মা সন্তোষী তুষ্টা হন সামান্য উপাচারেই। রাশি রাশি ভোগ মা কখনোই চান না। সামান্য ছোলা আর আঁখের গুড় মায়ের পূজায় প্রধান উপাদান। নিয়ম মতোন শুকনো ভাজা ছোলা আঁখের গুড়ের সাথে দিতে হয়। কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালী ভিজানো ছোলা, আঁখের গুড়ের সাথে মায়ের সামনে ভোগ নিবেদন করেন। সব মতই চলবে। যে, যেভাবে মায়ের পূজো করেন। পূজোর পর প্রসাদের অল্প অংশ গোমাতাকে প্রদান করতে হয়। তবে মা সন্তোষী পূজাতে টক বা অম্ল জাতীয় ফল বা কোন নৈবেদ্য প্রদান করা নিষিদ্ধ। সেজন্য মায়ের ব্রতকারিণী ও পূজারীগণ শুক্রবার টক জাতীয় ফল, ছানা, অম্বল ও টক পদার্থ বর্জন করেন। এমন কি ছানা থেকে প্রস্তুত কোন মিষ্টান্ন মায়ের ভোগে দেওয়া নিষেধ। নিমকি বানিয়ে চিনির রসে ডুবিয়ে কেবল মায়ের উদ্দেশ্যে মিষ্টি নিবেদন করা হয়। ১৬ শুক্রবার ধরে পূজা করার নিয়ম যথা বিধানে। এরপর উদযাপন করতে হয়। উদযাপনের দিন ৭ টি বালক কে ভোজন করিয়ে তাদের দক্ষিণা ও পান-কলা হাতে দিতে হয়। বালকদেরও ঐ শুক্রবার টক খাওয়া নিষেধ। এইভাবে যিনি সন্তোষী মাতার ব্রত পালন করেন - তিনি সর্ব সুখ প্রাপ্ত করেন।
ব্রতকথা
রামু নামক এক সরল সাধাসিধে লোক ছিল। সে বড় ছয় দাদার সাথে মাঠে কৃষিকাজ করত। বাড়ী ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বাড়ীর কর্তা ছিলেন এক বিধবা বৃদ্ধা মা। ফসল ঘরে তোলার পর ভাগ বাটোয়ারা করে যা উঠতো তাই সাত ভাই পেতো।
রামু ছিল বোকা ও সরল মনের। ভাইরা এমনকি ছয় বৌদি এর সুযোগ নিতো। মাঝে মাঝে বৌদিরা লুকিয়ে রামুকে এঁঠো-কাটা খেতে দিতো। সরল মনের রামু কিছুই বুঝতো না। একদা সাবিত্রী নামের এক সর্ব সুলক্ষণা কন্যার সাথে রামুর বিবাহ হল।
নতুন বৌ নিয়ে রামুর সুখে সংসার কাটছিল। একদিন সাবিত্রী জানতে পারলো বড় ছয় বৌদি রামুকে উচ্ছিষ্ট খেতে দেয়। রামু নিজেও এই দৃশ্য চোখে দেখলো। এই নিয়ে সে একদিন প্রতিবাদ করলো। এতে ছয় বৌদি আর ছয় দাদা মিলে রামুকে খুব অপমান করলো। রামু মনের দুঃখে প্রতিজ্ঞা করলো --‘যোগ্য মর্যাদা নিয়েই, কিছু করে সে এই বাড়ীতে বুক ফুলিয়ে আসবে।’ এই প্রতিজ্ঞা করে রামু গৃহত্যাগ করলো। তখন ছয় বৌদি আর ছয় দাদার রাগ গিয়ে পড়লো বেচারী সাবিত্রীর উপরে। সাবিত্রীকে ভীষন অত্যাচার শুরু করলো। সংসারের সব কাজ করাতে লাগলো।
দেখতে দেখতে সাবিত্রীর অঙ্গের লাবন্য মলিন হল। সন্ধ্যায় সে ঘরে আসতো। দুটি রুটি আর নারকেলের মালায় তে জল জুটতো তাঁর কপালে। একদিন সাবিত্রী জঙ্গলে কাঠ আনতে গিয়ে দেখে সেখানে দেবকন্যারা কি যেন ব্রত করছে। সাবিত্রী সব জিজ্ঞেস করলে দেবকন্যারা জানালো তারা মা সন্তোষীর ব্রত করছে। মায়ের কৃপায় সর্ব সুখ আসে। সাবিত্রী ভাবল সেও মা সন্তোষীর ব্রত করবে। দেবকন্যাদের কাছে নিয়ম শিখে ষোলো শুক্রবারের মা সন্তোষীর ব্রত শুরু করলো।
অপরদিকে রামু শহরে গিয়ে এক বড় স্বর্ণকারের দোকানে চাকরী পেয়েছিল। হঠাৎ তার বাড়ীর কথা, সাবিত্রীর কথা মনে পড়াতে বাড়ী ফিরতে চাইলো। স্বর্ণকার রামুকে অনেক ধন দৌলত দিয়ে বিদায় করলো। বাড়ী ফিরে রামু দেখে সাবিত্রীর দুর্দশা। রামু তাঁর ছয় দাদা, বৌদিকে খুব বকাঝকা করে সাবিত্রীকে নিয়ে অন্যত্র চলে গেলো। বিশাল বাড়ী বানিয়ে সাবিত্রীকে নিয়ে সুখে থাকতে লাগলো। একদা সাবিত্রী ভাবলেন মা সন্তোষীর উদযাপনে সকলকে নিমন্ত্রণ করবেন। প্রতিবেশী সবাইকে আমন্ত্রণ জানালো হল, ছয় দাদা, ছয় বৌদি, শাশুড়ীকে আমন্ত্রণ জানালো। ছয় বৌদির মধ্যে দুই বৌদি সাবিত্রীর সুখ ঐশ্বর্য দেখে হিংসায় জলতে লাগলো। তারা মায়ের প্রসাদে লেবুর রস দিয়ে দিলো। এতে মা খুব ক্ষিপ্তা হলেন। দুই বৌ বিকলাঙ্গ হয়ে গেলো। অবশেষে সাবিত্রীর কঠোর প্রার্থনায় মা সন্তোষী দুই বৌকে ভালো করে দিলেন। এই ভাবে সাবিত্রীর জীবনে সুখ নেমে আসল।
-
প্রত্যেক শুক্রবার তাঁর পূজা হয়। বাংলার ঘরে ঘরে এবং প্রতিটি নর-নারীর মুখে মুখে কলিযুগের সর্বদুঃখ বিনাশিনী দেবী মায়ের এই দেবীর আপার মহাত্ম্য ও অপরিসীম করুনা প্রচারিত। অগণিত ভক্তবৃন্দ সন্তোষীমাতার যশোগানে মুখরিত। জানি না, বাংলার মহাদুর্দিনের সন্ধিক্ষণে আমাদের অগণিত মা, ভাইবোন বন্ধুদের সর্বস্নেহময়ী সন্তোষী মায়ের কাছে বিনীত কি প্রার্থনা! তারা মায়ের কাছে কি চেয়েছেন আর মা কি দিয়েছেন -- এর সঠিক উত্তর তারাই দেবেন, যাঁরা মায়ের চরণে মনপ্রাণ উৎসর্গ করে তাঁর কৃপালাভে ধন্য হয়েছেন।
তবে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ভক্তের মুখে শোনা কথা যে, মা সাক্ষাৎ বলরুপিনী। মা তাঁর আরাধনায় আড়ম্বর চান না, তিনি চান ভক্তির পূজা। এক বিন্দু চোখের জল, ধান, দূর্বা ও ফুল, সাধ্যমত উপকরণ, গুড় আর ছোলা --- মা এতেই পরম তৃপ্তি লাভ করেন এবং ভক্তের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। তাই আজ অন্নাভাবে বহু দুঃখ জর্জরিত নর-নারী এই পরমা ঈশ্বরী দেবীর কাছে তাঁদের দুঃখ-দুদর্শা লাঘবের জন্য ব্যাকুল প্রার্থনা জানান। প্রতি শুক্রবারে আমাদের সতী সাধ্বী মা-বোনেরা ঘরে ঘরে সন্তোষী মায়ের ছবি ও ঘট স্থাপন করে বিশুদ্ধ ভাবে পূজার আয়োজন করে থাকেন এবং টক জাতীয় খাবার বর্জন করেন। সর্বসিদ্ধিদাত্রী এই মায়ের পূজায় সকল দেব-দেবী তুষ্ট হয়ে থাকেন। অনেকেই এই পুজায় সুফল পেয়েছেন। মনোকষ্ট, অর্থকষ্ট, বাধা-বিঘ্ন, দাম্পত্য জীবনের কলহ বা অশান্তি, গ্রহদোষ, পুনর্জীবন লাভ করতে এই দেবীর পূজা কর অবশ্য কর্তব্য। মা সন্তোষী যে কোন অশুভ ভাব দূর করেন এবং তার বরাভয় বা আশীর্বাদ প্রদান করেন।
হিংসা, লোভ, লালসা, রাগ, নেশা, নির্যাতন থেকে বিরত থেকে আসুন আমরা সবাই সন্তোষীমাতার ধ্যানে মগ্ন হই। আসুন, কালবিলম্ব না করে আমরা সকলেই তাঁর চরণে প্রণাম জানিয়ে মাতৃপূজায় জীবন উৎসর্গ করে মানবজীবন সার্থক করি।
লিখেছেনঃ Prithwish Ghosh
1 Comments:
মায়ের পুজায় টক কি কারণে বর্জনীয় একটু বুজিয়ে বলবেন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন