কালী বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে, তিনি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশ জন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী। শাক্তরা কালীকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিকারণ মনে করে। বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।

পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা; গলায় মানুষের মুণ্ড দিয়ে গাঁথা মালা; বিরাট জিভ, কালো গায়ের রং, এলোকেশ দেখা যায় এবং তাঁকে তাঁর স্বামী শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ব্রহ্মযামল মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীর বিভিন্ন রূপভেদ আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে "ব্রহ্মময়ী", "ভবতারিণী", "আনন্দময়ী", "করুণাময়ী" ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। এছাড়া মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে। কালী দেবীর উপাসকরা হিন্দু বাঙালি সমাজে বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন।
-
গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর। দেবীর ধ্যানে বলা হয়েছে যে -- 'গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা।'
-
মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দিরের কথা জানা যায়। মহাকাল সংহিতা মতে, নবধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা।
বাতাসে অল্প হিমেল গন্ধ আর সাথে শিউলির শেষ রেশটুকু নিয়ে শহর ছেড়ে রাঙামাটির পথে পাড়ি দিয়ে ঘুরে আসা যেতেই পারে যে কোনও ছুটির দিনে আকালীপুর, ভদ্রপুর। নলহাটি-বহরমপুর সড়কপথে বাসে করে গেলে পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ের ওপর নগোরার মোড় আর সেখান থেকে আকালীপুর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। আজিমগঞ্জ-নলহাটী শাখায় রেল স্টেশন লোহাপুর থেকে আকালীপুর মাত্র ছ'কিলোমিটার দূরে। কোলকাতার কাছেই এই মন্দিরের খোঁজ অনেকেরই হয়ত বা অজানা।কথায় বলে "কীর্তযস্য স জীবতি"! মহারাজা নন্দকুমারের কীর্তিসমূহ হেস্টিংস বিলোপ করতে চেয়েও পারেন নি। মহারাজা নন্দকুমারের অজস্র কীর্তির মধ্যে অন্যতম হল বীরভূমের আকালীপুরে 'উত্তরবাহিনী ব্রহ্মাণী নদী' তীরে গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা।
নন্দকুমার যখন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তখন ঐ গ্রামে জনাকয়েক মানুষের বাস ছিল তার মধ্যে কিছু ভট্টাচার্য বামুন ছিল, নদীতীর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। কথিত আছে এই 'গুহ্যকালী' মহাভারতে বর্ণিত মগধরাজ জরাসন্ধের আরাধ্যা দেবী। কালস্রোতে ইনি কাশীরাজ চৈতসিংহের গৃহে পূজিতা হন। রাজা চৈতসিং তাঁর রাহ্যে এক ইঁদারা খননের সময় এই কালীর হদিশ পান। অস্থায়ী মন্দির নির্মিত হয়ে পুজো শুরু হয়। হেষ্টিংস সে সময় এই অপূর্ব গুহ্যকালীর শিল্পশৈলীর কথা জানতে পেয়ে ইংল্যান্ডের 'এন্টিক' বস্তুর সংগ্রহশালায় ঐ দামী কষ্টিপাথরের মূর্তি নিয়ে যাবার ফন্দী আঁটেন। চৈত সিং এইকথা জানতে পেরে গোপনে দেবীকে ব্রাহ্মণী নদীর জলে নিমজ্জিত করে রাখেন। মহারাজ নন্দকুমার স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাতারাতি এই দেবীমূর্তিকে জল থেকে উদ্ধার করে তাঁর জমিদারীর অন্তর্গত আকালীপুর ভদ্রপুরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীকে স্থাপন করেন।
কেউ কেউ বলেন হেষ্টিংস নাকি নৌকাপথে ঐ মূর্তিকে পাচার করে দিছিলেন। নন্দকুমার গঙ্গাবক্ষেই দেবীকে উদ্ধার করেন এবং ওনার কোলকাতার বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে প্রথমে রাখেন এবং পরে মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। সে যাই হোক্, ব্রাহ্মাণী নদী ভাগিরথীর সাথে কাটোয়ায় মিলিত হয়েছে। নন্দকুমার চেয়েছিলেন এই নৌকাকে ভদ্রপুরে থামাতে কিন্তু নৌকাকে থামানো যায়নি। তাই আকালীপুরে যখন নৌকা এসে ভিড়েছিল তখন ঐ মূর্তিকে নামানো সম্ভব হয়েছিল। উত্তরবাহিনী ব্রাহ্মণী নদী কালের স্রোতে পূর্বমুখী হয়েছে। কে জানে দেবী স্বয়ং দুরাচার, অর্থপিশাচ হেষ্টিংসের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই হয়ত জঙ্গল পরিবেষ্টিত আকালীপুরকেই নিরাপদ স্থান বলে ভেবেছিলেন। অদূরে ব্রাহ্মণী নদীর কোলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশম কুটীরের ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের উপদান হয়ে থেকে গেছে।
মন্দিরটি ছিল আটকোণা দুর্গের অণুকরণে নির্মিত। চুন-সুরকির গাঁথনির মধ্যে ছোট ছোট বাংলা-ইঁঁট দিয়ে তৈরী। পাঁচিল পলাস্তরা বিহীন। দেওয়ালের খোপে দেবীর দশমহাবিদ্যার মূর্তির অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা। জনশ্রুতি আছে ভদ্রপুরের মহারাণী রাজপ্রাসাদ থেকে মন্দিরের চূড়ো দর্শন করতে চেয়েছিলেন। রাণীর ঐ দম্ভ দেবীর সহ্য হয় নি। তাই দৈব দুর্যোগে একরাতের মধ্যে নির্মিত ঐ মন্দিরের চূড়ো নষ্ট হয়ে যায় ও মন্দিরের পিছনের দেওয়ালে ফাটল ধরে। আবার কারো মতে এই দেবীমূর্তি শ্মশানকালী বলে মন্দির প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকতে নারাজ। তাই নির্মাণকালেই এই মন্দিরটি বিদীর্ণ হয় এবং এখনো অসমাপ্ত। ১৭৭৫ সালের গোড়ায় তিনি মুর্শিদাবাদ-বীরভূমের সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে দেবী গুহ্যকালীর মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু ওই বছর জুন মাসে তিনি ইংরেজের হাতে বন্দী হলে, মন্দির নির্মাণে ছেদ পড়ে। ফাঁসির পূর্বে তিনি পুত্র গুরুদাসকে তান্ত্রিক মতে দেবী গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে যান। লোকশ্রুতি, ওই বছর ১৫ জুলাই মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছিল।
মন্দিরের গর্ভগৃহটিকে বেষ্টন করে পরিখার মত আবরণী, তিনটি দরজা। প্রধান দরজা দক্ষিণদিকে, ত্রিনয়না দেবী দক্ষিণমুখী। ভারতবর্ষের অন্য কোথাও এমন কালীমূর্তির নিদর্শন নেই। অনেকটা নেপাল বা চীনের কালীমূর্তির মত গড়ন। কালো কষ্টিপাথরের একখন্ড টুকরো কেটে কোনোও এক অনামা শিল্পী বানিয়ে ছিলেন। আয়তাকার কালো পাথরের বেদীতে দুটি কুন্ডলীকৃত সাপের ওপর অর্ধ পদ্মাসনে উপবিষ্টা দেবী। দেবীর ডান পা সাপের মাথা স্পর্শ করে আছে। দেবীর মস্তকে পাঁচটি ধাপে সহস্রাধার। অর্থাত হটযোগে যে মস্তকে যে সহস্রাধারের কথা বলা হয় এই সাপের মুকুট তারই প্রতীক। দেবীর গলায় পঞ্চাশটি নরমুন্ড দিয়ে তৈরী মালা। কর্ণ কুহর থেকে বুক অবধি নেমে এসেছে দুটি শিশুর মৃত শবদেহ। দেবীর সর্প উপবীত। নাভীকুন্ডের ওপর দিয়ে সাপের কোমর বেষ্টনী। দুহাতে সাপের বলয়। উন্মুক্ত লোলজিহ্বা, বিস্ফারিত ত্রিনয়ন আর মুখ গহ্বরে নাকি আসল নরদন্তের সারি। চক্ষু ও নাকি নর-করোটির অংশে নির্মিত। দুই হাতে বর এবং অভয়।
একাধারে সৃষ্টি এবং লয়ের প্রতিকী এই দেবীর ভয়ানক রূপের মধ্যে আবার তাঁর প্রসন্ন রূপটিও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। ব্রহ্মাণী নদীতীর সংলগ্ন শ্মশানঘাটটির পরিবেশও বেশ ছমছমে। মন্দিরের দক্ষিণে "পঞ্চমুণ্ডী" নামে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন রয়েছে। আকালীপুরের দেবী গুহ্যকালীকে ভক্তেরা অতিশয় "জাগ্রত" দেবী মনে করেন। দূর-দূরান্তর থেকে পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে "মানসিক" করে পূজা দেন। দেবীর ভৈরব গৌরীশঙ্করের মূর্তিও আছে পাশেই। গুহ্যকালীর নিত্যপুজো হয় এখানে। দশপোয়া অতপচালের ভোগ দেওয়া হয় দুর্গাপূজার পর চতুর্দশীতে ভেড়া, ছাগল ও মোষ বলির ও প্রচলন আছে। মায়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে মাঘ মাসে রটন্তী কালীপুজোতে মেলাও বসে এখানে। তান্ত্রিকরা এই কালীকে 'বেদের বেটী' বলে থাকেন। ২০০৪ সাল থেকে এই মন্দিরের উন্নয়নে জোর কদমে কাজকর্ম চলছে। ব্রহ্মাণীনদীর সবুজ অরণ্যময়তায় আর বাঁশবনের মর্মরতায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিপুষ্ট এই আকালীপুর ভদ্রপুরের গুহ্যকালী বীরভূমের অন্যান্য সতীপিঠ অপেক্ষা কোনো অংশে কম নয়। আর মহারাজা নন্দকুমারের অপরিমিত সাহস ও দূরদৃষ্টির কথা বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই মন্দির। শক্তিসাধনার ক্ষেত্র হিসেবে এই তীর্থভূমি পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটি তীর্থ সাধনার স্থানের মতই।
-
গত বৎসর এই মন্দিরে মায়ের দর্শনে গিয়েছিলাম। মাতৃভক্ত সুজয় চন্দ্রের গাড়ীতে বহরমপুর থেকে মাতৃদর্শনে গিয়ে মন্দিরে বসে পূজায় অংশগ্রহণ করলাম। পূজারী একজন সজ্জন ও অমায়িক মানুষ -আলাপ করলে অবশ্যই আপনার ভালো লাগবে। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের ডান দিকে তার স্রীর পূজা সামগ্রীর দোকান। পুজা শেষে একটা পাঠা বলি হ'ল। প্রসাদ গ্রহণ করলাম, কয়েকটা ফটো তুলে মা'কে প্রণাম জানিয়ে নলহাটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
Courtesy by: Prithwish Ghosh

পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা; গলায় মানুষের মুণ্ড দিয়ে গাঁথা মালা; বিরাট জিভ, কালো গায়ের রং, এলোকেশ দেখা যায় এবং তাঁকে তাঁর স্বামী শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ব্রহ্মযামল মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীর বিভিন্ন রূপভেদ আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে "ব্রহ্মময়ী", "ভবতারিণী", "আনন্দময়ী", "করুণাময়ী" ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। এছাড়া মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে। কালী দেবীর উপাসকরা হিন্দু বাঙালি সমাজে বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন।
-
গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর। দেবীর ধ্যানে বলা হয়েছে যে -- 'গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা।'
-
মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দিরের কথা জানা যায়। মহাকাল সংহিতা মতে, নবধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা।
বাতাসে অল্প হিমেল গন্ধ আর সাথে শিউলির শেষ রেশটুকু নিয়ে শহর ছেড়ে রাঙামাটির পথে পাড়ি দিয়ে ঘুরে আসা যেতেই পারে যে কোনও ছুটির দিনে আকালীপুর, ভদ্রপুর। নলহাটি-বহরমপুর সড়কপথে বাসে করে গেলে পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ের ওপর নগোরার মোড় আর সেখান থেকে আকালীপুর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। আজিমগঞ্জ-নলহাটী শাখায় রেল স্টেশন লোহাপুর থেকে আকালীপুর মাত্র ছ'কিলোমিটার দূরে। কোলকাতার কাছেই এই মন্দিরের খোঁজ অনেকেরই হয়ত বা অজানা।কথায় বলে "কীর্তযস্য স জীবতি"! মহারাজা নন্দকুমারের কীর্তিসমূহ হেস্টিংস বিলোপ করতে চেয়েও পারেন নি। মহারাজা নন্দকুমারের অজস্র কীর্তির মধ্যে অন্যতম হল বীরভূমের আকালীপুরে 'উত্তরবাহিনী ব্রহ্মাণী নদী' তীরে গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা।
নন্দকুমার যখন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তখন ঐ গ্রামে জনাকয়েক মানুষের বাস ছিল তার মধ্যে কিছু ভট্টাচার্য বামুন ছিল, নদীতীর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। কথিত আছে এই 'গুহ্যকালী' মহাভারতে বর্ণিত মগধরাজ জরাসন্ধের আরাধ্যা দেবী। কালস্রোতে ইনি কাশীরাজ চৈতসিংহের গৃহে পূজিতা হন। রাজা চৈতসিং তাঁর রাহ্যে এক ইঁদারা খননের সময় এই কালীর হদিশ পান। অস্থায়ী মন্দির নির্মিত হয়ে পুজো শুরু হয়। হেষ্টিংস সে সময় এই অপূর্ব গুহ্যকালীর শিল্পশৈলীর কথা জানতে পেয়ে ইংল্যান্ডের 'এন্টিক' বস্তুর সংগ্রহশালায় ঐ দামী কষ্টিপাথরের মূর্তি নিয়ে যাবার ফন্দী আঁটেন। চৈত সিং এইকথা জানতে পেরে গোপনে দেবীকে ব্রাহ্মণী নদীর জলে নিমজ্জিত করে রাখেন। মহারাজ নন্দকুমার স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাতারাতি এই দেবীমূর্তিকে জল থেকে উদ্ধার করে তাঁর জমিদারীর অন্তর্গত আকালীপুর ভদ্রপুরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীকে স্থাপন করেন।
কেউ কেউ বলেন হেষ্টিংস নাকি নৌকাপথে ঐ মূর্তিকে পাচার করে দিছিলেন। নন্দকুমার গঙ্গাবক্ষেই দেবীকে উদ্ধার করেন এবং ওনার কোলকাতার বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে প্রথমে রাখেন এবং পরে মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। সে যাই হোক্, ব্রাহ্মাণী নদী ভাগিরথীর সাথে কাটোয়ায় মিলিত হয়েছে। নন্দকুমার চেয়েছিলেন এই নৌকাকে ভদ্রপুরে থামাতে কিন্তু নৌকাকে থামানো যায়নি। তাই আকালীপুরে যখন নৌকা এসে ভিড়েছিল তখন ঐ মূর্তিকে নামানো সম্ভব হয়েছিল। উত্তরবাহিনী ব্রাহ্মণী নদী কালের স্রোতে পূর্বমুখী হয়েছে। কে জানে দেবী স্বয়ং দুরাচার, অর্থপিশাচ হেষ্টিংসের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই হয়ত জঙ্গল পরিবেষ্টিত আকালীপুরকেই নিরাপদ স্থান বলে ভেবেছিলেন। অদূরে ব্রাহ্মণী নদীর কোলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশম কুটীরের ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের উপদান হয়ে থেকে গেছে।
মন্দিরটি ছিল আটকোণা দুর্গের অণুকরণে নির্মিত। চুন-সুরকির গাঁথনির মধ্যে ছোট ছোট বাংলা-ইঁঁট দিয়ে তৈরী। পাঁচিল পলাস্তরা বিহীন। দেওয়ালের খোপে দেবীর দশমহাবিদ্যার মূর্তির অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা। জনশ্রুতি আছে ভদ্রপুরের মহারাণী রাজপ্রাসাদ থেকে মন্দিরের চূড়ো দর্শন করতে চেয়েছিলেন। রাণীর ঐ দম্ভ দেবীর সহ্য হয় নি। তাই দৈব দুর্যোগে একরাতের মধ্যে নির্মিত ঐ মন্দিরের চূড়ো নষ্ট হয়ে যায় ও মন্দিরের পিছনের দেওয়ালে ফাটল ধরে। আবার কারো মতে এই দেবীমূর্তি শ্মশানকালী বলে মন্দির প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকতে নারাজ। তাই নির্মাণকালেই এই মন্দিরটি বিদীর্ণ হয় এবং এখনো অসমাপ্ত। ১৭৭৫ সালের গোড়ায় তিনি মুর্শিদাবাদ-বীরভূমের সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে দেবী গুহ্যকালীর মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু ওই বছর জুন মাসে তিনি ইংরেজের হাতে বন্দী হলে, মন্দির নির্মাণে ছেদ পড়ে। ফাঁসির পূর্বে তিনি পুত্র গুরুদাসকে তান্ত্রিক মতে দেবী গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে যান। লোকশ্রুতি, ওই বছর ১৫ জুলাই মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছিল।
মন্দিরের গর্ভগৃহটিকে বেষ্টন করে পরিখার মত আবরণী, তিনটি দরজা। প্রধান দরজা দক্ষিণদিকে, ত্রিনয়না দেবী দক্ষিণমুখী। ভারতবর্ষের অন্য কোথাও এমন কালীমূর্তির নিদর্শন নেই। অনেকটা নেপাল বা চীনের কালীমূর্তির মত গড়ন। কালো কষ্টিপাথরের একখন্ড টুকরো কেটে কোনোও এক অনামা শিল্পী বানিয়ে ছিলেন। আয়তাকার কালো পাথরের বেদীতে দুটি কুন্ডলীকৃত সাপের ওপর অর্ধ পদ্মাসনে উপবিষ্টা দেবী। দেবীর ডান পা সাপের মাথা স্পর্শ করে আছে। দেবীর মস্তকে পাঁচটি ধাপে সহস্রাধার। অর্থাত হটযোগে যে মস্তকে যে সহস্রাধারের কথা বলা হয় এই সাপের মুকুট তারই প্রতীক। দেবীর গলায় পঞ্চাশটি নরমুন্ড দিয়ে তৈরী মালা। কর্ণ কুহর থেকে বুক অবধি নেমে এসেছে দুটি শিশুর মৃত শবদেহ। দেবীর সর্প উপবীত। নাভীকুন্ডের ওপর দিয়ে সাপের কোমর বেষ্টনী। দুহাতে সাপের বলয়। উন্মুক্ত লোলজিহ্বা, বিস্ফারিত ত্রিনয়ন আর মুখ গহ্বরে নাকি আসল নরদন্তের সারি। চক্ষু ও নাকি নর-করোটির অংশে নির্মিত। দুই হাতে বর এবং অভয়।
একাধারে সৃষ্টি এবং লয়ের প্রতিকী এই দেবীর ভয়ানক রূপের মধ্যে আবার তাঁর প্রসন্ন রূপটিও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। ব্রহ্মাণী নদীতীর সংলগ্ন শ্মশানঘাটটির পরিবেশও বেশ ছমছমে। মন্দিরের দক্ষিণে "পঞ্চমুণ্ডী" নামে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন রয়েছে। আকালীপুরের দেবী গুহ্যকালীকে ভক্তেরা অতিশয় "জাগ্রত" দেবী মনে করেন। দূর-দূরান্তর থেকে পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে "মানসিক" করে পূজা দেন। দেবীর ভৈরব গৌরীশঙ্করের মূর্তিও আছে পাশেই। গুহ্যকালীর নিত্যপুজো হয় এখানে। দশপোয়া অতপচালের ভোগ দেওয়া হয় দুর্গাপূজার পর চতুর্দশীতে ভেড়া, ছাগল ও মোষ বলির ও প্রচলন আছে। মায়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে মাঘ মাসে রটন্তী কালীপুজোতে মেলাও বসে এখানে। তান্ত্রিকরা এই কালীকে 'বেদের বেটী' বলে থাকেন। ২০০৪ সাল থেকে এই মন্দিরের উন্নয়নে জোর কদমে কাজকর্ম চলছে। ব্রহ্মাণীনদীর সবুজ অরণ্যময়তায় আর বাঁশবনের মর্মরতায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিপুষ্ট এই আকালীপুর ভদ্রপুরের গুহ্যকালী বীরভূমের অন্যান্য সতীপিঠ অপেক্ষা কোনো অংশে কম নয়। আর মহারাজা নন্দকুমারের অপরিমিত সাহস ও দূরদৃষ্টির কথা বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই মন্দির। শক্তিসাধনার ক্ষেত্র হিসেবে এই তীর্থভূমি পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটি তীর্থ সাধনার স্থানের মতই।
-
গত বৎসর এই মন্দিরে মায়ের দর্শনে গিয়েছিলাম। মাতৃভক্ত সুজয় চন্দ্রের গাড়ীতে বহরমপুর থেকে মাতৃদর্শনে গিয়ে মন্দিরে বসে পূজায় অংশগ্রহণ করলাম। পূজারী একজন সজ্জন ও অমায়িক মানুষ -আলাপ করলে অবশ্যই আপনার ভালো লাগবে। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের ডান দিকে তার স্রীর পূজা সামগ্রীর দোকান। পুজা শেষে একটা পাঠা বলি হ'ল। প্রসাদ গ্রহণ করলাম, কয়েকটা ফটো তুলে মা'কে প্রণাম জানিয়ে নলহাটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
Courtesy by: Prithwish Ghosh
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন