০৩ মে ২০১৬

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব –৮)

নিষাদ রাজ্যে উপস্থিত হলেন শ্রীরাম । নিষাদ রাজ্যে উৎসব আরম্ভ হল। গুহকের বাল্যসখা ছিলেন ভগবান রাম। নিষাদ রাজা গুহক রামচন্দ্রের সেই অতিথি সৎকার করলেন । ভগবান রামের জন্য উত্তম কুটির নির্মাণ করে বললেন- “মিত্র রাম! চতুর্দশ বৎসর এখানেই আমাদের সাথে থেকে যাও। চারপাশে অরণ্য বেস্টিট অঞ্চলে আমরা থাকি। এখানে থাকলে তোমার শপথ পূর্ণ হবে।” নিষাদ রাজা ভগবান রাম, মাতা সীতা ও লক্ষণের জন্য প্রচুর রাজকীয় ভোগের ব্যবস্থা করলেন । প্রচুর মিষ্টান্নের আয়োজন করলেন । নিষাদেরা ভেবেছিলো যেহেতু রাম রাজপুত্র, তাই বনের ফলমূল কি গ্রহণ করবেন । কিন্তু রাজকীয় আহার দেখে ভগবান রাম বললেন- “হে নিষাদ রাজ! এই রাজকীয় খাদ্য আমি চতুর্দশ বৎসর গ্রহণ করবো না। মাতা কৈকয়ী আমাকে এইরূপ শর্ত দিয়েছেন । সীতা ও লক্ষণ যদি এইসব আহার করতে ইচ্ছুক হয় তবে আহার করতে পারে। শপথ বাক্য কেবল আমার জন্য। আমাকে বনবাসীর আহার্য- ফল, মূল, কন্দ প্রদান করো।” মাতা জানকী দেবী ও লক্ষণ উভয়েই সেই খাদ্য খেলেন না। তখন নিষাদ রাজ গুহক পদ্মপাত্রে তিনজনের জন্য ফল, মূল, কন্দ এনে দিলেন । মাটির পাত্রে নদীর শীতল জল এনে দিলেন । এভাবে রামচন্দ্রের সেবা করলেন । নিষাদেরা সারা রাত গান বাজনা দ্বারা নিশি যাপন করলো । এই মনোরম স্থানে এসে সীতাদেবী ও লক্ষণের ভালো লেগেছিলো । নিষাদ দের সেবা পেয়ে তিন জনেই প্রীত হলেন। অপরদিকে ভগবান রাম, মাতা সীতা শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে আসা জাতপাতের মিথ্যা কুসংস্কার কে ভঙ্গ করলেন । ভগবানের বন গমনের উদ্দেশ্য আরোও ধীরে ধীরে ব্যক্ত হবে।

দশানন রাবণ একটি ভয়ানক কুকীর্তি করে বসে। প্রথম অপরাধ করে রাবণ পুত্র মেঘনাদ । রাবণের মা কেকসী যখন শিব আরাধনা করেছিলেন, তখন ইন্দ্রদেবতা শিবলিঙ্গ হরণ করে কেকসীর পূজা ভঙ্গ করেন । কেকসীর মনে ধিকিধিকি প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল । সে তার পুত্র দশগ্রীব রাবণকে আদেশ করলো ইন্দ্রাদি দেবতাদের পরাজিত বন্দী করে আনতে। ইতিমধ্যে রাবণ নবগ্রহ কে পরাজিত করেছিলো নিজ শক্তিতে। রাবণের সভায় করজোড়ে তারা রাবণের সম্মুখে দণ্ডায়মান থাকতো । এমনই ছিলো রাবনের পরাক্রম । দেবতাদের পরাজিত করে বন্দী করতে রাবণ উদ্যত হলে মেঘনাদ এসে বলে- “পিতা! এই সামান্য কাজ আমি করতে পারবো। আমি মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করবার কৌশল জানি।” মেঘনাদ যুদ্ধ করতে গেলো। মেঘনাদের স্ত্রী প্রমীলা ( কৃত্তিবাসী রামায়ণ ) নাগ কন্যা ছিলেন। নাগদেবীর উপাসনা করে নাগপাশ প্রাপ্ত করে স্বামীকে দিয়েছিলেন । দেবতাদের সাথে মেঘনাদের মহাযুদ্ধ হল। মেঘনাদ নাগপাশ দিয়ে সব দেবতাদের বন্দী করে লঙ্কায় নিয়ে গেলো । পুত্রের বীরত্বে খুশী হয়ে দশানন বলল- “পুত্র তুমি দেবতা আর তাদের রাজা ইন্দ্রকে পরাজিত করে জয় প্রাপ্তি করেছো। আজ থেকে জগতে তুমি ইন্দ্রজিৎ নামে খ্যাত হবে।” এরপর দেবতারা বন্দী হলে সৃষ্টিকাজ ব্যহত হলে প্রজাপতি ব্রহ্মা এসে ইন্দ্রজিতকে বলল- “ বতস্য তুমি আমারই বংশজ। আমার আদেশ মেনে দেবতাদের মুক্ত করো।” মেঘনাদ তো নারাজ। তখন প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রস্তাব দিলো- দেবতাদের মুক্ত করলে তিনি ব্রহ্মাস্ত্র প্রদান করবেন । মেঘনাদ এই সুযোগ হাতছাড়া করলো না। ব্রহ্মাস্ত্রের মতো দুর্লভ অস্ত্র আর নেই । অতএব তাই মেঘনাদ সহজেই রাজী হল। পিতা দশাননের আদেশ নিয়ে দেবতাদের মুক্তি করলো। ভয়ে দেবতারা লঙ্কারাজ রাবণ ও মেঘনাদের বন্দনা করলো ।

এরপর প্রজাপতি ব্রহ্মা ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ নামক ভয়ানক অস্ত্র প্রদান করলেন । মেঘনাদ গ্রহণ করলো । একদিনের কথা। রাবণ পুস্পক রথ নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছিলো । রাবণের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবেরের পুত্রের নাম ছিলো নলকুবের । অপ্সরা রম্ভা কুবেরপুত্র নলকুবের এর সাথে প্রেম করতো। নলকুবের নিজেও রম্ভাকে ভালোবাসতো । একদা রম্ভা সুন্দর ভাবে সজ্জিত হলেন । তিনি নলের প্রত্যাশায় চললেন । একদিকে স্বর্গের অপ্সরা – অপূর্ব সুন্দরী, লাবণ্যময়ী। উপরন্তু সুন্দর তারকামালার ন্যায় অলঙ্কার পরিহিতা হয়ে তাঁর রূপ যৌবনের ষোলোকলা বিকশিত হয়েছিলো । রাবণ সেই সুন্দরী অপ্সরা দেখে অতি কামার্ত হল । রাবণ বলল- “এসো সুন্দরী রম্ভা। আমার সহিত এসো।” রাবণের কামার্ত পশু রূপ দেখে রম্ভা অত্যাধিক ভয় পেলো। সে করজোড়ে বলল- “হে লঙ্কাধিপতি ! আমি আপনার জেষ্ঠ্য ভ্রাতা কুবেরের পুত্র নলের প্রেমিকা। আমরা উভয়ে বিবাহ করিব । সম্পর্কে আপনি আমার স্বামীর খুঁড়োমহাশয় । আমার শ্বশুর । আপনি এমন কথা বলবেন না।” অট্টহাস্য করে রাবণ বলল- “হে সুন্দরী মধুমুখী! হে গজগামিনী ! আমি কুবেরকে কদাপি ভ্রাতা মানি না। আর তুমি নর্তকী। নর্তকী অপ্সরা কদাপি কাহারো বধূ হতে পারে না। কারণ নর্তকীর কর্তব্য কেবল আনন্দ বর্ধন করা। তোমার প্রভু ইন্দ্র আমার পুত্রের নিকট পরাজিত হয়েছে। অতএব তুমি এখন আমার সম্পত্তি। এসো প্রভুর মনোরঞ্জন করো।” রম্ভা অনেক মানা করে বললেন- “আমাকে অপবিত্র করবেন না। আমার বিবাহ স্থির হয়েছে।” রম্ভার কাকুতিমিনতিকে , দশানন পদদলিত করে ক্ষুধার্ত বাঘ যেরূপ মৃগিনীকে ভক্ষণ করে সেই রূপ রম্ভাকে ধর্ষণ করলো। দেবতারা কিছুই করতে উদ্যোগী হল না রাবণের ভয়ে। রম্ভার আর্তনাদ, শৃঙ্গার, সকল আশা রাবণ তার পশুত্ব দিয়ে ধ্বংস করে দিলো। রম্ভা তখন রাবণ কে অভিশাপ দিলো- “হে রাবণ! তুমি তোমার সকল কর্মের শাস্তি পাবে। তোমার বংশ নাশ হবে। তুমি তোমার বংশ ধ্বংস হতে দেখে নিদারুন কষ্ট পাবে, কিন্তু কিছু করতে পারবে না। তোমার কূলবধূরা সব বিধবা হবে। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি- তুমি যদি এরূপ কোন নারীকে বলপূর্বক ধর্ষণ করো তবে তোমার মস্তক সপ্ত ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।”

( ক্রমশঃ)
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।