২৪ মে ২০২০

ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরের এক বিশাল এক শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্য কথা জানবো ।

খামের সাম্রাজ্য ( ৮০২-১৪৩১) দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল । ৮০২ সালে চক্রবর্তী সম্রাট দ্বিতীয় জয়বর্মন এই সাম্রাজের প্রতিষ্ঠা করেন । বর্তমানের কম্বোডিয়া,থাইল্যান্ড,লাওস এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম নিয়ে গঠিত হয় এই শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্য । ১৫ শতাব্দীতে খামের সাম্রাজ্যের পতন হয় । খামেরদের রাজধানী ছিল অঙ্কোরাভাট অর্থাৎ মন্দিরের শহর ।

প্রাচীন মন্দির বলতে মানুষের ধারণা শুধু ভারতবর্ষেই। কিন্তু ভারতবর্ষ থেকেও হাজার মাইল দূরে কম্বোডিয়ায় অবস্থিত সনাতন ধর্মালম্বীদের স্থাপিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মন্দির। শুধু সর্ববৃহৎ বলে নয় এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্য দেখলে রীতিমতো তাজ্জব বনে যেতে হবে।
সব মন্দিরকে ছাপিয়ে এই অঙ্কোরভাট মন্দির অধীষ্ঠিত আছে অনন্য উচ্চতায়। বিস্তারিত বর্ণনার আগে জানিয়ে নেই এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন অঙ্কোরের তৎকালীন শাসক দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ। দ্বাদশ শতাব্দীতে (১১১৩-১১৫০) নিজের রাজধানী ও প্রধান উপসনালয় হিসেবে এই বিশাল স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ। রাজা সূর্যবর্মণের মৃত্যুর পর মন্দিরের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায় তাই মন্দিরের দেয়ালে কিছু কারুকাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তখন দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে এক শক্তিশালী সরকার গঠন করেছিলেন সেটা তাঁর এই স্থাপত্য দেখলেই অনুমান করা যায়৷ তাঁদের সাম্রাজ্যকে বলা হত খামের সাম্রাজ্য। খামের সাম্রাজ্যের আরাধ্য দেব মহাদেব হলেও দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন বিষ্ণু দেবের জন্য।
ঙ্কোরভাট নির্মাণশৈলী খামের স্থাপত্যশৈলীকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই মন্দিরের নির্মাণকৌশলে দুইটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে
১/ টেম্পল মাউন্টেন ধাঁচ (পাহাড়ি মন্দির ধাঁচ)
২/ গ্যালারি মন্দির ধাঁচ


★হিন্দু পূরাণের বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীর কেন্দ্র সুমেরু পর্বতে দেব-দেবীদের বসবাস তাই সেই সুমেরু পর্বতের আদলেই এই মন্দিরের মূল অংশ নির্মাণ করা হয়।
মন্দিরের ৫ টি সুইচ চুড়া সুমেরু পর্বতের ৫ টি পর্বতশৃঙ্গকে নির্দেশ করে।
★এই মন্দিরের সুরক্ষার জন্য মন্দিরের চারদিকে রয়েছে বিশাল পরিখা (ধারনা করা হয় কয়েকশত ফুট গভীর পরিখ) ও ৩.৫ কিঃমিঃ দীর্ঘ প্রাচীর। সম্পূর্ণ স্থাপনাটি প্রায় ৫০০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
★বাইরের দেয়ালটি দৈর্ঘ্যে ১০২৫ মিটার, প্রস্থে ৮০২ মিটার, এবং উচ্চতায় ৪.৫ মিটার। এর চার দিকে ৩০ মিটার দূরত্বে ১৯০ মিটার চওড়া একটি পরিখা আছে। মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য পূর্ব দিকে একটি মাটির পাড় এবং পশ্চিম দিকে একটি বেলেপাথরের পুল রয়েছে। এই পুলটি মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার, এবং মন্দির নির্মাণের অনেক পরে যোগ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় যে, এর স্থানে পূর্বে একটি কাঠের পুল ছিলো।
★মূল মন্দিরটি শহরের অন্যান্য স্থাপনা হতে উঁচুতে অবস্থিত। এতে রয়েছে তিনটি পর্যায়ক্রমে উচ্চতর চতুষ্কোণ গ্যালারি, যা শেষ হয়েছে একটি কেন্দ্রীয় টাওয়ারে। মান্নিকার মতে এই গ্যালারিগুলো যথাক্রমে রাজা, ব্রহ্মা, এবং বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। প্রতিটি গ্যালারির মূল (কার্ডিনাল) বিন্দুগুলোতে একটি করে গোপুরা রয়েছে। ভিতরের দিকের গ্যালারিগুলোর কোণায় রয়েছে টাওয়ার। কেন্দ্রের টাওয়ার এবং চার কোনের চারটি টাওয়ার মিলে পঞ্চবিন্দু নকশা সৃষ্টি করেছে।
দ্বিতীয় সূর্যবর্মণের মৃত্যুর পর মন্দিরটি সূর্যবর্মণের সমাধিসৌধ হিসেবেও বিবেচিত হত। আসলে তখনকার সত্যিকার ইতিহাসের কোন সাক্ষ্য এমনকি মন্দিরের পূর্বনাম সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় না।

১১৭৭ এর দিকে খামেদের চিরশত্রু চামদের দ্ধারা এই মন্দির লুন্ঠিত হয়। ধারণা করা হয় তখন এই মন্দিরের চূড়াগুলো স্বর্ন দিয়ে মোড়ানো ছিল৷ পরবর্তীতে ৭ম জয়বর্মন রাজ্যটিকে পুনর্গঠন করেন ও নতুন রাজধানী করেন অঙ্কোরথমকে এবং বায়ু নগরে প্রধান মন্দির স্থাপন করেন।
তবে কম্বোডিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচারের সাথে সাথে ১৪ শ থেকে ১৫ শ শতাব্দীর মধ্যে এই হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত হয় কিন্তু এখান থেকে বিষ্ণু মন্দির কখনও স্থানান্তরিত হয় নি এমনকি এই মন্দিরে এখনো প্রধান দেবতা হিসেবে ভগবান বিষ্ণুর পূজা হয়। ষোড়শ শতকের পর থেকে এই মন্দির অবহেলিত হতে শুরু হয় কিন্তু কখনওই পরিত্যক্ত হয় নি। মন্দিরের চারপাশের বিশাল পরিখার জন্যই এই মন্দিরকে জঙ্গলের গাছপালা গ্রাস করতে পারে নি।
পশ্চিমা পরিব্রাজকদের মধ্যে পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারক আন্তোনিও দা মাগদালেনার প্রথম এই মন্দির ভ্রমণ করেন ১৫৮৬ সালের দিকে। এই মন্দির ভ্রমণ করে তিনি লিখেছিলেন।
"এটি (মন্দিরটি) এমন অসাধারণ ভাবে নির্মিত যে, ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সারা বিশ্বে এরকম আর কোন ভবন বা স্থাপনার অস্তিত্ব নাই। এখানে রয়েছে খিলান ও অন্যান্য কারুকার্য, মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য সেরা সৃষ্টি।"
তবে পাশ্চাত্যে এই মন্দিরের কথা ছড়িয়ে পড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি অভিযাত্রী অনরি মৌহত এর ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমে। তিনি লিখেছিলেন,
"এই মন্দিরগুলির মধ্যে একটি (আঙ্করভাট), সলোমনের মন্দিরকেও হার মানায়। মাইকেলেঞ্জেলোর মতোই কোন প্রাচীন শিল্পী এটি নির্মাণ করেছেন। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর ভবন সমূহের সাথে এটি সমতূল্য। এটি এমনকী প্রাচীন গ্রিস বা প্রাচীন রোমের স্থাপনা গুলির চাইতেও অনেক বেশি রাজকীয়, সুন্দর। বর্তমানে এই দেশটি (কম্বোডিয়া এলাকা) যে বর্বরতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, তার সাথে এই মন্দিরের বিশালতার ও সৌন্দর্যের এক বিশাল ফারাক রয়েছে।"
বিংশ শতাব্দীতে আঙ্করভাটের ব্যাপক সংস্কার সম্পন্ন হয়। এ সময় প্রধানত এর চারিদিকে গ্রাস করে নেয়া মাটি ও জঙ্গল সাফ করা হয়। গৃহযুদ্ধ ও খ্‌মের রুজ শাসনকালে ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকগুলিতে সংস্কার কার্য বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আঙ্করভাট এলাকায় পরে স্থাপিত মূর্তিগুলি চুরি যাওয়া ও ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া মূল মন্দিরের খুব একটা ক্ষতি এসময় হয় নাই।
বর্তমানে আঙ্করভাটের মন্দিরটি কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এটি দেশবাসীর গৌরব। ১৮৬৩ সালে প্রথম প্রবর্তনের পর থেকে কম্বোডিয়ার সব পতাকাতেই আঙ্করভাটের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে।সারা বিশ্বে এটিই একমাত্র ভবন যা কোন দেশের পতাকায় প্রদর্শিত হয়েছে।
#১৯৯০ এর দশক হতে আংকর ওয়তের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। এর সাথে সাথে শুরু হয় পর্যটনশিল্প। ভারতের পুরাতাত্তিক সংস্থা ১৯৮৬ হতে ১৯৯২ সালের মধ্যে মন্দিরটিতে সংস্কারের কাজ করে। মন্দিরটি আংকরের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯২ সালে স্বীকৃত হয় এবং সপ্তম আশ্চর্যের নতুন ১৩ স্থাপত্যের তালিকায় জায়গা পায়।
২০১৫ সালে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রোলান্ড ফ্লেচার ও ড. ড্যামিয়ান "গ্রেট অঙ্কোর প্রজেক্ট" নামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন৷ সেসময় তারা প্রত্নতাত্ত্বিক যাচাইবাছাইয়ের জন্য তীক্ষ্ণ ভূমি রাডার এবং এয়ারবোর্ণ লেজার স্ক্যানিং ব্যবহার করেছিলেন। তারা বলেন মন্দিরটির স্থাপনায় এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে যা কল্পনার অতীত। স্ক্যানিংয়ে তারা এমন এক গঠনশৈলী পান যেটা আগে কখনও দেখা যায় নি৷ এর নাম দেন তারা "রেক্টিলিনিয়ার স্পাইরাল" তথা "সরলরৈখিক কুন্ডলী" যেটা মন্দিরের দক্ষিণ পাশে ৯ বর্গকিলোমিটার এ
লাকাজুড়ে

তারা মন্দিরের চারপাশে আরও কিছু টাওয়ারের সন্ধান পান যেগুলো মাটিচাপা অবস্থায় আছে এবং সম্পূর্ণটাই রহস্যময়।
আজ থেকে ৮০০ বছর আগে খামের সম্রাট দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ কম্বোডিয়ার নির্মাণ করে দিয়ে গেলেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হিন্দু মন্দির যেটা প্রায় ৬০০ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল হয়ত এখনও অনেকে এই বিষয় অজ্ঞাত।



©সংগৃহিত
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।