০৩ মে ২০১৬

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ৫ )

সুতীক্ষ্ণ মুনির সাথে রাম, সীতামাতা ও লক্ষণ গমন করতে করতে সুতীক্ষ্ণ মুনির কথিত গল্প শ্রবন করতে লাগলেন । সুতীক্ষ্ণ মুনি বললেন- “হে ভগবন! যে পিপ্পলি বনে আমার গুরুদেব অগস্ত্য মুনির আশ্রম , সেখানে পূর্বে দুই রাক্ষস বাস করতেন । আপনারা সেই কথা শ্রবন করুন।” বহু পূর্বে ইল্বল ও বাতাপি নামক দুই রাক্ষস বাস করতো। সেই মায়াদয়াহীন ভয়ানক রাক্ষস যুগল নিষ্ঠুর ভাবে ব্রাহ্মণ বধ করতেন । সেও ছিলো এক অদ্ভুত রকমের মায়া। যেনো মিছরির ছুড়ি। কোন আক্রমণ, অস্ত্রাদি ছাড়াই । মায়াবিদ্যায় পারঙ্গদ বাতাপি মেষের রূপ ধারন করে থাকতো । ইল্বল রাক্ষস, ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করে আনত । মেষের রূপধারী বাতাপিকে কেটে রান্না করে সেই ব্রাহ্মণকে মাংস ভোজন করাতো। ব্রাহ্মণ অমৃত ভেবে সেই মৃত্যুবিষ গ্রহণ করতো। পড়ে ইল্বল মায়াবিদ্যা দ্বারা বাতাপিকে ডাকলে , বাতাপি সেই ব্রাহ্মণের পেট ফুঁড়ে রাক্ষস দেহে বেরিয়ে আসতো । আর উদর ছিন্ন হয়ে সেই ব্রাহ্মণ ভয়ানক যন্ত্রনা পেয়ে মৃত্যুমুখে ধাবিত হত । এভাবে এখানে ইল্বল ও বাতাপি রাক্ষস রাজত্ব চালাতেন । প্রচুর ব্রাহ্মণ কে সেই দুই রাক্ষস এইভাবে যমদুয়ারে প্রেরণ করেছিলো। যে ব্রাহ্মণ ইল্বলের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতো সে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতো। সে বেঁচে ফিরতো না । একদিবসের কথা । অগস্ত্য মুনি এইস্থানে এসেছেন । অগস্ত্য মুনির দিব্য তেজের কথা ত্রিলোক বিদিত। এক গণ্ডূষে সপ্ত সমুদ্রের জল পান করেছিলেন ।

ইল্বল রাক্ষস তখন বাতাপির সাথে পরামর্শ করে বাতাপিকে মেষ সাজালো। অপরদিকে অগস্ত্য মুনিকে সাদরে বন্দনা জানিয়ে বলল- “হে মহামুনে! আপনার আগমনে আমি ধন্য। কৃপা করে মম গৃহে আপনার শ্রীচরণের ধুলো দিলে আমি কৃতার্থ হবো। হে ব্রাহ্মণ! আপনি কৃপা বশত আজ আমার গৃহে অবস্থান করে, আহার গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করবেন।” অগস্ত্য মুনি সবই জানেন । তিনি রাক্ষসের মায়াতে পা দেবার অভিনয় করে ইল্বলের সাথে গেলেন । অগস্ত্য মুনি বললেন- “বতস্য! আজ আমাকে মেষমাংস আহার করাও ! বহুদিন যাবৎ মেষমাংস আহারের ইচ্ছা ।” ইল্বল খুশীতে ডগমগ । অগস্ত্যের মতো ব্রাহ্মণ তেজস্বী মুনিকে হত্যা করতে পারলে রাক্ষসদের মাঝে সম্মান বৃদ্ধি পাবে। ইল্বল মেষরূপী বাতাপি কে কেটে রন্ধন করলেন। অপরদিকে স্নানান্তে অগস্ত্য মুনি কমণ্ডলু তে গঙ্গা দেবীর আহ্বান করে কদলীপত্র নিয়ে আহারে বসলেন । বললেন- “বতস্য! আমাকে সব টুকু মেষ মাংসই প্রদান করো। লোভ বশে নিজের জন্য সামান্য কিছু রাখলে আমি শাপ দেবো।” ইল্বল কদলী পত্রে অন্নাদি ব্যাঞ্জন ও সবটুকু মেষ মাংস প্রদান করলেন । অগস্ত্য মুনি পরম তৃপ্তি সহকারে ভোজন করতে লাগলেন । একেবারে সব টুকু মেষমাংস আহার করলেন । ইল্বল মনে মনে হাসতে লাগলো। মুনিও “অতি উত্তম রন্ধন” বলে সব ভোজন করলেন । আহারান্তে গঙ্গা জল পান করে মুখশুদ্ধি গ্রহণ করলেন। তখন ইল্বল রাক্ষস এসে “বাতাপি” , “বাতাপি” বলে ডাকতে লাগলো। অগস্ত্য মুনি বললেন- “তোমার সকল ছলছাতুরী আমি জানতাম। তোমাদের বিনাশের জন্যই আমি এখানে এসেছি। বাতাপি আর আসবে না। তাকে আমি খেয়ে হজল করেছি। সে প্রাণ হারিয়েছে। সে আর বেঁচে নেই।” শুনে ইল্বল, অগস্ত্য মুনিকে বধ করতে গেলে মুনি শাপ দিয়ে ইল্বলকে ভস্ম করলেন । সুতীক্ষ্ণ মুনির গল্প শুনতে শুনতে অগ্যস্ত মুনির আশ্রম চলে আসলো। সুতীক্ষ্ণ গিয়ে গুরুদেব অগস্ত্যকে প্রণাম জানিয়ে বললেন- “গুরুদেব! আমার সাথে স্বয়ং দাশরথি রামচন্দ্র ও তাঁহার পত্নী সীতাদেবী ও রামচন্দ্রের ভ্রাতা লক্ষণ এসেছেন।”

অগস্ত্য মুনি রাম, লক্ষণ, সীতাকে স্বাগত জানালেন। ভগবান রাম, জানকী দেবী ও লক্ষণ, মুনি অগস্ত্যকে বন্দনা করে প্রনাম জানালেন । মুনির আশ্রমে যেনো মহা উৎসব আরম্ভ হল। শিষ্য গণ ভগবান রামকে দেখে নিজেদের ধন্য মনে করছিলেন । উত্তম পুস্প দ্বারা ভগবান রামচন্দ্রের পূজাদি করলেন । সুগন্ধি চন্দনের প্রলেপ প্রভুর অঙ্গে প্রদান করলেন। বনের মিষ্টি ফল, গোদুগ্ধ, মধু, কন্দ ইত্যাদি প্রদান করলেন। মুনির আশ্রমে আনন্দ আর আনন্দ । মুনি বললেন- “রঘুবর! আমি জানি আপনি রাক্ষস বিনাশের জন্যই এই অরণ্যে এসেছেন। আপনাকে আমি অস্ত্রাদি বিদ্যা ও দেবতাপ্রদত্ত অস্ত্র প্রদান করিব। বহু পূর্বে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই সব অস্ত্র আমাকে দিয়ে আপনাকে প্রদান করতে আদেশ করছেন।” ভগবান রাম বললেন- “মুনিবর! আপনার থেকে আমি বিদ্যা গ্রহণে ইচ্ছুক। আপনি আমার আজ থেকে গুরু হবেন। গুরু হয়ে আমাকে শিষ্য বানিয়ে ধন্য করবেন।” সেই রাত্রি অগস্ত্য মুনির আশ্রমে সকলে কাটালেন । পরদিবস অগস্ত্য মুনি রামকে দীক্ষা দিলেন । তারপর নানান অস্ত্রাদি বিদ্যা প্রদান করলেন । এরপর রামচন্দ্রকে অনুরোধ জানালেন গোদাবোরী তীরে এই পঞ্চবটিতেই অবস্থান করে যেতে। ভগবান রামচন্দ্র স্বীকৃত হলেন। এখানে ভগবান রামের সাথে জটায়ুর সাক্ষাৎ হয়েছিলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।