যদি গৌর না হইত তবে কি হইত
কেমনে ধরিতাম দে ।।
রাধার মহিমা প্রেম রস সীমা
জগতে জানাত কে ।।
সেই দুষ্ট বালকটির নাম নিমাই। নিম বৃক্ষের নিচে জন্মগ্রহন করায় তার এই নাম। ১৪০৭ শকাব্দ (ইং ১৪৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী), তখন ফাল্গুনী পূর্ণিমার সন্ধ্যা। চন্দ্রগ্রহণ চলছিল। ভারতীয় বৈদিক রীতি অনুসারে, চন্দ্রগ্রহণের সময় দিনান্তে মানুষ সাধারণত গঙ্গা অথবা কোন পবিত্র নদীতে গিয়ে স্নান করেন এবং জড় কলুষ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করেন। সকলে তখন সর্বশ্রেষ্ঠ বৈদিক মহামন্ত্র “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” জপ-কীর্তন করছিলেন। দিব্য হরিনামের মঙ্গল ধ্বনিতে চারিদিক মাতিয়ে পশ্চিম বাংলার নবদ্বীপের শ্রীধাম মায়াপুর নামক স্থানে আবির্ভূত হন কলিযুগের পাবনাবতার, সকলের সৌভাগ্যের উদয়কারী সেই মায়াপুরচন্দ্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
মাতার নাম শ্রী শচীদেবী, পিতা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র। কয়েকটি কন্যা সন্তানের পাশাপাশি মহান এই ব্রাহ্মন দম্পতির দুটি পুত্র সন্তান-শ্রী বিশ্বরূপ ও শ্রী বিশ্বম্ভর। শ্রীবিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহনের পর শচী-জগন্নাথের একমাত্র অবলম্বন হল বিশ্বম্ভর (নিমাই)। যাঁকে ভক্তরা ভালোবেসে ‘মহাপ্রভু’ বলেও সম্বোধন করেন। মহপ্রভু ৪৮ বছর তাঁর অপ্রাকৃত লীলাবিলাস করেন। তাঁর জীবনের প্রথম ২৪ বছর তিনি নবদ্বীপে শৈশব ও গার্হস্থ্য লীলা ও পরবর্তী ২৪ বছর জগন্নাথ পুরী সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কলিযুগের একমাত্র যুগধর্ম হরিনাম প্রচার ও কৃষ্ণভক্তিবিজ্ঞান শ্রীমদ্ভাগবত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সন্ন্যাস লীলা সম্পাদন করেন। মহাপ্রভু কেবল শ্রীমদ্ভাগবতের বানীই প্রচার করেননি, তিনি ভগবদ্গীতার মূল তত্ত্বও অত্যন্ত ব্যবহারিকভাবে শিক্ষাদান করেছেন। শ্রীচেতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। দুর্ভাগ্যবশত, শ্রীকৃষ্ণে সরাসরি নির্দেশ এবং ভগবদগীতার শিক্ষা সত্ত্বেও অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা ভ্রন্তিবশত তাঁকে একজন মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলে মনে করে, এবং তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান বলে মেনে নিতে পারে না। এ সমস্ত নির্বোধ লোকেরা বিভিন্ন প্রবঞ্চক অভক্তদের দ্বারাও প্রতারিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের অপ্রকটের পর তথাকথিত অনেক বড় বড় পণ্ডিত ভগবদগীতার ভাষ্য প্রণয়ন করেছে, এবং তাদের প্রায় সকলেই স্বার্থসিদ্ধির ভাবনায় প্রভাবিত ছিল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জনসাধারনকে ভগবদ্ভক্তি সম্বন্ধে শিক্ষাদান করার জন্য ভক্তরূপে অবতরণ করেন। তিনি এসেছেন সকলকে শিক্ষা দিতে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্বকারণের পরম কারণ পরমেশ্বর ভগবান এবং ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে তাঁর সেবা করাই হচ্ছে জীবনের পরম উদ্দেশ্য। এবারে আমি শ্রীচেতন্য মহাপ্রভুর কিছু অপ্রাকৃত লীলা তুলে ধরব যাতে তাঁর পরমেশ্বরত্ব ও করুণা প্রকাশ পেয়েছে।
লীলা ১: একবার একটি চোর নিমাইয়ের গায়ের গহনা চুরি করার জন্য তাঁকে চুরি করে নিয়ে যায়। কিন্তু ভগবান খুব মজা করে সেই হমভম্ব চোরের কাঁধে ঘুরে বেড়ালেন। সেই চোরটি তাঁর গহনা-অলঙ্কার খুলে নেওয়ার জন্য একটি নির্জন জায়গা খুজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু ভগবানের মায়ার প্রভাবে সেই চোরটি ঘুরতে ঘরতে ঠিক জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ির সামনে একই স্থানে আবার উপস্থিত হল এবং ধরা পড়ার ভয়ে শিশুটিকে রেখে পালিয়ে গেল। উৎকণ্ঠিত পিতা মাতা ও আত্মীয়-স্বজনেরা হারিয়ে যাওয়া নিমাইকে ফিরে পেয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন।
লীলা ২: এক সময়ে এক তীর্থযাত্রী ব্রাহ্মন জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, এবং তিনি যখন ভগবানের ভোগ নিবেদন করছিলেন তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেখানে এসে সেই নৈবেদ্য খেতে শুরু করেন। একটি শিশু সেটি স্পর্শ করেছে বলে সেই নৈবেদ্য ফেলে দিয়ে ব্রাহ্মণ আবার ভোগ বানিয়ে তা ভগবানকে নিবেদন করলেন। এবারও মহাপ্রভু এসে সেই ভোগ খেতে শুরু করলেন। এইভাবে তিনবারই একই ঘটনা ঘটার পর শিশুটিকে ঘরের ভিতর বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল। রাত প্রায় বারোটার সময় যখন সকলে গভীর নিদ্রায় মগ্ন সেই ব্রাহ্মন তখন বিশেষভাবে রান্না করা ভোগ ভগবানকে নিবেদন করলেন এবং ঠিক আগেরই মতো শিশু মহাপ্রভু তাঁর নিবেদন নষ্ট করে দিলেন। ব্রাহ্মণ তখন কাঁদতে শুরু করলেন। কিন্তু সকলে যেহেতু গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল তাই কেউ সেই কান্না শুনতে পেল না। তখন শিশু মহাপ্রভু সেই সৌভাগ্যশালী ব্রাহ্মণের কাছে তাঁর স্বরূপ উদঘাটন করলেন এবং ব্রাহ্মণ দেখলেন যে, সেই শিশুটি হচ্ছে ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। ব্রাহ্মনকে এই ঘটনাটি সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে দিয়ে শিশু মহাপ্রভু তাঁর মায়ের কোলে ফিরে গেলেন।
লীলা ৩: একবার মহপপ্রভু শ্রীনিবাস ঠাকুরেরর বাড়িতে এক অপূর্ব অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেন। তখন প্রবলভাবে সংকীর্তন হচ্ছিল। তিনি ভক্তদের জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাঁরা কি খেতে চান, এবং তাঁরা জানালেন যে, তাঁরা আম খেতে চান, তখন তিনি আমের আটিঁ চাইলেন। তখন আমের সময় ছিল না, আঁটিটি যখন তাঁর কাছে আনা হল, তখন তিনি সেটি শ্রীনিবাস ঠাকুরের অঙ্গনে পুঁতলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেই আঁটিটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমন্বয়ে বর্ধিত হতে লাগল। অচিরেই সেটি একটি আম গাছে পরিণত হল এবং সেই গাছে এত সুপক্ব আম ধরল যে, ভক্তরা তা খেয়ে শেষ করতে পারলেন না। গাছটি শ্রীনিবাস ঠাকুরের অঙ্গনেই রইল এবং ভক্তরা সেটি থেকে তাঁদের যত ইচ্ছে আম নিয়ে খেল। ভক্তরা মহাপ্রভুর এই অপ্রাকৃত লীলা দেখে হরিধ্বনি দিতে লাগল। এখনও সেই গাছ শ্রীনিবাস অঙ্গনে বিদ্যমান।
লীলা ৪: মহাপ্রভু যখন প্রবলভাবে হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন তখন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ তাঁর এবং ভক্তদের বিরুদ্ধে চাঁদ কাজীর কাছে অভিযোগ করে। নবদ্বীপের মুসলমান কাজী ব্রাহ্মণদের এই অভিযোগটিতে প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রথমে তিনি মহাপ্রভুর অনুগামীদের উচ্চস্বরে হরিনাম সংকীর্তন করতে নিষেধ করেন। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর অনুগামীদর কাজীর সেই নির্দেশ অমান্য করতে নির্দেশ দেন, এবং তাঁরা পূর্বের মতোই সংকীর্তন করে যেতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্তন বন্ধ করার জন্য তাঁর পেয়াদা পাঠান এবং তারা সংকীর্তন কারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয়। এই ঘটনার কথা শুনে মহাপ্রভু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি এক বিরাট আইন-অমান্য আন্দোলন করেন। তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতবর্ষে প্রথম আইন-অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। হাজার হাজার মৃদঙ্গ এবং করতাল সহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেন, এবং কাজীর আইন অমান্য করে এই শোভাযাত্রা নবদ্বীপের পথে পথে হরিনাম কীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে যখন শোভাযাত্রাটি কাজীর বাড়িতে এসে পৌঁছায়, তখন ভয়ে কাজী তাঁর বাড়ির উপরতলার একটি ঘরে লুকিয়ে থাকেন। সেই বিশাল জনসমাবেশ কাজীর বাড়ির সামনে সমবেত হয়ে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে, কিন্তু মহাপ্রভু তাদের শান্ত হতে বলেন। মহাপ্রভুর আশ্বাস পেয়ে অবশেষে কাজী তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে কোরান ও হিন্দু-শাস্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় তিনি গো-বধের ভয়াবহ পরিনাম তুলে ধরেন। “তোমরা জীয়াইতে নার-বধমাত্র সার। নরক হইতে তোমার নাহিক নিস্তার।। গো-অঙ্গে যত লোম, তত সহস্র বৎসর। গো-বধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।” এভাবে মহাপ্রভু শাস্ত্র যুক্তির মাধ্যমে গোবধ এবং সবধরণের যজ্ঞ নিষিদ্ধ করলেন। তিনি একমাত্র যজ্ঞ হিসেবে হরিনাম সংকীর্তনকে জগতমাঝে প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন কাজী মহাপ্রভুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রবর্তিত সংকীর্তন যজ্ঞে কেউ যেন কখনও বাধা না দেয়, এবং তিনি তাঁর উইলে লিখে যান যে, তাঁর বংশের কেউ যদি সংকীর্তনে বাধা দেয়, তাহলে সে তৎক্ষণাৎ বংশচ্যুত হবে। নবদ্বীপে মায়াপুরের সন্নিকটে এখনও শ্রীচাঁদ কাজীর সমাধী আছে। এই ঘটনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিরীহ বৈষ্ণব ছিলেন না। বৈষ্ণব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের ভক্ত এবং প্রয়োজন হলে তিনি সিংহবিক্রমে যথার্থ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
লীলা ৫: মহাপ্রভুর নির্দেশে শ্রীনিত্যানন্দ এবং হরিদাস ঠাকুর সর্বত্র হরিনাম প্রচার করেন। ঐ সময়ের সর্ব সবনিকৃষ্ট পতিত হচ্ছেন দুই ভাই-জগাই ও মাধাই। পৃথিবীতে এমন কোন পাপ নেই যা তারা করেনি; মাংসাহার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট-সবকিছু। সারাদিন মদের নেশার বিভোর হয়ে থাকত এই দুইজন। তাদের এই পতিত দশা দেখে নিত্যানন্দ প্রভু এবং হরিদাস ঠাকুর তাদেরকে হরিনাম করতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধ শুনে মাতাল দুটি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল এবং অশ্লীল গালাগালি দিতে দিতে তাদেঁরকে তাড়া করতে শুরু করল। পরের দিন আবার তাঁরা দুই মাতালের কাছে গিয়ে ভগবানের নাম কীর্তন করতে অনুরোধ করলেন। পুনরায় ক্রুদ্ধ হয়ে মাধাই একটি কলসির কানা দিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর মাথায় আঘাত করল, এবং সেই আঘাতের ফলে প্রভুর কপাল কেটে দরদর ধারায় রক্ত ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু এতই করুনাময় যে, এই কাজের জন্য কোন রকম প্রতিবাদ না করে তিনি বললেন “তুমি যে আমাকে কলসির কানা ছুড়ে মেরেছ তাতে আমি কিছু মনে করিনি, কিন্তু আমার একমাত্র অনুরোধ যে তুমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির নাম কীর্তন কর। ইতিমধ্যে নিত্যানন্দ প্রভুর আঘাতের সংবাদ পেয়ে মহাপ্রভু অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান করলেন দুই পাপীকে সংহার করার জন্য। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তাদের হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন এবং মহাপ্রভুকে তাঁর অবতরনের উদ্দেশ্য মনে করিয়ে দিলেন। মহাপ্রভু অবতরনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কলিযুগের সমস্ত অধপতিত মানুষকে কৃষ্ণপ্রেম প্রদানের মাধ্যমে উদ্ধার করা এবং এই দুই ভাই-জগাই মাধাই হচ্ছে সেই অধপতিত মানুষের আদর্শ দৃষ্টান্ত। প্রকৃতপক্ষে, বৈদিক সমাজের বিলুপ্তি ও বর্তমান যুগের প্রভাবে অধিকাংশ মানুষই একেকটি জগাই মাধাইয়ে পরিণত হয়েছে। তবুও আমাদের মতো জগাই মাধাইদের জন্য একমাত্র সৌভাগ্যের বিষয় হল হরিনাম মহামন্ত্রকে জীবনের সম্বলরূপে গ্রহন করা। জগাই মাধাই সমস্ত পাপকর্ম বর্জন করে পরম দয়ালু ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণে আশ্রয় গ্রহন করল এবং কৃষ্ণপ্রেম লাভ করল। পাপী তাপী যত ছিল হরিনামে উদ্ধারিল তার সাক্ষী জগাই আর মাধাই।।
এভাবে মহাপ্রভু সবচেয়ে পতিত ব্যাক্তিদেরও কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করেছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন কলিযুগের অধপতিত জীবদের সৌভাগ্য আনয়নকারী সুহৃদ। যে দুর্লভ বস্তু-কৃষ্ণপ্রেম হাজার হাজার বছর তপস্যা করে লাভ করা যায় না, যা গোলোক বৃন্দাবনের সবচেয়ে গোপনীয় বস্তু, সেই কৃষ্ণপ্রেম আপামর মানুষকে অকাতরে তিনি বিতরণ করেছেন অত্যন্ত করুণার বশবর্তী হয়ে। শুধুমাত্র দিব্য হরিনাম উচ্চারণের মাধ্যমেই এই দুর্লভতম কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা যায়।
আর, এই হরিনামকে বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে দিয়েছেন মহাপ্রভুরই এক অন্তরঙ্গ প্রেরিত দূত, আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) এর প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। মহাপ্রভু ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম, সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম।” তাঁর এই ভবিষ্যত বাণীকে সার্থক রূপদান করেছেন শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁরই কৃপাতে সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদশূণ্য হয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করছে। তিনিই প্রকৃত জাতিসংঘ গঠন করেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অপার করুণায়। এই হরিনামের ফলেই সবাই লাভ করছে দিব্য আনন্দ ও সুখি জীবন। আসুন সবাই এখন আমরা এই মুহূর্ত থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই প্রতিদিন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করতে এবং কৃষ্ণ সেবায় নিজেদেরকে নিযুক্ত রাখতে। “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।” শ্রীল প্রভুপাদ কী জয় !! শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কী জয় !!! নিতাই গৌর প্রেমানন্দে..হরি হরি বোল !!!
কেমনে ধরিতাম দে ।।
রাধার মহিমা প্রেম রস সীমা
জগতে জানাত কে ।।
সেই দুষ্ট বালকটির নাম নিমাই। নিম বৃক্ষের নিচে জন্মগ্রহন করায় তার এই নাম। ১৪০৭ শকাব্দ (ইং ১৪৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী), তখন ফাল্গুনী পূর্ণিমার সন্ধ্যা। চন্দ্রগ্রহণ চলছিল। ভারতীয় বৈদিক রীতি অনুসারে, চন্দ্রগ্রহণের সময় দিনান্তে মানুষ সাধারণত গঙ্গা অথবা কোন পবিত্র নদীতে গিয়ে স্নান করেন এবং জড় কলুষ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করেন। সকলে তখন সর্বশ্রেষ্ঠ বৈদিক মহামন্ত্র “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” জপ-কীর্তন করছিলেন। দিব্য হরিনামের মঙ্গল ধ্বনিতে চারিদিক মাতিয়ে পশ্চিম বাংলার নবদ্বীপের শ্রীধাম মায়াপুর নামক স্থানে আবির্ভূত হন কলিযুগের পাবনাবতার, সকলের সৌভাগ্যের উদয়কারী সেই মায়াপুরচন্দ্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
মাতার নাম শ্রী শচীদেবী, পিতা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র। কয়েকটি কন্যা সন্তানের পাশাপাশি মহান এই ব্রাহ্মন দম্পতির দুটি পুত্র সন্তান-শ্রী বিশ্বরূপ ও শ্রী বিশ্বম্ভর। শ্রীবিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহনের পর শচী-জগন্নাথের একমাত্র অবলম্বন হল বিশ্বম্ভর (নিমাই)। যাঁকে ভক্তরা ভালোবেসে ‘মহাপ্রভু’ বলেও সম্বোধন করেন। মহপ্রভু ৪৮ বছর তাঁর অপ্রাকৃত লীলাবিলাস করেন। তাঁর জীবনের প্রথম ২৪ বছর তিনি নবদ্বীপে শৈশব ও গার্হস্থ্য লীলা ও পরবর্তী ২৪ বছর জগন্নাথ পুরী সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কলিযুগের একমাত্র যুগধর্ম হরিনাম প্রচার ও কৃষ্ণভক্তিবিজ্ঞান শ্রীমদ্ভাগবত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সন্ন্যাস লীলা সম্পাদন করেন। মহাপ্রভু কেবল শ্রীমদ্ভাগবতের বানীই প্রচার করেননি, তিনি ভগবদ্গীতার মূল তত্ত্বও অত্যন্ত ব্যবহারিকভাবে শিক্ষাদান করেছেন। শ্রীচেতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। দুর্ভাগ্যবশত, শ্রীকৃষ্ণে সরাসরি নির্দেশ এবং ভগবদগীতার শিক্ষা সত্ত্বেও অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা ভ্রন্তিবশত তাঁকে একজন মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলে মনে করে, এবং তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান বলে মেনে নিতে পারে না। এ সমস্ত নির্বোধ লোকেরা বিভিন্ন প্রবঞ্চক অভক্তদের দ্বারাও প্রতারিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের অপ্রকটের পর তথাকথিত অনেক বড় বড় পণ্ডিত ভগবদগীতার ভাষ্য প্রণয়ন করেছে, এবং তাদের প্রায় সকলেই স্বার্থসিদ্ধির ভাবনায় প্রভাবিত ছিল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জনসাধারনকে ভগবদ্ভক্তি সম্বন্ধে শিক্ষাদান করার জন্য ভক্তরূপে অবতরণ করেন। তিনি এসেছেন সকলকে শিক্ষা দিতে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্বকারণের পরম কারণ পরমেশ্বর ভগবান এবং ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে তাঁর সেবা করাই হচ্ছে জীবনের পরম উদ্দেশ্য। এবারে আমি শ্রীচেতন্য মহাপ্রভুর কিছু অপ্রাকৃত লীলা তুলে ধরব যাতে তাঁর পরমেশ্বরত্ব ও করুণা প্রকাশ পেয়েছে।
লীলা ১: একবার একটি চোর নিমাইয়ের গায়ের গহনা চুরি করার জন্য তাঁকে চুরি করে নিয়ে যায়। কিন্তু ভগবান খুব মজা করে সেই হমভম্ব চোরের কাঁধে ঘুরে বেড়ালেন। সেই চোরটি তাঁর গহনা-অলঙ্কার খুলে নেওয়ার জন্য একটি নির্জন জায়গা খুজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু ভগবানের মায়ার প্রভাবে সেই চোরটি ঘুরতে ঘরতে ঠিক জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ির সামনে একই স্থানে আবার উপস্থিত হল এবং ধরা পড়ার ভয়ে শিশুটিকে রেখে পালিয়ে গেল। উৎকণ্ঠিত পিতা মাতা ও আত্মীয়-স্বজনেরা হারিয়ে যাওয়া নিমাইকে ফিরে পেয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন।
লীলা ২: এক সময়ে এক তীর্থযাত্রী ব্রাহ্মন জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, এবং তিনি যখন ভগবানের ভোগ নিবেদন করছিলেন তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেখানে এসে সেই নৈবেদ্য খেতে শুরু করেন। একটি শিশু সেটি স্পর্শ করেছে বলে সেই নৈবেদ্য ফেলে দিয়ে ব্রাহ্মণ আবার ভোগ বানিয়ে তা ভগবানকে নিবেদন করলেন। এবারও মহাপ্রভু এসে সেই ভোগ খেতে শুরু করলেন। এইভাবে তিনবারই একই ঘটনা ঘটার পর শিশুটিকে ঘরের ভিতর বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল। রাত প্রায় বারোটার সময় যখন সকলে গভীর নিদ্রায় মগ্ন সেই ব্রাহ্মন তখন বিশেষভাবে রান্না করা ভোগ ভগবানকে নিবেদন করলেন এবং ঠিক আগেরই মতো শিশু মহাপ্রভু তাঁর নিবেদন নষ্ট করে দিলেন। ব্রাহ্মণ তখন কাঁদতে শুরু করলেন। কিন্তু সকলে যেহেতু গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল তাই কেউ সেই কান্না শুনতে পেল না। তখন শিশু মহাপ্রভু সেই সৌভাগ্যশালী ব্রাহ্মণের কাছে তাঁর স্বরূপ উদঘাটন করলেন এবং ব্রাহ্মণ দেখলেন যে, সেই শিশুটি হচ্ছে ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। ব্রাহ্মনকে এই ঘটনাটি সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে দিয়ে শিশু মহাপ্রভু তাঁর মায়ের কোলে ফিরে গেলেন।
লীলা ৩: একবার মহপপ্রভু শ্রীনিবাস ঠাকুরেরর বাড়িতে এক অপূর্ব অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেন। তখন প্রবলভাবে সংকীর্তন হচ্ছিল। তিনি ভক্তদের জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাঁরা কি খেতে চান, এবং তাঁরা জানালেন যে, তাঁরা আম খেতে চান, তখন তিনি আমের আটিঁ চাইলেন। তখন আমের সময় ছিল না, আঁটিটি যখন তাঁর কাছে আনা হল, তখন তিনি সেটি শ্রীনিবাস ঠাকুরের অঙ্গনে পুঁতলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেই আঁটিটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমন্বয়ে বর্ধিত হতে লাগল। অচিরেই সেটি একটি আম গাছে পরিণত হল এবং সেই গাছে এত সুপক্ব আম ধরল যে, ভক্তরা তা খেয়ে শেষ করতে পারলেন না। গাছটি শ্রীনিবাস ঠাকুরের অঙ্গনেই রইল এবং ভক্তরা সেটি থেকে তাঁদের যত ইচ্ছে আম নিয়ে খেল। ভক্তরা মহাপ্রভুর এই অপ্রাকৃত লীলা দেখে হরিধ্বনি দিতে লাগল। এখনও সেই গাছ শ্রীনিবাস অঙ্গনে বিদ্যমান।
লীলা ৪: মহাপ্রভু যখন প্রবলভাবে হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন তখন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ তাঁর এবং ভক্তদের বিরুদ্ধে চাঁদ কাজীর কাছে অভিযোগ করে। নবদ্বীপের মুসলমান কাজী ব্রাহ্মণদের এই অভিযোগটিতে প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রথমে তিনি মহাপ্রভুর অনুগামীদের উচ্চস্বরে হরিনাম সংকীর্তন করতে নিষেধ করেন। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর অনুগামীদর কাজীর সেই নির্দেশ অমান্য করতে নির্দেশ দেন, এবং তাঁরা পূর্বের মতোই সংকীর্তন করে যেতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্তন বন্ধ করার জন্য তাঁর পেয়াদা পাঠান এবং তারা সংকীর্তন কারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয়। এই ঘটনার কথা শুনে মহাপ্রভু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি এক বিরাট আইন-অমান্য আন্দোলন করেন। তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতবর্ষে প্রথম আইন-অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। হাজার হাজার মৃদঙ্গ এবং করতাল সহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেন, এবং কাজীর আইন অমান্য করে এই শোভাযাত্রা নবদ্বীপের পথে পথে হরিনাম কীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে যখন শোভাযাত্রাটি কাজীর বাড়িতে এসে পৌঁছায়, তখন ভয়ে কাজী তাঁর বাড়ির উপরতলার একটি ঘরে লুকিয়ে থাকেন। সেই বিশাল জনসমাবেশ কাজীর বাড়ির সামনে সমবেত হয়ে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে, কিন্তু মহাপ্রভু তাদের শান্ত হতে বলেন। মহাপ্রভুর আশ্বাস পেয়ে অবশেষে কাজী তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে কোরান ও হিন্দু-শাস্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় তিনি গো-বধের ভয়াবহ পরিনাম তুলে ধরেন। “তোমরা জীয়াইতে নার-বধমাত্র সার। নরক হইতে তোমার নাহিক নিস্তার।। গো-অঙ্গে যত লোম, তত সহস্র বৎসর। গো-বধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।” এভাবে মহাপ্রভু শাস্ত্র যুক্তির মাধ্যমে গোবধ এবং সবধরণের যজ্ঞ নিষিদ্ধ করলেন। তিনি একমাত্র যজ্ঞ হিসেবে হরিনাম সংকীর্তনকে জগতমাঝে প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন কাজী মহাপ্রভুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রবর্তিত সংকীর্তন যজ্ঞে কেউ যেন কখনও বাধা না দেয়, এবং তিনি তাঁর উইলে লিখে যান যে, তাঁর বংশের কেউ যদি সংকীর্তনে বাধা দেয়, তাহলে সে তৎক্ষণাৎ বংশচ্যুত হবে। নবদ্বীপে মায়াপুরের সন্নিকটে এখনও শ্রীচাঁদ কাজীর সমাধী আছে। এই ঘটনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিরীহ বৈষ্ণব ছিলেন না। বৈষ্ণব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের ভক্ত এবং প্রয়োজন হলে তিনি সিংহবিক্রমে যথার্থ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
লীলা ৫: মহাপ্রভুর নির্দেশে শ্রীনিত্যানন্দ এবং হরিদাস ঠাকুর সর্বত্র হরিনাম প্রচার করেন। ঐ সময়ের সর্ব সবনিকৃষ্ট পতিত হচ্ছেন দুই ভাই-জগাই ও মাধাই। পৃথিবীতে এমন কোন পাপ নেই যা তারা করেনি; মাংসাহার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট-সবকিছু। সারাদিন মদের নেশার বিভোর হয়ে থাকত এই দুইজন। তাদের এই পতিত দশা দেখে নিত্যানন্দ প্রভু এবং হরিদাস ঠাকুর তাদেরকে হরিনাম করতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধ শুনে মাতাল দুটি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল এবং অশ্লীল গালাগালি দিতে দিতে তাদেঁরকে তাড়া করতে শুরু করল। পরের দিন আবার তাঁরা দুই মাতালের কাছে গিয়ে ভগবানের নাম কীর্তন করতে অনুরোধ করলেন। পুনরায় ক্রুদ্ধ হয়ে মাধাই একটি কলসির কানা দিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর মাথায় আঘাত করল, এবং সেই আঘাতের ফলে প্রভুর কপাল কেটে দরদর ধারায় রক্ত ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু এতই করুনাময় যে, এই কাজের জন্য কোন রকম প্রতিবাদ না করে তিনি বললেন “তুমি যে আমাকে কলসির কানা ছুড়ে মেরেছ তাতে আমি কিছু মনে করিনি, কিন্তু আমার একমাত্র অনুরোধ যে তুমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির নাম কীর্তন কর। ইতিমধ্যে নিত্যানন্দ প্রভুর আঘাতের সংবাদ পেয়ে মহাপ্রভু অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান করলেন দুই পাপীকে সংহার করার জন্য। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তাদের হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন এবং মহাপ্রভুকে তাঁর অবতরনের উদ্দেশ্য মনে করিয়ে দিলেন। মহাপ্রভু অবতরনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কলিযুগের সমস্ত অধপতিত মানুষকে কৃষ্ণপ্রেম প্রদানের মাধ্যমে উদ্ধার করা এবং এই দুই ভাই-জগাই মাধাই হচ্ছে সেই অধপতিত মানুষের আদর্শ দৃষ্টান্ত। প্রকৃতপক্ষে, বৈদিক সমাজের বিলুপ্তি ও বর্তমান যুগের প্রভাবে অধিকাংশ মানুষই একেকটি জগাই মাধাইয়ে পরিণত হয়েছে। তবুও আমাদের মতো জগাই মাধাইদের জন্য একমাত্র সৌভাগ্যের বিষয় হল হরিনাম মহামন্ত্রকে জীবনের সম্বলরূপে গ্রহন করা। জগাই মাধাই সমস্ত পাপকর্ম বর্জন করে পরম দয়ালু ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণে আশ্রয় গ্রহন করল এবং কৃষ্ণপ্রেম লাভ করল। পাপী তাপী যত ছিল হরিনামে উদ্ধারিল তার সাক্ষী জগাই আর মাধাই।।
এভাবে মহাপ্রভু সবচেয়ে পতিত ব্যাক্তিদেরও কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করেছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন কলিযুগের অধপতিত জীবদের সৌভাগ্য আনয়নকারী সুহৃদ। যে দুর্লভ বস্তু-কৃষ্ণপ্রেম হাজার হাজার বছর তপস্যা করে লাভ করা যায় না, যা গোলোক বৃন্দাবনের সবচেয়ে গোপনীয় বস্তু, সেই কৃষ্ণপ্রেম আপামর মানুষকে অকাতরে তিনি বিতরণ করেছেন অত্যন্ত করুণার বশবর্তী হয়ে। শুধুমাত্র দিব্য হরিনাম উচ্চারণের মাধ্যমেই এই দুর্লভতম কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা যায়।
আর, এই হরিনামকে বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে দিয়েছেন মহাপ্রভুরই এক অন্তরঙ্গ প্রেরিত দূত, আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) এর প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। মহাপ্রভু ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম, সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম।” তাঁর এই ভবিষ্যত বাণীকে সার্থক রূপদান করেছেন শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁরই কৃপাতে সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদশূণ্য হয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করছে। তিনিই প্রকৃত জাতিসংঘ গঠন করেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অপার করুণায়। এই হরিনামের ফলেই সবাই লাভ করছে দিব্য আনন্দ ও সুখি জীবন। আসুন সবাই এখন আমরা এই মুহূর্ত থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই প্রতিদিন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করতে এবং কৃষ্ণ সেবায় নিজেদেরকে নিযুক্ত রাখতে। “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।” শ্রীল প্রভুপাদ কী জয় !! শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কী জয় !!! নিতাই গৌর প্রেমানন্দে..হরি হরি বোল !!!
Courtesy: প্রশ্ন করুন, উত্তর পাবেন। সনাতন ধর্মের হাজারও প্রশ্ন এবং উত্তর
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন