১৫ নভেম্বর ২০১৩

“মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ”- শ্রী জয় রায় (Part 3)


পর্ব (১-): http://sonatonvabona.blogspot.com/2013/11/blog-post_14.html





মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ (পর্ব )
-----------------------------
রাজনীতিতে চিরকালীন বন্ধু বলেও কিছু নেই, চিরকালীন শত্রু বলেও কিছু নেই- এই কথাটি আমরা সকলেই জানিএখানে, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা দুটোই সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক প্রয়োজনে। কিন্তু, মহাভারতের আত্মীয় রাজনীতির মধ্য সবকিছুই অন্যরকম। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণই এখানে দক্ষ রাজনীতিজ্ঞ, যাকে বিশ্লেষণ করা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

মহাভারতে বীরযোদ্ধা ও দক্ষ রাজনীতি বিশারদ হিসেবে যাদব-বংশের বেশ সুনাম ছিল। যাদবদের এই বল ও বুদ্ধির সমন্বয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গড়ে তোলেন নারায়ণী সেনা। প্রাগজ্যোতিষপুর, গান্ধার ও উত্তর ভারতের শক্তিশালি রাজ্য মগধ সহ অন্যান্য প্রদেশে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই নারায়ণী সেনা ব্যবহার করেছেন। প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্যবিশিষ্ট এই নারায়ণী সেনার প্রধান প্রধান যোদ্ধারা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, সাত্যকি, চেকিতান, কৃতবর্মা, শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব প্রমুখ। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় যেসকল রাজা যুধিষ্ঠিরের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করেছে; শ্রীকৃষ্ণের নারায়ণী সেনার সাহায্য নিয়েই যুধিষ্ঠির তাদের পরাজিত করে।



কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুর্যোধনের প্রচণ্ড ভয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের এই নারায়ণী সেনা নিয়ে। কারণ দুর্যোধন জানতেন, কৌরবদের ধ্বংস করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে শ্রীকৃষ্ণের এই নারায়ণী সেনাই যথেষ্ট। তাই শকুনির পরামর্শে দুর্যোধন সৈন্য সংগ্রহে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আসে। একই সময়ে অর্জুনও সেখানে উপস্থিত হয়। শ্রীকৃষ্ণ উভয়কেই আপ্যায়ন করে তাঁদের উদ্দেশ্য জানতে চায়। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, আমি নিরস্ত্র হয়ে এক পক্ষে যাবো, আর আমার শক্তিশালী নারায়ণী সৈন্য যারা বিক্রমে প্রত্যেকে আমার সমতুল, তারা অপরপক্ষে যুদ্ধ করবে। অর্জুনকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করায় অর্জুন স্বয়ং নারায়ণকেই (শ্রীকৃষ্ণ) স্বপক্ষে বরণ করে আর কপট দুর্যোধন অত্যন্ত আনন্দিত হয় নারায়ণী সৈন্যর প্রতিশ্রুতি পেয়ে।


শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, যার লীলা বোঝা দায়। মহাভারতে আত্মীয়তার দিক থেকে পাণ্ডবরা শ্রীকৃষ্ণের যতটা কাছের, ঠিক ততটাই কাছের দুর্যোধনের দিক থেকে। পাণ্ডবরা ছিল শ্রীকৃষ্ণের পিসতুতো ভাই আর দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণা ছিল শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্বের স্ত্রীমনুষ্যদেহ ধারন করে এই পৃথিবীতে এসে শ্রীকৃষ্ণ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে প্রতিমুহূর্তে  নিজের কর্তব্য পালন করে গেছেন। তাই নিজেদের মধ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে শ্রীকৃষ্ণ অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, তারপরেও যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে, কৌরব ও পাণ্ডব দুই পক্ষই শ্রীকৃষ্ণের সাহায্য চাইলে তিনি কাউকেও অখুশি করেন নি।    


কিন্তু, ধৃতরাষ্ট্রের ১০০ সন্তান কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নারায়ণী সেনাকে নেতৃত্ব দিলেও, পঞ্চ-পাণ্ডবের সামনে তারা ছিল তুচ্ছ। কারণ, নিজে যুদ্ধ না করলেও পঞ্চ-পাণ্ডবদের নেতৃত্ব দিয়েছেন দক্ষ রাজনীতিজ্ঞ ও বীর যোদ্ধা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। স্বয়ং নারায়ন যার পক্ষে, তাঁর কাছে সকল বাঁধাই তুচ্ছ.....

 

(পর্ব ১০)
-----------------------------
শুরু হয় ধর্মযুদ্ধ; যার ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৮ দিন। পাণ্ডবরা কুরুক্ষেত্রের (বর্তমান ভারতের হরিয়ানা রাজ্য) পশ্চিমভাগে সসৈন্যে পূর্বমুখ হয়ে অবস্থান করলো। দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ছিল পাণ্ডবদের সেনাপতি। অন্যদিকে, যুদ্ধের ১ম থেকে ১০ম দিন পর্যন্ত কৌরবদের সেনাপতি ছিল ভীষ্ম; ১১-১৫তম দিন পর্যন্ত দ্রোণ, ১৬-১৭তম দিন পর্যন্ত কর্ণ, ১৮তম দিনে সেনাপতি ছিল শল্য (মাদ্রীর ভাই) ও অশ্বত্থামা (দ্রোণের পুত্র)           


মহাযুদ্ধের শুরুতেই অর্জুন হঠাৎ করে, আমি যুদ্ধ করবো না এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ধনুক-বাণ ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণের পায়ের কাছে বসে পড়লো। অর্জুন বললো, আমি ভিক্ষাবৃত্তি করে খাবো, তবুও এই গুরুজনদের মারতে পারবো না। কেমন করে এই পিতামহ ভীষ্মের শরীরে শরাঘাত করবো? সবাই তো আমার ভাই, বন্ধু-পিতার মতো আত্মীয়-স্বজন এদের আমি কিভাবে মারবো? এই পাপ আমি করতে পারবো না!

এখান থেকেই শুরু হয় শ্রীশ্রী গীতার প্রথম অধ্যায়- অর্জুনবিষাদ যোগঅর্জুনের ক্লীবত্ব দূর করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে গীতার অগ্নিবানী শুনিয়ে মোহমুক্ত করলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, কে কাকে মারে অর্জুন। দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথসহ ধৃতরাষ্ট্রের ১০০ পুত্র তাদের সবাইকে আমিই মেরে রেখেছি, তুমি নিমিত্তমাত্র হও।


তাই, গীতায় অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন "দেখ অর্জুন, কর্মেই তোমার অধিকার কর্মফলে নয় পাপ-পুণ্যের বিচার না করে তুমি তোমার কর্ম করে যাও। হৃদয়ের তুচ্ছ দুর্বলতা ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বুঝিয়ে দিলেন, এই যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ। অতএব, ক্ষত্রিয় হয়ে এই যুদ্ধ না করাটাই অর্জুনের অন্যায় পাপ হবে।


সত্যিকার অর্থেই পাপপুণ্যের হিসাব করা আমাদের মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আর সেজন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মাধ্যমে মানব সমাজকে সমস্ত কর্মফলের চিন্তা ত্যাগ করে  শুধুমাত্র  নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী কর্ম করার উপদেশ দিয়েছেন। গীতার মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, “আমাদের অধিকার শুধু মাত্র কর্মে। কিন্তু সেই কর্মের হিসাব চিন্তা করে কোনটা পাপ বা কোনটা পুণ্য এই বিচার করার সামর্থ্য মানুষের নেই পাপ- পুণ্যের বিচার করতে গিয়ে আমরা যদি আমাদের কর্মকে ত্যাগ করি, তবে সেটাই হবে সবথেকে বড় অধর্ম।”



কুরুক্ষেত্রের সেই রণভুমিতে অর্জুনকে দেওয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই মুখ নিঃসৃত বানীই হচ্ছে শ্রীমদ্ভগবদগীতা"ই গীতাই আমাদের আর্য হিন্দু জাতির অহংকার, আমাদের গর্ব; যা সার্বলৌকিক, সার্বকালিক ধর্মগ্রন্থ।

গবদগীতা সম্পর্কে খুব সুন্দর একটি কথা প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, আমাদের এই দেহ হচ্ছে রথ, রথী অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ সারথি, ইন্দ্রিয়গণ হচ্ছে রথের ঘোড়া ও এই রথের লাগাম হচ্ছে আমাদের মন। কুরুক্ষেত্ররূপ এই সংসারে আমাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। দৈবী (শুভ) ও আসুরী (অশুভ) বৃত্তি হচ্ছে দুই পক্ষ। সেই যুদ্ধে যাতে শুভ শক্তি জয় লাভ করে সেইজন্য ভগবান সারথি হয়ে অনুভবসিদ্ধ জ্ঞান আমাদের দিয়ে যাচ্ছে।

মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, সত্য অপেক্ষা আর কিছু শ্রেষ্ঠ নেই। কিন্তু, সত্য নির্ণয় করা অনেক কঠিন। তাই, সংসার জীবনে মিথ্যা মায়ার পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলে চলবে না। ঈশ্বরের কৃপা নিয়েই সত্যর অনুসন্ধান করে অন্যায়কে ধ্বংস করতে হবে......


(পর্ব )
-----------------------------
মহাভারতের এক মহান আদর্শ চরিত্র ভীষ্ম। মহারাজ শান্তনু ও গঙ্গাদেবীর পুত্র ভীষ্ম ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বীর, মহাপ্রাজ্ঞ, সর্বত্যাগী ও জিতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ। ভীষ্ম পূর্বজন্মে ছিলেন অষ্ট বসুদের একজন হোমধেনু অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন বলে বশিষ্ঠের শাপে তিনি রাজা শান্তনু এবং দেবী গঙ্গা পুত্র হয় জন্মানযুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় ভীষ্মই সকলের সামনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য তুলে ধরে শ্রীকৃষ্ণ পূজার প্রবর্তন করেন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ১ম থেকে ১০ম দিন পর্যন্ত কৌরবদের সেনাপতি ছিল ভীষ্ম। যুদ্ধের তৃতীয় দিনে ভীষ্মের প্রচণ্ড প্রতাপে পাণ্ডবসৈন্যরা ভীত হয়ে পড়ে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রথ নিয়ে ভীষ্মের সামনে এগিয়ে আসে। কিন্তু, অর্জুন পিতামহ ভীষ্মের সাথে যুদ্ধ করতে অনীহা দেখায়। পাণ্ডবদের শোচনীয় অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথ থেকে নেমে পড়েন।


প্রচণ্ড ক্রোধে রথের চাকা তুলে নিয়ে ভীষ্মের দিকে এগিয়ে যায় শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু, ভীষ্ম অবিচলভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষ্ম জানতেন যে, স্বয়ং ভগবানের হাতে নিহত হলে তাঁর জীবন ধন্য। কিন্তু, অর্জুনের অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সংযত করেন।

ভীষ্মকে বধ করতে না পারলে যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় সম্ভব নয়, শ্রীকৃষ্ণ এটা জানতেন। তাই, শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে, কিভাবে ভীষ্মকে পরাজিত করা যায়-এটা জানতে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে যায় ভীষ্ম একান্ত নির্ভয়ে স্বেচ্ছায় বলে দেয় নিজের মৃত্যুর রহস্য। শান্তিস্থাপন ও ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় এইভাবেই নিজের জীবনকে স্বেচ্ছায় বলি দেয় ভীষ্ম।

পরবর্তীতে যুদ্ধের ১০ম দিনে ভীষ্মের কথামতো শিখণ্ডীকে সামনে রেখে যুদ্ধ করে অর্জুন। যুদ্ধক্ষেত্রে শিখণ্ডীকে দেখে অস্ত্রত্যাগ করে ভীষ্ম। অর্জুনের তীরে তিনি এমনভাবে বিদ্ধ হলেন যে, তাঁর শরীরে দুই আঙুল পরিমাণ স্থানও অবিদীর্ণ ছিল না। কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে শরশয্যায় শায়িত হলো ভীষ্ম। কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে যখন ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত হয় তখন ছিল দক্ষিণায়নকিন্তু, উত্তরায়ণ ছিল মৃত্যুর জন্য শুভ সময়তাই, ইচ্ছা মৃত্যুর বরে ভীষ্ম উত্তরায়ণ পর্যন্ত প্রতীক্ষা করে থাকে

তাঁর শরশয্যার ২৮ দিন পর অর্থাৎ ২৯তম দিনে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে যায়তখন, ভীষ্মের মৃত্যুর ৩০ দিন বাকি ছিলপরবর্তী ৩০ দিনে (শান্তিপর্বের ৫৬তম অধ্যায় থেকে অনুশাসন পর্বের ১৬৭তম অধ্যায়) দেহত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেয় ভীষ্মঅবশেষে শরশয্যার ৫৮ দিন পরে মাঘের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভীষ্ম দেহত্যাগ করেন        

মহাভারতে পিতৃভক্ত ভীষ্মের কঠোর প্রতিজ্ঞার জন্য এখনও আমরা সবাই ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা বলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ভীষ্মের তিরোধান তিথিতে (ভীষ্মাষ্টমী) আমরা হিন্দুরা তাঁর নামে তর্পণ করে থাকি। যা ভীষ্মতর্পণ নামে পরিচিত।


মহাভারতের রাজসূয় যজ্ঞে ভীষ্মই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব ঘোষণা করেছে। বীরভক্ত ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নির্ভয়ে শ্রীকৃষ্ণের আঘাতে মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলভীষ্মের আদর্শ, ত্যাগ, ধর্মের প্রতি ভালোবাসা এবং কৃষ্ণভক্তি আমাদের অনুপ্রাণিত করেভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে তাঁকে যে মর্যাদা দিয়েছেন সেটাই তাঁর পরম গৌরব। আমাদের মত মৃত্যুভয়ে জর্জরিত মানুষ কি ভীষ্মের অমর জীবনের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে সমর্থ?? আপনারাই তার বিচার করে দেখুন......

(পর্ব ১)
-----------------------------
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের শরশয্যা পর একাদশ দিনে কৌরবদের সেনাপতি হয় দ্রোণ।
যুদ্ধের ১৫তম দিনে অস্ত্রগুরু দ্রোণ দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে দ্রুপদ ও বিরাটকে বধ করে। পাণ্ডব শিবিরে শোকের ছায়া নেমে আসে। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরামর্শ দিলেন যে, “যেকোন উপায়ে দ্রোণকে অস্ত্র ত্যাগ করাতেই হবে।” সেই মুহূর্তে ভীম গদার আঘাতে “অশ্বত্থামা” নামে একটি হাতি বধ করে। পরবর্তীতে, যুধিষ্ঠির দ্রোণের কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, -“অশ্বত্থামা হতঃ”; তারপর অস্পষ্টভাবে বললেন, -“ইতি গজঃ”।


সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের মুখে এই কথা শুনে দ্রোণ ভাবলো যে, তাঁর নিজ পুত্র অশ্বত্থামা যুদ্ধে নিহত হয়েছে। পুত্রশোকে অধীর হয়ে দ্রোণ অস্ত্রত্যাগ করে। তখনি, পাণ্ডবদের সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের শিরচ্ছেদ করে তাঁকে বধ করে।  



কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে ভীষ্ম ও দ্রোণ অধর্মের পক্ষে যোগ দিলেও পাণ্ডবদের প্রতিই ছিল তাদের অন্তরের টান। যুদ্ধ করেছে অধর্মের পক্ষে, কিন্তু মনে মনে উভয়েই পাণ্ডবদের জয় প্রার্থনা করেছে।


ভীষ্মের শরশয্যা ও দ্রোণের শিরচ্ছেদ- এই দুটি ঘটনা কৌরবদের দুর্ভাগ্যকে তরান্বিত করে। শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধিবলেই এই দুই মহাবীরের পতন নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে, অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর মৃত্যুতে পাণ্ডবশিবিরে শোক নেমে আসে। অর্জুন প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে পড়ে। শ্রীকৃষ্ণের সাথে কোন পরামর্শ না করেই অর্জুন প্রতিজ্ঞা করে, “পরের দিন সূর্যাস্তের পূর্বেই জয়দ্রথ(ধৃতরাষ্ট্রের মেয়ে দুঃশলার স্বামী) কে বধ করতে না পারলে আগুনে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিবে এই ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা শ্রীকৃষ্ণকে অত্যন্ত চিন্তিত করে। পরবর্তীতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধি ও যোগশক্তিতে অর্জুন তাঁর প্রতিজ্ঞা পূরণে সক্ষম হয়।


দ্রোণাচার্যের শিরচ্ছেদের পর ক্রুদ্ধ অশ্বত্থামা পাণ্ডবসৈন্য বিনাশের জন্য নারায়ন অস্ত্র নিক্ষেপ করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঐ অস্ত্রকে ব্যর্থ করার উপায় জানতেন, সেটা হলো- অস্ত্র ত্যাগ করে রথ থেকে নেমে যাওয়া। শ্রীকৃষ্ণের আদেশে সকল পাণ্ডবসৈন্য অস্ত্রহীন হয়ে রথ থেকে নেমে যাওয়ায় বেঁচে যায়।


গীতার ১৮তম অধ্যায়ের ৬৬ তম শ্লোক আমরা সকলেই পড়েছি। সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, “সকল ধর্মকে অর্থাৎ সকল কর্তব্যকর্মকে আমাতে ত্যাগ করে তুমি কেবল সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর আমার স্মরণ নাও। আমি তোমাকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করে দেব। তুমি শোক করো না।”


পাণ্ডবরা নিজ স্বজনদের সাথে যুদ্ধ করতে ইতস্তত বোধ করলেও, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে তাঁরা নিঃসঙ্কোচে যুদ্ধ করেছেএইভাবে ভগবানের আদেশ পালন করাই হচ্ছে “ভগবৎ শরণাগতি” আর ভগবানের আদেশের সম্মুখে অন্য কোন ধর্ম না মানাই হচ্ছে “সর্বধর্ম পরিত্যাগ।” তাই মহাভারতে একটি কথা বার বার বলা হয়েছে যে, “ধর্মযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজনবোধে অন্যায় করলেও কোন পাপ হয় না।”

(পর্ব ১
-----------------------------
দ্রোণকে বধ করার পর কৌরবদের সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয় কর্ণকে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ১৭তম দিনে কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধ হয়। অর্জুনের সাথে যুদ্ধের সময় কর্ণের রথের চাকা বসে যায়। কর্ণ নিরুপায় হয়ে অর্জুনকে ধর্মের নামে যুদ্ধ বিরতির জন্য অনুরোধ করে। তখন অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে বললো, জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনার সময় তোমার এই ধর্ম কোথায় ছিল, কর্ণ? অস্ত্রহীন বালক অভিমুন্যর উপর তীরবর্ষণের সময় তোমার ধর্মের কথা মনে পড়ে নি?? তাই, আজ ধর্ম ধর্ম বলে চিৎকার করলেও ধর্ম তোমাকে রক্ষা করবে না, কর্ণ। অবশেষে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুন কর্ণকে বধ করে।



কর্ণ ছিল দুর্যোধনের সবথেকে বিশ্বস্ত বন্ধু ও সেনাপতি। দুর্যোধন তাঁর কোন ভাইয়ের মৃত্যুতে শোক করেনি, কিন্তু কর্ণের মৃত্যুতে সব থেকে বেশি শোক করে।


মহাভারতে কর্ণ চরিত্রটি দ্বিমুখী। কর্ণের বীরত্বের সঙ্গে ছিল দম্ভ, অহংকার আত্মভিমান। নিজের দম্ভ অহংকারের জন্যই তিনি অন্যদের কাছ থেকে সন্মান পায় নি। তাই, “সুতপুত্র (সারথির পুত্র) বলেই যে সবাই কর্ণের প্রতি অবিচার করেছে”- এটা ভাবা কখনোই ঠিক না। কারণ, ধৃতরাষ্ট্রের সারথি সঞ্জয়ও কিন্তু সুতপুত্র ছিল। বিদুর নিজেও দাসীর সন্তান ছিল। অথচ, সঞ্জয় বিদুর দুইজনেই নিজেদের চরিত্রবলে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। সুতপুত্র বা দাসীর সন্তান বলে কেউ তাদের প্রতি কখনোই অত্যাচার বা অবিচার করে নি

কিন্তু, কর্ণ নিজের স্বার্থের জন্য অর্থাৎ অর্জুনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শ্রেষ্ঠ বীরের সম্মানলাভের জন্যই নিজের সকল প্রতিভাকে স্বার্থপরায়ণ ও নীচ দুর্যোধনের কাছে উৎসর্গ করেছিলো। নিজের অদম্য উচ্চ আকাঙ্খার জন্যই কর্ণ পরশুরামের নিকট মিথ্যা বলে অস্ত্রবিদ্যা লাভ করে। তাই, গুরুভক্তি থাকা সত্ত্বেও পরশুরাম কর্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।    

 বীরত্ব আর মহত্ত্ব এক নয়। মহৎ জীবনের অধিকারী হতে গেলে সাধনা ঈশ্বরের কৃপা প্রয়োজন। ধর্মের চর্চা আমরা সবাই করি, কিন্তু প্রকৃত ধর্মের তত্ত্ব সবাই উপলব্ধি করতে পারি না। সারা জীবন ধর্মচর্চা করলেও কর্ণ ছিল অধর্মের সহায়ক। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনেক চেষ্টা করেও কর্ণকে ধর্মপথে আনতে পারে নি। তাই, ধর্মযুদ্ধে কর্ণের পরাজয় অনিবার্য ছিল।                

  
সুতরাং মহাভারতের কর্ণ চরিত্র থেকে আমরা একটি শিক্ষাই নিতে পারি, সেটা হচ্ছে- “সকল দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও  নিজের সন্মানের জন্য আমাদের ধর্ম পথে থেকেই সাধনা করতে হবে। তবুও অধর্মের সঙ্গ দেওয়া উচিত নয়। নিজের অধিকারের জন্য অবশ্যই সংগ্রাম করা উচিত, কিন্তু যার উপর আমাদের অধিকার নেই তাঁর আকাঙ্ক্ষা কখনোই করা উচিত না।

 (To be Continue….)    


# শ্রী জয় রায়,
সনাতন ভাবনা সংস্কৃতি

এই ধারাবাহিকের শেষ অংশ পড়ুনঃ 
http://sonatonvabona.blogspot.com/2013/11/blog-post_15.html
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।