ব্রাহ্ম ধর্ম নিয়ে অনেকের কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে আবার অধিকাংশের এ নিয়ে কোন ধারণাই নেই। আমি সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু লিখছি। অবশ্যই হিন্দু ও ব্রাহ্মের তূলনামূলক আলাপই মূখ্য। যারা হিন্দু ধর্মের সাথে ব্রাহ্ম ধর্মের বিস্তর ফারাক দেখতে পান- তারা এটার নৈকট্যকে আড়াল করেন। এটা অজ্ঞতাবশত হয় সাধারণত। ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে আমাদের এই অজ্ঞতার কারণ কি? মূল কারণটা হল- আমাদের বর্তমান সমাজে 'ব্রাহ্ম' বলে কোন কিছু আর বলতে গেলে নেই-ই। যদি আশেপাশে কিছু থাকত তাহলে আপনার জানার কৌতূহল হত, কৌতূহল মেটানোর সুযোগও থাকত। কিন্তু ব্রাহ্মরা নেই কেন? সেটাও আলোচনায় আসবে।
ব্রাহ্ম শব্দটা কোত্থুকে এলো? 'ব্রহ্ম' থেকে ব্রাহ্ম। রাজা রামমোহন ব্রহ্ম এর উপাসককে ব্রহ্মবাদী না বলে ব্রাহ্ম বললেন। এই ব্রহ্ম কোথায় পেলেন তিনি? আজ্ঞে বেদ থেকে। ওটা রাজা রামমোহনের নিজের সৃষ্ট কোন ধারণা নয়। বেদের ব্রহ্মকে তিনি নিজের মত করে ব্যাখ্যাও করেননি। একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম বলাটাও হাস্যকর; কেন না বৈদিক সনাতন ধারা কোন বহু-ঈশ্বরবাদী তত্ত্ব নয়। বরং বলা যেতে পারে তিনি ব্রাহ্ম মতে দ্বৈত বেদান্তকে মানেননি। তিনি অদ্বৈত সিদ্ধান্তকে ধরেছিলেন। বেদান্তই ছিল ব্রাহ্ম ধর্মের মূল ভিত। বেদান্ত কি? আজ্ঞে মূখ্যত উপনিষদগুলোই হল বেদান্তের প্রাণ। তাহলে হিন্দুর সাথে ব্রাহ্মের পার্থক্যটা কোথায়?
পার্থক্য দেখাচ্ছি। ব্রাহ্মধর্ম উঠে এসেছিল হিন্দু ধর্মের আচার ও প্রথাবদ্ধতার নিগড় থেকে। বহু দেবদেবী নির্ভর ধর্মাচার ভেঙে ব্রাহ্মধর্ম বলেছিল এক পরব্রহ্মের উপাসনাকেই সার করতে। প্রতিমা উপাসনারও দরকার নেই। এই মতামত একেবারেই নতুন নয় হিন্দুর ইতিহাসে। নিরাকারবাদী বৈদিক উপাসকের অভাব ছিল না কখনো। দেবদেবী অস্বীকার করলেও কেউ অহিন্দু হয় না যতক্ষণ না সে ব্যক্তি বৈদান্তিক সিদ্ধান্তকে অস্বীকার না করছে। ব্রাহ্মরা তা তো করেনি। ব্রাহ্মরা, কোলকাতার ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাবু সমাজ নিজেদের সাধারণ অজ্ঞ পুরোহিত শাসিত হিন্দু রীতিনীতি থেকে স্বতন্ত্র করতে বেদান্তের ব্রহ্মবাদ নিয়েই নিজেদের আলাদা করলেন। এখানে একটু পার্থক্য আছে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল- উপাসনা প্রণালীতে। ব্রাহ্ম উপাসনার ধরণ ছিল খ্রিষ্টীয়। উপাসনা গৃহও তৈরি হত গীর্জার আদলে। উপাসনার পদ্ধতিও ছিল বাইবেলের মত করেই সাজানো! এর মাধ্যমে তাদের পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ আর বৃটিশ সাহেবদের আনুকুল্য লাভের গন্ধটাই বেশী পাওয়া যেত। মোদ্দা কথা হল- তারা হিন্দুদের হাজার হাজার অপ্রোজনীয় আচার-বিচারের বালাই ছেড়ে, হিন্দু দর্শনের ব্রহ্মকে ধরেছিলেন আর তাতে একটু খ্রীষ্টিয় বাতাস বইয়ে দেন!
কিন্তু তারা অদ্বৈত বেদান্তী কখনোই হননি। তাদের উপাসনার ধারাটা ছিল দ্বৈত। তারা মনের ভেতর ব্রহ্মের সাকার প্রতিমা সাজিয়ে তাকে বাইরে নিরাকার বলে ভজনা করতেন! অদ্বৈত যেমন বলে নির্গুণ ব্রহ্ম- তিনি উপাধিরহিত, এরা তেমন বলতেন না। এরা দ্বৈতবাদের মত করেই ব্রহ্মকে মাতা, পিতা, বন্ধু, সখা, প্রভূ বলে প্রার্থনা করতেন। এতে বাঙালীর কিছু উপকার হয়েছে। কিসে উপকার জানেন? ব্রাহ্মদের মাথা থেকে এত সুন্দর সুন্দর উপাসনার গান বেরিয়েছিল, যাদের ব্রহ্মসঙ্গীত বলা হয়, এই গানগুলো ভাষার লালিত্যে অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের মত মহাপ্রতিভা যেখানে গান লিখছেন, নরেন্দ্রনাথ (বিবেকানন্দ) যেখানে গাইছেন- ভাবতে পারেন কি হচ্ছিল সে পরিবেশে?
কিন্তু ব্রাহ্ম ধর্ম টিকল না কেন? এর কিছু কারণ আছে। ব্রাহ্মধর্মের বিভাজনের কথা জানেন তো? ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে দু'ভাগ হল। কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীরা বেরিয়ে এসে নব-বিধান ব্রাহ্ম সমাজ গড়লেন। নব-বিধান কেন? তাদের বক্তব্য ছিল- ব্রাহ্মধর্ম একটা নতুন মত। এর মধ্যে কোন হিন্দুভাব থাকবে না। অথচ ব্রাহ্মসমাজীরা তখনো তাদের সমস্ত দৈনন্দিন রীতিনীতি হিন্দু নিয়মেই করতেন। যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িটি হয়ে উঠেছিল ব্রাহ্মসমাজের প্রাণকেন্দ্র সেটাই হয়েছিল আক্রমণের লক্ষ্য। ঠাকুরবাড়ির লোকেরা তখনো উপবীত পড়ত, হিন্দু আচার মানত নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে। আধুনিক ব্রাহ্মরা মানলেন না। বিজয়কৃষ্ণরা সইতে পারলেন না আর। পৈতা ছুঁড়ে ফেললেন। নতুন বিধান চাই আমরা। হয়ে গেল 'নব বিধান ব্রাহ্ম সমাজ'! আদি ব্রাহ্ম সমাজের চাইতে এই নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের দ্রুতি ছিল অনেক অনেক বেশী! এর কারণ কেশব চন্দ্র সেনের মত একজন ছিল তাদের নেতা। এখানেই শেষ নয়! এখনো কিছু দেখা বাকি!
কেশব সেনের সাথে বিজয়কৃষ্ণ আর থাকলেন না! বাঙালী কোন্দল না করে কি থাকতে পারে? বিজয়কৃষ্ণ পরে আর ব্রাহ্মও থাকলেন না। তিনি ঘোর বৈষ্ণব হয়ে গেলেন। এর পেছনে রামকৃষ্ণ দেবের প্রভাব কতটা তাও ভাবার। কেশব ও বিজয় দু,জনই রামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। ব্রাহ্ম আন্দোলনে বলতে গেলে রামকৃষ্ণ পরমহংসই জল ঢালেন। কেশব নিজের দলটল ছেড়ে রামকৃষ্ণের কাছে গিয়ে পড়ে থাকতেন। রামকৃষ্ণ তাদের মজা করে বলতেন 'ব্রহ্মদত্যি!' রামকৃষ্ণের মূল শিক্ষাটা ছিল- যা ইচ্ছে কর না বাপু, শুধু আমার মতটাই ঠিক, অপরেরটা বেঠিক, শুধু আমিই ঠিক পথে আছি, আর কেউ নেই- অমন গোঁড়ামি কোরো না। তোমরা যাকে ব্রহ্ম বল আমি তাকে কালী বলি! সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে বসে থাকলেও সাপ, হেললে দুললেও সাপ। চিনি এমনি খাও আর জলে গুলে খাও মিষ্টিই লাগবে! অর্থাৎ ব্রহ্মকে যে যেভাবেই ডাকুক না কেন- বস্তু তো এক। রামকৃষ্ণের এই 'যত মত তত পথ' দর্শন ছিল বাঙালী নবজাগরণের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী আলো! এতে ব্রাহ্মধর্মের গোঁড়ামিতে ঘা লাগে। কেশব সেনের মত প্রচারের ধারাতেও রামকৃষ্ণ বারবার আলোচিত হতেন। রামকৃষ্ণকে নিয়ে সাহেবদের পত্রিকায় কলাম লিখেছিলেন তিনি। ধীরেধীরে তিনি গোঁড়া মতবাদ থেকে সরে আসেন। তিনি রামকৃষ্ণের মতবাদ থেকেই বলতে থাকেন- যে যে মতেই ডাকো না কেন আন্তরিক হলে, ব্যকুল হলে, সবাই সত্যকে জানতে পারে।
ব্রাহ্ম ধর্মের সবচেয়ে বেশী দ্রুত বিলুপ্ত হবার কারণ হল- এটা বাবু সমাজের ধর্ম হয়েছিল। কখনো সাধারণ মানুষের কাছে তা যেতে পারেনি। আরেকটা মোক্ষম কারণ হল স্বামী বিবেকানন্দের উদয়। স্বামী বিবেকানন্দ যৌবনের শুরুর দিকে ব্রাহ্ম অনুসারী হলেও তিনি রামকৃষ্ণের শিক্ষাতেই পেয়েছিলেন নিজের পূর্ণতা। শিকাগো ধর্মসভায় বিবেকানন্দের সাফল্য ও দেশ-দুনিয়া এক করে ফেলা খ্যাতি তাকে ব্রাহ্ম সমাজের চক্ষুশূল করে ফেলে। শিকাগোতে অবস্থানরত ব্রাহ্ম প্রতিনিধি প্রতাপচন্দ্র মজুমদার বিবেকানন্দের পেছনে কিরকম উঠেপড়ে লেগেছিলেন সেসব হয়ত কেউ কেউ পড়েছেন। এমনকি ঠাকুর পরিবারের বলয়টিও এই নব্য হিন্দু জাগরণকে মেনে নেয়নি। রবীন্দ্রনাথ সে সময়টাতে এই ব্যাপারে যথেষ্ট নেতিবাচক ছিলেন বলেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের ভেতর ইতিবাচক ভাবনা আসে ভগিনী নিবেদিতার সংস্পর্শে আসার পর। তারও অনেক পর রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখছি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রশস্তি গাইতে। সে এক পরবর্তীকালের পরিবর্তিত রবীন্দ্রনাথ! পরিণত রবীন্দ্রনাথও।
কবিগুরু তাঁর 'গোরা' উপন্যাসে যে সমাজচিত্র এঁকেছেন, তাতে যে ব্রাহ্ম-হিন্দু দার্শনিক বাদানুবাদ দেখিয়েছেন, এবং উপন্যাসের মূল নায়ক 'গোরা' করেছেন- এর সবটার পেছনেই ভগিনী নিবেদিতার শক্তিশালী প্রভাবটা স্পষ্ট! রবীন্দ্র গবেষকরা বলেন 'গোরা' আসলে নিবেদিতার প্রতিরূপ। কিন্তু এই উপন্যাসেও কি কবিগুরু কোন সমাধানে আসতে পেরেছিলেন? শেষমেষ গিয়ে মানবধর্মে সমপর্ণ করেছেন সবাইকে। ম্রিয়মান ব্রাহ্মধর্মের যে দার্শনিক সংকীর্ণতা ছিল সেটাকে তিনি মানবধর্মের আলোতে এনে বুজিয়ে দিতে চাইলেন। বিবেকানন্দের মতাদর্শ ভারতের বুকে আছড়ে পড়াতে একদিকে যেমন গোঁড়া পুরোহিতকুলে ঘা লাগে তেমনি অপরদিকে হিন্দু-বিরোধী স্রোতগুলোতেও ভাটা পরে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, অন্যকে ছোট করে বড় হওয়া যাবে না, অপরের মুক্তিতেই আমাদের মুক্তি! বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আচার-বিচার-প্রথা-পুঁথি-পত্র এমনকি মন্দির-উপাসনালয়ও ধর্ম নয়- ধর্ম অনুভবের, ধর্ম আচরণের। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, জীবের সেবা-ই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ উপাসনা। এর চেয়ে বড় ধর্ম নেই! বিবেকানন্দ বলেছিলেন- আমাদের জনজীবনের বহু আচারই হতে পারে একদম অকেজো, তাই বলে তাকে লাথি মেরে দূরে সরাতে হবে না, সংস্কারের নামে মানুষকে আঘাত করা কেন? মানুষকে উপযুক্ত শিক্ষা দাও, তারাই বুঝতে পারবে তাদের করণীয় কি! বিবেকানন্দ বলেছিলেন- হিন্দু শুধু একটা ধর্ম নয়, এটা এখানকার ভৌগলিক সংস্কৃতির নাম! এটাকে ছুঁড়ে ফেলে কিছু করা যাবে না এই ভূমিতে। কেউ চাইলেও পারবে না! বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আমাদের অনেক ধর্ম হয়েছে, আমাদের এখন অন্ন চাই! আমাদের সবার আগে চাই স্বাধীনতা! আমাদের চাই শিল্প ও বিজ্ঞান! বিবেকানন্দ হিন্দুর চিরন্তন আদর্শের সাথে, হিন্দুর দর্শনের সাথে পাশ্চাত্যের ভাবনার সামঞ্জস্য করতে পেরেছিলেন। কবিগুরুর কথাতেও আমরা পেয়েছিলাম, তিনি বলছেন- রামমোহনের পর একমাত্রে বিবেকানন্দই পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে একটা সেতু হতে পেরেছিলেন!
বিবেকানন্দের এই সেতু হয়ে ওঠায় আমরা দেখেছি বহু পাশ্চাত্য নরনারীকে বেদান্তের আলোতে নিয়ে আসে, হিন্দু শিক্ষিত সমাজের ধর্ম বিমুখতাকে ভেঙে নতুন করে ভাবতে শেখায়, ব্রাহ্মদের যে হিন্দু-ধারা বিরোধী প্রচার তা একদম মুখ থুবরে পড়ে, খ্রীষ্টান মিশনারিদের ধর্মান্তরিতকরণের মহোৎসব নিষ্প্রাণ হয়ে যায়! দেশপ্রেম, মানবসেবা ও দর্শনের সাথে লোকপ্রথার এমন অভূতপূর্ব সমন্বয় বিবেকানন্দের আগে কারো ভেতর দেখা যায়নি। বিবেকানন্দের এই আবির্ভাব ব্রাহ্মসমাজকে সমাপ্ত করেছে না বলে বলা যায় আত্মস্থ করেছিল যা সে সময়ের ইতিহাস পড়লেই ভালভাবে বুঝতে পারবেন। আমার এই পোস্ট একটা প্রাইমারি স্কেচ। এতে ব্রাহ্মসমাজের উত্থান ও পতন নিয়ে কিছু ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। যাদের এই বিষয়ে আরও জানার আগ্রহ আছে তারা আশা করি নিজে থেকেই পড়াশোনা করে নেবেন আরও।
(c)
বিশাখদত্ত দত্ত
ব্রাহ্ম শব্দটা কোত্থুকে এলো? 'ব্রহ্ম' থেকে ব্রাহ্ম। রাজা রামমোহন ব্রহ্ম এর উপাসককে ব্রহ্মবাদী না বলে ব্রাহ্ম বললেন। এই ব্রহ্ম কোথায় পেলেন তিনি? আজ্ঞে বেদ থেকে। ওটা রাজা রামমোহনের নিজের সৃষ্ট কোন ধারণা নয়। বেদের ব্রহ্মকে তিনি নিজের মত করে ব্যাখ্যাও করেননি। একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম বলাটাও হাস্যকর; কেন না বৈদিক সনাতন ধারা কোন বহু-ঈশ্বরবাদী তত্ত্ব নয়। বরং বলা যেতে পারে তিনি ব্রাহ্ম মতে দ্বৈত বেদান্তকে মানেননি। তিনি অদ্বৈত সিদ্ধান্তকে ধরেছিলেন। বেদান্তই ছিল ব্রাহ্ম ধর্মের মূল ভিত। বেদান্ত কি? আজ্ঞে মূখ্যত উপনিষদগুলোই হল বেদান্তের প্রাণ। তাহলে হিন্দুর সাথে ব্রাহ্মের পার্থক্যটা কোথায়?
পার্থক্য দেখাচ্ছি। ব্রাহ্মধর্ম উঠে এসেছিল হিন্দু ধর্মের আচার ও প্রথাবদ্ধতার নিগড় থেকে। বহু দেবদেবী নির্ভর ধর্মাচার ভেঙে ব্রাহ্মধর্ম বলেছিল এক পরব্রহ্মের উপাসনাকেই সার করতে। প্রতিমা উপাসনারও দরকার নেই। এই মতামত একেবারেই নতুন নয় হিন্দুর ইতিহাসে। নিরাকারবাদী বৈদিক উপাসকের অভাব ছিল না কখনো। দেবদেবী অস্বীকার করলেও কেউ অহিন্দু হয় না যতক্ষণ না সে ব্যক্তি বৈদান্তিক সিদ্ধান্তকে অস্বীকার না করছে। ব্রাহ্মরা তা তো করেনি। ব্রাহ্মরা, কোলকাতার ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাবু সমাজ নিজেদের সাধারণ অজ্ঞ পুরোহিত শাসিত হিন্দু রীতিনীতি থেকে স্বতন্ত্র করতে বেদান্তের ব্রহ্মবাদ নিয়েই নিজেদের আলাদা করলেন। এখানে একটু পার্থক্য আছে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল- উপাসনা প্রণালীতে। ব্রাহ্ম উপাসনার ধরণ ছিল খ্রিষ্টীয়। উপাসনা গৃহও তৈরি হত গীর্জার আদলে। উপাসনার পদ্ধতিও ছিল বাইবেলের মত করেই সাজানো! এর মাধ্যমে তাদের পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ আর বৃটিশ সাহেবদের আনুকুল্য লাভের গন্ধটাই বেশী পাওয়া যেত। মোদ্দা কথা হল- তারা হিন্দুদের হাজার হাজার অপ্রোজনীয় আচার-বিচারের বালাই ছেড়ে, হিন্দু দর্শনের ব্রহ্মকে ধরেছিলেন আর তাতে একটু খ্রীষ্টিয় বাতাস বইয়ে দেন!
কিন্তু তারা অদ্বৈত বেদান্তী কখনোই হননি। তাদের উপাসনার ধারাটা ছিল দ্বৈত। তারা মনের ভেতর ব্রহ্মের সাকার প্রতিমা সাজিয়ে তাকে বাইরে নিরাকার বলে ভজনা করতেন! অদ্বৈত যেমন বলে নির্গুণ ব্রহ্ম- তিনি উপাধিরহিত, এরা তেমন বলতেন না। এরা দ্বৈতবাদের মত করেই ব্রহ্মকে মাতা, পিতা, বন্ধু, সখা, প্রভূ বলে প্রার্থনা করতেন। এতে বাঙালীর কিছু উপকার হয়েছে। কিসে উপকার জানেন? ব্রাহ্মদের মাথা থেকে এত সুন্দর সুন্দর উপাসনার গান বেরিয়েছিল, যাদের ব্রহ্মসঙ্গীত বলা হয়, এই গানগুলো ভাষার লালিত্যে অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের মত মহাপ্রতিভা যেখানে গান লিখছেন, নরেন্দ্রনাথ (বিবেকানন্দ) যেখানে গাইছেন- ভাবতে পারেন কি হচ্ছিল সে পরিবেশে?
কিন্তু ব্রাহ্ম ধর্ম টিকল না কেন? এর কিছু কারণ আছে। ব্রাহ্মধর্মের বিভাজনের কথা জানেন তো? ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে দু'ভাগ হল। কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীরা বেরিয়ে এসে নব-বিধান ব্রাহ্ম সমাজ গড়লেন। নব-বিধান কেন? তাদের বক্তব্য ছিল- ব্রাহ্মধর্ম একটা নতুন মত। এর মধ্যে কোন হিন্দুভাব থাকবে না। অথচ ব্রাহ্মসমাজীরা তখনো তাদের সমস্ত দৈনন্দিন রীতিনীতি হিন্দু নিয়মেই করতেন। যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িটি হয়ে উঠেছিল ব্রাহ্মসমাজের প্রাণকেন্দ্র সেটাই হয়েছিল আক্রমণের লক্ষ্য। ঠাকুরবাড়ির লোকেরা তখনো উপবীত পড়ত, হিন্দু আচার মানত নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে। আধুনিক ব্রাহ্মরা মানলেন না। বিজয়কৃষ্ণরা সইতে পারলেন না আর। পৈতা ছুঁড়ে ফেললেন। নতুন বিধান চাই আমরা। হয়ে গেল 'নব বিধান ব্রাহ্ম সমাজ'! আদি ব্রাহ্ম সমাজের চাইতে এই নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের দ্রুতি ছিল অনেক অনেক বেশী! এর কারণ কেশব চন্দ্র সেনের মত একজন ছিল তাদের নেতা। এখানেই শেষ নয়! এখনো কিছু দেখা বাকি!
কেশব সেনের সাথে বিজয়কৃষ্ণ আর থাকলেন না! বাঙালী কোন্দল না করে কি থাকতে পারে? বিজয়কৃষ্ণ পরে আর ব্রাহ্মও থাকলেন না। তিনি ঘোর বৈষ্ণব হয়ে গেলেন। এর পেছনে রামকৃষ্ণ দেবের প্রভাব কতটা তাও ভাবার। কেশব ও বিজয় দু,জনই রামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। ব্রাহ্ম আন্দোলনে বলতে গেলে রামকৃষ্ণ পরমহংসই জল ঢালেন। কেশব নিজের দলটল ছেড়ে রামকৃষ্ণের কাছে গিয়ে পড়ে থাকতেন। রামকৃষ্ণ তাদের মজা করে বলতেন 'ব্রহ্মদত্যি!' রামকৃষ্ণের মূল শিক্ষাটা ছিল- যা ইচ্ছে কর না বাপু, শুধু আমার মতটাই ঠিক, অপরেরটা বেঠিক, শুধু আমিই ঠিক পথে আছি, আর কেউ নেই- অমন গোঁড়ামি কোরো না। তোমরা যাকে ব্রহ্ম বল আমি তাকে কালী বলি! সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে বসে থাকলেও সাপ, হেললে দুললেও সাপ। চিনি এমনি খাও আর জলে গুলে খাও মিষ্টিই লাগবে! অর্থাৎ ব্রহ্মকে যে যেভাবেই ডাকুক না কেন- বস্তু তো এক। রামকৃষ্ণের এই 'যত মত তত পথ' দর্শন ছিল বাঙালী নবজাগরণের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী আলো! এতে ব্রাহ্মধর্মের গোঁড়ামিতে ঘা লাগে। কেশব সেনের মত প্রচারের ধারাতেও রামকৃষ্ণ বারবার আলোচিত হতেন। রামকৃষ্ণকে নিয়ে সাহেবদের পত্রিকায় কলাম লিখেছিলেন তিনি। ধীরেধীরে তিনি গোঁড়া মতবাদ থেকে সরে আসেন। তিনি রামকৃষ্ণের মতবাদ থেকেই বলতে থাকেন- যে যে মতেই ডাকো না কেন আন্তরিক হলে, ব্যকুল হলে, সবাই সত্যকে জানতে পারে।
ব্রাহ্ম ধর্মের সবচেয়ে বেশী দ্রুত বিলুপ্ত হবার কারণ হল- এটা বাবু সমাজের ধর্ম হয়েছিল। কখনো সাধারণ মানুষের কাছে তা যেতে পারেনি। আরেকটা মোক্ষম কারণ হল স্বামী বিবেকানন্দের উদয়। স্বামী বিবেকানন্দ যৌবনের শুরুর দিকে ব্রাহ্ম অনুসারী হলেও তিনি রামকৃষ্ণের শিক্ষাতেই পেয়েছিলেন নিজের পূর্ণতা। শিকাগো ধর্মসভায় বিবেকানন্দের সাফল্য ও দেশ-দুনিয়া এক করে ফেলা খ্যাতি তাকে ব্রাহ্ম সমাজের চক্ষুশূল করে ফেলে। শিকাগোতে অবস্থানরত ব্রাহ্ম প্রতিনিধি প্রতাপচন্দ্র মজুমদার বিবেকানন্দের পেছনে কিরকম উঠেপড়ে লেগেছিলেন সেসব হয়ত কেউ কেউ পড়েছেন। এমনকি ঠাকুর পরিবারের বলয়টিও এই নব্য হিন্দু জাগরণকে মেনে নেয়নি। রবীন্দ্রনাথ সে সময়টাতে এই ব্যাপারে যথেষ্ট নেতিবাচক ছিলেন বলেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের ভেতর ইতিবাচক ভাবনা আসে ভগিনী নিবেদিতার সংস্পর্শে আসার পর। তারও অনেক পর রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখছি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রশস্তি গাইতে। সে এক পরবর্তীকালের পরিবর্তিত রবীন্দ্রনাথ! পরিণত রবীন্দ্রনাথও।
কবিগুরু তাঁর 'গোরা' উপন্যাসে যে সমাজচিত্র এঁকেছেন, তাতে যে ব্রাহ্ম-হিন্দু দার্শনিক বাদানুবাদ দেখিয়েছেন, এবং উপন্যাসের মূল নায়ক 'গোরা' করেছেন- এর সবটার পেছনেই ভগিনী নিবেদিতার শক্তিশালী প্রভাবটা স্পষ্ট! রবীন্দ্র গবেষকরা বলেন 'গোরা' আসলে নিবেদিতার প্রতিরূপ। কিন্তু এই উপন্যাসেও কি কবিগুরু কোন সমাধানে আসতে পেরেছিলেন? শেষমেষ গিয়ে মানবধর্মে সমপর্ণ করেছেন সবাইকে। ম্রিয়মান ব্রাহ্মধর্মের যে দার্শনিক সংকীর্ণতা ছিল সেটাকে তিনি মানবধর্মের আলোতে এনে বুজিয়ে দিতে চাইলেন। বিবেকানন্দের মতাদর্শ ভারতের বুকে আছড়ে পড়াতে একদিকে যেমন গোঁড়া পুরোহিতকুলে ঘা লাগে তেমনি অপরদিকে হিন্দু-বিরোধী স্রোতগুলোতেও ভাটা পরে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, অন্যকে ছোট করে বড় হওয়া যাবে না, অপরের মুক্তিতেই আমাদের মুক্তি! বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আচার-বিচার-প্রথা-পুঁথি-পত্র এমনকি মন্দির-উপাসনালয়ও ধর্ম নয়- ধর্ম অনুভবের, ধর্ম আচরণের। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, জীবের সেবা-ই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ উপাসনা। এর চেয়ে বড় ধর্ম নেই! বিবেকানন্দ বলেছিলেন- আমাদের জনজীবনের বহু আচারই হতে পারে একদম অকেজো, তাই বলে তাকে লাথি মেরে দূরে সরাতে হবে না, সংস্কারের নামে মানুষকে আঘাত করা কেন? মানুষকে উপযুক্ত শিক্ষা দাও, তারাই বুঝতে পারবে তাদের করণীয় কি! বিবেকানন্দ বলেছিলেন- হিন্দু শুধু একটা ধর্ম নয়, এটা এখানকার ভৌগলিক সংস্কৃতির নাম! এটাকে ছুঁড়ে ফেলে কিছু করা যাবে না এই ভূমিতে। কেউ চাইলেও পারবে না! বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আমাদের অনেক ধর্ম হয়েছে, আমাদের এখন অন্ন চাই! আমাদের সবার আগে চাই স্বাধীনতা! আমাদের চাই শিল্প ও বিজ্ঞান! বিবেকানন্দ হিন্দুর চিরন্তন আদর্শের সাথে, হিন্দুর দর্শনের সাথে পাশ্চাত্যের ভাবনার সামঞ্জস্য করতে পেরেছিলেন। কবিগুরুর কথাতেও আমরা পেয়েছিলাম, তিনি বলছেন- রামমোহনের পর একমাত্রে বিবেকানন্দই পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে একটা সেতু হতে পেরেছিলেন!
বিবেকানন্দের এই সেতু হয়ে ওঠায় আমরা দেখেছি বহু পাশ্চাত্য নরনারীকে বেদান্তের আলোতে নিয়ে আসে, হিন্দু শিক্ষিত সমাজের ধর্ম বিমুখতাকে ভেঙে নতুন করে ভাবতে শেখায়, ব্রাহ্মদের যে হিন্দু-ধারা বিরোধী প্রচার তা একদম মুখ থুবরে পড়ে, খ্রীষ্টান মিশনারিদের ধর্মান্তরিতকরণের মহোৎসব নিষ্প্রাণ হয়ে যায়! দেশপ্রেম, মানবসেবা ও দর্শনের সাথে লোকপ্রথার এমন অভূতপূর্ব সমন্বয় বিবেকানন্দের আগে কারো ভেতর দেখা যায়নি। বিবেকানন্দের এই আবির্ভাব ব্রাহ্মসমাজকে সমাপ্ত করেছে না বলে বলা যায় আত্মস্থ করেছিল যা সে সময়ের ইতিহাস পড়লেই ভালভাবে বুঝতে পারবেন। আমার এই পোস্ট একটা প্রাইমারি স্কেচ। এতে ব্রাহ্মসমাজের উত্থান ও পতন নিয়ে কিছু ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। যাদের এই বিষয়ে আরও জানার আগ্রহ আছে তারা আশা করি নিজে থেকেই পড়াশোনা করে নেবেন আরও।
(c)
বিশাখদত্ত দত্ত
1 Comments:
ভালো লিখেছেন দাদা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন