কামাখ্যায় এক মঠের সন্ন্যাসী সাধক ছিলেন --- স্বামী জ্ঞানানন্দ মহারাজ, জন্মস্থান - বর্ধমান। সংসারে তাঁর একমাত্র বন্ধন ছিলেন মা। মায়ের দেহান্তের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বর্ধমান, পুরী, ভুবনেশ্বর, হরিদ্বার, কাশী ও প্রয়াগ প্রভৃতি তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করে নিজের বাসস্থান, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সৎ কাজের জন্য দান করে দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মঠের যে কামরাটিতে আশ্রয় নেন, সেখানে থেকে রাত্রি ৩টে একমাত্র স্নান ছাড়া অন্য কোন কারণেই মঠের বাইরে যেতেন না। এমনকি তিনি তাঁর সুদীর্ঘ ৬২ বৎসরের সন্ন্যাস জীবনে মায়ের মন্দির দর্শন করেন নি। পবিত্র সন্ন্যাস-ধর্ম যে কী কঠিনতম ব্রত, তা অজগর-বৃত্তিধারী এই মহাতপা যোগীর পুণ্যজীবন দেখলে তবেই মর্মে মর্মে অনুভব করা যায়।
তাঁর জীবন-দর্শনের একটা কাহিনী শুনুন -
এক ভক্ত একদিন স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ব্যবসায় বিপর্যয়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করে উন্নতির উপায় খুঁজতে এসেছেন। তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের এক বিখ্যাত ব্যবসায়ী। স্বামীজীর আশীর্বাদে ব্যবসায় তিনি বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু আজ সর্বহারা। সেই তিনিই স্বামীজীকে বললেন --- 'আপনার আশীর্বাদে আমি বহু অর্থ উপার্জন করেছিলাম, অহংকারে আমি আপনার অবদান মানিনি, আজ বড়ই দুঃসময়, গতবছর থেকে ব্যবসায়ে মার খাচ্ছি। আপনি আশীর্বাদ করুন, কিছু প্রতিকার দিন, যাতে ব্যবসায় বিপর্যয় কাটিয়ে আমি আমার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসিা।'স্বামীজী বললেন --- সে কি! আমি আবার তোমার ভাগ্য ফিরালাম কবে? আমি নিজে ভিখিরি, মায়ের দুয়ারে পড়ে আছি। ভিখিরি আবার টাকার সন্ধান জানবে কি করে? তুমি তোমার কর্ম অনুযায়ী ফল পেয়েছ বা পাচ্ছ। অতবড় পণ্ডিত ছেলে তুমি, পাছে টাকার প্রয়োজনে অন্য কোন বৃত্তি তুমি অবলম্বন করে ফেল, এজন্য বলেছিলাম রসায়ন জান যখন আছে, আয়ুর্বেদের চর্চা করে বিশুদ্ধ কবিরাজী ঔষধের ব্যবসা কর। আশা ছিল - তোমার সংসারের প্রয়োজনও মিটবে আর যে বিরাট প্রতিভা থেকে তোমার জন্ম, হয়ত একদিন তোমার হাত দিয়ে কোন বিস্ময়কর ওষুধও বের হয়ে যেতে পারে। নতুবা আমার মত ভিখিরি, টাকার সুলুক-সালুক কি করে জানবে বাবা! ছিঃ বাবা, সন্ন্যাসীর কাছে টাকা চাইতে নেই, টাকা দিতে নেই, টাকার প্রসঙ্গ তুলতেও নেই।
স্বামীজীর এই কথা শুনে ভক্ত বড় কাতর হয়ে পড়লেন। কিছু পরে স্বামীজী উঠে পড়লেন।
স্বামীজী ভক্তকে বললেন --- 'চল বাবা, উপরে ছাদে যাই।'
দু'জনে উপরে উঠে গেলেন। তিনতলায় ছাদের উপর তখন মঠ সংলগ্ন একটা অশ্বত্থ গাছের ছায়া পড়েছে। সূর্যাস্ত হতেও তখন বেশী দেরী ছিল না। হঠাৎ স্বামীজী ভক্তকে জিঞ্জেস করলেন --- 'বাবা! এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি- তুমি ও আমি, একটু আগেও এখানে রোদ ছিল, কিন্তু এখন ছায়া পড়েছে। এই যে ছায়া এটা কি সূর্যের জন্য?'
ভক্ত বললেন --- 'কালের জন্য। সন্ধ্যা হয়ে আসছে- তাই ছায়া।'
স্বামীজী বললেন --- 'আবার রোদ আসবে?'
ভক্ত বললেন --- 'হ্যাঁ, আবার রাত্রি গত হলে কাল সকালে এইখানে রোদ আসবে। '
স্বামীজী বললেন --- 'তবে দেখ, রোদের পর ছায়া, দিনের আলোর পর সন্ধ্যা - এই তো নিয়ম। কাল শুভ হয়েছিল, তোমার ঐশ্বর্য হয়েছিল, এখন সন্ধ্যা - অপেক্ষা কর, আবার ঘুরে ঘুরে সূর্যের আলো এইখানেই এসে পড়বে- এই নিয়ম। এতে কারও হাত নেই। মনে কর, একটা ফেরিওলা, হাসিমুখে ফেরি করতে করতে চলে গেল পশ্চিম দিকে। তুমি বসে আছ এখানে। এখন তুমি যদি তাকে ঐখানে আটকে রাখতে না পার অথচ তার থেকে কিছু কিনতে যদি ইচ্ছা কর, তাহলে তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে, ঠায় ঐখানটায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ না সে ফেরি করতে করতে আবার ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরে আসে। আবার এটাও ভেবে দেখা দরকার, ঠিক এই পথ দিয়েই সে আসতেও পারে, নাও পারে। এলেও হাসিমুখে তার জিনিস বেঁচবে কি না তারও কোন ঠিক নেই। সবই তাঁর ইচ্ছা। সেই মহাকাল সব নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমি সাধারণ মানুষ, তোমার ভাগ্য ফিরাব কি করে!'
লিখেছেনঃ Prithwish Ghosh
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন