম্ভের মাঝে মাঝে কুলুঙ্গি করা হয়েছে। তাতে অপেক্ষাকৃত বড় মূর্তিগুলি ছিল, যার অনেকগুলিই এখন আর নেই। অলসকন্যা, মিথুনমূর্তি এখনও কিছু কিছু আছে আর রয়েছে রাহাপাগের উল্লম্বনরত বিড়াল, কোনাপাগ ও অনুরথ পাগের খাঁজে গজবিড়াল ও রাক্ষস বিড়ালের মূর্তিগুলি। উপর জঙ্ঘার পরিকল্পনা তলজঙ্ঘার মতই। সবার ওপরে বড়ণ্ডিতেও নানান নকশা রয়েছে।
বড় দেউলের তিনদিকে সূর্যদেবের তিন মূর্তি - দক্ষিণে দন্ডায়মান পূষা, পশ্চিমে দন্ডায়মান সূর্যদেব ও উত্তরে অশ্বপৃষ্ঠে হরিদশ্ব। জগমোহনের পূর্বদ্বারের সামনে ছিল একটি ধ্বজস্তম্ভ। তার শীর্ষে ছিল সূর্যসারথি অরুণের মূর্তি। এই মূর্তিটি এখন পুরীর মন্দিরে আছে।
জগমোহনের তিনদ্বারের সামনে সোপানের কাছে ও মন্দিরের চত্ত্বরের ভিতরেই প্রকান্ড পাদপীঠের ওপর রয়েছে তিনজোড়া বিশালকায় মূর্তি। উত্তরদ্বারের দিকে দুটি হস্তি, দক্ষিণদ্বারে দুটি অশ্ব এবং পূর্বদ্বারে হস্তিদলনকারী শার্দুল মূর্তি।
পীর দেউলের গন্ডিতে তিন পোতাল। প্রথম পোতালের চাতালের চারদিকে চারটি করে মোট ষোলটি কন্যামূর্তি। আর রাহা অবস্থানে ঝুঁকে থাকা আটটি নৃত্যশীল ভৈরবমূর্তি। দ্বিতীয় পোতালেও ষোলটি কন্যামূর্তি। তৃতীয় পোতালে রয়েছে করালদ্রংস্ট্রা সিংহ। তার ওপরে ঘন্টা-শ্রী, আমলক প্রভৃতি। কন্যামূর্তিগুলি সম্ভবত নৃত্যরতা দেবদাসীর। কঙ্কন, কেয়ূর, শতনরী, কর্ণাভরণ মুকুট - অলঙ্কারে শোভিত দেবদাসীদের কেউবা পাখোয়াজ, মাদল, বাঁশি, খঞ্জনি, করতাল, ঝাঁঝর হাতে গীতবাদ্যে মত্ত, কেউবা দর্পনহাতে ব্যস্ত প্রসাধনে। মূল মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমে সূর্যপত্নী মায়াদেবীর মন্দির। মন্দিরে পাওয়া ভাস্কর্যের বেশকিছু নিদর্শন নিয়ে কাছেই কোণারক মিউজিয়াম। শুক্রবার ছাড়া রোজই খোলা থাকে।
কোণারক থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে চন্দ্রভাগা সংগম- চন্দ্রভাগা নদী মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। এখানে সূর্যাস্ত অপরূপ। কোণারক থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কুরুম গ্রামে আবিস্কৃত হয়েছে বৌদ্ধযুগের ধ্বংসাবশেষ। ভূমিস্পর্শ বুদ্ধমূর্তি এবং ১৭ মিটার লম্বা ইঁটের প্রাচীর দ্রষ্টব্য। হিউয়েন সাঙের ভ্রমণকাহিনিতেও এর উল্লেখ আছে।
কোণারক থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্বে কুশভদ্রী নদী ও সমুদ্রের মোহনায় দেবী রামচন্ডীর মন্দির। কোণারক থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে কাকতাপুরে মঙ্গলাদেবী ও বনদুর্গার মন্দির। কাকতাপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অস্তরঙ্গা লবণ তৈরি এবং মাছ ধরার কেন্দ্র, এখানে সূর্যাস্তও ভারি সুন্দর। কাকতাপুর থেকে কোণারকের পথে ১৪ কিলোমিটার দূরে চৌরাশি। এখানে রয়েছে নবম শতকের তান্ত্রিক দেবী বরাহমাতার মন্দির আর অমরেশ্বর লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির।
নি। এখানে নাটমন্দির নেই। দেউল ও জগমোহন মিলিয়ে একটা ইউনিট হিসেবে তৈরি হয়েছিল। এখন আমরা কোণারকে যে মন্দিরটি দেখতে পাই সেটি মন্দিরের জগমোহন ও ভোগমন্ডপ অংশ। মূল মন্দির বা রেখ দেউল বহু শতাব্দী আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষপদে যবন আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল মন্দিরটি। ক্রমশঃ কালের গহ্বরে তা বিলীন হয়ে যায়। ১৮২৫ সালে এস্টারলিং-এর বর্ণনায় রেখ দেউলের ভগ্নাবশেষের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৩৭ সালে জেমস ফার্গুসনের হাতে আঁকা ছবিতে রেখ দেউলের একটা অংশ দেখা যায় যার উচ্চতা ছিল ১৪০-১৫০ফুট। অর্থাৎ বর্তমান জগমোহনের চেয়ে উঁচু। কোণারক মন্দিরের প্রকৃত সংরক্ষণ শুরু হয় ১৯০১ সালে, লর্ড কার্জনের আমলে। পুরাতত্ত্ববিদ জন হান্টারের নেতৃত্বে রথের চাকা আর রথের ঘোড়া বালি সরিয়ে বের করে আনা হয়। জগমোহনের ভেতরটাও এই সময়েই বালি দিয়ে বুজিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

Written by: Prithwish Ghosh

Share:

বিশ্বামিত্র

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে বিশ্বামিত্র মহারাজ গাধির পুত্র। উল্লেখ্য গাধির সত্যবতী নামে একটি কন্যা ছিল। এই কন্যার সাথে ঋচিক নামক এক ঋষির সাথে বিবাহ হয়। বিশ্বামিত্রের জন্ম সম্পর্কিত বিষয় ঋচীক চরিত্রের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। ইনি ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও তপস্যার দ্বারা ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন। যথাসময়ে বিশ্বামিত্র উত্তরাধিকার সূত্রে রাজত্ব লাভ করেন। একবার তিনি মৃগয়ায় গিয়ে দারুণ পিপাসার্ত হয়ে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রয়ে উপস্থিত হন। এখানে ইনি বশিষ্ঠের কামধেনু দেখে তা পাবার জন্য বশিষ্ঠের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
ত্রিশঙ্কু সসরীরে স্বর্গে যাবার ইচ্ছাকে কার্যকরী করার সূত্রে ইনি নিজ তপোবলে শূন্যে দ্বিতীয় স্বর্গ তৈরি করা শুরু করেন। এই সময় সপ্তর্ষিমণ্ডলেরও জন্ম হয়। দেবতারা এই দৃশ্য দেখে অত্যন্ত ভীত হয়ে বিশ্বামিত্রের কাছে আসেন। অবশেষে স্থির হয় যে- ত্রিশঙ্কু জ্যোতিশ্চক্রের বাইরে দেবতুল্য নক্ষত্ররূপে বিরাজ করবে এবং অন্যান্য নক্ষত্রসমূহ তাঁকে অনুসরণ করবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে তপস্যার বিঘ্ন হওয়ায় বিশ্বামিত্র পশ্চিমাংশের পুস্করতীর্থবনে তপস্যা শুরু করেন। এই সময় অযোদ্ধার রাজা অম্বরীষ এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। ইন্দ্র এই যজ্ঞের পশু হরণ করলে- যজ্ঞের পুরোহিত এর বিকক্প হিসাবে নরবলি দিতে বলেন। অম্বরীষ অনুসন্ধান করে বলির উপযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে ঋচীকের মধ্যমপুত্র শুণঃশেফকে নির্বাচন করেন। রাজা শুণঃশেফকে ধরে আনার সময় বিশ্বামিত্রের আশ্রমে উপস্থিত হলে- শুণঃশেফ বিশ্বামিত্রের কাছে প্রাণভিক্ষা করেন। বিশ্বমিত্র তখন শুণঃশেফকে অগ্নিদেবের স্তব করতে বলেন। এই স্তবে অগ্নিদেব সন্তুষ্ট হয়ে যজ্ঞের আগুন থেকে তাঁকে রক্ষা করেন। পরে বিশ্বামিত্র তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। এরপর বিশ্বামিত্রের কঠোর তপস্যায় সন্তষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে ঋষিত্ব প্রদান করেন। কিন্তু বিশ্বামিত্র এবারেও সন্তুষ্ট না হয়ে আবার তপস্যা শুরু করেন।
ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের কঠোর তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য মেনকা নামক অপ্সরাকে পাঠান। প্রথমে তেজস্বী বিশ্বামিত্রের কাছে মেনকা যেতে রাজি হন নাই। কিন্তু ইন্দ্রের আদেশে তাঁকে শেষ পর্যন্ত বিশ্বামিত্রের কাছে যেতেই হয়। তবে যাবার আগে মেনকা ইন্দ্রের কাছে এরূপ বর প্রার্থনা করেন, যেন বিশ্বামিত্রের ক্রোধাগ্নি তাকে দগ্ধ করিতে না পারে। এরপর মেনকার অনুরোধে তাকে সাহায্য করার জন্য, বায়ু তার সাথে যায়। মেনকা তপস্যারত বিশ্বামিত্রের সামনে গিয়ে ক্রীড়া-কৌতুক শুরু করে। একসময় বায়ু মেনকার বসন অপহরণ করলে বিশ্বামিত্র তা দেখে মুগ্ধ হন এবং মেনকার সাথে মিলিত হন। কিছুদিন পর মেনকা গর্ভবতী হলে, মেনকা হিমালয়ের পাদদেশে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে এবং সদ্যজাতা কন্যাকে মালিনী নদীর তীরে নিক্ষেপ করিয়া দেবরাজসভায় প্রস্থান করে। এই সময় কিছু শকুন এই কন্যাকে রক্ষা করেন। কণ্ব মুনি শকুন পাখি পরিবেষ্টিত অবস্থায় এই কন্যাকে পেয়ে আশ্রমে নিয়ে আসেন। শকুন্ত পাখি দ্বারা রক্ষিত হয়েছিল বলে কন্যার নাম রাখেন শকুন্তলা।
বিশ্বামিত্র এবার স্থান ত্যাগ করে উত্তরদিকে যান এবং হিমালয়ের কৌশিকী নদীর তীরে আশ্রম নির্মাণ করে তপস্যা করতে থাকেন। এবার তিনি ব্রহ্মার বরে মহর্ষিত্ব লাভ করেন। সেই সাথে ব্রহ্মা তাঁকে ইন্দ্রিয় জয় করতে বললেন। ব্রহ্মার কথা অনুসারে তিনি আবার তপস্যা শুরু করেন। ইন্দ্র এই তপস্যা ভাঙার জন্য রম্ভা নামক অপ্সরাকে পাঠান। এবার ইনি রম্ভাকে সহচরী হিসাবে গ্রহণ না করে অভিশাপের দ্বারা পাথরে পরিণত করেন। কিন্তু ক্রোধের বশে এই অভিশাপ দেওয়ায় তাঁর তপস্যার ফল নষ্ট হয়- ফলে তিনি আবার তপস্যা শুরু করেন। দীর্ঘ তপস্যার পর ব্রহ্মা তাঁকে ব্রাহ্মণত্ব দান করেন।
বশিষ্ঠ মুনি রাজা হরিশচন্দ্রের প্রশংসা করলে- ইনি তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য কৌশলে রাজার সকল সম্পত্তি হরণ করেন। এরপর ইনি রাজার কাছে দক্ষিণা প্রার্থনা করেন। দক্ষিণার অর্থ সংগ্রহ করার জন্য হরিশচন্দ্র কাশীতে উপস্থিত হন। সেখানে যথাসময়ে দক্ষিণার অর্থ সংগ্রহ করতে না পেরে রাজা তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে এক ব্রাহ্মণের কাছে এবং নিজেকে এক চণ্ডালের কাছে বিক্রয় করেন। এই সময় রাজার পুত্র সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করলে- মৃত পুত্রকে নিয়ে রাজমহিষী শ্মশানে আসেন। শ্মশানে হরিশচন্দ্রের সাথে রাজমহিষীর দেখা হলে উভয়ই বিলাপ করতে থাকেন। এরপর বিশ্বামিত্র উপস্থিত হয়ে হরিশচন্দ্রের আত্মত্যাগের প্রশংসা করে, তাঁর মৃত পুত্রের জীবনদান করেন এবং রাজ্যপাট ফিরিয়ে দেন।
মার্কেণ্ডয় পুরাণের হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান মতে- বশিষ্ঠ মুনি বার বত্সর গঙ্গায় বসবাসের পর জল থেকে উঠে এসে হরিশচন্দ্রের বিবরণ শুনে- বিশ্বামিত্রকে বক পাখি হওয়ার অভিশাপ দেন। বিশ্বামিত্রও তাঁকে আড়ি পাখি হওয়ার অভিশাপ দেন। পরে আড়ি-বক যুদ্ধ শুরু করলে- পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়। পরে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় এই বিরোধের অবসান ঘটে। এরপরে বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠ পরস্পরের মিত্র হয়ে যান।
রামায়ণের মতে- বিশ্বামিত্রের যজ্ঞনাশের জন্য রাক্ষসেরা সচেষ্ট হলে- রাজা দশরথের অনুমতিক্রমে ইনি রাম-লক্ষ্মণকে নিজের আশ্রমে নিয়ে যান। পথে তিনি এঁদের দুজনকে অবলা ও অতিবলা মন্ত্রসহ বিভিন্ন অস্ত্রদান করেন। রাম এই সকল অস্ত্রের সাহায্যে তাড়কা রাক্ষসীকে হত্যা করেন। এরপর বিশ্বামিত্র এই দুই ভাইকে নিয়ে মিথিলা নগরীর পথে রওনা হন। পথে ইনি রামের স্পর্শ দ্বারা অহল্যার অভিশাপ মোচন করান। মিথিলা নগরীতে পৌঁছে ইনি রামকে দিয়ে হরধনু ভঙ্গ করান এবং সীতার সাথে রামের এবং লক্ষ্মণের সাথে উর্মিলার বিবাহ দেন। ইনি শীলাবতীর সাথে মিলিত হলে এঁর একটি পুত্র সন্তান জন্মে। এই পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল কতি। পরবর্তীতে কতি থেকে কাত্যায়নি বংশের পত্তন হয়েছিল।

Written by :  Prithwish Ghosh
Share:

মানবদেহের সাত চক্র

দেহচক্রের কথা শুনলেই আমরা একটু চিন্তিত হয়ে যাই। মনের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন উকিঁঝুকি দিতে থাকে। আমাদের দেহে আবার চক্র আসবে কোথা থেকে? এ চক্রগুলো কোথায় থাকে, এ চক্রগুলোর কাজ কী ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকেই জানি না, আমাদের দেহে একটি দুটি নয়, সাত সাতটি চক্র আছে। আমরা বেশির ভাগ সময় অনেক গোপন সত্য জানা থেকে পিছিয়ে থাকি। আমাদের দেহের নিম্নাঙ্গে, তলপেটে, নাভিতে, হৃদয়ে, কণ্ঠে, দু চোখের মাঝে ও মাথার ওপরে আছে সাতটি চক্রের অবস্থান। চক্রগুলো হলো, মূলাধার চক্র, স্বাধিষ্ঠান চক্র, নাভিচক্র, হৃদচক্র, বিশুদ্ধ চক্র, আজ্ঞা চক্র ও সহস্রার চক্র।
-
দেহ একটা রঙের বাক্সের মতো। 'দিব্যশক্তি' শিশুর মতো এ দেহে রঙতুলি নিয়ে নানা ভঙ্গিমায় খেলা করতে থাকে। খেলার জন্য তার পছন্দের জায়গা ‘চক্র’। এক-একটি চক্র তার কাছে এক-একটি প্লে-গ্রাউন্ড। খামখেয়ালিভাবে সে চক্রে চক্রে নেচে বেড়ায়। তার নৃত্যের তালে তালে আমাদের জীবন হয়ে উঠে ছন্দোময়, প্রেমময় ও আলোময়। তাই ইংরেজি ‘হিউম্যান বিইং’ শব্দটি মানুষের জন্য সঠিকভাবে প্রযোজ্য। Human Being=`Hue+ Man+ Being’ where Hue means Color, Man means Manifestation and Being means Light. অর্থাৎ হিউম্যান বিইং অর্থ ‘রঙরূপ আলো’। প্রতিটি চক্রের সাথে দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িত। যখন যে চক্রে দিব্যশক্তি খেলা করে তখন সে চক্রের ওপর ভাল-মন্দ দুরকমের প্রভাব পড়ে। যেমন, বিশুদ্ধ চক্রে খেলা করলে কথা বলার শক্তি ও গানের সুরধারা আসে। আবার সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা ও মন খারাপ হয়ে থাকে। এভাবে অন্যান্য চক্রের ওপরও প্রভাব ফেলে থাকে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ দিব্যশক্তির এই খেলায় এক পর্যায়ে সব মন্দ হয়ে ওঠে ভালো। এমনকি রোগ সারানোসহ বিভিন্ন মিরাকলও ঘটে।
-
এবার জানা যাক চক্র বিষয়ে -----
-
মূলাধার চক্র (Root/Ovaries/Testes)
-
মূলাধার চক্র দেহের মেরুদন্ডের শেষ প্রান্তে বা নিম্নাংশে অবস্থিত। এটিকে কুণ্ডলিনী বলে। এ চক্রের চারটি দল। এর রঙ লাল। এটি আমাদের চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ চক্রটি চেতন থেকে অবচেতন পর্যন্ত বিস্তৃত। জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি- এ চারটির নিয়ামক এ চক্র। কামশক্তির আধার এটি। এটিতে আছে অস্থিধাতুর শক্তি। এ চক্রে দিব্যশক্তি খেলা করলে কামনা বাড়ে। জন্ম হয়। মৃত্যু হয়। রোগ হয়।
-
স্বাধিষ্ঠান চক্র (Abdomen/Pancreas glands)
-
স্বাধিষ্ঠান চক্র দেহের তলপেট বা অগ্নাশয় নিয়ে গঠিত। এ চক্রের ছয়টি দল। এর রঙ গাঢ় গোলাপি। এটি আমাদের লোভ, কামনা, বাসনা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটিতে আছে মেদ ধাতুর শক্তি। এ চক্রে দিব্যশক্তির নৃত্যে কামনা বাড়ে। বাসনা বাড়ে। লোভ বাড়ে। বমি হয়। ডায়ারিয়া হয়। ভয় কাজ করে।
-
মণিপুর বা নাভিচক্র (Solar plexus/Adrenal glands)
-
মণিপুর চক্র দেহের নাভি বা বৃক্কাশয় বা পাকস্থলির নিচের শিরাজাল নিয়ে গঠিত। এ চক্রের দশটি দল। এটির রঙ বেগুনি। এটি আমাদের উচ্চ চেতনা, জীবনীশক্তি, আবেগ, বাসনা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটিতে আছে মাংসধাতুর শক্তি। তেজশক্তির আধার এটি। এ চক্রে দিব্যশক্তি মণিপুরি নৃত্য করে। দিব্যশক্তির উন্মাদ নাচের তালে দেহের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়। পেটের পীড়া হয়।
-
অনাহত বা হৃদচক্র (Heart/Thymus gland)
-
হৃদচক্র আমাদের বুকের মাঝখানে অবস্থিত। এ চক্রের বারটি দল। এর রঙ সোনালি-গোলাপি। এটি আমাদের আবেগ, রাগ-অনুরাগ, প্রেম, বিরহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটির অনেক গভীরে আত্মা থাকে। এটিতে আছে রক্ত ধাতুর শক্তি। এ চক্রে দিব্যশক্তির খেলায় রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। প্রেম-ভালবাসা হয়। বিরহ আসে। বুক-পিঠ ব্যথা করে। হৃদরোগ হয়।
-
বিশুদ্ধ চক্র (Throat/Thyroid gland)
-
বিশুদ্ধ চক্র আমাদের কণ্ঠে অবস্থিত। এ চক্রের ষোলটি দল। এর রঙ ধূসর। এটি আমাদের ভাবপূর্ণ মন ও বাহির মনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ চক্র মানসিক শক্তি ও মনের সব ভাব প্রকাশ করে থাকে। এটিতে আছে স্নিগ্ধশক্তি। এ চক্রে শিশু খেলা করলে কথা বলার শক্তি আসে। গানের সুর আসে। সর্দি, কাশি, গলা-ঘাড় ব্যথা ও মন খারাপ হয়।
-
আজ্ঞা চক্র (Third Eye/Pineal gland)
-
আজ্ঞা চক্র আমাদের দু ভুরুর মাঝখানে অবস্থিত। এ চক্রের দুটি দল। এর রঙ সাদা। এটি আমাদের গতিময় মন, ইচ্ছা, দিব্যদৃষ্টি, মানসিক গঠন ও মনের সব চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটিতে আছে মজ্জা ধাতুর শক্তি। এ চক্রে দিব্যশক্তির খেলায় মন কাজ করে। চিন্তাশক্তি আসে। ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আসে। কবিতা, উপন্যাস লেখাসহ সব সৃষ্টিশীল কাজ করার ক্ষমতা আসে। মাথা ঘোরায়। কখনও কখনও মাথা চিন্তাশূন্য হয়ে পড়ে।
-
সহস্রার চক্র (Crown/Pituitary gland)
-
সহস্রার চক্র আমাদের মাথার ঠিক ওপরে অবস্থিত। এ চক্রের সহস্রটি দল। এটিতে নির্দিষ্ট কোনো রঙ নেই। এটি আমাদের উচ্চ চেতনা বা অধিচেতনা, অর্ন্তদৃষ্টি, বোধিসত্ব চেতনা, দিব্য চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটির তিনটি অংশ আছে : সচ্চিদানন্দ (সৎ, চিৎ, আনন্দ), নিচ থেকে উপরে আনন্দ অংশ, এর উপরে চিৎ (দর্পণ) অংশ এবং এরও উপরে সৎ (মহাশূন্যতারুপী অন্ধকার) অংশ। এ চক্রে দিব্যশক্তির খেলায় দিব্যজ্ঞান আসে। মানুষ জাগতিক ও মহাজাগতিক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে জানতে পারে। মাথার তালু জ্বলে যায়।
আমাদের দেহের চক্রগুলো একই সাথে গোলাকার ও লম্বাকার। সব চক্রের কেন্দ্র হৃদয় বা অনাহত বা হৃদচক্র। চক্রগুলো সবসময় দেহের মধ্যে সক্রিয় থাকে। প্রতিটি চক্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটিতে কাজ হলে অন্যটির উপরও প্রভাব পড়ে। প্রতিটি চক্র দেহের সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী দিব্যশক্তি কাজ করে থাকে, অন্যদিকে উল্টাটাও সত্য।
বিভিন্ন যোগী, ঋষি, সাধক-সাধিকারা এই চক্রের অনুশীলন করে থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে এটি করা কঠিন। কেউ যদি নিজে নিজে এটি করতে চান, করতে পারেন কিন্তু এতে ঝুঁকি থেকে যায়। এজন্য একজন গুরু বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসা প্রয়োজন।

Written by : Prithwish Ghosh
Share:

নবগ্রহ প্রণাম মন্ত্র এবং গ্রহ বীজ মন্ত্র

নবগ্রহ প্রণাম মন্ত্র 
=============
ওঁ জবাকুসুমসংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্ ।
ধ্বান্ত্যারিং সর্বপাপঘ্নম্ প্রণতোহশ্মি দিবাকরম্ ॥
দিব্যশঙ্খতুষারাভং ক্ষীরোদার্নভসম্ভবম্ ।
নমামি শশীনং ভক্তা শম্ভোর্মুকুটভূষণম্ ॥
ধরণীগর্ভোসম্ভূতং বিদ্যূতপুঞ্জসমপ্রভম্ ।
কুমারং শক্তিহন্তস্চ লোহিতাঙ্গং প্রণম্যহং ॥
প্রিয়ঙ্গুকলিকাশ্যমং রূপেনাপ্রতিমং বুধম ।
সৌম্যং সৌম্যগুণপেতং নমামি শশীনংসুতম্ ॥
দেবতানাংম্রিশিনান্চং গুরুং কনকসন্নিভং ।
বন্দে ভক্তা ত্রিলোকেশং ত্বং নমামি বৃহস্পতিম্ ॥
হিমকুন্দমৃণালাভং দৈত্যানাং পরমং গুরুম্ ।
সর্বশাস্ত্রপ্রবক্তারং ভার্গবং প্রণম্যহ্ ॥
নিলাঞ্জনংচয়প্রক্ষ্যং রবিসূতং মহাগ্রহম্ ।
ছায়ায়ং গর্ভসম্ভূতং বন্দেভক্তা শণৈশ্চরম ॥
অর্দ্ধকায়াং মহাঘোরং চন্দ্রাদিত্যবিমর্দকম
সিংহিকায়া মহারৌদ্রং ত্বং রাহুং প্রণম্যহম্ ॥
পলাশধূমসংকাশং তারাগ্রহবির্মদকম ।
রৌদ্রং রৌদ্রত্বকং ঘোরং ত্বং কেতুং প্রণম্যহম্ ॥
গ্রহ বীজ মন্ত্রঃ 
========
সূ্র্য্য মন্ত্র -- ওঁ হ্রীং হ্রীং সূর্য্যায়ঃ । জপ সংখ্যা ৬০০০ বার । দেবতা-মাতঙ্গী । ধূপ-গুগুল । বার-রবিবার । প্রশস্ত- সকাল ১২ টা পর্যন্ত ।
চন্দ্র মন্ত্র -- ওঁ ঐং ক্লীং সোমায়ঃ । জপ সংখ্যা ১৫০০০ বার । দেবতা-কমলা । ধূপ- সরলকাষ্ঠ । বার-সোমবার । প্রশস্ত-সন্ধা ৬-৯ পর্যন্ত ।
মঙ্গল মন্ত্র -- ওঁ হুং শ্রীং মঙ্গলায়ঃ । জপ সংখ্যা-৮০০০ বার । দেবতা-বগলামুখী । ধূপ-দেবদারু । বার-মঙ্গলবার । প্রশস্ত-সকাল ১২ টা পর্যন্ত ।
বুধ মন্ত্র -- ওঁ ঐং স্ত্রীং শ্রীং বুধায়ঃ । জপ সংখ্যা-১০০০০ বার । দেবতা-ত্রিপুরাসুন্দরী । ধূপ-সঘৃত দেবদারু । বার-বুধবার । প্রশস্ত-বেলা ১২টা পর্যন্ত ।
বৃহস্পতি মন্ত্র -- ওঁ হ্রীং ক্লীং হুং বৃহস্পতয়ে । জপ সংখ্যা-১৯০০০ বার । দেবতা-তারা । ধূপ-দশাঙ্গ । বার-বৃহস্পতিবার । প্রশস্ত-বেলা ১২ পর্যন্ত ।
শুক্র মন্ত্র -- ওঁ হ্রীং শুক্রায়ঃ । জপ সংখ্যা-২১০০০ বার । দেবতা-ইন্দ্র । ধূপ-গুগুল । বার-শুক্রবার । প্রশস্ত-সন্ধ্যাবেলা ।
শণি মন্ত্র -- ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং শনৈশ্চরায়ঃ । জপ সংখ্যা ১০০০০ বার । দেবতা-দক্ষিনাকালী । ধূপ-কৃষ্ণাগুরু ।বার শনিবার । প্রশস্ত সন্ধ্যাবেলা ।
রাহু মন্ত্র -- ওঁ ঐং হ্রীং রাহবে । জপ সংখ্যা-১২০০০ বার । দেবতা-ছিন্নমস্তা । ধূপ-দারুচিনি । বার-শনি/মঙ্গল বার । 
প্রশস্ত সন্ধ্যাবেলা ।
কেতু মন্ত্র -- ওঁ হ্রীং ঐং কেতবে । জপ সংখ্যা-২২০০০ বার । দেবতা-ধূমাবতী। ধূপ-মধূযুক্ত দারুচিনি । বার-শনি/মঙ্গল বার । 
প্রশস্ত সন্ধ্যাবেলা ।

Written by :  Prithwish Ghosh
Share:

অন্যপ্রকার গ্রহ-প্রতিকার জপমন্ত্র


রবি -- ওঁ হ্রাং হ্রীং হ্রং সঃ সূর্যায় নমঃ -- জপসংখ্যা ৬০০০ বার
চন্দ্র -- ওঁ শ্রাং শ্রীং শ্রং সঃ চন্দ্রায় নমঃ -- জপসংখ্যা -- ১৫০০০ বার
মঙ্গল -- ওঁ ক্রাং ক্রীং ক্রং সঃ ভৌমায় নমঃ -- জপসংখ্যা -- ৮০০০ বার
বুধ -- ওঁ ব্রাং ব্রীং ব্রং সঃ বুধায় নমঃ -- জপসংখ্যা -- ১৭০০০ বার
বৃহস্পতি -- ওঁ গ্রাং গ্রিং গ্রং সঃ গুরুবৈ নমঃ -- জপসংখ্যা -- ১৯০০০ বার
শুক্র -- ওঁ দ্রাং দ্রিং দ্রং সঃ শুক্রায় নমঃ -- জপসংখ্যা -- ২১০০০ বার
শনি -- ওঁ প্রাং প্রিং প্রং সঃ শনৈ নমঃ -- জপসংখ্যা -- ১০০০০ বার
রাহু -- ওঁ ভ্রাং ভ্রিং ভ্রং সঃ রাহবৈ নমঃ -- জপসংখ্যা -- ১২০০০ বার
কেতু -- ওঁ স্ত্রাং স্ত্রিং স্ত্রং সঃ কেতবৈ নমঃ -- জপসংখ্যা --১২০০০ বার
.
> কেবল দীক্ষিত ব্যক্তিরাই জপফল প্রাপ্ত হ'ন, টিভি অনুষ্ঠানে বসে অনেক জ্যোতিষীই মন্ত্র জপের পরামর্শ দেন, যা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক।
> গুরুদেবের মুখ থেকে মন্ত্র শুনে ও মন্ত্রের অর্থ জেনে তবেই মন্ত্র জপ করা উচিত কর্তব্য।
Written by:  Prithwish Ghosh

Share:

মহাদেব, শিব, অনাদি অনন্ত কত রূপে বিরাজ করছেন তিনি

একধারে তিনি পঞ্চানন, পাঁচ টি তাঁর আনন বা মুখ আর নয়ন তিনটি । তৃতীয়টি তাঁর জ্ঞান নয়ন । জ্ঞান ত’ অগ্নি স্বরূপ । সব আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে চারিদিক আলোকিত করে তোলে। এই রূপে তিনি সগুণ ঈশ্বর ।ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা , জীবের নিয়ন্তা, দেবী তাই ত বললেন, “ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে”। পঞ্চভুত ত’ তাঁর ইঙ্গিতেই নাচছে। আরও বলছেন দেবী, “অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম।” বিশ্বনাথ তিনি; তিনি যে জগতের পতি, হলাহল পান করে তিনিই ত’ সৃষ্টি রক্ষা করেছিলেন,  তাই ত তাঁর কণ্ঠ ভরা বিষ। “কুকথায় পঞ্চমুখ” – তারও যেন কি একটা অর্থ আছে,  কুকথা মানে কিন্ত গালাগালি বা খারাপ কথা নয়, সেকি চতুর্বেদেরও ওপারে যে তত্ব আছে তারই ইঙ্গিতই করছে?
তবে, এইখানেই শেষ নয় অন্য আরেক দিক দিয়ে দেখতে গেলে শিব নির্গুণ ব্রহ্মও বটেন। তাই ত দেবী বললেন, “অতিবড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ। কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন”
আবার জীব রূপে এই শিবই ত’ এই বিশ্বচরাচর ছেয়ে আছেন । আপন প্রকৃতিকে অবলম্বন করে তিনিই ত জীব সেজে হাসছেন, কাঁদছেন, নাচছেন, সংসার সংসার খেলা খেলে চলেছেন।
অবশ্য জীব সাজতে গিয়ে শিব কে প্রকৃতির সাহায্য নিতে হয়েছে । শাস্ত্র বলে, প্রকৃতির দুইটি রূপ পরা আর অপরা।
গিরিরাজকন্যা পার্বতী  শান্ত সমাহিত সেই দৈবী পরা প্রকৃতির প্রতীক ।
আর গঙ্গা? তাঁর অপরা প্রকৃতির প্রতীক, যাকে অবলম্বন করে শিবের জীবলীলা।
তাই ত’ দেবী বলছেন, “গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি, জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি”।
গঙ্গা যে উচ্ছল তরঙ্গায়িত সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় সে চলার নেশায়. । শিবের এই বিশ্বলীলার ধারক ও বাহক সে তাকেই অবলম্বন করে, যে স্বরূপত শিব, তার এই জীব জীব খেলা।
এ খেলা খেলা হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। আরও কতদিন চলবে কে তা জানে?
তবে একদিন নিশ্চয়ই আসবে যেদিন হয়ত শিবের এই খেলা সাঙ্গ করার সাধ হবে  কিম্বা হয় ত এই সাধও এই খেলারই এক অঙ্গ। সে যাই হক, সেদিন শিবেরই জটা জালে আবদ্ধা হবে তরঙ্গময়ী উচ্ছল গঙ্গা। তাঁরই মঙ্গলময় স্পর্শে নিয়ন্ত্রিতা হবে তাঁর এই জীব প্রকৃতি। ধীরে ধীরে সেই চপলা প্রকৃতির মাঝে জেগে ওঠবে এক কল্যাণময় রূপ ।
পর্বত কন্দরে যার জন্ম, পার্বতীর সেই সতীন কেমন করে যেন রূপান্তরিত হতে থাকবে? আসলে তার আর পার্বতীর মধ্যে স্বরূপত ত’ কোন ভেদ নেই। তাই সাগরের বুকে নিজেকে বিলীন করে গঙ্গা আবার ফিরে যাবে সেই গিরি পর্বতের মাঝে।
পার্বতীর সতীন তখন পার্বতীরই বুকের মাঝে লীন হয়ে যাবে। আর জীব হয়ে যাবে শিব।
সেই জীব রূপী শিব তখন বলে ওঠবে, ওম তত সৎ ওম... ওম তত সৎ ওম. ।

Written by : Prithwish Ghosh
Share:

শনির দৃষ্টি


৯-এ নবগ্রহ। আর নবগ্রহের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে সুপরিচিত গ্রহটি হল শনি ওরফে শনৈশ্চর। ‘শনির দৃষ্টি’বা ‘শনির দশা’ কথাটা রাজ্যের যত অশুভ ও অমঙ্গলের সমার্থক শব্দ; এমনই শনির কুখ্যাতি! যাঁর দৃষ্টিতে গণেশের মতো জাঁদরেল দেবতার মুন্ডু উড়ে যেতে পারে, তাঁর কাছে মানুষ তো কোন ছাড়! আর তাই স্বর্গপাড়ার এই মস্তান-দেবতাটিকে তুষ্ট করতে ভারতের পথে-ঘাটে-ফুটপাথে কিংবা প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে মন্দিরে প্রতি শনিবার বসে বারোয়ারি শনিপুজোর আসর; গ্রহবিপ্রেরা এই ‘মারণ’ দৃষ্টির কোপ থেকে মানুষকে বাঁচাতে দেন হরেক রকমের গ্রহশান্তির বিধান।

 
কিন্তু এই ভয়ংকর দেবতাটি সম্পর্কে আমরা জানি কতটুকুই বা?
আসুন পুরাণের তালপাতার পুথি খুলে জেনে নিই আমাদের অতিপরিচিত শনিদেবকে।
শনি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা যতই ভয়ভীতিমিশ্রিত হোক না কেন, মৎস্য পুরাণ কিন্তু শনিকে লোকহিতকর গ্রহের তালিকাতেই ফেলেছে। মৎস্য ও সৌর পুরাণের মতে, শনি বিবস্বান (সূর্য) ও ছায়ার পুত্র। আবার অগ্নি পুরাণের মতে, বিবস্বানের পত্নীর সংজ্ঞার গর্ভে শনির জন্ম। এদিকে মার্কণ্ডেয়, বায়ু, ব্রহ্মাণ্ড, বিষ্ণু ও কূর্ম পুরাণ মতে, শনি বা শনৈশ্চর অষ্টরুদ্রের প্রথম রুদ্রের পুত্র। তাঁর মায়ের নাম সুবর্চলা।
স্কন্দ পুরাণের আবন্ত্য খণ্ডে আছে, শনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শিপ্রা ও ক্ষাতা নদীর সংযোগস্থলে। উক্ত পুরাণেই শনির জন্ম নিয়ে একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনির অবতারণা করা হয়েছে: শনি জন্মগ্রহণ করেই ত্রিলোক আক্রমণ করে বসলেন এবং রোহিণীর পথ ভেদ করলেন। সারা ব্রহ্মাণ্ড শঙ্কিত হয়ে উঠল। ইন্দ্র প্রতিকার চাইতে ছুটলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা সূর্যের কাছে গিয়ে শনিকে সংযত করতে বললেন। কিন্তু ততক্ষণে শনির দৃষ্টিপাতে সূর্যেরই পা-দুটি পুড়ে গিয়েছে। তিনি কিছুই করতে পারলেন না। তিনি ব্রহ্মাকেই উলটে শনিকে সংযত করার অনুরোধ করলেন। ব্রহ্মা গেলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণুও নিজে কিছু করতে পারবেন না ভেবে ব্রহ্মাকে নিয়ে চললেন শিবের কাছে। শিব শনিকে ডেকে পাঠালেন। শনি বাধ্য ছেলের মতো মাথাটি নিচু করে এলেন শিবের কাছে। শিব শনিকে অত্যাচার করতে বারণ করলেন। তখন শনি শিবকে তাঁর জন্য খাদ্য, পানীয় ও বাসস্থানের নির্দেশ করতে বললেন। তখন শিবই ঠিক করে দিলেন—শনি মেষ ইত্যাদি রাশিতে তিরিশ মাস করে থেকে মানুষের পিছনে লাগবেন এবং এই করেই তাঁর হাড় জুড়াবে। অষ্টম, চতুর্থ, দ্বিতীয়, দ্বাদশ ও জন্মরাশিতে অবস্থান হলে তিনি সর্বদাই বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হবেন। কিন্তু তৃতীয়, ষষ্ঠ বা একাদশ স্থানে এলে তিনি মানুষের ভাল করবেন এবং তখন মানুষও তাঁকে পূজা করবে। পঞ্চম বা নবম স্থানে এলে তিনি উদাসীন থাকবেন। এও ঠিক হল, অন্যান্য গ্রহদের তুলনায় তিনি বেশি পূজা ও শ্রেষ্ঠতম স্থান পাবেন। পৃথিবীতে স্থির গতির জন্য তাঁর নাম হবে স্থাবর। আর রাশিতে মন্দ গতির জন্য তাঁর নাম হবে শনৈশ্চর। তাঁর গায়ের রং হবে হাতি বা মহাদেবের গলার রঙের মতো। তাঁর চোখ থাকবে নিচের দিকে। সন্তুষ্ট হলে তিনি লোককে দেবেন রাজ্য, অসন্তুষ্ট হলে লোকের প্রাণ নেবেন। শনির দৃষ্টি যার দিকেই পড়বে, তিনি দেবতাই হোন, বা দৈত্য, মানব, উপদেবতাই হোন, পুড়ে মরতে হবেই হবে। এই কথা বলে শিব শনিকে মহাকালবনে বাস করতে বললেন।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের গণেশের জন্মকাহিনির সঙ্গে শনির যোগের কথা অনেকেই জানেন। তবু সেটার উল্লেখ না করলে এই রচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উক্ত পুরাণ মতে, শনি আদৌ কুদৃষ্টি নিয়ে জন্মাননি; বরং স্ত্রীর অভিশাপই তাঁর কুদৃষ্টির কারণ। একদিন শনি ধ্যান করছিলেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী সুন্দর বেশভূষা করে এসে তাঁর কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করলেন। ধ্যানমগ্ন শনি কিন্তু স্ত্রীর দিকে ফিরেও চাইলেন না। অতৃপ্তকাম শনিপত্নী তখন শনিকে অভিশাপ দিলেন, “আমার দিকে ফিরেও চাইলে না তুমি! যাও, অভিশাপ দিলুম, এরপর থেকে যার দিকেই চাইবে, সে-ই ভষ্ম হয়ে যাবে।” এরপর ঘটনাচক্রে গণেশের জন্ম হল। সকল দেবদেবীর সঙ্গে শনিও গেলেন গণেশকে দেখতে। কিন্তু স্ত্রীর অভিশাপের কথা স্মরণ করে তিনি গণেশের মুখের দিকে তাকালেন না। পার্বতী শনির এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে শনি অভিশাপের বৃত্তান্ত খুলে বলেন। কিন্তু পার্বতী সেকথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি শনিকে পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলেন। বারংবার অনুরোধের পর শনি শুধু আড়চোখে একবার গণেশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাতেই গণেশের মুণ্ড দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাজা দশরথের সঙ্গে শনির সাক্ষাৎকারের একটি বর্ণনা আছে। কৃত্তিবাস এই কাহিনিটি আহরণ করেছেন স্কন্দ পুরাণের নাগর ও প্রভাস খণ্ড থেকে—তবে একটু অন্যভাবে। উক্ত পুরাণের মতে, অযোধ্যার জ্যোতিষীগণ দশরথকে সাবধান করে বলেছিলেন, শনিগ্রহ শীঘ্রই রোহিণী ভেদ করবেন। আর তার ফলে বারো বছর ধরে রাজ্যে ভীষণ অনাবৃষ্টি হবে। এই কথা শুনে ইন্দ্রের দেওয়া দিব্য রথে চড়ে দশরথ তৎক্ষণাৎ শনির পিছন ছুটলেন। সূর্য ও চন্দ্রের পথ অতিক্রম করে একেবারে নক্ষত্রমণ্ডলে গিয়ে শনির সামনে উপস্থিত হয়ে রাজা বললেন, “তুমি রোহিণীর পথ পরিত্যাগ কর। না করলে, আমি তোমাকে বধ করব।” শনি দশরথের এই রকম সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি রাজার পরিচয় জানতে চাইলে দশরথ আত্মপরিচয় দিলেন। শুনে শনি বললেন, “আমি তোমার সাহস দেখে অত্যন্ত প্রীত হয়েছি। আমি যার দিকে তাকাই, সেই ভষ্ম হয়ে যায়। তবু তুমি প্রজাহিতের জন্য নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে আমার কাছে এসেছো, এতে আমি আরও বেশি খুশি হয়েছি। যাও, আমি কথা দিলাম, রোহিণীর পথ আমি আর কোনোদিনও ভেদ করব না।” কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে, অনাবৃষ্টি শুরু হওয়ার পর দশরথ শনির কাছে গিয়েছিলেন।
এবার চলে যাই দেশান্তরের পুরাণে। আমরা হিন্দুরা যে গ্রহটিকে শনি নামে চিহ্নিত করেছি, পাশ্চাত্য জগতে সেই গ্রহটির নাম স্যাটার্ন (Saturn)। রোমান দেবতা। তবে রোমান পুরাণের অন্যান্য দেবতাদের মতো ইনিও গ্রিক পুরাণ থেকে আমদানিকৃত। গ্রিক পুরাণে স্যাটার্নের নাম ক্রোনাস। স্যাটার্নের নাম অনুসারে স্যাটারডে, যেমন শনির নামে শনিবার। এছাড়া শনি ও ক্রোনাস/স্যাটার্নের মধ্যে মিল অল্পই। কালিকা পুরাণে শনির ধ্যানমন্ত্রে আছে --

ইন্দ্রনীলনিভঃ শূলী বরদো গৃধ্রবাহনঃ।
পাশবাণাসনধরো ধ্যাতব্যোঽর্কসুতঃ।।

অর্থাৎ, “নীলকান্তমণির মতো গাত্রবর্ণবিশিষ্ট; শূল, বরমুদ্রা, পাশ ও ধনুর্বাণধারী; শকুনিবাহন সূর্যপুত্র শনিকে ধ্যান করি।” মহানির্বাণ তন্ত্রে আরও এক ধাপ উঠে বলা হয়েছে, শনি হলেন কানা ও খোঁড়া। বলাবাহুল্য, এই চেহারার সঙ্গে ক্রোনাস/স্যাটার্নের চেহারার মিল আদৌ নেই। তাঁর হাতে থাকে কাস্তে। গ্রিক পুরাণে ক্রোনাস হলেন দেবরাজ জিউসের পিতা। তিনি ব্রহ্মাণ্ডপিতা ইউরেনাসের পুত্র। পিতাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে তিনি ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হন। অত্যন্ত ক্ষমতালোভী ছিলেন। তাঁর ছেলেরা যাতে তাঁকে অনুসরণ করে সিংহাসনের দখল না নিতে পারে, সেজন্য তিনি নিজের ছেলেমেয়েদেরই ভক্ষণ করতেন। শেষে পুত্র জিউসের হাতে তাঁকে ক্ষমতা হারাতে হয় এবং তিনি কৃষিকর্মের দেবতা হয়ে থেকে যান। রোমান স্যাটার্নও কৃষিকাজ, মুক্তি ও সময়ের দেবতা। সেই হিসেবেও দেখা যায়, শনির মতো লোকপীড়নকারী চরিত্র এঁদের নয়।

শেষ পাতে, জ্যোতিষ থেকে চলে আসি জ্যোতির্বিজ্ঞানে। হিন্দুপুরাণের শনি যতই কুৎসিত এবং ক্ল্যাসিক্যাল পুরাণের স্যাটার্ন যতই নৃশংস হোন না কেন, আমাদের সৌরজগতের ষষ্ঠ গ্রহটি কিন্তু রূপে গুণে অসামান্য। তার কারণ, অবশ্যই এই গ্রহকে ঘিরে থাকা চাকতিগুলি; জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে আমরা বলি ‘শনির বলয়’। তুষারকণা, খুচরো পাথর আর ধূলিকণায় সৃষ্ট মোট নয়টি পূর্ণ ও তিনটি অর্ধবলয় শনিকে সর্বদা ঘিরে থাকে। শনি দৈত্যাকার গ্রহ; এর গড় ব্যাস পৃথিবীর তুলনায় নয় গুণ বড়ো। এর অভ্যন্তরভাগে আছে লোহা, নিকেল এবং সিলিকন ও অক্সিজেন মিশ্রিত পাথর। তার উপর যথাক্রমে একটি গভীর ধাতব হাইড্রোজেন স্তর, একটি তরল হাইড্রোজেন ও তরল হিলিয়াম স্তর এবং সবশেষে বাইরে একটি গ্যাসীয় স্তরের আস্তরণ। আমাদের শনিদেবের গায়ের রং নীলকান্তমণির মতো (শ্রদ্ধেয় হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে এই রং বিষ্ণুর থেকে ধার করা)। শনি গ্রহের রং কিন্তু হালকা হলুদ। এর কারণ শনির বায়ুমণ্ডলের উচ্চবর্তী স্তরে অবস্থিত অ্যামোনিয়া ক্রিস্টাল। শনির ধাতব হাইড্রোজেন স্তরে প্রবাহিত হয় এক ধরনের বিদ্যুত প্রবাহ। এই বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকেই শনির গ্রহীয় চৌম্বক ক্ষেত্রের উদ্ভব ঘটেছে। এখনও পর্যন্ত শনির বাষট্টিটি চাঁদ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তার মধ্যে তিপ্পান্নটির সরকারিভাবে নামকরণ করা হয়েছে। অবশ্য এগুলি ছাড়াও শনির শতাধিক উপচাঁদ বা চন্দ্রাণু (Moonlets) আছে। সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটান শনির বৃহত্তম উপগ্রহ। এটি আকারে মঙ্গলের চেয়েও বড়ো এবং এটিই সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যার একটি সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল আছে।


Written by : Prithwish Ghosh

Share:

সাক্ষীগোপাল কৃষ্ণের মূর্তি ও মন্দির

সাক্ষী (-ক্ষিন্) বিণ. 
> কোনো বিষয় বা ঘটনা প্রত্যক্ষকারী, প্রত্যক্ষদর্শী; 
> ঘটনা জানে এমন। [সং. 'সাক্ষাত্ দ্রষ্টা' এই অর্থে নি.]।
সাক্ষীগোপাল - বি. 
<> পুরীর নিকটবর্তী স্হানবিশেষ বা ওই স্হানে প্রতিষ্ঠিত শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহবিশেষ; 
> যে ব্যক্তি স্বয়ং নিষ্ক্রিয় থেকে অন্যের কার্যকলাপ লক্ষ করে; 
> ঘটনা দেখে অথচ পুতুলের মতো নিষ্ক্রিয় ব্যক্তি।
.
পুরীর সন্নিকটে সমুদ্রতীরে সাক্ষীগোপাল কৃষ্ণের মূর্তি ও মন্দির। কীসের সাক্ষ্য দেবার সাক্ষ্যবহন করছে এই মূর্তি? তার পিছনে রয়েছে এক লোককথা। পুরীতে তীর্থ করতে এসে এক প্রৌঢ় বিপ্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গী এক তরুণ বিপ্র শুশ্রূষায় তাঁকে বাঁচিয়ে তুললেন। কৃতজ্ঞ প্রৌঢ় তাঁর কন্যার সঙ্গে তরুণ বিপ্রের বিবাহ দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। গ্রামে ফিরে কিন্তু ভুলে গেলেন প্রতিজ্ঞার কথা। শ্রীক্ষেত্রে উচ্চারিত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলে প্রৌঢ় অভিশাপগ্রস্ত হবেন, তাই তরুণ বিপ্র তাঁকে প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিতে প্রৌঢ় বললেন তাঁর এই প্রতিজ্ঞা দেবার সাক্ষী আনতে পারলেই তিনি বিবাহ দেবেন। তরুণ বিপ্র জগন্নাথকে অনুনয় করল সাক্ষী হিসাবে তার সঙ্গে গ্রামে যেতে। জগন্নাথদেব রাজি হলেন এক শর্তে: তিনি তরুণ বিপ্রের পিছু পিছু যাবেন, কিন্তু সে পিছন ফিরে দেখলেই তিনি থেমে যাবেন। তরুণ প্রশ্ন করল কী করে সে বুঝবে যে জগন্নাথ তাঁকে অনুসরণ করছেন। জগন্নাথ জানালেন তাঁর চরণের নূপুরধ্বনিতেই সেটা বোঝা যাবে। যাত্রা শুরু হল। পথ চলতে চলতে নটখট নটবর কৃষ্ণের মাথায় দুষ্টুমি চাপল। কয়েক লহমার জন্যে নূপুর চেপে ধরলেন। নূপুরের আওয়াজ না শুনে আতঙ্কিত তরুণ বিপ্র পিছনে ফিরে তাকালেন। কৃষ্ণ সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। কোন অঘটন সামনে ঘটতে দেখেও যে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে তার জন্যেই এই সাক্ষীগোপাল বিশেষণ।
-
এই মন্দিরে কখনও গেলে পাণ্ডাদের থেকে সাবধান। অযাচিত টাকা-পয়সা দেবার জন্য চাপাচাপি করে।


 লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

২৬ নভেম্বর ২০১৫

নীলমাধব ও জগন্নাথ দেব ( পুরীর নীলমাধব মন্দিরের অসংখ্য ছবিসহ )

মালবরাজ ইন্দ্রদুম্ন্য ছিলেন পরম বিষ্ণু ভক্ত। একদিন এক তেজস্বী সন্ন্যাসী তাঁর রাজবাড়ীতে পদার্পণ করলেন। দেব দ্বিজে ভক্তিপরায়ন রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য পরম যত্নে সন্ন্যাসীর সেবা যত্ন করলেন। সন্ন্যাসী ভারতবর্ষের সমস্ত তীর্থের কথা বলে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের নীল পর্বতে ভগবান বিষ্ণুর পূজার কথা জানালেন। এখানে ভগবান বিষ্ণু গুপ্তভাবে শবর দের দ্বারা নীলমাধব রূপে পূজিত হচ্ছেন, নীলমাধব সাক্ষাৎ মুক্তিপ্রদায়ক, তিনি মোক্ষ প্রদান করেন।

সন্ন্যাসীর কথা শুনে ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য ভগবানের রূপ দর্শনে আকুল হলেন। রাজা তাঁর পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে শবর দের রাজ্যে গিয়ে নীলমাধবের সন্ধান করে আনতে বললেন। এরপর শবর দের দেশে এসে বিদ্যাপতি শবর দের রাজা বিশ্বাবসুর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। শবর রাজা বিদ্যাপতিকে স্বাদর অভ্যর্থনা করে অতিথি চর্চার জন্য কন্যা ললিতাকে দায়িত্ব দেন। কিছুদিন থাকার পর বিদ্যাপতি শবর রাজা বিশ্বাবসুর কন্যা ললিতার প্রেমে পড়েন। উভয়ে উভয়কে ভালোবেসে ফেলেন। যার পরিণাম-স্বরূপ ললিতা অন্তঃসত্ত্বা হন। ললিতা এ কথা বিদ্যাপতিকে জানান এবং তাঁকে বিবাহ করতে বলেন। বিদ্যাপতি ললিতাকে এর বিনিময়ে নীলমাধব দর্শনের অভিপ্রায় জানান। ললিতা সে কথা শুনে বিচলিত হয় কিন্তু সে বলে এক সর্তে সে নীলমাধবকে দেখাতে পারে - বিদ্যাপতি যে পথে যাবেন সেই সময় তাঁর দুই চোখ সম্পূর্ণ বন্ধ করা হবে অর্থাৎ কাপড়ের পট্টি বাঁধা হবে যাতে তিনি রাস্তা না দেখতে পারেন কিম্বা চিনতে পারেন। বিদ্যাপতি রাজি হয়ে যান। কিন্তু বিদ্যাপতি একটি বুদ্ধি করেন, উনি সঙ্গে করে সরষে নিয়ে যান। হাতে এক মুঠো এক মুঠো করে সরষে নিয়ে সারা রাস্তা ফেলতে ফেলতে যান। এ' সব কাজ ললিতার অগোচরেই সম্পন্ন হয়। বিদ্যাপতির উদ্দেশ্য ছিল নীলমাধবকে পুরীতে নিয়ে যাওয়া। সেই পথ চেনার জন্য উনি সরসের গাছ দেখতে দেখতে নীলমাধবের মন্দিরে পৌঁছন কিন্তু প্রভু নীলমাধব অন্তর্যামী বিদ্যাপতির হাতের নাগাল থেকে অন্তর্ধান হ'ন।
.
বিশ্ববসু কন্যা ললিতার মারফৎ বিদ্যাপতি নীলমাধব কে দর্শন লাভ করলেন বিশ্ববসুর অগোচরে। তারপর বিদ্যাপতি গিয়ে রাজাকে সব জানালেন। রাজা খবর পেয়ে সৈন্য সামন্ত নিয়ে নীলমাধবের দর্শনে আসলেন।
ইন্দ্রদুম্ন্য পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে এসে নীলমাধব দর্শন করতে গেলে শুনলেন নীলমাধব অন্তর্ধান হয়েছেন। মতান্তরে শবর রাজ বিশ্বাবসু সেটিকে লুকিয়ে রাখেন। রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য এতে খুব দুঃখ পেয়ে ভাবলেন প্রভুর যখন দর্শন পেলাম না তখন এই জীবন রেখে কি লাভ? অনশনে প্রান ত্যাগ করাই শ্রেয় । এই ভেবে রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কুশ শয্যায় শয়ন করলেন। সে' সময় দেবর্ষি নারদ মুনি জানালেন --- “হে রাজন তোমার প্রাণত্যাগের প্রয়োজন নাই। এই স্থানে তোমার মাধ্যমে ভগবান জগন্নাথ দেব দারুব্রহ্ম রূপে পূজা পাবেন। স্বয়ং পিতা ব্রহ্মা একথা জানিয়েছেন।”
রাজা শুনে শান্তি পেলেন। এক রাতের কথা রাজা শয়নে ভগবান বিষ্ণুর স্বপ্ন পেলেন।
স্বপ্নে ভগবান শ্রীহরি বললেন --- “হে রাজন । তুমি আমার প্রিয় ভক্ত। ভক্তদের থেকে আমি কদাপি দূর হই না। আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। পুরীর বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্ম রূপে পাবে।”
রাজা সেই স্থানে গিয়ে দারুব্রহ্মের সন্ধান পেলেন। কিন্তু তাকে একচুল ও নড়াতে পারলেন না । রাজা আদেশ দিলেন হাতী দিয়ে টানতে। সহস্র হাতী টেনেও সেই দারুব্রহ্ম কে এক চুলও নড়াতে পারলো না। রাজা আবার হতাশ হলেন।
সেই সময় ভগবান বিষ্ণু স্বপ্নে জানালেন --- “হে রাজন। তুমি হতাশ হইও না। শবর রাজ বিশ্বাবসু আমার পরম ভক্ত। তুমি তাকে সসম্মানে এইস্থানে নিয়ে আসো। আর একটি স্বর্ণ রথ আনয়ন করো।”
রাজা সেই মতো কাজ করলেন। ভক্ত বিশ্বাবসু আসলেন। বিশ্বাবসু, বিদ্যাপতি আর রাজা তিনজনে মিলে দারুব্রহ্ম তুললেন। সেসময় চতুর্দিকে ভক্তেরা কীর্তন করতে লাগলো। তারপর দারুব্রহ্ম কে রথে বসিয়ে তিনজন নিয়ে এলেন।
প্রকাশ থাকে পুরীর দৈতাপতিরা ওই ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি এবং শবর কন্যা ললিতার বংশধর। তাই ওরা কেবল রথের সময় ভগবান জগন্নাথের সেবা করার অধিকার পান। রথে উপবিষ্ট প্রভু জগন্নাথ বলভদ্র মা সুভদ্রা এবং সুদর্শনের। এই বছরও নব-কলেবর যাত্রায় দৈতাপতিরা দারু অন্বেষণ এবং ব্রহ্ম পরিবর্তনের কাজ সমাপন করেছেন। এ ছাড়া ওনারা পুর্ব বিগ্রহদের পাতালিকরন কাজ সমাপন করেন 'কোইলি বৈকুন্ঠে' ।
রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য সমুদ্রে প্রাপ্ত দারুব্রহ্ম প্রাপ্তির পর গুণ্ডিচা মন্দিরে মহাবেদী নির্মাণ করে যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞ সমাপ্তে দেবর্ষি নারদ মুনির পরামর্শে রাজা সেই দারুব্রহ্ম বৃক্ষ কাটিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ তৈরীতে মনোনিবেশ করলেন। এর জন্য অনেক ছুতোর কারিগর কে ডেকে পাঠানো হোলো। কিন্তু বৃক্ষের গায়ে হাতুড়ী, ছেনি ইত্যাদি ঠেকানো মাত্রই যন্ত্র গুলি চূর্ণ হতে লাগলো। রাজা তো মহা সমস্যায় পড়লেন। সেসময় ছদ্দবেশে বিশ্বকর্মা মতান্তরে ভগবান বিষ্ণু এক ছুতোরের বেশে এসে মূর্তি তৈরীতে সম্মত হলেন।
তিনি এসে বললেন- “হে রাজন। আমার নাম অনন্ত মহারাণা। আমি মূর্তি গড়তে পারবো। আমাকে একটি বড় ঘর ও ২১ দিন সময় দিন। আমি তৈরী করবো একটি শর্তে। আমি ২১ দিন দরজা বন্ধ করে কাজ করবো। সেসময় এই ঘরে যেন কেউ না আসে। কেউ যেন দরজা না খোলে।”
অপর দিকে মোটা পারিশ্রামিকের লোভে যে ছুতোররা এসেছিলো তাদের নিরাশ করলেন না অনন্ত মহারাণা।
তিনি বললেন- “হে রাজন । আপনি ইতিপূর্বে যে সকল কারিগর কে এনেছেন, তাদের বলুন তিনটি রথ তৈরী করতে।”
ছদ্দবেশী বিশ্বকর্মা ঘরে ঢুকলে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে সেখানে কড়া প্রহরা বসানো হোলো যাতে কাক-পক্ষীও ভেতরে না যেতে পারে। ভেতরে কাজ চলতে লাগলো। কিন্তু রানী গুণ্ডিচার মন মানে না। স্বভাবে নারীজাতির মন চঞ্চলা হয়। রানী গুন্ডিচা ভাবলেন -- “আহা কেমনই বা কারিগর বদ্ধ ঘরে মূর্তি গড়ছেন। কেমন বা নির্মিত হচ্ছে শ্রীবিষ্ণুর বিগ্রহ। একবার দেখেই আসি না। একবার দেখলে বোধ হয় কারিগর অসন্তুষ্ট হবেন না।”
এই ভেবে মহারানী ১৪ দিনের মাথায় মতান্তরে ৯ দিনের মাথায় দরজা খুলে দিলেন। কারিগর ক্রুদ্ধ হয়ে অদৃশ্য হোলো। অসম্পূর্ণ জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর মূর্তি দেখে রানী ভিরমি খেলেন। একি মূর্তি! নীল নবঘন শ্যামল শ্রীবিষ্ণুর এমন গোলাকৃতি নয়ন, হস্ত পদ হীন, কালো মেঘের মতো গাত্র বর্ণ দেখে মহারানীর মাথা ঘুরতে লাগলো।
রাজার কানে খবর গেলো। রাজা এসে রানীকে খুব তিরস্কার করলেন। বদ্ধ ঘরের মধ্য থেকে এক কারিগরের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় বিচক্ষণ মন্ত্রী জানালেন তিনি সাধারন মানব না কোনো দেবতা হবেন। বিষ্ণু ভক্ত রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য তাঁর আরাধ্য হরির এই রূপ দেখে দুঃখিত হলেন। রাজাকে সেই রাত্রে ভগবান বিষ্ণু আবার স্বপ্ন দিলেন।
বললেন --- “আমার ইচ্ছায় দেবশিল্পী মূর্তি নির্মাণ করতে এসেছিলেন। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ হওয়াতে এই রূপ মূর্তি গঠিত হয়েছে। হে রাজন, তুমি আমার পরম ভক্ত, আমি এই অসম্পূর্ণ মূর্তিতেই তোমার পূজা নেবো। আমি দারুব্রহ্ম রূপে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে নিত্য অবস্থান করবো। আমি প্রাকৃত হস্তপদ রহিত, কিন্তু অপ্রাকৃত হস্তপদাদির দ্বারা ভক্তের সেবাপূজা শ্রদ্ধা গ্রহণ করবো। আমি ত্রিভুবনে সর্বত্র বিচরণ করি। লীলা মাধুর্য প্রকাশের জন্য আমি এখানে এইরূপে অধিষ্ঠান করবো। শোনো নরেশ -- ভক্তেরা আমার এই রূপেই মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণ রূপের দর্শন পাবেন। যদি তুমি ইচ্ছা করো তবে ঐশ্বর্য দ্বারা সোনা রূপার হস্ত পদাদি নির্মিত করে আমার সেবা করতে পারো। ” সেইথেকে উল্টো রথের পর একাদশীর দিন তিন ঠাকুরের সুবর্ণ-বেশ রথের ওপর হয়। সেই বেশ দেখলে সাত জন্মের পাপ ক্ষয় হয় যা দেখতে লক্ষ লক্ষ ভক্ত পুরী আসেন প্রত্যেক বৎসর।
.
আমরা দেখলাম যে ভগবান বিষ্ণু তাঁর পরম ভক্ত রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কে স্বপ্নে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এই বলে যে তিনি সেই হস্তপদ রহিত বিকট মূর্তিতেই পূজা নেবেন। সেই স্বপ্ন পর্ব তখনো চলছে। ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে যে ভক্তির সম্বন্ধ তা একে একে উঠে আসছে। নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্নে রাজা তখনও সেই ছদ্দবেশী অনন্ত মহারানার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে বলছেন --- “হে প্রভু জনার্দন, যে বৃদ্ধ কারিগরকে দিয়ে তুমি তোমার এই মূর্তি নির্মিত করিয়াছ – আমার অভিলাষ এই যে সেই কারিগরের বংশধরেরাই যেনো তোমার সেবায় রথ যুগ যুগ ধরে প্রস্তুত করিতে পারে।” ভগবান নারায়ন তাঁর ভক্তদের খুবুই স্নেহ করেন। তাই ভগবান একে একে রাজার ইচ্ছা পূর্ণ করতে লাগলেন। এরপর ভগবান বিষ্ণু বললেন --- “হে রাজন। আমার আর এক পরম ভক্ত শবর রাজ বিশ্বাবসু আমাকে নীলমাধব রূপে পূজা করতো- তাঁরই বংশধরেরা আমার সেবক রূপে যুগ যুগ ধরে সেবা করবে । বিদ্যাপতির প্রথম স্ত্রীর সন্তান গন আমার পূজারী হবে। আর বিদ্যাপতির দ্বিতীয়া স্ত্রী তথা বিশ্বাবসুর পুত্রী ললিতার সন্তান এর বংশধরেরা আমার ভোগ রান্নার দায়িত্ব নেবে। আমি তাদের হাতেই সেবা নেবো।”
বিদ্যাপতি প্রথম রাজার আদেশে নীলমাধব সন্ধান করতে গেছিলেন শবর দের দেশে, শবর বা সাঁওতাল যাদের আমরা ছোটো জাত বলে দূর দূর করি --- শ্রীভগবান বিষ্ণু প্রথম তাঁদের দ্বারাই পূজা নিলেন। অপরদিকে তিনি তাঁদের হাতে সেবার আদেশ দিলেন। ব্রাহ্মণ ও শূদ্র জাতির একত্র মেলবন্ধন ঘটালেন স্বয়ং ভগবান। সেজন্যই বলে পুরীতে জাতি বিচার নেই। জগতের নাথ জগন্নাথ সবার। বিদ্যাপতি শবর দেশে নীলমাধবের সন্ধান করতে গিয়ে বিশ্বাবসুর দুহিতা ললিতার সাথে ভালোবাসা ও বিবাহ করেছিলেন। আর বিদ্যাপতিকে শবর দেশে পৌছানোর জন্য এক রাখাল বালক বারবার পথ প্রদর্শন করেছিলেন। সেই রাখাল বালক আর কেউ নয় স্বয়ং বৃন্দাবনের 'রাখালরাজা নন্দদুলাল'। ইন্দ্রদুম্ন্য স্বপ্নে ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রতিশ্রুতি দিলেন --- “হে মধূসুদন, প্রতিদিন মাত্র এক প্রহর অর্থাৎ তিন ঘণ্টার জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকবে, বাকী সময় মন্দিরের দ্বার অবারিত থাকবে, যাতে তোমার সন্তান ভক্তেরা তোমার দর্শন লাভ করে। সারাদিন আপনার ভোজোন চলবে। আপনার হাত কদাপি শুস্ক থাকবে না।”
ভগবান বিষ্ণু রাজাকে তাই বর দিলেন। এবার ভগবান ভক্তের পরীক্ষা নিলেন --- তিনি বললেন --- “এবার নিজের জন্য কিছু প্রার্থনা করো, তুমি আমার ভক্ত।”
প্রকৃত ভক্তেরা নিস্কাম, তাই কোনো প্রকার সুখ ঐশ্বর্য তারা চান না।
রাজা একটি ভয়ানক বর চেয়ে বললেন -- “প্রভু আমাকে এই বর দিন আমি যেন নির্বংশ হই, যাতে আমার বংশধরের কেউ যেন আপনার দেবালয়কে নিজ সম্পত্তি দাবী না করতে পারে।”
ভগবান হরি তাই বর দিলেন। জগন্নাথ মন্দিরে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা।
.
পদ্মপুরাণে লিখিত আছে ভগবান রামচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্ন এই স্থানে এসেছিলেন। ব্রহ্ম পুরাণ ও বৃহৎ নারদীয় পুরানে এই স্থানের নাম পাওয়া যায় । জগন্নাথ মন্দিরের মূর্তি প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় ব্রহ্মা ব্রহ্মলোক থেকে মর্তে এসেছিলেন। তিনিই হয়েছিলেন পুরোহিত। জগন্নাথ দেব রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কে স্বপ্নে নিত্য পূজোর নিয়মকানুন বলেছিলেন ইন্দ্রদুম্ন্য সেই মতো সব ব্যবস্থা করেন।
স্কন্দপুরান মতে শবর জাতির লোকেরা পূর্বে নীলমাধব রূপে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করতো। ব্রহ্ম পুরাণ ও বৃহৎ নারদীয় পুরান মতে শবর-গণ নীলমাধব রূপী নারায়নের পূজা করতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর পূর্বে স্বর্গের দেবতাগণ গুপ্ত রূপে নীলমাধবের পূজা করতেন। পরে শবর গণ সেই খোঁজ পান।
জগন্নাথ দেবের সৃষ্টি সম্বন্ধে ওড়িয়া মহাভারতে এক অদ্ভুত আখ্যান আছে। লীলা সংবরণের আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৈকুণ্ঠে গমনের চিন্তা করতে লাগলেন। যদু বংশ গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে। বলরাম ভ্রাতা যোগবলে দেহ রেখেছেন। তিনি এই ভেবে বনে গিয়ে একটি বৃক্ষে আরোহণ করে মহাভারতের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। সেসময় তাঁর চরণ কে পক্ষী ভেবে জরা নামক এক ব্যাধ শর বিদ্ধ করলেন। বলা হয় এই ব্যাধ পূর্ব জন্মে বালী পুত্র অঙ্গদ ছিলেন। ভগবান রাম বালীকে বধ করে অঙ্গদ কে বর দিয়েছিলেন, পর জন্মে শ্রীকৃষ্ণ রূপে তিনি অঙ্গদের শরে দেহ রাখবেন। পরে শ্রীকৃষ্ণ দেহ রাখলে তাঁর দেহকে দ্বারকায় সমুদ্র তটে চন্দন কাষ্ঠে, খাঁটি গো ঘৃতে দাহ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ৬ দিন হলেও ভগবানের শরীর একটুকুও পুড়লো না।
তখন দৈববাণী হোল --- “ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই নশ্বর দেহ আগুনে দাহ করা যাবে না। এই পবিত্র দেহ সমুদ্রে বিসর্জন দাও।” ঠিক সেই মতো সমুদ্রে বিসর্জিত করা হলে সেই দেহ কাষ্ঠে রূপান্তরিত হয়ে ভাসতে ভাসতে এলো। সেই কাষ্ঠ রোহিনীকুণ্ডে পাওয়া যায়। সেই কাষ্ঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ তৈরী হোলো।
ওড়িশা ভারতের এক প্রাচীন রাজ্য। এখানকার সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনেক পুরানো। জগন্নাথ যেমন বৈষ্ণবদের নিকট বিষ্ণু তেমনি শাক্ত ও শৈবদের নিকট ভৈরব শিব। যে যেমন ভাবে দেখতে চায় --- জগন্নাথ তাঁর কাছে সেরূপেই প্রকাশিত হন। হরিহর অভেদ তত্ত্ব এই শ্রীক্ষেত্রে দেখা যায় । ওড়িশার নানা অঞ্চল জুড়ে বহু প্রাচীন মন্দির আছে। এগুলোর সবকটি সম্বন্ধে লেখা অসম্ভব। কি শিব মন্দির, কি শক্তিপীঠ, কি গোপাল মন্দির এমনকি বৌদ্ধ ও জৈ ধর্মের নিদর্শন ওড়িশা রাজ্য জুড়ে দেখা যায়।
জয় জগন্নাথ স্বামী নয়ন পথ গামী ............
জগন্নাথ ক্ষেত্র বা ওড়িশা বা ঔড্র দেশ বা নীলাচল ধাম অপূর্ব সুন্দর ক্ষেত্র .....
জয় জগন্নাথ .....
[সাথের ছবিটি -- নীলমাধব মন্দিরের]

লিখেছেনঃ Prithwish Ghosh
 মন্দিরের কিছু ছবি দেওয়া হলোঃ
নীলমাধব মন্দিরের ভিতরে গম্বুজের কারুকার্য্য

নীলমাধব মন্দিরের আঙিনায়  হনুমান মন্দিরে  বজরঙবলী


মহাপ্রভুর সাধন কুটির গম্ভীরায় সংরক্ষিত তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী


পুরীর সি-বিচ্-এ উড়িয়া মহিলারা খুব সকালেই বেলাভুমিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় রত কার্তিক-পূর্ণিমায় ছোট্ট ছেলেটা ভোরবেলা সমুদ্রে নৌকা ভাসাতে ব্যস্ত

নীলমাধব মন্দিরের প্রবেশ দ্বার
সাক্ষীগোপাল
সাক্ষীগোপাল মন্দির
হরিদাস প্রভুর সমাধি ক্ষেত্র


হরিদাস প্রভুর সাধনস্থল সিদ্ধবকুলতলা
নীলমাধব মন্দিরে বিগ্রহের ছবি তোলা নিষেধ তাই ছবি থেকে তোলা ফটোগ্রাফ্

নীলমাধব মন্দিরের চূড়া


নীলমাধব মন্দিরের আঙিনায় কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ

Share:

২১ নভেম্বর ২০১৫

হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি পর্ব ০৩

অম্বা

১.১. দুর্গা দেবীর অপর নাম।
১.২. জনৈকা অপ্সরা বিশেষ।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– কাশীরাজের প্রথমা কন্যা। এঁর অপর দুই বোনের নাম হলো– অম্বিকা ও অম্বালিকা। ভীষ্ম চরিত্রের সাথে অম্বা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।


অম্বালিকা


হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– কাশীরাজের কনিষ্ঠা কন্যা। এঁর অপর দুই বানের নাম হলো- অম্বা ও অম্বিকা। ভীষ্ম তাঁর সৎভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য এই তিন বোনকে স্বয়ংবর সভা থেকে অপহরণ করেন। ভীষ্মের সৎমাতা সত্যবতীর পুত্র বিচিত্রবীর্যের সাথে অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বিবাহ দেন। এই দুই বানের সাথে বিচিত্রবীর্যের অপরিমিত যৌনাচারের ফলে, সাত বৎসর বয়সে যক্ষ্মারোগে তাঁর মৃত্যু হয়। এই দুই বোনের কোনো সন্তান না থাকায়- এঁদের শাশুড়ী সত্যবতী বংশরক্ষার জন্য তাঁর অপর পুত্র ব্যাসদেবের সাথে সহবাস করতে বলেন। ব্যাসদেব মাতৃ আজ্ঞা রক্ষার জন্য এঁরা এই সহবাসে রাজী হন। এক নির্দিষ্ট রাতে ব্যাসদেব অম্বিকার কাছে সঙ্গমের জন্য আসেন। ব্যাসদেব ছিলেন বিরাটকায় পুরুষ। অম্বিকা ঋষিকে দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইলেন। এবং সঙ্গম শেষ না হওয়া পর্যন্ত চোখ খুললেন না। অম্বিকার ঘর থকে বের হয়ে এসে ঋষি তাঁর মাকে বললেন যে– এই কন্যার একটি অন্ধ পুত্র-সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, কারণ সঙ্গমকালে কন্যা চোখ বন্ধ করে ছিল। পরে ইনি এক অন্ধপুত্র প্রসব করেন। এই অন্ধপুত্রই হলেন মহাভারতে অন্যতম চরিত্র ধৃতরাষ্ট্র।

সত্যবতী অন্ধ-সন্তানের কথা শুনে ভাবলেন, রাজ্য রক্ষায় অন্ধ-সন্তান অপারগ হবে। তাই ঋষিকে বললেন যে, অম্বালিকাকে সে একটি সন্তান দান করুক। ঋষি মাতৃ-আজ্ঞায় এক নির্দিষ্টরাতে অম্বালিকার শয়নকক্ষে এলেন। অম্বালিকাও ঋষিকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পলেন। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে অন্ধ সন্তান হবে এই ভয়ে– চোখ খুলে রাখলেন। কিন্তু সেই বিরাটকায় পুরুষের প্রবল সঙ্গমের প্রচণ্ডতায় ও ভয়ে অম্বালিকা পাণ্ডুবর্ণের হয়ে গেলেন। অম্বালিকার ঘর থেকে বের হয়ে এসে ঋষি তাঁর মাকে বললেন যে– এই কন্যার একটি পুত্র-সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। তবে এই পুত্র পাণ্ডুবর্ণের হবে। এই পুত্র হলেন মহাভারতে অন্যতম চরিত্র পাণ্ডু। শেষ জীবনে ইনি তাঁর মধ্যমা ভগ্নি অম্বিকার সাথে বনে চলে যান এবং তপস্যায় জীবন অতিবাহিত করেন।


অম্বিকা


হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– কাশীরাজের মধ্যমা কন্যা ও ধৃতরাষ্ট্রের মা। এঁর অপর দুই বানের নাম হলো– অম্বা ও অম্বালিকা। অম্বালিকা চরিত্রের সাথে অম্বিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– কাশীরাজের মধ্যমা কন্যা ও ধৃতরাষ্ট্রের মা। এঁর অপর দুই বানের নাম হলো– অম্বা ও অম্বালিকা। অম্বালিকা চরিত্রের সাথে অম্বিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– কাশীরাজের মধ্যমা কন্যা ও ধৃতরাষ্ট্রের মা। এঁর অপর দুই বানের নাম হলো– অম্বা ও অম্বালিকা। অম্বালিকা চরিত্রের সাথে অম্বিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

অরুণ

ইনি মহর্ষি কশ্যপ মুনির ঔরসে ও বিনতার গর্ভে অণ্ডরূপে জন্মেছিলেন। উল্লেখ্য বিনতা দুটি ডিম প্রসব করেছিলেন। দীর্ঘদিন ডিম দুটি ফুটে কোনো সন্তান বের হচ্ছে না দেখে, অধৈর্য হয়ে বিনতা এর একটি ডিম অকালে ভেঙে ফেলেন। এই ডিম থেকে ঊরুহীন অবস্থায় অরুণের জন্ম হয়। তাই এর অপর নাম হয়েছিল অনূরু বা ঊরুহীন। জন্মের পর অরুণ তাঁর মাকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে- পাঁচশত বৎসর বিনতা তাঁর সপত্নী কদ্রুর দাসী হিসাবে থাকবেন। যদি অসময়ে ইনি অপর ডিমটি না ভাঙেন, তবে ওই ডিম থেকে জন্ম হওয়া সন্তান- তাঁর এই দাসত্ব থেকে মুক্ত করবেন। অরুণ সূর্যের রথের সারথি ছিলেন। সপ্ত অশ্বযোগে ইনি এই রথ পরিচালনা করতেন। এর অপর ভাইয়ের নাম ছিল গরুড়। এঁর স্ত্রীর নাম ছিল শ্যেনী। এঁদের সম্পাতি ও জটায়ু নামে দুটি সন্তান ছিল।


অরুণোদয়-সপ্তমী

অরুণোদয়ে স্থিতা সপ্তমী/মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। মাঘমাসের শুক্লা সপ্তমীকে এই নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দু মতে –মাঘ মাসের শুক্লা সপ্তমী সূর্যগ্রহণতুল্য তিথি। ঐ তিথিতে সূর্য উঠার সময় স্নান করলে মহাফল হয়।


অরুন্ধতী

কর্দম প্রজাপতির ঔরসে দেবাহুতির গর্ভে এঁর জন্ম হয়েছিল। বশিষ্ঠ মুনির সাথে এঁর বিবাহ হয়। ইনি অতিশয় বিদুষী হিসাবে খ্যাত ছিলেন। পতিভক্তিতে ইনি অদ্বিতীয়া ছিলেন। এই কারণে, অগ্নিকে কামনা করে স্বাহা এর রূপ ধরতে ব্যর্থ হন। ইনি নক্ষত্ররূপে বশিষ্ঠের পাশে অবস্থান করছেন। হিন্দু বিবাহে কুশণ্ডিকাকালে মন্ত্র উচ্চারণের সময় নববধূকে এই নক্ষত্র দেখানো হয়।


অর্জুন


হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে এই নামে একাধিক চরিত্র পাওয়া যায়। যেমন–

১. মাহিষ্মতী পুরীতে অর্জুন নামক একজন রাজা ছিলেন। এঁর পিতার নাম ছিল কৃর্তবীর্য। এই কারণে ইনি কার্তবীর্য বা কার্তবীর্যার্জুন নামে পরিচিত ছিলেন।



বালির রাজপথে অর্জুন


২. মহাভারতের অন্যতম চরিত্র। এঁর অপরাপর নাম– অরিমর্দন, কপিকেতন, কপিধ্বজ, কিরীটী, কৃষ্ণসখ, কৃষ্ণসারথি, কৌন্তেয়, গাণ্ডিবধন্বা, গাণ্ডিবী, গুড়াকেশ, চিত্রযোধী, জিষ্ণু, তৃতীয় পাণ্ডব, ধনঞ্জয়, পার্থ, ফল্গুন, ফাল্গুনি, বিজয়, বীভৎসু, শব্দবেধী, শব্দভেদী, শুভ্র, শ্বেতবাহ, শ্বেতবাহন, সব্যসাচী।

পাণ্ডু নামক রাজা কিমিন্দম মুনির অভিশাপের (যে কোন নারীর সাথে সঙ্গম করতে গেলে– পাণ্ডু মৃত্যুবরণ করবেন) কারণে স্ত্রীসংগম থেকে বিরত থাকেন। এই কারণে ইনি তাঁর স্ত্রীদ্বয়ের গর্ভে সন্তান লাভ করতে পারলেন না। এরপর ইনি তাঁর স্ত্রী কুন্তী'কে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদনের জন্য অন্য পুরুষকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। কুন্তী সন্তান কামনায় তিনবার তিনজন দেবতাকে আহ্বান করেছিলেন। শেষবারে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে আহ্বান করেন। এর ফলে ইন্দ্রের ঔরসে তিনি অর্জুনকে জন্ম দেন। উল্লেখ্য এঁর পূর্বে একই ভাবে কুন্তী পাণ্ডুর অনুরোধে আরও দুটি সন্তান লাভ করেছিলেন। এরা হলেন- ধর্মের ঔরসে যুধিষ্ঠির ও পবনের ঔরসে ভীম। সেই কারণে অর্জুন তৃতীয় পাণ্ডব নামে পরিচিত হয়ে থাকেন। অবশ্য তবে তারও আগে অবিবাহিতা অবস্থায় সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে জন্মেছিল কর্ণ। কিন্তু তখন তিনি পাণ্ডুর স্ত্রী ছিলেন না বলে- কর্ণ পাণ্ডব হিসাবে স্বীকৃতি পান নি।

অর্জুন প্রথমে কৃপাচার্যের কাছে, পরে দ্রৌণাচার্যের কাছে অন্যান্য পাণ্ডব ও ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানদের সাথে অস্ত্রবিদ্যা ও যুদ্ধনীতি শিক্ষা করেন। ইনি দ্রৌণাচার্যের সকল শিষ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কথিত আছে দ্রৌণাচার্য তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা এবং অর্জুনকে বিশেষ যত্নের সাথে অস্ত্রশিক্ষা দান করছিলেন। ধনুর্বিদ্যায় সমকালীন সকল বীরদের মধ্যে ইনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কৌরবসভায় অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনকালে দ্রৌণাচার্য সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ব্রহ্মশির নামক অমোঘ অস্ত্র দান করেন। গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে পরাজিত করে- তাঁর কাছ থেকে তিনি চাক্ষুষী বিদ্যা (যার প্রভাবে যে কোন অদৃশ্য বস্তুকে দেখা সম্ভব হতো) লাভ করেন।

দ্রুপদ-কন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভায় অন্যান্য পাণ্ডবদের সাথে ছদ্মবেশে ইনি উপস্থিত হন। এই সভায় একমাত্র তিনিই চক্রমধ্য-মৎস্যকে বিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সূত্রে ইনি দ্রৌপদীকে লাভ করেন। কিন্তু মাতৃ-আজ্ঞায় পঞ্চপাণ্ডব একত্রে তাঁকে বিবাহ করেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে যাতে ভ্রাতৃবিরোধ না ঘটে, সে কারণে- নারদ নিয়ম করে দেন যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, দ্রৌপদী একজন মাত্র পাণ্ডবের স্ত্রী হিসাবে থাকবেন। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অধীকারপ্রাপ্ত পাণ্ডব ব্যতীত অন্য কোন পাণ্ডব দ্রৌপদীকে গ্রহণ করলে বা দ্রৌপদীর সাথে অধিকারপ্রাপ্ত পাণ্ডবের বিহারকালে অন্য পাণ্ডব দর্শন করলে- তাঁকে ১২ বৎসর বনবাসী থাকতে হবে। ঘটনাক্রমে একবার এক ব্রাহ্মণকে সাহায্য করার জন্য- অর্জুন অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলে- সেখানে যুধিষ্ঠিরের সাথে দ্রৌপদীকে এক শয্যায় দেখতে পান। এই কারণে ইনি ১২ বৎসর বনবাসের জন্য গৃহত্যাগ করেন। বনবাসকালে ইনি বিভিন্নস্থানে ভ্রমণ করে বেড়ান। এই সময়ে ইনি পরশুরামের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাঁর কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। এই ভ্রমণকালে ইনি নাগকন্যা উলূপী ও মণিপুর-রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করেন। তাঁর ঔরসে উলূপীর গর্ভে ইরাবান এবং চিত্রাঙ্গদার গর্ভে বভ্রুবাহনের জন্ম হয়।

এরপর অর্জুন দক্ষিণসাগরের দিকে যাত্রা করেন, পঞ্চতীর্থকে কুমীরমুক্ত করেন। উল্লেখ্য এই তীর্থে অভিশপ্ত অপ্সরা বর্গা ও তাঁর চার সখী কুমিররূপে থাকতেন। অর্জুনের স্পর্শে তাঁরা অভিশাপমুক্ত হন। এরপর অর্জুন দ্বারকায় এলে শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। সেখানে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে ও সহায়তায় তাঁর বোন সুভদ্রাকে হরণ করে অর্জুন বিবাহ করেন। সুভদ্রার গর্ভে তাঁর অভিমন্যু নামে একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করে। ১২ বৎসর পর পুনরায় পাণ্ডবদের সাথে ইনি মিলিত হন। এই সময় দ্রৌপদীর সাথে মিলিত হলে, শ্রুতকর্মা নামক একটি পুত্রসন্তান জন্মে।

এই সময় একদিন অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ যমুনাতীরে ভ্রমণ করার সময় অগ্নি এসে খাণ্ডববন দগ্ধ করার জন্য অর্জুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। অর্জুন তাকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। কিন্তু একই সাথে জানালেন যে, উক্ত বন দগ্ধ করতে গেলে দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। এবং আরও বললেন যে, দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে গেলে যে ধরনের অস্ত্র প্রয়োজন, সে ধরনের অস্ত্র তাঁর কাছে নেই। অগ্নিদেব তখন তাঁর সখা বরুণকে অনুরোধ করে– তাঁর কাছ থেকে গাণ্ডীবধনু, অক্ষয় তূণীদ্বয় ও কপিধ্বজা রথ এনে দিলেন। এই সকল অস্ত্রের সাহায্যে কৃষ্ণ ও অর্জুন দেবতাদের পরাস্ত করেন। পরে শর নিক্ষেপে অর্জুন খাণ্ডববন দগ্ধ করেন।
[২২৩-২৪ অধ্যায়। আদিপর্ব। মহাভারত]

এরপর অক্ষক্রীড়ায় যুধিষ্ঠির রাজ্যচ্যুত হলে, অন্যান্য ভাইদের সাথে ইনি ১৩ বৎসরের জন্য বনবাসে যান। এই সময়ে কিরাতবেশী মহাদেব-এর সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুনকে পাশুপাত অস্ত্র প্রদান করেন। এরপর ইন্দ্র, বরুণ, কুবের ও যমের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রসমূহ লাভ করেন। এরপর তাঁর পিতা ইন্দ্র তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান। সেখানে ইনি গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের কাছে নৃত্যগীতি শিক্ষা করেন। স্বর্গবাসকালে উর্বশী তাঁকে প্রেম নিবেদন করলে- ইনি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করেন। এই কারণে, উর্বশী তাঁকে এক বৎসর নপুংসক অবস্থায় অতিবাহিত হওয়ার অভিশাপ দেন। এরপর ইনি ইন্দ্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত করেন। শিক্ষা শেষে ইনি গুরুদক্ষিণা বাবদ- ইন্দ্রের শত্রু নিবাতকবচ নামক তিন কোটি দানবকে তাদের সমুদ্র মধ্যস্থ দুর্গসহ ধ্বংস করেন এবং পৌলম ও কালকেয় অসুরদের বিনাশ করেন। এই কারণে ইন্দ্র সন্তুষ্ট হয়ে- তাঁকে অভেদ্য দিব্যকবচ, হিরণ্ময়ী মালা, দেবদত্ত শঙ্খ, দিব্যকিরীট, দিব্যবস্ত্র ও ভরণ উপহার দেন। পাঁচ বৎসর ইন্দ্রলোকে থাকার পর ইনি বনে এসে ভাইদের সাথে যোগ দেন।

এরপর দ্বৈতবনে থাকাকালে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দুর্যোধনকে বন্দী করেন। এই কারণে চিত্রসেনের সাথে অর্জুনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অর্জুন চিত্রসেনকে পরাজিত করে দুর্যোধনকে উদ্ধার করেন।

সিন্ধুরাজ দ্রৌপদীকে হরণ করলে, অর্জুন ও ভীম মিলে তাঁকে শাস্তি দেন। এরপর এঁরা মৎস্যরাজ বিরাট-ভবনে উপস্থিত হন। সেখানে উর্বশীর শাপে অর্জুন নপংশুক হয়ে বৃহন্নলা নাম ধারণ করেন। এই বেশে বিরাট-কন্যা উত্তরাকে ইনি নৃত্যগীত শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে এক বৎসর অতিবাহিত করেন। পাণ্ডবদের এই অজ্ঞাতবাসের শেষাংশে দুর্যোধন বিরাটরাজের গোধন হরণ করলে বৃহন্নলারূপী অর্জুন কৌরব-সৈন্যদের পরাস্ত করে গোধন উদ্ধার করেন। যুদ্ধ শেষে বিরাটরাজ অর্জুনের সাথে উত্তরার বিবাহ ঠিক করেন। কিন্তু শিষ্যা কন্যার মত বলে ইনি নিজ পুত্র অভিমন্যুর সাথে উত্তরার বিবাহ দেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি কৃষ্ণকে উপদেষ্টা ও তাঁর রথের সারথি হিসাবে লাভ করেন। এরপর অর্জুন স্বজনবধে বিমুখ হলে- কৃষ্ণ তাঁকে উপদেশ দিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করেন। এই উপদেশসমূহের সংকলনই হলো- শ্রীমদ্ভগভদ্গীতা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি অসংখ্য কৌরব-সৈন্যকে হত্যা করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দশম দিনে এঁর শরাঘাতে ভীষ্ম শরশয্যা গ্রহণ করে- ইচ্ছামৃত্য গ্রহণ করেন। এছাড়া যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে ভগদত্তকে, চতুর্দশ দিনে অভিমন্যু বধের প্রতিজ্ঞা স্বরূপ জয়দ্রুতকে, পঞ্চদশ দিনে দ্রোণাচার্যকে, ষোড়শ দিনে মগধরাজ দণ্ডধারকে ও সপ্তদশ দিনে কর্ণকে হত্যা করেন।

যুদ্ধজয়ের পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞের অশ্ব রক্ষার জন্য অর্জুন যাত্রা করে ত্রিগর্ত, প্রাগ্‌জ্যোতিষপুর ও সিন্ধুদেশ জয় করেন। মণিপুরে নিজপুত্র বভ্রুবাহনের সাথে যুদ্ধে ইনি প্রাণ হারালে– অর্জুনের স্ত্রী নাগকন্যা উলূপী নাগলোক থেকে সঞ্জীবনী এনে তাঁকে জীবিত করে তোলেন। এরপর ইনি অশ্বসহ স্বরাজ্যে ফিরে সেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু ও যাদবকুলের বিনাশের সংবাদ পেয়ে ইনি দ্বারকায় যান। অর্জুন সেখানকার নারীদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসার সময়- পথে আভীর দস্যুরা যাদব-নারীদের লুণ্ঠন করে। কৃষ্ণের মৃত্যু ও নিজ দৈবশক্তি হানির ফলে ইনি দস্যুদের বাধা দিতে পারেন নাই।

পাণ্ডবরা অর্জুনের পৌত্র (অভিমন্যুর পুত্র) পরীক্ষিত্কে রাজা করে মহাপ্রস্থানে গমন করেন। পথে লোহিত সাগরের তীরে অগ্নিদেবের অনুরোধে অর্জুন গাণ্ডীবধনু ও অক্ষয় তূণ দুটি পরিত্যাগ করেন। হিমালয় পার হয়ে মহাস্থানের পথে যেতে যেতে- দ্রৌপদী, সহদেব, নকুলের পতনের পর অর্জুনের মৃত্যু হয়। ভীমের প্রশ্নে উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন, –অর্জুন একদিনে শত্রু-সৈন্য বিনষ্ট করবার প্রতিজ্ঞা করে তা রক্ষা করতে অসমর্থ হয়েছিলেন এবং অন্যান্য ধনুর্ধরদের অবজ্ঞা করতেন বলেই এঁর পতন হয়েছে।

অর্বাবসু

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি ছিলেন মহর্ষি রৈভ্যের সন্তান। এঁরা ছিলেন দুই ভাই। এর অপর ভাইয়ের নাম ছিল পরাবসু। উভয় ভাই অত্যন্ত যত্নের সাথে পিতা রৈভ্যর কাছে বেদ শিক্ষা করেন। ফলে উভয়কেই ব্রাহ্মণ ও দেবতারা অত্যন্ত সম্মান করতো।

অন্যদিকে রৈভ্যের প্রতিবেশী ছিলেন ভরদ্বাজ নামক প্রখ্যাত ঋষি। এই ঋষি ও তাঁর পুত্র যবক্রীত বেদ অধ্যয়ন না করে তপস্যার দ্বারা বেদজ্ঞান লাভের চেষ্টা করেছিলেন বলে, অন্যান্য ঋষিরা ভরদ্বাজ ও যবক্রীতকে সম্মান করতেন না। বিষয়টি লক্ষ্য করে যবক্রীত কঠোর তপস্যা শুরু করেন। এই তপস্যায় ইনি কোন গুরুর সাহায্য নিলেন না। এই তপস্যায় ইনি এতই কঠোরভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন যে, ইন্দ্র অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লেন এবং তাঁকে গুরুর কাছে বেদ শিক্ষার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু যবক্রীত ইন্দ্রের কথা না শুনে তপস্যা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এরপর ইন্দ্র যক্ষ্মারুগী ব্রাহ্মণের রূপ ধরে গঙ্গা তীরে এসে বার বার মুঠি মুঠি বালি পানিতে ফেলতে লাগলেন। এই দেখে যবক্রীত ব্রাহ্মণরূপী ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। এর উত্তরে ইন্দ্র বললেন, তুমি যেমন বেদজ্ঞ হওয়ার আশায় বৃথা তপস্যা করছ, আমিও তেমনি বালু দিয়ে গঙ্গায় সেতু বাঁধার চেষ্টা করছি। যবক্রীত পরে ইন্দ্রের পরিচয় জানতে পেরে তাঁর কাছে বিদ্বান হওয়ার বর প্রার্থনা করলেন। তখন ইন্দ্র খুশী হয়ে পিতাপুত্রকে বেদজ্ঞ হবার বর দান করেলেন। এরপর যবক্রীত এই বিষয়টি তাঁর পিতা ভরদ্বাজকে জানালে, ভরদ্বাজ যবক্রীতকে বললেন, অভীষ্ট বর পেয়ে তুমি অহঙ্কারী ও ক্ষুদ্রমনা হবে, ফলে তোমার মৃত্যু হবে।

এর কিছুদিন পর, একদিন যবক্রীত পরাবসুর সুন্দরী স্ত্রীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কামনা করলেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে পরাবসুর স্ত্রী ভয় পেয়ে সেখানে থেকে পালিয়ে যান। এই সংবাদ পেয়ে রৈভ্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দুইগাছি জটা ছিন্ন করে আগুনে নিক্ষেপ করলে এক সুন্দরী নারী ও একটি রাক্ষস সৃষ্টি হয়। যবক্রীতকে হত্যা করার জন্য রৈভ্য উভয়কে আদেশ করেন। এরপর রৈভ্য প্রেরিত সেই নারী যবক্রীতকে রূপ দ্বারা মুগ্ধ করে তাঁর কমণ্ডলু চুরি করে। কমণ্ডলুহীন হয়ে যবক্রীত আত্মরক্ষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এই সময় রৈভ্য প্রেরিত রাক্ষস শূল তুলে তাঁকে হত্যা করার জন্য অগ্রসর হয়। যবক্রীত বিপদ বুঝতে পেরে দৌড়ে ভরদ্বাজের অগ্নিহোত্র গৃহে আশ্রয় নিতে গেলে- সেই ঘরের অন্ধ রক্ষী তাঁকে সবলে ধরে রাখে। ফলে রাক্ষস অনায়াসে শূলের আঘাতে যবক্রীতকে হত্যা করে। ভরদ্বাজ পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রৈভ্যকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে- কনিষ্ঠ পুত্রের হাতেই রৈভ্যের মৃত্যু হবে। এরপর ভরদ্বাজ আগুনে আত্মহত্যা করেন।

এর কিছুদিন পর রাজা বৃহদ্যুম্নের একটি যজ্ঞ করার আয়োজন করেন। উক্ত যজ্ঞের কাজে রাজা অর্বাবসু ও পরাবসুকে নিযুক্ত করেন। একদিন রাত্রে পরাবসু আশ্রমে ফেরার সময় বনের মধ্যে রৈভ্যকে দেখে হরিণ মনে করে হত্যা করেন। পিতার হত্যার পর পরাবসু তাঁর বড় ভাই অর্বাবসুকে পিতৃহত্যার কথা বলেন। এরপর পরাবসুর কথামতো অর্বাবসু আশ্রমে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে রাজা বৃহদ্দ্যুম্নের যজ্ঞে যোগদান করেন। কিন্তু রাজা ভাইয়ের পিতৃহত্যার অপরাধে- অর্বাবসুকে বিতারিত করেন। এরপর অর্বাবসু বনে গিয়ে সূর্যের উপাসনা করতে লাগলেন। উপাসনার ফলে সূর্য ও দেবতারা খুশি হয়ে অর্বাবসুকে বর প্রদান করেন। এই বরে রৈভ্য, ভরদ্বাজ ও যবক্রীত পুনর্জীবিত হন এবং পরবাসুর পাপ দূর হয়।

পুনর্জীবন লাভ করার পর যবক্রীত দেবতাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বেদাধ্যায়ী ও তপস্বী হওয়া সত্ত্বেও রৈভ্য তাঁকে কেমন করে হত্যা করার ক্ষমতা লাভ করলেন? উত্তরে দেবতারা বললেন- গুরুর সাহায্য না নিয়ে কেবল তপস্যার ফলে বেদশিক্ষা করেছিলেন যবক্রীত। কিন্তু রৈভ্য অতি কষ্টে গুরুর কাছে দীর্ঘকাল বেদপাঠ করেছিলেন। সে কারণে ক্ষমতার বিচারে রৈভ্য ছিলেন শ্রেষ্ঠ স্থানে।



অর্যমা

ঋগ্বেদ এর মতে- আদিত্যেদের একজন। ঋগ্বেদের ২য় মণ্ডলের ২৭ সূক্তে ছয়জন আদিত্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন মিত্র, অর্যমা, ভগ, বরুণ, দক্ষ এবং অংশ। কশ্যপ -এর ঔরসে অদিতি'র গর্ভে এঁর জন্ম হয়েছিল। দ্বাদশমূর্তি রূপে সূর্য দ্বাদশ আদিত্য-এ বিভাজিত।

প্রাচীন ভারতীয় আর্য এবং ইরানীয় আর্যরা মিত্রের পূজা করতেন। ইরানীয় আর্যরা মিথ্র (আলো বা সূর্য) হিসেবে পূজা করতেন। ভারতীয় আর্যরাও মিত্রকে আলো বা দিনের দেবতা হিসেবে মান্য করতেন



অশ্বত্থামা

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে দুটি ক্ষেত্রে এই নাম পাওয়া যায়। যেমন–
১. একটি হাতির নাম পাওয়া যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডব পক্ষের রাজা ইন্দ্রবর্মার হস্তির নাম ছিল অশ্বত্থামা। এই হাতির মৃত্যু হলে— যুদ্ধের কৌশল হিসাবে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচর্যের সামনে নাম উচ্চারণ করেছিলেন।

২. পিতার নাম দ্রোণাচার্য ও মাতার নাম কৃপী। ইনি জন্মের পরপরই অশ্বের মতো শব্দ করেছিলেন বলে- এঁর এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ অশ্বের ন্যায় স্থাম যাহার/ বহুব্রীহি সমাস– এই অর্থে সকার স্থানে তকারাদেশে নাম হয়েছিল অশ্বত্থামা। মহাদেব, যম, কাম ও ক্রোধের মিলিত অংশে এঁর জন্ম হয়েছিল। ইনি অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। এঁর চোখ ছিল পদ্ম-পলাশের মতো। তাঁর মাথায় একটি সহজাত মণি ছিল। এঁর পরিধেয় বস্ত্র ছিল নীল।

ইনি তাঁর পিতার কাছ থেকে বেদাদিশাস্ত্র ও ধনুর্বেদ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। পরে পিতা-মাতার সাথে ইনি হস্তিনাপুরে কৃপাচার্যের (কৃপী'র ভাই ও অশ্বত্থামার মামা) কাছে আসেন। এই সময় ভীষ্ম দ্রোণাচার্যকে কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্র শিক্ষায় নিয়োগ করলে তাঁদের সাথে ইনিও অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেন। পুত্রের প্রতি অত্যধিক স্নেহবশত ইনি অন্যান্য শিষ্যদের চেয়ে অশ্বত্থামাকে অধিকতর শিক্ষা প্রদান করেন। এর ফলে অশ্বত্থামা বহু গুপ্ত অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল পিতার কাছ থেকে শিখেছিলেন। পিতার কাছ থেকে নারায়ণ প্রদত্ত নারায়ণাস্ত্র ও ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র লাভ করেন। পাণ্ডবদের বনবাসকালে দুর্যোধন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে ইনি হস্তিনাপুরে অবস্থান করেন। এই সময় ভূমণ্ডলে অজেয় হওয়ার আশায় ইনি দ্বারকায় গিয়ে কৃষ্ণের কাছে ব্রহ্মশির অস্ত্রের বিনিময়ে সুদর্শনচক্র প্রার্থনা করেন। কৃষ্ণ তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে তাঁকে উক্ত চক্র উত্তোলন করতে বললে- ইনি তা উত্তোলনে অক্ষম হন এবং লজ্জিত হয়ে নতশিরে প্রত্যাগমন করেন।

দ্রোণাচার্য বিরাটরাজার গো-হরণের সময় ইনি দুর্যোধনের সাথে গিয়েছিলেন। বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে দেখে কর্ণ আস্ফালন করতে থাকলে, ইনি অর্জুনের শক্তির কথা উল্লেখ করে কর্ণকে তিরস্কার ও অপমান করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি তাঁর পিতার সাথে দুর্যোধনের পক্ষাবলম্বন করেন। যুদ্ধের আরম্ভে, দম্ভের সাথে ইনি প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন- দশদিনে ইনি পাণ্ডব সৈন্য নিধন করবেন। বলাবাহুল্য তিনি তা পারেন নি। দুর্যোধন এঁর হাতে এক অক্ষৌহিনী (২১৮৭০ গজ ও গজারোহী, ২১৮৭০ রথ ও রথী, ৬৫৬১০ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ১০৯৩৫০ পদাতিক ) সৈন্যের ভার অর্পণ করেছিলেন। এঁর রথের পতাকায় সিংহের লেজ অঙ্কিত ছিল।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণাচার্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে- শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের সকল সৈন্যকে 'অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে'- এইরূপ ঘোষণা দিতে বলে। সেইভাবে এই বাক্য ঘোষিত হতে থাকলে দ্রোণাচার্য প্রথমে তা অবিশ্বাস করে বলেন যে,- যুধিষ্ঠির বললে তবেই তিনি তা বিশ্বাস করবেন। এরপর কৃষ্ণ ও ভীমের প্ররোচনায় যুধিষ্ঠির দ্রোণের উদ্দেশ্যে 'অশ্বত্থামা হতঃ- কুঞ্জর ইতি' (অশ্বত্থামা -নামক হাতী নিহত হয়েছে) বাক্য উচ্চারণ করেন। উল্লেখ্য পাণ্ডব পক্ষের রাজা ইন্দ্রবর্মার হস্তির নাম অশ্বত্থামা ছিল এবং তা পূর্বেই নিহত হয়েছিল। যুধিষ্ঠির কুঞ্জর ইতি শব্দটি আস্তে বলাতে দ্রোণচার্য মনে করেন যে তাঁর পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়েছে। এরপর দ্রোণাচার্য অস্ত্র ত্যাগ করলে– ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করেন। অশ্বত্থামা তাঁর পিতার এরূপ মৃত্যুর কথা শুনে নারায়ণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। কিন্তু কৃষ্ণের উপদেশে সকলে রথ ও অস্ত্রাদি ত্যাগ করে অস্ত্রের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালে এই অস্ত্র বিফল হয়। এরপর ইনি পিতার হত্যাকারী ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করার জন্য বার বার চেষ্টা সত্বেও ভীম, অর্জুন ও সাত্যকির কারণে তা সম্ভব হয় নি। এই সময় অসংখ্য পাণ্ডব সৈন্য ধ্বংস করার পরও কৃষ্ণার্জুনকেও হত্যা করতে সক্ষম হলেন না। এরপর অর্জুন-কর্ণের যুদ্ধে অর্জুনের বীরত্ব দেখে ইনি দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব দিতে বলেন। দুর্যোধন সে কথা না শুনে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন।

অর্জুন কর্তৃক কর্ণ নিহত হলে- দুর্যোধন তাঁর কাছে নূতন সেনাপতি নিয়োগের পরামর্শ নিতে এলে- ইনি শল্যকে সে পদ দিতে বলেন। দুর্যোধনের উরুভঙ্গের পর ইনি সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত হন। সেনাপতি পদ লাভ করার পর ইনি চিত্কার করতে করতে অগ্রসর হলে- কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা তাঁকে অনুসরণ করে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সন্ধ্যার দিকে একটি বনে প্রবেশ করেন। একটি প্রকাণ্ড গাছের নীচে কৃপাচার্য ও কৃপবর্মা ঘুমিয়ে পড়লেও পাণ্ডবদের প্রতি ক্রোধের কারণে অশ্বত্থামা ঘুমাতে পারলেন না। সেই সময় ইনি দেখলেন যে- একটি বিশাল পেঁচা রাত্রির অন্ধকারে অসংখ্য ঘুমন্ত কাককে হত্যা করছে। এ দৃশ্য দেখার পর ইনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাত্রের অন্ধকারে পাণ্ডবশিবিরে প্রবেশ করে এইভাবে পাণ্ডবদের হত্যা করবেন। এই কাজের জন্য ইনি কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাঁর কাজে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করলেন। প্রথমে এঁরা রাজী না হলেও শেষ পর্যন্ত ইনি তাঁদেরকে তাঁর অনুগামী হতে বাধ্য করলেন। পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশের মুখে ইনি মহাদেবের আরাধনা করলে, স্বয়ং মহাদেব আবির্ভুত হয়ে তাঁকে খড়্গ প্রদান করেন। উল্লেখ্য, এই সময় পঞ্চপাণ্ডব, কৃষ্ণ ও সাত্যকি গঙ্গাতীরে অবস্থান করছিলেন। এরপর কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাকে দ্বার রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করে ইনি পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে প্রথমে ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করেন। এরপর খড়্গাঘাতে- উত্তমৌজাঃ, যুধামনু্যকে হত্যা করলে, অন্যান্য পাণ্ডব-বীরেরা জেগে উঠেন এবং তাঁরা অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করেন। কিন্তু অশ্বত্থামা পাল্টা আঘাতে সবাইকে হত্যা করতে সক্ষম হন। এরপর ইনি দ্রৌপদীর পুত্রদের, শিখণ্ডী ও অন্যান্য পাণ্ডব বীরদের হত্যা করেন। এই সময় যারা ভয়ে শিবির থেকে পলায়নের চেষ্টা করেন তাঁদেরকেও কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা হত্যা করেন। এই সময় কৃতবর্মার অসতর্কতার কারণে ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি কোন প্রকারে পালাতে সক্ষম হন। পরদিন যুধিষ্ঠিরকে সকল বিষয় জানালে, দ্রৌপদী পুত্র ও ভ্রাতৃশোকে প্রতিজ্ঞা করে বলেন যে, অশ্বত্থামাকে পরাজিত করে তাঁর সহজাতমণি যদি যুধিষ্ঠির ধারণ না করতে পারেন, তবে তিনি প্রায়োপবেশনে প্রাণ ত্যাগ করবেন। এরপর ভীম অশ্বত্থামাকে হত্যা করার জন্য অগ্রসর হলে তাঁকে সাহায্য করার জন্য যুধিষ্ঠির অর্জুনকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হন।

অশ্বত্থামা এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর প্রথমে দুর্যোধনকে সংবাদ দান করলে, আনন্দে ইনি তাঁকে আশীর্বাদ করে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ইনি ভাগীরথীর তীরে ব্যাসদেবের কাছে যান। এঁকে খুঁজতে খুঁজতে যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জুন সেখানে উপস্থিত হলে- ইনি পাণ্ডব নিধনের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করেন। কৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুনও প্রতিষেধক হিসাবে একই অস্ত্র প্রয়োগ করলে- উভয় অস্ত্রের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়। সে কারণে দেবর্ষি নারদ ও মহর্ষি ব্যাস এই দুই অস্ত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উভয়ের অস্ত্র সংবরণ করতে বলেন। অর্জুন ব্রহ্মচর্য পালনের কারণে অস্ত্র প্রতিহারে সমর্থ হলেও, অশ্বত্থামা সদা সত্পথে না থাকায় ইনি তাঁর অস্ত্র প্রত্যাহার করতে পারলেন না। ফলে উক্ত অস্ত্র ব্যর্থ হয়ে অর্জুনের পুত্রবধু উত্তরার গর্ভস্থ শিশুকে হত্যা করে। পরে কৃষ্ণ যোগবলে শিশুটিকে জীবিত করেন।

অশ্বত্থামা এর পরে পাণ্ডবদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে তাঁর সহজাত মণি প্রদান করেন। এরপর দুঃখিত মনে বনে গমন করেন। অশ্বত্থামা বিবাহ করেন নি। ব্রাহ্মণ হয়েও ইনি পিতার মতো ক্ষাত্রবৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন।


অশ্বপত

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি মুদ্রা দেশের রাজা ছিলেন। ইনি সন্তান লাভের জন্য সাবিত্রী'র আরাধনা করেন। দেবীর বরে এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে ইনি এই কন্যার নাম রাখেন সাবিত্রী। এই সাবিত্রীই হলো- মহাভারতে বর্ণিত সাবিত্রী-সত্যবান উপাখ্যানের নায়িকা।


অশ্বমেধ

ভারতীয় আর্যদের পালিত যজ্ঞ বিশেষ। অশ্ব বলি দিয়ে এই হোম বা যজ্ঞ করা হতো। বড় বড় রাজারাই এই যজ্ঞ করতেন।

নিরানব্বইটি যজ্ঞ করার পর সর্বসুলক্ষণাক্রান্ত একটি অশ্বের কপালে জয়পত্র বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হতো। যজ্ঞের ঘোড়ার বর্ণনায় বলা হয়েছে― এই ঘোড়া হবে কৃষ্ণবর্ণের, মুখ সুবর্ণতুল্য, মুখের দুই পাশে থাকবে অর্ধচন্দ্র চিহ্ন অঙ্কিত, পুচ্ছ হবে বিদ্যুতের মতো প্রভাযুক্ত, পেট হবে কুন্দ ফুলের ন্যায় শ্বেতবর্ণ। এর হরিৎবর্ণের পা থাকবে এবং কান হবে সিঁদুরের মতো রক্তিম। জিহ্বা হবে প্রজ্জ্বলিত আগুনের মতো, চোখ হবে তেজস্কর এবং সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকেব সুগন্ধ।

এই ঘোড়া হবে অত্যন্ত বেগবান। এইরূপ ঘোড়া এক বৎসর ধরে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াত। এই সময়, এই ঘোড়াকে রক্ষা করার জন্য এর সাথে সৈন্যসামন্ত থাকতো। কেউ ওই ঘোড়াকে ধরলে এর সাথের সৈন্যরা তার সাথে যুদ্ধ করে সে ঘোড়াকে উদ্ধার করতো। এইভাবে বৎসরান্তে ঘোড়াটি ফিরে এলে, ঘোড়ার অধিকারী রাজা রাজচক্রবর্তী উপাধি প্রাপ্ত হতেন। ঘোড়া ফিরে এলে ব্রাহ্মণেরা শাস্ত্রমতে তাকে হত্যা করতো। রাত্রে রাজপত্নীরা এই ঘোড়াকে রক্ষা করতেন।

এই যজ্ঞে অশ্বকে বলিদানকালে বাঁধার জন্য একুশটি কাঠের যূপ তৈরি করা হতো। এর ছয়টি যূপ বেলকাঠের, ছয়টি খদির কাঠের, ছয়টি পলাশ কাঠের, দুটি দেবদারু কাঠের এবং একটি শ্লাষ্মতক কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো। এই যজ্ঞে অশ্ব ছাড়াও প্রায় তিনশত গরু, ছাগল এবং মেষও বলি দেওয়া হতো।এরপর অশ্ব বলি দেওয়া হতো। যজ্ঞের অশ্বের বক্ষঃস্থলের মেধ অগ্নিতে সংস্কার করা হত এবং দেহের অবশিষ্টাংশ দ্বারা হোম করা হতো।

আর্যরা মনে করতেন, এই যজ্ঞের ফলে ব্রহ্মহত্যাসহ সর্বপ্রকার পাপের ক্ষয় এবং স্বর্গ ও মোক্ষ লাভ হবে। যজ্ঞশেষে ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা এবং নিমন্ত্রিত রাজা ও অন্যান্য বর্ণের অতিথিদের উপহার দেওয়া হতো।

রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠির এই যজ্ঞ করেছিলেন। রাজা দশরথ পুত্র-কামনায় এই যজ্ঞ করেছিলেন। কথিত আছে শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে ইন্দ্রত্ব লাভ করা যায়। এই কারণে ইন্দ্র তাঁর ইন্দ্রত্ব রক্ষার জন্য শতমেধ যজ্ঞের বাধা দিতেন। এই কারণেই ইন্দ্র দিলীপ ও সগররাজের শততম অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব অপহরণ করেছিলেন।

ব্রহ্মপুরাণে কলিকালে এই যজ্ঞ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। অবশ্য আমেরের রাজা সেওয়ার জয়সিংহ অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।

অশ্বসেন

দ্রোণাচার্য-এর রথের সারথির নাম।

নাগ বিশেষ। এর পিতার নাম তক্ষক। কৃষ্ণ ও অর্জুন কর্তৃক খাণ্ডববন দহনকালে এর মা একে গলধকরণ করে বাইরে আনার চেষ্টা করলে অর্জুন তার শিরোশ্ছেদ করেন। এই সময় ইন্দ্র ঝড়বৃষ্টি সৃষ্টি করে অর্জুনকে মোহাচ্ছন্ন করলে অশ্বসেন মুক্ত হয়। অগ্নি, কৃষ্ণ ও অর্জুন তাকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে― সে নিরাশ্রয় হবে।

কর্ণার্জুন যুদ্ধের সময় অশ্বসেন মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অর্জুনকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে, কর্ণের অজ্ঞাতে তাঁর তূণে প্রবেশ করেছিল। কর্ণ যখন অর্জুনের উদ্দেশ্যে বাণ নিক্ষেপ করেন, তখন কৃষ্ণ এই বিষয়ে অবগত হয়ে রথ নিচু করেন। ফলে অশ্বসেন বাণ হয়ে অর্জুনের মুকুট দগ্ধ করে। এরপর অশ্বসেন কর্ণের কাছে গিয়ে আত্মপরিচয় দিয়ে তাকে পুনরায় বাণরূপে ব্যবহার করতে অনুরোধ করে। কিন্তু কর্ণ একবাণ দুইবার ব্যবহার না করতে এবং অন্যের সাহায্যে জয়লাভে অসম্মত হওয়ায়, অশ্বসেন নিজেই অর্জুনকে হত্যা করার জন্য ধাবিত হয় এবং অর্জুনের অস্তরাঘাতে নিহত হয়।


অশ্বায়ুর্বেদ
অশ্বের আয়ুর্বেদ বিষয়ক শাস্ত্র। শালিহোত্র তাঁর পুত্র সুশ্রুতকে ঘোড়ার চিকিৎসা বিষয়ক এই শাস্ত্র প্রদান করেছিলেন।


অশ্বিনী
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে–
১. প্রজাপতি দক্ষের কন্যা। এঁর সাথে চন্দ্রের বিবাহ হয়েছিল। চন্দ্রের ছিল ২৭টি স্ত্রী। এই স্ত্রীরা সবাই নক্ষত্র। চন্দ্রের ২৭টি নক্ষত্র-স্ত্রীর মধ্যে অশ্বিনী ছিলেন প্রথম।
২. অশ্বিনী কুমারের অপর নাম।


অশ্বিনীকুমার
অশ্বিনী (অশ্ব রূপিণী সূর্যপত্নী সংজ্ঞা) এবং তাঁর কুমার (পুত্র)। এই অর্থে অশ্বিনীকুমার।
স্বর্গের চিকিৎসক। এঁর পিতার নাম সূর্য ও মাতার নাম সংজ্ঞা।

সংজ্ঞা সূর্যের অসহ্য তেজ সহ্য করতে না পেরে, সূর্যকে দেখলে চোখ নামিয়ে ফেলতেন। এই জন্য সূর্য ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে, সংজ্ঞা তাঁর চক্ষু সংযমন করার জন্য প্রজাদের সংযমনকারী যম-কে প্রসব করবেন। এরপর এই অভিশাপের সূত্র সংজ্ঞা মৃত্যু দেবতা যমকে প্রসব করেন। এরপর তিনি অত্যন্ত ভীতা হয়ে চপলভাবে সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। তাঁর এই চপল চক্ষু দেখে সূর্য বললেন যে, তিনি চঞ্চলস্বভাবা একটি নদী প্রসব করার অভিশাপ দেন। এই অভিশাপের সূত্রে সংজ্ঞা, যমী নামক কন্যার জন্ম দেন। এই কন্যা যমুনা নামে প্রবাহিত হয়। এই কারণে যমী'কে অনেক সময় যমুনা বলা হয়।

যম ও যমী (যমুনা) জন্মের পর, স্বামীর রূপ ও ক্রোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, ইনি নিজের অনুরূপ ছায়া নামক এক নারীকে সৃষ্টি করেন। এরপর সূর্য ও নিজের পুত্র-কন্যার পরিচর্যার ভার ছায়ার উপর অর্পণ করে, পিতৃগৃহে যান। কিন্তু সংজ্ঞার পিতা বিশ্বকর্মা অসন্তুষ্ট হয়ে কন্যাকে সূর্যের কাছে ফিরে যেতে বলেন। এরপর ইনি স্বামীর কাছে না গিয়ে উত্তর কুরুবর্ষে ঘোটকীর রূপ ধারণ করে ভ্রমণ করতে থাকেন।

ছায়া নিজের সন্তানদের মত সংজ্ঞার সন্তানদের প্রতিপালন করতেন না। এতে যম একদিন ক্রুদ্ধ হয়ে ছায়াকে পদাঘাত করতে উদ্যত হয়েও পরমুহূর্তেই যম ছায়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু ছায়া ক্ষমা না করে যমকে অভিশাপ দিলেন যে, তাঁর পা খসে যাবে। যম পিতার কাছে গিয়ে বিমাতার এই ব্যবহারের কথা বলেন। সুর্য নিজ পুত্র যমকে অভিশাপ থেকে মুক্ত না করে বলেন যে, তাঁর পায়ের মাংস নিয়ে কৃমিরা মাটিতে প্রবেশ করবে। এরপর যম, সংজ্ঞা যে তাঁর আপন মা নয়― সে কথা সূর্যকে জানালেন। সমস্ত বিবরণ গোপন রেখে ছলনা করবার জন্য সূর্য ছায়াকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে, ছায়া সমস্ত কথা স্বীকার করে, সংজ্ঞার পিতৃগৃহে গমনের সমস্ত সংবাদ সূর্যকে বলে দেন।

এরপর সূর্য বিশ্বকর্মা'র কাছে গিয়ে, তাঁর স্ত্রীর (সংজ্ঞা) গৃহত্যাগের কারণ জানতে পারেন। এরপর সূর্য সমাধিস্থ হয়ে সংজ্ঞার অবস্থান এবং অশ্বীরূপ সম্পর্কে জানতে পারলেন। এরপর সূর্য বিশ্বকর্মা'র কাছে গিয়ে নিজের তেজ কমিয়ে অশ্বরূপ ধারণ করে ঘোটকীরূপিণী সংজ্ঞার সাথে মিলিত হলেন। এই মিলনের ফলে প্রথমে যুগল দেবতা অশ্বিনীকুমারদ্বয় ও পরে রেবন্তের জন্ম হয়।

―মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, বৈবস্বত ও সাবর্ণির উপখ্যান।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে এরা অশ্বিনীকুমারদ্বয় নামে খ্যাত। পরবর্তী সময়ে এরা চিকিৎসাবিদ্যায় সুপণ্ডিত হয়ে উঠলে– স্বর্গবৈদ্য উপাধিতে ভূষিত হন। চিকিৎসা বিষয়ক এদের রচিত গ্রন্থের নাম হলো চিকিৎসা-সার-তত্ত্ব।

এরা দেখতে একইরকম ছিলেন এবং সবসময় এক সাথেই থাকতেন। অত্যন্ত রূপবান হিসাবে এঁরা খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পাণ্ডুপত্নী মাদ্রী ক্ষেত্রজ সন্তান লাভের জন্য কুন্তীর শেখানো মন্ত্রের সাহায্যে এই দুই ভাইকে আহ্বান করেছিলেন। উভয় দেবতার সাথে মিলিত হয়ে মাদ্রী দুটি সন্তান লাভ করেছিলেন। এই সন্তানদ্বয় হলো– নকুল ও সহদেব।

এঁরা একটি সুবর্ণ রথে দিনে তিনবার ও রাতে তিনবার পৃথিবী পরিভ্রমণ করেন। আশ্বিনীকুমারদ্বয় সম্পর্কে বেশ মতভেদ রয়েছে। যেমন–
১. নিরুক্তকার যস্কের মতে : চন্দ্র ও সূর্য।
২. বেদের মতে : পৃথিবী ও স্বর্গ, দিবা ও রাত্রি, সূর্য ও চন্দ্র, বিবস্বান ও কারণ্যুর পুত্র, আকাশের পুত্র, সিন্ধুগর্ভ সম্ভূত, দক্ষ সম্ভূত ইত্যাদি।

এঁর অপরাপর নাম : অব্দিজ, অরুণাত্মজ, অর্কতনয়, অর্কনন্দন, অর্কপুত্র, অর্কসূত, অর্কসূনু, অশ্বিনীকুমার, অশ্বিনীপুত্র, অশ্বিনীসূত, অশ্বিনীসূত।


অশ্বী
হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র। ঋগ্বেদের মতে– ত্বষ্টার দুটি যমজ সন্তান ছিল। এর একটি ছিল কন্যা, অপরটি ছিল পুত্র। কন্যার নাম ছিল সরণ্যু এবং পুত্রের নাম ছিল ত্রিশিরা। বিবস্বানের সাথে সরণ্যুর বিবাহ হয়েছিল। এঁদের যম এবং যমী নামে যমজ পুত্র-কন্যা জন্মেছিল।

সরণ্যু বিবস্বানের তেজ সহ্য করতে না পেরে, নিজের মত করে একটি নারী সৃষ্টি করে স্বামীর কাছে উক্ত সন্তানদ্বয় রেখে– অশ্বিনীর (ঘোটকী) রূপ ধারণ করে ভ্রমণ করতে থাকেন। বিবস্বান উক্ত নারীকে স্ত্রী ভেবে তাঁর সাথে মিলিত হন। ফলে উক্ত নারীর গর্ভে মনু নামক একটি তেজস্বী সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বিবস্বান পরে সরণ্যুর পলায়ন বৃত্তান্ত জানতে পেরে– ঘোড়ার রূপ ধরে অশ্বিনীরূপী সরণ্যুর সাথে মিলিত হন। এর ফলে দুটি কুমারের জন্ম হয়। এঁদের একজনের নাম নাসত্য ও অপরের নাম দস্র। অশ্বীদ্বয় নামে এঁদের স্তব করা হয়।


অসমঞ্জ

হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র। এর অপর নাম অংশুধর।
সগর রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র। এঁর মায়ের নাম কেশিনী। সগর রাজার দুটি স্ত্রী ছিল। সগরের অপর স্ত্রীর নাম ছিল সুমতি। একবার সগর পুত্র পাওয়ার আশায় দুই পত্নীকে সাথে নিয়ে হিমালয়ে তপস্যা করেন। এরপর ভৃগুর বরে সুমতির গর্ভে অসমঞ্জ ও কেশিনীর গর্ভে ষাট হাজার পুত্র জন্মে। অসমঞ্জ যৌবনের প্রারম্ভে দুর্দান্ত ছিলেন। এজন্য এঁর পিতা এঁকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেন। সগরের যজ্ঞের জন্য নির্বাচিত অশ্ব অন্বেষণের জন্য তাঁর ষাট হাজার পুত্র যখন কপিলমুনির ক্রোধে ভস্মীভূত হয়, তখন অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান কপিলমুনিকে সন্তুষ্ট করে যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে আনেন।



অসিক্লী


হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি ছিলেন প্রজাপতি বীরণের কন্যা । পিতার নামানুসারে এঁর অপর নাম বৈরণী। ইনি দক্ষের স্ত্রী ছিলেন। দক্ষের ইচ্ছা পূরণের নিমিত্তে এঁরই গর্ভে মহামায়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পৌরাণিক কাহিনিতে এই কন্যা সতী নামে খ্যাত।


অসিত

১. সূর্যবংশীয় ভরতের পুত্র।
২. জনৈক মুনি। ইনি অসিতদেবল নামে সর্বাধিক পরিচিত।


অসিতদেবল

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি সরস্বতী নদীর তীরে আদিত্যতীর্থে বসবাস করতেন। ইনি ছিলেন গার্হস্থ্য-ধর্মী তপস্বী। একবার ভিক্ষু জৈগীষব্য মুনি দেবলের আশ্রমে এসে যোগনিরত অবস্থায় বাস শুরু করেন। ইনি সারাদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে শুধুমাত্র খাওয়ার সময় হাজির হতেন। ফলে অসিতদেবলের সাথে তাঁর বিশেষ পরিচয় ঘটার সুযোগ হলো না। একদিন অসিতদেবল খাবারের সময়ও এই তপস্বীকে দেখতে না পেয়ে, একটি কলস নিয়ে আকাশপথে মহাসমুদ্রে এসে দেখলেন– তপস্বী সেখানে উপস্থিত আছেন। ইনি তাঁর ধ্যানে বিঘ্ন না ঘটিয়ে আশ্রমে ফিরে এসে দেখলেন তপস্বী তাঁর আগেই আশ্রমে ফিরে এসেছেন। এরপর কৌতুহলবশত ইনি অন্তরীক্ষ, পিতৃলোক, যমলোক, সূর্যলোক ইত্যাদি পরিভ্রমণ করে, প্রত্যেক স্থানে তপস্বীকে দেখতে পেলেন। অবশেষ এই তপস্বী ব্রহ্মলোকে এসে হারিয়ে গেলেন। অসিতদেবল তাঁর অল্প তপস্যার কারণে সেখানে প্রবেশ করতে পারলেন না। এরপর ইনি আশ্রমে ফিরে এসে তাঁর কাছে মোক্ষধর্ম গ্রহণ করে সিদ্ধি লাভ করেন। ইনি অসিত, অসিতদেবল ও দেবল এই তিন নামে খ্যাত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন– হিমালয় কন্যা একপর্ণা।


অসিতলোমা
দানব বিশেষ। কশ্যপ মুনির ঔরসে ও দনুর গর্ভে এঁর জন্ম হয়েছিল। মহিষাসুরের সাথে দুর্গাদেবীর যুদ্ধের সময় অসিতলোমা দুর্গার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যুদ্ধে ব্রহ্মার বরে ইনি দুর্গার বিরুদ্ধে জয়ী হন। পরে ইনি বরুণের সাথে যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হয়ে তাঁকেও পরাজিত করেন। এরপর ইনি সকল দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলে, দেবতারা মহাদেবের শরণাপন্ন হন। মহাদেব সকল দেবতাদের সাথে করে বিষ্ণুর কাছে যান। বিষ্ণু এই দানবকে বিনাশ করার জন্য তাঁর শরীর থেকে অষ্টাভূজা মহালক্ষ্মীর সৃষ্টি করেন। এই মহালক্ষ্মীর হাতে অসিতলোমা নিহত হন।
















Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।