০৩ মে ২০১৬

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব-৬ )

অগস্ত্য মুনির আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে রাম লক্ষণ ও সীতাদেবী সেই দণ্ডকারণ্য ঘুরে দেখতে লাগলেন। এখানে গভীর জঙ্গল বহুদূর দুরান্ত অবধি বিস্তৃত হয়েছে । চতুর্দিকে কেবল সবুজে আচ্ছদিত বৃক্ষ । আর পবিত্র গোদাবরী নদী । কুলকুল বেগে স্বচ্ছ মিষ্টি জল প্রবাহিত হচ্ছে । নদী যেনো এখানে কথা বলে এমনই । আর দেখলেন সেখানে বহু মুনি ঋষির আশ্রম । সেই শাস্ত্রীয় বিদ্বান মুনি ঋষি সন্ন্যাসী গন এখানে ভগবান প্রাপ্তির জন্য কঠিন সাধনায় মগ্ন। ভগবান রাম, লক্ষণ ও সীতা সেই মুনিদিগকে প্রণাম পূর্বক নানা আলোচনাতে মগ্ন হলেন । এই ফুল, ফল দিয়ে সজ্জিত অরণ্য দেখলে মনে হয় বিধাতা সকল প্রকার শান্তি, আনন্দ দিয়ে এই অরণ্যের সৌন্দর্যকে গেঁথেছেন । মুনি গন বললেন- “হে রাম! এই স্থান যত সুন্দর তত ভয়ানক। হিংস্র পশুর থেকেও এখানে হিংস্র রাক্ষসেরা বাস করেন। তুমি তাড়কা, সুবাহু বধ করে মারীচকে দূর করেছো, বিরাধ বধ করেছো এই সংবাদ অবশ্যই খড় আর দূষণ পেয়েছে। তুমি এখানে জানলে সে নিশ্চুপ থাকবে না।” ভগবান রাম বললেন- “হে মহাত্মাগণ আমি চাই তারা এই সংবাদ পাক। তাদের নিধন করে এই অরণ্য থেকে চিরতরে রাক্ষসদের বিদায় করবো। আপনাদের তখন আর কোন ভয় থাকবে না।” মুনি ঋষিরা বললেন- “আমরা জানি আপনি সেই রাক্ষসদের বধের জন্যই নরদেহ অবলম্বন করেছো। সেই খড় দূষণের সাথে প্রবল শক্তিশালী মায়াবী চতুর্দশ রাক্ষস থাকে। তাদের যথেচ্ছ আক্রমণে আমরা বড়ই বিপদে। আপনি শীঘ্র সেই রাক্ষসদের অন্ত করবেন- ইহা আমরা জানি।” এইভাবে মুনি ঋষিরা রাম লক্ষণ কে দিব্যজ্ঞান এর সাথে সাথে রাক্ষসদের অত্যাচারের ঘটনা সব বর্ণনা করলো । এরপর রামচন্দ্র লক্ষণ কে আদেশ দিলেন- “ভ্রাতা! এইস্থানেই কুটির নির্মাণ করো। আমরা এই স্থানেই থাকবো। এই পঞ্চবটি গোদাবরী খুবুই রম্য অরণ্য। দেবী জানকীও এই স্থানে এসে অত্যাধিক প্রীতা হয়েছেন।”

লক্ষণ ও বনবাসীরা মিলে কুটির নির্মাণের আয়োজন করতে লাগলো। মাটি দিয়ে বেদী বানালো। চতুর্দিকে বাঁশ ও শালের কাণ্ড দ্বারা খুঁটি নির্মিত করা হল । খঁড়, বাঁশ দিয়ে ছাউনি বানিয়ে দেওয়াল ও উপরের আচ্ছাদন নির্মাণ করা হল। বাঁশ দিয়ে জানলা, দরজার কপাট নির্মিত করা হল। এইভাবে সুন্দর কুটির নির্মাণ হল। কুটিরের প্রবেশের মুখে কদলী বৃক্ষ রোপিত করা হল। তুলসী, আমলকী, বিল্ব, হরিতকী , আম্র, দাড়িম্ব ও অনান্য পুস্পের বৃক্ষ কুটিরের চারিদিকে রোপণ করা হল । ভগবান রাম মুনি ঋষিদের দ্বারা গৃহ প্রবেশের পূজাদি সম্পন্ন করলেন। যজ্ঞ করলেন মৃগনাভি, কস্তূরী দ্বারা । এই প্রকারে কুটির নির্মাণ হল । কুটিরে বাঁশ দ্বারা খাঁট, তাঁর ওপরে শুকনো তৃন বিছিয়ে শয্যা স্থাপিত হল। এইখানেই রাম, লক্ষণ, সীতাদেবী বাস করতে লাগলেন। প্রত্যহ রাম ও লক্ষণ জঙ্গলে ফলমূলাদি অন্বেষণে যেতেন । মাতা সীতাদেবী বনবালিকাদের সাথে গোদাবরীতে নাইতে যাইতেন। মৃত্তিকার কলসে জল ভরে আনতেন । বনবালিকাদের সাথে সীতাদেবী ক্রীড়া করতেন । বনবালিকারা নতুন সই পেয়ে অতীব প্রীত হয়েছিলো। তারা উত্তম সুগন্ধি পুস্প, মিষ্ট ফল এনে সীতাদেবীকে উপহার দিতেন । সকলের সাথে মিলে সীতাদেবী সেসকল গ্রহণ করতেন । গৃহে ফিরে ফল মূলাদি ভগবান রাম ও লক্ষণকে প্রদান করে নিজে সেবা নিতেন । সাধু সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা চাইতে এলে সীতাদেবী ভিক্ষা দিতেন। সাধু সন্ন্যাসীরা প্রসন্ন চিত্তে ভিক্ষা পেয়ে গমন করতেন । প্রকৃতির সাথে সীতাদেবী একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন । যখন বনে যেতেন দেখতেন বিবিধ রংবেরঙের কারুকার্য শোভিত প্রজাপতি ডানা মেলে প্রকৃতির দেওয়া উপহার পুস্প থেকে পুস্পে উড়ে বেড়াতো। সীতাদেবীকে উজ্জ্বল পুস্প ভেবে ভ্রমে প্রজাপতি কখনো কখনো তাঁর উপর বসতো । মৃগশিশুরা সীতাদেবী যখন ক্রীড়া করতে গিয়ে বনে মাঠে বনবালিকাদের সাথে গল্প করতেন, তখন তাঁর ক্রোড়ে এসে অধিষ্ঠান করতো নিশ্চিন্তে ।

বনবালিকাদের মাঝে মাঝে মনে হতো, নিরাকারা প্রকৃতিদেবীই সাক্ষাৎ সাকারা হয়ে সীতা মূর্তি ধরে এই বনে এসে তাহাদিগের সাথে ক্রীড়া করছেন । ইনি কোন মানবী নয়। স্বর্গের কোন দেবী । নাহলে গাত্রে এত জ্যোতি কেন ? চেহড়ায় এত দ্যুতি কেন ? সমস্ত প্রকার সৌন্দর্য, মধুরিমা একত্রিত হয়ে সীতা রূপে আবির্ভূতা হয়েছে । যখন সীতাদেবী গোদাবরী নদীতে অবস্থান করতেন, মৎস্য রা নির্ভয়ে তার অঙ্গ স্পর্শ করতো নিশ্চিন্ত হয়ে। মনে হতো এই অভয়া দেবী কোন প্রকার ক্ষতি করতে পারেনই না । এঁনার থেকে ভয় কি! পক্ষী কূল মিষ্টি সুরে ক্রীড়াতে যখন ক্লান্ত হতেন জানকী দেবী তখন ছন্দে ছন্দে তারা কলরব করতেন । মিষ্টি সুর, শীতল বন, বিবিধ সুগন্ধি ফুলের ঘ্রানে আমোদিত হয়ে থাকতো দণ্ডকারণ্য । সেই স্থানে এইভাবে বাস করতে থাকলেন রাম, লক্ষণ, সীতাদেবী। ভগবান রামচন্দ্র ও সীতাদেবী নানা দিব্য কথায় রাত্রি জাগরণ করতেন। কুটিরের বাইরে অগ্নি প্রজ্বলিত করে লক্ষণ ধনুর্বাণ নিয়ে সতর্ক পাহাড়ায় থাকতেন । এই ভাবে তাহাদের মিষ্টি মধুর দিন কাটতে লাগলো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বৎসর কেটে গেলো। নয়, থেকে দশ বৎসর তারা এখানেই কাটালেন । বনের পরিবেশে আনন্দ, হাসির সাথে। কিশোরী সীতাদেবী এখন যুবতী । তাঁর সৌন্দর্যে কোটি চন্দ্র একত্রিত হয়েও লজ্জা পাবে। এমনই ছিলো মাতা লক্ষ্মীর রূপ ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।