আমরা সকলেই ভারতের অধঃপতন সম্বন্ধে শুনিয়া থাকি। এককালে আমিও ইহা বিশ্বাস করিতাম। কিন্তু আজ অভিজ্ঞতার দৃঢ়ভূমিতে দাঁড়াইয়া, সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি লইয়া সর্বোপরি দেশের সংস্পর্শে আসিয়া উহাদের অতিরঞ্জিত চিত্রসমূহের বাস্তবরূপ দেখিয়া সবিনয়ে স্বীকার করিতেছি, আমার ভুল হইয়াছিল। হে পবিত্র আর্যভূমি, তোমার তো কখনও অবনতি হয় নাই। কত রাজদণ্ড চূর্ণ হইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, কত শক্তির দণ্ড এক হাত হইতে অন্য হাতে গিয়াছে কিন্তু ভারতবর্ষে রাজা-রাজসভা অতি অল্প লোককেই প্রভাবিত করিয়াছে। উচ্চতম হইতে নিম্নতম শ্রেণী অবধি বিশাল জনসমষ্টি আপন অনিবার্য গতিপথে ছুটিয়া চলিয়াছে, জাতীয় জীবনস্রোত কখনও মৃদু অর্ধচেতনভাবে, কখনও প্রবল জাগ্রতভাবে প্রবাহিত হইয়াছে। শত শতাব্দীর সমুজ্জ্বল শোভাযাত্রার সম্মুখে আমি স্তম্ভিত বিস্ময়ে দণ্ডায়মান। সে শোভাযাত্রার কোন কোনও অংশে আলোকরেখা স্তিমিতপ্রায়, পরক্ষণে দ্বিগুণ তেজে ভাস্বর, আর উহার মাঝখানে আমার দেশমাতৃকা রানীর মতো পদবিক্ষেপে পশুমানবকে দেবমানবে রূপান্তরিত করিবার জন্য মহিমময় ভবিষ্যতের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছেন; স্বর্গ বা মর্তের কোন শক্তির সাধ্য নাই—এ জয়যাত্রার গতিরোধ করে।
হে ভ্রাতৃবৃন্দ, সত্যই মহিমময় ভবিষ্যৎ! প্রাচীন উপনিষদের যুগ হইতে আমরা পৃথিবীর সমক্ষে স্পর্ধাপূর্বক এই আদর্শ প্রচার করিয়াছেঃ ‘ন প্রজয়া ন ধনেন ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’—পারে। জাতির পর জাতি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হইয়াছে এবং বাসনার জগতে থাকিয়া জগৎ-রহস্য সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে। তাহারা সকলেই ব্যর্থ হইয়াছে, প্রাচীন জাতিসমূহ ক্ষমতা ও অর্থগৃধ্নুতার ফলে জাত অসাধুতা ও দুর্দশার চাপে বিলুপ্ত হইয়াছে—নূতন জাতিসমূহ পতনোন্মুখ । শান্তি অথবা যুদ্ধ, সহনশীলতা অথবা অসহিষ্ণুতা, সততা অথবা খলতা, বুদ্ধিবল অথবা বাহুবল, আধ্যাত্মিকতা অথবা ঐহিকতা—এগুলির মধ্যে কোন্টির জয় হইবে, সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও বাকি।
বহু পূর্বে আমরা এ-সমস্যার সমাধান করিয়াছি, সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়া সেই সমাধান অবলম্বন করিয়াই চলিয়াছি, শেষ অবধি ইহাই ধরিয়া রাখিতে চাই। আমাদর সমাধান—ত্যাগ, অপার্থিবতা।
সমগ্র মানবজাতির আধ্যাত্মিক রূপান্তর—ইহাই ভারতীয় জীবন-সাধনার মূলমন্ত্র, ভারতের চিরন্তন সঙ্গীতের মূল সুর, ভারতীয় সত্তার মেরুদণ্ড-স্বরূপ, ভারতীয়তার ভিত্তি, ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান প্রেরণা ও বাণী। তাতার, তুর্কী, মোগল, ইংরেজ—কাহারও শাসন কালেই ভারতের জীবনসাধনা এই আদর্শ হইতে কখনও বিচ্যুত হয় নাই।
ভারতের ইতিহাসে কেহ এমন একটি যুগ দেখাইয়া দিন দেখি, যে-যুগে সমগ্র জগৎকে আধ্যাত্মিকতা দ্বারা পরিচালিত করিতে পারেন, এমন মহাপুরুষের অভাব ছিল। কিন্তু ভারতের কার্যপ্রণালী আধ্যাত্মিক—সে-কাজ রণবিদ্যা বা সৈন্যবাহিনীর অভিযানের দ্বারা হইতে পারে না। ভারতের প্রভাব চিরকাল পৃথিবীতে নিঃশব্দ শিশিরপাতের ন্যায় সকলের অলক্ষ্যে সঞ্চারিত হইয়াছে, অথচ পৃথিবীর সুন্দরতম কুসুমগুলি ফুটাইয়া তুলিয়াছে। নিজস্ব শান্ত প্রকৃতির দরুন এ-প্রভাব বিদেশে ছড়াইয়া পড়িবার উপযুক্ত সময় ও সুযোগের প্রয়োজন হইয়াছে, যদিও স্বদেশের গণ্ডিতে ইহা সর্বদাই সক্রিয় ছিল। শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, ইহার ফলে যখনই তাতার, পারসীক, গ্রীক বা আরব জাতি এদেশের সঙ্গে বহির্জগতের সংযোগ-সাধন করিয়াছে, তখনই এদেশ হইতে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব বন্যাস্রোতের মতো সমগ্র জগৎকে প্লাবিত করিয়াছে। সেই এক ধরনেরই ঘটনা আবার আমাদের সম্মুখে দেখা দিয়াছে। ইংরেজদের জলপথ ও স্থলপথ এবং ঐ ক্ষুদ্র দ্বীপের অধিবাসীদের অসাধারণ বিকাশের ফলে পুনরায় সমগ্র জগতের সঙ্গে ভারতেরসংযোগ সাধিত হইয়াছে, এবং সেই একই ব্যাপারের সূচনা মাত্র, বৃহত্তর ঘটনাপ্রবাহ আসিতেছে।
বাণী ও রচনা-৫।৩৭৫
(c)স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
হে ভ্রাতৃবৃন্দ, সত্যই মহিমময় ভবিষ্যৎ! প্রাচীন উপনিষদের যুগ হইতে আমরা পৃথিবীর সমক্ষে স্পর্ধাপূর্বক এই আদর্শ প্রচার করিয়াছেঃ ‘ন প্রজয়া ন ধনেন ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’—পারে। জাতির পর জাতি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হইয়াছে এবং বাসনার জগতে থাকিয়া জগৎ-রহস্য সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে। তাহারা সকলেই ব্যর্থ হইয়াছে, প্রাচীন জাতিসমূহ ক্ষমতা ও অর্থগৃধ্নুতার ফলে জাত অসাধুতা ও দুর্দশার চাপে বিলুপ্ত হইয়াছে—নূতন জাতিসমূহ পতনোন্মুখ । শান্তি অথবা যুদ্ধ, সহনশীলতা অথবা অসহিষ্ণুতা, সততা অথবা খলতা, বুদ্ধিবল অথবা বাহুবল, আধ্যাত্মিকতা অথবা ঐহিকতা—এগুলির মধ্যে কোন্টির জয় হইবে, সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও বাকি।
বহু পূর্বে আমরা এ-সমস্যার সমাধান করিয়াছি, সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়া সেই সমাধান অবলম্বন করিয়াই চলিয়াছি, শেষ অবধি ইহাই ধরিয়া রাখিতে চাই। আমাদর সমাধান—ত্যাগ, অপার্থিবতা।
সমগ্র মানবজাতির আধ্যাত্মিক রূপান্তর—ইহাই ভারতীয় জীবন-সাধনার মূলমন্ত্র, ভারতের চিরন্তন সঙ্গীতের মূল সুর, ভারতীয় সত্তার মেরুদণ্ড-স্বরূপ, ভারতীয়তার ভিত্তি, ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান প্রেরণা ও বাণী। তাতার, তুর্কী, মোগল, ইংরেজ—কাহারও শাসন কালেই ভারতের জীবনসাধনা এই আদর্শ হইতে কখনও বিচ্যুত হয় নাই।
ভারতের ইতিহাসে কেহ এমন একটি যুগ দেখাইয়া দিন দেখি, যে-যুগে সমগ্র জগৎকে আধ্যাত্মিকতা দ্বারা পরিচালিত করিতে পারেন, এমন মহাপুরুষের অভাব ছিল। কিন্তু ভারতের কার্যপ্রণালী আধ্যাত্মিক—সে-কাজ রণবিদ্যা বা সৈন্যবাহিনীর অভিযানের দ্বারা হইতে পারে না। ভারতের প্রভাব চিরকাল পৃথিবীতে নিঃশব্দ শিশিরপাতের ন্যায় সকলের অলক্ষ্যে সঞ্চারিত হইয়াছে, অথচ পৃথিবীর সুন্দরতম কুসুমগুলি ফুটাইয়া তুলিয়াছে। নিজস্ব শান্ত প্রকৃতির দরুন এ-প্রভাব বিদেশে ছড়াইয়া পড়িবার উপযুক্ত সময় ও সুযোগের প্রয়োজন হইয়াছে, যদিও স্বদেশের গণ্ডিতে ইহা সর্বদাই সক্রিয় ছিল। শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, ইহার ফলে যখনই তাতার, পারসীক, গ্রীক বা আরব জাতি এদেশের সঙ্গে বহির্জগতের সংযোগ-সাধন করিয়াছে, তখনই এদেশ হইতে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব বন্যাস্রোতের মতো সমগ্র জগৎকে প্লাবিত করিয়াছে। সেই এক ধরনেরই ঘটনা আবার আমাদের সম্মুখে দেখা দিয়াছে। ইংরেজদের জলপথ ও স্থলপথ এবং ঐ ক্ষুদ্র দ্বীপের অধিবাসীদের অসাধারণ বিকাশের ফলে পুনরায় সমগ্র জগতের সঙ্গে ভারতেরসংযোগ সাধিত হইয়াছে, এবং সেই একই ব্যাপারের সূচনা মাত্র, বৃহত্তর ঘটনাপ্রবাহ আসিতেছে।
বাণী ও রচনা-৫।৩৭৫
(c)স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন