
প্রথমেই বলিয়া রাখি যে, ভারতবর্ষে বহু-ঈশ্বরবাদ নাই। প্রতি দেবালয়ের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া যদি কেহ শ্রবণ করে, তাহা হইলে শুনিতে পাইবে পূজক দেববিগ্রহে ঈশ্বরের সমুদয় গুণ, এমন কি সর্বব্যাপিত্ব পর্যন্ত আরোপ করিতেছে। ইহা বহু-ঈশ্বরবাদ নয়, বা ইহাকে কোন দেব-বিশেষের প্রাধান্যবাদ বলিলেও প্রকৃত ব্যাপার ব্যাখ্যাত হইবে না। গোলাপকে যে-কোন অন্য নামই দাও না কেন, তাহার সুগন্ধ সমানই থাকিবে। সংজ্ঞা বা নাম দিলেই ব্যাখ্যা করা হয় না।… ভাবানুষঙ্গ-নিয়মানুসারে জড়মূর্তি দেখিলে মানসিক ভাববিশেষের উদ্দীপন হয়, বিপরীতক্রমে মনে ভাববিশেষের উদ্দীপন হইলে তদনুরূপ মূর্তিবিশেষও মনে উদিত হয়। এই জন্য হিন্দু উপাসনার সময়ে বাহ্য প্রতীক ব্যবহার করে। সে বলিবে, তাহার উপাস্য দেবতায় মন স্থির করিতে প্রতীক সাহায্য করে। … মন্দির, প্রার্থনাগৃহ, দেববিগ্রহ বা ধর্মশাস্ত্র – সবই মানুষের ধর্মজীবনের প্রাথমিক অবলম্বন ও সহায়ক মাত্র, তাহাকে ক্রমশ অগ্রসর হইতে হইবে।
শাস্ত্র বলিতেছেনঃ ‘বাহ্যপূজা – মূর্তিপূজা প্রথমাবস্থা; কিঞ্চিৎ উন্নত হইলে মানসিক প্রার্থনা পরবর্তী স্তর; কিন্তু ঈশ্বরসাক্ষাৎকারই উচ্চতম অবস্থা।’ (মহানির্বাণতন্ত্র, ৪।১২)
স্বামী বিবেকানন্দ, ‘হিন্দুধর্ম’, শিকাগো বক্তৃতা
=================================
অহিন্দুরা অনেকে বিশ্বাস করেন যে, আমরা হিন্দুরা বহু দেবদেবীর পূজা করি। এই ধারণা সর্বৈব ভুল। আমরা ব্রহ্ম বা এক ঈশ্বরকেই ভিন্ন ভিন্ন নামে ও ভিন্ন ভিন্ন রূপে আরাধনা করি। আসলে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাঁদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য ঈশ্বরের নাম ও রূপভেদ সম্পর্কে স্বতন্ত্র্য কিছু ধারণা পোষণ করেন। এই কারণেই, আজকের হিন্দুসমাজে ঈশ্বরের এত রূপবৈচিত্র্য আমাদের চোখে পড়ে। ইতিহাসের পথ ধরে হিন্দুসমাজে চারটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে–শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ও স্মার্ত। শৈবরা শিবকে ও বৈষ্ণবরা বিষ্ণুকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর মনে করেন। শাক্তেরা মনে করেন এই মহাবিশ্বে মহাশক্তিই সর্বেসর্বা। স্মার্ত মতটি অনেক উদারপন্থী। তাঁরা মনে করেন, সকল দেবতাই সর্বোচ্চ ঈশ্বর ব্রহ্মের স্বরূপ। তাই তাঁরা দেবতা নির্বাচনের ভারটি ভক্তের উপর ছেড়ে দেন। অবশ্য এও মনে রাখতে হবে যে, স্মার্ত মতটি হিন্দুধর্মে বহুল প্রচলিত হলেও, প্রধান মত নয়। সে যাই হোক, এই মতবৈচিত্র্যের জন্যই হিন্দুরা একে অপরের ধর্মমতের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস যেমন বলেছেন, ‘যত মত তত পথ।’ অর্থাৎ, সকল মতই সেই এক ঈশ্বরের কাছেই পৌঁছানোর এক একটি পথ।
হিন্দুধর্মের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল এই যে, আমরা হিন্দুরা ঈশ্বরকে বহুদূরের স্বর্গে বসবাসকারী দেবতা মনে করি না। আমাদের ঈশ্বর বাস করেন আমাদের অন্তরে, আমাদের হৃদয়ে, আমাদের চেতনায়। শুধু তিনি অপেক্ষা করেন, যতক্ষণ না আমরা আমাদের মধ্যে স্থিত ঈশ্বরকে চিনে নিতে পারি। ঈশ্বর যে আমাদের সঙ্গেই থাকেন, এই কথাটি আমাদের আশা ও শক্তি জোগায়। তাই হিন্দু জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল সেই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মকে জানা।
আমরা হিন্দুরা একাধারে মনোথেইস্টিক (একেশ্বরবাদী) ও হেনোথেইস্টিক। আমরা পলিথেইস্টিক বা বহুঈশ্বরবাদী নই। কারণ আমাদের হিন্দুধর্মে সমক্ষমতাসম্পন্ন একাধিক দেবতার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। হেনোথেইজম্-ই হিন্দু মতবাদটির সঠিক সংজ্ঞা গতে পারে। এই মতবাদের মূল কথাটি হল, অন্যান্য দেবতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করেও এক ঈশ্বরের আরাধনা করা। আমরা হিন্দুরা বিশ্বাস করি, এক সর্বব্যাপী ব্রহ্ম এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের শক্তির উৎস। মানুষ সহ সকল জীবের জীবনের মধ্যেই আমরা তাঁকে প্রত্যক্ষ করি। সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান ও ঈশ্বর কর্তৃক সকল জীবের প্রাণধারণের এই মতবাদটিকে বলে প্যানেনথেইজম। প্যানথেইজমের থেকে এটি আলাদা। কারণ, প্যানথেইজম বলে প্রাকৃতিক ব্রহ্মাণ্ডখানিই ঈশ্বর এবং তার বেশি কিছু নয়। অন্যান্য ধর্মের রক্ষণশীল ধর্মতাত্ত্বিকগণ মনে করেন, ঈশ্বর জগতের উর্ধ্বে, জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং মানুষের অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির অগম্য। হিন্দুধর্ম তা মনে করে না। প্যানেনথেইজম একটি সর্বময় ধারণা। এটি বলে, ঈশ্বর জগতের ভিতরে ও বাইরে দুই স্থানেই আছেন। তিনি একাধারে মানুষের চেতনার আয়ত্তাধীন, আবার অগম্যও বটে। এই বৃহত্তর ধারণাটিই হিন্দুর ধারণা।
আমাদের হিন্দুদের বিভিন্ন শাখাসম্প্রদায়ে ব্রহ্মের নানান নাম প্রচলিত রয়েছে। এই নামবৈভিন্ন্যের কারণ সম্প্রদায়গুলির স্বতন্ত্র ধর্মীয় প্রথা ও রীতিনীতি। আর এই নামবৈভিন্ন্যই অহিন্দুদের যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণার কারণ। হিন্দুরা পরম সত্যকে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করে, কিন্তু তাই বলে পরম সত্য স্বয়ং বিভিন্ন হয়ে যান না। এই বিভিন্ন নাম থেকে বিভিন্ন রূপের উৎপত্তি; কিন্তু প্রত্যেক রূপই সেই এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মের রূপান্তর-মাত্র। হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর অনেক পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। আমরা হিন্দুরা প্রতিটি পথকেই অভ্রান্ত মনে করি। তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট পথকে সকলের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী আমরা নই। পথ নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা হিন্দুরা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করি।
তবে এই বিষয়ে শুধু অহিন্দু নয়, অনেক হিন্দুর মধ্যেও ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। ঈশ্বর ও দেবতার মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান, তা অনুধাবন করতে পারলেই এই ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়। ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের হিন্দুদের ধারণায় কোনো সংকীর্ণতা নেই। এখানে বলে রাখা ভাল, হিন্দুদের একাংশ নিরাকার ঈশ্বরেরও উপাসনা করেন। অন্যেরা দেবতাদের ব্যক্তিগত দেবতা (ইষ্টদেবতা বা কূলদেবতা) হিসেবে পূজা করেন। স্বামী বিবেকানন্দ এই প্রসঙ্গে একটি প্রণিধানযোগ্য উক্তি করেছেন, “যে একাগ্র সাধক জানু পাতিয়া দেববিগ্রহের সম্মুখে পূজা করেন, লক্ষ্য কর – তিনি তোমাকে কি বলেন, ‘সূর্য তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না; চন্দ্র তারা এবং এই বিদ্যুৎও তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না; এই অগ্নি তাঁহাকে কিরূপে প্রকাশ করিবে? ইহারা সকলেই তাঁহার আলোকে প্রকাশিত।’ (কঠ উপনিষদ ২।২।১৫; শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ ৬।১৪; মুণ্ডক উপনিষদ ২।২।১০) তিনি কাহারও দেববিগ্রহকে গালি দেন না বা প্রতিমাপূজাকে পাপ বলেন না। তিনি ইহাকে জীবনের এক প্রয়োজনীয় অবস্থা বলিয়া স্বীকার করেন। শিশুর মধ্যেই পূর্ণ মানবের সম্ভাবনা নিহিত রহিয়াছে। বৃদ্ধের পক্ষে শৈশব ও যৌবনকে পাপ বলা কি উচিত হইবে? হিন্দুধর্মে বিগ্রহপূজা যে সকলের অবশ্য কর্তব্য, তাহা নয়। কিন্তু কেহ যদি বিগ্রহের সাহায্যে সহজে নিজের দিব্য ভাব উপলব্ধি করতে পারে, তাহা হইলে কি উহাকে পাপ বলা সঙ্গত?” (‘হিন্দুধর্ম’, শিকাগো বক্তৃতা) বিশ্বের প্রাচীনতম জীবিত এবং সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যশালী ধর্মমতের এই বৈশিষ্ট্য অনন্য। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, ‘বহুত্বের মধ্যে একত্বই প্রকৃতির ব্যবস্থা, হিন্দুগণ এই রহস্য ধরিতে পারিয়াছেন।’ (‘হিন্দুধর্ম’, শিকাগো বক্তৃতা)
সূত্রঃস্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, প্রথম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
হিন্দুইজম টুডে পত্রিকা।
Courtesy: Amith Pal
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন