ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কাল থেকে মাতৃদেবী বা আদিশক্তির পূজো হয়ে আসছে । অনার্য বা দ্রাবিড় জাতির মধ্যেও মাতৃকা দেবীর পূজা দেখা যায়। উপনিষদের যুগে কাত্যায়নী, কন্যাকুমারী দেবীর পূজো প্রচলিত ছিল। উমা- হৈমবতী দেবীর নামও পাওয়া যায় । মহাভারতে বিন্ধ্যবাসিনী ও মহিষাসুর মর্দিনীর নাম পাওয়া যায় । এই ভাবে আমরা চণ্ডিকা দেবীর উপাসনা বিধিও দেখি । অতি প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় সংসারের মঙ্গল কামনায় মহিলা গন বৈশাখ মাসে মঙ্গলচণ্ডীর পূজো করে থাকেন । পুরানের দেবী চণ্ডী অস্ত্রধারিনী, অসুর মর্দিনী । কিন্তু মঙ্গলচণ্ডী দেবীর যে পট ছবি আমরা দেখি তাতে তিনি দ্বিভুজা, হাতে পদ্ম পুস্প, পদ্মাসীনা । সমগ্র মাতৃত্বের রূপ দেবীর মধ্যে প্রস্ফুটিত । চণ্ডীদেবীর কথা বৃহধর্ম পুরানে পাওয়া যায় । ভবিষ্য পুরানে মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান মতে ইনি কেবল স্ত্রীলোকের দ্বারা পূজিতা বলা হয়েছে । চণ্ডীমঙ্গল কাব্য অনুসারে চন্ডী দেবীর আবির্ভাবের প্রথম পর্বে দেখি কালকেতু ও ফুল্লরার কথা। কালকেতু জাতিতে শবর ব্যাধ, তার পত্নী ফুল্লরা এক শবরী । কালকেতু বনে শিকার করে মাংস হাটে বিক্রি করে সংসার চালাতো। একদা দেবী চণ্ডী তাঁদের গৃহে ছদ্দবেশে এসে পরীক্ষা নেন। কালকেতু ও ফুল্লরাকে শেষে দশভুজা রূপে দর্শন দিয়ে তাঁদের গুজরাট প্রদেশের অধিপতি করেন ।
অপর ঘটনা দেখি সেখানে ধনপতি বণিক ও খুল্লনার ঘটনা । চণ্ডিমঙ্গল কাব্যের ঘটনা অনুসারে ধনপতি সদাগর এর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল খুল্লনা। ধনপতি গর্বে উন্মত্ত হয়ে একদা চণ্ডী দেবীর ঘট ভেঙ্গে ফেলে। এরপর সদাগর বাণিজ্যে গিয়ে দেবীর এক অদ্ভুত রূপ দেখতে পায়। এই রূপ ‘কমলেকামিনী’ নামে মঙ্গল কাব্যে আখ্যায়িত হয়েছে । দেবী এক পদ্মের ওপর বসে একটি হাতি একবার শুঁড়ে ধরে গিলে ফেলছেন, আবার বমন করে বের করে দিচ্ছেন । এই ঘটনা দেখে বিস্মিত ধনপতি সিংহলের রাজাকে গিয়ে জানালেন। সিংহলের রাজা এই দৃশ্য দেখতে পায়নি দেবীর মায়ায়। রাজা তখন মিথ্যেবাদী সন্দেহে ধনপতিকে বন্দী করে রাখে। দেবীকে অবজ্ঞা করার শাস্তি সে পায় । অপরদিকে খুল্লনার পুত্র শ্রীমন্ত একদা সিংহল যাত্রা করে । কালক্রমে সেও সিংহল রাজের আদেশে বন্দী হয় । অবশেষে দেবীর কৃপায় তারা মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফেরে। ততদিনে ধনপতি বনিক মায়ের একজন ভক্ত হয়ে ওঠে ।
বাঙ্গালী কবিগণ মধ্যযুগে চণ্ডিমঙ্গলের ওপর কাব্য রচনা করেন । মানিক দত্ত, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম এঁনারা চণ্ডিমঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবি। এঁদের সেরা হলেন মুকুন্দরাম । তিনি ‘কবিকঙ্কন’ উপাধি পান । এমন বলা যায় পুরানের অসুরনাশিনী দেবী দুর্গাই মঙ্গলকাব্যের দেবী চণ্ডী। মধ্যযুগে মঙ্গলচণ্ডীর গান, পালা আড়ম্বরে পালিত হতো। সেই সময় গৃহে চণ্ডীপূজো হতো। সেই পরম্পরা থেকে চলছে গৃহে গৃহে দেবী মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত ও পূজা। দেবী সকল প্রকার অশুভ, জড়তা, অমঙ্গল নাশ করেন । দেবীর কৃপায় মঙ্গল হয় । তাই তিনি মা মঙ্গলচণ্ডী ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন