নিত্যপূজায়, পার্বণে সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী বিশেষ কিছু উপাচার ব্যবহৃত হয়ে থাকে যার মধ্যে শঙ্খ অন্যতম। শঙ্খ হল এক ধরণের সামুদ্রিক শামুক। এর বৈজ্ঞানিক নাম “turbinella pyrum “। এটি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মে পূজার উপাচার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
হিন্দু ধর্মমতে শঙ্খঃ
পবিত্র সনাতন ধর্মে শঙ্খ ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক। একে বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গী হিসেবেও পূজো করা হয়। সৃষ্টির শুরুতে সমুদ্রগর্ভ হতে, পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণু ও স্বর্গীয় দেবতাদের তৈরী ঘূর্ণাবর্তের মধ্য থেকে অস্ত্ররূপে শঙ্খকে হাতে ধরে আবির্ভাব হয় ভগবান বিষ্ণুর। অপরদিকে শঙ্খ ধন ও প্রতিপত্তির দেবী মা লক্ষীর আব্রু। “ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ” মতে, শঙ্খ ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠানকারী মন্দির।
২.২ পূজো-অর্চনায় শঙ্খের ব্যবহারঃ
আরতিতে দুই ধরণের শঙ্খ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটি পূজোর পূর্বে শঙ্খনাদ ধ্বনি উচ্চারনে আর অন্যটি পূজোর সামগ্রী হিসেবে প্রনিত্য পূজো, য়োজন হয়। কিন্তু কখনোই পূজোর আগে বাজানোর জন্যে ব্যবহৃত শঙ্খ পূজোর কাজে ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
“বরাহ পুরাণ” স্পষ্ট ভাবে বলেছে, কখনই মন্দিরের দ্বার শঙ্খ ধ্বনির উচ্চারণ ব্যতীত খোলা উচিৎ নয়। বামাবর্তী শঙ্খ বাজানোর জন্যে ব্যবহৃত হয়।
যেহেতু শঙ্খনী জাতীয় শঙ্খ ব্যবহার নিষিদ্ধ, তাই এগুলো কালো জাদু, যাকে বলা হয় “অঘোরী বিদ্যা” কিম্বা অপদেবতার আরাধনায় কাজে লাগানো হয়।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবসময় মনে রাখা উচিৎঃ
ক) যে শঙ্খ ব্যবহার করা হয়, সেটা কখনোই পূজোর শঙ্খ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
খ) শঙ্খ বাজাবার পর সেটা ধুয়ে রাখা জল কখনোই দেব-দেবীকে অঞ্জলী দেয়া চলবে না।
গ) কখনোই পূজোর কাজে দুক) বাজানোর কাজে টি শঙ্খ রাখা যাবে না।
ঘ) কোনোক্ষেত্রেই শিব পিন্ডিকে নিত্যপূজো চলাকালীন শঙ্খ দিয়ে স্পর্শ করা যাবে না।
ঙ) দেবাদিদেব মহাদেব এবং সূর্যদেবের স্নানের কাজে কখনোই শঙ্খ ব্যবহার করা যাবে না।
শঙ্খের ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক উপকারিতাঃ
১) শঙ্খকে ওম ধ্বনির উৎপাদক বলা হয়।
২) শঙ্খ আনে সুনাম, দীর্ঘায়ু আর যশ; দূর করে সকল পাপ, ক্লেশ, উৎপন্ন করে পবিত্র জলের প্রস্রবণ।
৩) একবার শঙ্খ বাজালে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয় তা থেকে তিন ধরণের শক্তি নির্গত হয়। একটি হল “চৈতন্য”। এই শক্তি বৃত্তাকারে শাঁখের খোলোসের মধ্যভাগ হতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আরেকটি হল “ধ্যান” যা তির্যক সরলরৈখিক পথে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর সর্বশেষ শক্তিটি হল “আনন্দ” যেটা ক্রমান্বয়ে শঙ্খের মধ্যভাগ হতে ধীরে ধীরে সবার অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
৪) প্রকৃতিতে প্রধানত তিন ধরণের শক্তি তরঙ্গ থাকে। এই তরঙ্গগুলোই হল সমগ্র সৃষ্টি জগতের নির্মাণ তন্তু। এদের মধ্যে একটি হল “সত্যবাদ তরঙ্গ” আর বাকী দুটি “রাজসিক (অহঙ্কার অর্থে) তরঙ্গ” এবং “তমসিক (দুষ্প্রবৃত্তি) তরঙ্গ”। এই প্রতিটি তরঙ্গের মধ্যে পাঁচ ধরণের মহাজাগতিক উপাদান থাকে। এরা হল “ভূমি”, “জল”, “আগুন”, “বায়ু” এবং “ইথার”। সত্যবাদ, রাজসিক এবং তমসিক তরঙ্গের সংখ্যা এই পাঁচটি উপাদানের ভিত্তিতে যথাক্রমে ১৫০ টি, ২০০ টি এবং ১৫০ টি (সত্যবাদ তরঙ্গের বিপরীত অনুক্রমে বণ্টিত)। রাজসিক আর তামসিক তরঙ্গদ্বয় সত্যবাদ তরঙ্গকে মন্দিরের পরিবেশে প্রবেশে বাধা দেয়। শঙ্খনাদ রাজসিক এবং তামসিক তরঙ্গদ্বয়কে প্রতিহত করে মন্দিরের পরিবেশ, সকল উদ্ভিদ এবং প্রাণীর মাঝে সত্যবাদ শক্তিকে প্রবেশ করায় যা মনের সব অহংবোধ, জড়তা, আঁধার কেটে সবকিছুকে পবিত্র করে। আবার শঙ্খনী জাতীয় শঙ্খে খাঁজগুলো অসম ভাবে বণ্টিত থাকে, যার দরুন এই শঙ্খ বাজালে সত্যবাদ তরঙ্গের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে রাজসিক আর তমসিক তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে গিয়ে কম্পাঙ্ক বেড়ে যায়, অর্থাৎ তীব্রতা বাড়ে।
৫) “যর্যুবেদ” এবং আধুনিক বিজ্ঞান এর ভাষ্যমতে শঙ্খ থেকে উৎপন্ন কম্পন যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তা বাতাসের সাথে মিশে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করে।
৬) নিয়ম মাফিক শঙ্খ বাজালে, বাদকের মস্তিষ্কের গোড়ার সুষুম্না কাণ্ড সতেজ থাকে, রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং রাজসিক ও তমসিক তরঙ্গের অন্তর্গত তেজ ও বায়ুর উপাদানগুলো সাম্যাবস্থায় থাকে।
৭) আয়ূর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থায় শঙ্খচূর্ণ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শঙ্খ চূর্ণ ক্যালসিয়া, ম্যাগনেসিয়াম এবং লৌহ ধারণ করে যা পেটের পিড়া দূর করে পরিপাক ব্যবস্থাকে সচল রাখে।
৮) শঙ্খের সাথে আরও কিছু প্রাকৃতিক উপাদানের সমাহারে তৈরী বড়ি “শঙ্খবতী” যা “ডিসপেপসিয়া” নামক অন্ত্রের রোগের চিকিৎসায় ফলদায়ক। এটি বাত, পিত্ত দমন এবং সৌন্দর্য ও শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
৯) কিছু কিছু শঙ্খ মুক্তা তৈরী করে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন