শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় কর্মবাদ ও আমরা সনাতনীরা
অধ্যাপক শিব প্রসাদ
হিন্দু ধর্ম একটি প্রাচীন ধর্ম। এ ধর্মে দেব-দেবীর
বিশ্বাস যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে খাঁটি একেশ্বরবাদী (Pare Monism) ধ্যান ধারণা। কিন্তু সংস্কৃতিগতভাবে যেহেতু বেশিরভাগ হিন্দুই দেব-দেবী পূজা
করে থাকে সেহেতু বাহ্যিকভাবে বিশেষতঃ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই মনে করে থাকেন এটি
বহু ঈশ্বরবাদী ধর্ম। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট দার্শনিক ও সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স মুলার এর একটি মন্তব্য স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন আসলে বেদের
যে দেবতাতত্ত্ব তাকে বহু ঈশ্বরবাদ(Polytheism ) বলে আখ্যায়িত না করে এক পরম সত্তায় বহু দেবতার মিলন Henotheism বলাই ভালো। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে ঈশ্বরবাদ নিয়ে আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য
নয়। তবুও প্রসঙ্গক্রমে
দু'চারটি কথা বলা। কারণ ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বরকে সন্ত্তষ্টি বিধানের
নিমিত্তে বিভিন্ন রকমের বিধি-বিধান পালন করা এবং বিবিধ প্রকারের পাপাচার থেকে বিরত
থাকাই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। হিন্দুধর্ম হতে ঈশ্বর লাভের অসংখ্য পথ রয়েছে। এর মধ্যে একাগ্রচিত্তে
যে কোন একটি পন্থায় ঈশ্বারোপাসনা উত্তম।
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় উল্লেখিত পন্থাগুলোর মধ্যে
কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিযোগ অন্যতম। এখানে আমরা কর্মযোগ
সম্পর্কে কিছু কথা বলবো। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় বলা হয়েছে জীবমাত্রই কর্মের অধীন। কোনও জীবই কর্ম ভিন্ন
বাঁচতে পারে না। এর মানে খাওয়া, ঘুমানো, কথা বলা, হাসি, কান্না, বসে থাকা, শুয়ে থাকা ইত্যাদি সব কিছুই কর্ম। যেহেতু যার প্রাণ আছে, সেই কোন না কোন কর্মের অধীন; সেহেতু মানুষের উচিৎ
সর্বসময়ই সৎকর্মের প্রতি অনুরাগী হওয়া এবং নিয়ত নিরাসক্তভাবে কর্ম করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ
কর্ম। এক নিস্কাম কর্ম বলে। এছাড়া আরও একটি কর্ম
আছে তাকে সকাম কর্ম বলে। এই কর্মের ভেতর কামনা-বাসনা যুক্ত থাকে। এত জীব মুক্ত হতে পারে
না, বরং বদ্ধজীবে রূপান্তর হয়। ফলে সে মোক্ষলাভ না করে কর্মানুসারে কামনা
বাসনার বশবর্তী হয়ে এই পৃথিবীতে বারংবার জন্মলাভ করে কর্মানুসারে কামান বাসনার বশবর্তী
হয়ে এই পৃথিবীতে বারংবার জন্মলাভ করে কর্মানুসারে ফল ভোগ করতে থাকে। তবে হিন্দু ধর্ম মতে
মানুষ স্বর্গে যাক, আর নরকেই যাক কর্মফল অনুসারে সে একটা নির্দিষ্ট
সময় পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে পারে। কর্মফল ভোগ শেষ হলে সে পুনরায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং এখানেই
তাকে পুনরায় পরীক্ষা দিতে হয়। ঈশ্বর তার সকল কর্মেরই অত্যন্ত সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাবে সংরক্ষণ
করেন এবং এই কর্মফল অনুসারে তাকে পুরস্কার কিংবা শাস্তি দিয়ে থাকেন। একটা পাপাত্মা প্রায়
৮৪ লক্ষ-যৌনী ঘুরে আসার পর মনুষ্যরূপ লাভ করে। তার মানে প্রতিটি প্রাণী এবং উদ্ভিদও কর্মফল
অনুসারেই জন্ম-মৃত্যুর অধীন। এটি একটি চক্র। এই চক্র বুঝতে হলে কাল মহাকাল (Time ) সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কাল হচ্ছে সকল কর্মের আধার। আমরা যেমন পৃথিবী ছাড়া
অবস্থান করতে পারি না, তেমনি কাল ছাড়া কোনও
কর্ম সম্পন্ন করতে পারি না। এই কালের কোন শুরু নেই, শেষ নেই। কাল হচ্ছে অনন্ত এবং একমুখী One dimensional ।
এই জগৎ এবং জাগতিক সকল প্রাণী এবং বস্তু জগৎ
সৃষ্টি, পালন তথা সংরক্ষণ ও সংহার করা, আবার পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি, সংরক্ষণ এবং সংহার করা এটি ঈশ্বর বা পরব্রহ্মের একটি লীলা খেলা। তবে এই চক্র থেকে সচেতন
জীব তথা মানুষ মুক্তি পেতে পারে; যাকে হিন্দু ধর্মে
মোক্ষ বলা হয়। এর জন্য প্রয়োজন মানুষকে নিস্কাম কর্ম সম্পাদক করা অর্থাৎ ফলের আশা না করে,
কোন কামনা-বাসনা বশবর্তী না হয়ে কর্মের খাতিরে কর্ম করা এবং
তা অবশ্যই সৎকর্ম হতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঈশ্বরে শরণাগতি থাকতে হবে। তাঁকে স্মরণ করা,
তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ থাকা, তাঁর নিকট সর্বাবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করা জীবমাত্রই একান্ত কর্তব্য। ঈশ্বর তার চেয়ে বেশি
কিছু চান না। এ ক্ষেত্রে তিনি দয়াময় তবে জীবমাত্রই যেহেতু কর্মের অধীন, সেহেতু কর্মফল তার অদৃষ্ট এবং তা ভোগ করতেই হবে। তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতায়
বলা হয়েছে জ্ঞানীরা বহু দেব-দেবীর ভজনা ছেড়ে এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের স্মরণ নিয়ে থাকে
এবং নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করে। পাশ্চাত্যে এই তত্ত্বটি জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট 'কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য' Duty for duty Sake বলে প্রচার করেছেন।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন