-----------------------------
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যতিত আমাদের হিন্দুদের জীবন অন্ধকারে
পরিপূর্ণ। কারণ, আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে শ্রীকৃষ্ণ
চরিত্র!
মহাভারতের আদিপর্বেই বেদব্যাস শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষ ও
ভগবান বলে চিহ্নিত করেছেন। আমরা অনেকেই জানি যে, সম্পর্কের দিক থেকে পঞ্চপাণ্ডবের
মাতা কুন্তী ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পিসী। মহাভারতে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় বলরামের
সাথে আমরা শ্রীকৃষ্ণকে প্রথম দেখি। তিনি ছিলেন অর্জুনের সমবয়স্ক। শ্রীকৃষ্ণের
চরিত্র ও তাঁর দূরদৃষ্টিকে জানতে হলে মহাভারতে তাঁর সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে
সেগুলো আমাদের সঠিক ভাবে জানতে হবে।
সেসময় বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের রাজন্যবৃন্দ
পারস্পারিক দ্বন্দ্বে মত্ত থেকে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যপ্রয়াসকে করেছিলেন
সুদূরপরাহত। সার্বভম সর্বভারতীয় এক রাষ্ট্রগঠনের মনোভাব বা দূরদর্শিতা তাদের ছিল
না। বলা হয়ে থাকে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভারতে একটি দৃঢ় রাষ্ট্রবাবস্থা প্রবর্তন
করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে যুধিষ্ঠিরই ছিলেন সেই প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের কর্ণধার
হওয়ার পক্ষে সবদিক থেকে উপযুক্ত ব্যক্তি। দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষনতার জন্য
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ।
স্বীয় মর্যাদাবোধের অহমিকায় আচ্ছন্ন না থেকে শ্রীকৃষ্ণ সর্বদা সামাজিক কর্তব্যবোধকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যার উদাহরন হচ্ছে, “শ্রীকৃষ্ণ রাজসূয় যজ্ঞে নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন।”
আজ ধর্ম-সাম্রাজ্য-সংগঠক শ্রীকৃষ্ণের কর্মপ্রতিভা ও
কীর্তিকলাপের স্মৃতিগুলি বিসর্জন দিয়ে তাঁকে শুধুমাত্র বৃন্দাবনের ভাবসাধনার
প্রতিমায় সাজিয়ে বসনচোরা, গোপীচোরা হিসেবেই বেশি প্রচার করা হয়।
আর্য হিন্দুজাতির সংস্কারক, ধর্ম সাম্রাজ্য সংগঠক শ্রীকৃষ্ণের
জীবনের যথার্থ ও ঐতিহাসিক কীর্তিকলাপের প্রচারের একটি অংশ হিসেবে শুরু হল
এই ধারাবাহিক লেখা; যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও চরিত্রের সকল বিকৃতি দূর করে
সমগ্র হিন্দু জাতির আরাধ্য আদর্শ, হিন্দু ধর্মের ও জাতীয়তার পরিপূর্ণ বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণকে
সঠিকভাবে তুলে ধরা হবে......
(পর্ব ২)
-----------------------------------
মহাভারতের সময় বিশাল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঐক্য ও ধর্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ ভারতে একটি দৃঢ় রাষ্ট্রবাবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে
যুধিষ্ঠিরই ছিলেন সেই প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের কর্ণধার হওয়ার পক্ষে সবদিক থেকে
উপযুক্ত ব্যক্তি।
কিন্তু, সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন শক্তি বৃদ্ধি করা। কারণ,
অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি বা “মিলিটারিজম” ক্ষমতা থাকলে বন্ধু কতটা জোটে, তা আমরা
রাশিয়া কিংবা বর্তমান আমেরিকা-চীনকে দেখে বুঝতে পারি।
তাই, এই শক্তি বৃদ্ধির জন্যই ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হবার পর রাজসূয় যজ্ঞের
জন্য শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ চেয়েছিল যুধিষ্ঠির। শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন
যে, ভারতের প্রতাপশালী রাজা জরাসন্ধকে পরাজিত করতে না পারলে রাজসূয় যজ্ঞ করার
অধিকারী হবেন না যুধিষ্ঠির। কারণ, সেই সময় ভারতবর্ষে বড় বড় বংশে জন্মানো
যত রাজা ছিল, তাঁরা সকলেই জরাসন্ধের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
“এই জরাসন্ধ কে ছিল বা তৎকালীন ভারতবর্ষে
তাঁর প্রভাব কতটুকু বিস্তার লাভ করেছিল” আজ আমি আপনাদের সামনে সেই তথ্যই বিস্তারিতভাবে
তুলে ধরবো।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখনও আবির্ভূত হন নি। মথুরায় তখন কূলতন্ত্রের শাসন চলছে এবং
প্রশাসনিক রাজপদে অভিষিক্ত আছেন উগ্রসেন। কৃষ্ণপিতা বসুদেব কুলপ্রধানদের অন্যতম, তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধিও যথেষ্ট এবং উগ্রসেনের ছেলে কংসের প্রায় সমবয়সি। উগ্রসেন
বেঁচে থাকতেই কংস ক্ষমতালোভী হয়ে পড়েন এবং তাঁর লোভ আরও বেড়ে যায় মগধরাজ জরাসন্ধের
সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ায়। জরাসন্ধ নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্যই কংসকে মদত দিতে
থাকেন এবং কংসকে হাতের পুতুল বানিয়ে রাখার জন্য নিজের দুই মেয়ে অস্তি এবং প্রাপ্তির
সঙ্গে কংসের বিয়ে দেয়। ফলে, কংস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং শ্বশুর জরাসন্ধের বুদ্ধিতে
নিজ পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে।
এদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতা বসুদেব দেবকীকে বিয়ে করার আগে হস্তিনাপুরের তৎকালীন
সম্রাট শান্তনুর ভাই বাহ্লীকের মেয়ে রোহিণীকে বিয়ে করে। আমরা জানি যে, এই মাতা রোহিণীর গর্ভেই বলরাম ও সুভদ্রার জন্ম হয়েছিলো।
পরবর্তীতে কৃষ্ণপিতা বসুদেব উগ্রসেনের ভাই দেবকের মেয়ে দেবকীকে বিয়ে করে। আর, এই দেবকীর গর্ভেই মনুষ্যরূপ ধারণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন।
(পর্ব ৩)
-----------------------------------
শ্বশুর
জরাসন্ধের জোর দেখিয়ে কংসের অত্যাচার যখন চরমে উঠলো; তখন শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করে। কংস মারা যাবার পরে মথুরাবাসী একটা বড় অত্যাচার থেকে মুক্তি পেল; কিন্তু তাঁরা এবার আরও বড় আক্রমণের মুখে পড়ে গেলেন। কংসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই স্ত্রী বাপের বাড়ি গিয়ে পিতা জরাসন্ধকে উত্তেজিত করলেন পতিহত্যাকারী শ্রীকৃষ্ণকে চরম দণ্ড দেওয়ার জন্য। কিন্তু, জরাসন্ধ বার বার মথুরা আক্রমণ করেও, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে পরাজিত করতে পারে নি।
মহাভারতের সময়ে কুরুবংশ, মদ্রবংশ, দ্রুপদ, ভীষ্মক (ভোজ বংশের অধিপতি),
শিশুপাল, পৌন্ড্র-বাসুদেব, সিন্ধুরাজ বৃদ্ধক্ষত্র এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম
(যাদবকুল ও বৃষ্ণিবংশ) এঁরাই ছিল সবথেকে শক্তিশালী রাজা।
এদের মধ্য জরাসন্ধ ছিল ক্ষত্রিয় বিরোধী। যিনি ৮৬ জন রাজাকে বন্দী করে রেখেছিলো; ১০০ জন পূর্ণ
হলেই তিনি তাদের বলি দিতেন। মগধরাজ জরাসন্ধের নিজেরই ছিল বিশ অক্ষৌহিনী সৈন্য। তাঁর ভয়ে ভীত হয়ে বহু
রাজা উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে পালিয়ে যায়। চেদিরাজ শিশুপাল জরাসন্ধের
সেনাপতি।
সেসময় বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশের নাম ছিল পুন্ড্রবর্ধন;
যার রাজা ছিল পৌন্ড্র-বাসুদেব (যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতই চক্রক্ষেপণ করতে পারে
বলে নিজেই “বাসুদেব” উপাধি ধারণ করেছিলো)। এই পৌন্ড্র-বাসুদেব ছিল শ্রীকৃষ্ণ
বিরোধী। এদের সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রতাপশালী বীর ভীষ্মক; যার মেয়ে রুক্মিণীকে ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ বিয়ে করেছিলেন।
আমরা সকলেই জানি যে, “শান্তিস্থাপন ও ধর্মরাজ্য সংস্থাপন”- এই দুই কাজ
করতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। যুদ্ধমত্ত অধার্মিক শক্তিকে ধ্বংস করে নতুনভাবে
যুধিষ্ঠিরের মত শান্তিকামী ও ধার্মিক রাজাকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আর সেজন্যই, রাজসূয় যজ্ঞের মাধ্যমে অধার্মিক জরাসন্ধকে বধ করার
দায়িত্ব দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের হাতে। এটাই ছিল ধর্মরাজ্য প্রবর্তনের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রথম প্রয়াস।
(পর্ব ৪)
-----------------------------------
মহাভারতের কাহিনী পর্যালোচনা করলে একটি জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্ট যে,“
রাজ্য ও ক্ষমতার লালসা এমনই এক বিচিত্র স্বভাব তৈরি করে, যেখানে
স্নেহ,আত্মীয়-স্বজন বা বৈবাহিক সম্পর্ক- কোন কিছুরই দাম থাকে না।”
যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বিদর্ভ এর রাজা ভীষ্মক। যার মেয়ে রুক্মিণীকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিয়ে করে। মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণীর এই বিয়ের মধ্য একটা রাজনৈতিক অভিসন্ধি কাজ করেছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রুক্মিণীর ভালোবাসা হয়তো এখানে প্রধান প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছে কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বিবাহের বাড়তি ফলটা ভেবেছিলো তাঁর অনুকূলে ফলবে। কিন্তু, সেটা ঘটেনি।
ভীষ্মকের
মেয়ে রুক্মিণীকে বিয়ে করে শ্রীকৃষ্ণ ভেবেছিলেন, -
মেয়ের জন্যই বৈবাহিক কারণে ভীষ্মক শ্রীকৃষ্ণের অনুকূলে আচরণ করবে। অর্থ্যাৎ এই বিবাহের মাধ্যমে যাদব ও বিদর্ভের মধ্য একটি
সুসম্পর্ক স্থাপিত হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটা হয় নি।
কারণ, ভীষ্মক চেয়েছিল তাঁর মেয়ে রুক্মিণীকে
নিজের অনুগত শিষ্য জরাসন্ধের সেনাপতি ‘শিশুপালে’র সাথে বিয়ে দিতে। অন্যদিকে,
ভীষ্মকের ছেলে রুক্মী ছিল শিশুপালের অন্ধ সমর্থক। এই অবস্থায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
সুকৌশলে রুক্মিণীকে বিয়ের আগের দিন বিদর্ভ থেকে হরণ করে দ্বারকায় নিয়ে যায় এবং
সেখানে রুক্মিণীর ইচ্ছায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাদের বিয়ে হয়।
বিবাহসভায় জরাসন্ধ-শিশুপালের এই অপমান
ভীষ্মককে সহ্য করতে হয় এবং এই ঘটনায় ভীষ্মক আরও ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু, ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ ভেবেছিলেন- এই ক্ষোভ সাময়িকভাবে থাকবে এবং মেয়ের প্রতি স্নেহবশতই
ভীষ্মকের কৃষ্ণ-বিরোধিতা কমে আসবে ও জরাসন্ধের সাথে ভীষ্মকের দূরত্ব বাড়বে।
কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি।
একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট যে, “মহাভারতে
কুরু-পাণ্ডবের জ্ঞাতি রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে এতদিন ধরে মগধরাজ জরাসন্ধকে
কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার নিয়ন্ত্রণ
নিতে চাইছেন নিজের হাতে।”
আর সেজন্যই, যতক্ষণ না অধার্মিক জরাসন্ধকে
শেষ করা যাচ্ছে; ততক্ষন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের ফলপ্রাপ্তি অসম্ভব। আজ এখানেই
শেষ করছি। মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমা সম্পর্কে আরও জানতে অবশ্যই চোখ রাখুন
পরবর্তী পর্বে...
# শ্রী জয় রায়,
সনাতন
ভাবনা ও সংস্কৃতি
এই লেখার পরবর্তী পর্বগুলো পড়ুনঃ
এই লেখার পরবর্তী পর্বগুলো পড়ুনঃ
2 Comments:
bes sundor alochona
ভালো লাগল পড়ে
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন