দীপাবলি- আলোর উৎসব; প্রতি বছরই দুর্গাপূজার আনন্দ-উচ্ছাস মিইয়ে যাবার আগেই দীপাবলি আসে। বিজয়ার ভাসানে- পাঁচদিনের আনন্দ-বিদায়ে অবচেতনে হলেও যে বিয়োগ-বিধূর চেতনায় আবিষ্ট হয় মন সেই মন দীপাবলিকে সামনে রেখেই আবার আনন্দের স্বপ্ন দেখে। সনাতন বাঙ্গালি সমাজে দুর্গাপূজা থেকেই শুরু হয় উৎসবের। তারপর লেগে থাকে বছর জুড়ে। দুর্গাপূজার পরে দীপাবলিতে কালী পূজা, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, উত্তরায়ন সংক্রান্তি, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা, ঢোলপূর্ণিমা(হোলি)- এভাবেই বর্ষা শেষের বছর কেটে যায়। আবহমান বাঙ্গালি সমাজে বর্ষা হলো পরিশ্রমের, কষ্টের, দূর্ভোগের, বপনের-রোপনের; বর্ষাতেই রোপন হয় সারা বছরের ভাগ্য-লিপি; তারপরে আশ্বিনের পর থেকে একের পর এক উৎসব আসতে থাকে। বাকিটা বছর এভাবেই চলতে থাকে, আর উৎসব জোরদার হয় আগনের পর থেকে।
ছোটবেলা থেকেই এই উৎসবের পালন দেখে আসছি।আমি দীপাবলিকে ‘দিবানিতা’ নামেই জেনে এসেছি।সিলেটের সনাতন সমাজে এই নামকরণের পেছনের কারণ এখনও জানিনি। তবে বাংলা অভিধানে 'দীপাবলি'র সমার্থক আরেকটি শব্দ আছে, 'দীপান্বিতা'। স্পষ্টতই এই শব্দ ভ্রংশ হয়ে এসেছে কথ্য 'দিবানিতা'। সন্ধ্যার আগে মাটির প্রদীপ সাজানো হয়। অথবা কলা গাছের সতেজ খোল দিয়ে তৈরি হয় প্রদীপ। তেলে জড়িয়ে সলতে প্রদীপে রাখা হয়। মোমবাতিও আনা হয়। উঠোনের মাঝখানে একটা কলাগাছ রাখা হয়- আলকাধার হিসেবে। তার গায়ে বাঁশের টুকরো গেঁথে দেওয়া হয়, যাতে প্রদীপদানীর মত ব্যবহার করা যায়। ফুল দিয়ে সেই গাছ সাজানো হত। কলার খোল দিয়ে বড় বড় করে কয়েকটি ডুঙ্গা তৈরি করা হয়, মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে। বাবা তাঁর বাবা ও মায়ের নামে দুটি ডুঙ্গার প্রদীপ জেলে পুকুরের জলে ভাসাতেন; তাতে ধূপ জ্বলত; কাঁসরের শব্দে আলতো হাতের স্রোতে ভাসতো প্রদীপ- সেই প্রজ্বলিত প্রদীপে এক অন্যরকম পরিবেশ চলে আসত। বর্তমান আর অতীত যেন এক সাথে দাঁড়াত।ভূত-অভূত সময় যেন একটুর জন্য হলেও এক হত হাতের আলতো স্রোতের তোড়ে ভাসমান প্রদীপের শিখায়। পিতৃদেব-মাতৃদেবীর উদ্দেশ্যে উদ্যত জোড় হাতের প্রণামে জীবিত আর বিগত প্রাণ স্পন্দন অনুভূত হত, অমাবস্যার এক নিশির প্রারম্ভে, কাঁসর বাজা সন্ধ্যায়- আলোময়-প্রজ্বলিত রাতের পূর্বে।
তারপর; সন্ধ্যা নেমে আসত। একে একে জ্বলে উঠত মাটির প্রদীপ, কলার প্রদীপ, মোমবাতি। দেবালয়ে, উঠোনে, দেউড়িতে, বাড়ির পথে- সর্বত্র জ্বলত প্রদীপ। এত এত জ্বলন্ত প্রদীপের সামনে দাঁড়িয়ে অনুভূতির সীমানার লাগাম টানা বেশ দুষ্কর। সেদিন বিদ্যুত লোডশেডিংয়ে কিছু সময়ের জন্যে চলে গেলে মন খুশীই হত।
-কথাগুলো সব অতীত কালে বলেছি, কারণ- সাত বছরের মত হতে চলল আমি এই উৎসবে বাড়িতে থাকতে পারি না। তাই আমার কাছে সবই অতীত।
দীপাবলি- শুধু সনাতনধর্মীদের নয়, শিখ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও অনুষ্ঠান। আর এখন- এই অনুষ্ঠান সার্বজনীন; গ্লোভালাইজড সমাজে এখন একে আর সীমাবদ্ধ রাখা যায় না; এই অনুষ্ঠান আমার- আপনার- সবার; এদেশের- সেদেশের- ওই দেশের; এ জাতির- সে জাতির- ঐ জাতির। বাংলাদেশে আজকেই এই দিনে কালী পূজা হয়- তাই দীপাবলি আর কালী পূজা একসাথে গাঁথা। এই দিন সরকারী ছুটি না সংরক্ষিত ছুটি; আমার জানা নেই। তবে হাইস্কুলে থাকতে এই দিন অর্ধদিবসের জন্য ছুটি চেয়েছিলাম সব ক্লাসমেটদের অনুরোধে- তাই মনে হচ্ছে সরকারী ছুটি নেই এই দিনে।হয়তো সংরক্ষিত ছুটি থেকে স্কুল-কলেজে ছুটি দেওয়া হয়। মালোয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, গুয়ানা, ত্রিনিদাদ-টোব্যাগো, মারিশাস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিজি এবং সুরিনামে এই দিন সরকারী ছুটির দিন।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে দীপাবলিতে কালী পূজা হয়। অন্যান্য অঞ্চলে এই দিনে গণেশ পূজা এবং লক্ষ্মী পূজাও করা হয়।সনাতনদের মাঝে কেউ কেউ আজকের দিনকে বিষ্ণুদেব এবং লক্ষ্মীদেবীর বিবাহ বার্ষিকি হিসেবে পালন করেন। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে আজকেই এই দিনে মোক্ষ (নির্বাণ) লাভ করেন। এই দিনে শিখ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দ জী অমৃতসরে ফিরে আসেন; সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিওর দুর্গ থেকে বায়ান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করে- তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে শিখগণ পালন করেন; তারা এই দিনকে ‘বন্দী ছোড় দিবস’ও বলেন।
রামায়ন অনুসারে আজকের দিনে ত্রেতা যুগে শ্রী রাম রাবণ বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রী রামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্য জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রজারা খুশীতে শব্দবাজি করে। অনেকে মনে করেন দীপাবলীর আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজি ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই অন্যসব অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছে, পরিচিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে।
দীপাবলী মূলত পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব। দীপাবলীর আগের দিনের চতুর্দশীকে (এই দিনকে দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন বলা হয়) বলা হয় ‘নরকা চতুর্দশী’; এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। চতুর্দশী পরের অমাবস্যা তিথি দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিন, কিন্তু এই দিনই মূল হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিন রাতে শাক্ত ধর্মের অনুসারীগণ শক্তি দেবী কালীর পূজা করেন। তাছাড়া এই দিনে লক্ষীপূজাও করা হয়, কথিত আছে এই দিনে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী বরধাত্রী রূপে ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করেন। বিষ্ণুপুরান মতে, বিষ্ণুর বামন অবতার অসুর বলিকে পাতালে পাঠান; আজকের এই দিনে পৃথিবীতে এসে অন্ধকার ও অজ্ঞতা বিদূরিত করতে, ভালবাসা ও জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করতে অসুর বলিকে পৃথিবীতে এসে অযুদ অযুদ প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। দীপাবলীর তৃতীয় দিন- কার্তিকা শুদ্ধ; এই দিন অসুর বলি নরক থেকে বেরিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুর বরে পৃথিবী শাসন করে।চতুর্থ দিন হচ্ছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া; একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়; এই দিন বোনেরা ভাইকে নিমন্তণ করে, কপালে ফোটা দেয়, হাতে রাখী বেঁধে দেয়।
প্রত্যেক সার্বজনীন আনন্দের উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভাল'র জয়কে উদযাপন করে। আলোকসজ্জার এই দিবস অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালার দিন। নিজের ভেতরের বাহিরের সকল অজ্ঞতা ও তমঃকে দীপ শিখায় বিদূরিত করার দিন। প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বলিত করার দিন। দেশ থেকে দেশে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে- এই দিনের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন; তবু মূল কথা এক। আর আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে এই দিন- আত্মাকে প্রজ্বলিত করে পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার দিন।
সবার জীবনে সুখ আসুক। সকল অন্ধকার ঘুচে যাক। সকল যন্ত্রনা মুছে যাক। শান্তির প্রদীপ জ্বলুক। ভালবাসার প্রদীপ জ্বলুক।
সবাইকে দীপাবলির শুভেচ্ছা।
লিখেছেনঃ সজল শর্মা
1 Comments:
ধন্যবাদ আপনাকে
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন